সবুজ কাজলের কৌটো - পর্ব ০২ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৩!! 

দরজার কাছে যেতেই যে মানুষটা দরজা খুলে বের হলো তার দিকে হা করেই তাকিয়ে রইলো আয়ান। পুরো হলুদ পরী লাগছে এই মূহুর্তে মায়রাকে। আর আয়ানেরও মনে হচ্ছে আজকের দিনে এই বেশের চেয়ে কোন কিছুতেই মায়রাকে এর চেয়ে বেশি সুন্দর লাগা সম্ভব নয়। পুরো দু মিনিট ড্যাবড্যাব করেই তাকিয়ে রইলো আয়ান মায়রার দিকে।। 

আর মায়রা দরজা খুলেই আয়ানকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। তার উপরে আয়ানের এই অপলক চাহনি!! আর কি লাগে!! বেচারি লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, কমলা সব রঙেই রঙিন হয়ে গেলো। তবুও আয়ানের ঘোর কাটল না। 

-এভাবে কি দেখছেন?? 

---------------

-এই যে!!!????

আয়ানের হুঁশ নেই মায়রার কথায়। মায়রার ঠোঁটের নড়নচড়ন দেখছে সে। কিন্তু একটা শব্দও তার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না।। মায়রার সাজটা তার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে-ইন্দ্রিয় গুলোকে অকেজো করে দিচ্ছে। আর হার্ট বিটটাকে বেহায়ার মতো বাড়িয়েই যাচ্ছে।।  মনে হচ্ছে বুকের ভেতরের ধুকপুক শব্দটাও মায়রা শুনতে পাবে।

 সবুজ কাজলে রাঙা চোখদুটোয় কালো কাজলের একটু টান চোখদুটোকে আরো বেশি মায়াবি করে তুলেছে মায়রার। হলুদ লেহেঙ্গায় কি মনে করে আয়ান অর্ডার করিয়ে সবুজ পাথরের ভারি কাজ করিয়েছে কে জানে।। তবে সেই সবুজ পাড় দেয়া ভারি পাথর বসানো লেহেঙ্গাটার সাথে মায়রার সবুজ রেশমি চুড়িগুলো বেশ মানিয়েছে। সবুজ পাথরের ঝুল কানের দুল, নাকের ঝুল নথ, চুলের ফাঁকে উঁকি দেয়া গোল্ডেন কালারের টায়রা, কোমড়ে জড়ানো গোল্ডেন কালারের বিছা সবই যেন মায়রার আজকের সাজটাকে আরো পরিপূর্ণ করার জন্যই তৈরি হয়েছে। 

মায়রা অনেকক্ষণ থেকেই আয়ানকে ডাকতে ডাকতে একসময় বিরক্ত হয়ে গেলো।

-ধুর আমি গেলাম-।। শুনেই না কথা-!!

মায়রা রুমের দিকে ঢুকে গেলে আয়ানও রুমে ঢুকে মায়রার হাতটা টেনে নিজের দিকে ঘুরালো।

-এই মেয়ে--। কি সমস্যা!! দেখছি না তোমাকে!!!

-কি দেখছেন?? ডাকতে ডাকতে মরে গেলাম--।। হুহ।। ভালো না লাগলে বলে দিন না-- চেঞ্জ করে আসি---??

-এই মেয়ে--।।দুই লাইন বেশি বুঝো কেন হ্যাঁ??? 

-আমি কি বললাম!! ভালো লাগছে না দেখেই তো বলছেন না কিছু---।। আর জানি তো হলুদ আপনার একটুও---।

-আজকে এই মূহুর্ত থেকে হলুদ আর সবুজ হলো আমার সবচেয়ে পছন্দের রঙ।। আর তোমাকে কেমন লাগছে আমি বলে বুঝাতে পারব না---।।

-এতো খারাপ লাগছে???

মায়রা মন খারাপ করে মুখটা নামিয়ে নিতেই আয়ান আবার ওর মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো।

-পরী লাগছে পিচ্চি বউটা---।। তাই ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না কতটা সুন্দর লাগছে সেটা বলার জন্য---।। খালি উল্টা বুঝো কেন বাচ্চাদের মতো---??

লজ্জায় আবার লাল হয়ে গেল মায়রা। এবার মুখটা নামিয়ে মাটির দিকে তাকাতেও পারছে না।। আর আয়ান মায়রার লজ্জারাঙা মুখটার দিকেই তাকিয়ে রইলো।।

-মায়রা---???

-হুম???

-পরী---?? আমাদের গায়ে হলুদেও এভাবে সাজবে কেমন?? আর সাজগোজ শেষ করে অবশ্যই আমাকে পিক সেন্ড করবে----।।।

মায়রা আলতো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।

-পরীটা---।। চলো না বিয়ে করি---??

-কি সব বলেন??? 

আয়ান হেসে মায়রার কপালে সবুজ টিপটা একটু বাম পাশে করে দিয়ে কপালের ঠিক মাঝ বরাবর এনে দিয়ে কপালে আলতো ঠোঁট ছোঁয়াল।

-আজও টিপটাই ঠিক করে পড়তে শিখলে না পিচ্চি--।। কি যে হবে আমার!

-আপনি সব সময়----------।।।

-বউটা---।। এখন গেলাম--।। ও বাড়ি যেতে হবে তো?? তাথৈয়ের কাছ থেকে মোবাইল নিয়েই রিহানের ওখানে যেতে হবে---।। আসছি এখন??? আর হ্যাঁ-- সুন্দর করে হাত ভর্তি করে মেহেদী দিবা-। মেহেদী রাঙা বউটাকে দেখতে চাই বলে দিলাম----।।আসছি কেমন???

আয়ান আরো একবার মায়রার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর তার যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো মায়রা।। আর ভাবতে লাগলো- হঠাৎ এমন করলো কেন মানুষটা!!???

মায়রা বেশ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলো আয়ানের হঠাৎ করে চলে যাওয়ার মানে কি। সে কি রাগ করেছে কোন কারণে?! বা বিরক্ত হয়েছে মায়রার উওর?? নাকি---??!!

চিন্তা করতে করতে তাথৈয়ের রুমে এসে দেখল তাথৈও এক মনে চিন্তা করছে। আয়ান নেই।

-আপ্পি--!!?? কি ভাবো!!??

তাথৈ মুখ তুলে মায়রাকে দেখে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।।তারপর উঠে এসে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিল।

-আমার বোনটাকে সাজলে একবারে পরীর মতো লাগে--। সাজিস না কেন?? এরপর থেকে সুন্দর করে সাজবি। আয়ানের ভালো লাগবে----।

মায়রা লাজুক হাসল।।

-বারে--।। এখন লজ্জা পাওয়া হচ্ছে ফাজিল মেয়ে--।৷ আমাকে বললে কি আমি তোকে বকা দিতাম!!

-উনি তো না করলো-----।।

-এখন তো তোমার উনিই সব।। আমি তো বানের জলে ভেসে এসেছি---।।

-আপিইইইই-----।।

-উলে বাবা---।। লজ্জা পাওয়া হচ্ছে?? ছাড়ছি না দুটোকেই---।।

-আপি কি ভাবছিলে--??

-আমি সব কিছুই বেশি বেশি করে ফেলি না রে মায়রু??? 

-কি বলো এগুলা!!??

-খুব বেশি জ্বালাই না তোদের?? তোকে?? আয়ানকে?? রিহানকে???সবাইকে??

-কি হয়েছে আপুই??

-এই যে দেখ সেই কয়বার রিহানকে কল করলাম--।।সে রুমে ছিল না নাকি।। পরে এসে কল দেখে ভয়েই নাকি কল ব্যাক করে নি---।। এতোই দজ্জাল আমি বল?

-তুমি তো শুধু দজ্জাল না--।। দজ্জাল রাণী দ্যা ডেভিল কুইন---।।

-মায়রানী----।। আজকে তোর----।।

তাথৈয়ের হাতে ধরা পড়ার আগেই মায়রা ছুট লাগালো।। আর তার পিছনে তাথৈ।। দু বোন সারা ঘরময় ছুটোছুটি করছে।। তাথৈ মায়রাকে কিছুতেই ধরতে পারছে না।। মায়রার খিলখিল হাসির শব্দ সারা ঘরে দেয়ালের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। তাথৈ একবার ধরতে পারলে একটা মাইরও মাটিতে পড়বে না ভাবতেও হাসি পাচ্ছে মায়রার। হাসির মাত্রাটা আরো বাড়ছে। তাথৈও ছুটছে আর হাসছে।। 

তাথৈ আর মায়রা-দুজনের হাসি দেখে আরো একজন মানুষ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাসছে।৷ মানুষটা আর কেউ না ওদের বাবা।৷ তাথৈ অনেক হাসিখুশি একটা মেয়ে।। জেদী,  কিছুটা একরোখা হলেও মনের দিক থেকে মেয়েটা অনেক ভালো।। রিহান ছেলেটাও অনেক ভালো।। তাথৈয়ের জন্য এই পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছে সে। শেষমেশ মেয়েটা হার মেনেছে রিহানের ভালোবাসার কাছে।। অবশ্য তাথৈকে বিয়ের জন্য রাজি করার পিছনে একটা মানুষেরই অবদান কখনো অস্বীকার করতে পারবে না রিহান। আর সেটা হলো আয়ানের। তাথৈ আর রিহানের কমন বেস্ট ফ্রেন্ড আয়ান।। কিভাবে দুই মেরুর দুইজন মানুষকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে এই ব্যাপারে কারোই ধারণা নেই। 

ছোট মেয়ে মায়রার হাসি ভরা মুখের দিকেও তাকিয়ে হাসলেন ওদের বাবা। মায়রা-তাথৈয়ের একদম উল্টো একটা চরিত্র।। ছোট বেলা থেকেই একদম শান্ত, চুপচাপ, গম্ভীর একটা মেয়ে। ওদের মা মারা যাওয়ার সবচেয়ে বেশি এফেক্ট পড়েছিল মায়রার উপরেই।। আরো চুপ হয়ে যায় মেয়েটা।৷ এখন অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে। 

তাথৈয়ের বিয়ের পর আবার কি হবে ভেবে তাথৈয়ের বাবা একটু চিন্তায় পড়লেন। মায়রার জন্য একটু চটপটে, ফুরফুরে মেজাজের, আর ভালো ছেলের কথা চিন্তা করতেই সবার প্রথমেই আয়ানের কথাটাই মাথায় আসে উনার। ছেলেটা ভালো।। দেখতে হ্যান্ডসাম। ৬'২" লম্বা ছিপছিপে তবে হৃষ্টপুষ্ট শরীর। অমায়িক ব্যবহার আর সদা হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখলেও এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে মনে। তাথৈয়ের বিয়ের ব্যাপারটা শেষ হলেই আয়ানের বাসায় কথা বলবেন ভেবে রাখলেন তিনি।

তাথৈ আর মায়রা ছুটোছুটি করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় সোজা শুয়ে গেল।। হাসিটা তখনো বন্ধ হয় নি কারো।। তবে কথা হলো দুজনেই ভারি লেহেঙ্গা পড়ে এতোক্ষণ কিভাবে সারা ঘর দাপাদাপি করেছে সেটাই দেখার বিষয়।।

০৪!! 

রাত দুটো বেজে পনেরো মিনিট।

মায়রা টায়ার্ড হয়ে খাটে শুয়ে শুয়ে হাতের মেহেদি শুকানোর অপেক্ষা করছে। তাথৈয়ের সাথে বাজি ধরেছে কার মেহেদি কতো বেশি রঙ হবে তা নিয়ে। মায়রা খুব একটা মেহেদি পড়ে না।। আর পড়লেও পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ধুয়ে ফেলে।। সেটাও ঈদের আগের চাঁদ রাতের কাহিনী। আজ অবশ্য সে ধৈর্য্য ধরেই বসে আছে।। মানে এখন পর্যন্ত আর কি।। মেহেদির তো শুকোনোর নাম গন্ধও নেই।। এদিকে আয়ানেরও খবর নেই।। ফোন রিংটোন মুডে দেয়া। তবুও ১৫ সেকেন্ড পর পর মোবাইলটার স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছে মায়রা।। 

যাওয়ার সময় আয়ানের এভাবে দুম করে চলে যাওয়া ব্যাপারটা একটুও ভালো লাগে নি মায়রার। মনে হয়েছে কিছু একটা কারণে আয়ান খুব করে রাগ করেছে ওর উপরে।। কিন্তু কি সেটা ধরতে পারছে না।। 
এক মনে চিন্তা করেই যাচ্ছে শুয়ে শুয়ে।। বেখেয়ালে হাতের নখ খুঁটছে।। কখনো ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। কখনো দাঁত দিয়ে নখ কাটার চেষ্টা করছে।। মেহেদীর তেঁতো স্বাদটা মুখে যেতেই ঠোঁট উল্টে আবার নখ খুঁটুচ্ছে অন্য নখ দিয়ে।। 

আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়রার এসব কান্ড দেখছে তাথৈ।। সেই কখন এসে দাঁড়িয়েছে।। মায়রা টেরই পায়নি। খোলা দরজা দিয়ে আলো বাইরে এসে পড়ছে।। ঘরে এখনো আলো জ্বলছে দেখেই তাথৈ মায়রার সাথে একটু বকবক করতে এসেছে।। বকবক না ঠিক। বকা দিতে এসেছিল। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। আর এই মেয়ে নাকি এখনো ঘুমায়ই নি।। বকা তো খাবেই।। 

-মায়রা??? কি ভাবিস বাবা???

-হুম???আপ্পি--তুমি কখন এলে?? কিছু লাগবে!!?? 

-লাগবে।। উঠিস না।।  শুয়ে থাক।। আমি আজ তোর সাথে থাকি??!

-আমার সাথে!!!!!!

-কেন কোন সমস্যা!!?? 

-এই না না--। সমস্যা কেন হবে!!?? এসো না আপ্পি--।। শোও---।।

-ভাবছিস হঠাৎ আজ কেন তাই না!? কখনো তো বেড শেয়ার করি না কারো সাথে--।।  কাল তো চলেই যাব--।। আবার কবে একসাথে দু বোন-----।

-আপ্পি??!! মন খারাপ তোমার??

-হুম!!?? না রে পাগলি--।। তোর কি হয়েছে!!? কি ভাবছিলি!!?

--------------------

-আয়ানের সাথে কথা হয়নি??

-উহু----।।

-আরে বাবা--।। রিহানের বাসার সবটাই ওকে সামলাতে হচ্ছে।। তাই ব্যস্ত একটু।। আর পিক পাঠিয়েছিস আজকের!!?? সবাই তো আমার থেকে বেশি তোর ছবি তুলেছে আজকে!!?? তোর সাহেবের মাথা ঘুরিয়ে দিতে হবে না!!??

-পাঠাই নি তো---।। নেই আমার কাছে।।

-শেয়ার ইট অন কর আমি দিচ্ছি---।।

-আপ্পি----??

-হুম???

-মেহেদী???

-ওরে পাগলী---।। যা ধুয়ে আস---।।

-রং না হলে!!??

- তাহলে বুঝতে হবে তোর বদমাইশ বর তোকে একটুও ভালোবাসে না---।।

মায়রা করুণ মুখে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।।সেটা দেখে তাথৈ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার দশা হলো।। 

-ওই-?? তুই বড় হবি টা কবে!!! যা ধুয়ে আয় তো।। দেখ আমিও হাত ধুয়ে মুছে তারপর এসেছি।। আর রঙ অনেক সুন্দর হবে দেখিস। যা।। পাগলী মেয়েটা----।।।

মায়রার হাতের মেহেদী খুব শুকিয়ে গেছে।। পানির মধ্যে হাত ডুবাবে তার আগেই তাথৈ ওর হাতটা টেনে ধরলো।।

-ওই--??এভাবে মেহেদী ধুলে একটুও রং থাকবে!!??

-তো!!!

তাথৈ একটা টিস্যু নিয়ে হালকা হালকা হাতে মেহেদী তুলতে লাগলো।। মায়রা অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাথৈকে একবার আর নিজের হাতের মেহেদীকে একবার দেখছে।। অনেক সুন্দর রং হয়েছে। কালচে লাল রং।। তাহলে কি সত্যিই আয়ান মায়রাকে খুব বেশি ভালোবাসে!!!!

-হ্যাঁ রে বাবা---।। খুব ভালোবাসে---।।

-কি!!!!!???

-ভাবছিস ভাব--।। মনে করে মেহেদীর ছবিও পাঠাস--।। পার্লারের মেয়েটাকে বলে তোর হাতের মেহেদীতে আয়ানের নামের অক্ষর লেখিয়েছি।৷ একটু খুঁজে বের করতে বলিস---।।

-কি!!???

-ওই মেয়ে এতো কি কি করিস কেন!? ছবি উঠা। হলুদের ছবি নে-।৷ সবগুলা তোর ফাজিল বররে পাঠা।। আর আমারে শান্তিতে একটু ঘুমাতে দে তো---।।।

-আপ্পি???

-ছবিও তুলে দিতাম!!! মাইয়া----!!! আল্লাহ!!! আমার ফ্রেন্ডটার কপালে কোন বাচ্চারে গছাইয়া দিলা!!!

তাথৈয়ের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে ফেললো মায়রা। একদম ছোট্ট বাচ্চার মতো করে হাসছে মায়রা।৷ আর ওর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে তাথৈও হেসে মায়রার মোবাইলটা হাতে নিয়ে হাসি মুখটার একটা ছবি তুলে নিল।

মায়রা বেশ কয়েকটা ছবি মেইল করলো আয়ানকে। তাথৈ সিলেক্ট করে দিয়েছে কোনগুলো পাঠাতে হবে। মায়রার হাসি মাখা পিক- হলুদ হলদে মায়রার পিক, মায়রা আর তাথৈয়ের একসাথে হলুদে রাঙা পিক, দুজনের মেহেদী পড়া পিক, মায়রার মেহেদীর পিক। সব মিলিয়ে ২০-২৫ টা পিক। পিকগুলো উঠানোর সময় মায়রা টের পায় নি একটাতেও। তাই হয়তো ছবিগুলোতে একটু বেশিই প্রাণবন্ত লাগছে ওকে। মায়রা মেইল করে অপেক্ষা করতে লাগলো। এই মূহুর্তে বাজে ভোর চারটা। আয়ানের এখনো কোন খবর নেই। কেন করছে মানুষটা এমন!!?

 তাথৈ শুয়ে পড়েছে। পাশে গিয়ে মায়রাও শুয়ে পড়লো। কাল তাথৈয়ের বিয়ে। মন খারাপ হলে ছুটে এসে তাথৈকে আপ্পি বলে আর জড়িয়ে ধরা হবে কিনা কে জানে! রাতে চুলে তাথৈয়ের হাতের স্পর্শে ঘুমও ভাঙবে না হয়তো আর। তাথৈ রেগে গেলে সারা ঘর মায়রাকে দৌঁড়ানিও দিবে না হয়তো। কালকের পর সবটা বদলে যাবে। মায়ের কথা খুব করে মনে পড়ছে মায়রার। মা মারা যাওয়ার পর দুটো মানুষই সামলেছে ওকে।। তাথৈ আর আয়ান। তাথৈ তো চলেই যাবে কাল। আর আয়ান!!??

আয়ানের কথা চিন্তা করতেই ফোনে টুং করে শব্দ হলো। আয়ানের মেসেজ।

 " সুন্দর লাগছে হলুদ পাখিটাকে। ঘুমিয়ে যাও। কেমন?? সকালে উঠতে দেরি হবে আমার। উঠে কল দিবো। "

মেসেজটা পড়ে মায়রার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ব্যথা করে উঠলো৷ কিছু একটা খালি খালি লাগছে। তবে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। অন্য সময়ের মতোই স্বাভাবিক মেসেজ। প্রায়ই আয়ানের এমন মেসেজ পায় মায়রা। মায়রা ঘুমিয়েছে ভেবে আয়ান কল না করে মেসেজ করে দেয়। তবে আজকের মেসেজে কিছু একটা মিসিং! কি সেটা!!??

ভাবতেই চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো মায়রার। ওর বান্ধবী নেহা- বলেছিলঃ-

 "এতো বেশি ছেলেমানুষ হলেও হয় না মায়রু--।। ছেলেমানুষি এক দিন ভালো লাগবে-দুদিন সহ্য হবে।। তিন দিনের সময় ঠিকই বিরক্তি চলে আসবে।। আর ছেলেদের মন তো--------।" 

ভাবতে ভাবতে মায়রার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।। এমন সময় আবার টুং করে শব্দ হলো মোবাইলে।। চোখ মুছে মেসেজটা ওপেন করলো মায়রা।। 

" কান্না করবে তো এক্ষুনি চলে আসবো বলে দিলাম-। মন খারাপ করো না বউটা। ঘুমাও। কাল খুব করে বকে দিও। গুড নাইট পিচ্চি বউ।" 

মায়রা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হেসেও ফেললো এক সময়।। আশেপাশে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো- ও যে কাঁদছে বা ওর মন খারাপ ব্যাপারগুলো আয়ান জানে কি করে!! এই রুমে কি কোন সিক্রেট ক্যামেরা ট্যামেরা লাগানো আছে নাকি!! এই রুমে না অন্য যে কোন জায়গায়ও সেইম ঘটনা ঘটে।৷ আয়ান কি করে জানি বুঝে যায় মায়রার মনের কথা। আশ্চর্য!! 

এতো রাতে সিক্রেট ক্যামেরা খোঁজার মোটেও ইচ্ছে নেই মায়রার। ঘুম পাচ্ছে খুব। সকালে উঠতে হবে। কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেল নিজেও জানে না মায়রা।।

সকালে আধো আধো ঘুমেও মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বিভোর করছে মায়রাকে। ঘ্রাণটা খুব পরিচিত মায়রার। তবে ঘ্রাণটা কিসের! আয়ান আশেপাশে থাকলেই এই মিষ্টি ঘ্রাণটা পায় মায়রা।। ব্যাপারটা মনে পড়তেই লাফিয়ে উঠে বসে পড়লো।। এখনো ঘুম ঘুম চোখে দেখার চেষ্টা করছে আয়ান কোথা থেকে এলো!!!  সামনের দিকেই চেয়েই বেচারি আধো ঘুম চোখেও লজ্জা পেল।। আয়ান এক দৃষ্টিতে ওকেই দেখছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো এখনো আয়ান।। আর ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি।। 

-আ-আপ-আপনি এখানে!!!???

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন