বন্ধন - পর্ব ১৯ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩৭!! 

তিয়াশ কয়েক সেকেন্ড ওয়েট করে আবার তিথির নাম ধরে ডাকলো। এবারও তিথির কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তিয়াশ দরজাটা খুলে তিথির রুমে ঢুকে পড়লো। তিথিকে বিছানায় বসে থাকা দেখে বুক চিরে একটা নিঃশ্বাস বের হলো তিয়াশের। তিয়াশ রুমের দরজাটা লক করে দিয়ে তিথির সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে তিথির মুখটা তুলে ধরলো। তিথি তখনো কাঁদছে আর কেঁপে কেঁপে উঠছে একটু পর পর৷ তিয়াশ যত্ন করে তিথির চোখ মুছে দিয়ে উঠে তিথির পাশে বসলো৷ আলতো করে তিথিকে বুকে চেপে ধরলো। পিচ্চিটার মনটা খারাপ দেখে তিয়াশের নিজেরই সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কি যে করবে পাগলিটার মন ভালো করতে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না তিয়াশ। তিথি অনেকক্ষণ পর তিয়াশের কাছ থেকে সরে এলো। তিয়াশ ভ্রু কুঁচকে তিথির দিকে তাকালো। তিথিকে কাছে টেনে নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই তিথি বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তিথির এই কাজকর্ম সবটাই তিয়াশের মাথার উপর দিয়ে গেল। মেয়েটার মাথায় কি চলছে কে জানে। তিয়াশ তিথির একেবারে সামনে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো তিথির৷ তিথি মুখ নিচু করেই সরার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

-তিথু? কি হয়েছে পিচ্চি? এমন করছো কেন?

-আপনি এখানে কেন এসেছেন এখন? বাইরে বৌভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। যান সেখানে--। এখন কেউ এসে দেখলে----।

-এই তাকাও আমার দিকে? আমি আসবো না তো কে আসবে শুনি? হুম? আর আমি একা যাবো নাকি? তুমিও যাবা সাথে---।

-ছাড়ুন--। আমি যাবো না বাইরে--। আপনি যান---।

-তিথি? তাকাও তো আমার দিকে? কি হয়েছে? তাকাও না কেন? এই?

-আপনি যান তো---৷ খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হলে ভাইয়া আর ভাবি আপনাদের বাড়ি যাবে--। আপনি খেয়ে নিন এখন---। 

-তাকাতে বললাম না তোমাকে?

-ছাড়ুন--। ব্যথা পাচ্ছি---।

-ইশ! কোথায় লেগেছে দেখি?

-উফফফ--। যান তো-। ছাড়ুন-। এমন সাপের মতো পেঁচিয়ে রেখেছেন যে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে----। 

-কি? আমাকে সাপ মনে হয় তোমার? সেটা বোঝাতে চাইছো এখন তুমি?

-যা ইচ্ছে ভাবুন--। যান এখন এখান থেকে--। আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ লিভ মি এলোন।

-ওকে---। থাকো তুমি----। 

তিয়াশ রাগ দেখিয়ে তিথিকে ছেড়ে দিয়ে দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় ধুম করে দরজাটা এমনভাবে ধাক্কা দিয়ে গেল যে দরজাটা একবার বন্ধ হয়েই আবার খুলে গেল। তিথি দরজাটা আর বন্ধ না করেই ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো। চোখের পানিতে সব ঝাপসা লাগছে। তবু সমানে কাঁদছে তিথি৷ মানুষটার থেকে যে করেই হোক দূরে যেতেই হবে ওকে। অন্তত ভাই ভাবির জন্য হলেও তিয়াশের সাথে এখানেই সম্পর্কটার ইতি টানতে হবে৷ বাসায় ওদের ব্যাপারে জানাজানি হলে তো সবচেয়ে বেশি ইফেক্ট আয়ান মায়রার উপরেই পড়বে। আরিয়ান হয়তো ঠিকই বলেছে হয়তো তিথির জন্যই ওর ভাইয়ের সাজানো সংসারটা নষ্ট হবে? না না। তিথি এটা কিছুতেই হতে দিবে না। 

তিথি এসব ভাবতে ভাবতেই হুঁশ হলো কেউ পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েছে ওকে। চোখ মুছে তাকাতেই তিয়াশকে দেখে চমকে গেল তিথি। তিয়াশ ভ্রু নাচিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে তিথিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পাশে বসলো। তিথি থতমত খেয়ে তিয়াশকে দেখলো কিছুক্ষণ। তিয়াশ তিথির হাত ধরে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে কোথায় ব্যথা পেয়েছে। তিথি তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে গেল। তিয়াশও ভ্রু কুঁচকে তিথির মুখের দিকে তাকালো।

-আরে? কি সমস্যা তিথি?

-তুমি! তুমি তো চলে গেছিলে?

-হ্যাঁ। গেছিলাম তো--। স্যাভলন আনতে--। বললা না ব্যথা পাইসো? কোথায় লেগেছে দেখাও।

-তুমি!

-হ্যাঁ রে বাবা আমি। আসো এখন?

-তুমি এলে আমি টের পাইনি কেন?

-যেমন পড়ে পড়ে কাঁদছিলে টের পাবা কেমনে? আমি আসলাম৷ দরজা লক করলাম--। তারপর না তোমাকে----।

-তুমি যাও না প্লিজ?

-বেশি কথা বলবা না বুঝসো? তোমাকে কিভাবে চুপ করাতে হয় সেটা আমার ভালোই জানা আছে জান---।

-তোমাকে আমি------।

তিয়াশ তিথির হাত ধরে টান দিয়ে কোলে বসিয়ে নিলো। বাম হাতে শক্ত করে তিথির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে ডান হাতে তিথির চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মুখটা তুলে ধরলো। তিথি তিয়াশের স্পর্শে চমকে উঠে ছোটার জন্য আরেকবার চেষ্টা করলো। কিন্তু পর মূহুর্তেই বাম কাঁধে তিয়াশের ঠোঁটের স্পর্শে একেবারে শক্ত হয়ে গেল তিথি। তিয়াশের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়া জায়গাটায় চিনচিনে জ্বালা করলেও ভিষণ ভালো লাগলো তিথির। তিয়াশ তিথির মুখটা একটু তুলে দিয়ে চোখে চোখ স্থির করলো। 

-একটু জ্বালা করবে সোনা। কেমন? 

-হুম?

-সম্ভবত সেইফটিপিনের ঘষায় ছিলে গেছে অনেকখানি-। আমি স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি-। কিচ্ছু হবে না---।

-হুম-----।

তিয়াশ আলতো করে তিথির কাঁধে স্যাভলন লাগিয়ে দিয়ে ফুঁ দিয়ে দিলো। তিয়াশের চেহারা দেখে তিথির মনে হচ্ছে তিথির নয় তিয়াশেরই ব্যথা লাগছে। তিথি মুচকি হেসে মুখ নামিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেই তিয়াশ তিয়াশ তিথির মুখটা তুলে ধরে কপালে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলো। 

-ড্রেসটা পাল্টে নাও পিচ্চি। উমমম। একটা শাড়ি পড়ো নাহয় এখন--। তবে সেইফটিপিন লাগাতে হবে না। 

-আমি তো ওভাবে শাড়ি পড়তে পারি না--। ইনফ্যাক্ট আমি শাড়িই পড়তে পারি না---। 

তিয়াশ তিথির কোমড় ধরে আরেকটু কাছে টেনে নিলো। 

-আমি পড়িয়ে দিই?

-হুম? কি! অসভ্য লোক একটা!

-এমন করো কেন? দেই না প্লিজ?

-হুম? আচ্ছা----। 

-তুমি ওয়াশরুম থেকে চেইঞ্জ করে আসো লেহেঙ্গাটা। আর কি কি পড়ার পড়ে এসো---। আমি আছি এখানেই--।

-হুম---। 

তিথি বেশ কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে চেইঞ্জ করে এলো। তিয়াশ আলতো করে তিথির কোমড় জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো খেল। 

-আর কোথাও লেগেছে পিচ্চি বউটা?

-উহুঁ-----। 

তিয়াশ তিথিকে আলতো হাতে একটা লাল জর্জেটের শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে আর একটু পর পর আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসছে৷ তিথির সেদিকে হুঁশ নেই। তিথি অপলকে তিয়াশকেই দেখে যাচ্ছে। কি করে এই মানুষটার থেকে দূরে থাকবে সেটাই তিথির মাথায় ঢুকছে না। একটু পরে তিথির হুঁশ হলো। তিয়াশ তিথির শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিয়ে মুখ তুলে তিথির ভাবুক মুখটা দেখে দুষ্টুমি করে তিথির পেটে নাক দিয়ে ঘষা দিলো। তিথি চমকে এক পা পিছিয়ে যেতেই তিয়াশ বসে থেকেই তিথির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নাভিতে ছোট্ট করে বেশ অনেকগুলো চুমো খেল। তিয়াশের ঠোঁটের ছোঁয়ায় তিথি কেঁপে উঠছে বারবার। তিয়াশ উঠে দাঁড়িয়ে তিথির মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো।

-আমার পিচ্চি বউটাকে সত্যি সত্যি একদম নতুন বউ লাগছে--। ইচ্ছে করছে এখনি বিয়ে করে ফেলি--। ইশ! শাড়িটা পড়ানো একদমই ঠিক হয়নি---।

-কে-কেন? বিশ্রি লাগছে দেখতে?

-ইশ!

তিয়াশ আলতো করে তিথির ঠোঁটে কামড় দিলো। নাকে আলতো করে নাক ঘষে দিয়ে হাসলো। 

-কতোটা আবেদনময়ী লাগছে সেটা তো বুঝবা না--। বুঝো তো খালি উল্টাপাল্টাগুলা--। সাহস কতো আমার বউকে নাকি বিশ্রি লাগছে বলে? আর কখনো যদি এমন কিছু বলেছ না তাহলে একেবারে ঠোঁটটা কামড়ে----।

-আচ্ছা? একটা কথা বলো তো? আমাকে সত্যিই কি তোমার সাথে মানায় না? বেশি বাচ্চা বাচ্চা লাগে?

তিয়াশ তিথিকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো।

-দেখো তো? মানাচ্ছে না আমাদেরকে? সুখি দম্পতি লাগছে চেয়ে দেখো একবার---। 

-কিন্তু-----?

তিথির কথাটা আর শেষ হলো না। তিয়াশ আয়নায় তিথিকে দেখছে আর তিথির সাথে দুষ্টুমি করছে। কানের লতিতে কামড়ে বসাচ্ছে কখনো, কখনো ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে, আবার কখনো গালে মুখে পিছন থেকেই চুমো খাচ্ছে। তিথি কোনমতে তিয়াশের সামনে থেকে সরে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো৷ তিয়াশও তিথির সিরিয়াস মুখের দিকে তাকালো। দুষ্টুমি না করে শোনার চেষ্টা করলো মেয়েটা কি বলে। তিথিও কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তিয়াশের মুখের দিকে তাকালো।

-তবুও তোমার পাশে তো মেচিউর কাউকে মানায় বলো? অন্তত আমার মতো পিচ্চি কাউকে না।  আরেকটু লম্বা, স্মার্ট-। আমি তো আসলেই ঠিক খাপ খাই না----৷ 

তিয়াশ আর কিছু না বলেই হেসে তিথির কোমড় ধরে উঁচু করে নিজের মুখ বরাবর করলো। তিথি চমকে উঠে তিয়াশের গলায় হাত ঝুলালো। 

-কি! কি করছো? নামাও?

-আমার জন্য তুমিই পারফেক্ট বুঝসো? আর তোমার থেকে মেচিউর কাউকে দিয়ে কি করবো বলো? আমার তো এই পিচ্চিটাকে ভালো লাগে ভিষণ। খুব ভালোবাসি এই বাচ্চা মেয়েটাকে। তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে তুমি যখন একেবারে বুকের ভিতরে গুটিশুটি হয়ে থাকো তখন তো আমার বুকটা শান্তিতেই ভরে থাকে-। এর বেশি খাপ খাওয়ানো কাউকে তো চাই না বউটা--। এই তিথি? আমার পিচ্চি বউ হবা প্লিজ? প্রমিস করছি প্রতিদিন ভোর ভোর উঠে এত্তোগুলা আদর দিয়ে ঘুম ভাঙাবো--। তুমি যখন সেদিনের মতো ময়দায় মাখামাখি হয়ে রান্নাঘরে বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তখন হুট করে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে গালে গাল ঘষে দিয়ে সেই ময়দা নিজের গালে মাখিয়ে নিবো। আর রাগ করে তুমি কথা না বললেও শক্ত করে জড়িয়ে রাখবো বুকের ভিতরে। আজীবন পাশে থেকে আরো বেশি বেশি জ্বালাতন করবো--। হবা আমার পিচ্চি দুষ্টু বউটা?

-কিন্তু? কিন্তু বাসায় যদি না মানে? ভাইয়া, ভাবি, মা, বাবা---।

-আরে পাগলিটা! সেসব কোনো চিন্তা করো না। সেই দিকটা সামলানোর দায়িত্বটা আমার উপরে ছেঁড়ে দাও-। তুমি একবার রাজি থাকলে আমি-।

-আমি রাজি-। আমি তোমার বুকে মাথা রেখে শান্তিতে মরতে চাই।

-তিথি? আলতু ফালতু কথা বলতে হয় সবসময়?

-না--সত্যি-। আমি সত্যি চাই তোমার বুকে--।

-ধ্যাত---। এতো সুন্দর মুডটাই নষ্ট করে দিলো মেয়েটা-----।

-আরে!

তিয়াশ তিথিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তিথি জিভ কেটে তিয়াশের পিছন পিছন ছুটলো। মানুষটা যেভাবে রাগ করেছে কি যে আছে কপালে কে জানে! মায়রারা ও বাড়িতে ফেরার আগে যে করেই হোক মানুষটার রাগ ভাঙাতে হবে। যে করেই হোক।

৩৮!! 

বৌভাতের অনুষ্ঠানে আয়ানের সব আত্মীয়রা এসে মায়রাকে দেখে যাচ্ছে। কেউ এটা ওটা গিফ্ট দিচ্ছে। কেউ হালকা কথাবার্তা বলছে। আর মায়রাও হেসে তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে। আয়ানের ভিষণ ভালো লাগছে দেখতে। মেয়েটার হাসিমাখা মুখটা দেখে অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে আয়ানের। মায়রাও একটু পর পর আয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। তাই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে একটু পর পর৷ আয়ান মায়রার পাশে স্টেজে এসে বসলো। হালকা মাথা নিচু করে মায়রার দিকে চোখ নাচালো।

-এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কি দেখো? এতো দেখতে মন চাইলে চলো---।

-কই--কিছু দেখছি না তো---।

-আহা! আমি যেন টের পাই না? কেমন কেমন করে তাকাও আমার দিকে৷ আমার মতো সুইট একটা ছেলের দিকে এভাবে তাকাতে তোমার লজ্জা নাও করতে পারে, তবে আমার ভিষণ লজ্জা করে--।

মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের কোলের উপরে হাতে হাত রেখে নখ খুঁটতে লাগলো। লোকটা এসব কি বলে! কথার কোন মাথামুন্ডু নেই! হুহ।

-মনে মনেও আমার কথাই ভাবা হয় তাহলে?

-আপনিও তো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন এভাবে--। তাতে লজ্জা পান না?

-ইশ! তোমাকে দেখছে কে? আমি তো আমার বউকে দেখছি। নিজের বউকে ১০০ বার দেখবো আমি। তোমার তাতে কি?

আয়ানের কথা শুনে মায়রা মুখ টিপে হাসলো। আয়ান আলতো করে মায়রার হাতে হাত রাখলে মায়রা মুখ তুলে আবার তাকালো আয়ানের দিকে। আয়ান দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে মায়রাকে দেখলো একটু। 

-আবার আপনি করে বললা তো? এর শাস্তি আজ রাতেই পাবা-। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ-।

বলেই আয়ান চোখ টিপে হাসলো মায়রার দিকে তাকিয়ে। মায়রা কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলো। এই মানুষটার সাথে কথা বললেই আবার কিছু একটা বলে ওকেই লজ্জা দিবে। এর চাইতে আপাতত চুপ থাকাই ভালো মনে হচ্ছে মায়রার। 

এদিকে তিয়াশ রাগ দেখিয়ে তিথির দিকে তাকাচ্ছেই না। তিথিও তিয়াশের আশেপাশে ঘুরঘুর করে একসময় শয়তানি হাসি দিয়ে অন্য দিকে হাঁটা ধরলো। তিয়াশ তিথির কাজকর্ম খেয়াল করলেও কিছু বললো না। একটু পরে তিথিকে দেখে তিয়াশের মাথাটা আরো খারাপ হয়ে গেল। তিথি হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে হেসে হেসে একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। তিয়াশ গিয়ে তিথির সামনে দাঁড়াতেই তিথি চুপ করে গেল। ছেলেটা তিয়াশের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকালে তিয়াশ তিথির দিকে চোখ গরম করে তাকালো। তিথি মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো।

-এক্সকিউজ মি প্লিজ? আমি একটু ওর সাথে কথা বলে আসছি আবার।

-ওকে তিথি---।

ছেলেটা অন্য দিকে যেতেই তিয়াশ তিথির হাত ধরে টেনে একপাশে নিয়ে এলো। আরো কয়েকজন এদিকে আসছে দেখেও হাতটা ছাড়ছে না দেখে তিথিই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। 

-আরে! কি করছ? উনারা দেখবে তো? ছাড়ো?

-দেখবে মাই ফুট---। তুমি এখন আমার সাথে যাবা----।

-কোথায়?

-আপাতত যেখানে গেলে তুমি এমন নাচানাচি করবা না কেউ আসছে বলে-----।

-ওহ! তুমি আমার রুমে যাও-। আমি আসছি-।

-বললাম না তুমি আমার সাথে যাবা?

-আরে এভাবে একসাথে দুজনই চলে গেলে সবাই কি ভাববে--?

-ধুত্তোর------। 

তিয়াশ রাগ করে তিথির হাতটা ঝটকা দিয়ে ছেড়ে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। তখনকার ছেলেটা এসে তিথির মাথায় ছোট্ট করে একটা গাট্টা মারলো।

-তুই কোনদিন নিজের কারণেই মরবি দেখিস-।

-হা হা--। থ্যাংকু ভাইয়া-। থ্যাংকু সোওওওওও মাচ। তুমি ভাবিকে নিয়ে ভাইয়া আর আমাদের নতুন ভাবিকে দেখে এসো--। আমি যাই।

-যা--। বিপদে পড়লে আমি কিন্তু নাই ভাই--।

-হি হি----।

তিথি তাড়াহুড়ো করে রুমে গেল। দরজার সামনে আসতেই তিয়াশ তিথির হাত ধরে টেনে রুমের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। 

-তোমাকে আসতে বলার পরও তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই ছেলের সাথে হাসাহাসি করছিলা? বেশি সাহস হয়েছে না তোমার? হ্যাঁ?

-একটু--। আমি কি করবো? তুমিই তো কথা বলছ না। আমার একা একা বোর লাগে না?

-তিথি?

-কি তিথি? নিজে রাগ দেখাতে পারবা আর আমি কারো সাথে একটু হেসেও কথা বলতে পারবো না?

-যাও বলো যাও। ওই ছেলের কাছেই যাও--। 

-হুম--। যাবোই তো--। তুমি একটা খারাপ। ও অনেক ভালো। আমাকে কক্খনো বকে না---।

তিয়াশ তিথিকে আরো জোরে দেয়ালে চেপে ধরলো। 

-কে ওই ছেলেটা? কি কথা বলছিলা এতো ওর সাথে? এতো হাসাহাসি কেন হ্যাঁ?

-শুনবা কি কথা হচ্ছিল? শোনো তবে---।

তিয়াশ অবাক হয়ে তিথির দিকে তাকাতেই তিথি মোবাইলের রেকর্ডিং থেকে একটা ভয়েস ওপেন করলো।

-কি রে তিথি? তুই উনার পাশে পাশে এমন ঘুরছিলি কেন? আর তোকেই বা এতো ইগনোর করছে কেন?

-আরে ভাইয়া বলো না৷ রাগ করেছে বজ্জাত লোকটা। 

-ওহো! তা কে রে? আমাদের ভবিষ্যৎ জামাই? হা হা হা--।

-হি হি--। হা হা। হ্যাঁ ভাইয়া৷ এতোক্ষণ পাত্তা দিচ্ছিলো না তো? এখন বোঝাবো মজা তারে আমি। হি হি। হা হা হা---।

-কি রে? তুই এমন পাগলের মতো হাসছিস কেন? উনি তো এমন লুক দিচ্ছে! আল্লাহ! বাঁচাও!

-হি হি---। বুঝুক মজা এখন--। হুহ।

-বইন এমন হাসা বন্ধ কর প্লিজ? তোর ভাবি দেখলে আমারে উল্টা লক্টায়া ঝাঁটাপেটা করবো বইন। প্লিজ প্লিজ?

-হা হা হা। হি হি। দারুণ আইডিয়া। হা হা হা--। তা বোনের জন্য একদিন ঝেঁটাপেটা খাইলা আর কি---।

-এএএহহহ। আমার এতো শহীদ হওয়ার শখ লাগে নি---।

তিয়াশ থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি মুখ কালো করে তিয়াশের সামনে থেকে সরার চেষ্টা করছে৷ তিয়াশ এমনভাবে দেয়ালে চেপে ধরেছে যে তিথি রীতিমতো ব্যথা পাচ্ছে৷ তবু কিছু বলছে না। শুধু সরার জন্যই ছটফট করছে। তিয়াশের একটু হুঁশ হতেই আলতো করে তিথির মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো। 

-সরি সরি? সরি পিচ্চি বউটা। সরি। আমি আসলে রাগের মাথায় কিসব বলে ফেলেছি বউটাকে--। সরি।

-লাগছে আমার।

-হুম?

-হাতে ব্যথা পাচ্ছি---। 

-ওপস---। সরি সরি----।

তিয়াশ সরে এসে তিথিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তিথির সামনেই ফ্লোরে বসে তিথির কোলে মাথা রাখলো। তিথি থতমত খেয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। মানুষটাকে রাগাতে দুষ্টুমি করেই করেছিল। কিন্তু রাগটা পড়ে যেতে যে মানুষটার মনে অনুশোচনা ভর করবে সেটা তো আর তিথি ভাবে নি৷ তিথি কি করবে ভেবে না পেয়ে তিয়াশের চুলগুলো নাড়াতে লাগলো চুপ করে। তিয়াশ মুখ না তুলেই আরো আয়েশ করে তিথির কোলের মধ্যে মুখ লুকালো। 

-তিথি? আমি খুব খারাপ তাই না? অহেতুক তোমার সাথে রাগ দেখাই, হুটহাট বিরক্ত করি-৷ আসলে বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কোনভাবেই হারাতে চাই না। তোমাকে হারিয়ে ফেললে সত্যি মরে যাবো বিশ্বাস করো---। 

-আরে! কি বলছ? আর তখন আমাকে ধমক লাগিয়েছ মরার কথা বলেছি বলে--। এখন নিজেই বলছ। হুহ--। আমি কিন্তু মানি না এসব।

-সরি পাগলিটা। এতোগুলা বকা দিয়েছি-। সরি?

-হুম--। এই? তুমি লাঞ্চ করে নাও না? ভাবিরা যাবে না আবার? তুমি কি না খেয়েই চলে যাবা নাকি! আজব!

-তুমি চলো---। খেয়ে এসে রেডি হও--। 

-ওমা! আমি কই যাবো?

-তুমিও যাবা আমাদের সাথে। এন্ড দ্যাটস ফাইনাল। মায়রা আর ভাইয়া কেউ থাকবে না এখানে। আর ঘরভর্তি তোমার এতো মানুষ। আমি আর কোন রিস্ক নিতে পারবো না বাপু---।

-হ্যাঁ? কিসের রিস্ক?

-অতো শত তোমার না বুঝলেও চলবে পিচ্চিটা। চলো খেয়ে এসে রেডি হবা। আমি আয়ান ভাইয়ার সাথে কথা বলে নিবো--। নো মোর আর্গুমেন্ট---।

-হুহ---। আচ্ছা ঠিক আছে। 

-পিচ্চিটা আমার---।

খাওয়া দাওয়া করে এসে তিথি শাড়িটা না বদলেই হালকা সাজগোজ করে নিলো। আবার মায়রার কাছে গিয়ে স্টেজে বসলো। তিয়াশ একটু পর পর তাকাচ্ছে দেখে তিথিও মায়রার পিছনে মুখ লুকাচ্ছে একটু পর পর। মায়রা বুঝতে পারলেও কিছু বললো না৷ তিয়াশও আয়ানের সাথে কথা বলেছে তিথির যাওয়ার ব্যাপারে। আয়ানও আপত্তি করে নি কোনো। পিচ্চিটার মুখে হাসিই বলে দিচ্ছে মেয়েটা কতোটা খুশি। তাই আয়ান আর কিছু না বলেই বাবা মাকে বলে এলো তিথিও ওদের সাথে যাবে। উনারাও কোন আপত্তি করলেন না। 

বিকেল পেরিয়ে আসতেই মায়রার বাবা মা আগের গাড়িতে করে চলে গেছে। আয়ান, মায়রা, তিয়াশ আর তিথি আয়ানের গাড়িতে করে যাবে। আয়ান মায়রাকে নিয়ে গাড়ির পিছনের সিটে বসার আগে তিয়াশকে চাবি ধরিয়ে দিলো। তিথি চোখ পিটপিট করে আয়ানের দিকে তাকালো।

-কি রে তিথুই? এমন ভাবে তাকাস কেন? সামনে বস?

তিথি আয়ানকে মুখ ভেংচি দিয়ে তিয়াশের পাশের সিটে বসলো।

-আসলে ঠিকই বলে--। বিয়ের পর ছেলেগুলো আসলেই বদলে যায়। আগে যে ছেলে কাউকে গাড়ির আশেপাশেই আসতে দিতো না, এখন সে গাড়ির চাবি সুদ্ধ আরেকজনকে দিয়ে দেয়--। কি কপাল!

-হা হা হা-। এখন গাড়ি চালালে তো অনেক কিছু মিস করতে হবে। আপাতত সেটা করতে চাচ্ছি না। 

আয়ানের কথায় মায়রা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ফিরে বাইরের দিকে তাকালো। আয়ান আলতো করে মায়রাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে একটু পর পর। মায়রা কেঁপে উঠছে আয়ানের সেই স্পর্শে। সামনের সিটে তিয়াশও ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে তিথিকে দেখছে৷ তিথি তিয়াশের দিকে ফিরে একটু পর পর ফানি ফেইস করছে। তিয়াশ শব্দ না করেই হাসছে তিথির পাগলামি দেখে। এভাবে পাগলামি করতে করতেই মায়রাদের বাড়িতে চলে এলো ওরা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন