বিরহের নাম তুমি - পর্ব ২৮ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


!!৭০!!

গান শেষ হওয়ার আগেই লাইভ কেটে দেয় আদিল। এতশত কমেন্টের উত্তর দেওয়ার সময় নেই এখন। তখনও স্থির দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল রাসেল। কী অদ্ভুত! হঠাৎ করে হলো কী তার? সে পেইজে গিয়ে দেখল কোনো আপডেট আছে কিনা। নেইতো! হুট করে ভূমি এখানে কোত্থেকে থেকে এলো? চিন্তা-ভাবনা সব বাদ দিয়ে ফোন ডেস্কের ওপর রেখে সোজা হয়ে বসে সে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। ভালো লাগছে না। তাই সে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য সুমির বাড়িতে যাবে। ভূমিকে নিয়ে ভাবার মতো সময় তার নেই।

!!৭১!!

ভূমি টিসএসসি থেকে ফিরে দেখে সূচনা পড়তেছে। সারাদিন মেয়েটা বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে। আচ্ছা ওর ভেতরেও কি অনবদ্য কোনো কষ্ট লুকিয়ে আছে, যেটা ভূমি জানে না? না হলে তো মেয়েটা এতটাও চুপচাপ গোছের ছিল না। বইগুলো টেবিলের ওপর রেখে সে ওয়াশরুমে চলে যায়।চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেসিনের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় তাকিয়ে দেখতে থাকে নিজের মুখটি। চোখের কোণে আবারও অশ্রু জমা হতে শুরু করে। সে আটকায় না সেই অশ্রুকে। রাসেলের জন্য তার ক্ষত-বিক্ষত মনটা নতুন করে পুড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। আজকাল সেও অভিনয় করতে শিখে গেছে। ভালো থাকার অভিনয়।

চোখে-মুখে আরও কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে সে রুমে ফিরে আসে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বসে সূচনার বিছানায়। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,'এত পড়ুয়া হলি কবে থেকে তুই?'
সূচনা একবার তাকিয়ে শুধু স্মিত হাসে। কী উত্তর আছে এই প্রশ্নের? সেও তার বোনের মতো ব্যস্ত থাকতে চায়। অল্প সময়ের সেই সুন্দর স্মৃতিগুলো ভুলে থাকতে চায়। আর তার ব্যস্ত থাকার জন্য পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছুই নেই।

'কী ভাবছিস?' প্রশ্ন করে ভূমি।
সূচনা দু'দিকে মাথা নাড়ায়। ইশারায় বোঝায়, সামনে পরীক্ষা তাই এত পড়ে। এবার ভূমি জিজ্ঞেস করে,'আদিলকে তোর কেমন লাগে?'
ভ্রুঁ কুঞ্চন করে তাকায় সূচনা। এমন প্রশ্ন যেন সে আশাই করেনি। ভূমি নিজেই বলল,'আজ নীলক্ষেতে ওর সাথে দেখা হয়েছিল। তোর নামে নালিশ করল। তুই নাকি নুসরাতের সাথে থাকলে অনেক হাসাহাসি করিস, আর ওর সামনে গেলেই গম্ভীর হয়ে যাস।'
সূচনা বিরক্ত প্রায়। আদিল ছেলেটা ভালো। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই ভালো। তবে তার অন্য কারও প্রতি কোনো অনুভূতি নেই। আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে, ভূমির সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটির পর সে আর কোনো ছেলেকে বিশ্বাসই করতে পারবে না। কে জানে কার মনের ভেতর কী আছে! রাসেলের মতো মুখোশধারী মানুষ তো অভাব নেই আমাদের আশেপাশে। খাতায় সে বিরক্ত হয়ে লিখল,'এসব কেন বলছিস আমায়?'
'আদিলই বলল,আমি যেন তোকে বলি। ওর সাথে ওমন করিস না।'
'আপু দেখ, উনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কালেভাদ্রে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয় এইটুকুই। উনি আমার ফ্রেন্ডের ভাই। যতটুকু সম্মান উনাকে দেওয়া দরকার আমি সেটা দেই। তাই বলে তো আর উনার সামনে সারাক্ষণ দাঁত কেলিয়ে হাসতে পারব না।'

শেষের লাইনটি পড়ে ভূমি হেসে ফেলে। বলে,'খুব রাগ দেখছি ওর ওপর? আমার কিন্তু আদিলকে খারাপ লাগেনি।'
'মানুষ চেনা বড়ো দায়। আমার প্রতি উনার একটা এট্রাকশন কাজ করছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আর মানুষ যে কতটা বিষাক্ত সেটা আমার চেয়ে তুই ভালো জানিস।'
ভূমি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। মনে মনে ভাবে,'তা আর বলতে!'
সে ব্যাপারে আর কোনো কথা বলল না। সূচনার যা ভালো মনে হবে তাই করবে। জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হয়। শুধু সে মনে মনে এটাই প্রার্থনা করে, তার মতো যেন সূচনার জীবনটা না হয়। একটা সঠিক মানুষই যেন ওর জীবনে আসে। সেটা আদিল হোক বা অন্য কেউ; তবে সঠিক মানুষ।

সে সূচনাকে বলল,'আচ্ছা বাদ দে এসব। পড় তুই।'
সূচনা আবার পড়ার প্রতি মনোযোগী হয়। ভূমি সাতকাহন বইটা নিয়ে বিছানায় পড়ে। প্রথম কয়েক পেজ পড়তে পড়তে সে বইয়ের মাঝে ডুবে যায়। কখনো কখনো আবার নিজের সেই শৈশবে হারিয়ে যায়। এর মাঝেও আবার হঠাৎ হঠাৎ তার রাসেলের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনই সবকিছু তার বিরক্ত লাগা শুরু করে। কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না। বইটা বন্ধ করে রেখে দেয়। এখন আর একটা লাইনও সে মন, মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবতে পারবে না। ফোনটা হাতে নিয়ে নোটপ্যাডে যায়। লিখতে শুরু করে নিজের জীবনের ঘটনা। কয়েক ঘণ্টা যাবৎ সে অনেক কিছুই লিখে ফেলে। কী মনে করে আবার সেই লেখাগুলো ফেসবুকেও পোস্ট করে। বেশিক্ষণ অনলাইনে না থেকে শুয়ে পড়ে। এপাশ, ওপাশ ফিরে ঘুম তো আর আসে না। আবারও বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর মনে পড়ে রাসেলের আইডিটা সার্চ করে একটু দেখবে। সে আবারও যায় ফেসবুকে। রাসেলের আইডি ঘাঁটতে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে বুকের ব্যথা। কী অসহনীয় যন্ত্রণা!

রাসেলের হাসি হাসি মুখটার দিকে সে অনেকক্ষণ যাবৎ তাকিয়ে থাকে। চোখ থেকে পড়তে থাকে নোনাজল। নোটিফিকেশনের শব্দে সূচনার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটছিল। সে ইশারায় বলে ফোন সাইলেন্ট করতে। ভূমি ফোন সাইলেন্ট করে নিউজফিডে ফিরে আসে। এসে দেখে কয়েক মিনিটেই ২০+ রিকোয়েস্ট। সে হকচকিয়ে যায়। এত রিকোয়েস্ট আসছে কেন হঠাৎ? তখন সে নিজের টাইমলাইনে যায়। তার ঐ পোস্টে লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের ছড়াছড়ি। সবাই জানতে চাচ্ছে পরবর্তীতে কী হয়েছিল। ভূমি কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকে। এসবকিছু তো তার ধারণারও বাইরে ছিল।

!!৭২!!

কুয়াশা আজ এতটাই ঘন যে সামনের কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে রয়েছে হাঁড় কাঁপানো শীত। আজ বোধ হয় আর রোদের দেখা মিলবে না। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সূচনা কলেজে যাওয়ার জন্য বের হয়। এত শীত পড়েছে বলে হয়তো আজ একটা রিকশাওয়ালাও নেই। তাদেরও তো একটু আরাম-আয়েশের প্রয়োজন আছে।

অবান্তর চিন্তা-ভাবনায় বুদ হয়ে হাঁটছিল সে। আস্ত একটা মানুষ যে তার খুব কাছাকাছি হাঁটছে, এটা সে খেয়ালই করেনি। দিব্যি নিজের মনে চিন্তা-ভাবনার আঁকিবুঁকি করে চলেছে। এবার আগুন্তুক লোকটি সূচনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলা খাঁকারি দিয়ে কাঁশে। ভাবনায় ছেদ পড়ে সূচনার। পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় আদিলকে। গায়ে কালো জ্যাকেট। ভেতরে সম্ভবত সাদা রঙের টি-শার্ট পরেছে। প্রতিবারের মতো এবারও সূচনার চোখে-মুখে বিরক্ত উপচে পড়তে লাগল। আগে আদিলকে দেখলে তার অস্বস্তি লাগত আর এখন বিরক্ত লাগে। এর কারণটাও স্পষ্ট। কারণ এখন সে জানে, আদিল তাকে পছন্দ করে। ভালোবাসে। তবে সে ভালোবাসায় বিশ্বাসী নয়। বিশ্বাস শব্দটি এখন আর তার জীবনের আনাচে-কানাচে কোত্থাও নেই। সে মনেপ্রাণে এটাই বিশ্বাস করে যে, প্রতিটা মানুষই পরিবর্তনশীল। আজ হোক বা কাল মানুষ বদলাবেই। তবে এর মাঝেও কিছু ভাগ্যবান আর ভাগ্যবতী রয়েছে যাদের ভালোবাসা সারাজীবন অটুট থাকে। তারা কখনো বদলায় না। তবে এতটা সুখ অন্তত সূচনার কপালে সইবে না, এতটুকু সে আন্দাজ করতে পেরেছে।

সূচনার সুন্দর মুখটুকুতে বিরক্ত ভাবটা বুঝতে পেরে মনে মনে বেশ আহত হয় আদিল। এত সকালে সে শুধুমাত্র সূচনার জন্যই ঘুম থেকে উঠেছিল। আধ ঘণ্টা যাবৎ অপেক্ষা করছিল ওর হোস্টেলের সামনে। মেয়েটার মন এত কঠোর কেন? সে কি ভালোবাসা বোঝে না নাকি বুঝতে চায় না? দুজনই হাঁটছে নিরবে, পাশাপাশি। আদিল আর চুপ করে থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,'আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?'

সূচনা কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায় না। সে এড়িয়ে যাচ্ছে আদিলকে। যতটা সম্ভব আরও বেশি এড়িয়ে যাবে। সে কোনো রকম মায়ায় জড়াবে না। ভালোবাসা নামক কোনো সম্পর্কে জড়াবে না। কোনো সম্পর্কই স্থায়ী নয়। মানুষ সারাজীবন এক রকম থাকে না। হয়তো বাকি সবার মতো আদিলও সূচনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমন পাগলামি করছে। এই পাগলামি বেশিদিন থাকবে না। ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো একদিন জয়ের মতো সেও দূরে চলে যাবে।

'আপনি আমাকে ইগনোর করছেন কেন?' আদিল পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল। সূচনার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে এবার সে পথ আগলে দাঁড়ায়। নিজের ফোনটি সূচনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,'আপনার সমস্যাটা কি আমায় লিখে জানান।'
সূচনা ফোনটি নিল। নোটপ্যাডে গিয়ে লিখল,'আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে। যেতে দিন।'
লেখা মনঃপুত হলো না আদিলের। সে বলল,'আমি যা জানতে চেয়েছি তা লিখুন।'
এবার সূচনা পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে আদিল হাত টেনে ধরে। বরফের মতো ঠান্ডা হাতটি সূচনার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরতেই তার বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে। জয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তবুও সে স্বাভাবিক থাকে। শান্তভাবে তাকায় আদিলের দিকে। চোখে চোখ রেখে আদিল বলে,'আপনাকে আমি ভালোবাসি আপনি জানেন? ঠিক এজন্যই কি আপনি আমাকে এড়িয়ে চলছেন? তাহলে শুনে রাখুন, আপনি যত খুশি আমাকে ইগনোর করুন তবুও আমি আপনার পিছু ছাড়ছি না।' 
এই বলে সে সূচনার হাত ছেড়ে দেয়। সূচনা আর সেখানে দাঁড়াল না। সরাসরি কলেজের ভেতর চলে গেল।

!!৭৩!!

ইদানীং বেশ ব্যস্ত সময়ই কাঁটছে ভূমিকার। সারাদিন অফিস, অফিস থেকে ফিরে একটু বই পড়া তারপর লেখালেখি করা। আগের আইডিটা ডিএক্টিভ করে সে নতুন আইডি খুলেছে। লেখালেখিটা চলছে নতুন আইডিতেই। নতুনভাবে জীবন চলার শুরু বলা যায়। অফিসেও তার বেশকিছু বন্ধু হয়েছে। মনকে রিল্যাক্স করার জন্য মাঝে মাঝে অফডে তে একসাথে হ্যাং আউটও করে। এতদিনে সে একটা তিক্তকর সত্যি এবং বাস্তবতা বুঝে গেছে যে, রাসেল আর তার নেই। হাজার চাইলেও সম্পর্কটি আর আগের মতো হবে না। আর এ সত্য মেনে নিতেই তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়। সারাদিন হাসি-খুশি থাকলেও এমন কোনো রাত নেই যে সে, কাঁদে না। তার এ বোবাকান্নার সাক্ষী রাতের নিস্তব্ধতা এবং বালিশ।

লেখালেখি করে অল্প সময়েই বেশ পাঠকমহল গড়ে তুলেছে সে। হয়তো এসব আল্লাহ্-র ইচ্ছেতেই। এখন তাকে অফিস করার পাশাপাশি লেখালেখি নিয়েও ভাবতে হয়। এখানে একটা প্লাস পয়েন্ট রয়েছে। মস্তিষ্ক এখন রাসেলকে নিয়ে ভাবার চেয়ে লেখালেখি নিয়ে ভাবাতে বেশি সময় দেয়। এতে তার মনের ওপর প্রেশার কম পড়ে। সারাদিন খাটাখাটি করে, আবার লেখালেখি এসব করতেই দু'চোখের পাতা বুজে আসে। এখন আর রাত হলেই তাকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয় না।

অফিসের একটা লিস্ট করছিল সে তখন তার ফোনটি বেজে ওঠে। হোয়াটসএপে এসেছে কলটি। অফিসেও ডাটা অন করাই থাকে। হাতের কলমটি ডেস্কের ওপর রেখে ফোন হাতে তুলে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে চির-পরিচিত নাম্বার আর ছবিটি দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে। অস্বাভাবিকভাবে তার হাত-পাও কাঁপছে উত্তেজনায়। এতদিন বাদে রাসেল কেন ফোন করেছে?
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন