১১!!
দেখতে দেখতে আরো দুটো মাস কেটে গেছে। এই দুইমাসে অবশ্য মায়রাকে আর সীমান্তের রাগের মুখোমুখি হতে হয় নি। কিন্তু মায়রার জীবন থেকে হাসি, আনন্দ জিনিসগুলো যেন হারিয়ে গেছে আজীবনের মতো। কেমন যেন একটা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে মায়রা৷ প্রতিদিন সকাল থেকেই রুটিন মাফিক জীবন শুরু হয় মায়রার। ঘুম ভাঙতেই উঠে ফ্রেশ হয়ে সীমান্তের জন্য নাস্তা বানানো দিয়ে দিনটা শুরু হয় মেয়েটার। আর রাতে সীমান্তের ডিনার শেষ হলে সবকিছু গুছিয়ে রাখার পর ক্লান্তিকর একটা সমাপ্তি হয় মায়রার ক্যালেন্ডার থেকে।
সীমান্ত মায়রার এই রোবটের মতো কাজকর্ম লক্ষ্য করে কিনা সেটা মায়রা বুঝতে পারে না। লোকটা কখনো লাইট জ্বালিয়ে নিজের অফিসের কাজ করে। কখনো মায়রাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। আবার কখনো নিজের মতোই ঘুমিয়ে অচেতন হয়ে থাকে। মাহিব আর তিয়া আসে মাঝে মাঝে বাসায়৷ সেই সময়টাই মায়রা একটু কথাবার্তা বলে। নয়তো কথা বলার মতো মায়রার সুযোগই হয় না। সীমান্ত বাসায় থাকলে সে নিজেই নিজের মতো বলে যায়। মায়রা শোনে, হু হা উত্তর করে। ওইটুকুই।
আজকের দিনটা ভিষণ মনটা খারাপ মায়রার৷ গতবছরও এই দিনটা একদম অন্যরকম কেটেছে মায়রার। সবার আগে আয়ানই ওকে বার্থডে উইশ করেছিল। একদম ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ১২ টা বাজে তখন ঘড়িতে। তারপরের উইশটা মামা মামির করা। মামি ওকে সুন্দর একটা কালো পাড়ের লাল সিল্কের শাড়ি গিফ্ট করেছিল। সেই শাড়ি পড়েই মায়রা আয়ানের সাথে সাগর দেখতে গিয়েছিল। কত মজাই হয়েছিল সেদিন! আর আজ? আজও মায়রার জন্মদিন। শুধু ওর জীবন থেকে ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা হারিয়ে গেছে। আর তার সাথেই হারিয়ে গেছে ওর জীবনের সব খুশি, আনন্দ, সবকিছু।
দুপুরবেলা এসব ভাবতে ভাবতেই রান্না করছিল মায়রা। একটা চুলোয় ভাত বসিয়েছে। অন্যটায় একটা তরকারি। নিজের কথা ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল ও। হঠাৎ খেয়াল হলো হাঁড়ি থেকে ভাত ছিটকে বাইরে পড়ছে। একটা ভাত চেক করতেই দেখলো একটু বেশিই নরম হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে চুলো থেকে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে মাড় ঝড়াতে চেষ্টা করতেই গরম ভাতের মাড় সোজা এসে পড়লো মায়রার হাতে। মায়রা ঠোঁট কামড়ে সেটা সহ্য করে কোনমতে ভাতের হাঁড়িটা ধরে মাড় ঝড়িয়ে নিলো। তারপর হাঁড়িটা ঠিক করে রেখে হাত মেলে ধরলো বেসিনের পানির কলের ধারার নিচে। ততক্ষণে হাতটা টকটকে লাল রঙ ধারণ করেছে মায়রার। হাতের দিকে তাকিয়ে মায়রা আনমনেই হাসলো।
"কেন যে তুই নিজের অতীত ভাবতে যাস রে মায়রা? যত ভাববি তত ক্ষতিটা তোরই হবে। আজ হাত পুড়েছে, কাল শরীর পুড়বে। কিন্তু মনের পোড়ার জ্বালাটাকে তো এই সামান্য জ্বলুনিটা ঢাকতে পারে না! এটাই তোর জীবন মায়রা। মেনে নে। মেনে নে। নয়তো---।"
মায়রা ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটিয়ে কথাগুলো নিজেকেই শোনাচ্ছিল। কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারলো না। মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠলো। মায়রা এক মূহুর্ত থমকে গিয়ে ছুটে গিয়ে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো। মোবাইলটা হাতে নিয়েই মেয়েটার চোখ দিয়ে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো৷ যার কলের কথা ভেবে ছুটে এসেছিল মোবাইলের স্ক্রিনে তার নাম ভাসছে না। চোখ মুছে কণ্ঠটা একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে একটা শ্বাস টেনে মায়রা কলটা রিসিভ করলো।
-হ্যালো?
----------------------
-মামি? কথা বলবে না?
-----------------------
-ও মামনি? তোমার মেয়েটার উপরে এখনো এতো রাগ করে থাকবে?
-তুই আমার মেয়ে মায়রা? আমার মেয়ে? আমার মেয়ে হলে অন্তত আমাদেরকে নিজের মনের কথাটা বলতে পারতি না?
-মামনি?
-এখন একদম ন্যাকা কান্না কাঁদবি না মায়ু। একদম সহ্য হয় না আমার তোর কান্না। জানিস না সেটা?
----------------------
-তুই কেন এমন বোকামিটা করলি বল তো মায়রা? তোর মামা আর আমি তোর বাবা মায়ের হাতে পায়ে পর্যন্ত ধরেছি বিয়েটা না দেয়ার জন্য---। তবু তুই কি করে পারলি----!? একটা বার আমাদের কথাটা মনে হলো না তোর?
-আমি তো মাকে আয়ানের কথাটা বলেছিলাম মামনি--। মা তো শুনলোই না। আর বাবা! তার কাছে তো সীমান্ত! সীমান্ত একজন ফেরেশতা তাদের কাছে। আর ফেরেশতাকে জামাই হিসেবে পাওয়া! কম ভাগ্যের কথা তো নয়---।
-তো? তুই কেন তাদের কথা মেনে নিলি? নিজের মনের কথাটা একটা বারের জন্য আমাকে বলতি--। আমি তখনই তোকে নিয়ে আসতাম নিজের সাথে করে--। দেখতাম আমার মেয়েকে আনতে কে আটকাতো আমাকে! এতোটুকু অধিকার কি নেই আমার তোর উপরে!!
--------আমি পারি নি মামি! পারি নি। বাবা মায়ের সম্মান কথা ভেবে আমি----।
-ওরা তোর কথা ভেবেছিল? যে তুই ওদের জন্য বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলি! আর আয়ান? সেই ছেলেটার কথাও একবার ভাবলি না তুই? তোর খবর না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছিলো ছেলেটা। তোর মামার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছিল বাড়িতে যাওয়ার জন্য---। সেদিন ছেলেটা না আসলে তো----। এই নাকি তুই আমাকে মা মানিস মায়রা? নিজের জীবনের এতো বড় কথা আমার কাছেই---। বাহ!
-মামি---?
-আয়ান তো তোকে আনতেই গেছিলো তাই না? তাহলে এলি না কেন তুই ওর সাথে? একটা মানুষের এতোদিনের ভালোবাসার চেয়েও তোর কাছে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করা জরুরি মনে হলো?
-মামি আমি কি করতাম! তাথৈ আপু চলে যাওয়ায় মা বাবা----। বাবা মরে যেত মামনি--। আমি কি করে সেটা দেখতাম বলো?
-তাথৈ চলে গেছে বেশ করেছে। ও যাকে ভালোবাসে তাকে বেছে নিয়েছে। তোর মতো একজনকে ভালোবেসে আর একজনের সাথে জীবন কাটানো ও মেনে নেয় নি--। আর তুই কি ভাবিস সত্যি তোর বাবা মরে যেত! হাসালি!
-মামি--!!
-বাবার মরে যাওয়ার কথা মনে করে বিয়েটা তো করে নিলি মায়রা। কিন্তু একটা বারও ভেবেছিস যে ছেলেটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে সে কিছু একটা করে বসলে তার দায়টা কে নিবে? ভেবেছিস?
-মামি প্লিজ থামো। প্লিজ?
-শুনতে খারাপ লাগছে এখন মায়রা? বিয়ের পাঁচটা মাস কেটে গেছে। ভালোই আছিস নিশ্চয়ই তুই? কিন্তু ছেলেটা আদৌ বেঁচে আছে কিনা সেটার খোঁজ নিয়ে দেখেছিস একবারও?
-মামি!
-এই জন্যই তোর বিয়েতে আমরা কেউ ছিলাম না মায়ু। না আমি, না তোর মামা, না তোর ছোট্ট বাঁধনটা। তোকে এভাবে দেখার জন্য এতোগুলো বছর নিজের সন্তানের মতো তো আগলে রাখি নি রে মায়রা। তুই তো আমার প্রথম সন্তান রে মায়ু। পেটে ধরি নি ঠিক আছে, কিন্তু তোকে যে বাঁধনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি সেটা তো জানিস, না রে? কিন্তু দেখলি তো? আপা সেদিন কি বললো?! তোর বিষয়ে আমাদের কারো কিচ্ছু বলার অধিকার নেই। হাহ। ভালোই---।
-মামনি? শোনো না? কেঁদো না প্লিজ।
-হ্যাঁ হ্যাঁ বল মায়রা? শোনার জন্যই তো কলটা করেছি আজ। কি আর করবো বল? প্রতিবছর তো তোর বার্থডেতে তোর পছন্দের সব রান্না করতাম আমি। নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দিতাম--। এবারও বোকার মতো রান্না করে ফেলেছি। পরে মনে পড়লো। যার জন্য এসব সে তো আমাদের পর করে কবেই----।
-মামনি? কি বলছ তুমি এসব?
-নাহ।---। কিছু বলছি না তো। তা কি করছিস মায়রা? নতুন সংসার হয়েছে---। ঝুর ঝামেলা তো নেই। আবার নাকি বরকে নিয়ে ঢাকায়ও চলে গেছিস? বাব্বাহ! একেবারে তো ঝাড়া হাত পা এখন তোর। তা কি করছিস এখন?
-কি আর করবো বলো মামনি? তোমার মেয়েকে তো তুমি রান্নাবান্না কিছুই শেখাও নি--৷ তাই হাত পা পুড়ে রাঁধছি---।
-হাত পা পুড়ে রাঁধছিস মানে?
-কিছু না গো মামনি। আমার কথা ছাড়ো। তোমরা কেমন আছো? বাঁধন কোথায়? স্কুল থেকে ফিরেছে?
-আজকের দিনটা কি ও স্কুলে যায় কখনো?
----------------------
-রাখছি রে মায়রা। জন্মদিনের অনেক অনেক অনেক শুভেচ্ছা নিস। আর ভালো থাকিস---।
-হ্যাঁ মামনি। আমি ভালোই থাকবো। ভেবো না। তোমরাও ভালো-ভালো থেকো--।
-মায়রা? কি হয়েছে তোর? মায়ু? মামনিকে বল কি হয়েছে?
-কিছু-কিছু হয়নি মামনি--। তোমার সাথে এতোদিন পর কথা হলো তো---। ওহ শিট! মামনি রাখছি। আমার চুলোয় রান্না বসানো ছিল---। রাখছি রাখছি---।
মায়রার নাকে একটা পোড়া গন্ধ আসতেই কলটা কেটেই একছুটে রান্নাঘরে এলো মায়রা। তাড়াতাড়ি গ্যাসের নবটা বন্ধ করে দিয়ে ঢাকনাটা সরিয়ে দিলো। গরম ঢাকনায় হাত দিতেই আরেকবার হাত পুড়লো। সাথে ঢাকনাটাও হাত থেকে পড়ে গেল মায়রার৷ কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামালো না মায়রা৷ তরকারিটা নিচে থেকে পুড়ে একদম কালো হয়ে গেছে ভয়ে ঢোক গিললো মায়রা৷ আজকে ওর কপালে কি অপেক্ষা করছে কে জানে!
১২!!
কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। আজ মায়রার মনে হচ্ছে এই প্রবাদটা আজকের সিচুয়েশনের জন্য একদম পারফেক্ট। পুড়ে যাওয়া তরকারিটুকু থেকে উপরের খানিকটা সরিয়ে নিয়ে পোড়া হাঁড়িটা পানিতে ভিজিয়ে রেখে মায়রা ভাবছে কি রান্না করবে এখন। অবশ্য ওর নিজের জন্য রান্না করার হলে না করলেও চলতো। কিন্তু সীমান্তের কাজ না থাকলে মাঝেমাঝেই দুপুরেই বাসায় চলে আসে। আজও যদি চলে আসে! এই ভয়ে মায়রা কিছুটা তটস্থ হয়ে রইলো। মনে মনে 'আল্লাহ আল্লাহ' করছে যাতে আজকের দিনটা লোকটা দুপুরে বাসায় না আসে। অবশ্য মায়রার অন্য প্রার্থনাগুলোর মতো এই ফরিয়াদটাও সম্ভবত গ্রহণ হয়নি। সীমান্ত আজ দুপুরেই বাসায় ফিরে এসেছে।
মায়রা দরজা খুলে সীমান্তকে দেখে এতোটা থমকে গিয়েছিল যে দরজার সামনে থেকে সরতে পর্যন্ত ভুলে গেছে মেয়েটা। সীমান্ত বিরক্ত চোখে মায়রার মুখের দিকে তাকালো।
-মায়রা? দরজার সামনে এমন সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? সরো?
-জি? হ্যাঁ---। সরি---।
-তুমি আর তোমার সরি--! ও গড! সরো?
মায়রা সামনে থেকে সরে দাঁড়াতেই সীমান্ত ঢুকে গটগট করে বেডরুমের দিকে পা বাড়ালো।
-মায়রা? ভাত বাড়ো--। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে---। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি--।
-হুম--। আচ্ছা---।
খেতে বসে সীমান্ত প্লেটে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ডিম ভাজি আর একটা আধপোড়া তরকারি দেখে ভ্রু কুঁচকে মায়রার মুখের দিকে তাকালো। মায়রা পাশেই চেয়ারে বসে ভয়ে ঢোক গিললো সীমান্তের চোখে চোখ পড়তে। সীমান্ত মায়রার ভীত মুখটা দেখে একটু হেসে চুপচাপ ভাত মাখিয়ে প্রথমা লোকমা মায়রার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। সীমান্তের এমন কাজে মায়রা পুরোই বেকুব বনে গেল। অবাক হয়ে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-এই যে ম্যাডাম? কি হলো? হা করো?
-হুম?
-হা করতে বলেছি--। তাকিয়ে থাকতে না---।
মায়রা তাড়াতাড়ি হা করলো। সীমান্ত হেসে মায়রার মুখে ভাত পুরে দিয়ে নিজের অন্য লোকমা খেল। খেতে বসে সাধারণত সীমান্ত কখনোই কথা বলে না। চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায়। কিন্তু আজ লোকটার কি হলো কে জানে মায়রার সাথে সহজ গলায় কথা বললো অনেকক্ষণ। সারাদিন সে নিজে কি করেছে, মায়রা কি করেছে এসব নিয়ে সাদামাটা কথোপকথন। মায়রা ভয়ে ভয়ে চিন্তা করতে লাগলো। ভাতটা মুখে দেয়ার সাথে সাথেই তরকারির পোড়ার ব্যাপারটা বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু তবু লোকটা কিচ্ছু বলছেই না ব্যাপারটা নিয়ে। কারণটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না মায়রার। এই লোকটাকে বোঝা আসলেই ওর সাধ্যের বাইরে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সীমান্ত মায়রাকে ডাইনিং টেবিলটা গুছিয়ে রুমে আসতে বলে নিজে বেডরুমে চলে গেল। মায়রা ডাইনিং রুমটা পরিষ্কার করে প্লেট বাটিগুলো ধুয়ে রেখে গুটিগুটি পায়ে রুমে এলো। সীমান্ত খাটের উপরে বসতে ইশারা করায় মায়রা চুপচাপ বসে পড়লো। সীমান্ত উঠে কিছু একটা নিয়ে মায়রার ডান হাতে লাগিয়ে দিতে লাগলেই মায়রা হাত সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। সীমান্ত ভ্রু কুঁচকে মায়রার দিকে তাকাতেই বেচারি চুপ হয়ে গেল।
-কি সমস্যা বলো তো তোমার? এতোখানি পুড়লো কি করে?
-না মানে--। ভাতের মাড় পড়েছে-।
-মায়রা? সাধারণত তুমি এমন ভুল তো কখনো করো না--। কাজ তুমি ঠিক করে না পারলেও বেশ মনযোগ দিয়েই করার চেষ্টা করো--। কিন্তু আজ কি হলো? হাত পুড়লে, তরকারি পুড়লে--। না আমাকে খবর দিলে, না ওষুধ লাগালে--। কি হয়েছিল?
-আসলে----।
-হুম---। আসলে?
-আমমম--। আসলে একটু বে- বেখেয়ালে হয়ে গেছে--। আর-- আর হবে না---।
-হবে না তো বুঝলাম--। কিন্তু প্রশ্ন হলো আজ কেন হলো--।
-না--মানে--আসলে----।
-ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলে নিশ্চয়ই? তাই তাড়াহুড়োয় এসব ঘটেছে নিশ্চয়ই?
-না মানে------।
-কার সাথে কথা বলছিলে? মোবাইলটা কোথায় তোমার? হুম? দেখি----? দাও মোবাইলটা---।
মায়রা ইশারায় মোবাইলটা দেখিয়ে দিতেই সীমান্ত মোবাইলটা নিয়ে কললিস্টটা ওপেন করলো। লাস্ট একটা নাম্বারে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে দেখে মায়রার দিকে তাকালো সীমান্ত।
-এই মামনি সেইভ করা নাম্বারটা কার? তোমার মা বা আমার মা কারোই তো নাম্বার না এটা--।
-মামির নাম্বার---।
-ওহ! তা বিয়েতে আসলেন না উনার আদরের ভাগনির--। আজ হঠাৎ এতোগুলো দিন পর কি মনে করে মনে পড়লো?
-আজ---। আজকে আমার জন্মদিন তাই----।
-আজ তোমার বার্থডে!! ওহ শিট! আগে বলবে না তুমি! আমি তো জানতামই না--। ধ্যাত---।
-ইটস ওকে--। এমন কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কিছু হয়নি আজকে---।
-আমি সত্যিই জানতাম না বউটা৷ সরি সরি? হ্যাপি বার্থডে মায়রা--।
-থ্যাংক ইউ----।
-হায় রে! আজকের দিনেই তোমার এমন হাত পোড়াতে হলো! ইশ! কতোখানি পুড়েছে? কেমন লাল হয়ে গেছে! জ্বালা করছে এখনো?
-উঁহু---।
-মায়রা?
-হুম?
সীমান্তের ডাক শুনে মুখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। সীমান্ত আলতো করে মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে মুখটা ধরে চোখে চোখ রাখলো।
-রাগ করো না প্লিজ? আর প্লিজ একটু সাবধানে কাজ করা শিখো। খাবার পুড়ে যাওয়াটা কোন ফ্যাক্ট না। কিন্তু চিন্তা করো একবার--। আজ তুমি একা, হাত পুড়েছ--। আজ না হোক কাল তো নতুন অতিথি আসবে--। এভাবে কেয়ারলেস হয়ে কাজ করলে তার কিছু একটা হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে কখনো?
-আম--। আর হবে না---।
-হুম। সো বি কেয়ারফুল। কাজ করবে একটু দেখে শুনে, ওকে?
-হুম------।
-আর এখন চুপটি করে ঘুমাবা--। আজকে কাজের কোন প্রেশার নিতে হবে না--। আমরা আজকে বাইরে ডিনার করবো---। ওকে?
-বাইরে! কি দরকার?
-অন্তত একটা দিন এই ডিম ভাজি আর তরকারি থেকে তো রেহাই দাও! প্লিজ?
----------------------
-সরি বউ---। জাস্ট কিডিং--। একদিন আমরা দুজনে নিজেদের মতো করে তো টাইম স্পেন্ড করতেই পারি--। কি বলো?
------হুম----। মাহিব ভাইয়া আর তিয়া ভাবিকে বললে------।
-কোন দরকার নেই--। এমনিতেই ছুটির দিনে ইরিটেট করতে চলে আসে--। অসহ্য----।
-হুম??
-এখন চুপ করে ঘুমাবে এসো? সন্ধ্যার পরে বের হবো। একটু ঘুরে দেখবো আশপাশটা--। কেমন?
-হুম----।
-কই? শোও---?
মায়রা আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে শুয়ে পড়লো। সীমান্ত নিজেও শুয়ে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মায়রা চোখ বুজে মূর্তির মতো পড়ে আছে। সীমান্তের বুকে মাথা রাখা। কিন্তু মেয়েটার মনে অন্য একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছে। আয়ান এখনো ওকে উইশটা পর্যন্ত করে নি। ছোট্ট একটা মেসেজ পর্যন্ত পাঠায় নি লোকটা। গত তিনবছরে সবার প্রথমে যে মানুষটা ওকে উইশ করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে আজ তার অনুপস্থিতিটা বেশি মনে বাজছে মায়রার৷ যদিও স্বামীর বুকে মাথা রেখে অন্য কারো জন্য চোখের পানি ফেলা মোটেও ঠিক নয়, সেটা ভালো করেই জানে মায়রা৷ তবু প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে মায়রার৷ অভিমানটা কার উপরে সেটা মায়রা জানে না। হয়তো আয়ানের উপরে, হয়তো নিজের উপরে। অথবা ওদের ভাগ্য বিধাতার উপরে। আর ওর অভিমানগুলো বিন্দু বিন্দু কান্না হয়ে গড়িয়ে পড়ছে দু চোখ বেয়ে। মায়রাকে বুকে জড়িয়ে রাখা মানুষটা এসবের বিন্দুমাত্রও টের পেল না।