অচেনা অতিথি - পর্ব ২৭ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


আমার কাছে যথেষ্ট প্রমান আছে বলতেই ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় পড়লো রূপসার গালে। রূপসা হতবম্ভ হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইলো। সে ভাবতেই পারেনি সবার সামনে  এই ভাবে ওর মানহানি হবে।

রজনী  তার মেয়ে রূপসাকে, এই ভরা আসরে সবার সামনে থাপ্পড় মারলো। রজনী চিৎকার করে বলল," আম্মাজান সব সময় ঠিকই বলত, শয়তানের বাচ্চা শয়তানই হয়।"

আমিই আম্মাজানরে ভুল বুঝতাম কিন্তু তার প্রতিটা কথার মধ্য সবার মুখোশ তিনি বের করে আনেন। তোমার বাবা এই বাসায় কেন আসেননা, জানো তুমি সেই কথা!

আজ থেকে ২২ বছর আগে এরকমই ভরা মানুষের মধ্য তোমার ঐ বাবা আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। শুধু আমাকে ছেড়ে দিবে বলে তোমার দাদার বাসা সহ আমার বাসার লোকজনের সামনে আমাকে নষ্ট মেয়ে বলে বার বার গালি দিয়েছিল। আমার সম্মানের ছিটাফোঁটাও সে রাখেনি। আমার মৃত্যু ছাড়া সেদিন আর কোন বাঁচার উপায় নাই। 

কিন্তু আমার আম্মাজান সবার সামনে তোমার বাবাকে ঠাটিয়ে এভাবেই কয়েকটা চড় মেরে সবার সামনে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল, তার এই মেয়ের যদি এক বিন্দু পরিমান নষ্টামির প্রমান কেউ দিতে পারে  তাহলে তিনি সারা জিবন তোমার দাদাদের সংসারে দাসীগিরী করবেন।  সেইদিন এক চড়েই তোমার বাবা সোজা হয়ে গিয়েছিল। আর আজ আমাকে সেই একই স্থানে তোমায় সোজা করতে হচ্ছে। আর কত নিচে নামবে তুমি!


রূপসা কান কর্তাল ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল," মা মাহাদ সম্পর্কে তুমি কি জানো! আমার তো মনে হয় এই বাসার কোন কাজের মেয়েকেও ছাড় দেয়নি সে। আমি নিজে দেখেছি কাল রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে ফুর্তি করতে। " 

রুমকির বরকে নিয়ে রুমকি উঠে গেল। কারন এখানে থাকলে মান সম্মান রাখবেনা রূপসা। আগে সম্রাট কে রুমে দিয়ে আসি তারপর এই বিয়াদপের বিয়াদপী ছুটাবো।


আপা আন্নে এত বড় জালিম! ভাইজান আরে নিজের মাইয়ার মত ভালোবাসে আর আন্নে তারে লইয়া এইগুলা কথা কন! মাথার উপর আল্লাহ্ আছে। আল্লাহ্ আন্নের বিচার করবো। যে মুখ দিয়া খারাপ কতা কইছেন ঐ মুখ যেন পঁচে যায়। আন্নের কথা শুনে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কাইপা উঠবো। 
দাদী কিছু কন আন্নে। আন্নে না ভাইজানরে ভালো বাসেন তাইলে আজ ক্যান চুপ করে আছেন! সাবিনা কান্না করতে করতে কথাগুলো বলে ফেললো।


বাতাসি বিবি ভাল করেই জানে, তিতির ছাড়া মাহাদ  কারো জন্য পাগল না। পৃথিবীর সবাই যদি মাহাদের চরিত্র নিয়ে কথা বলে তাও বাতাসি বিস্বাস করবেনা। কিন্তু এগুলোর জন্য তিতির কষ্ট পাচ্ছে যেটা বাতাসি খুব উপভোগ করছে।


এই রূপসা তোর কাছে কি প্রমান আছে যার জন্য তুই মাহাদের নামে এসব বলছিস! অযথা কথা না বাড়িয়ে যা বলছিস তাই প্রুভ করে দেখা।(রেজওয়ান)


এবার রূপসা থেমে যায়। আজ রাগের বশে কোন প্রুভ ছাড়াই সে মাঠে নেমেছে। এখন কি করা যায় সেটাই মনে মনে ফন্দি আঁটছে রূপসা।
রূপসার ফন্দি আঁটার মাঝখানে এবার রুমকি এসে সজোড়ে ধাক্কা দিল রূপসাকে। তারপর কঠোর গলায় বলল," ছোট থেকে এই বাসায় মানুষ হয়েছি। কোনদিনও যেই মানুষের মধ্য খারাপ কিছু দেখিনি আর আপনি দু'দিন এসেই তার চরিত্রের ব্যান্ড বাজাচ্ছেন!  বাসা ভর্তি মানুষের সামনে মিটিং বসান! একবারও মনে হয়নি আপনার! এসব কথা আমার শশুড় বাসার লোকজনের কানে গেলে আমার কতটা সমস্যা হবে! এত রাতে আপনি ভিমরতি ধরছেন! আপনার ভিমরতি ছুটাতে এই রুমকি একাই যথেষ্ট। 


রুমকি, আগে ওর গাল  ফাটা তারপর তোরে কে কি কয় হেইডা আই দেখমু। আগে বাপ সভা বসাইছিল আজ মাইয়া বসাইছে। আমের গাছ থেকে আমই ধরে, কোনদিন কাঁঠাল ধরেনা। রজনী তোর মাইয়ারে আর চোখের সামনে থাইকা সরা। আই বাঁইচা থাকতে যেন ও এই বাড়িতে পা না দেয়। খাবিসের বাচ্চা ইবলিস! (বাতাসি)


মাহাদের প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। তাই সোফা হতে উঠে লম্বা একটা হাই তুলে রূপসার সামনে দাড়িয়ে বলল," তুই জিবনেও শোধরাবি না। নাজানি ফুফুকে তুই কত জ্বালাস। আগে নিজে শুধরা তারপর অন্যকে শুধরাতে আসিস। আজ যা তুই করলি, সেটা ক্ষমার অযোগ্য।  একটা ১১ বছরের ছোট মাসুম মেয়ের চরিত্র নিয়ে এত কিছু করলি, শুধু নিজের স্বার্থের জন্য!  আজকের পর থেকে রাস্তা-ঘাটে তোর সাথে যদি ভুলেও দেখা হয় তাহলে তোকে কখনো পরিচয়ও দিব না যে তুই আমার কাজিন হস। আর কথা বলাতো দুরেই রইল। আমি তোর নামের "রূ" শব্দটাও কোনদিন উচ্চারন করতে চাইনা।"

মাহাদ কথাগুলো বলে উপরে চলে গেল।

রুমকির মন চাচ্ছে ঠাটিয়ে রূপসার গালে চড় মারতে। চড় মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে একটু জিড়িয়ে নিয়ে আবার  প্রথম থেকে চড় মারা শুরু করলেও গায়ের রাগ মিটবেনা। 


কামরান সাহেব আর লাবীবাও মন ভার করে চলে গেল। সংসারের শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে তাই তারা কিছু না বলেই চলে গেল।
সবাই যে যার রুমে চলে গেল। শুধু আসমা রান্নাঘরে যেতেই তিতিরকে দেখলো, ও চোখের পানি মুছছে।

আসমাকে দেখেই তিতির কেঁদে উঠলো। দেখছো আসমা, তোমার ভাইজানকে নিয়ে কতগুলো খারাপ কথা বললো মেয়েটা! আমিতো চিনি আমার মানুষটা কেমন!

" আপা বাদ দেন তো! ওই ফাযিল মেয়ের কথা কে মানবে! আমরা সবাই জানি মাহাদ ভাইজান কেমন মানুষ।  আপনি ঘরে যান। আপনার না সামনে পরীক্ষা! আপনি এগুলো টেনশন করেন না। শেষে ভাইজান উল্টা আপনার উপর রাগ করবে।"

♦♦♦♦

রুমকি সোফায় বসে আছে। চোখ দিয়ে অঝোড়ে পানির ধারা চলছে। সম্রাট বসে বসে তার বিবাহিত স্ত্রীর কান্না দেখছে। সৌরভ কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে তার ওয়াইফ কেন কাঁদছে!

সম্রাট গম্ভীর মুখে বলল, "তাহলে মাহাদ ভাইয়ায় আপনার সবচেয়ে  প্রিয় মানুষ ছিল! যার জন্য আপনি সব কিছু করতেও দু'বার ভাববেন না!"

এবার রুমকির কান্নার গতি বেড়ে গেল। ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে সে। শেষে বাধ্য হয়ে টিসু বক্স নিয়ে কয়েকটা টিসু এগিয়ে দিল রুমকিকে সম্রাট।

" আপনি জানেন, আমি এই বাসায় ছোট থেকে মানুষ হয়েছি। কোনদিনও ওনার বিরুদ্ধে রির্পোট আসেনি। উনি কোনদিনও আমার সামনে দাড়িয়ে পাঁচটা মিনিট কথা বলেনি। যেদিন হতে ভালবাসা কি জিনিস বুঝেছি সেদিন থেকে আমি ওনাকে পাগলের মত ভালোবেসেছি। কিন্তু আমি ওনাকে প্রথম যেদিন প্রপোজ করেছিলাম সেদিনও উনি ঠান্ডা মাথায় আমাকে সামলিয়েছেন। উনি যদি খারাপই হত তাহলে সেদিন ঠিকিই সুযোগ নিত। ওনার অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবী আছে। তারা এই বাসায় আসতো। কোনদিনও তার নামে কেউ বাজে কথা বলেনি। বরং নানী ওনার সমন্ধে কিছু বললে তার বান্ধবীরা বলতো মাহাদের মত ছেলেই হয়না।
আর আজ ঐ মেয়েটা কিনা ঐ রকম পবিত্র মানুষের নামে এসব বাজে কথা বলছে। আমি কেমন করে সইবো বলেন!

" হুম বুঝলাম, আপনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো ঠিক থাকতে পারতাম না। যা করেছেন মনুষত্ব্য বোধ থেকেই করেছেন। এতে প্রসংসা পাওয়ার যোগ্যতা আপনি রাখেন।"

" চোখের পানি মুছে রুমকি বলল," দেখেন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি চাই একটা ভালো মেয়ের মত সংসারে মনযোগ দিতে। কিন্তু আমার তাতে একটু সময় লাগবে। আশা করি আপনি বুঝে গেছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি!"

" হুম বুঝে গেছি। আবার একটা রাত বউকে ছাড়া থাকতে হবে। আমি কিন্তু মাহাদ ভাইয়ার উপর মোটেও সন্তুষ্ট নয়। কারন তার জন্য আজও আমার ওয়াইফকে কাছে পাইনি। যাই হোক, সময় নিতে চাচ্ছেন নেন, কিন্তু সেটা খুব বেশি নিয়েন না। তখন আমি এমন ভালো ব্যবহার আপনার সাথে নাও করতে পারি। কারন সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।"

" রুমকি হাসি মুখে সম্মতি জানালো। তারপর গিয়ে বেডে সুয়ে পড়ে। একটু পরে আলো নিভিয়ে সম্রাটও সুয়ে পড়ল।" 

♦♦♦♦

তিতিরের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সে কিছুতেই ঘুমাতে পারছেনা। মাহাদকে সে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনা। এই এখুনি সে পাগলের মত ভালবাসবে আর একটু পরে এমন ব্যবহার করবে যেন মনে হয় সে আমাকে চিনেইনা। এমন কেন উনি! কত বার কল দিলাম উনি রিসিভ বা কোন মাসেজ অবদি করলোনা । উনি কেন বোঝেন না! ওনার এমন আচরনে আমার কষ্ট হয়।  আরো অনেক রাত পর্যন্ত তিতির জেগে রইলো তারপর ঘুমের বুকে ঢলে পড়লো।


পরের দিন সকালে রজনী তেমন কাউকে না জানিয়ে রূপসাকে নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে শুধু বাতাসি বিবিকে বলে গেল। বাতাসি রুপালীর সাথে কথা বললেও রুপসার সাথে কোন কথা বললো না। 

সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই রূপসার চলে যাওয়ার কথা জানলো। এতে কারো কোন যায় আসে না। দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো। তিতির ঝটপট নাস্তা সেরে ভারর্সিটিতে চলে গেল। আর যেগুলো মেহমান ছিল সবাই নাস্তা সেরে চলে গেল।

♦♦♦♦

তিতির ক্লাসে বসে আছে। একটু পরে ক্লাস শুরু হবে। অবাক কান্ড,  কেউ তিতিরের পাশে বসল না। ওকে সবাই অ্যাভোইড করছে। কেন করছে বুঝতে পারছেনা। এমন সময় স্যার ক্লাসে আসল। যথারীতি ক্লাস শেষও হয়ে গেল। অনেক দিন ক্লাস মিস হয়ে গেছে তাই নোটস্ গুলো দরকার। কেউ কথা বলতে চাচ্ছেনা। কার কাছে জিঙ্গাসা করবে সে! 

শেষে দিপুর দিকে চোখ পড়ল তিতিরের। ক্লাস হতে বের হয়ে দিপুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো তিতির। অবশেষে দিপুর দেখা মিললো কিছুক্ষন পরেই।
দিপু বলে ডাক দিতেই দিপু কাছে এসে বলল," কিছু বলবে!"

" আসলে আমার কিছু নোটস্ দরকার ছিল। তুমি কি আমায় সাহার্য্য করতে পারবে!"

" দিপু কোন কথা না বলে ব্যাগ থেকে কয়েকটা খাতা বের করে তিতিরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল," একগুলো কপি করে কাল আমায় দিও।" আর কিছু না বলে দিপু চলে গেল।"

" আজব! কেউ আমার সাথে কথা বলছেনা। আমি কি করেছি তার জন্য কেউ কথা বলছেনা? তিতির খাতাগুলো নিয়ে ফটোস্ট্যাট করতে দোকানে গেল। এমন সময় পিছন থেকে দিপু এসে বললো," তুমি কি বিবাহিত!"

দিপুর কথা শুনে চমকে উঠলো তিতির। নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে বলল," হঠাৎ এই প্রশ্ন!"

" না এমনি করলাম প্রশ্নটা, তোমাকে নিয়ে যা চর্চা হচ্ছেনা এই ভার্সিটিতে! কি বলব আর তোমায়। রিপা আপুকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আপুর ক্লাসের অনেকে এই সিদ্ধান্তে অসুন্তষ্ট প্রকাশ করেছে। যাইহোক, ফাষ্ট ইয়ারের রেজাল্টটা একটু ভাল করে সবাইকে দেখিয়ে দিও। যাতে সবাই বুঝতে পারে একজন মেধাবী স্টুডেন্টস এর ক্যারিয়ার নষ্ট করার চেষ্টা করেছে রিপা আপু। "

দিপুর কথাগুলো শেষ হতেই ফটোকপি গুলো হাতে পেল তিতির। পরীক্ষার রুটিন নিয়ে টাকা পরিশোধ করে দিপুকে বিদায় জানিয়ে বাসায় রওনা দিল তিতির। এতকিছু হয়ে গিয়েছে সে তেমন কিছুই জানেনা। দিপুর কথাগুলোও বেশ ভাবাচ্ছে তিতিরকে।  তিতির বাসায় এসে ফ্রেস হয়েই কোমড় বেঁধে পড়তে শুরু করলো। যেভাবেই হোক রেজাল্ট তার ভালো করতেই হবে।

♦♦♦♦

তিনদিন পর,

এই তিনদিনে মাহাদের সাথে তিতিরের দেখা পর্যন্ত হয়নি কথা বলাতো দুরে থাক। তিতির সময়ের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ন পড়াশুনায় মনযোগ দিয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে এসে একটু রেষ্ট করে পড়তে বসেছে এমন সময় ফোনটা  কেঁপে উঠলো। কে আর হবে, নিশ্চয় তিতিরের লাফাঙ্গা বরটা কল দিয়েছে। তিনদিন ধরে যোগাযোগ নাই আর আজ কল দেওয়া হচ্ছে! ধরবোনা কল.........

কল কেটে যেতেই তিতির আবার পড়ায় মনযোগ দিল। কিন্তু নাহ্ সে আবার কল দিয়েছে। এবার তিতির কল রিসিভ করেই বলল," আপনি যাকে কল দিয়েছেন সে এখন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত আছে তাই দয়া করে বার বার কল দিয়ে তাকে বিরক্ত করবেন না। "
তিতিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলটা কেটে গেল। এতে তিতির বেশ রেগে যায়। কথা শেষ না হতেই উনি কেটে দিল! একটুও দয়া হলোনা! প্রচন্ড খারাপ লাগা এসে তিতিরকে ঘিরে ধরলো। গলাটা ভারী হয়ে গেল। আমি আর আপনার ফোন রিসিভই করবোনা। চোখে পানি টলমল করছে। এই বুঝি চোখ দিয়ে ঝর্না বেয়ে যাবে।

" একটু পরে আবার কল আসলো। এবার তিতির খপ করে কল রিসিভ করেই বলল," আপনি অত্যন্ত অসভ্য একটা মানুষ। তার সাথে কঠিন মনের একটা মানুষ। তিনদিন পর আমার খোঁজ নিচ্ছেন! আমার খোঁজ আপনার নিতে হবেনা। আমি বেশ আছি।"

" বৌ......."

" এবার তিতির শেষ,  বৌ ডাকটার প্রতি তিতিরের খুব দুর্বলতা রয়েছে। এই বৌ শব্দটাই তিতিরকে নাকানি-চুবানি খাওয়ায় ছাড়ে। তিতিরের বা চোখ দিয়ে টপ করে একফোটা জল পড়ে গেল। খানিকপর তিতির বলল," কই যাইতে হবে!"

" আপাততো বাসার বাহিরে আসলেই চলবে।"

" দেখেন, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবোনা। আমার পড়া আছে।"

" হুম, বলে মাহাদ কলটা কেটে দিল।"

তিতির মাথায় ঘোমটা দিয়ে রুম থেকে সাবধানে বের হইলো। ডাইনিংরুম পার হয়ে  পা টিপে টিপে আস্তে করে দরজা খুলে বের হয়ে এল। সবার চোখকে ফাঁকি দেওয়া চাট্টিখানী কথা নয়।


মাহাদ কিছুটা দুরে দাড়িয়ে রয়েছে। তিতির মাহাদের সামনে যেতেই মাহাদ তিতিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল পিছনের গেটের কাছে। তারপর গেট খুলে দু'জনেই বের হয়ে এল রাস্তার ধারে। মাহাদ তিতিরকে রাস্তার উপর রেখে এসে গেটে চাবি দিয়ে আবার তিতিরের কাছে ফিরে আসলো।

" আমরা কোথায় যাচ্ছি মাহাদ!"

" চুরি করতে!"

" কিহ্,  এই দুপুর রাতে আমরা চুরি করতে যাচ্ছি! আপনার মাথা ঠিক আছে!

" মাহাদ চট করে তিতিরকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। ঠোট, গলা, কপাল,শেষে গালটা আলিঙ্গন করে তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল," কোন কথা না।"

" তিতিরকে যতটুকু মেডিসিন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল মাহাদ ঠিক ততটুকুই মেডিসিন দিল। এতেই এনাফ।

তিতির ভালো করেই জানে মাহাদ তাকে যতটা ভালেবাসে পৃথিবীর আর কেউ তাকে এতটা ভালোবাসবেনা। তাই কোন কথা না বলে মাহাদের হাত ধরে পথ চলতে লাগল। "

" রাস্তা থেকে  একটা খোলা মাঠে নেমে পড়লো দু'জনেই। আশেপাশে কয়েকটা বাসা রয়েছে। সেগুলো ছেড়ে আরো খানিকটা দুরে গিয়ে আম গাছের নিচে এসে দাড়ালো। "

" মাহাদ,  আপনি এই রাতে আম চুরি করবেন বলে আমায় এতদুর ডেকে নিয়ে এসেছেন!"

" জ্বী ভাবী, আম চুরি করার জন্যই আমরা এখানে এসেছি বলে গাছের আড়াল থেকে দুইটা ছেলে বের হয়ে এল।"

" তিতির এদের দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। শেষে মাহাদ আম চোরের খাতায় নাম লেখালো! তিতির কিছুটা দুরে দাড়িয়ে এদের কাজ দেখতে লাগলো।"


কিরে সব নিয়ে আসছিস তো বলতেই ফায়সাল আর হাসিব দুইটা বস্তা, একটা ব্যাগ, আর দড়ি বের করে মাহাদকে দেখালো। 
মাহাদ সত্যই সব আম আজ নামাবি! (হাসিব)


তুই কি ভাবছিস এই রাতে তোকে হরর মুভি দেখাইতে এখানে ডেকে এনেছি! 
আমাদের জায়গা আমার দাদা গাছ লাগিয়েছে আর দখল করে খায় তার চাচাতো ভাই মোজাম্মেল ফকির। দাদি নাকি কিছুদিন আগে ওনারে কল দিয়ে বলেছিল কিছু আম দিতে। এতে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে  দাদীকে। এবার ওকে জন্মের মত আম খাওয়ায় ছাড়বো। গাছটা আমাদের সীমানার শেষপ্রান্তে পড়েছে তাই ওরা নিজের বলে দাবি করে। বাবাকে তো চিনিস!  কোনদিনও একটা কথা বলবেন না। এত জিবন খেয়েছিস আজ দাদি চাইছে বলে কথা শুনাবি!
যা গাছে চড়।

"আমরা তো গাছে চড়তে জানিনা। "

" কিহ্ গাছে উঠতে পারিসনা! তাহলে তোদের ডেকে আনলাম কেন! মাহফুজকে ডাকলেই তো হত!"

" তাহলে এখন ডাক।"

তিতির এদের কান্ড দেখে না হেঁসে আর পারলোনা।  কাছে এসে বলল," এই আপনাদের মুরোদ! 
ফায়সাল ভাইয়া আর হাসিব ভাইয়া আপনারা দুরে গিয়ে পাহারা দেন। এদিকে কেউ আসলে ওনাকে কল দিয়েন। বাঁকিটা আমরা সামলে নিচ্ছি।

হাসিব আর ফায়সাল লজ্জা পেয়ে চলে গেল।

" তুমি গাছে উঠতে পারো!"

" খুব পারি। এমনকি আপনাকে নিয়েই উঠতে পারবো।"

তিতির কোমড়ে ওড়না পেঁচিয়ে একটা ব্যাগের হান্ডেলে দড়ি বেঁধে দড়িটা মাহাদের হাতে  দিয়ে একটা ঢিল কুড়ে নিয়ে গাছে ঢিল ছুড়ে মারলো। সাথে সাথে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল গাছ থেকে। এবার ওঠা যায় বলে একনিমিষেই বাদরের মত তর তর করে গাছে উঠে গেল তিতির।  মাহাদ লাইট জ্বালাতেই তিতির ধমক দিল উপর থেকে। লাইট জ্বালাচ্ছেন কেন! যদি ধরা পড়ি তাহলে স্ব-শরীরে আর বাসায় যাইতে পারবোনা। চুরি করতে আসছেন আর চুরি বিদ্যা জানেন না! 

তিতির চাঁদের আলোয়  যতগুলো আম দেখতে পাচ্ছে সেগুলো টপ টপ করে নামাচ্ছে। ব্যাগ ভরতেই মাহাদ দড়ি ঢিল করলো আর ব্যাগ সড় সড় করে নিচে নেমে আসলো। মাহাদ আমগুলো বস্তাতে ভরছে। মাহাদ ব্যাগে টর্চটা দিয়ে বলল," তিতির ব্যাগে টর্চ দিলাম ওটা নাও।"

প্রায় আধাঘন্টার উপর আম পেড়ে প্রায় গাছ সাবাড় করলো। কিন্তু শেষের দিকে কিছুদুরে মোজাম্মেল এর বাসার গেটের লাইট জ্বলে উঠলো। সেটা তিতির আগে  দেখতে পেয়ে মাহাদকে বলল," মাহাদ লুকিয়ে পড়েন, কেউ মনে হয় এদিকে আসছে।"

মাহাদ ফায়সাল কে কল দেওয়ার আগেই মোজাম্মেল বুইড়া দৌড়ে গাছের দিকে আসতেই দুরে দুইটা ছায়ার মত কাউকে দেখতে পেয়ে বলল," ঐ কে ওখানে রে! খাড়া বলছি বলেই দৌড়।"

ফায়সাল আর হাসিব সর্বোচ্চ গতিতে দৌড় দিতে দিতে বলল, "মাহাদ তুই আজ গেছিস।" 

মোজাম্মেল বুড়ো গাছের দিকে দৌড়ে আসতেই তিতির ওর ওড়নাটা খুলে মাথায় ঘোমটা দিল আর পুরা টর্চের আলো ওর মুখে ধরলো। হাতের আঙ্গুল ফাঁকা করে আলোর উপর ধরলো।  লাল ওড়নার আলোর দৃশ্যটা আমগাছের মগডালে একটা ভুতুরে পরিস্থিতি তৈরি হল।  মনে হচ্ছে কোন ভূত মগডালে বসে আম খাচ্ছে। সেটা দেখে মোজাম্মেল বুড়ো স্থির হয়ে দাড়িয়ে গেল। ও বাবা গো মা গো বলে ভিমড়ি খেয়ে  ফ্লাট হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। বুড়ো সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছে।  এই সুযোগে তিতির আর দেরি না করে  লাইট অফ করে দ্রুত গাছ থেকে নেমে পড়ে। তিতির গাছে থেকে নামতেই মাহাদ আড়াল থেকে বের হয়ে এসেই তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল," তুমি ঠিক আছো?"

" আদর পরে করেন। হাতে সময় নেই। ওনাদের ডাকেন। এগুলো নিয়ে যেতে বলেন।"

মাহাদ ওদের ফোন দিতেই ওরা চলে আসে। মাহাদ ওদের সব আম নিতে যেতে বলতেই ওরা বলল," বাহ্ ভাবী, আপনার কি উপস্থিত বুদ্ধি। আপনি না থাকলে আজ  যে কি হত, আল্লাহ্ ভালো জানে।

তিতির ব্যাগ ভর্তি আম নিয়ে বাঁকিটা ওনাদের দিয়ে ওখান থেকে মাহাদকে নিয়ে রাস্তায় চলে আসলো। তারপর কি মনে করে থেমে গেল তিতির। মাঠে মোজাম্মেল বুড়ো ওভাবেই পড়ে আছে। 

আপনি এখানে থাকেন আমি আসছি বলে তিতির রাস্তা থেকে  পড়ে থাকা তিনটি আধলা ইট নিয়ে মোজাম্মেলের বাসার সামনে গিয়ে গেটে পর পর তিনটা ইটই ছুড়ে মারলো। বিকট শব্দে দরজা কেঁপে উঠতেই তিতির দৌড়ে এসে মাহাদ কে বললো চলেন এবার। আর কিছুক্ষন থাকলে এবার আমরা ধরা পড়বই।

মাহাদ আর তিতির দ্রুত বাসার পিছনে এসে দাড়ালো। মাহাদ গেট খুলে আমের ব্যাগটা হাতে নিয়ে পিছন দিকে ফিরে দেখলো তিতির নেই। এই তো ছিল কাছে। এর মধ্য কই গেল।

তিতির ওয়ালের উপর থেকে মাহাদকে ডাক দিয়ে বলল," থাম্বার মত দাড়িয়ে আছেন কেন! ভিতরে ঢুকেন!"

মাহাদ ভিতরে ঢুকে গেটে চাবি দিয়ে চোখ কটমট করে তিতিরের দিকে তাকালো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন