রাত..... ১২টা ছুই ছুই।
কুহু খাবার টেবিলে ইউসুফের জন্য বসে থেকে ঝিমুচ্ছে। খবর নেই আসার এখনো ইউসুফের।কুহু জাগনা দেখে ঘুমুচ্ছে না রুমি।সেও সোফার সাথে ঠেসে মাটিতে বসে।কুহু হাই তুলে ফোন স্ক্রল করে দেখলো ১২ টা বাঁজতে আর কিছু মুহুর্ত বাকি। কুহুর এ জন্য চিন্তা হচ্ছে। কারণ এর আগে কখনো ইউসুফ এত লেট করেনি।আর আজ অনেক লেট হচ্ছে।কুহু এবার উঠে বারান্দায় গিয়ে পায়চারী করছে নাহ্ ইউসুফের ছায়াটাও নেই। ধীরে ধীরে মনটি খারাপ হতে লাগলো তার। এত পরিবর্তন কিভাবে হয়ে গেল সে?যেখানে কুহুর সুখের জন্য দিন রাত লেগে থাকতো? সেখানে আজ কত দিন যাবত তার পাত্তাই নেই। এসব ভেবে ছোট শ্বাস নিয়ে বারান্দার ডিভানে পা তিলে বসে পরলো। এবং ইউসুফকে কলও করে চললো....কিন্তু ফোন ধরছে না।খুব বিরক্তি লাগচ্ছে আজ।নাহ্ এভাবে আর চলে না। এবার সে সরাসরি কথা বলবে ইউসুফের সাথে।যদি ওর জীবনে কুহু ভ্যালু নাই থাকে? তাহলে কেন থাকবে এখানে সে? চলে যাবে বহু দূর ওর থেকে। এ কথাটি মনে আসতে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। চাপা একটা কষ্ট বাসা বেঁধে নেয়...সত্যিকি আছে ওর জীবনে কেউ? সত্যিকি তাকে ছেড়ে যেতে হবে? বহুদূর? অনেক দূর?? এটা ভেবেই ডুকুরে উঠে কুহু। তখনি ফোনে মাঝে মেসেজ ইউন ভেসে আসে।কুহু চোখে পানি মুছে চট জলদি ফোনটি হাতে তুলে নেয়।স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ইউসুফ নামটি। সাথে স্ক্রল করে দেখে,,
"বাবুইপাখি ছাদে আসো"
এটুকু দেখেই কুহু দৌড়ে বের হয়ে যেতে নেয় ছাদে দিকে। পিছন থেকে রুমির ডাক,,"আপামনি কই জান" পৌছলো বলে মনে হলো না তার কানে।
কুহু দৌড়ে ছাদে এসে হতভম্ব। চোখ দিয়ে তখনো জল গড়িয়ে পরছে তার। সাথে দু হাত মুখে চেপে ধরে সামনের দিক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
রাতের অন্ধকারে সামনে থেকে আসা ব্যক্তিটিকে দেখে কয়েক দফা হার্ট বিট করা বন্ধ হয়ে গেল কুহুর। ফর্মাল লুকে ইউসুফ তার হাসি মাথা মুখে তার সামনে এসে দাড়ালো। হালকা সিল্কি চুল গুলো রাতের এই স্নিগ্ধ বাতাসে উড়ছে। লাল পাতালা ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে আছে। সেই হাসি ধরেই বলে উঠলো ইউসুফ__
" হেপি বার্থডে টু ইউ, হেপি বার্থডে টু ইউ বাবুইপাখি হেপি বার্থডে টু ইউ"
ইউসুফের মুখে বার্থডের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে কুহু। অবাক হয়ে বলল,
---আমার আজ বার্থ ডে?
ইউসুফ কুহুর কপালে চুমি দিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
--হে আজ আমার বাবুইপাখির জম্ম দিন!
--আমার জম্মদিন আর আমি জানতামি না?মন খারাপ করে বলল কুহু।
--তো কি হয়েছে? আমার তো মনে আছে বাবুইপাখি।(মৃদু হেসে বলল ইউসুফ)
তারপর কুহুর দিক চেয়ে হাতে চুটকি বাঝাতেই অন্ধকার ছাদে গোল গোল লাল, নীল, হলুদ নানা রঙ্গের আলো জ্বলে উঠতেই চমকে গেল কুহু আরেক দফা। সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো একটি গোল টেবিল, যেটা খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা।যেখানে একটা লাভ কেক, আর তার পাশে অসংখ্য ফুলের পাপড়ি আর নানা রকম ক্যান্ডল। সব কিছু যখন মুগ্ধ নয়নে দেখতে ব্যস্ত কুহু, তখনি কুহুর ধরে হাত ধরে টেবিলে বিয়ে বলল,,
--কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?
কুহু চোখ মুছে মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
--অনেক সুন্দর।
তারপর দুজন মিলে কেক কাঁটলো। ইউসুফ এক পিস কুহুকে মুখে তুলে খাইয়ে দিল। কুহুও ইউসুফকে খাইয়ে দিল।তারপর দুষ্ট হেসে ইউসুফ কুহুর মুখে নাকে কেক লাগিয়ে দিলো। কুহু কঁপাট রাগ দেখিয়ে ইউসুফকে লাগাতে গেলেই, কুহু দৌড়ে পালিয়ে যায়। কুহুও তার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলো। আর খিল খিল করে হাসতে লাগলো। কুহুর হাসির শব্দে দাঁড়িয়ে গেল ইউসুফ কুহু ও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।তখনি ইউসুফ পিছন মুড়ে তার গাল এগিয়ে দিয়ে বলল,,
--লাগিয়ে দাও?
কুহু চোখ বড় বড় করে বলল,,
--সত্যি?
ইউসুফ মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,,
---হে!
কুহু খুশিতে লাফিয়ে উঠে, ইচ্ছা মতো ইউসুফে মুখে লাগিয়ে দিল।আর খিল খিল করে হাসতে লাগলো। তখনি ইউসুফ কুহুর দু হাত ধরে স্লো ভয়েসে বলল,,
--ইটস মাই ট্রান।
বলে কুহুর গালে সাথে ইউসুফের গাল লাগিয়ে, কুহুর মুখেও কেক মাখামাখি করে দিতে লাগলো। ইউসুফের এমন কাজে ইউসুফে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি লাগায় শরীরে বার বার কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগলো তার সাথে মনের মাঝে আলাদা ভাল লাগার অনুভতি হতে লাগলো। কুহু শিউড়ে উঠচ্ছে বার বার। তাই চোখ বন্ধ করে ফললো কুহু।
কিছুক্ষণ পর কুহুর কানে ফিসফিস করে বলল,,
--কেমন লাগলো?
কুহু লজ্জা পেয়ে ইউসুফের বুকে মুখে লুকালো।ইউসুফও আবেশে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো তার বাবুইপাখিকে।
♠
ঘুমিয়ে আছে কুহু।তাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। তার সাথে ভয়। হুম ভয়।কুহুকে হাড়িয়ে ফেলার ভয়। কাল সকালে ইউসুফকে ঢাকা যেতে হবে তার বাবার আদেম। আর কালকেই কুহুর ইনজেকশন দিতে হবে। নয়তো কুহুর সব কিছু মনে পড়ে যাবে। কুহু যদি সব কিছু মনে পড়ে যায় বাই এনি চান্স তাহলে সে আর এক মুহুর্ত তার সাথে থাকবে না, তা ইউসুফ ভার করেই জানে।তা নিয়ে টেনশনে ঘৃম আসচ্ছে না তার। তার উপর নতুন আরেক টেনশন যোগ হয়েছে। কেউ ইউসুফকে প্রতিনিয়ত ব্লেকমেইল করছে। কে করছে ধরতে পারচ্ছে না সে। ব্লেকমেইলারের কথা মনে পড়তেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে তার। একবার পেলে ওই বেটার রক্ষে নেই। ইউসুফ এবার তাকালো কুহুর দিক কি শান্তিতে ঘুমুচ্ছে তার বাবুইপাখি। একটা দিন কতই না কষ্ট দিয়েছে তাকে। সেও পেয়েছে। কি করার ছিল তার? ব্লেকমেলার যে তার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে! কুহুকে হাড়িয়ে ফেলার ভয়? কুহু যখন সব জানবে? তখন কি হবে? আরো ঘৃণা করবে নিশ্চয়? তাইতো চায় না ইউসুফ কুহুর কিছু মনে পড়ে যাক।তাই তো এত গুলো মাস কুহুকে ইনজেকশন দিয়ে আসচ্ছে সে।এসব ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো ইউসুফ, কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,
---আম সরি, বাবুইপাখি! আমি নিরুপায়! জানি ক্ষমার পাত্র অামি না, তোমার পরিবার, তোমার পরিচয়, তোমার স্মৃতি সব কিছু থেকে তোমাকে দূরে রেখেছি আমি। জানি অনেক স্বার্থপর আমি কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। মরে যাবো । পাড়লে ক্ষমা করো আমাকে।
বলে চুমু এঁকে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে চলে গেল ইউসুফ।
—————
বারান্দার রেলিং এ মুঠ করে ধরে আছে ইউসুফ। মুখে তার রাগ, ক্ষোভ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
--একবার শুধু হাতের কাছে পাই আমি সেই ব্লেকমেইলার কে! নদীর মাছের খাবার বানাবো তোরে।আই যাষ্ট কিল ইউ।
এসব ভেবে রাগ আরো বাড়চ্ছে ইউসুফের। কিন্তু এখন রাগ করলে চলবে না। কোনো মতেই না।নিজেকে ঠান্ডা করে রুমে চলে আসলো ইউসুফ।
পরেরদিন সকালে কুহুর থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায় ইউসুফ ঢাকার উদ্দেশ্যে। কুহু ইউসুফকে বিদায় দিয়ে সোফায় এসে বসলো। খুব খালি খালি লাগচ্ছে পুড়ো বাসাটায়।এক কথা মিস করছে কুহু ইউসুফকে।তখনি রুমি এসে বলল,,
--আফামনি চলেন খাবেন! স্যার আমারে কড়া বাবে কইয়া গেছেন আপনারে যেন টাইম মতো খাওয়া দেই। নেয়তো আমার চাকরি নট।
রুমির কথায় হেসে দিল কুহু। তারপর বলল,,
--তুমি তোমার স্যারকে ভয় পাও?
--নাহ্ আফামনি। ভয় না। সম্মান করি।জানেন আফামনি স্যার অনেক ভালা মানুষ। আমার বাপে আমারে বেইচা দিতে চাইছিল। সেদিন সেইখান থেকে পালাইছি।আর স্যারের সাথে দেখা। স্যার আমারে কাম দিছে, মাথা গুজার ঠাই দিসে। আর আপনি তার জান পড়ান আপনার খেয়াল কেমনে না রাখি কোন?
কুহু মুচকি হাসলো। আর বলল,,
--আচ্ছা চল খাবো।
খাওয়া শেষে রুমে এসে বসলো কুহু। মাথাটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করছে তার। চোখের সামনে ভেসে উঠচ্ছে নানান রকমের চেহারা যেখানে একটি লোক বলচ্ছে,,
--হেপি বার্থডে কুহু মামনী।
একজন মহিলা বলচ্ছে,,
--হেপী বার্থডে আমার আম্মুটা।
কিন্তু কারো চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাড়চ্ছে না সে। যতই মাথায় জোড় দেয়ার চেষ্টা করছেন ততই মাথা ব্যথা বৃদ্ধি হচ্ছে তার। কুহু মাথা চেপে ধরে বসে আছে।
এদিকে ইউসুফ তার বাসায় পা রাখতেই একটি ফোন আসে। রিসিভ করতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরে তার। কুহুকে যেই ডাক্তার ইনজেকশন দেয়ার কথা সে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ইউসুফ সাথে সাথেই লোকটিকে জিগাসা করলো,
--ওনার কাছে একটি ইনজেকশনের বক্স আছে। তা ঠিক আছে কি?
ওপাশ থেকে লোকটি জানালো,,
--স্যার ইনজেকশন কাচের বোতলের হওয়াতে তা ভেঙ্গে গেছে।
ইউসুফ এবার রেগে, ফোন আছড়ে মারে বলল,,
---ডেম ইট! কি হলো এটা! না না এটা হতে পারে না! বাবুইপাখি, বাবুইপাখিকে কিছুক্ষণের মাঝে ইঞ্জেকশন না দিলে সব মনে পড়ে যাবে। না না তা হতে পারে না। নিজের চুল টেনে ধরে ফ্লোরে বসে পাগলের মতো বলতে লাগে ইউসুফ।
কয়েক দফা মাটিতে ঘুসি মারলো ইউসুফ যার ফলে তার হাতে জখম হয়ে গেছে।এদিকে মনে মনে ভেবেই যাচ্ছে, ইনজেকশন দুইদিনের আগে পাবে না। আর কুহুর সব মনে পরে গেছে এই মুহুর্তে কি করছে তার বাবুইপাখি? সে কি পালাতে চাইবে???
---না না এ হতে পারে না। সাথে সাথে ফোন তুলে টুকরো গুলো জোরা লাগিয়ে কল করলো রুমি কে।ও পাশ থেকে ফোন তুলতেই ইউসুফকে কিছু বললার আগেই রুমির কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল।
--স্যার আপনি কই? জলদি আহেন, মেম জানি কেমন করতাসে। আমার ভয় করতাসে।
ইউসুফ ফোনের ওপাশের কুহুর চিল্লা পাল্লা শুনে বুঝতে আর বাকি নেই... কুহুর সব মনে পরে গেছে। ইউসুফ ঠোঁট কামরে এসব শুনচ্ছে, চোখ থেকে তার জল গড়িয়ে পড়লো সাথে তার বাবুইপাখি কি তাহলে তাকে ছেড়ে চলে যাবে??
ইউসুফ নিজেকে সামলে বলল,,
--তোমার আপমনিকে তার রুমে বন্ধ করে রাখো আমি আসচ্ছি। খবরদার আমি না আসা পর্যন্ত দরজা খুলবে না। মনে থাকবে?
--যে স্যার।
ইউসুফ ফোন কেঁটে দিলো। মাথার চুল টেনে বলে উঠলো,,
--ওকে ফাইন। এতদিন তোমার মেমোরি লস করে যা করতে পারিনি। তা এখন করবো। তকন একটা অপরাধ বোধ কাজ করলেও এখন করবে না এখন যা হবে তার তোমার সজ্ঞানে।বলেই বাঁকা হেসে বেড়িয়ে পড়লো ইউসুফ।
এদিকে কুহু দরজায় করাঘাত করে যাচ্ছে। কেউ দরজা খুলচ্ছে না। সে শুধু চিল্লিয়ে বলেই যাচ্ছে,,
--দরজা খুলো আমি বাবা মার কাছে যাবো। আমাকে মুক্ত করো। আমি এই সাইকোর সাথে থাকবো না। প্লীজ। কিন্তু কেউ শুনচ্ছেই না।
কুহু ঘরের সব উলোট পালোট করে চিতকার করে কান্না করতে করতে দেয়াল ঘেসে বসে পড়লো। আর হাটুতে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো।
তখনি খট করে দরজা খুলে যায়। সামনে ইউসুফকে দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়।তখন ইউসুফ বলল খুব ঠান্ডা কন্ঠে,
--কি হয়েছে বাবুইপাখি তোমার? রুমের এ হাল কেনও করেছো? আর এভাবে চিৎকার কেন করছো?
কুহু নিজেকে সামলে ইউসুফের পা ধরে বলে উঠে,,
--প্লীজ আমাকে যেতে দিন! আমি বাসায় যাবো, আ আ আমাকে দেতে দিন।
কুহুর কথায় কোনো হেলদোল হলো সা ইউসুফের। উল্টোর কুহুর দু বাহু শক্ত করে চেঁপে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলে উঠলো,,
--তুমি না কোথাও যাচ্ছো! আর না আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিচ্ছি।
ইউসুফের এভাবে ধরাতে ব্যথায় কুকিয়ে উঠছে বার বার। নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে বলতে লাগে,,
--আমাকে ছাড়েন ব্যথা লাগচ্ছে আমার। আমি থাকবো না এখানে, পালিয়ে যাবো আমি এখান থেকে। যেখানে গেলে আপনি আমাকে পাবেন না...আর আমি কিছু ভুলিনি আপনি আমার সাথে কি কি করেছেন।
ইউসুফ তার এক হাত কুহুর চুলের পিছনে নিয়ে চুলে মুঠ করে কুহুর মুখ ইউসুফের মুখোমুখি এনে মুচকি হেসে বলে উঠে,,
--আমিও তাই চাই তোমার যেন সব মনে পরে।
ইউসুফের এমন কথায় বিস্মিত হয়ে গেল কুহু।