বকুল ফুলের মালা - পর্ব ৩৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৬৫!! 

দেখতে দেখতেই তিন-চারটা দিন কেটে গেছে। শাশুড়ির সাথে সম্পর্কটা আবার আগের মতো স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে মায়রার। মায়রার শাশুড়ি সম্পর্কটা ঠিক করার যতটা চেষ্টা করছেন, তার সম্ভবত দশ গুণ বেশি চেষ্টা করছে মায়রা। শাশুড়ী সুস্থ হওয়ার পরেও মায়রা তেমন কাজই করতে দিচ্ছে না। শাশুড়িও মায়রার এমন সব পাগলামি হাসি মুখেই মেনে নিচ্ছেন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। শাশুড়ি অনেক করে মায়রাকে রান্নায় হেল্প করতে চাইলেও মায়রা কিছুতেই রাজি হলো। তাই শাশুড়িও হেসে মায়রাকে পাশে থেকে এট ওটা বলে দিয়েছেন। কতটুকু তেল, লবণ লাগবে এসব। মায়রা তাতেই খুশি মনে নিজের কাজ করেছে সারাদিন।

দুপুরে শ্বশুড় শাশুড়ির খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রান্নাঘরটা গুছিয়ে রাখছিল এমন সময় কলিংবেল বাজার শব্দে মায়রা চমকে উঠলো। বেসিনে হাত ধুয়ে নিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে মেইন ডোরের দিকে এগিয়ে গেল মায়রা। এই মূহুর্তে ঠিক কে আসতে পারে সেটা ভেবে আরো বেশি বিরক্ত লাগছে মায়রার। আয়ানেরও এতো তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়। তাহলে কে! মায়রা রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে আরো দুবার কলিং বেল বেজে উঠলো। তাতে মায়রার মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। এতোবার কলিংবেল বাজানোর কি আছে সেটাই মায়রা বুঝে না। অসহ্য!

মায়রা দরজা খুলে আয়ানকে দেখে দেখে অবাক হওয়ার চেয়ে বিরক্তিই একটু বেশি হলো। কিছু না বলেই আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই আয়ান তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে মায়রার পিছনে ছুটলো। মায়রা আবার রান্নাঘরে এসে নিজের কাজে মন দিয়েছে। আয়ান এসে মায়রাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই মায়রা বিরক্ত হয়ে সরে এসে আবার নিজের কাজ করতে লাগলো। আয়ান কিছুটা অবাক হলেও মায়রাকে সরতে দিলো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। 

-কি হলো পরীটার? আজ আমার লাজুক পরীটা হঠাৎ থেকে এংগ্রী ওমেন হয়ে গেল কেন? কিছু ভুল করে ফেলেছি নাকি গো?

-সরো? উফ আয়ান? ছাড়ো তো? সবসময় এসব ভালো লাগে না। 

-যাব্বাবা! আমি কি করলাম আবার? একটু জড়িয়েই তো ধরেছি শুধু বউটাকে। তাতেই এতো রাগ! বাব্বাহ!

-তুমি ছাড়বে? কাজ করছি দেখছো না? যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার জন্য খাবার নিচ্ছি--। যাও।

-আরে বাবা! খাবার নিবা তো। এতো তাড়া কিসের? কোথায় তাড়াতাড়ি এলাম দেখে একটু খুশি হবে তা না?

-এসেছ যখন আরেকটু আগে আসতে। সবাই একসাথে খেয়ে নেয়া যেত। এখন আবার তার জন্য খাবার নাও। এক কাজ একশো বার করতে হয়---। অসহ্য!

-আরে? এতো রাগ করছ কেন? মায়ু? কি হয়েছে বলো তো? আজ হঠাৎ এতো বিরক্ত হয়ে আছে কেন পরীটা? হুম?

-ছাড়বে তুমি? যাও তো এখান থেকে। কাজ করতে দাও তো---। এমনিতেই মাথা ব্যথা করছে---।

-মাথাব্যথা কেন? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন মায়ু? শরীর খারাপ করেছে নাকি? কি হয়েছে দেখি?

-উফফ! আয়ান? ভালো লাগছে না। যাও তো এখন।

-আচ্ছা বাবা। যাচ্ছি---। তুমি কাজ করো।

-হুম।

এক রাশ কৌতূহল নিয়ে আয়ান নিজেদের রুমের দিকে চললো। প্রথম পরিচয়ের দিনের পর মায়রাকে এতোটা বিরক্ত হয়ে থাকতে কখনো দেখে নি আয়ান। বিরক্তিটা কি জন্য আয়ান সেটাই বুঝতে পারছে না। ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যাপারটা দেখবে ভাবতে ভাবতে আয়ান রুমে চলে এলো। কাবার্ড খুলে একটা ট্রাউজার আর টি শার্ট বের করতে গিয়েই জিনিসটা চোখে পড়লো আয়ানের। আর সাথে সাথেই মায়রার রাগ আর কিটকিটে মেজাজের রহস্যটাও পরিষ্কার হয়ে গেল আয়ানের কাছে। আর দেরি না করে শাওয়ার নিতে চলে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শাওয়ার নিয়ে চেইঞ্জ করে নিচে চলে এলো আয়ান। মায়রা ততক্ষণে আয়ানের জন্য প্লেটে খাবার নিয়েছে। আয়ান এতো তাড়াতাড়ি আসায় মায়রা নিজেও একটু অবাক হলো। কিছু না বলে আয়ানের পাশেই চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে রইলো। আয়ান প্রথম লোকমা নিজে খেয়ে মায়রার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো। মায়রা কিছুটা থতমত খেয়ে মাথা নাড়লো। 

-তুমি খাও। আমি খাবো না।

-হা করো তো? চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নাও। আর কথা কম বলো একটু। তোমার পারমিশন চাই নি। খেতে বলছি---। কই? হা করো?

-উফ আয়ান? খাবো না বলছি না? তুমি খাও তো? 

-খাবো না বললেই হলো নাকি? হা করো? বলেছি না অহেতুক 'খাবো না খাবো না' করবা না? না খেলে শরীর খারাপ করবে তো বাবুটা?

-গা গুলাচ্ছে। খেতে পারবো না। পরে বমি হয়ে যাবে--। সরাও---।

-বমি হলে হবে। তবু খেতে হবে। না খেয়ে না খেয়ে শরীরটাকে অসুস্থ বানানো না? সেটা হবে না---। হা করতে বলেছি কিন্তু মায়রা? পরে আমি জোর করে খাওয়াতে হলে তোমার নিজেরই আফসোস করা লাগবে বলে দিলাম।

-হুহ--। ধুর---।

মায়রা গজগজ করতে করতে কয়েক লোকমা খেয়ে মাথা নাড়লো। আয়ান খেয়ে মায়রার মুখ মুছিয়ে দিল।

-মায়রু? তুমি রুমে যাও। আমি আসছি। 

-প্লেট রেখে রান্নাঘরটা গুছিয়ে রেখে আসছি। তুমি----।

-এদিকটা আমি দেখছি। আমার ফোনে একটা জরুরি কল আসার কথা। ভুলে ফোনটা রুমেই ফেলে চলে এসেছি। তুমি যাও। গিয়ে দেখো তো--। 

-তুমি গেলেই তো হয়। আমার কেন যাওয়া লাগছে? উফফফ।

-আরে বাবা। বলছি যখন যাও না রুমে। প্লেট বাটি এগুলা আমি গুছিয়ে রেখে দিচ্ছি। তুমি যাও।

মায়রা এবারে আরেকবার বিরক্ত হয়ে রুমে চলে গেল। মায়রা চলে যেতেই আয়ান প্লেট বাটিগুলো সব গুছিয়ে রেখে একটা বাটিতে দুটো কলা ছোট ছোট টুকরো করে নিয়ে তাতে উপর থেকে একটুখানি মধু আর দারচিনি গুঁড়ো ছিটিয়ে দিল। ততক্ষণে চুলোয় বসানো দুটো ডিম সিদ্ধ হয়ে গেছে আর পাশের চুলোয় পানিটাও টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে। আয়ান চুলা থেকে ডিমের হাঁড়িটা নামিয়ে ডিমের খোসা ছাড়িয়ে নিলো। তারপর সিদ্ধ ডিম দুটো একটা বাটিতে নিয়ে হালকা একটু গোলমরিচ গুঁড়া আর লবণ ছিটিয়ে দিল। সবার শেষে গরম পানিটুকু একটা হট ওয়াটার ব্যাগে ভরে একটা ট্রেতে বাটিদুটো আর হট ওয়াটার ব্যাগ আর একটা শুকনো টাওয়াল নিয়ে রুমে এলো আয়ান। ট্রেটাকে বেড সাইড টেবিলের উপরে রেখে মায়রার দিকে তাকালো আয়ান। খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে মেয়েটা। চোখের উপরে হাতটা কিছুটা ভাঁজ করে রাখা। তাই হয়তো আয়ানের আসা টের যেমন পায়নি, তেমনি আয়ানকে দেখেও নি। আয়ান মায়রার একপাশে বিছানায় বসে মায়রার কপাল থেকে হাতটা নামিয়ে দিলো। মায়রা একটু চমকে উঠে চোখ মেললো। আয়ান আলতো করে মায়রার গালে হাত ছুঁয়ে দিলো।

-মায়ু? বেশি খারাপ লাগছে?

-হুম? উঁহু না। 

-ধরো? এগুলো খাও তো এখন--।

-মাত্র তো ভাত খেলাম! এগুলো কেন আবার? ধ্যাত---।

আয়ান কিছু না বলে হেসে উঠে গেল। একটু পরেই মায়রার হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে ঝুঁকে মায়রার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। চকলেট হাতে মায়রা বোকার মতো আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়ান মায়রার এমন হতভম্ব মুখটা দেখে আবারও হাসলো। মায়রার হাতে ডিম সিদ্ধ রাখা বাটিটা ধরিয়ে দিলো।

-ধরো তো পরী। আগে গরম গরম সিদ্ধ ডিম দুটো খেয়ে নাও। পরে ফল আর চকলেট খেও বসে বসে। 

-দুটো ডিম সিদ্ধ খাবো কেন? আমাকে কি ভূতে ধরেছে আজকে? এতো খাওয়াচ্ছ কেন আজব?

-ইশ রে! বউটার মেজাজ কিটকিটে হয়ে আছে আজকে। ডিম আর ফল খেলে শরীরে শক্তি পাবা। তাহলে আমার সাথে বেশি বেশি ঝগড়া করতে পারবা।

-এই কি বললা তুমি? কি বললা? আমি তোমার সাথে ঝগড়া করি সারাক্ষণ? এটা বুঝাতে চাচ্ছ তুমি?

-এই রে! না না না তো বউটা। এমনি দুষ্টুমি করেছি। আচ্ছা যাও সরি।এই দেখো কান ধরছি। আর বলবো না। তুমি লক্ষী মেয়ের মতো এগুলো খেয়ে নাও। দেখবে ব্যথাটা কমবে। আর চকলেট খাও। মুডও ফ্রেশ হবে। 

-আমার কিছু লাগবে না। আর খাবো না বললাম তো।

-আচ্ছা যাও। একটু করে খাও। একটা ডিম খাও আগে। তারপর--।

-আয়ান?

-আরে বাবা! না খেলে আরো বেশি দুর্বল লাগবে। খেয়ে তারপর রেস্ট করবা। ভালো লাগবে তাহলে---।

মায়রা আর কোন তর্ক না করে চুপচাপ খাওয়ার মন দিলো। এই লোকের সাথে তর্ক করে কোনো যে লাভ হবে না সেটা মায়রা এতোক্ষণে ভালোই বুঝতে পেরে গেছে। আর না খাইয়ে এখান থেকে যে আয়ান নড়বেই না সেটা তো বলাই বাহুল্য। তাই বেচারি মুখ পানশে করে বসে বসে খাচ্ছে। আয়ান ততক্ষণে হট ওয়াটার ব্যাগটা টাওয়ালে পেঁচিয়ে নিয়ে কতোটুকু গরম হয়েছে সেটা চেক করে মায়রার পেটে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে 'কোথায় বেশি ব্যথা করছে' জিজ্ঞেস করলো। হট ওয়াটার ব্যাগের মৃদু গরম তাপ লাগায় পেটের ব্যথাটা কিছুটা কমে স্বস্তি লাগছে ঠিকই। কিন্তু আয়ানের প্রশ্নটার কারণেই কিনা কে জানে মায়রার মনে হচ্ছে লজ্জায় বেচারি মাটির সাথেই মিশে যাবে। এমন করে কেউ জিজ্ঞেস করে? আয়ানের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। সে হালকা হাতে মায়রার পেটে গরম পানির ছ্যাঁকা দেয়ায় ব্যস্ত। অন্তত তাতে যদি মেয়েটার ব্যথার কিছুটা উপশম হয়। আর আয়ানের এমন উদ্বিগ্নতায় লজ্জা পেলেও কেমন যেন একটু ভালো লাগছে মায়রার। সংকোচের থেকেও এই মানুষটার জন্য অনেক বেশি ভালো লাগাই কাজ করছে মায়রার মনে। এই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তাই নিজেকে আজ আরেকবার খুব লাকি মনে হচ্ছে মায়রার। এতো কেয়ারিং একটা মানুষ পাশে থাকায় হয়তো পিরিয়ডের এই ব্যথাটাও আজ মায়রার খানিকটা হলেও কম মনে হচ্ছে। আসলেই একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী পাশে থাকলে জীবনটা কতোই না সুন্দর হয়!

৬৬!! 

দেখতে দেখতে আরো ছয়টা মাস কেটে গেছে। এতোগুলো দিনে দুই শহরে থাকা দুজন মানুষের জীবনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। তাদের একজন হলো মায়রা, আর অন্যজন সায়না। মায়রার জীবনের পরিবর্তনটাকে ইতিবাচকই বলা চলে। শ্বশুর শাশুড়ি আর স্বামীর সাথে ওর জীবনটা আগের চেয়েও বেশি মধুর হয়ে উঠেছে। শ্বশুর শাশুড়ী তো মায়রাকে একেবারে চোখে হারায়। আর আয়ান? এই মানুষটার ভালোবাসা প্রতিনিয়ত মায়রাকে পূর্ণতা দিয়ে গেছে। এমন কি এখনও মায়রার সব জেদ, পাগলামি মুখ বুজে সহ্য করেও আরো এক ধাপ বেশি পাগলামিতে মাতিয়ে রাখতে আয়ানের সত্যিই জুড়ি মেলা ভার। গত তিনমাসে মায়রার জীবনে ঘটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো। একটা বছর গ্যাপ দেয়ার পর মায়রা নতুন ব্যাচের সাথে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। পড়ালেখার তেমন প্রেশার নেই আপাতত। তবু আয়ান পাশে আছে ছায়ার মতো। আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো মায়রার 'দিবাশা' নামে একটা ছোট্ট দাতব্য সংস্থায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আয়ানই ব্যবস্থা করে দিয়েছে অবশ্য। কাজের প্রেশার কম। ফিল্ডে কাজ করতে হয় না মায়রাকে। মায়রা ঘরে বসেই ফিল্ড অফিসারদের আনা তথ্যগুলোর ভিত্তিতে কি করতে হবে সেটার সাজেশন দেয়। আর কেইস হিস্ট্রিগুলো রেকর্ড করে রাখে। এই কাজে আরো তিনজন মানুষ তাদের বিজ্ঞ মতামত দিয়ে মায়রাকে সাহায্য করে। মানুষ তিনজন আরো কেউ নয়, আয়ান আর মায়রার শ্বশুর শাশুড়ী। এসব খুঁটিনাটি কাজেই সারাদিন আয়ান মায়রার এই ছোট্ট টোনাটুনির সংসারটা মেতে আছে। 

আরেকদিন সায়নার দিন কাটছে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ মাসখানেক আগেই। আগে হলে এই সময়টার জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করতো সায়না। কখন পরীক্ষাটা শেষ হবে  আর কখন আয়ানদের বাড়িতে গিয়ে উঠবে। নিজের বাড়িতেও হয়তো সায়না ততদিন থাকে নি যতদিন আয়ানদের বাড়িতে পড়ে ছিল। কিন্তু এখন? এখন ঢাকা শহরের এদিক ওদিক ঘুরেই দিন কাটছে সায়নার। আজ মিউজিয়ামে যাচ্ছে,  তো কাল পার্কে। একই জায়গা বারবার দেখে দেখে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে গেছে সায়না নিজেই। তবু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। বাড়ি ফিরলে হয়তো বেহায়া মনটা আবার আয়ানের কাছেই ঘুরঘুর করবে। তাই সায়না পণ করেছে যত কষ্টই হোক এবারের ছুটিটা সায়না বাড়ি কিছুতেই যাবে না। 

আজও সারা সকাল ঘুমিয়ে কাটিয়ে বিকেলে ৩ টার দিকে বাসা থেকে মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সায়না। জাতীয় জাদুঘরের এতো এতো গ্যালারি ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার অবস্থা সায়নার। সময় কোথা দিয়ে উড়ে গেছে সায়না যেন টেরই পায় নি। কয়েকটা গ্যালারি ঘুরে দেখতে দেখতেই কখন যে মিউজিয়াম বন্ধের সময় হয়ে প্রায় পুরো মিউজিয়ামটা কখন ফাঁকা হয়ে গেছে সেটাও একদম টের পায়নি সায়না। ও নিজের মতো এদিক ওদিক ঘুরে গ্যালারির কালেকশন দেখায় বিভোর হয়ে পড়েছে একেবারেই। মিউজিয়ামের সিকিউরিটি গার্ডের ডাকে যখন হুঁশ ফিরে সায়নার বেচারি পুরোই লজ্জায় লাল হয়ে যায়। নিজের দেশের ইতিহাসের পাতায় এতোটাই হারিয়ে গিয়েছিল যে সময়ের হিসাবটাই ভুলে গেছে। সায়না মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আশপাশটা দেখায় মন দিলো। এই এরিয়াটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে সায়নার। আশেপাশের জায়গা ঘুরতে ঘুরতে ঢাকার বুকে অন্ধকার নেমে এলো। সায়নাও সেই অন্ধকারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই এগিয়ে যেতে লাগলো পথ ধরে। আজকের এই উদ্দেশ্যহীন যাত্রাটা সায়নার খুব বেশিই মন ধরেছে। মনটা যেমন ফুরফুরে হয়ে গেছে, তেমনি বুকের কোণে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলোও যেন ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। সম্ভবত এটাই প্রকৃতির হিলিং পাওয়ার (Heeling power)।

অন্ধকার রাস্তার উদ্দেশ্যহীন এই যাত্রায় কতোটা সময় পেরিয়ে গেছে সায়না টের পায়নি একদমই। যখন বুঝতে পারলো ঢাকার মতো ভিড়ভাড় নগরীতে একলা এভাবে বের হয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ানোটা ঠিক হচ্ছে না ততক্ষণে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। নিজেকে নিজেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে সায়নার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা খালি ট্যাক্সি আসছে দেখে সেটাকেই হাতের ইশারায় থামতে বললো। ট্যাক্সিটা থামতেই সায়না সেটায় উঠে বাসার ঠিকানাটা বলতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। সায়না জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগলো। শহরের এই কোলাহল, অন্ধকার আজ ওকে এতো কেন টানছে সেটাই বুঝতে পারছে না সায়না। একদম একা এই কোলাহলে ভরা ঢাকা শহরটাকে এর আগে কখনো দেখে নি বলে? নাকি নিজের একাকিত্বটাকে উপভোগ করছে বলে? পাশ দিয়ে শা শা করে কতো গাড়ি চলে যাচ্ছে। সবার একটা ঠিকানায় পৌঁছানোর তাড়া আছে। কেউ তাই কারো দিকে তাকানোর সময় পায় না। হয়তো সায়নার তাড়া নেই বলেই সায়না সবাইকে দেখছে। ঠিক দেখছে না গাড়ি ক্রস করে যাওয়ার এই মিলি সেকেন্ডে যতটুকু সময় পাওয়া যায় সেই সময়টায় একেবারে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। কাজটা মোটেই সহজ নয়। শা করে পেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দেখা জিনিস বা মানুষটাও যেন স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। 

এর মধ্যে কিছু একটা অদ্ভুত মনে হলো সায়নার। সায়নার ট্যাক্সিটা রাস্তার উপরে পার্ক করে রাখা একটা গাড়ি ক্রস করার সময় একটা লোককে দেখে চোখ আর মন দুটোই যেন মূহুর্তের জন্য সেখানেই আটকে গেছে সায়নার। কিছুতেই লোকটা কে সেটা মনে করতে পারছে না। সোজা হয়ে বসে পিছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো সায়না। লোকটা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ। এবারে কেমন ত্রস্ত হয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। আসছে সায়নার গাড়ির পিছনেই। হয়তো তারও কোথাও যাওয়ার তাড়া  আছে। কিন্তু লোকটাকে এতো চেনাচেনা কেন লাগছে? কে এই লোকটা!

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে জানলা থেকে সরে সিটে বসেছিল সায়না। হঠাৎ দমকা একটা বাতাসে সায়নার ওড়নাটা একটু সরে এসে ওর নিজেরই মুখের উপরে এসে পড়ে। সায়না বিরক্ত হয়ে মুখের উপর থেকে ওড়না সরানোর সময় কেন জানি ট্যাক্সির ড্রাইভারের দিকে নজর পড়ে। লোকটা যে লুকিং গ্লাস দিয়ে ওর দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সেটাও সায়না মূহুর্তেই টের পেয়ে যায়। কেন জানি একটু ভয় লাগতে শুরু হয় সায়নার। ওড়নাটা গায়ে আবার ঠিক করে পড়ে আশেপাশে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে সায়না। এতোক্ষণে মেয়েটা ভালোমতোই টের পেয়েছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। তাই বাসায় পৌঁছাতে এতোটা সময় লাগারও কথা না। কথাটা চিন্তা করতেই ভয়ে প্রায় গলা শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো সায়নার। সায়না আরেবার আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ট্যাক্সিটা অনেক স্পিডে চলছে। এতো স্পিডে চলা গাড়ি থেকে হুট করে নেমে যাওয়াও সম্ভব নয়। 

-গাড়িটা সাইড করুন তো একটু? আমি নামবো এখানে--।

-এখানে নামা যাবে না ম্যাডাম। আর আপনার বাসা আসতে দেরি আছে আরো।

-আমি কোথায় নামবো সেটা কি আপনি ঠিক করে দিবেন? বলছি না গাড়ি থামান?

-বেশি ক্যাটক্যাট করবেন না ম্যাডাম। ক্যাটক্যাট শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। আর এখন গাড়ি থামবে না। জায়গা মতো গিয়ে গাড়ি থামানো হবে। ততক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন।

-বলছি গাড়িটা থামান। নইলে আমি চিৎকার করবো---।

-করেন। কে মানা করসে? গাড়ি থামবে না। আর কোওপারেট করলে আপনারই সুবিধা। বেশি ঝামেলা করে নিজের বিপদ ডাকবেন না ম্যাডাম। আগেই বলে দিচ্ছি---।

পাশ দিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছে দেখে সায়না খোলা জানলা দিয়ে হাত বের করার চেষ্টা করলো। যত জোরে চিৎকার করা সম্ভব ততটাই জোর দিয়ে একটা শব্দই বলার চেষ্টা করলো সায়না। 

-হেল্প----।

কিন্তু এতো এতো গাড়ির হর্নের ভিড়ে সায়নার কাতর সাহায্যের আবেদনটা হয়তো গাড়িতে থাকা মানুষটার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। লোকটা একবার অবাক চোখে তাকাতেই সায়নাও মানুষটাকে দেখে চমকে উঠলো। সায়না কয়েক সেকেন্ড চমকে লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে সব যেন ভুলে গেল। আবার সেই লোকটা! কে সে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই গাড়িটা ওদের ট্যাক্সিকে ক্রস করে সামনে এগিয়ে গেল। সায়না এতোটা অবাক হয়ে গিয়েছিল যে বোকার মতো বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ বিশ্রি একটা হাসির শব্দে সায়না চমকে উঠলো। ট্যাক্সির ড্রাইভার বিশ্রি শব্দে হেসে উঠেছে।

-এই ব্যস্ত শহরে কে আপনার আওয়াজ শুনবে ম্যাডাম? আর শুনলেও কে ই বা এগিয়ে আসবে? ধরেন কেউ যদি আসেও সে ও আপনাকে বাঁচাতে নয়, ভাগ বসাতেই আসবে---। তাই অহেতুক নিজের এনার্জির অপচয় না করে রিল্যাক্স করুন। আমাকে বিরক্ত না করলে আপনারও কষ্টটা কম হবে। অহেতুক নাটক আর নাচানাচি না করে চুপচাপ বসেন---। চলে এসেছি আমরা ডেস্টিনেশনে। 

কথাটা শেষ করেই লোকটা আবার বিশ্রি শব্দে হা হা করে হেসে উঠলো। আর সেই হাসিটা সায়নার আত্মাটাও যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে। গাড়িটার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বের হওয়া যায় কিনা একবার দেখার চেষ্টা করলো সায়না। দরজাটাও লক করা দেখে শেষ আশাটাও যেন নিমিষেই হারিয়ে গেল মেয়েটার। গাড়িটা মেইন রোড থেকে হুট করে একটা গলির অন্ধকার রাস্তায় বাঁক নেয়ার সায়না প্রায় ছিটকে অপর পাশের দরজার সাথে ধাক্কা খেল। মাথায় এতো জোরে আঘাত পেয়েছে যে সামনে সবকিছু ধীরে ধীরে অন্ধকার হতে শুরু করেছে সায়নার। অবচেতন হওয়ার আগ মূহুর্তেও সায়না যেন টের পেল ট্যাক্সিটা হঠাৎ আবার ব্রেক করেছে। ড্রাইভার কিছু একটা বলছে না জানি কাকে বিড়বিড় করে গালাগালি করতে করতে খচমচ করে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসছে। ভয়, আতঙ্ক আর ব্যথা-সব মিলিয়ে সেকেন্ডের মাঝেই সায়নার চোখের সামনে নেমে এলো ঘোর আঁধার। এই অন্ধকারটা মেয়েটাকে জীবনের শেষ মূহুর্তে নিয়ে ফেলবে কি না কে জানে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন