সবুজ কাজলের কৌটো - পর্ব ০৭ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৩!! 

তাথৈ জোর করে মায়রাকে স্টেজে নিয়ে বসিয়ে দিল। মায়রা চারপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজছে কাউকে। এতো পরিচিত মুখের মাঝেও একজনের কাঙ্ক্ষিত মুখটা খুঁজে পাচ্ছে না।৷ অথচ সমস্ত ইন্দ্রিয় মানুষটার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে বারবার। এর মাঝে তাথৈ কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করে নি মায়রা।

-এতো খুঁজে লাভ নেই--। আজকে সে তোমার সামনে আসতে পারবে না বোনু-।

মায়রা তাথৈয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।।

-ভাইয়া আর তুমি দুজনেই এখানে!! আঙ্কেল আন্টিও এখানে!! ওই বাড়িতে কে তাহলে??

তাথৈ জবাব না দিয়ে হেসে বেরিয়ে গেল। এই মেয়েটার এই এক সমস্যা। সব সময় তার রসিকতা করার মুডে থাকা চাই!! আশ্চর্য!! কথার উত্তর না দিয়ে চলে যায়! কোন ধরনের ভদ্রতা এটা!! মায়রা বিরক্ত হয়ে বসে আছে। একটু পরেই হলুদ লাগানো শুরু হবে।। এর পরে মেহেদী।। মানুষটা কাছাকাছি কোথাও আছে-অথচ দেখা হবে না!! ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছে না মায়রা। 

হাতে কারো আলতো স্পর্শ পেল মায়রা। সাথে পেস্টের মতো কিছু একটা ঠান্ডা অনুভূতি তৈরি করছে।। চট করে পাশে তাকাল মায়রা। মাঝারি পুরুত্বের একটা পর্দা টাঙানো মায়রার পাশে। এটা এতোক্ষণ ছিল না। পর্দার অপর পাশের মানুষটাকে আবছা দেখা যাচ্ছে।। এই আবছায়াতেও মায়রা বেশ ভালোই মানুষটাকে চিনতে পারছে। 

-গায়ে হলুদের প্রথম হলুদের ছোঁয়াটা নাহয় আমিই দিলাম--।। 

অভিমানে মায়রার গলা দিয়ে একটা কথাও বের হলো না। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

-পিচ্চি, সরি??? এই দেখো কান ধরছি--।

--------------------

-এই বউটা?? তাকাও না প্লিজ???

-বলুন।।

-রাগ করে আছে আমার পাগলীটা?? সরি তো--??

-না--।। তা আপনি এখানে কেন!! 

-পরীটার ছবির চেয়ে সামনে থেকে আরো বেশি ভালো লাগবে দেখতে--।। তাই--আরকি চলে এলাম---।।

-ওওওও।

-সরি পরীটা--।। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম আমার পিচ্চি পরী বউটাকে-।। পরী বউটা যে এতো রেগে যাবে সেটা তো ভাবি নি---।।

-আচ্ছা--।। অসম্ভব ভালো সারপ্রাইজ পেয়েছি।। আরো কিছু বাকি আছে?? প্রস্তুতি নিতে হবে তো--!?

-আচ্ছা বাবা সরি তো।। আর হবে না--।

-------------------

-আর তোমার বোনটার খবর আমি পরে নিচ্ছি--।৷ মাঝে ইয়া বড় এই পর্দা দিয়ে দিসে--!! তোমাকে ভালো করে দেখতেও পারছি না---।। কিছু বলো না ওকে??!!

-বেশ করেছে--।।

-বেশ করেছে না?? তোমার হিসাব পরে নিচ্ছি--।। ওয়েট করো--।।

-হুহ---।। চুপ করেন এখন।। সবাই আসছে।।

-আচ্ছা বাবা--।।চুপ।।। 

সবাই একে একে মায়রা আর আয়ানকে হলুদ মাখালো।। গায়ে হলুদের গান বাজলো। 

"হলদি বাটো-মেন্দি বাটো-। বাটো ফুলের মৌ--।। বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা----।।"

সবাই খানিক হাসাহাসি- মাতামাতি- নাচানাচি ও করলো।। বর কনেকে গোসল করিয়ে হলুদের ড্রেস পড়িয়ে আবার স্টেজে বসালো। এবার আর মাঝে পর্দাটা নেই।। আয়ানের বহু অনুরোধের পর তাথৈ সেটা সরানোর ব্যবস্থা করেছে।। এর জন্য অবশ্য আয়ান আর রিহান দুজনকেই বহু হ্যাঁপা পোহাতে হয়েছে।।

আয়ান মায়রার পাশে বসে অপলকে মায়রাকে দেখছে।। লেহেঙ্গা ছেড়ে মায়রাকে লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি পড়ানো হয়েছে।। সাথে কমপ্লিট ফুলের সাজ।। দেখতে "হলুদ পরী হলুদ পরী" লাগছে একেবারে।। অবশ্য আয়ানকেও দেখতে কম লাগছে না। হলুদ পাজামা পাঞ্জাবির সাথে হলুদ ওড়না।। দেখতে রাজকুমার লাগছে।। মায়রার হাতের কনুই পর্যন্ত ডিজাইন করে মেহেদি আঁকা হয়েছে।। আয়ানেরও হাতেও একটু মেহেদী লাগানো হয়েছে। একটু পর পর একজন অন্য জনকে দেখছে।৷ চোখাচোখি হতেই মায়রা লজ্জা পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেও আয়ান অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েই আছে।। একটা মানুষকে এতোটা স্নিগ্ধ কি করে লাগতে পারে!! মুখটায় কিসের এতো মায়া মেয়েটার!!??

আশেপাশে কি হচ্ছে আয়ানের সেদিকে খেয়াল নেই। একটা কথায় হুঁশ ফিরতেই সামনে তাকিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আয়ান।। আজকের দিনে এই মানুষটা এখানে আসবে কল্পনাও করতে পারে নি আয়ান।।

-হ্যালো মিস্টার আয়ান? কংগ্রাচুলেশনস। বিজয়ের এই মাসে যে কেউ নিজের পায়ে শিকল পড়াতে পারে সেটা আমার জানাই ছিল না। বাই দা ওয়ে-।। শিকল মোবারক হোক আপনার--।। 

আয়ান থতমত খেয়েই দাঁড়িয়ে রইল।। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে খুশি হবে নাকি অবাক হবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না বেচারা।। মায়রাও মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে আয়ানের মতো অবাক চোখে নয়। মেয়েটা অসাধারণ রূপবতী-সে ব্যাপারে মায়রার কোন সন্দেহ নেই।। কিন্তু তার বলা কথাগুলো একটুও পছন্দ হয়নি বলেই হয়তো- মেয়েটাকে একদম ভালো লাগছে না মায়রার। মায়রা মেয়েটাকে আরো একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো।

ব্লাড রেড কালারের জর্জেট একটা স্টোনের কাজ করা শাড়ি পড়নে। ভারি মেকাপের সাথে রেড পার্লের হালকা গয়না। চোখে মোটা করে আই লাইনার- আই শেডোর ফাঁকে মায়া মায়া এক জোড়া চোখ। ঠোঁট টকটকে লাল লিপস্টিকে রাঙা। দেখতে হিন্দি ফিল্মের হিরোয়িনের মতো লাগছে। কিন্তু মেয়েটা কে!!?? আয়ানের পরিচিত কেউ!!?? কে হতে পারে!!?? 

-মায়রা-ইনি হলেন আমাদের কোম্পানির এম.ডি মিস আরিশা ম্যাম--।। আর ম্যাম আমার ওয়াইফ-মায়রা--।।

-হ্যালো মিসেস সরি উড বি মিসেস মায়রা আয়ান চৌধুরী।।আমি আরিশা তাহনুমা চৌধুরী। পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো-।

-আমারও ভিষণ ভালো লাগলো--।।

-ম্যাম--। আপনি আমার গায়ে হলুদে আসবেন আমি কল্পনাও করতে পারি নি।

-ওহ কাম ওন-মিস্টার আয়ান--। আপনি আমাদের অফিসের ইম্পর্ট্যান্ট এ্যান্ড হার্ড ওয়ার্কার ইমপ্লোয়ি--।। আপনার বিয়ের সবকটা অনুষ্ঠানে তো আমার আসতেই হয়--।।

মায়রা একটু হেসে ব্যাপরটা সায় দিলেও বিরক্ত লাগছে আরিশার কথায়।। হাত ভর্তি করে মেহেদি আঁকা ওর। তার উপরে ওর নিজের গায়ে হলুদ। কোথাও যেতেও পারছে না।। আর এদিকে এই মেয়ের সামনে থাকতেও পারছে না আর।। সব মিলিয়ে অসহ্য লাগছে।। সবচেয়ে বেশি অসহ্য লাগছে আয়ানকে। এই মেয়ের সাথে এতো হেসে হেসে কথা বলার কি আছে!!??

আয়ান আরিশার সাথে বললেও মায়রার বিরক্তি ঠিকই খেয়াল করছে। পিচ্চি মেয়েটা কি জেলাস ফিল করছে!!?? আরিশা ওদেরকে আরো একবার শুভেচ্ছা জানিয়ে অায়ানের অন্য অফিস কলিগদের সাথে কথা বলতে চলে গেল।। আয়ান আবার গিয়ে মায়রার পাশে এসে বসেছে।। মায়রার মুখ লাল হয়ে আছে দেখে আয়ান হেসে ফেলল।।

-পিচ্চি?? ম্যাডাম কি বলেছে শুনেছো?? আমার নাকি এতো কম বয়সে পায়ে শিকল পড়া মোটেও ঠিক হয়নি---।।আর তুমি তো এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে--।।

-তো আপনার ম্যাডামকে গিয়েই বিয়ে করুন না যান---??!

-সত্যি করবো?? উমম--।  তুমি অনুমতি দিলে অবশ্য করতেই পারি--।।

-করেন--।। এতো শখ যখন--কাল আমার জায়গায় উনাকেই বিয়ে করেন--। আমি তো বাচ্চা মেয়ে--।। আমাকে বিয়ে করতে হবে না আপনাকে--।।

মায়রা গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। আর আয়ান ওর মিষ্টি রাগে লাল মুখটা দেখে মজা পেয়ে হাসছে।। দূরে বসে ওদের দুজনের মান অভিমানের খেলাটা কেউ খেয়াল করছে ভালো করে।।

মেহেদির অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত ২ টা মতো বাজলো।। এর মধ্যে মায়রার মেহেদীর চড়া রঙ নিয়ে প্রবীণ আত্মীয়রা কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করলো।। রিহান আর তাথৈ-মায়রার কাজিনরা বেশ হুল্লোড় করে আয়ানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উপহারের ভ্যাট নিলো।। আরিশা আর বাকিরা একে একে চলে গেলো বিদায় নিয়ে।। মায়রাও গাল ফুলিয়ে নিজের রুমে এসে বসলো।।

এই লোকটা পেয়েছেটা কি!?যখন ইচ্ছে ধুম করে আসবে ধুম করে গায়েব হবে। যখন ইচ্ছে এটা ওটা বলবে!! আর ম্যাডামকে বিয়ে করা না?? করো বিয়ে-।। আমি আর থাকবোই না--।। মায়রা মাথা নিচু করে খাটে বসে একমনে এসব ভাবছে। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু করে জমা অভিমানগুলো কান্নায় রূপ নিচ্ছে। 

হঠাৎই পায়ের উপর থেকে শাড়িটা একটু সরে যেতে তাড়াতাড়ি চোখ মুখে তাকাল মায়রা।। পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ অনুভব করতে পারছে।। সেটা পাত্তা না দিয়ে মায়রা আয়ানকেই দেখছে। মাথা নিচু করে নিজের কাজেই মগ্ন আয়ান। হাতটা একটু কেঁপে উঠছে থেকে থেকে।।

-কি করছো তুমি??

-রাগ করে আছো এখনো??

--------------------------

-আচ্ছা বলতে হবে না--।। দেখো তো কেমন লাগছে?? পছন্দ হয়েছে??

মায়রা পায়ের দিকে তাকালো।। এক জোড়া ঝলমলে রূপার  ভারি নূপুর।। মায়রা পা নাড়িয়ে ঝুমঝুম শব্দ করে হেসে ফেললো।। আয়ান মায়রার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খাটে বসে মায়রাকে বুকে টেনে নিল।।

-তোমার পায়ে শিকল পড়ালাম ছোট্ট পরী---।।যেন কখনো পালাতে না পারো রাগ করে--।। যতোবার আমার থেকে দূরে যেতে চাইবে-ততোবার আমি আষ্টেপৃষ্টে তোমাকে জড়িয়ে রাখবো এমন করে---।।

আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।। আর মায়রা অবাক হয়ে আয়ানের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলো।। কি হলো চিন্তা করতে করতেই ক্লান্তিতে দু চোখ ভেঙে ঘুম নেমে এলো ওর। 

১৪!! 

বেশ বেলা করেই মায়রার ঘুম ভাঙল। ঘুমের ঘোরে চোখ খুলতেই পারছে না। আধো আধো চোখ খুলেই নিজের মেহেদী রাঙা হাতটা দেখে হেসে ফেলল মায়রা। হাতে অদ্ভুত সুন্দর রঙ ধরেছে মেহেদীর। পা খাট থেকে নিচে নামাতেই রুনুঝুনু শব্দে একটু চমকে উঠলো মায়রা। পায়ের নূপুর জোড়ার কথাও মনে পড়লো। সেই সাথে আয়ানের পাগলামির কথাও। এই মানুষটাকে কতো যে জ্বালায় সে!! তবু মানুষটা একটুও রাগ করে না। বাচ্চা মেয়ের মতো সবসময় সামলায়। আয়ানের কথা মনে হতেই মুখে মিষ্টি একটা হাসি ফুটলো মায়রার।

ফ্রেশ হয়ে গোসল সেরে এসে খাটের উপর একটা চিরকুট পেল মায়রা। সাথে কয়েকটা শপিং ব্যাগ।। চিরকুটটা হাতে নিল মায়রা। নিয়েই হেসে ফেলল৷ এই কাজটা আয়ানের। খুব ভালো করেই জানে মায়রা।

" নাস্তা করে আস্তেধীরে রেডি হও ডিয়ার পিচ্চি--। একেবারে বরযাত্রী নিয়েই তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে আসবো---।"

হাতে চিরকুট নিয়ে হাসছে মায়রা। এর মধ্যে রুমে কয়েকটা মেয়ে ঢুকলো।। তাথৈও সাথে এসেছে।।

-তোর বর তোকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে মেয়েও পাঠিয়ে দিয়েছে- আর তুই এখনো খাস ই নি কিছু--।। উনারা নাস্তা করতে করতে খেয়ে আয় যা---।।

-আপ্পি----???

-তোর জন্য আমি আবার বকা খেতাম! ইম্পসিবল!! যা খেয়ে আয়---। আচ্ছা খাবার এনে দিচ্ছি--।। এখানেই খেয়ে নে।

এদের দুজনকে নিয়ে এই এক অশান্তিতে আছে মায়রা।। একজন বলে খালাস- আর একজন করবে জুলুম।। বিয়ের নার্ভাসনেসের মধ্যে খাওয়া যায় কিছু!! বুঝে না কেন এরা!! মনে মনে বিড়বিড় করে বকা দিয়ে নাস্তা করে নিলো মায়রা। তারপর শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলো। বিয়ের বেনারসি!! গোল্ডেন সুতায় পান পাতা ছাপানো টকটকে লাল বেনারসি। লাল ভারি কাতানের ব্লাউজ।ব্লাড রেড কালারের কনের ওড়না। ওড়নাটার চারপাশে মোটা করে গোল্ডেন লেইসের কাজ। মায়রা শাড়িটা গায়ের উপর টেনে আয়নায় নিজেকে দেখলো।। তাথৈ আর পার্লারের মেয়েগুলো মায়রাকে অবাক চোখে দেখছে।মায়রা লাজুক হেসে বেনারসিটা নিজেই পড়ে নিল।। বেনারসিটা পড়ে আসার পর মায়রাকে কোন সাজ ছাড়াই লাল পরী লাল পরী লাগছে।

টুকটুকে লাল বেনারসির সাথে তাথৈ মায়রাকে হাতে বালা,পাঞ্জা, হাতপদ্ম, মান্তাসা পড়িয়ে দিয়েছে। আঙুলে আংটি।।গলায় সীতাহার, পাতিহার। কোমড়ে বিছা হার।। নাকে নথ।। কানে ঝুল ঝুমকো। পাফ করে আধো ফুলানো চুলে গোল্ডের টিকলি আর টায়রা।। 

পার্লারের মেয়েরাও খুব যত্ন করে মায়রাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পাফ করে আলতো করে ফুলিয়ে খোঁপা করেছে কেউ।। কেউ আবার মোটা করে আইলাইনার আর কাজল দিয়ে মায়রার চোখ সাজাতে ব্যস্ত।। ঠোঁটে টকটকে লাল ম্যাট লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁটের কাজটা ভালো করে ফুটিয়ে ট্যাডিশনাল একটা লুক দিল।। মায়রা আয়নায় নিজেকে দেখলো।। কপালে কুমকুম টিপের ফোঁটাগুলো অসম্ভব ভালো লাগছে ওর। কুমকুম টিপের ফোঁটার মাঝে টকটকে লাল টিপ।।সেটাতেও বহু কারিগরি করা।। নিজেকে চিনতেই হিমশিম খাচ্ছে মায়রা। সাজতে মায়রা বরাবরই খুব একটা পছন্দ করে না। তবে আজকের এই ভারি মেকাপ- এতো এতো ফাউন্ডেশন- পাউডার- কাজল- কুমকুম-সবই বেশ লাগছে মায়রার।।মেহেদী রাঙা হাতের সদা স্বচ্ছ নখে আজ টকটকে লাল নেইলপালিশটাও বেশ লাগছে ওর এখন।। আসলেই বিয়ের অনুভূতিটাই আলাদা। 

খোঁপা বাঁধা চুলে খোঁপার জালি পড়িয়ে বেলি ফুলের গাজরা পড়ালো।। তারপর কনের ওড়নাটা মাথার উপরে দিয়ে সাজটা কমপ্লিট করলো মেয়েগুলো।। মায়রার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে পার্লারের মেয়েগুলো বিদায় নিলো।। সাজ হতে বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগেছে। এখন কেবল অপেক্ষা।। কারো আসার।।। 

আলাদা করে স্টেজ করা হয়নি। আজও স্টেজটা একসাথে।। বরযাত্রী এলেই মায়রাকে স্টেজে নেয়ার কথা। কিন্তু সবাই মিলে আগে আগেই মায়রাকে স্টেজে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। কাজটা তাথৈয়ের।৷ মায়রা তাথৈকে মনে মনে একশটা বকা দিতে দিতেই স্টেজের আলোটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেলো। মায়রা বেচারি ঢোক গিলে চিন্তা করলো-এটাই বাকি ছিলো?!!

সবাই লাইটের কি হলো দেখার জন্য ছুটোছুটি করে যে যার মতো চলে গেল।।দিনের বেলাতেও সবকিছু এতো অন্ধকার!!! কেমনে কি!!?? মায়রা আশেপাশে অন্ধকারে তাকিয়ে না তাথৈকে দেখতে পেল-না অন্য কাউকে।। হচ্ছেটা কি!!! বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো মায়রা।। এভাবে গাধার মতো একলা বসে থাকার কোন মানে আছে??! উঠে দাঁড়িয়েছে মায়রা এমন সময় আলতো করে একটা লাইট জ্বলে উঠলো।। তার পরে ভেসে এলো কারো কণ্ঠস্বরঃ-

"Aisa lagta hai kyun
Teri aankhen jaise
Aankhon mein meri reh gayi

Kabhi pehle maine na suni
Aisi baatein keh gayi

Tu hi tu hai jo har taraf mere
Toh tujhse pare main jaaun kahan
Mere dil mubarak ho
Yahi toh pyar hai
Ae mere dil mubarak ho
Yahi toh pyar hai
Jahan pehle pehal tu aa mila tha
Thehra hoon wahin main bhi
Tera dil woh shehar hai
Jis shehar se jaake lauta na main kabhi
Laapata sa mil jaaun kahin toh
Mujhse bhi mujhe mila de zara
Ae mere dil mubarak ho
Yahi toh pyar hai
Ae mere dil mubarak ho
Yahi toh pyar hai

Ishq mubarak, rang mubarak
Ishq mubarak, rang mubarak
Ishq mubarak, rang mubarak
Ishq mubarahai,rang mubarak
Ishq mubarak..."

কণ্ঠস্বরটা মায়রার পরিচিত। মায়রা মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে কখন যে লাইটের আলোর মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করে নি।। আলতো করে কেউ মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। মায়রা চোখ বন্ধ করে মানুষটার স্পর্শ অনুভব করলো। এই স্পর্শটা ওর পরিচিত। এই মিষ্টি গন্ধটাও ওর পরিচিত।৷ 

চোখ খুলে মায়রা আয়ানের দিকে তাকালো। গোল্ডেন কালারের ভারি শেরোয়ানি, গোল্ডেন পাজামা, পার্লের কাজ করা পাগড়ি, নাগাড়া, চাদরের মতো করে ওড়না, হাতে রাখি, গলায় জরির মালা-- সব মিলিয়ে আয়ানকে ঠাকুরমার ঝুলির কোন এক অচীন দেশের রাজকুমারের মতো লাগছে।। 

আর এদিকে আয়ানও মায়রাকে অপলকে দেখে যাচ্ছে।। টকটকে লাল রঙের বেনারসি আর বিয়ের ট্যাডিশনাল সাজে মায়রাকে লাল পরী লাগছে।। 

দুজনেরই ঘোর ভাঙলো পাশের ঝুম করতালির শব্দে।। মায়রাকে আলতো করে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরেই স্টেজে নিয়ে বসালো আয়ান। দুজন দুজনকে একটু পর পর দেখছে। আর সেটা নিয়ে ওদের কাজিনরা বেশ হাসাহাসিও করছে। 

বিয়ের যাবতীয় নিয়ম কানুন-আচার-অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বিকেল হলো। প্রিয় মানুষটাকে আজীবনের জন্য নিজের করে পেতে 'কবুল' নামক ছোট্ট শব্দটা বলতে আয়ান আর মায়রা দুজনেরই গলাটা কেঁপে উঠলো একটু। কবুল পর্ব শেষে রেজিস্ট্রি হলো।। তারপর পান-চিনির অনুষ্ঠান।। বেশ মাতামাতি করেই ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা শেষ হলো।। তারপর এলো খাওয়া দাওয়ার পর্ব।। সেই কখন খাওয়া দাওয়া হয়েছে খেয়ালই নেই কারো।। খাওয়া দাওয়ার পর বর আর কনে পক্ষের নাচ-গানের ছোট্ট আয়োজন। 

সুন্দর কাঠ বেলি আর নীল অর্কিড ফুলে সাজানো গাড়িতে শ্বশুড়বাড়িতে রওনা হলো মায়রা। রিহান ড্রাইভিং করছে। তার পাশে তাথৈ। আর পিছনের সিটে মায়রা আর আয়ান। আজকের দিনটা মায়রার জন্য সবচেয়ে খুশির দিন।। প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ তার আজ। তবু এতো খুশির মধ্যেও অশ্রু বিন্দুগুলো কি কারণে কে জানে বারবার বাঁধ ভাঙছে। এতো কান্নাকাটির কিছু হয় নি-সেটা মায়রা জানে।৷ তবু কাঁদছে। হু হু করছে বুকের ভেতরটা। কিসের যেন একটা শূন্যতা কাজ করছে ভিতরে। অনুভূতিটা বুঝতে পারছে না মায়রা। গাড়ি নিজের গতিতে চলছে। আর মায়রা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চোখের পানিগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।

আয়ানও চুপ করে মায়রার হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছে। মায়রার কান্নার কারণটা তার কাছে স্পষ্ট নয়-কিন্তু কাঁদতে বাঁধও সাধলো না আয়ান। একটু পর পর তাকাচ্ছে ও মায়রার দিকে। বেশ নিঃশব্দেই কাঁদছে মায়রা। একটু পর পর হেঁচকি মতো উঠছে কাঁদতে কাঁদতে। মায়রার হাতটা আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরলো আয়ান। পিচ্চিটার এক এক ফোঁটা চোখের পানি আয়ানের মনে বিষাক্ত এসিডের মতো ছাপ ফেলছে।। কি করবে সে!!??

-এই পিচ্চি?? কেঁদে কেটে পেত্নী হচ্ছো কেন!? কাজল ছড়িয়ে-----।।

মায়রা ফোঁপাতে ফোপাঁতে আয়ানের দিকে তাকাল। আয়ান অপলকে মায়রাকে দেখছে।। মায়রার কাজল ছড়িয়ে মোটেও পেত্নী পেত্নী লাগছে না। ওয়াটারপ্রুফ কাজল আইলাইনার-ছড়ানোর প্রশ্নই আসে না। মেয়েটার কান্না বন্ধ করাতেই কথাটা বলেছে আয়ান। এতো কান্নাকাটি করে মুখে লাল আভায় মায়াপরী লাগছে মায়রাকে আয়ানের কাছে।।

আয়ানদের নতুন বাসায় আসতে অনেকটা সময় লেগেছে। বাসাটা বাইরে থেকে বেশ সুন্দর করে লাইটিং করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। কয়েকজন মানুষ আছে কেবল বাসায়।। এদেরকে মায়রা চিনে না। তবে দেখে মনে হচ্ছে এরা মায়রাদের আসার অপেক্ষা করছিল এতোক্ষণ।। মায়রার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামালো আয়ান। তারপর দুজনে বাসায় ঢুকলো।। ওদের পিছন পিছন তাথৈ আর রিহানও ঢুকলো বাসায়। বাসার বাকি মানুষগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আয়ান। মিনু, ১৪-১৫ বছরের কিশোরী মেয়েটা- ওদের বাসায় থাকবে আর টুকিটাকি কাজে মায়রাকে হেল্প করবে।। দারোয়ানের কাজ করবেন পঞ্চাশোর্ধ করিম চাচা। আর ২০-২১ বছরের  ড্রাইভার নিয়াজ।।

মিনু মায়রা আর তাথৈকে রুমে নিয়ে গেল। এই ভারি মেকাপ উঠানো মায়রার একার কর্ম নয়।। আর এদিকে আয়ান আর রিহান বসে ড্রইংরুমে গল্প করছে। তাথৈ আর রিহানরা থাকবে রাতে। বাসাটা নতুন করে ঘোছাতে আয়ানের বেশ অনেকদিন লেগেছে। তবে যতটা সম্ভব মায়রার পছন্দ মতো করে সাজানোর চেষ্টা করেছে। মায়রার মনে হচ্ছে বাসাটা যেন ওদের বাসার ডুপ্লিকেট কপি।। এখানে নতুন করে নতুন সংসার শুরু করবে-ভাবতেই মায়রার বেশ লাগছে। আয়ানেরও বেশ লাগছে নতুন সংসার নিয়ে ভাবতে। যে মানুষটাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে সে মানুষটা আজ থেকে তার প্রতিদিনকার সাথী হয়ে থাকবে আজীবন। ব্যাপারটা যে কি পরিমাণ আনন্দের সেটা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না সে।। 

এভাবেই চলছে আয়ান আর মায়রার জীবন।। বেশ অনেক গুলো দিন কেটেছে ওদের একসাথে। মায়রার ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে।। আর আয়ানের বেড়েছে অফিসের দায়িত্ব। ক্লাস করে বাসায় ফিরে মায়রার কাজ আয়ানের জন্য অপেক্ষা করা। আর আয়ান?? কাজের চাপে প্রায় সবকটা দিনেই তার ফিরতে দেরি হয়৷ শুক্র শনি বন্ধের দিনগুলোতেও তার সময় কাটে অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে। আয়ান কর্মনিষ্ঠ- অনেস্ট ছেলে-তাই প্রোমোশন যেমন জলদি হয়েছে-তেমনি বেড়েছে দায়িত্বও। মায়রা সেটা বোঝে-। আর বোঝে বলেই অনেক রাত হলেও আয়ানের জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকে।। বসে থাকতে থাকতে কখন যে ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে তার আর হুঁশ থাকে না। অবশ্য প্রতিদিন সকালে চোখ খুলে যখন নিজেকে খাটে আবিষ্কার করে তখন অভিমানটা গলে যায়। আর একটা ছোট্ট চিরকুট- সমস্ত মন খারাপটাকেও নিমিষেই হাওয়া করে দেয়।। ছোট্ট একটা চিরকুট-।

" সরি মনি, কালও রাত হয়ে গেছে অনেক। আর এখনো তোমার ঘুমের মায়া মুখটা দেখে আর জাগাতে ইচ্ছে করছে না। আজকে পাক্কা তাড়াতাড়ি আসবো।। লাভ ইউ পাগলীটা।।"

চিরকুটটা শক্ত করে ধরে মিটিমিটি হেসে সেটা বারবার পড়তে ভালো লাগে মায়রার। মানুষটা আজকেও হয়তো অনেক রাত করে ফিরবে। আর সকালে উঠেই আবার বেরিয়ে পড়বে।। তবুও মায়রা জানে দিন শেষে মানুষটা শুধু তার। বেলা শেষে এই মানুষটার হৃদয়রাজ্যের একছত্র মালিক সে নিজেই।। তিনটে মাস দেখতে দেখতেই কেটে গেছে।। বাকি সময়টাতেও তার কেবল আয়ানকেই চাই।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন