উমা - পর্ব ১৭ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


উমার নিজের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করলো তার পালাতে হবে। শাবীব তার পাশেই চলছিলো। তার খেয়াল অন্যদিকে যেতেই উমা পালানোর জন্য ছুট লাগালো। কিন্তু তার ইচ্ছে থাকলেও সফল হতে পারলো না। যেই না পালাতে যাবে অমনি পেছন থেকে সজোরে কেউ আঘাত করলো তাকে। প্রচন্ড ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো উমা। চাহনী ঝাপসা হতে লাগলো। ক্রমেই উমা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। শাবীব তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে চায় নি উমাকে আঘাত করতে, কিন্তু উমা পালাতে চাচ্ছিলো। এটা যে কোনো ভাবেই হতে দিতে পারে না সে। ঝাপসা নজর ধীরে ধীরে নিকষকৃষ্ণ আভায় মিলিয়ে যেতে লাগলো। উমার মনে হতে লাগলো সে তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের মায়াজালে। বক্ষস্থলে একটি আকাঙ্খা, যদি আজ ই তার অন্তিম দিন হয় তবে একটি বার রুদ্রকে দেখতে চায় সে। শুধু একটি বার। 

নির্বাচন শেষ হবার দিকে, রুদ্র এখনো কেন্দ্র থেকে বের হয় নি। এদিকে ওসি আবদুল্লাহ এসে পৌছেছে কেন্দ্রে। অরাজকতা সৃষ্টি হবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। শাশ্বত রুদ্রের মতিগতি বুঝতে পারছে না, উমা খুজতে এখনো কেনো রুদ্র যাচ্ছে না এই প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে না সে। পরমূহুর্তে একটি চিন্তা তাকে ব্যকুল করে তুলছে এতো বড় জায়গায় কে উমাকে অপহরণ করেছে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না সে। তার সন্দেহ হচ্ছে কাজটি অভিনব সিংহের। রুদ্র সেদিন দোকানেও এই কথাটি বলেছিলো, উমার সবথেকে বড় শত্রু অভিনব সিংহ। কারণ তিনি জানেন রুদ্রের দুর্বলতা উমা। বাবা হয়ে সরাসরি তাকে আক্রমন করলে ব্যাপারটি ভালো দেখায় না। তাই তিনি লুকিয়ে রুদ্রের হাটু ভাঙ্গতে চান। শাশ্বত কিছু একটা ভেবে রুদ্রের কাছে গেলো, স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“তুই উমাকে খুজতে যা, আমি আছি এখানে”
“কোথায় খুজবো?”

রুদ্রের প্রশ্নে চুপ করে যায় শাশ্বত। রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় শাশ্বতের দিকে। শাশ্বত কি বলবে নিজেও বুঝতে পারছে না। তখন রুদ্র বলে,
“উমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না। কারণ ওরা চায় যেনো আমি কেন্দ্র থেকে বের হই, উমার কিছু করলে আমি ওদের আস্তো রাখবো না।“
“তাহলে কিসের অপেক্ষায় আছিস?”
“কোনো ছুতার, আমাকে বের করতে হলে কোনো চিঠি বা ফোন আসবে। সেটার অপেক্ষা।“

শাশ্বত তখন বলে উঠে,
“এমন ও তো হতে পারে তোর বাড়িতে কোনো চিঠি রেখে গেছে।“
“হতেই পারে, কিন্তু বাদল খালি হাতে ফিরেছে। ধরা যেতেই পারে কোনো চিঠি রেখে আসে নি।“
“বাদলের সাথে আরেকবার কথা বলে দেখ, যদি কিছু মনে পড়ে ওর।“

রুদ্র ছোট করে “হু” বলে। শাশ্বত খেয়াল করলো রুদ্রের কন্ঠে চাপা ভয়ের সূক্ষ্ণ রেখা ফুটে উঠছে। কিন্ত সেটা সে প্রকাশ করছে না। মানুষই তো ভয় তো হবেই, এটাই তার বৈশিষ্ট্য। রুদ্র শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তেজনায় গা কাঁপছে। কিন্তু এই সময়টা ব্যাকুল হবার নয়। শান্ত থেকে দৃষ্টির অগোচরে লুকিয়ে থাকা শত্রুকে পরাজিত করার। 

এদিকে বাদলের মাঝে এক অস্বস্থিবোধ লক্ষ্য করা গেলো। তাকে বেশ অস্তির এবং চিন্তিত ঠাহর হলো। সুযোগ খুজতে লাগলো কখন একটু অভিনব সিংহ এর সাথে কথা বলবে। কিন্তু অভিনব সিংহ আজ অনেক ব্যাস্ত, হবে না কেনো? বিগত তিনবার উনি ই চেয়ারম্যান হয়েছেন, উনার প্রভাব পরিচিতি চিন্তার বাহিরে। তাই তাকে সবার সাথেই কথা বলতে হচ্ছে। সবাই তাকে সালাম ঠুকছেন। আর না পেরে বাদল দীপঙ্করের কাছে গেলো। দীপঙ্কর তাকে দেখে অবাক কন্ঠে বলে,
“এ কি তুমি এখানে?”
“জ্যেঠুর সাথে কথা বলতাম”
“জ্যেঠু ব্যস্ত আছেন, নির্বাচন শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু তুমি এখানে কেনো? কাজ হয়েছে?”
“কাজ হলে তো হয়েই যেতো, খুব দরকার আমার। জ্যেঠুর সাথে না কথা বললে অনর্থ হবে”

ব্যাগ্র কন্ঠে বাদল কথাটা বললো, দীপঙ্কর চোখ কুচকে তাকালো তার দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো তার ধৈর্য্যহারার কারণ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,
“আসো আমার সাথে”

একটা শ্রেণীকক্ষে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অভিনব সিংহ এবং বাদল। অভিনব সিংহের মুখশ্রীতে একরাশ বিরক্তি। তেতো কন্ঠে বাদলকে শুধালো,
“কি এমন হয়েছে যে তোমার তর সইলো না। আর তুমি এখানে কেনো?”
“জ্যেঠু খুব খারাপ খবর আছে।“
“কি হয়েছে?”

ভ্রু যুগল কুচকে আসলো অভিনব সিংহের। মুখোভাব বদলে গেলো তার। এক রাশ ভীতি এবং বিস্ময় জড়ো হলো মুখে। বাদল আমতা আমতা করে বললো,
“আমি বৌদিকে অপহরণ করতে পারি নি।“
“মানে?”

বাদল বড় সড় ঢোক গিলে বললো,
“আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু ঘরে তালা মারা। বৌদিকে অন্য কেউ ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের পরিকল্পনা জলে চলে গিয়েছে জ্যেঠু”
“রুদ্র জানে?”
“জানে, আমি এসেই ওকে বলেছি।“

অভিনব সিংহ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বাদল বুঝতে পারলো তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। কিছুসময় বাদে তার মুখমন্ডল উজ্জ্বল হলো। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
“উমা অপহরণ হয়েছে এটাই আমাদের জন্য সবথেকে বড় সুখবর। রুদ্রের শত্রু কেবল আমরাই নই, সুতরাং উমাকে কে অপহরণ করেছে সেটা নিয়ে আমাদের না চিন্তা করলেও হবে। এখন রুদ্র সবথেকে দুর্বল অবস্থায় আছে। আমাদের লোহা গরম থাকতেই হাতুড়ি মারা উচিত। তুমি যাও, রুদ্রকে কেন্দ্র থেকে বের করার প্রচেষ্টা করো। আর দীপঙ্কর তুমি চিঠিটা রুদ্রের হাতে দেবার ব্যাবস্থা করো।“
“কিন্তু জ্যেঠু বাদল তো অপহরন করে নি।“
“তাতে কি, অপহরণ তো হয়েছে। যাও যাও”

অভিনব সিংহের মুখে উজ্জ্বল হাসির প্রলেপ দেখা গেলো। দীপঙ্কর সময় নষ্ট না করে রুদ্রকে অপহরণের পত্রটি রুদ্রের কাছে দেবার ব্যাবস্থা করলো। বাদলের চিন্তা দূর হলো না। রুদ্রের শান্ত স্বভাব তাকে চিন্তিত করছে। রুদ্র এমনেই মাথা গরম প্রকৃতির ছেলে, রাগ উঠলেই তার মুখশ্রী সেটার জানান দেয়। অথচ আজ রুদ্র শান্ত। বাদলের গতবারের মারটা আজও মনে আছে তার। একটুর জন্য যমের দোয়ারে তাকে যেতে হয় নি। বাদলের মনে হচ্ছে এটা ঝড় আসার পূর্ব সংকেত। তার ভয় বাড়ছে, ভয়ার্ত কন্ঠে সে অভিনব সিংহকে বললো,
“জ্যেঠু আমি না গেলে হবে না?”
“এটা তো কথা ছিলো না?”
“আসলে”
“রুদ্রকে ভয় পাচ্ছো নাকি?”
“জ্বী, পরান কাঁপতেছে।“
“আমার কাছ থেকে মোটা অংক নিয়েছো ভুলে যেও না”

বাদল চুপ মেরে গেলো, হ্যা সে তার বন্ধুর পিঠে ছুরি মারার জন্য মোটা টাকা নিয়েছে। শুধু তাই নয়, উমার প্রতি নোংরা লালসাটা পুনরায় মাথা চারা দিয়ে উঠেছিলো। কিন্তু সবকিছুই যেনো গুবলেট হয়ে গেলো। মাথা নত করে বেরিয়ে গেলো বাদল। বের হতেই রুদ্রের সাথে তার দেখা হলো। রুদ্র উগ্রীব কন্ঠে বললো,
“বাদল, উমার অপহরণকারীর খোঁজ পেয়েছি, চল আমার সাথে”

রুদ্রের মাঝে শান্ত ঢেউ নিয়ে, সে খানিকটা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ দীপঙ্কর তার কাজ করে ফেলেছে। বাদল ঢোক গিলে বলল,
“চল”

রুদ্র তার বাইক স্টার্ট দেয়। তারা কেন্দ্র থেকে বেড়িয়ে যায়। এদিকে নির্বাচন শেষ। সব ব্যালোট বক্সগুলো এক ঘরে আনা হয়েছে। নির্বাচন অফিসাররা ভোট গণনা করবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রুদ্রের লোকেরা বাহিরে তদারকি করছে, যেনো কেউ ভেতর প্রবেশ না করতে পারে। অপরদিকে আবদুল্লাহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ নিয়োগ করেছে। যতগুলো কেন্দ্র আছে সব জায়গায় কড়া পাহারা। 

পিচের রাস্তা চিরে মোটরসাইকেল চলছে। বাতাসের বেগে উড়ছে রুদ্রের চুল। সাইকেলের বেগ বাড়ছে। বাদলের মনে হলো তারা হাওয়ার গতিতে যাচ্ছে। একটু হলেই ছিটকে পড়বে তারা। রুদ্রের মাঝে একটা তাড়া আছে। তবে বাদলের ভয় কমলো না, যা তারা পরিকল্পনা করছে সেই অনুযায়ী রুদ্র এবং সে বেড়িয়ে পড়বে। কিন্তু রুদ্রের সাথে রুদ্রের সাঙ্গপাঙ্গ গুলোও বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু সেটি হলো না। রুদ্র একাই বের হলো। শুধু তাই নয়, তারা এমন কোথাও যাচ্ছে যেটা পরিকল্পনার বাহিরে। হঠাৎ ব্রেক কষলো রুদ্র। বাদল অবাক কন্ঠে শুধালো,
“থামলি কেনো?”
“এসে পড়েছি। নাম”
“অসম্ভব আমাদের তো নদীর পাশ টায় যাবার কথা”
“তুই কিভাবে জানিস? আমি তো তোকে স্থান বলি নি”

রুদ্রের শান্ত কন্ঠে বলা কথাটি শুনে বাদলের বুক কেঁপে উঠে। এবার রুদ্র মোটর সাইকেল থেকে নামলো, বাদল ও নামলো তার পিছু পিছু। রুদ্র রাস্তার এক কোনায় বসলো, জায়গাটি খুবই নীরব। বিকালেই আধার নেমে এসেছে, না জানি সন্ধ্যের পর কি হবে। এখানে কাউকে মেরে ফেললেও কেউ টেরটি পারে না। রুদ্র চোখ তুলে তাকালো বাদলের দিকে। তার কপালের বা পাশের শিরাটি ফুলে উঠেছে। ধীর স্বরে বললো,
“উমা কোথায়?”
“জানা নেই, সত্যি আমি জানি না দোস্ত”
“দোস্ত শব্দটি বলিস না, বড্ড কুৎসিত লাগে তোর মুখে”

বাদল মাথানত করে ফেললো। ভয়ে গা ছমছম করছে তার। রুদ্র কি করবে জানা নেই। তবে তার জন্য খুব খারাপ কিছুই অপেক্ষা করছে। সূর্যের লাল রেখা দেখা যাচ্ছে, নীল আকাশে রক্তিম সূর্যটি ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শীতল হাওয়া বইছে। বাতাসে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, মৃত্যুর নোংরা গন্ধ
______________________________

উমার জ্ঞান ফিরলো। চোখ পিটপিট করে বড্ড কষ্ট খুললো সে। চোখ ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখলো সে। সে তার নিজের ঘরে ছিলো। মাথার পেছনটা ব্যাথা করছে প্রচন্ড। খুব কষ্টে উঠে বসলো সে। তখন ই রুদ্র এগিয়ে আসলো, ধীর স্বরে বলল,
“কেমন লাগছে?”
“আমি বাড়ি কিভাবে আসলাম? শাবীব দা আমাকে তো………”

উমার কন্ঠ কাঁপছে, দলা পাকিয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। রুদ্র তার কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে বলল,
“কালো মেঘ কেটে গেছে, ভয় নেই। আমি আছি।“

উমা আর কথা বললো না। জড়িয়ে ধরলো সে রুদ্রকে। রুদ্র পরম আবেশে আলিঙ্গনে নিলো সে উমাকে। শাবীবকে সেই পাঠিয়েছিলো উমাকে সুরক্ষিত করতে। উমা পালাচ্ছিলো বলে শাবীব বাধ্য হয়ে তাকে আঘাত করেছিলো। সেজন্য তাকে শাস্তিও দিয়েছে রুদ্র। এই পুরো পরিকল্পনাটি ছিলো তার এবং শাশ্বতের। তারা জানতো এমন কিছু হবে। সেকারণে পরিকল্পনা করেছিলো তারা। উমাকে আগ থেকে জানাতে পারে নি। কারণ পরিকল্পনাটি সকালে করেছিলো। বাদল আগের রাতে অভিনব সিংহ এবং দীপঙ্করের সাথে কথা বলেছিলো সেই মূহুর্ত দেখে ফেলেছিলো শাশ্বত। রুদ্রকে জানাতেই সে এই পরিকল্পনা করে। বাদলকে হাতে নাতে ধরেছে সে। অপরদিকে, রুদ্র যাবার পর ব্যালোট চুরি করতে গিয়েছিলো অভিনবের লোক। আবদুল্লাহ তাদের হাতেনাতে ধরে। তারা যদিও মুখ খুলে নি। কিন্তু বিপুল ভোটে রকীবুল মাসটার হয়েছে এবারের চেয়ারম্যান। মেম্বার হয়েছে রুদ্র। এবার আর লুকিয়ে খেলবে না রুদ্র। অভিনব সিংহকে উত্তর দিতে হবে সব প্রশ্নের। আর বাদল সে এখন হাসপাতালে ভর্তি। বাঁচা মরাটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে রুদ্র। বিশ্বাসঘাতক যে তার পছন্দ নয়। উমাকে শুয়িয়ে দিলো রুদ্র। ধীর স্বরে বললো,
“কাল গ্রামে যাবো। তৈরি থেকো”

রুদ্রের মুখোমুখি বসে আছেন অভিনব সিংহ। তার কপালের চিন্তার রেখা। তরতর করে ঘামছেন তিনি। একটু পর পর রুমাল দিয়ে মাথা মুছছেন। রুদ্র শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজ তার মাথানত নেই। বরং মুখে এক অনন্য আত্নবিশ্বাস দেখতে পাচ্ছে সে। চুরুটের পাইপটা হাতে নিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো অভিনব সিংহ। রুদ্র কঠিন কন্ঠে বললো,
“কাজটা ভালো করেন নি বাবা, আগেও বলেছি এখনো বলছি উমার দিকে হাত বাড়াবেন না। যদি আমাকে হারাতে হয় আমাকেই নিশানা করবেন। কিন্তু আপনি সেটা করেন নি।“
“আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি বলছো”
“স্বীকার না করলে আপনার ব্যাপার, তবে বাদল কিন্তু সবটা বলেছে আমায়”

অভিনব সিংহের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। সে আতংকিত চাহনীতে তাকালো রুদ্রের দিকে। রুদ্র এবার এগিয়ে এসে ঝুকলো খানিকটা। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“ইট মারলে পাটকেল খেতেই হয়, প্রস্তুত থাকুন। এই সাম্রাজ্য যদি মিশিয়ে না ফেলি আমার নাম রুদ্র নয়। এবার যুদ্ধ ঘোষনা করলাম, যা করার করুন”

বলেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। ঘুরে দাঁড়াতেই অভিনব সিঙ্ঘের কাঁপা স্বর শুনে সে,
“যার জন্য এতো কিছু, সময় আসলে তাকে পাশে পাবে তো?”

রুদ্র কিছুক্ষন থমকে দাঁড়ালো। পরমূহুর্তে উত্তর না দিয়েই বেড়িয়ে গেলো। অভিনব সিংহ চুরুট টানতে লাগলো। তার মুখে নিকষকৃষ্ণ ভয়ের রেখা স্পষ্ট। সাম্রাজ্য হারাবার ভয়।

উমা বসে রয়েছে নিখিলের ঘরে, হাতে নিখিলের লেখা চিঠি। রতী নিখিলের কাপড়ের সাথে পেয়েছিলো। যত্নে রেখে দিয়েছিলো। আজ উমা আসলে তাকে দিয়েছে। উমা চিঠিটি পড়ে নি এখনো। বুকটা কাঁপছে। উথাল পাতাল দিয়ে কান্না পাচ্ছে। হিচকি তোলা কান্না। জমা পাথরটা আজ নামছে বুক থেকে। আজ বাবাকে খুব স্মরন হচ্ছে। চিঠিটা হাতে নিয়ে ক্রন্দনমাখানো কন্ঠে বললো,
“বাবা, আরেকটু সময় কেনো থাকলে না তুমি।“

তখন রুদ্রের ডাক শোনা গেলো। সে ও বাড়ি থেকে চলে এসেছে। উমা চোখ মুছে নিলো। ধীর পায়ে দরজায় দাঁড়ালো। রুদ্রকে উঠানে দেখা যাচ্ছে। চিঠিটা এখন পড়বে না উমা। সময় আসলে পড়বে। রুদ্রের হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখা যাচ্ছে। গোপালের সাথে হাসছে সে। উমার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। তার জীবন এখন এই মানুষটাকে ঘিরে, এটাই হয়তো জীবন________________

—————

১৯!! 

স্নানঘরের বেসিনে দাঁড়িয়ে গরগর করে বমি করে যাচ্ছে উমা। জল অবধি সহ্য হচ্ছে না তার। বমির দাপটে ছোট মুখখানা আরো বেশি ছোটো হয়ে গিয়েছে। ফর্সা মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। শরীরটা দুর্বল লাগছে, মাথার পেছনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বেসিনকে ভর করে খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বখানা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষন করে নিলো সে। কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা একই সাথে নাস্তা করছিলো উমা, রুদ্র, রাজশ্বী এবং গোপাল। দুধের গন্ধেই গা গুলিয়ে এলো উমার। অহেতুক সবাইকে বিরক্ত না করে জল খেয়ে নিলো সে। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। মুখ চেপে ছুটে আসতে হলো স্নানঘরের দিকে। এই শরীর খারাপটা বেশ কদিন ধরেই হচ্ছে, এতোদিন আমলে নেয় নি। ভেবেছে হয়তো ভাজাপোড়া, অসময় করে খাবার জন্য পেট সহ্য করে নি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সেটা নয়। বিগত দুমাস যাবৎ মাসিক হচ্ছে না তার। উমার মনে তীব্র সন্দেহ বাসা বেধেছে। তার মধ্যে কি নতুন জীবের সঞ্চার হয়েছে? চিন্তার ঘোর কাটলো রুদ্রের আতংকিত কন্ঠে,
“তুমি ঠিক আছো তো উমা? দ্রুত গতিতে উঠে এলে কেনো? উমা, আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে”
“আমি ঠিক আছি”

ধীর স্বরে উমা কথাটা বললো। তারপর মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলো সে। উমার শুকনো মুখখানা দেখে আলতো হাতে তার গাল স্পর্শ করলো রুদ্র। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“মনে হচ্ছে না তুমি ঠিক আছো। বলো তো ডাক্তার ডাকি”
“সামান্য পেট খারাপ হয়েছে, এতে এতো ব্যস্ত হবার কিছুই হয় নি।“
“কোনো কিছুই সামান্য হয় না উমা, সব কিছুর কিছু না কিছু প্রভাব আছে”

রুদ্রের জিদের কাছে হার মানতে হলো উমার। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“বেশ, বাবুর যা ইচ্ছে”
“আমি মিনুকে বলছি চিরা ভিজিয়ে দই দিয়ে দিতে।“
“মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না, আর দুধেল জিনিস তো না, গন্ধেই গা গুলোয়”
“তাহলে কলা, চিরা দিতে বলসি, এবার বাহানা দিও না।“

উমা স্মিত হাসলো। তারপর ধীর পায়ে নেমে এলো নিচ তালায়। গোপাল তখন পেট পুজোতে ব্যাস্ত। রাজশ্বীর চোখ উমার দিকে। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“দিদি, তুই ঠিক আছিস?”
“হু, তোর খাওয়া শেষ?”
“হ্যা, আমার খাওয়া শেষ। তুই কি কলেজে যাবি?”
“আজ উমা যাবে না রাজী, তুমি একাই চলে যাও। আমি গোপালকে স্কুলে দিয়ে আসবো।“

কথার মাঝেই রুদ্র কথাটা বলে উঠে। উমা কিছু বলে না, শরীরটা সত্যি ই চলছে না। আজ কলেজ যাবে না সে। খাওয়া শেষে উমার কপালে উষ্ণ পরশ দেয় রুদ্র, ধীর স্বরে বলে,
“ব্যস্ততা না থাকলে যেতাম না, কিন্তু যেতে হবে কাজ আছে জানোই। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।“
“মিনু আছে তো, চিন্তা করবেন না”

রুদ্র, গোপাল এবং রাজশ্বী একত্রে বেরিয়ে পড়লো। উমা মিনুকে ডেকে বললো,
“টেবিলটা গুছিয়ে দাও মিনু”
“খাবার কি এখন ই দিবো দিদি?”
“একটু পরে দিও, খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার পড়াশোনা কতদূর?”
“পড়াশোনা তো ভালো মতোই চলছে দিদি, শুধু অক্ষরে গন্ডগোল খানা বাধছে। স্বর অ আর স্বর আ গুলিয়ে ফেলছি।“
“বাহ গোড়াতেই গলদ বানিয়ে বলছো ভালো চলছে। এ মাসে অক্ষর পার হওয়া হবে না। বিকেলে বই নিয়ে বসো। সারাক্ষন টিভি দেখলে হবে? ডিশলাইন কেটে দিবো ভাবছি।“

মিনু মাথানিচু করে নিলো। সত্যি সে টিভি দেখতে খুব ভালোবাসে। নতুন ডিশলাইন নেবার কারণে তার টিভি দেখার মাত্রাটা বেড়ে গেছে। উমা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“যাও কাজগুলো করে নাও। আমি উপরে গেলাম”

উমা নিজের রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। শীতল বাতাসে চুল উড়ছে সে। সালটি ২০০৮, পৌষের প্রথম দিন। দেখতে দেখতে চারটি বছর কেটে গেছে। তার এবং রুদ্রের বিয়ের ও চারটি বছর কেটে গেছে। চার বছরে অনেক কিছু বদলেছে, বদলেছে উমাও; প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে সে আরোও শক্ত হয়েছে, হয়েছে আরোও আত্নবিশ্বাসী। বর্তমানে সাতক্ষীরা কলেজে প্রানীবিজ্ঞানে অনার্স করছে সে। তার ডাক্তার হওয়াটি আর হলো না। ইচ্ছে তো ছিলো, কিন্তু ভাগ্য হাল ছেড়ে দিলো। অবশ্য এতে উমার আফসোসটি নেই। কারণ সে দৃঢ় প্রকল্প নিয়েছে জ্ঞানের অন্ধকার এই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সরাবেই। একটি কল্যান সংঘঠন নির্মান করে গতবছর সিডরের পর। মানুষের কাছে সাহায্য, শিক্ষা, কর্মস্থলের খোঁজ নিয়ে সে যায়। নাম “ধরনী কল্যান সংঘঠন” অবশ্য এই বুদ্ধিটা রুদ্রের ই ছিলো। রুদ্রের সাহায্য উমা এগিয়ে যাচ্ছে। আজ তার সংঘঠনের সাথে অনেক নারী, পুরুষ, বাচ্চা জড়িত। মিনুও তাদের ই একজন। সিডরের প্রকোপে তার বাবা মারা যায়, লোকটি একজন কাঠুরে ছিলো। মা তো আগ থেকে যমের কাছে ছিলো। এগারো বছরের মেয়েটিকে উমা পায় সংঘঠনের মাধ্যমে। তার যাবার জায়গা ছিলো না বলে সে নিজ গৃহে আশ্রয় দেয়। রাজশ্বী এবং গোপাল উমার সাথেই আছে। রতী গত হয়েছে তিন বছর হয়েছে। কেউ তাকে হত্যা করেছে, কিন্তু খুনীর খোজ মিলে নি। রুদ্র রাজশ্বী এবং গোপাল কে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে।  রুদ্রের ব্যাবসা বড় হয়েছে। তত্ত্ববধায়ক সরকার আসার রাজনীতির অবস্থা পালটে গেছে। অহেতুক কারণে রকিবুল মাষ্টারকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ও কয়েকবার জেলে গিয়েছেন, কিন্তু তার পরিচিতির কারণে তাকে আটকে রাখতে পারে নি। রুদ্র এর রাজনৈতিক কোনো ছাপ না থাকায় সে বেঁচে গেছে। তবে সামনের বছরের মাঝামাঝিতে পুনরায় আবারো নির্বাচন হবে, রুদ্র সেটার জন্য প্রস্তুত। এবার অদ্ভুত ভাবে বাপ বেটার মধ্যে যুদ্ধ হবে, অভিনব সিংহ পৌরসভার মেয়র পদের জন্য দাঁড়াবেন। এবং তার বিপরীতে রুদ্র দাঁড়াবে। এই চার বছরে অনেক কিছুই জানতে পেরেছে উমা। বাবা ছেলের ভেতরের যুদ্ধ ও তার জানা, রুদ্র ও বাড়িতে যায় না তেমন। যদি দরকার হয় লক্ষী দেবীকে এ বাড়ি নিয়ে আসে। গোপিনাথপুর আর আগের মতো নেই। অনেক বদলেছে। কালীগঞ্জ ও বলদেছে অনেক। উমা অতীতের খেয়ালে ডুবে ছিলো ঠিক তখন ই তার মোবাইলটি বেজে উঠে। এখন মোবাইল ফোন সকলের হাতে চলে এসেছে। বেকার যন্ত্রটি এখন কাজ করে। উমার কাছেও একটি আছে। উমা মোবাইল ধরতেই শিউলী বলে উঠে,
“উমা, আজ আসবি অফিসে?”
“শরীরটা ভালো লাগছে না শিউলী আপা। আজ বাসায় ই থাকবো ভাবছি”
“তুই আসলে ভালো হতো, জরুরী দরকার ছিলো”
“কেনো কি হয়েছে?”

শিউলির ব্যাকুল কন্ঠে ভ্রু কুচকে আসে উমার। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্নটি করে সে। শিউলি তখন ধীর স্বরে বলে,
“শিল্পীর জামাই আবার ওকে মেরেছে”

কথাটি শুনতেই চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে যায় উমার। শিল্পী নামক মেয়েটি তাদের সংঘঠনেই কাজ করে। বেশ ভালো কাথা সেলাই করে সে। সেগুলো রুদ্র শহরে পাঠায়। মেয়েটির বর কিছুদিন পর পর প্রহার করে তার উপর। উমা অনেকবার মেয়েটির বরকে বুঝিয়েছে কিন্তু শোনার ইচ্ছে ই রাখে না সে। উমা ধীর স্বরে বলে,
“আমি বিকেলের দিকে আসছি”
“ঠিক আছে”

শিউলি ফোনটি রেখে দিলো। শিউলী রকিবুল মাস্টারের মেয়ে। এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। সে এই সংঘঠনের সেক্রেটারি। উমার সাথে সেও “ধরনী কল্যান সংঘঠন” তৈরিতে সাহায্য করে। তাই এই সংঘটনের সেক্রেটারী হিসেবে সে কর্মরত। উমা ফোন রেখে আকাশের দিকে তাকালো। মিহি বাতাসে তার চুল ঊড়ছে। চোখে দৃঢ় প্রতীক্ষা। আজ একটা শেষ দেখেই ছাড়বে সে। 

শাশ্বত সংবাদপত্রের অফিসে বসে রয়েছে। তার প্রমোশন হয়েছে, এখন সে সিনিয়ার রিপোর্টার। কিন্তু ঢাকায় তার যাওয়া হয়। এই সাতক্ষীরার অফিসেই তার কাজ। মামামশাইকে একেবারে বসিয়ে দেবার পরিকল্পনায় ছিলো সে। কিন্তু পারে নি, মামার পরিচিতির কারণে। উলটো সে এবার পৌর মেয়রের পদে দাঁড়াচ্ছে। রুদ্র তার প্রতিপক্ষ। এই চারবছরে বাপ ছেলের বেশ কবার দ্বন্দ ই হয়েছে। অভিনব সিংহের চোরাকারবারি প্রায় ধরা পড়েই গেছিলো। কিন্তু একটুর জন্য বেচে গেছেন তিনি। সময় থাকতে থাকতে সব ব্লাক মানি সরিয়ে ফেলে অভিনব সিংহ। মজার ব্যাপার, শাশ্বতের কাছে এখনো বেনামি খাম আসে। খামে অভিনব সিংহের অপকীর্তির সব প্রমাণ থাকে। কিছু কিছু ধরতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু থেকে মুক্তি পেয়ে যায় সে। আজও একটি খাম এসেছে শাশ্ব্তের কাছে। খামটি টেবিলেই আছে। শাশ্বত এখনো জানে না খামগুলো কে পাঠায়। এর কারণ উমার সংগঠন। তাই সবাই চাইছে যেনো এবার রুদ্র পৌর মেয়র হোক। রুদ্রের বৈভব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপারটা সন্দেহ জাগাচ্ছে শাশ্বতের মনে। কিন্তু প্রমান পাচ্ছে না। শাশ্বত চিন্তা ছেড়ে খাদি খামটি হাতে নিলো। খামটি খুলতেই তার চোখ কুচকে আসলো, বেশ কিছু পেপার কাটিং। কাটিং গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো শাশ্বত। তাতে লেখা,
“দারোগা উত্তম চ্যাটার্জির কাটা দেহ পাওয়া গেলো রেললাইনের ধারে……………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন