২৭!!
-তোমার আর শওকত সাহেবের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় জানো নিরব? তুমি নিজের স্বার্থের জন্য এতোটা অন্ধ হয়ে গেছ যে নিজের পরিবারকেও ধোঁকা দিতে তোমার বিবেকে বাঁধে নি এবারও। আর শওকত সাহেব? উনি শুধু খান ইন্ডাস্ট্রিজের একজন এমপ্লয়ি হয়ে সেই দায়িত্বটা ভাই আর সন্তানের মতো পালন করেছে। বুঝলে না তো? মৌনি আপু হঠাৎ করেই তোমার সাথে আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার জন্য জেদ ধরে বসে নি। শওকত সাহেবের সাথে কথা বলেই আসল কালপ্রিটকে ধরতে মৌনি আপু এই কাজটা করেছিল। তখনও আপু একবারের জন্যও ভাবতে পারে নি যাকে সবাই আদর করে মাথায় তুলে রেখেছে সেউ এভাবে তাদের পিঠে ছুড়ি মারছে। আয়ারল্যান্ডে গিয়ে তোমার কাজকর্মগুলো মৌনির কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলেও শওকত সাহেবের কাছে নামটা প্রকাশ করতে পারে নি উনি। কারণ আর যাই হোক তুমি এই পরিবারেরই একটা অংশ ছিলে, এমন একটা পচা অংশ যা ধীরে ধীরে ক্যান্সারের মতো গ্রাস করতে চেয়েছিল পুরো খান ইন্ডাস্ট্রিকে। তাই না?
নিরব মায়ার দিকে আধ বোজা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের হাত দুটো জোড় করলো এবারে। চোখ জোড়া মেলে রাখতে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে নিরবের। রক্তের পয়জনের চেয়ে মৃত্যু ভয়টাই যেন বেশি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে নিরবের। একটু পর পর চোখ জোড়া আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ওর। তবু নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে সজাগ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। ঘুমিয়ে পড়লে তো তার কোনোমতেই চলবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে।
-মায়া? এবার তো আমি সব সত্যিটা বলে দিয়েছি বলো? এবার এন্টিডোটটা দাও প্লিজ? আর তো হাতে সময় নেই একদমই। প্লিজ?
-তোমার হাতে আসলেই খুব বেশি সময় নেই নিরব। তবে এন্টিডোটের কোনো দরকার নেই। আরে না না। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। তোমাকে খুন করার কোনো প্ল্যান নেই আমার। তোমার মতো একটা জানোয়ারকে শাস্তি দিয়ে নিজের বাকি জীবনটা জেলখানার অন্ধকারে কাটানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছেই আমার নেই। তবে আশা করি পুলিশ হেফাজতে বেশ ভালোই খাতির যত্ন হবে আজ তোমার। আর হয়তো সেই খাতিরের ঠেলায় তোমার পানিতে মেশানো আর ইনজেক্টড করা ঘুমের ওষুধের রিএকশ্যানের রেশ কেটে যাবে।
-হোয়াট! এতো বড় ধোঁকা! আমাকে ভয় দেখিয়ে সবটা স্বীকার করিয়ে নিতে চাইছ? কিন্তু আমি তো আদালতে গিয়ে একটা কথাও স্বীকার করবো না। আর কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারবে আমার বিরুদ্ধে?
-কষ্ট করে তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করার সময় কার আছে এখন বলো তো? সব তো নিজের মুখেই স্বীকার করে নিলে। সেটাই আপাতত আদালতে পেশ করলেই চলবে। বেশি কিছু করা----।
-হা হা হা। ভিডিও রেকর্ডিং করেছ? লাইভ জবানবন্দি? হা হা হা। আইডিয়াটা জোস বলতেই হবে। কিন্তু একটা গন্ডগোল করে ফেলছ। রেকর্ডিং এর সময় জাজ এটাও তো দেখবে তুমি কি করে আমাকে ইনজেকশন দিয়ে বাধ্য করেছ কথাগুলো বলতে। আর এটা বুঝতে মাননীয় আদালতের দেরি হবে না যে সাক্ষীর কনফেশন তৈরির সময় এমন জোর খাটাতে পারে, সে মিথ্যে একটা ভিডিও তো বানাতেই পারে। ইজন্ট ইট মিস মায়া?
নিরবের কথাটা একেবারে ফেলে দেয়ার মতোও নয়। মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তো সব সত্যটা ওর কাছ থেকে জোর করে স্বীকার করানো গেছে। কিন্তু এর পর? এই প্রমাণটুকু অমানুষটাকে শাস্তি দেয়ার জন্য আসলেই কি যথেষ্ট? মায়া এবারে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাতেই তিনিও কিছুটা ইতস্তত করলেন। আইনের মারপ্যাঁচে লোকটা যে সহজেই ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারে সেটা নিয়ে অফিসার নিজেও চিন্তিত। সবটা জানার পরেও শাস্তি হবে কিনা সে নিশ্চয়তা দিতে না পেরে নিজের উপরেই চাপা একটা ক্ষোভ হচ্ছে অফিসারের। কেন আমাদের বিচার ব্যবস্থা এতোটা দুর্বল? এতোটাই দুর্বল যে প্রমাণের অভাবে এসব দানবেরা রাজত্ব করে বেড়ায়, আর মিথ্যে সাক্ষীর জের ধরো কতো নিরাপরাধ লোককে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াতে হয়! আর কতোকাল আইনের এসব দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অত্যাচারী আরো বলবান হবে, আর নিরাপরাধ হবে আরো দুর্বল?
-বাট আই হ্যাভ এ কোশ্চেন মিস মায়া। এই বুড়ো সরি আই মিন আমার আঙ্কেল এখনো বেঁচে আছে কি করে বলুন তো? মৌনি আর আন্টি মারা যাওয়ার পর থেকেই তো একটু একটু করে ভুল ওষুধ দিয়ে আসছি। তবু এই কৈ মাছের প্রাণ লোকটা মরে না কেন? ভুল ওষুধ দিলে তিন থেকে ছয়মাসের মধ্যেই তো পরপারের টিকিট কাটার কথা। তাহলে এই বুড়ো বেঁচে আছে কি করে? এই মিস্ট্রিটা সলভ করবেন প্লিজ?
মায়া একবার আহমাদ খানের দিকে তাকিয়ে আবার নিরবের দিকে তাকালো। আপনাআপনিই মায়ার চোয়াল কিছুটা শক্ত হয়ে উঠলো। এই লোকটাকে এখানেই মেরে ফেলতে পারলে হয়তো শান্তি লাগত ওর।
-আপনার মতো মীরজাফর যেমন আঙ্কেলের আশেপাশে ছিল, ঠিক তেমনই শওকত সাহেবের মতো মীরমদন ও ছিল। যতটা সূক্ষ্মভাবে গোপনে আপনি আঙ্কেলকে ওষুধের নামে বিষ দিচ্চিলেন ঠিক ততটাই সাবধানে আঙ্কেলকে এই বিষের হাত থেকে বাঁচিয়ে এসেছেন উনি। শুধু আপনার কালো চেহারার মুখোশটা টেনে খুলে আনার জন্য একা শক্তি পাচ্ছিলেন না। তাই আজ সেই কাজটা আমরা সবাই মিলে করে দিলাম। আর হ্যাঁ। আপনি হয়তো ভাবছেন দু সপ্তাহ ধরে নিজ হাতে ওষুধ খাইয়ে দেয়ার পরেও আঙ্কেলের কিছু হলো না কেন। তাই না?
-হ্যাঁ সেটাই তো। আমি নিজের হাতে ক্যাপসুলগুলোর ভিতরে বিষাক্ত কেমিক্যাল রেখেছি। দুই আড়াই সপ্তাহের মধ্যে হার্ট ব্লক হয়ে মারা যাওয়ার তো কথা ছিল। সেটা হলো না কেন?
-মিস্টার নিরব আপনি যেমন কায়দা করে ওষুধে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে দিতে পারেন, তেমনি অন্য কেউও সেই ওষুধটা ফরেনসিক ইনকোয়ারিতে পাঠিয়ে তার জায়গায় আসল বিষ মুক্ত ওষুধ রাখতেই পারে। দু সপ্তাহের মধ্যে আপনাকে একদম রাজার আসন থেকে নামিয়ে জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে ফেলতে পারলে, এটা খুব বেশি কঠিন কাজ বলে তো মনে হয় না, তাই না?
-এসবের কলকাঠি তাহলে তুমি নাড়িয়েছ! কে তুমি হ্যাঁ? কে? দিয়ার ফ্রেন্ডই তো, রাইট? তোমাকেই যদি মৌনির মার্ডারে আমি না ফাঁসিয়েছি তবে আমার নামও নিরব-----।
নিরব কথাটা আর শেষ করতে পারলো না। তার আগেই একটা কাঁপা হাতের থাপ্পড় এসে ওর গালে আছড়ে পড়লো। নিরব চোখ গরম করে আহমাদ খানের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার মায়ার দিকে রাগী চোখে তাকালো।
-তোমাকে তো আমি দেখে নিবো মেয়ে। তোমার জন্য জীবনে এই প্রথম বার কেউ আমার গায়ে হাত তুললো। আর হাত তোলা লোকটা আর কেউ নয় স্বয়ং আঙ্কেল---।
-এই থাপ্পড়টা আপনার গালে আজ থেকে দশ বারো বছর আগে পড়লে হয়তো আজ মৌনি আপু আর আন্টি বেঁচে থাকতেন। আফসোস তখন কেউ আপনার এই ইনোসেন্ট মায়াবী মুখটার পিছনে লুকিয়ে থাকা শয়তানটাকে দেখতে পায় নি। আসলেই ঠিকই বলে জানেন তো, অমানুষগুলোও দেখতে ঠিক মানুষের মতোই হয়। তাই তাদের চিনতে পারা আসলেই কঠিন। যেমনটা আঙ্কেল চিনতে পারে নি তখন। আর সেই ভুলটার শাস্তি মৌনি আপু নিজের জীবন দিয়ে শোধ করে গেছে। কিন্তু মৌনি আপুর এই ত্যাগটা বৃথা যাবে না নিরব। শাস্তি আপনার হবেই। এমন শাস্তি যে আর কোনো নিরব এভাবে মাথা চাড়া দিতে উঠার কথা কল্পনা করলেও আপনার পরিণতির কথা ভেবে শিউরে উঠবে।
-হাহ! তাই নাকি? তা কে দিবে শাস্তি? তোমার এই আধো রেকর্ডেড ভিডিও দেখে কোনো পাগল জাজই আমাকে কারাদন্ড দিবে। আর ওষুধে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশানোর ব্যাপারটাও প্রমাণ করতে পারবে না।
-প্রমাণ করার তো দরকারও নেই। আপনাকে কোর্টে তোলার আগে আপনার যত ইল্লিগ্যাল বিজনেস আছে তাই পুলিশ বের করে ফেলবে। এই ধরুন ড্রাগসের ব্যবসা, চোরাই মদের ব্যবসা, বন্য প্রাণীর দামী চামড়ার চোরাচালানের ব্যবসা---।
-আর ব্যাস ব্যাস! ও মাই গড! নিজের এতো গোপন খবর তো আমার নিজেরও জানা নেই। আপনি জানলেন কি করে?
-কারো নাম থেকে আপনার দেয়া মিথ্যে কলঙ্কটাকে মুছতে এতোটুকু তো করাই যায়। আর এই খান এন্ড খানস কোম্পানির প্রত্যেক পরতে পরতে আপনার নামটা এমনভাবে মিশে আছে যে সেটা খুব কানে এসে লাগো বুঝলেন। অতিরিক্ত শো অফ করে সবাইকো নিজের আধিপত্য দেখাতে চাইলে যা হয় আরকি---।
-আই ফিল সো স্যাড ফর ইউ মিস মায়া। আপনার এতো সাধের প্ল্যানিং, এতো কষ্টের রিসার্চ সবই জলে ভেসে যাবে। ভাবতেই কষ্ট লাগছে। সমস্যা নেই। ছাড়া পেলেই সোজা দুই মিনিট নিরবের নিরবতা পালন করতে চলে আসবো। আপনার সাথে পরিচিত হওয়াও বাকি এখনো------।
-কনফিডেন্স ভালো মিস্টার নিরব। কিন্তু ওভার কনফিডেন্স শরীরের জন্য ভিষণ ক্ষতিকর। অফিসার? প্লিজ এই লোকটাকে নিয়ে যান। আর টলারেট করতে পারছি না এটাকে।
-ইট উইল বি ফান টু মিট ইউ এগেইন মিস মায়া। ওয়েট ফর মি ওকে? পালাবে না কিন্তু একদমই। শাস্তি হোক না হোক যখনই ছাড়া পাই না কেন তার পরদিন সকালে তোমার বাসার দরজার বাইরে আমাকে পাবে, এটা নিশ্চিত থাকো।
অফিসার নিরবের কলার চেপে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার সময় মায়ার দিকে তাকালো।
-মিস মায়া এই লোকটা যেন আর কখনো আপনার সামনে এসে দাঁড়াতে না পারে সেটার খেয়াল আমি রাখবো। আর আমাদের পুলিশদের একটা দোষ আছে বুঝলেন। যে কেইস কোনো আদালতে মিমাংসা করা যায় না, সেই কেইসটাকে আমরা নিজেদের মতো করে মিটিয়ে নিই। ইটস কলড এনকাউন্টার।
-হোয়াট! অফিসার? আর ইউ ক্রেজি? আমার এনকাউন্টার করার প্ল্যান করছ? জানো এই কথাটা বলার জন্য কি শাস্তি পেতে পারো তুমি? লিভ মি। আমি তোমাকে এতো টাকা দিবো যে বাকি জীবনটা আর এই পুলিশের চাকরি করতে হবে না। তোমার সন্তান, নাতি নাতনি সবাই পায়ের উপর পা তুলে খেলেও শেষ হবে না এতো সম্পদ দিবো তোমাদেরকে আমি----।
-বাংলাদেশের সব পুলিশ কিন্তু ঘুষ খেয়ে নিজের ঈমান বিক্রি করে দেয় না মিস্টার নিরব। আর টাকা থাকলেই যে বছরের পর বছর অন্যায় করে যাবেন আপনার সেই ভুল ধারণাটারও আজ অবসান ঘটবে। মিস মায়া? আশা করি কাল সকালে টিভিতে নিউজটা দেখতে পারবেন। আসছি আজকে। চলুন মিস্টার নিরব স্যার। সকালের আগে কিছু খাতিরদারি করি আপনার? পরে যেন কোনো মনোকষ্ট থেকে না যায় আপনার---।
-অফিসার--আমি এখনো আপনাকে বলছি। জীবন বদলে যাবে আপনার---।
অফিসার নিরবকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মায়া। ওর গায়ে হলুদের জন্য সাজানো প্যান্ডেলটা খুলে নেয়া হয়েছে। ঝিকিমিকি তারাবাতিগুলো নিভে গেছে। স্টেজটাও প্রায় অর্ধেক খুলে ফেলা হয়েছে। শুধু এই আঁধার গলিতে অযত্নে পড়ে আছে কাতার করে বেছানো চেয়ারগুলো। এরই একটা চেয়ারে থ হয়ে বসে আছে আহমাদ খান। তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে শওকত সাহেব, আহমাদ খানের ম্যানেজার। আর তাদের থেকে কিছুটা দূরে গলির ধুলোবালি ভরা রাস্তায় বসে আছে রাহাত। দুটো মানুষের জন্যই ভিষণ কষ্ট হচ্ছে মায়ার। আজকের একটা ঘটনা তাদের দুজনকেই পাঁচ বছর আগে থেকে পুষে রাখা একটা ভুল চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে। সত্যটা এতোটা নির্মম হবে কেউ ভাবতেও পারে নি তারা। কিন্তু নির্মম সত্যটা মেনে নেয়া ছাড়া আর কি ই বা করার আছে তাদের? স্মৃতির এই শেষ পরিণতির ঘটনা মায়ার জীবনেই বা কি প্রভাব ফেলবে কে জানে!
২৮!!
চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। তবু কারো যেন কোনো হুঁশই নেই। সারাদিনের এতো ক্লান্তির পর মায়ার শরীরটাও যেন অসাড় হয়ে আসতে চাইছে। কোনোমতে ক্লান্ত শরীরটা টেনে আহমাদ খানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এমন সময় শওকতের মোবাইলে কারো একটা কল এলো। শওকত সাহেব দু মিনিট কথা বলে আবার আহমাদ খানের কাছে ফিরে এলো।
-স্যার? অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিয়া ম্যাডাম বাসায় একা রয়েছেন। আমাদের এখন ফিরে যাওয়া উচিত।
শওকতের কথায় আহমাদ খানের যেন হুঁশ ফিরলো। দিয়া যে বাড়িতে একা কথাটা বেমালুম ভুলে গেছিলেন তিনি। এক সন্তানের ভাবনায় এতোই মগ্ন ছিলেন যে অন্য সন্তানেরও যে তাকে এই মূহুর্তে পাশে দরকার সেটা খেয়ালই ছিল না আহমাদ খানের। এবারে একটু ধাতস্থ হয়ে রাহাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আহমাদ খান। ছেলেটা এখনো থ হয়ে বসে আছে। কি ঘটছে না ঘটছে সেটার যেন হুঁশই নেই ওর। এবারে আহমাদ খান একটু নিচু হয়ে রাহাতের কাঁধে হাত রাখলো।
-রাহাত? তোমার কষ্টটা আমার চেয়ে এখানে বেশি কেউ বুঝবে না জানি। কিন্তু তোমাকে কি বলে শান্তনা দিবো সেই ভাষা আমার জানা নেই। পাঁচটা বছর অনেক সময় রাহাত। এতোগুলো দিন মৌনির জন্য অপেক্ষা করার পর আজ হঠাৎ করে ওর মৃত্যু সংবাদটায় তোমার ভেঙ্গে পড়াটা স্বাভাবিক। আমরা তবু জানতাম যে আমাদের মেয়েটা আর নেই এই পৃথিবীতে। তুমি তো তাও জানতে না। চোখের সামনে থেকে ধোঁয়াশাটা কাটতে পাঁচটা বছর লেগে গেল। আশা করি সব ভুলে নতুন করে জীবনটা শুরু করবে। আর আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করো। ও তো খুব ভালোবাসতো তোমাকে।
রাহাত কয়েক মিনিট চুপচাপ আহমাদ খানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। উনার বলা কথাগুলো রাহাত কানে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেটা বোঝাও যাচ্ছে না। রাহাত হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ালো। একটা পাগলাটে ভাব ফুটে উঠেছে রাহাতের চোখে মুখে।
-আঙ্কেল স্মৃতির কবরটা কোথায়? আমাকে একটু ওর কাছে নিয়ে যাবেন? আমি কিছুক্ষণ-----।
-অবশ্যই যাবো বাবা। এখন তো অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে নাহয় যাবো কেমন?
-কাল সকালে?
-হ্যাঁ। এখন বাড়িতে ফিরতে হবে। দিয়া, আমার ছোট মেয়ে, ও বাড়িতে একা আছে।
-ওহ আচ্ছা।
-একটা কথা বলি রাহাত। মৌনি চেয়েছিল বিয়ের পর ওর পুরো পরিবারের সাথে তোমার পরিচয় করাতে, সবাইকে সারপ্রাইজ দিতেই হয়তো---। মেয়েটা আর নেই। আমার ভাঙা সংসারে আমি আর দিয়া ছাড়া আর কেউ নেই। আগামী সপ্তাহে মেয়েটার বিয়ে। মৌনি থাকলে হয়তো এতোদিনে বাড়িটা মাথায় তুলে ফেলতো। হাহ। আমি খুবই খুশি হবো তুমি যদি দিয়ার বিয়েতে এ্যাটেন্ড করো। মৌনির বোন ভেবে নাহয় নিজের ছোট বোন ভেবেই নাহয় ওকে দোয়া করতে বিয়েতে একবারের জন্য হলেও এসো প্লিজ?
-দিয়া? আসবো আঙ্কেল। নিশ্চয়ই আসবো।
-আমি কালই তোমাকে কার্ড আর লোকেশন সবটা জানিয়ে দিবো। সময় তো হাতে নেই তেমন।
-জি আঙ্কেল।
-চলো? তোমাকে ড্রপ করে দিই?
-না আঙ্কেল। আমার কিছু কাজ আছে। আর বাবাও এখানেই কোথাও আছে।
-ওকে রাহাত। কাল দেখা হচ্ছে তোমার সাথে।
-আল্লাহ হাফেজ আঙ্কেল।
শওকতের হাত ধরে ধীরে ধীরে নিজেদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আহমাদ খান। আর ভাবছেন গত কয়েক ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে কতকিছুই না হয়ে গেল। যাকে এতোগুলো বছর সন্তানের মতো স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন আজ তাকে চোখের সামনে জেলখানায় পাঠাতে হলো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আহমাদ খান নিজের বাড়ির দিকে যাত্রা করলেন। রাহাতও ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে মায়ার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মায়াও নিজেকে সামলে নিয়ে রাহাতের মুখের দিকে তাকালো। লোকটার চোখেমুখে হারানোর বেদনাটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
-মায়া তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার। আমি কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দিবো---।
-আপনার ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য আমি কাজটা করি নি স্যার। এতো বছর ধরে সবাই ভেবে এসেছিল যে মৌনি আপু যাকে ভালোবাসত সেই উনার খুন করিয়েছে। আপনার ফার্মহাউজে মৌনি আপুর ছবিগুলো দেখে আর আপনার মুখে স্মৃতি নামটা শুনে, উনার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা শুনে আমি নিজের হিসেব মিলাতে পারছিলাম না। তাই নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতেই খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। উনাদের সাথে আমার পরিচয় ছিল তাই খোঁজ নিতে সুবিধা হয়েছিল। অবশ্য সত্যটা এতোটা ভয়ংকর হবে সেটা আমি ভাবতেও পারি নি।
-তুমি মৌনিকে কি করে চিনতে? বা ওর পরিবারের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক?
-সেসব নাহয় আপনার না জানাই থাক। তবে একটা কথা বলি স্যার। ভালোবাসলে যে বিশ্বাস করতে হয় সেই কথাটা আপনি বারবার ভুলে যান।
-মায়া---। আমি স্মৃতিকে অবিশ্বাস করি নি কখনোই---।
-হা হা হা। হাসালেন মিস্টার রাহাত। প্রথমবার মৌনি আপু যখন আপনাকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে উদাও হয়ে যায় তখনও কি সত্যিই আপনি উনাকে অবিশ্বাস করেন নি? আপনি ভেবেছিলেন স্মৃতি নামের একটা ধোঁকাবাজ মেয়ে আপনাকে ঠকিয়ে, অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেছে। বা ভেবেছেন আগে থেকেই ও প্ল্যান করেই আপনার অফিসে আপনার জীবনে এসেছিল তাই না স্যার?
-মায়া?
-এই ভুলটা হয়তো ক্ষমা করে দেয়াই যায় রাহাত। কারো জন্য অপেক্ষায় বসে থাকার পরও সে না আসলে কতরকম কথা, ভয় মাথায় আসে সেটা আমিও জানি। ধরে নিলাম সেই ভয় থেকেই আপনি অবিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা? আজ এতোগুলো বছর পর যখন জানলেন মানুষটা বেঁচে নেই, তখনও আপনি অন্য একটা লোকের কথায় আবার সেই মৃত মানুষটাকেই অবিশ্বাস করলেন। এই হলো আপনার ভালোবাসার নমুনা।
-মায়া হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে আমার মাথায়। মৌনি কেন নিজেকে স্মৃতি পরিচয় দিলো, ও আমাকে আগে থেকেই কি করে চিনত, কেনইবা এতো কিছু আমার কাছ থেকে লুকিয়েছিল-----।
-সেদিন আপনার দেয়া গিফ্টগুলো ফিরত দেয়ার পর যে সেগুলো একবারের জন্যও খুলে দেখেন নি সেটাই প্রমাণ হলো। অবশ্য খুলে দেখার কোনো কারণও যে ছিল না সেটা আমি এবারেও বুঝতে পারি নি। কতটা বোকার মতো ভুলভাল স্বপ্ন দেখে ফেলি----।
-আসলে কাজের চাপে জিনিসগুলো দেখার সময় হয় নি---।
-সেটা না পাওয়াই স্বাভাবিক। তবে ব্যাগে আপনার গিফ্টগুলোর সাথে আরেকটা জিনিসও ছিল। মৌনি আপুর ডায়েরি। আপু নাকি প্রতিদিন ডায়েরি লিখতো। উনার ডায়েরি পড়ার অধিকার তো আমার নেই, তাই যার অধিকার সবচেয়ে বেশি এই ডায়েরিটার উপরে তাকেই দিতে চেয়েছিলাম।
-হোয়াট! তুমি আমাকে বললে না কেন? তুমিও কেন সবটা গোপন করে নিলে আমার থেকে?
-হাহ্। সরি স্যার। ভুল করে ফেলেছি। পারলে ক্ষমা করে দিবেন। আর আপনার জীবনে আমার জায়গা কতোটুকু ছিল সেটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
-মায়া? আমি এভাবে কথাটা বলতে চাই নি। দেখো আমি জানি তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। ইউ নো ইউ ডিজার্ভ টু বি হ্যাপি।
-জি স্যার। আপনি আমার কতোটা ভালো চান সেটা আপনার প্রথম হলুদের ছোঁয়াটাই আমাকে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। আপনি ভাববেন না স্যার। আমি ভালো থাকবো। আপনাকে ভুলতে কষ্ট হবে হয়তো, কিন্তু আমি সবকিছু ভুলে সামনে এগিয়ে যাবো স্যার। আপনার সামনে এসে আর কখনো দাঁড়াবো না। প্রমিস।
-মায়া? আম' রিয়েলি সরি। আমি বুঝতে পারি নি দ্বীপ এমন চিপ মেন্টালিটির একটা লোক হবে--।
-বাদ দিন স্যার উনার কথা। যা হয়ে গেছে সেটা আর বদলানো যাবে না। সম্বন্ধটা তো আপনিও আনেন নি তাই আপনার এসব নিয়ে কষ্ট পেতে হবে না। আশা করি আজকের পর আর আমার কারণে কখনো আপনাকে বিব্রত হতে হবে না।
-মায়াবতী? দেখো আমি কখনোই তোমার কারণে বিরক্ত বা বিব্রত হই নি সেটা নিশ্চয়ই জানো তুমি? তাহলে এভাবে কেন বলছো বলো তো?
-জি জানি তো। বড় স্যার বোধহয় মায়ের সাথে কথা বলতে বাসায় গেছে। আমি স্যারকে বলছি আপনি অপেক্ষা করছেন উনার জন্য। আসছি স্যার।
মায়া রাহাতের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উল্টো ঘুরে নিজেদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। রাহাত মায়ার যাওয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। লাল পেড়ে হলুদ রঙা শাড়িটা গ্রাম্য ভঙ্গিতে পড়ানো হয়েছে মায়াকে। আঁচল টেনে ঘোমটা জড়ানোয় পিছন থেকে মেয়েটাকে কোনো মায়াবী রাজ্যের রাজকন্যা মনে হচ্ছে রাহাতের কাছে। ক্লান্ত পা ফেলে মায়ার রঙওঠা পুরোনো বাড়ির ভিতরে ঢুকে যাওয়ার দৃশ্যটাও রাহাত মন দিয়ে দেখলো। যেন কিছু হারানোর বেদনা বুকে চেপে পরাজিত সৈনিকের মতো নিজের আস্তানায় ফিরেছে মায়া। মায়ার মুখের দিকটা দেখতে পেলে হয়তো মেয়েটার চোখের অশ্রুবন্যাটাও চোখে পড়তো রাহাতের। কিন্তু সেটা আর হলো না। মায়া বাড়ির ভিতরে ঢুকে যেতেই রাহাত গলির সাজের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মায়ার গায়েহলুদের জন্য সবাই মিলে ঘটা করে গলিটাকে ভরিয়ে দিয়েছিল আলোয় আলোয়। সেই আলোটাও এখন নিভে গিয়ে চারদিকের অন্ধকারেও কেমন একটা গুমোট ভাব এসেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কেমন ভূতুড়ে দেখতে লাগছে জায়গাটা। কয়েক ঘন্টা আগের এতো আলো, এতো আয়োজন সব যেন নিমিষেই কোথায় হারিয়ে গেছে। শুধু পড়ে আছে খা খা শূন্যতা। ঠিক রাহাতের জীবনের মতো। এই নিকষ কালো অন্ধকারটা ভেদ করে এক গুচ্ছ আলোক রশ্মি এসে চারপাশটা আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিবে না কখনই? কখন কি রাহাতের আলোহীন এই জীবনটাতে আলোর প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্ব নিয়ে আসবে না তার মায়াবতীটা? কথাটা ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাহাতের বুক চিরে। মায়াবতীটার কাছে তাকে ফিরতেই হবে সেটা রাহাত জানে। কিন্তু সে ফিরলেও মায়াবতী কি তখনও তাকে গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নটারও জবাব নেই আজ রাহাতের কাছে। শুধু আছে উত্তরটা জানার অপেক্ষা। দীর্ঘ অপেক্ষা।