আমার একটাই যে তুই - পর্ব ০৭ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


বাস চলছে খাগড়াছড়ি দিকে। সময় রাত...১০ঃ২০ মিনিট।আমি মুখ গোমড়া করে জালানার দিকে বাহিরে তাকিয়ে আলো আধারের খেলা দেখছি। আর আমার ঠিক পাশেই বসে আছেন ইউসুফ ভাই। তার দিক না তাকিয়েও বুঝতে পাড়ছি তিনি আমার দিক চোখ গরম করে তাকিয়ে আছেন। তার যথেষ্ট কারণ আছে। তিনি কিছুক্ষণ আগে আমাকে এক গাদা খাবার এনে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,,

--" ফিনিশ ইট! "

আমিও তখন ভেংচি কেটে খাবার সরিয়ে দিয়ে বললাম,,

--" খাবে না!"

তখন উনার থমথমে গলায় বললেন,,

--" কুহু বাচ্চামো কেন করিছিস? সকাল থেকে কিছু খাস নাই!  এখন তামশা বাদ দিয়ে খেয়ে নে!"

--" আপনি শুন্তে পাননি? নাকি কথা কানে যায় না? বলছি না খাবো না?"কাটকাট জবাব দিলাম আমি।

ইউসুফ ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর ছোট একটা শ্বাস ফেলে, স্লো ভয়েসে বললেন,,

--" বাবুইপাখি কেন এমন করছিস? প্লীজ খেয়েনে না! প্লীজ? পড়ে দেখা যাবে সবাই ঘুড়চ্ছে ফিরছে তুই অসুস্থ হয়ে হোটেলে পড়ে আছিস!"

আমি আগের মতোই জবাব দিলাম,,

--" খাবো না বলছি ব্যাস খাব না!  আপনাকে কি বলছি আমাকে নিয়ে আসুন? কেন এনেছেন? তামাশাটা বরং আপনি করেছেন আমার সাথে! বুঝতে পারছেন!  কতটা ট্রিপিক্যাল সিচুয়েশন তৈরি করেছেন আমার জন্য?? এমনিতে ঝামেলায় কম না আমার লাইফে! কেন করছেন এমন?হোয়াই??"

ইউসুফ ভাইয়া আমার কথায় অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন হয়তো ভাবেননি! তার সাথে এভাবে কথা বলবো আমি! তখনি পাশ থেকে তিথি বলল,,

--" খেয়েনে না বনু। সকাল থেকে তোর পেটে কিছু পড়ে নি! কান্না করে চলছিলি! এখন তো খা! আচ্ছা আমি খাইয়ে দেই?"

--" আমি খাবো না তিথি।  আমার পেটে খুদা নাই! তোর মন চাইলে তুই খা! এক দিন না খেলে আমি মরে যাবো না! মরলেই ভাল হতো সবাই মুক্ত হতো!"

আমার কথা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে ইউসুফ ভাইয়া ধমকে উঠলেন,,

--" ভাল কথা শিখেচ্ছিস দেখছি তুই? অনেক বড় বড় কথা বলছিস?খুব বুলি ফুটেছে দেখছি তোর মুখে? খাবি না তো? তাই তো? দাঁড়া দেখচ্ছি মজা, তুই খাবি না তোর ঘাড় খাবে!"

বলে আচমকা ইউসুফ মুখ চেপে ধরলেন আমার। মুখ টা হা হতেই, মুখে খাবার পুড়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিলেন!চোখ চোখ বড় বড় করে তার এমন কাজ দেখছি আমি! উনি এমন কিছু করবেন ভাবনার বাহিরে ছিল। আমি খাবার না চিবুয়ে মুখে পুড়েই বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখেই যাচ্ছি।তখনি তিনি রাম ধমক দিলেন আমায়। সাথে সাথে চিবুনো স্টার্ট হয়ে গেল আমার। খাবার শেষ হতেই ইউসুফ ভাইয়া আমাকে বললেন,,

--" ঘুম পাচ্ছি কি তোর? ঘুম ধরলে আমার কাঁধে মাথা রেখে গুমিয়ে পর!"

আমি সাথে মাথে বললাম,,

--" আমি আপনার কাঁধে শুবো না!"

--"কেন?"

--"কারণ আমি পরপুরুষের কাঁধে মাথা রাখি না?"

ইউসুফ ভাইয়া চমকে গেলেন। নিজেকে সামলে বলল,,

--" কে পরপুরুষ? "

ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলাম,,

--"আপনি!"

তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন এমন ভাব করে বললেন,,

--" আমি পরপুরুষ! "

--" আমি কি উর্দু ভাষা বলেছি? পিউর বাংলায় বলেছি, কোনো মিক্সড ছাড়া! যে,  ইউ আর পরপুরুষ ফর মি!"

তখন থেকেই "পরপুরুষ" কথাটা আমার মুখ থেকে শুনার পর থেকেই রাগ মিশ্রীত চোখে চেয়ে আছেন তিনি। যা আড় চোখে বার কয়েক দেখতে পেয়েছি আমি।সরাসরি তাকা বার সাহস আমার নেই। পড়ে দেখা যাবে সেই চোখ দিয়েই জলিয়ে পুড়িয়ে ছাই ছাই করে দিবেন। তাই আমি বাহিরে তাকিয়ে। বুঝতে পাড়চ্ছি খুব আমার কথাটা হজম করতে পারেন নি উনি। ভাল হয়েছে রাগ করেছে! রাগ হলেও বরং আমার থেকে দূরে থাকবেন তিনি! এটাই ভাল সবার জন্য!

ইউসুফ ভাইয়া এভাবে বসে থেকে উঠে গেলেন কিছুক্ষণ পর।  তার সিটে তিথি এসে বসতে বসতে বলল,,

--" কুহু? কি করেছিসরে তুই? ভাই রেগে নাক মুখ লাল করে আছে?"

আমি চুপ রইলাম। কি বলবো? তখন তিথি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,,

--" কি হলো বলছিস না কেন?"

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,,

--" কি বলবো?"

--"ওই যে ভাইয়া উঠে গেল কেন?"

--" আমি তাকে পরপুরুষ বলছি!"

আমার কথা শুনে তিথি ভুত দেখার মতো তাকিয়ে রইলো ড্যাব ড্যাব করে। তারপর হালকা ঢোক গিলে বলল,,

--" সিরিয়াসলি কুহু! তুই এটা কি করলি? তুই কি বুঝিস না ভাই তোকে লাইক করে? তুই তো ছোট না! কোনো মেযের প্রতি কোনো ছেলের ফিলিংস কাজ করছে?  তা একটা মেয়ে ইজিলি বুঝে যায়? তুই কেন পাড়চ্ছিস না? তুই তো রুমে বসেছিল দরজা আটকে যাবি না বলে! তুই কি জানিস? কতটা লড়েছে তোর জন্য ভাইয়া চাচীর সাথে??"

--" তাইতো আমি চাই না তিথি! আমি চাই না আমার জন্য কেউ লড়ুক কারো  সাথে। বুঝেছিস?"

--" তাহলে এটা কি! এখন বলিস না কুহু এসব মিথ্যা? ভাইয়ার কথা বাদ দিলাম! তোর মনে কিছু নেই!

 আমার ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল তিথি। যেখানে ইউসুফ ভাইয়ার কাল রাতের ছাদের ভিডিওটা চলছে!

আমি অবাক হলাম! তারপর আমতা আমতা করে বললাম,,

--" তুই এটা কিভাবে!"

--" ছাদে পেয়েছিলাম আজ ভোরে তোর ফোন দরজার কাছে! ভিডিও চলছিল। কৌতুহল জাগচ্ছিল। তাই দেখেছিলাম যেহেতু তোর পাসওয়ার্ড জানি তাই কষ্ট হয়নি! সরি তোর পার্সোনাল বিষয় ছিল এটা বাট আমার তো জানিস কৌতুহল জেগেছে তাই আর কি! প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড!"

আমি কিছু বললাম। তিথি ও চুপ! এখন চলছে নিরবতা। মাঝে মাঝে গাড়ির ঝাঁকি আর স্ব স্ব বাতাসের শব্দ। তখনি তিথি আমার হাত ধরে আবার বলতে শুরু করলো,,

--" কুহু তুই ইউসুফ ভাইয়াকে ভালবাসিস আমি জানি! কিন্তু কেন বলিস না তাকে! কেন বুঝতে দিস না? "

আমি এক পলক ইউসুফ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। চোখ বুজে আছেন উনি। হয়তো ঘুমিয়ে আছেন! তার গুমন্ত চেহারা দেখতে ভাল লাগে আমার খুব বেশী ভাল লাগে। আলতো করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়নতার মাথা চুল গুলো। তার দিক তাকিয়েই ছোট্ট শ্বাস নিয়ে তিথির দিক অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে মলিন হেসে বললাম,,

--" সব ভালবাসা যে পরিপূরণতা পেতে নেই।"

তিথি তখন আমার হাত টা শক্ত করে আকড়ে ধরে বলল,,

--" ঠিক আছে মানলাম। সব ভালবাসা পরিপূরণতা পেতে নেই! কিন্তু কুহু! বোন আমার, প্রকৃতি যখন কিছু  মুহূর্ত উপহার দেয়! তখন কিন্তু দু হাত তুলে ঝাঁপটে ধরতে হয়!"

আমি কিছু বললাম শুধু তিথির কথায় চেয়ে রইলাম তার দিক।

__________________

সকাল.....৫ঃ৩০।
গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙ্গেইতেই নিজেকে ইউসুফ ভাইয়ার বুকে পাই আমি। সাথে সাথে সরে আসতেই মিটমিটে  হেসে ইউসুফ ভাইয়া বললেন,,

--"কেউ একজন কাল বলেছিল,  পরপুরুষের কাঁধে মাথা রাখবে না। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে সেই পরপুরুষের বুকে ঘুমিয়ে!

আমি তখন লজ্জায় কিছু বলতে পাড়চ্ছিলাম নিচের ঠোঁট কামড়ে  জানালার বাহিরে তাকিয়ে হাসচ্ছিলাম বিনা শব্দে! লোকটি প্রতিবার লজ্জায় ফেলার একটি চান্স মিস দেয় না! কিন্তু উনি এখানে কি করছেন? এখানে তো তিথি ছিল!তার দিক ফিরে চোখ ছোট ছোট করে বললাম তাকে,,

--" এখানে তিথি ছিল! আপনি কেন? ও কই গেল? "

ইউসুফ ভাইয়া বলল,,

--"আমার সিট আমি তিথিকে দিছি কিছু সময়ের জন্য! আবার নিয়ে নিয়েছি! এনি প্রবলেম??আর হে দূরে গিয়ে বসুন! আমি পর মহিলার সাথে কথা কম বলি ওকে!!"

আমি তখন উনার কথায় হা হয়ে গেলাম। কিসুন্দর আমার কথা আমাকে ফিরে দিচ্ছে।  আমিো কম না। আমিও ভেংচি কেঁটে সোজা হয়ে বসে গেলাম।তখন ইউসুফ ভাইয়ার ঠোঁটে হাসি! এই হাসি দেখে অন্য কোনো সময় মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখতাম। কিন্তু এখন রাগ উঠছে।  গা জলছে তার হাসিতে হুহ!!

দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামলো  খাগড়াছড়ি বাস স্ট্যান্ডের সামনে। একে একে নেমে এলো নুশরা, বুশরা, তিথি, রাহুল ভাইয়া, ভাবী, রাহুল ভাইয়ার খালার দু ছেলে,  হাসান, ফুয়াদ আর আমি আর ইউসুফ ভাই।সব মিলিয়া হৈ-হুল্লোড় বিষয়। কিন্তু আমার কাছে মোটেও না। কেন জানি চেয়েও খুশি হতে পারছি না। 

তখনি শুনা গেল নুশরার ন্যাকা কান্নার কন্ঠ,,

--" ভাইয়া গাড়ি আনলেই হতো। বাসে বসে আমার ঘুম হয়নি রাতে!  গাড়িতে আরাম করে ঘুমাতাম উফ..!"

তখনি পাশ থেকে হাসান ভাইয়া চাটি মেরে বরল নুশরাকে,,

--" এটা পাহাড়ি এলাকা গাধী! গাড়ি দিয়ে নে এভাবেই মজা বেশী! খোলা মেলা জিপে বসে,  চাঁন্দের গাড়ি করে যাবো! আহ্ কি খুশি খুশি লাগেরে মামা!"

—————

সাথে সাথে হেসে দিল সবাই!!সাথে আমিও।তারপর হাঁটা ধরলাম সবাই চান্দের গাড়ির দিক!তখনি একটি ছেলে এসে বলল...

--"হাই আমি জায়েদ!"

সাথে সাথে আমারা ছেলেটির দিকে তাকালাম। সুন্দর মতো উঁচু লম্বা হালকা লম্বাটে মুখ তার। কাঁধে ব্যাগপ্যাক।ইউসুফ ভাইয়া হালকা হেসে হাত মিলিয়ে বলল,,

--"হেলো! আমি ইউসুফ! আমি তোমাকে আগেই চিন্তে পেরেছি! ডায়মন্ড আমাকে তোমার পিক হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল।"

ডায়মন্ড নামটা শুনে আত্মা ছেত করে উঠলো। নিজকে সামলে ছেলেটির দিকে তাকালাম। ইউসুফ ভাই জায়েদকে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের সাথে। তিনি খাগড়াছড়িতে থাকেন! যেহেতু আমরা নতুন, তাই গাইড করে নিয়ে যাবেন।পিকের কথায় হয়তো ছেলেটি লজ্জা পেল। মাথা চুলকে বলল,,

--" তো চলুন যাওয়া যাক!"

আমি ছেলেটিকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করছি। তখনি পাশ থেকে তিথি ধাক্কা দিয়ে বলল,,

--" রং নাম্বারে ডায়েল করিস না বনু! হিতে বিপরীত হবে!"

আমি তিথির দিকে রাগে কটমট হয়ে তাকাতেই দাঁত কেলিয়ে বলল,

--" তোর ভালোর জন্য বলছি! বাকিটা তোর মর্জি!"

বলে সুর সুর করে চলে গেল বুশরার পাশে। আজব মাইয়া! তার এহেন কর্মকান্ডে হেসে দিলাম আমি।তখনি পাশ থেকে ইউসুফ ভাই আমাকে বলতে লাগে,,

--" লাষ্ট পর্যন্ত হেসেছিস তাহলে! মাশাআল্লাহ! কি সুন্দর হাসি! কেন মুখ এক রাস কালো মেঘ করে বসে থাকিস?হাসবি সব সময় এই হাসিটা তোর মুখে সুট করে খুব।"

আমি কিছু বললাম না চুপ রইলাম। উনি কি বুঝবে আমার সিচুয়েশন! যখন কাউকে ভালবাসার পর সেই মানুষটিকে আঁকড়ে ধরতে না পারার কষ্ট কতটুকু!তবু ও ফিকে হাসলাম।

দেখতে দেখতে চলে এলাম চান্দের গাড়ির কাছে।এক সিরিয়ালে সাড়ি সাড়ি গাড়ি দাড়িয়ে।রাহুল ভাইয়া সবাইকে গাড়িতে উঠার তারা দিচ্ছেন।কারণ জায়েদ বলেছে,,

--"৯ঃ০০ টার মাঝে খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্প হয় সাজেক যেতে হলে । পরে পরবে ১০ নং বাঘাইহাট পুলিশ । সেখান থেকে আমাদের সাজেক যাওয়ার অনুমতি নিতে হবে! পরে দেড়ি হলে আবার ---৩ঃ০০ পর্যন্ত ওয়েট করতে হবে।সো হারি আপ গাইজ!"

গাড়িতে উঠে বসলো সবাই। গাড়ি ছুটছে তার গতিবেগে। সকলেই নানা কথা বার্তায় ব্যস্ত। ইউসুফ ভাই আমার সাথে বসে।ঊনার শরীরের ঘ্রাণ নাকে লাগচ্ছে। মাতাল করা ঘ্রাণ। না চাইতেও গাড়ির ঝাঁকুনিতে তার গায়ের ছোয়া লেগে যাচ্ছে। সাথে শরীরে মাঝে কাঁটা দিয়ে উঠছে! উনাকে আমার কাছে ক্যাকটাস গাছের মতো মনে হচ্ছে। ক্যাকটাস গাছের কাঁটা গায়ে বিঁধলে ব্যথা অনুভব হয়। কিন্তু তার স্পর্শ কাঁটা মুক্ত।নরম তুলতুলে তুলোর মতো! এই স্পর্শ ব্যাথার বদলে চোখ মুখে লাজুক আভা ফুঁটে উঠছে আমার। গাড়িতে আবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।  এবার পরে যেতে নিলাম আমি! সাথে সাথে ইউসুফ ভাইয়া আমার কোমর চেপে ধরে তার দিক নিয়ে চেপে বসে। আমি শক্ড!হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি তার দিক চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছি! তিনি আমার দিক বাঁকা হেসে চোখ টিপ মারলেন! উনার কাজে  লজ্জা পেলাম আমি! তিনি আবার কথা বলতে লাগলেন সবার সাথে! কিন্তু তার হাত এখনো আমার কোমরে চেপে রেখেছেন যেন আমি পড়ে না যাই! মাঝে মাঝে তার কেয়ারিংয়ে খুব অবাক হই আমি!

গাড়িতে নিরবতা চলছে! নিরবতা ভেঙ্গে হাসান ভাই বললো,,

--" তো জায়েদ! নিজের সম্পর্কে কিছু বলো?"

জায়েদ হালকা হেসে বলতে লাগে,,

--" আমি এবার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি।  সাথে বাবার ব্যবসা দেখছি!"

তখনি ফুয়াদ ভাই বলল,,

--"তোমার আর ভাই-বোন নেই!"

জায়েদ হেসে মাথা নাড়ায় যে নেই!তখনি পাশ থেকে রাহুল ভাইয়া বলে উঠে,,

--" তো সাজেক সম্পর্কে কিছু ধারণা দেও! আমারা তো নতুন! তুমি কবার এসেছো সাজেক?"

জায়েদ হাসলো কিছুটা। এর হাসি যেন মুখের মাঝে মাকড়সার জালের মতো ঝুলে থাকেই। কিছু বললেই হেসে উত্তর দেয়!এর হাসির নাম হওয়া উচিৎ ঝুলনতো হাসি। এখনো তার বিপরীত হলো না! সে হেসে বলল,,

--" সাজেক আমার কাছে সব থেকে প্রিয় জায়গা! আমি এই পর্যন্ত ১০/১২ বারের উপরে গিয়েছি! কিন্তু বাইকে! সাজেক গেলে কখনো বোরিং ফিল করি নাই! প্রতিবার নতুন রূপ দেখেছি সাজেকের। আর  সাজেক হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন । যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল । সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিনে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম,পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা। একটা মজা ব্যাপার আছে জানেন! আপনারা চাইলে নৌ পথে সাজেক যেতে পারতেন! কিন্তু ওটা খুব রিস্কি! তাই সবাই এই পথে যাওয়া!"

তখনি পাশ থেকে তিথি  জানতে চাইলো,,

--" আপনি নৌ পথে গেছিলেন? "

তিথির কথায় জায়েদ তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়। যাতে লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে তিথি সাথে ঠোঁটে লজ্জা রাঙ্গা হাসি।  তিথি এমন কাজে সন্দেহ  সন্দেহ লাগচ্ছে। তখন জায়েদ ভাইয়া হেসে বলল,,

--"হে বহুত বার।রাঙামাটি থেকে নৌপথে কাপ্তাই হয়ে এসে অনেক পথ হেঁটে সাজেক যেতে হয় । "

তিথি এখনো লজ্জা পাচ্ছে।  মনে হচ্ছ লজ্জায় গাড়ি থেকে লাফ দিবে সে! আমি ভ্রু জোরা কুঁচকে চেয়ে দেখচ্ছি তাকে!আমার দিকে বার কয়েক চোখ চোখি হতেই চোখ ফিড়িয়ে নেয় তিথি। কেমন রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি!এরি মাঝে হুট করে ইউসুফ ভাইয়া আমাকে চিমটি কাঁটে। আমি "আহ্" করে উঠে ইউসুফ ভাইয়ার দিকে তাকাই সে হাসচ্ছে মিটমিট করে।তার এহেন কাজে অবাক আমি! আর কত রূপ দেখবো এই লোকের আল্লাহ জানেন। তখনি ভাবি জিগ্যেস করে,,

--" কি হয়েছে কুহু!" 

আমি ইউসুফ ভাইয়ার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলাম! তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,,

--" মশা কামড় দিয়েছে! "

তখনি পাশ থেকে রসিকতার সুরে বলল তিথি,,

--- হে হে বুঝতে পাড়চ্ছি! অনেক বড় মশা! যার দুটো হাত,  দুটো পা, দুটো চোখ,একটি নাক মূলত মানুষ সরূপ দেখতে!নারে বনু??"

তিথি কথায় হো হো করে সবাই হেসে দিল। ইউসুফও হাসচ্ছে! আর আমি লজ্জায় লাল।বেটা খাটাশ কি হাসি তার।  মন চাইছে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই!

_________________

গাড়ি এসে থামলো আর্মি ক্যাম্প। অনুমতি নিয়ে ফের চলতে লাগলো। আশেপাশে সৌন্দর্য মুগ্ধ নয়নে দেখছি আমি।ছোট বড় পাহারের বুক চিড়ে উড়ে উঠে চলছি আমরা। কিছুক্ষণ আগের বড় বড় বাড়ি ঘর দালানকোঠা সব ছোট ছোট হতে লাগলো। চারিপাশের আকাশের নীল আভায় হালকা তুলোর মতো মেঘ ঘুর ঘুর করে ঘুরে কি সুন্দর করে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ জায়েদের কথায় ধ্যান ভাঙ্গল আমার।

--"এটা হচ্ছে কাসালং ব্রিজ, এখানে ২টি নদী মিলে কাসালং নদী হয়েছে ।এর পরে টাইগার টিলা আর্মি পোস্ট ও মাসালং বাজার । সেখানে নাস্তা খাওয়ার জন্য থামতে হবে ভাইয়া। এর পর আর কোনো হোটেল বা বাজার নেই! সেখানে থেকে যা কেনা কাটা করা করে নিতে হবে আপনাদের!"

সবাই সম্মতি জানালো!কিছুক্ষণ পর এসে থামলো মাসালং এ। সবাই সেখানে নাস্তা করে নিলাম আমরা। তিথি, নুশরা, বুশরা, ভাবি কেনা কাটা করছে। এখানে পাশেই বাজার সবাই নানান সবজি নিয়ে বসে।  সব পাহাড়ি নাম না জানা সবজি, ফলমুল।এদিকে অধিবাসীরা কেনা-কাটা করছে।সব থেকে ইন্টারেস্টিং বিষয় এখানে বিদ্যুৎ নেই সোলারের মাঝে চলছে সব।

_____________

গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। বাজার পার হতেই দেখা মিললো সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া যার উচ্চতা ১৮০০ ফুট । এর প্রবীণ জনগোষ্ঠী লুসাই । এছাড়া পাংকুয়া ও ত্রিপুরারাও বাস করে । রুইলুই পাড়া থেকে অল্প সময়ে পৌঁছে যাবো। কাছেই প্রায় জায়েদ বলল আমাদের। আমরা মুগ্ধ নয়নে সব দেখে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে গাড়ি উঠে যাচ্ছে সাজেকের দিক!মনে হচ্ছে আকাশের মেঘ ছুঁইব!

ঘন্টা খানিকের মাঝে এসে থামলো সাজেক।গাড়ি থেকে বের হয়েই আমি স্তব্ধ।  এত সুন্দর দৃশ্য আমি আমার লাইফে কখনো দেখিনি! এ যে এক অপরূপ লীলাভূমি। আশে পাশে তাকিয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে আমি! তখনি কারো চিৎকারে "ইউসুফ" বলে ঝাপটে ধরে। তখনি ভাবনার সুতা ছিড়ে গেল।  সাথে সাথে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মনের মাঝে দুঃখ দুঃখ লাগচ্ছে। চোখের পানি টলমল করছে। এ বুঝি টপ করে পগবে। নিজেকে সামলে সামনে তাকাতেই বিস্মিত  হলাম! এতো দেখছি....!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন