৪১!!
হালকা সিল্কের শাড়িটা পড়তেও মায়রা সমানে ঝামেলায় পড়ছে। এই শাড়িটা আগেও বেশ কয়েকবার পড়েছে মায়রা। খুব সুন্দর করে কুঁচি হয় শাড়িটায়, কিন্তু আজ শাড়িটায় কিছুতেই ঠিক করে কুঁচি করতে পারছে না মায়রা। একবার কুঁচিগুলোর সাইজ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, আরেকবার কুঁচি শাড়িতে গুঁজে দেয়ার সময় শাড়ির ভাঁজগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো সব ঠিকঠাক হলে শাড়ির সাইডটা বিশ্রি করে বাইরে বেরিয়ে আসছে। মায়রা রাগে শাড়িটা কোনমতে গুঁজে নিয়ে বারান্দায় রকিং চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়লো। মাথার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে মায়রার। ইচ্ছে করছে কাউকে জাপটে ধরে ঘন্টাখানেক কান্নাকাটি করতে। কিন্তু ওর সেই রাস্তাটা তো বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।
আয়ান রুমে এসে মায়রাকে না দেখে বারান্দায় চলে এলো। বারান্দায় মায়রাকে দেখে একটু অবাক হলো আয়ান। মায়রা চোখ বুজে রকিং চেয়ারটায় আধশোয়া হয়ে আছে। তুমুল বৃষ্টি হওয়ার আগে আকাশটা যেমন গুমট হয়ে থাকে, মায়রার মুখটা তেমনি কালো হয়ে আছে। কি হয়েছে মেয়েটার সেটাই আয়ান বুঝতে পারছে না। মায়রা ঘুমিয়ে গেছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না আয়ান। আয়ান আর কিছু না ভেবেই মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। মায়রা চমকে চোখ খুলে আয়ানের গলায় হাত ঝুলালো।
-আরে? কি করছ?
-তুমি এখানে একা একা কি করছ? আমি তো ভাবলাম এখানেই ঘুমিয়ে গেছ--।
-নাহ--। এমনি বসে ছিলাম---।
-তা তো দেখতেই পাচ্ছি ম্যাডাম--। কি হয়েছে বলো তো আমার লাজুক পরীটার? চোখমুখ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে? মন খারাপ কেন?
-না না--। মন খারাপ না --।
-তাহলে কোনো কারণে রাগ করে আছো আমার উপরে?
-নাহহহহহ----।
-তো? তাহলে? কি হয়েছে সেটা আমাকে না বললে বুঝবো কি করে পরীটা? কেউ কিছু বলেছে? নাকি বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে?
-না তো--। কিচ্ছু হয়নি---।
-শরীর খারাপ লাগছে?
-বলছি তো কিচ্ছু হয় নি----।
-ওকে--। ওয়েট--। আমিই দেখছি---।
আয়ান মায়রাকে নিয়েই খাটে বসে পড়লো। মায়রা ওর কোলের উপর বসে রইলো চুপ করে।
-মায়রা? কি হয়েছে সেটা আমাকে না বললে--।
-আমার কিছু হয় নি---।
-আমি জানি তো পরীটা। একদমই সময় দেয়া হচ্ছে না পরীটাকে। তাই আমার পরীটা অভিমান করেছে--। ওকে। আজকে আমার সারাটা রাত বউটার---।
-------------------------------
-এই যে ম্যাডাম? এমন বেহাল অবস্থা কেন? তোমাকে না রেডি হয়ে থাকতে বলেছিলাম?
-শাড়িটা পড়তে পারছি না---।
-কি! আমি তো জানতাম বউটা শাড়ি পড়ায় এক্সপার্ট---।
-মজা করছেন?
-আরে না রে বাবা। তা একদিন নাহয় শাড়িটা বউকে আমিই পড়িয়ে দিলাম। কি বলো?
মায়রা আবার চুপ করে আছে দেখে আয়ান আলতো করে মায়রার মুখটা তুলে ধরে কপালে চুমো খেল।
-তোমার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি লাজুক হাসিটাই বেশি মানায় গো পরীটা। তুমি এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে আমার বুকের ভেতরে চিনচিনে একটা ব্যথা উঠে গো। কেন যে বুঝো না?
-তোমার না কাজ ছিল---? শেষ?
-আরে নাহ--। আরো কয়েকটা মাস এভাবেই ঝামেলা চলতেই থাকবে। প্রজেক্টটা কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই একদম---।
-ওওওওওও-। আচ্ছা? আরিশা আপুও তোমার সাথে একই অফিসে-----?
-হুম। আমি আর আরিশা একসাথে পার্টনারশিপ করে তো কোম্পানিটা করেছি--। ওর জুয়েলারি আইডিয়া, ডিজাইন আর আমার ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়ালেখা। দুটো মিলিয়ে আমাদের ছোট্ট কোম্পানিটা, দিবাশা--।
-ওহ আচ্ছা---।
-কি ভাবছ মায়রা?
-দুপুরে মিটিংয়ে আপুও গেছিলো?
-নাহ। প্রজেক্টটা আমার। তাই মিটিংয়ে আরু যায় নি--। আমিই গেলাম। কেন বলো তো?
-নাহ--। এমনি---।
-মায়রা--। লুক-। আরিশার ব্যাপার নিয়ে প্লিজ তুমি অন্য কিছু ভাবতে যেও না। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ফ্রেন্ড হতে পারবে না এটা শুধু সালমান ভাইয়ের মুভিতেই মানায়। বুঝসো পাগলি?
-হুম----।
-এই? শোনো? আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাকে রেডি করিয়ে দিবো। তুমি চুপ করে বসে থাকো। ওকে?
-আচ্ছা---।
আয়ান মায়রাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। মায়রা একমনে ভাবার চেষ্টা করছে। আরিশা যদি আয়ানের সাথে মিটিংয়ে নাই গিয়ে থাকে তাহলে ওদের দুজনকে বিকেলে শপিং মলের কফিশপে যে একসাথে দেখলো? ওরা কি তাহলে অফিসের বাইরে কফিশপে দেখা করতে এসেছিল? কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সাহস হয়নি মায়রার। আর কিইবা জিজ্ঞেস করবে? আয়ান তো বলেই দিলো আরিশা ওর বেস্টফ্রেন্ড। ওকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু মাথায় না আনতে। কিন্তু আয়ান যেভাবে আরিশার হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বলছিল সেটা দেখেও কিছু না ভেবে থাকতে পারছে না মায়রা। ওর মাথার ভেতরে যেন দৃশ্যটা কেউ খোদাই করে দিয়েছে। চাইলেও সেই দৃশ্য ভুলতে পারছে না মায়রা।
আয়ান শাওয়ার নিয়ে এসে দেখলো মায়রা এখনো থ হয়ে বসে আছে। আয়ান ভিজে চুল মুছে টাওয়ালটা মায়রার কোলের উপরে ফেলতেই মায়রা চমকে তাকালো। আয়ানের দিকে তাকাতেই মায়রার বুকের ভিতরে ধুকপুক করে উঠলো। আয়ান হেসে নেভি ব্লু শার্ট আর জিন্স পড়ে মায়রার হাত ধরে টেনে টিটেবিলের সামনে বসালো। একটা প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে মায়রার দিকে চাওমিন এগিয়ে দিলো। মায়রার এতোক্ষণে খেয়াল হলো আয়ান খাবার নিয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে উঠতে যাবে এমন সময় আয়ান আবার মায়রাকে টেনে বসিয়ে দিলো।
-আরে? কি মুশকিল? না খেয়ে উঠছ কেন? আমি এতো শখ করে চাওমিন আনলাম তোমার জন্য--।
-তুমি খাবার নিয়ে এসেছ আমাকে বলবা না? সবাইকে খেতে দিবো--।
-ম্যাডাম আমি মাকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। মা ই তোমার মন খারাপ দেখে আমাদের খাবারটা রুমে নিয়ে আসতে বলেছিল--। বুঝেছ?
-এটা আমি কি করলাম? মা কি ভাবলো?
-কিচ্ছু ভাবলো না পাগলী--। এখন খাও---।
-আমি মায়ের কাছ থেকে আসছি একটু---।
-এই? বলছি না মা কিছু মনে করে নি? যাওয়ার সময় যা ইচ্ছে হয় বলে যেও। এমনিতেই খাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে--। হা করো?
-হুম------।
দুজনে মিলে খেয়ে নিয়ে আয়ান মায়রার কোমড় চেপে কাছে টেনে নিয়ে শাড়িটা খুলে নিল। আলমারি থেকে নেভি ব্লু রঙের একটা জামদানি নিয়ে এসে যত্ন করে পড়িয়ে দিল আয়ান। কুঁচি ঠিক করে গুঁজে দিয়ে মায়রার নাভিতে গভীর আবেশে চুমো খেল একটা। মায়রা কেঁপে উঠে আয়ানের কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরতেই আয়ান হেসে উঠে দাঁড়ালো। মায়রা লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়েছে দেখে আয়ান আলতো করে কপালে চুমো খেল। খাবারের প্লেট দুটো তুলে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো আয়ান।
-এই শোনো? সাজটাও আমিই করিয়ে দিবো?
-উহু--। আমি পারবো---।
-ওকে ম্যাডাম। আপনি সাজ কমপ্লিট করুন--। চুড়ি, কাজল, টিপ-ওকে? আমি প্লেট রেখে নিচে গাড়িতে ওয়েট করছি--।
-আচ্ছা---। মাকে বলেই চলে আসবো---।
-আচ্ছা বউটা--। তাড়াতাড়ি করো--। অলরেডি ৯ টা বাজে।
-হুম----।
মায়রা পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে নিচে এসে শাশুড়ির রুমের দরজায় নক করলো।
-মা আসবো?
-হ্যাঁ মায়রা মা? আয় আয়----।
মায়রা রুমে ঢুকে দেখলো শাশুড়ি খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে।
-মা? আমরা একটু বাইরে-- বাইরে যাচ্ছি---।
-হ্যাঁ রে মা। সাবধানে যাস। আয়ান বলেছে তো আমাকে--।
-সরি মা---। আমি তখন আসতে--।
-আরে সরি বলছিস কেন? আয়ানের উপরে রাগ হয়েছে তাই না রে?
-না মা----।
-আরে বাবা। রাগ হলে রাগ করবি---। কিন্তু খবরদার এমন মুখ কালো করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবি না। তোর নিজের স্বামী। রাগ হলে রাগ দেখাবি। টাইট দিবি। কিন্তু খবরদার ভুলেও বাপের বাড়ি যাওয়ার নাম নিবি না। জামাইগুলো এসবে আর আজকাল ভয় পায় না।
-জি?
-আমাকে দেখিস না? আমিও রেগে গেলে তোর শ্বশুর মশাইকে জব্দ করি--। উহু বাবা! রাগ হলে সেটা গুনে গুনে উসুল করে নিবি--। বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকার কি দরকার? আরো কত উপায় আছে---।
-এই আয়ানের মা তুমি বৌমাকে কি কুটনামি বুদ্ধি শিখাচ্ছো বলো তো?
দরজার দিকে তাকিয়ে মায়রা থতমত খেয়ে গেল। শ্বশুর রুমে এসেছে দেখে মায়রা লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে এলো। দুজনকে সালাম করেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো মায়রা। পিছন থেকে শ্বশুর শাশুড়ির কথাগুলো কানে আসছে মায়রার।
-এই তুমি আমাকে কুটনি বললা কেন? আমি কুটনি? তোমার মতো কুটনা বুড়ারে বিয়া করে আমার জীবন শেষ--। এখন সে আমারে বলে কিনা আমি কুটনি!
-এতো সোজা সিধা ছেলের বউটারে কি শিখাচ্ছিলা তুমি? তোমার মতো হুট করে রাগ করে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে? আর আমার ছেলেটাও আমার মতো কাজকর্ম ফেলে ওকে খুঁজতে যেতে--?
-কি বললা তুমি? আমি মায়রাকে কুটনামি শিখাইতেসি? দল পাকাইতেসি? আমি আজই যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাবো--।
মায়রা আর না দাঁড়িয়ে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো। শ্বশুর শাশুড়ির এমন ছেলেমানুষি ঝগড়া শুনে হাসিও পাচ্ছে আবার ভিষণ লজ্জাও লাগছে মায়রার। কিন্তু মনে মনে ভাবছে ও চাইলেও আয়ানের সাথে এমন করে বাচ্চাদের মতো ঝগড়া লাগতে পারবে না। তবে আয়ানের সাথে এমন খুনসুটি ঝগড়া বাঁধানোর আইডিয়াটা নেহায়তই মন্দও লাগছে না মায়রার কাছে। এসব ভাবতে ভাবতেই মায়রার ঠোঁটের কোণে আবার আগের সেই মিষ্টি হাসিটা ফিরে এলো।
৪২!!
মায়রা এসে আয়ানের পাশে বসলে আয়ান গাড়ি স্টার্ট দিলো। মায়রার ঠোঁটের কোণে হাসিটা দেখে একটু হালকা লাগছে আয়ানের। পাগলিটার মন খারাপ দেখলে আয়ানের নিজেরই প্রচন্ড খারাপ লাগে। মেয়েটা তবু যে কেন এতো মন খারাপ করে রাখে কে জানে। মায়রাও এক মনে জানলার বাইরে তাকিয়ে রাতের অন্ধকার দেখছে। রাস্তায় পাশের ইলেকট্রিক পোলের আলো, রাস্তার এতো এতো গাড়ির হেডলাইটের আলো চারপাশে তবু রাতের এই অন্ধকারকে কিছুতেই আলোয় ভরে দিতে পারছে না। ইলেকট্রিকের পোলটা পেরিয়ে কিছুদূর গেলে বা কোন গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেলে সব নিকষ কালো অন্ধকার। আধো আলো-আঁধারি খেলা চলছে যেন। এসব দেখতে বেশ ভালো লাগছে মায়রার। পাশে যে আয়ান বসে একটু পর পর ওকে দেখছে সেদিকে মায়রার হুঁশই নেই। এতোদিন পরে এভাবে হুট করে বেরিয়ে ভিষণ আনন্দ হচ্ছে মায়রার।
গাড়িটা হঠাৎ করে ব্রেক করায় মায়রা আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রেখে মায়রার সিট বেল্ট খোলায় মন দিয়েছে। জানলা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস এসে মায়রার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে বারেবারে। কিন্তু জায়গাটা এতো অন্ধকার যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাই মায়রা বুঝতেও পারছে না কোথায় এসেছে। আয়ানও মায়রাকে কাছে টেনে কোলে তুলে নিলো।
-এই? কোথায় এসেছি আমরা?
-সেদিনের নদীর পাড়ের কথা মনে আছে? আমরা এখানে ঘাসের উপর বসে কথা বলতে বলতে সময়টাই ভুলে গেছিলাম--।
-সত্যি? আমার নদীর পাড়ে এসেছি? চলো না হাঁটবো?
-উঁহু---। এখন না --। আরেকটু পর---।
-কেন?
-এখন বউটাকে দেখবো আর আদর করবো--।
-এই?
-কি কি? হুম? আমার বউ আমি আদর করবো।
আয়ান মায়রাকে কাছে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। বেশ অনেকক্ষণ পর সরে এসে দেখলো মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে চোখ বুজে আছে। আয়ান হেসে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুলে হাত বুলালো।
-তোমার ঠোঁটের কোণে এই মিষ্টি লাজুক হাসিটা কতোটা মানায় তুমি কি সেটা জানো মায়রু? কেন মুখটা মলিন করে এই সৌন্দর্যটা নষ্ট করো বলো তো? তোমার কোনো কারণে মন খারাপ হলে আমার কতটা কষ্ট লাগে সেটা কি তুমি বুঝো না পাগলিটা?
মায়রা কিছু না বলে আয়ানের বুকের আরো ভিতরে মুখ ডুবিয়ে নিলো।
-সরি--। আর হবে না।
আয়ান আর কিছু না বলে মায়রার চুলে নাক গুঁজলো।
-এই মায়রু? তুমি না নদীর পাড়ে হাঁটতে যাবা? এখন তাহলে এভাবে লুকিয়ে আছো কেন বুকের ভেতরে?
-তুমিই তো লুকিয়ে রেখেছ--।
-ইশ! আমি তো সবসময়ই এভাবে বউটাকে লুকিয়ে রাখতে চাই। সেটা আর হয় কই?
-কি!
-চলো চলো? কিছুক্ষণ হাঁটি নদীর পাড়ে। আবার বাসায় ফিরতে হবে--।
-হুম---।
আয়ান মায়রাকে নিয়ে নদীর পাড়ে বেশ অনেকক্ষণ হাঁটলো। হাতে হাত রেখে খালি পায়ে নদীর পাড়ে হাঁটলো ওরা দুজন। বাতাসের দাপটে মায়রার আঁচলটা উড়াউড়ি করে বারবার আয়ানের গায়ে পড়ছে। আয়ান হেসে মায়রার আঁচলটা টেনে নিজের গায়ে পেঁচিয়ে নিল। মায়রা ভ্রু কুঁচকে আয়ানের কাজ দেখছে।
-মায়রা? একটা গান শুনবা?
-এখন!
-বাসায় গিয়ে তো আর গান গাওয়ার সময় পাবো না। অন্য কাজ থাকবে--।
-হুম? কি কাজ!
-আছে আছে---। শুনবা গান?
-হুম---।
আয়ান মায়রার কাঁধে হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে গান ধরলো। নিস্তব্ধ নদীর পাড়ে গানের প্রত্যেকটা শব্দ বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে।
-"Lab pe dil ki baat hai aayi
Main kaise khamosh rahu
Dhadkan kahti hai jo mujhse
Kaise tujhse wo baat kahu
Sath chhodu na tera chahe duniya ho khafa
Sath chhodu na tera chahe duniya ho khafa
Ye hai mera faisla kya hai tera faisla,
O rabba
Vaada todu na sanam chahe koi ho sitam
Vaada todu na sanam chahe koi ho sitam
Ye hai mera faisla kya hai tera faisla
Ho rabba
Sath chhodu na tera chahe duniya ho khafa
Main to jeeungi tere intezaar me
Aansu piungi har ghadi main pyar me
Teri wafa pe mujhe aetbar hai
Dil kya hai tujhpe meri jaan nisar hai
Hona tha ek din dil ko deewana
Kismat mein to tha yeh pyar aana
Ho dil to maine sathiya naam tere likh diya
Ho dil to maine sathiya naam tere likh diya
Ye hai mera faisla kya hai tera faisla
O rabba
Sath chhodu na tera chahe duniya ho khafa
Khamosh dharti falak bejuban hai
Apni mohabbat ka ye imtihan hai
Rishte dilo ke koi tod na sake
Tufaan ki dhara koi mod na sake
Hum to likhenge apna fasana
Jo jee mein aaye karle zamana
Teri baaho mein rahu dard tera main sahu
Teri baaho mein rahu dard tera main sahu
Yeh hai mera faisla kya hai tera faisla
O rabba
Vaada todu na sanam chahe koi ho sitam
Sath chhodu na tera chahe duniya ho khafa
Yeh hai mera faisla kya hai tera faisla
O rabba
Yeh hai mera faisla kya hai tera faisla
O rabba o rabba o rabba o rabba-----"
গানটা শেষ হতেই আয়ান আচমকা মায়রাকে আবার পাঁজাকোলা করে তুলে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো। মায়রা চমকে গিয়ে আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো।
-আরে? এই এই? কি করছ?
-বাসায় ফিরবো এখন আমরা--।
-এখনই ফিরতে হবে? আর একটু থাকি না প্লিজ?
-উহু-। বাসায় ফিরতে তো টাইম লাগবো বউটা। অলরেডি দেখো সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে প্রায়।
-ওহ। আচ্ছা চলো।
-মন খারাপ করে না বউটা। আবার একদিন আসবো আমরা এখানে কেমন? সেদিন কোনো তাড়াহুড়ো করবো না। ওকে?
-হুম। আচ্ছা--।
মায়রা পুরোটা রাস্তা বাইরের দিকে তাকিয়ে আলো-আঁধারির খেলা দেখতে দেখতে এলো। আয়ান বেশ বুঝতে পারছে পাগলিটার মনটা আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাসায় তো ফিরতেই হবে। নয়তো এতো সুন্দর একটা সারপ্রাইজ মিস করবে। বাসায় আসতেই আয়ান মায়রার জন্য গাড়ির দরজাটা খুলে ধরলো। মায়রা একটু হাসি দিয়ে নামলো গাড়ি থেকে। আয়ান হাত ধরে বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই বুঝতে পারলো দরজাটা খোলাই ছিল। ড্রইংরুমটাও পুরো অন্ধকার দেখে মায়রা আয়ানের দিকে তাকালো।
-এই? সব লাইট অফ কেন? আর দরজাও খোলা ছিল---।
-আরে? কি মুশকিল আমি কি করে বলবো? তুমি এখানটায় দাঁড়াও। একটুও নড়বা না কিন্তু। আমি লাইট অন করে আসছি---।
-আমিও যাবো---।
-উহু---। বললাম না এখানে দাঁড়াও?
--------আচ্ছা---।
-ভয় পাবা?
-উহু------। তুমি লাইট দাও--।
-ওকে ম্যাডাম----।
আয়ান অন্ধকারের মধ্যেই কোথাও একটা চলে গেল। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও লোকটার আসার নাম গন্ধ নেই দেখে মায়রার সত্যি একটু ভয় করতে লাগলো। কিন্তু আয়ান এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে তাই যেতেও পারছে না। কি একটা অবস্থা! মায়রার ভয়ের সাথে এবার রাগও লাগছে। আয়ানকে কয়েকবার ডাকলো। কোন সাড়াও দিলো না। বিরক্তি হয়ে সামনের দিকে পা বাড়াবে এমন সময় একই সাথে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল। তিথি, আয়ান, তিয়াশ, আয়ানের বাবা মা সবাই চিৎকার করে কিছু একটা বললেন। সেটা মায়রা বুঝতে পারার আগেই ড্রইংরুমের লাইট জ্বলে উঠলো আর মায়রার গায়ে কোথা থেকে অনেকগুলো ফুলের পাপড়ি এসে পড়লো। সব একসাথে ঘটায় মায়রা থতমত খেয়ে গেল। সবাই হাসিমুখে মায়রার দিকে হাত তালি দিতে দিতে এগিয়ে এলো।
-হ্যাপি বার্থডে মায়রা। মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অব দা ডে--।
-আজকে আমার বার্থডে!
মায়রা অবাক হয়ে একবার একজনের দিকে তাকাচ্ছে। এর আগে কখনো মায়রার জন্মদিনে কেউ মায়রাকে এভাবে উইশ করে নি। এই যে এতো আলো! এতো ফুলের পাপড়ি! ইভেন এই মাঝরাতে। তিয়াশ যদিওবা মায়রার প্রত্যেক জন্মদিনে মায়রাকে কেক এনে খাওয়াতো, তবে সেটা বাবা মাকে লুকিয়ে। মায়রার নিজেরই তাই এই দিনটার কথা কোনো বছরই মনে থাকে না। অবশ্য যে দিনটা ওর জীবনের সম্ভবত কলুষিত একটা দিন ছিল, সেটা মনে পড়বেই বা কেন? তবে আজকের দিনে সবার এই হাসি মুখগুলোর উইশ পেয়ে মায়রার মনে হচ্ছে সারাজীবনের সমস্ত অভিযোগ আজ ও ভুলে গেছে। সমস্ত না পাওয়া, সমস্ত অপমান যেন আজকের এই দিনে এই মানুষগুলোর একটা ছোট্ট উইশের সাথে শূন্যে মিলিয়ে গেছে। অন্যরকম একটা শান্তি লাগছো মায়রার। শান্তিটা কিসের সেটা মায়রা জানে না, তবুও মেয়েটা এই অনুভূতিটা উপভোগ করছে খুশি মনে।