মায়াবতী (পর্ব ০৭)


১৩!! 

রাহাত স্মৃতিকে নিয়ে ডাবলিন শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা বিশাল প্রাসাদের মতো ডুপ্লেক্স বাড়ির গেইট দিয়ে ঢোকার সময় স্মৃতির মুখের দিকে তাকালো। এত বড় বাড়িটা দেখে মেয়েটার চোখেমুখে কোনো কৌতূহল, আগ্রহ বা খুশি কিছুই দেখতে না পেয়ে নিজেই কিছুই অবাক হলো রাহাত। বাড়ির গেইটে কোনো দারোয়ান নেই। গেইট সবসময় খোলা থাকে বলে দারোয়ান নিজের ছাউনির মতো ঘরটাতেই বসে থাকে। রাহাত এবারে গাড়ি নিয়ে সোজা বিশাল বাড়িটার গাড়ি বারান্দায় এসে থামতেই স্মৃতি চোখে মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। রাহাতও নেমে এসে স্মৃতির লাগেজটা নিয়ে পাশে দাঁড়াতেই স্মৃতি রাহাতের দিকে তাকালো।

-কোথায় বলুন তো মিস্টার রাহাত?

-কি কোথায়? বুঝলাম না।

-আরে আপনার কুঁড়েঘরটা কোথায় সেটা জানতে চাচ্ছি। আশেপাশে কোথাও তো দেখতে পাচ্ছি না। ওয়েট এ সেকেন্ড। আপনি কলেজে যাওয়ার আগে ম্যাজিক করে লুকিয়ে রেখে যান নি তো? নাকি কেউ দেখে টুক করে পকেটে ভরে নিয়ে গেছে?

-মিস স্মৃতি? আর ইউ কিডিং উইথ মি?

-নো। আই এম ড্যাম সিরিয়াস। 

-সিরিয়াসলি? তা ম্যাডাম আপনার ড্রামা শেষ হয়েছে? নাকি আরো কিছুক্ষণ কন্টিনিউ করবেন?

-যাব্বাবা! ড্রামা আমি করলাম নাকি আপনি? এটা কুঁড়েঘর হলে বাংলাদেশে আমরা যেখানে থাকি সেটাকে তো বস্তি বললেও কম বলা হবে। 

-কি আর করবো বলুন? আপনার ঠোঁটের কোণের এই মিষ্টি হাসিটা দেখার পর দুনিয়ার সবকিছুই কেমন তুচ্ছ তুচ্ছ লাগছে। আর তাছাড়া পুরোনো ডুপ্লেক্স বাড়িটাকে নিজের মতো করে রেনোভেশন করিয়ে নিয়েছি। আগের অবস্থায় থাকলে আপনি হয়তো এক পা রাখারও সাহস পেতেন না। 

-এখন কিন্তু বাড়িটাকে কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে কম লাগছে না। লাইক এন ওয়ান্ডারফুল হিস্টোরিকাল ক্যাসেল। 

-তাহলে এই রাজপ্রাসাদের রাণী হয়ে গৃহ প্রবেশ করে এই অধমকে কৃতার্থ করুন প্লিজ?

-প্রথম পরিচয়ে সবাইকেই কি এভাবেই রাণী বানিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন নাকি মিস্টার?

-আজকের আগে এই অভাগার ভাঙ্গা প্রাসাদে আর হৃদয়ের কুটিরে কেউ প্রবেশ করতে পারে নি ম্যাডাম। রাণী করে আনা তো দূরের কথা।

স্মৃতি কিছু না বলে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে আড়চোখে একবার রাহাতের দিকে তাকিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। রাহাতও স্মৃতির লাগেজটা নিয়ে চললো ওর পিছনে। বাড়িতে ঢুকে স্মৃতি তো প্রায় আকাশ থেকে পড়লো। বাইরে থেকে পুরোনো দিনের রাজবাড়ির মতো মনে হলেও ভিতরের দৃশ্যটা একেবারেই আলাদা বাড়িটার। ড্রইংরুমটা দেখে স্মৃতির মনে হচ্ছে ভুল করে ও বুঝি কোনো সিনেপ্লেক্সে ঢুকে গেছে। গভীর রাতে বেড টাইপের সোফায় গা এলিয়ে আয়েশ করে হরর মুভি দেখার এরচেয়ে পারফেক্ট জায়গা এই দুনিয়াতে আর একটাও আছে বলে স্মৃতির মনেই হচ্ছে না। বিশাল বড় এলইডি টিভিটা ড্রইংরুমের দেয়াল জুড়ে বিস্তার করছে। পাশেই সাউন্ড সিস্টেম আর মাথার উপরে চেইঞ্জেবল লাইটিং সিস্টেম। এই একটা রুম দেখেই স্মৃতির এতো পছন্দ হয়েছে যে এই বাড়িটাতে থাকবে ভেবেই আনন্দ লাগছে মেয়েটার। 

-এই যে ম্যাডাম? এখনই অবাক হলে চলবে? বাকি রুমগুলো দেখে কি করবেন?

-বাইরে থেকে দেখে কল্পনাও করতে পারি নি আমি বাড়িটা এতো গোছানো। আর এই মিনি সিনেমাহল! আম জাস্ট লাভিং ইট।

-বাইরে থেকে দেখে পোড়ো বাড়ি মনে হলেও বাড়িটাকে নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছি নিজে থাকার জন্য। ভাবছি বউয়েরও যদি পছন্দ হয় তাহলে এখানেই সেটেল্ড করে যাবো। আচ্ছা বলুন দেখি? এই বাড়িতে থাকতে কি সে রাজি হবে?

-হবে না মানে! ১০০ বার রাজি হবে। ইশ! কি সুন্দর ডেকোরেশন! এই এ্যাকোরিয়ামের মাছগুলোও কি সুন্দর! আমার খুব খুব খুব পছন্দ হয়েছে।

-তাহলে চলুন দেখা যাক। বাকি রুমগুলো পছন্দ হয় কিনা। আপনি নিজের জন্যও একটা রুম সিলেক্ট করে ফেলুন তাহলে।

-আমি তো এই ড্রইংরুমেই থেকে যেতে পারবো সারাজীবন। আই লাভ দা রুম।

-হা হা হা। ড্রইংরুমটাকে কি বেডরুম বানানোর চিন্তা করছেন? নাকি বেডরুমেও একটা মিনি সিনেমাহল বানিয়ে দিবো এটার মতো?

-বাহ! মন্দ হয় না তাহলে। অবশ্য সমস্যা একটাই। আমি একা একা হরর মুভি দেখতে পারি না। ভয় পাই। হি হি। 

-একা দেখার প্রয়োজন পড়বে না আশা করি। ভয়ে পেলেই বুকে মুখ লুকানোর জন্য কাউকে অবশ্যই পাশে পাবেন। 

-বাহ! তাহলে তো আর সমস্যাই রইলো না। চলুন এখন অন্যরুমগুলো দেখি। 

-চলুন। বেডরুম দিয়েই শুরু করি তাহলে। সিনেমাহলে পার্ট ২ এর ট্রান্সফরমেশনটা কেমন দেখাবে সেটা নিয়েও তো জোর গবেষণা করতে হবে তাই না?

স্মৃতি এবারে কিছু না বলে মুখ টিপে হাসলো। রাহাতের পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতে যেতে রাহাতের মুখে বাড়িটার ইতিহাস শুনছে স্মৃতি। এই বাড়ি আর এই সামনের মানুষটা- দুজনকেই যে স্মৃতির খুব ভালো লেগেছে সেটা বুঝতে গেলে মনোবিদ হতে হয় না। রাহাতের সাথে করিডর দিয়ে হেঁটে একটা রুমে এসে ঢুকে প্রায় হা হয়ে গেল স্মৃতি। ধবধবে সাদা রঙ করা রুমটার প্রত্যেকটা কোণা। রুমের এক পাশের দেয়ালে লাগোয়া সোফা থেকে শুরু করে বেড কভার, বালিশ, কাবার্ড, এমন কি ওয়াশরুম আর বারান্দায় যাবার দরজাটায় পর্যন্ত শুভ্রতার ছোঁয়া লেগেছে। স্মৃতির মনে হচ্ছে কোনো বরফের রাজ্যে চলে এসেছে ও। স্মৃতি নিজের গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে রাহাতের দিকে তাকালো। রাহাত এতোক্ষণ যে ওকেই দেখছিল সেটা বুঝতেও দেরি হলো না স্মৃতির। কিছুটা ইতস্তত করলেও পরেই আবার সামলে নিয়ে রাহাতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্মৃতি। 

-পুরো শুভ্রতার রাজ্যে চলে এসেছি মনে হচ্ছে। এতো সুন্দর কেন রুমটা! ইশ! আমি কি এই রুমটায় থাকতে পারি? প্লিজ প্লিজ প্লিজ?

-আপনি থাকতে চাইলে আমার কোনো সমস্যা নেই। সাদা রঙটা আমার ভিষণ পছন্দের। তাই এভাবে সাজিয়েছিলাম রুমটা। আপনার পছন্দ হয়েছে দেখে ভালো লাগলো।

-সব গুলো রুমই এমন ধবধবে সাদা?

-আরে নাহ। যেটার সাথে যে কনসেপ্ট ভালো লেগেছে সেটাকে সেভাবে সাজিয়েছি। আপনি আনপ্যাক করুন। আমি ততক্ষণে কাবার্ডটা খালি করে দিচ্ছি আপনাকে---।

-এই রুমে কি কেউ থাকে? সরি সরি এক্সাইটমেন্টে কথাটা আমার মাথাতেই আসে নি।

-ব্যাপার না ম্যাডাম। এখন থেকে রুমটা আপনার। 

-কিন্তু এই রুমে কে থাকত? উনি রাগ করবে না?

-আপনি পুরো বাড়িটা দখল করলেও সে রাগ করবে না ম্যাডাম। বরং একটু খুশিই হবে। 

দেখতে দেখতে রাহাতের রাজপ্রাসাদে তিনটা মাস কেটে গেছে স্মৃতির। রাহাত ওকে নিজের বিজনেস ফার্মে একটা চাকরি দিয়েছে। রাহাত কলেজে থাকার সময়টা স্মৃতি ডাবলিন শহরটা ঘুরে বেড়ায় নিজের মতো করে। আর রাহাত ফিরলে দু জনে একসাথে লাঞ্চ করে তারপর অফিসে যায়। ফিরে সন্ধ্যার পর। দুজনে একসাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে, মুভি দেখে তারপর ঘুমাতে যায়। আর ছুটির দিনগুলো রাহাত আর স্মৃতি নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। কখনো লংড্রাইভে যাওয়া, কখনো বিচে, আর কখনো আশেপাশের এলাকায় ঘুরতে যাওয়া এভাবেই কাটছিল ওদের দিনগুলো। একে অন্যেকে ভালোবাসি কথাটা না বললেও দুজনেই সেটা বেশ টের পেত। 

তবে ওদের এই সুখে কারো যেন একটা নজর লেগে গেল। বেশ কয়েকদিন ধরেই স্মৃতিকে কিছু একটা নিয়ে টেনশন করতে দেখছিল রাহাত। কয়েক বার জিজ্ঞেস করলেও স্মৃতি ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। কি এমন ব্যাপার আছে যা স্মৃতিকে এতো বিরক্ত করছে সেটা খোঁজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় রাহাত। স্মৃতির চিন্তায় রাহাত নিজেও ক্লাসে কনসেন্ট্রেট করতে পারছিল না ঠিক করে। তাই একটা ক্লাস শেষ হতেই ক্লাস কোঅরডিনেটর প্রফেসরকে বলে একদিনের লিভ নেয় রাহাত।

ফেরার সময় মাঝরাস্তায় হঠাৎ স্মৃতিকে দেখে অবাক হয়ে যায়। রাহাত যে লেইনে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল তার উল্টো দিকের রাস্তায় একটা ছেলের সাথে কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি করছিল স্মৃতি। আজকের স্মৃতিকে সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে রাহাতের কাছে। রাহাতের গিফট করা ওভারকোটটা না থাকলে রাহাত হয়তো অন্যকেউ ভেবে ভুল করতো। কিন্তু স্মৃতির ওই ওভারকোট, হাত নাড়িয়ে কথা বলার ভঙ্গি সব এলোমেলো করে দিচ্ছে রাহাতের। স্মৃতি আজ  হঠাৎ এমন ছেলেদের বেশে কেন বের হয়েছে সেটাই রাহাত বুঝতে পারছে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা কিছু একটা নিয়ে স্মৃতির সাথে চেঁচামেচি করে এগিয়ে এসে স্মৃতির মাথায় থাকা ক্যাপটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতেই স্মৃতির চেহারাটা সম্পূর্ণ দেখতে পেল রাহাত। মেয়েটার চোখেমুখে এক বিন্দুও ভয় দেখতে পেল না রাহাত। ভয়ের বদলে কিসের একটা চাপা ক্ষোভ খেলা করছে মেয়েটার চোখেমুখে। রাহাত এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল করলো ছেলেটা এগিয়ে এসে দু হাতে শক্ত করে স্মৃতির কাঁধ চেপে কিছু একটা বলে হাসতে শুরু করেছে। স্মৃতি রেগে গিয়ে ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো উল্টো দিকে। আর ছেলেটাও সেখানে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে ধীর পায়ে ভিড়ের সাথে মিশে গেল। 

আর রাহাত? রাহাত থমকে গাড়িতেই বসে রইলো। একটু আগে নিজের চোখে দেখা ঘটনাটার কোনো ব্যাখ্যাই নেই রাহাতের কাছে। রাস্তার উল্টোপাশে থাকায় স্মৃতি আর ওই অচেনা ছেলেটার মাঝে কি কথা হয়েছে কিছুই শুনতে পায়নি রাহাত। কিন্তু গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে সেটা টের পাচ্ছে রাহাত। কিন্তু কি! স্মৃতির গত কয়দিনের টেনশনের সাথে এই ছেলেটার কোনো সম্পর্ক নেই তো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একমাত্র স্মৃতিই দিতে পারে। আজ স্মৃতির কাছে সরাসরি জানতে চাইবে রাহাত। এতো দ্বিধা দ্বন্দ্ব আর নিতে পারছে না ও। এতো লুকোচুরির কি চলছে সেটা রাহাতকে জানতেই হবে। 

১৪!! 

স্মৃতিকে ছেলেটার সাথে দেখার পর সেখান থেকে কি করে গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে এসেছে রাহাত নিজেও সেটা জানে না। রাহাত বাড়ি ফিরে এক মূহুর্তও দেরি না করে সোজা এসে স্মৃতির রুমের দরজায় গিয়ে নক করলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না রাহাতকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে দরজা খুলে রাহাতকে দেখে কিছুটা অবাক হলো স্মৃতি। এখন রাহাতের ফেরার কথা নয়। রাহাতের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়েও কিছুটা অবাক হলো স্মৃতি। রাহাতও এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ স্মৃতিকে দেখলো। রাহাতের ফিরে আসার আগেই স্মৃতি নিজের ছেলেদের বেশটা পাল্টে নিয়েছে, শাওয়ার নিয়ে আবার ওর আগের সেই টপস আর জিনস পড়েছে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই রাহাত আরো খেপে গেল এবারে। স্মৃতিও দরজার সামনে থেকে সরে রাহাতের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। লোকটাকে এমন অদ্ভুত রূপে এর আগে কখনো দেখে নি স্মৃতি। তাই কি বলবে সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না মেয়েটা।

-রাহাত? কি হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? তোমার শরীরটা খারাপ নাকি? কি হয়েছে?

রাহাতের কানে স্মৃতির একটা কথাও ঢুকেছে কি না কে জানে। স্মৃতি এগিয়ে এসে রাহাতের হাত ধরার জন্য হাত বাড়াতেই রাহাত আরো রেগে গিয়ে স্মৃতিকে পাশের দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো। স্মৃতি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও কিছু না বলে রাহাতের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকালো। দেয়ালের সাথে চেপে ধরায় মেয়েটা যে ব্যথা পাচ্ছে সেদিকেও হুঁশ নেই রাহাতের। ওর চোখের সামনে রাস্তায় দেখা ঘটনাটাই ভাসছে।

-রাহাত? এমন করছ কেন তুমি? কি হয়েছে?

-ওই ছেলেটা কে ছিল স্মৃতি?

-ছে-ছেলে! কো-কোন ছেলে!

-যার সাথে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলে সেই ছেলেটা। যে এতো ভিড়েও তোমার কাঁধ চেপে ধরেছিল সেই ছেলেটা। হাউ ডেয়ার হি টু টাচ ইউ?

-ওওও--কেউ না। ছাড়ো রাহাত লাগছে আমার।

-ও যখন তোমাকে স্পর্শ করছিল তখন আমারও লেগেছে। অনেক বেশি লেগেছে। সেটা কি জানো তুমি?

-তোমার লেগেছে মানে? কেন? 

-এই কেন এর উত্তরটা কি তুমি এখনো জানো না স্মৃতি? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছ? 

-রাহাত? কিসব আবোলতাবোল বলছ তুমি? আর এই তুমি আজ হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি এলে কি করে? ক্লাস মিস দিয়ে আমার উপরে নজর রাখছিলে বুঝি?

-ছি স্মৃতি! তুমি এভাবে বলতে পারলে? তোমাকে নিয়ে প্রজেসিভ আমি। তাই বলে এতোটা নিচ ভাবো? শরীরটা ভালো লাগছিল না বলে লিভ নিয়েছি আজকে। অবশ্য আজ তাড়াতাড়ি না এলে তো জানতেও পারতাম না যে---।

-যে? কি রাহাত? কি জানতে পারতে না?

-যে তুমি এমন কোথাও যাও যেখান থেকে এসে এতো তাড়াহুড়ো করে শাওয়ার নেয়া লাগে---।

-অসভ্য ছেলে? কি বললা তুমি? তোমাকে আমি আজকে মেরেই ফেলবো।

স্মৃতি রেগে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে রাহাতকে সরিয়ে দিয়ে এলোপাথাড়ি কিল বসালো রাহাতের বুকে। রাহাতের মুখের ভাবটা কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে ততক্ষণে। স্মৃতির হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে আনলো। স্মৃতির রাগী টুকটুকে লাল মুখটা দেখে বুকের ধুকপুকানিটা বেড়ে যাচ্ছে রাহাতের। এই মেয়েটার উপরে রাগ করে থাকা রাহাতের পক্ষে কি করে সম্ভব? একদমই সম্ভব নয়। স্মৃতি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর রাগে ফুঁসছে। রাহাত এবারে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে স্মৃতিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।

-ছাড়ো আমাকে। আমি আর এক মিনিটও তোমার বাড়িতে থাকবো না। এক্ষুণি চলে যাবো আমি---।

-কেন? কোথায় যাবে? 

-যেখানে ইচ্ছে যাই তাতে তোমার কি? এখান থেকে চলে যেতে হলে তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?

-তা তো হবেই। এতোদিন একসাথে ছিলে। একটা দায়িত্ব আছে না তোমার?

-ছাড়ো বলছি ছাড়ো? ছাড়ো? দায়িত্ব দেখাতে এসেছে সে আমাকে। 

-গত তিনমাসে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। আজ হঠাৎ কি এমন হলো যে তুমি চলে যেতে চাইছ? অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছ? নাকি তোমার ফ্রেন্ডের ঠিকানা খুঁজে বের করতে পেরেছ?

-যে লোকটা আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে তার সাথে এক বাড়িতে থাকব সেটা আশা করো কি করে তুমি?

-আরে বাবা! ছেলেটা তোমাকে ওভাবে ধরছিল বলে রাগে কি বলতে কি বলে ফেলেছি। সরি তো স্মৃতি সরি। রাগ করো না প্লিজ স্মৃতি?

-ছাড়ো আমি থাকবই না--। সব সমস্যা সরি বলে সমাধান করা গেলে তো কথাই ছিল না। আর ছেলেটার সাথে কথা বলতে দেখেছ। ওর আমাকে স্পর্শ করা দেখেছ। আমার তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া দেখো নি। 

-স্মৃতি আম সরি। কিন্তু যে কারণেই হোক ও তোমাকে স্পর্শ করবে কেন? আমি ছাড়া আর কেউ তোমার একটা আঙ্গুল ধরলেও সেটা আমি মানতে পারবো না।

-কেন? আমি কে হই তোমার? দয়া করে থাকতে দিয়েছ----। 

-শশশশ। জানো না কে হও? আমার পৃথিবী তুমি, ঠোঁটের কোণের হাসির কারণ তুমি। আর আমার বেখেয়ালী মনের গান তুমি, সেই গানের সুর তুমি। জীবনের ছন্দ তুমি, সেই ছন্দের বাস্তব রূপও তুমি। তোমাকে কতোটা ভালোবাসি সেটা কি সত্যিই বুঝতে পারো না?

-ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হয় রাহাত। চোখ বুজে ভরসা করতে হয় অন্ধের মতো। করো ভরসা আমাকে?

-নিজের চেয়েও বেশি।

-বিয়ে করতে পারবে আমাকে? আমার সম্পর্কে কিছু না জেনে, কোনো প্রশ্ন না করে? পারবে?

-তুমি চাইলে আজই নাহয় আমরা বিয়ে করবো। প্রমিস তুমি নিজে থেকে না বলা পর্যন্ত একটা প্রশ্নও করবো না তোমাকে। কিচ্ছু জানতে চাইব না। তোমাকে যে নিজের সাথে বাঁধতে পারবো সেটাই হবে আমার জীবনের পরম পাওয়া।

-আজ না। আগামী সপ্তাহে। কিন্তু তোমার বাবা যদি না মানে?

-বাবাকে তিন মাস আগেই জানিয়ে দিয়েছি তোমার কথা। আর এটাও বলেছি যে বিয়ে করলে তোমাকেই করবো।

-তুমি সত্যি একটা পাগল রাহাত। আমার সম্পর্কে একদম কিছু না জেনেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে?

-তোমার চোখের ছেলেমানুষিগুলো আমাকে কানে কানে বলে যায় তোমার ভালোবাসার কথা। তোমার দুষ্টু ঠোঁটের কোণের লজ্জারাঙা হাসিটা বলে যায় আমার সান্নিধ্যে তুমি কতোটা কমফোর্টেবল। তোমার চিবুক জোড়ায় যে রক্তিম আভা ফুটে ওঠে আমার সামনে এলে সেটাও জানিয়ে দেয় তুমিও আমাকে কতোটা চাও। তবু আজ নাহয় তুমি নিজের মুখেই বলো। ডোন্ট ইউ লাভ মি? ভালোবাসো আমাকে? নাকি সবটাই আমার মনের ভুল?

-ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।

ভালোবাসি কথাটা বলে রাহাত আর স্মৃতি দুজনেই হেসে ফেললো। স্মৃতি রাহাতের কাঁধে হাতে ঝুলিয়ে রাহাতের দিকে এগিয়ে আসলো কিছুটা। রাহাতও হেসে স্মৃতির মুখটা এক হাতে তুলে ধরে স্মৃতির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো। স্পর্শটা যতটা না মধুর ছিল, ততটাই পবিত্র ছিল রাহাতের কাছে। সেদিনের সেই ছোঁয়া রাহাতের প্রত্যেকটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন মিশে গিয়েছিল। তাই হয়তো এতোগুলো বছর পরেও স্পর্শটা এখনও এতোটা বাস্তব আর জীবন্ত লাগছে রাহাতের কাছে। ঠোঁটে স্মৃতির উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ ধীরে ধীরে মুছে যেতে যেতে রাহাত টের পেল ওর পাশেই কোথাও কিছু  একটা যেন বিকট শব্দ করে কেঁপে উঠছে। রাহাত কোনমতে ক্লান্ত চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে। মাথার পাশে মোবাইলটায় 'পি.এ কলিং' লেখাটা দেখেই রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বসলো রাহাত। তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করে কানে লাগালো।

-স্যার? আপনি কোথায়? মায়া ম্যাডাম তো চলে এসেছে অফিসে।

-হোয়াট! ওহ শিট! টায়ার্ডনেসের কারণে কখন ঘুমিয়ে গেছি টেরই পাইনি। মায়াকে ৫ টা মিনিট ওয়েট করতে বলুন। আমি এক্ষুণি আসছি।

-স্যার বেশি টায়ার্ড লাগলে আপনি রেস্ট করুন। আমি ম্যাডামকে কালকে আসতে বলি?

-আপনাকে কি আমি আমার কাজে নাক গলাতে বলেছি মিস লিজা? মায়া আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছে তাই এখনো পর্যন্ত আপনি মায়ার জায়গায় টিকে আছেন। কথাটা ভুলে যাবেন না। যেটা বলছি সেটা করুন। আগ বাড়িয়ে সাজেশন দেয়ার চেষ্টা করবেন না একদমই।

-সরি স্যার।

-শফিককে বলুন মায়াকে এক কাপ কফি দিয়ে যেতে। কফি শেষ হওয়ার আগেই আমি চলে আসবো। 

-জি স্যার।

কলটা কেটে দিয়ে রাহাত প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। রাহাতের মাথায় শুধু একটা কথাই চলছে। মায়ার সাথে তার কথা বলতে হবে। কি নিয়ে কথা বলার জন্য এতো ছটফট করছে সেটা রাহাত নিজেও জানে না। কিন্তু মায়াবতীর সাথে সরাসরি কথা বলতেই হবে রাহাতের। আর কেউ ওকে না বুঝলেও মায়াবতী ঠিকই ওকে বুঝবে। এটা রাহাতের বিশ্বাস। অন্তত সবটা বলে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত রাহাত হয়তো একবিন্দু শান্তিও পাবে না। এখন শুধু মায়াবতীকে সবটা জানানোর অপেক্ষা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন