লাবীবা আর বাতাসি ভোরেই হসপিটালে চলে এসেছে। মাহাদকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। মাহাদ অনেকটা সুস্থ। কিন্তু সে ঘুমিয়ে আছে।
লাবীবা মাহাদের পাশে বসে চোখের পানি মুছে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ফুয়াদ এসে ওর মায়ের একদম পায়ে পড়ল।
" মা কেমন আছো? কতদিন পর তোমায় দেখছি। আমায় কি ভুলে গেছ! আমায় ক্ষমা করে দাও মা।"
লাবিবা ফুয়াদের মাথায় হাত দিতেই বাতাসী চোখ গরম করল। সাথে সাথে লাবীবা ভয় পেয়ে হাতটা সরিয়ে নিল। অসহায়ের মত বাতাসির দিকে চেয়ে রইল লাবীবা।
বিয়া করার সময় বাপ-মায়ের কতা মনে পড়িছলনা! এখন কি ভাতের অভাব হইছে তার লায় বাপ-মায়ের কতা মনে পড়ছে! সেইদিনতো আমাগো সগ্গলের সম্মান লইয়া টানাটানি করছোস আর এহন আইসা ক্ষমা চাইলেই তোরে মাফ কইরা দিমু? আশা বাদ দে...
ফুয়াদ আর কিছু না বলে রুম থেকে চলে আসল। তারপর নিসাকে বাসায় চলে যেতে বলল। ফুয়াদ হসপিটাল থেকে বের হয়ে চলে গেল নিধিকে আনতে।
এদিকে নিসা বাসায় না গিয়ে মাহাদের কেবিনের সামনে গিয়ে দাড়াল। এর মধ্য বাতাসি লাবীবাকে ধমক দিয়ে বলল," অ্যার সামনে ছিঁচকাঁদুনে কানবা না। কুলাঙ্গার পুত জন্ম দিয়ে আবার কানতে আইচে।"
মাহাদকে কই থাইকা পাইল কামু?"
ও তিতিরের কাছে ছিল। যত সমস্যা তিতিরের জন্য বলে আড়াল থেকে বের হয়ে এল নিসা। মাহাদ মাঝে মাঝে তিতিরের কাছে থাকে আপনারা জানেন না?
বাতাসি নিসার কথা শুনে ক্ষেপে উঠল। ঐ মাইয়া, তোরে আমাগো মধ্য কেডাই কতা কইতে কইছে। লাবীবা, এই মাইয়ার জন্য তুমি অ্যার কাছে সুপারিশ করো, এই মাইয়ার জন্য!
যেই মাইয়ার নিজের ছোড জনের সাথে হয়না হেই তোমার সাথ মিলবো কি কইরা? তোমারে সারাডা জিবন অ্যারে দেখে রাকতে হইছে তেমনই তোমার মতই অর্কমার ঢেঁকি তোমার বড় পুতও হইছে।
ঐ মাইয়া এহানে খাড়াই কি দেহোস? যা চোখের সামনে থাইকা। তোরে দেখলে অ্যার পিত্ত্ব জ্বইলা যায়।
নিসা এখানে পাত্তা না পেয়ে বাসায় চলে গেল।
♦♦♦♦
তিতির নিধিকে কোলে নিয়ে খাবার খাওয়ায় দিচ্ছে আর গল্প শুনাচ্ছে। এমন সময় ফুয়াদ বাসায় আসে। ফুয়াদ কে দেখেই তিতির মাহাদের কথা জিঙ্গাসা করলো।
" ও ভালো আছে তিতির। তুমি কি এসে খাবার খেয়েছ!"
" না ভাইয়া, খেতে মন চায় না।"
you'll have nothing. How so?
তিতির হতাশার সুরে শ্বাস ত্যাগ করে বলল," জিবনটা বড্ড কঠিন ভাইয়া। আমরা যা চাই তা পাইনা কিন্তু সময় শেষ হয়ে গেলে তা আমাদের হাতের নাগালে এসে যায়। সময় থাকতে আর আসেনা।"
"তিতির, life never stop for anyone. you go it?"
"জ্বী ভাইয়া।"
" নিধি, চটজলদি খাবার শেষ করো মা। তোমাকে বাসায় রেখে অফিসে যেতে হবে।"
ঘন্টাখানেকের মধ্য ফুয়াদ নিধিকে নিয়ে চলে গেল। এর ভিতর তিতির ওর জিবনের সবচেয়ে বড় ডিসিশন নিয়ে নিল। যতটা পারে সে মাহাদের কাছ থেকে দুরে থাকবে। জিবনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ নিজের জন্য একটা শক্ত প্লাটফর্ম তৈরি করা। মাথা থেকে সব চিন্তা দুর করে পড়ার প্রতি একনিষ্ঠ ভাবে মনযোগ দিল।
সাতদিন পর,
এই সাতদিনে মাহাদ তিতিরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। লাবীবা কড়া নজরে রেখেছে ছেলেকে। ফোন, ল্যাপটপ, অফিস যাওয়া, বন্ধুদের সাথে কথা বলা সব বন্ধ করে দিছে। একপ্রকার নজর বন্দি যাকে বলে।
তিতির এর মধ্য ওর শশুড়কে কল দিয়ে মাহাদের খোঁজ নিয়েছে কিন্তু ওকে দেখার সুযোগ হয়নি। মাহাদ ভাল আছে সেটাই বা কম কিসের?
রাত আটটা বাজে। তিতির পড়ছিল এমন সময় ওর ফোনে একটা আননোন নাম্বারে কল আসে।
প্রথমে রিসিভ করলোনা কিন্তু পরপর দুইবার কল দেওয়াতে রিসিভ করলো তিতির।
হ্যালো........
ফোনের ওপাশ থেকে কোন শব্দ এলনা। তিতির যখন কল কেটে দেওয়ার মন স্থির করলো তখনই মা বলে অতিপরিচিত কন্ঠ ভেঁসে এল।
তিতিরকে আর কিছু বলতে হলনা। কারন তিতির বুঝে গেছে এটা ওর বাবা। তিতির হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল," বাবা, তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন।"
আজ এরশাদ মীরের মেয়ের প্রতি যেন একটু বেশিই দরদ দেখাচ্ছে। দু'চোখ বেয়ে পানি পড়ছে মীর সাহেবের। দু'হাতে চোখের পানি মুছে বলল," আমি ঢাকাতে আসছি বড় ভাইজানের সাথে। রবিনকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুই আমাকে দেখতে আসবি মা?"
হুম বাবা, আমি অবশ্যই যাবো। কাল ক্লাস শেষ করে যাব। আজ দীর্ঘ সময় ধরে বাবা-মেয়ের মধ্য কথা হল। তিতির ওর বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে বোরখাটা পড়ে গোলাবকে নিয়ে হিনুর কাছে গেল। হিনু তখন ওর বরের সাথে কথা বলছিল ফোনে। হিনুর বর অস্টলিয়াতে থাকে। হিনুরও যাওয়ার কথা চলছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরে স্বামীর কাছে পাড়ি জমাবে সে।
হিনুর মা বসে টিভি দেখছিল। তিতিরকে বসতে বলে হিনুকে ডাকতে গেলেন তিনি। কিছুক্ষন পরে হিনু আসতেই তিতির সাথে সাথে বলল," আপু আপনার স্কুটিটা দিবেন? একটু মাহাদকে দেখেই চলে আসবো।"
"এত রাতে কেন যাবে? কাল সকালে যেও।"
" তিতির মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। মাহাদ হিনু আপুর অনুমতি নিয়ে সবসময় বাসার বাহিরে যেতে বলেছে। তাই জানাতে এসেছে। না হলে কখন ছুটে যেত প্রিয় মানুষটার কাছে।"
তিতিরের এমন নিঃশ্চুপ হয়ে যাওয়াটা হিনুর পছন্দ হলনা। কারন ও এই কষ্ট বোঝে। বর দুরে থাকলে একটা মেয়ের জন্য কতটা কষ্টকর ও সেটা নিজে ভালো করেই বোঝে।
হিনু রুমে গিয়ে রেডী হয়ে এসে বলল," চল তোমার সাথে আমিও যাই।"
" তিতির শুধু হিনুর দিকে একবার ছলছল চোখে তাকিয়ে শুকরিয়া ঙ্গাপন করলো।"
হিনু স্কুটি বের না করে গাড়ীই বের করলো। রাত হয়ে গেছে তার ভিতর দু'জনই মেয়ে মানুষ তাই গাড়ীই সেভ মনে করলো।
তিতির, আমি এর আগে কখনো মাহাদের বাসায় যাইনি, তাই চিনিনা। তুমি পথ দেখিয়ে দিও।
আপু আমি এখান থেকে বাসায় যেতে পারবোনা। কিন্তু আপনি ওখানে যান, ঐ মোড় থেকে বাসায় যেতে পারবো বলে লোকেশন বলল তিতির।
ওকে বলে হিনু গাড়ী ড্রাইভ করতে লাগল। মাহাদের এলাকায় আসতেই তিতির পথ দেখিয়ে দিল। এখন ওরা মাহাদের বাসা থেকে খানিকটা দুরে দাড়িয়ে আছে। এবার তিতির গোলাবকে ছেড়ে দিয়ে ইশারা করে সব কিছু বুঝিয়ে দিল।
গোলাব চলে যেতেই হিনু বলল, " তিতির, গোলাব কি কাজটা পারবে?"
" তিতির মুচকি হেসে বলল," আমাদের থেকেও গোলাব উত্তম ভাবে কাজ সমাধান করবে আপু। শুধু দেখে যান ও কি কি করে।!"
সত্যিই গোলাব ওর তেলেসমাতি দেখায় হিনুকে। ওয়াল টপকে বাসার ভিতর চলে যায়। হিনু হেঁসে বলল," তুমিও যেমন তোমার কুকুরটাও তেমন।"
" আপু ওরে গোলাব বলে ডাকবেন। মাহাদের সামনে যদি ওরে কেউ ঐ নামে ডাকে তাহলে ও রেগে যায়। এই নিয়ে দাদীর সঙ্গে অনেক ঝগড়াও হয়েছে ওনার।"
"ওকে আর বলবনা। এবার খুঁশি তো!"
♦♦♦♦
গোলাব সরাসরি বাসার মধ্য ঢুকে পড়ে। বাতাসি বিবি সোফায় বসে টিভি দেখছে আর সাবিনা লিচু ছিলে একটা বাটিতে রাখছে। বছরের শেষ লিচু, সাবিনা ফ্রোজেন করে রেখেছিল সেটা বাতাসিরে বের করে খেতে দিয়েছে। বাতাসি একটা লিচু নিয়ে মুখের সামনে ধরে কেবল ওটা খেতে যাবে এমন সময় গোলাব সামনে গিয়ে ভুগ ভুগ করে ডেকে ওঠে। এতে বাতাসির সখের লিচু খানা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেল। বাতাসি আর গোলাব এরা মনে হয় দু'জনেই দু'জনার জন্মের শত্রু। সেদিনের প্রতিশোধ আজ নিয়েই ছাড়ল গোলাব। বাতাসি কিছু বলার আগেই গোলাব পগাড় পাড়। দ্রুতই সিড়ি পাড় করে মাহাদের রুমে চলে গেল।
বাতাসি টুলটুল করে লিচুর দিকে চেয়ে আছে। কারন সাবিনাও গিয়ে উঠে হাত থেকে সব লিচু ফেলে দিয়েছে।
বাতাসির মুখ থেকে একটাই কথা বের হল," অ্যার বছরের শেষ লিচু।"
♦♦♦♦
মাহাদ সৌরভের একটা অফিসের কাজ সলভ্ করে দিচ্ছিল। মাহাদ অসুস্থ বলে রুমকি আর সৌরভ ওকে দেখতে আসছিল।
এমন সময় গোলাব এসে ফাইলের উপর দিয়ে এক লাফে মাহাদের কাছে গিয়ে ওর কোলের মধ্য বসে পড়ল। সৌরভ তো চমকে লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে দু'হাত দুরে পিছু হটলো। মাহাদ নিজেও হতবাক হয়েছে গোলাবের কান্ডে। মাহাদের বুঝতে আর বাঁকি রইল না তার কাছে কে এসেছে।
মাহাদ আর একমুহুত্ব দেরী না করে নিচে নেমে এসে দেখল বাতাসি বাসা মাথায় তুলেছে।
এই কুত্তা কই থাইকা আইলো! হারামজাদি কুত্তার প্রতিশোধ লইতাছস সেদিনের? তোরে তো আজ দশের কান্দোত তুলম। অ্যার বাড়িত থাইকা বাড়া।
" দাদী গোলাব তো মরদা কুত্তা। হেরে আবার ভুল গালি দ্যান! হারামজাদা কন হারামজাদা । তয় হেই এতদিন পর আইলো কইত থাইকা?"
" গোলাব এসে এবার সত্যি সত্যি বাতাসির সাথে জগড়া লেগে গেল। বাতাসি একটা চিক্কুর দিলে গোলাব পাঁচটা চিক্কুর দিয়ে বাতাসির কানে তালা লাগায়।"
গোলাব কামিং বলে মাহাদ বাহিরে চলে গেল। লাবীবা কিচেন থেকে বের হয়ে বলল," মাহাদ কই যাস?"
মাহাদ ততক্ষনে বাহিরে চলে গিয়েছে।
♦♦♦♦
হিনু আর তিতির গাড়ির মধ্য বসে আছে। তিতির, তোমার গোলাব মাহাদকে ডেকে আনতে পারবে তো?
জ্বী আপু। একটু অপেক্ষা করুন বলতেই তিতির দেখলো মাহাদ ওদের গেট থেকে বের হচ্ছে। তিতিরকে আর পায় কে! আর এক মুহুত্ব দেরি না করে গাড়ীর ডোর খুলেই এক দৌড়। মাহাদ চোখের সামনে দেখল তিতির দৌড়ে আসছে। এই আস্তে আসো, কারো সাথে ধাক্কা লেগে যাবে তো!
কে কার কথা শোনে, তিতির এক দৌড়ে মাহাদের কাছে এসেই ওকে জাপটে ধরে। মাহাদও সাথে সাথে তিতিরের জড়িয়ে ধরে সম্পূর্ন উপরে তুলে খুশিতে একটা পাক খেয়েই নিজের ব্যালেন্স ঠিক করে থেমে গেল। তিতির রাস্তার ধারে সবার সামনেই মাহাদকে জড়িয়ে ধরে আছে।
মাহাদ তিতিরকে ধমক দিয়ে বলল," এত জোড়ে দৌড়ে আসে কেউ!"
" আমি আসি আমার জংলি বরটার কাছে।"
মাহাদ কিছু না বলে তিতিরকে ছেড়ে দিয়ে ওর মুখের হিজাবটা খুলে তিতিরকে একবার প্রান ভরে দেখে নিল। অন্ধকারে তেমন দেখা যায়না তবুও ওতটুকুতেই মাহাদ তৃপ্তি পেল অনেক।
তিতির, এতদিন পর তোমার এই জংলি ছানার কথা মনে পড়ল।"
" আসতে প্রচন্ড ভয় পেতাম। যদি ধরা পরে যাই! তাই মনে সাহস হয়নি। আজ মনের সাথে লড়াই করতে পারলামনা তাই চলেই আসলাম।"
" তুমি জানোনা, এখানে তোমার বর থাকে তাই তোমার মাহাদ থাকতে এত ভয় কেন! তুমি কি একা এসেছ তিতির?"
" নাহ্, হিনু আপু গাড়িতে আছে।"
মাহাদ তিতিরের হাত ধরে হিনুর কাছে গেল। এতক্ষনে হিনু এদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্য ভালোবাসা দেখে আবেগপ্রবন হয়ে গেছে। কবে যে সে এভাবে তার বরকে জড়িয়ে ধরবে। হিনু গাড়ী থেকে বের হয়ে মাহাদের কাছে গিয়ে বলল," এখন তোর শরীর ভালো আছে তো?"
" আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। চল বাসায়? "
" নারে যাবোনা। অন্যদিন যাব। তিতির, ওকে দেখা হয়েছে তো! দেখা হলে চল বাসায় ফিরবো।"
" আরে কই যাস! এই প্রথম আমাদের বাসায় আসলি। আর এখন না ঢুকেই চলে যাচ্ছিস?"
এমন সময় লাবীবা বাসা থেকে বের হয়ে এদিকেই আসতে লাগলো। তিতির চট করে মাহাদের কাছ থেকে কিছুটা দুরে দাড়িয়ে হিজাবটা ভালো করে লাগিয়ে মুখের উপর পর্দা নামিয়ে দিল।
লাবীবা কাছে দাড়াতেই মাহাদ হিনুকে বলল," হিনু আমার মা।"
" হিনু সাথে সাথেই সালাম জানালো, তিতিরও হাতের ইশারা করে সালাম জানালো।"
এতে মাহাদ চট করে বলে উঠলো," মা হিনুর কাজিন। খুব পর্দা করে। আর কথাও বলে কম। ও তোমাকে সালাম জানিয়েছে।"
সালাম নিয়ে লাবিবা বলল," তোমরা বাহিরে আছো কেন মা! বাসায় চল বলে তিতিরের হাত ধরল লাবীবা। "
তিতির সাথে সাথে মাহাদের দিকে চাইলো। মাহাদ তিতিরের ভয় পাওয়া দেখে চোখ বন্ধ করে তিতিরকে আশ্বস্ত করলো। সে থাকতে কোন সমস্যা নেই।
না আন্টি অন্যদিন আসবো বলতেই লাবীবা জোড় করে ওদের ভিতরে নিয়ে আসলো। মাহাদ হিনুর কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে গাড়ী ভিতরে নিয়ে এসে রাখলো।
♦♦♦♦
লাবীবা ততক্ষনে ওদের খাতির যত্ন শুরু করে দিছে। রুপালি, মৌ, রুমকি, সৌরভ তারাও কাছে এলে মাহাদ ওদের সাথে হিনুর পরিচয় করে দিল। বাতাসি এত সহজে মেনে নিলনা। বাতাসি টুপ করেই সবার মাঝে বলে উঠলো," কিরে মাহাদ, তোর কুত্তা কি ওগো বাড়িতে থাকে?"
" মাহাদ কটমট করে বাতাসির দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল," জ্বী দাদি।"
মাহাদের রাগের পরোয়া করেনা বাতাসি। হিনুরে বলেই ফেলল," আচ্ছ মাইয়া কও দেহি, কুত্তারে কুত্তা কমু না তো কি কইয়া ডাকুম?"
" হিনু একটু হেঁসে মাহাদের দিকে তাকাইলো। মাহাদ কিছু বলছেনা কিন্তু মনে মনে ফুসছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।"
এদিকে তিতির একধ্যানে মৌয়ের মেয়ে রাতিশার দিকে চেয়ে আছে। কারন ও প্রচন্ড কাঁদছে। কতবড় হয়ে গেছে মেয়েটা। আমাকে কি সে ভুলে গেছে বলেই তিতির সব কিছু ভুলে উঠে গিয়ে রাতিশার কাছে গেল। তারপর দু'হাত প্রসারিত করে হাত বাড়াতেই ছোট্ট রাতিশা হুমরি খেয়ে তিতিরের দিকে দু'হাত বাড়িয়ে চলে এল। তিতির ওকে নিয়ে এদিক ওদিক হাটতে লাগলো। শেষে কি মনে হল তিতির দ্রুত রাতিশাকে মৌয়ের কোলে দিয়ে এসে সোফায় বসল।
"ঐ মাইয়া কতা কওনা ক্যান! তুমি কি বোবা নাকি?"
বাতাসির কথায় হিনু বলল, " দাদী, ওর গলায় একটু সমস্যা। ডাক্তার দেখাইতে আসছিলাম। ওর কথা না বলায় ভালো। আপনি আমাকে বলুন আমি ওর হয়ে সব বলছি।
না, অ্যাই ভাবলাম মাইয়া কতা কইতে পারেনা। পর্দাতো হেই ভালোয় করে।
লাবীবা তিতিরের কাছে এসে ওর হাতটা ধরে বলল," আম্মা, আমরা মাহাদকে বিয়ে দেওয়ার জন্যতো এমনই মেয়ে খুঁজছি। এমন একটা মেয়ে পেলে আমার মনের আশা পুরুন হত। একদম আমার মনের মত মেয়ে তাইনা?
মাহাদের জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছে বলতেই তিতির কেঁপে উঠলো। কিন্তু লাবীবা ভাবল মেয়েটা নিজের বিয়ের কথা শুনে হয়ত লজ্জায় এমন কেঁপে উঠছে। যেটা লাবীবার খুব পছন্দ হল।
লাবীবার মেয়ে এতই পছন্দ হল যে বার বার মেয়ের হাত নেড়েচেড়ে দেখছে।
মাইয়ার মুখ না দেইখাই তোমার এত ভাল লাগল! মাইয়া ধলা না কাইলা হেইডা তো দেখলা না! শেষে কালা মাইয়া দেইখা চিক্কুর না মারো।
রুপলাী বাতাসির কথার প্রতিবাদ করে বলল," কালো ফর্সা বলে কি আছে? মেয়ের গুনই আসল কথা। লাবীবা আমারও পছন্দ হয়েছে মেয়েটাকে।
শেষে রুপালীও এসে তিতিরের হাত ধরে বলল, " সত্যিই এখনকার যুগে এমন মেয়ে পাওয়া যায়না।"
মাহাদ মনে মনে বলল," মা, তুমি তিতির আর ওর স্বভাবকে ঠিকিই পছন্দ করতে। কিন্তু নিজের দাম্ভিকতার কাছে হার মানতে চাওনা বলে সেদিন তিতিরের সাথে ওমন ব্যবহার করেছ।
বাতাসি বিবি চোখ বড়বড় করে বলল," তা মাইয়া তোমার নাম কি?"
" জান্নাতুন তাজরীম" ( তিতিরের সার্টিফিকেটেরর নাম এই বাসায় কেউ জানেনা।)
হিনুর কথা শুনে বাতাসি বলল," মাইয়া কি সত্যই কথা কইতে পারে?"
মাহাদ মুচকি হেঁসে বলল," সে অত্যান্ত চমৎকার ভাবে কথা বলতে পারে দাদী।"
মাহাদের হাসি দেখে বাতাসি মনে মনে বলল," ঘরে বৌ থুয়ে অন্য মাইয়ার সাখ লছপছ করোস! তুই ও শেষ বেলায় তোর দাদার মত হলি! তোর নামডাও লুচ্চার খাতায় নামালি? তোরা সব ব্যাটাছলই খারাপ জাত। তোদের উপর ভরষা বলতে কিছু নাই।
তাহলে হিনু ওর বাবা-মায়ের কন্ট্রাক্ট নাম্বারটা দিওতো মা। একটু ওনাদের সাথে কথা বলব।
মাহাদের মায়ের কথা শুনে হিনু মনে মনে হেঁসে ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। মনে হচ্ছে চেনা জিনিস অচেনার ভিড়ে হারিয়ে গেছে।
মা মেহমানদের খাবার না দিয়ে কি সব গল্পে মজে গেছ। ওদের খাবার ব্যবস্থা করো।
মাহাদের কথায় লাবীবার টনক নড়ল। বসা থেকে উঠতেই একজন সারভেন্ট এসে নাস্তা দিয়ে গেল। হিনু সরাসরি মুখে তুলে খেলেও তিতির হিজাবের নিচ দিয়ে একটু খাবার খেয়ে চুপ করে রইল। মনে হচ্ছে এই বুঝি এদের সামনে ধরা পড়ে।
এদিকে গোলাবকে নিয়ে মহাচিন্তায় পড়ে গেছে মাহাদ। গোলাবকে একটু ছেড়ে দিলেই গোলাব শুধু তিতিরের দিকেই যাচ্ছে। শেষে মাহাদ আস্তে আস্তে বলল," গোলাব, ভরা বাজারে আমার হাড়ি ভাঙ্গতে চাচ্ছিস কেন বাবা! আমি ঐ বাসায় গেলে তো ঠিকি আমাকে ছাড়া নড়িস না আর এখানে এসে মা মা করে পাগল হচ্ছিস? "
বাতাসি গোলাবের দিকে তাকাতেই গোলাব গড়গড় করতে লাগলো। শেষে মাহাদ বাতাসিকে বলল," তুমি ওর পিছু ছাড়বা? তোমার দুঃখে ওকে এই বাসায় রাখিনা। আজ এসেছে তবুও তোমার ওকে ছাড়তে মন চায়না?"
আই কি কইচি! তোর কুত্তারে ক, বাড়িত থাইকা চলে যাওনের আগে যেন অ্যারে লিচু কিইনা দেয়। বছরকার শেষ লিচু হেই খাইতে দেয়নাই আরে।
মাহাদ সেদিকে নজর না দিয়ে ওর মাকে বলল," মা অনেক হয়েছে। ওদের ছেড়ে দাও। রাত হয়ে গেছে। ওদের বাসা অনেকদুর।
শেষে ওরা বাসা হতে চলে যাওয়ার জন্য ডাইনিংরুম থেকে বের হল। এর মধ্য তিতিরকে একবার ছুয়ার আর কথা বলার ট্রাই করলো মাহাদ কিন্তু বাতাসি দারোগার জন্য সম্ভব হলনা। সেও সবার সাথে ওদের এগিয়ে দিতে এসেছে।
লাবীরার তিতির রুপী জান্নাতুল তাজরীমকে এতই পছন্দ হয়েছে যে যাওয়ার সময় একটা চুমা পর্যন্ত খেল হিযাবের উপরই।
শেষে হিনু বাধ্য হয়ে ওর মায়ের নাম্বার দিয়েই বলল," এখানে যোগাযোগ করেন আন্টি, তাহলে ওর খোঁজ পাবেন।"
তিতির আর হিনু বাসার পথে রওনা দিল। রাস্তার মধ্য হিনুতো হাঁসতে হাঁসতে শেষ। তিতির ওরা তোমায় পেয়ে কত খুঁশি দেখছো?
তিতির বিষন্ন মনে বলল," আমার মুখ যদি তারা দেখত তাহলে এই খুঁশি নিমিষেই শেষ হয়ে যেত আপু।"
তিতিরের কথায় হিনু চুপ করে রইলো। তারপর তারা বাসায় ফিরে লাবীবাকে জানালো তার বাসায় এসে পড়েছে।
♦♦♦♦
মাহাদ ওর রুমে বসে সৌরভের ফাইলের কাজ করছে। এমন সময় বাতাসির আগমন। বাতাসি এসে মাহাদের সামনাসামনি বসে পড়ল।
মাহাদ ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বলল," কি বাতাসি! মেয়ে পছন্দ হয়েছে?"
তোর ঘরে একখান বৌ রাইখা আর একখান বিয়ার কতা চিন্তা করোস তোর লজ্জা করেনা? তুইও লুচ্চার খাতায় নাম দিলু? তোরা মরদ জাতটায় খারাপ। একখান দিয়া তগোর হয়না। তাই মাইয়া মানুষ দেখলেই তগো লাল ঝরে।
কি আর করবো বলো? তোমরা তো তিতিরকে মেনে নিবানা। এভাবে একা একা আর কতদিন থাকবো। তাই তোমাদের পছন্দেই বিয়ে করি। তাও যদি বৌকে নিয়ে থাকতে পারি।
বাতাসি অত্যান্ত খুঁশি হয়ে বলল," এতদিন পর একখান ভালা চিন্তা করছোস। মাইয়াডা তয় খুবই ভালা। অ্যার ভালা লাগছে। অ্যাই ওর বাপ মায়ের লগে কথা কমু। এই বাতাসি এক কতার মানুষ। যমুনা সেতু ডুইবা যাইবো নদীর পানিতে তাও এই বাতাসির কতার নড়চড় হইবোনা কোনদিন। তোর মত জামাই পাওয়া ওগো ভাগ্যর ব্যাপার।
এই থামো, থামো। এত জলদি ডিসিশন নিচ্ছো? ভেবে চিন্তে সব কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সব কাজে এত জলদির কি আছে বল!
ভালা কামে দেরি করতে নাই। তুই যহন রাজি হইছোস তহন দেখ তোর বিয়া কামনে দেই। কতা দিনু সেই একখান বিয়া হইবো। বাতাসি যহন একবার কতা দিচে মানে বুজে নে তোর বিয়া হয়ে গেছে।
এত সহজে রাজি হইলা বাতাসি! মেয়ের আরো গুনের কথা শুনবানা?
বাতাসি পা দুখানা মেলিয়ে আরামে বসে খুশি খুশি মুখে বলল," তাইলে ক। ভালা মাইয়ার ভালা গুন হুইনা নিজেরে ধন্য করি। তোরে তো ওর লগেই বিয়া দিমু।"
" সবে তো দুবার বিয়ে করেছি। তুমি চাইলে কয়েক হাজার বারও বিয়ে করতে রাজি আছি আমি। এবার মেয়ের গুনের কথায় আসা যাক। মেয়ে খুব ভালো পর্দা করে, পড়ালেখায় অত্যান্ত টালেন্ট, ভার্সিটিতে ছাড়া অযথা বাহিরে যায়না, তার কোন বন্ধু-বান্ধব নেই, খুব কম কথা বলে। বাসার কাজে প্রচন্ড মনযোগী আর কাজও খুব ভালো পারে। এখন তুমি বল, এই মেয়েকে কখনো হাত ছাড়া করা যায়? আমি কখনোই করতে চাইনা। শত বাঁধা এলেও করবোনা।"
মাহাদের কথা শুনে বাতাসির সব হাসি উড়ে গেল। একটা বেলুনের বাতাস যেমন সব বের হয়ে যায় তেমনই বাতাসির মুখ চুপসে গেল। শেষে একটা ছোড মাইয়ার কাছে এমন ব্যাকশর্ট খেল বাতাসি! তিতির এভাবে বাতাসিকে হাফসুল খাওয়াবে বাতাসি সেটা ভাবতেই পারেনি। কথার খেলাফ হওয়ার ভয়ে বাতাসি মাথা নিচু করে চুপচাপ সুড় সুড় করে বের হয়ে গেল মাহাদের রুম থেকে।
বাতাসি চলে যেতেই মাহাদ প্রচুর হাসল। এত হাঁসল যে ওর চোখ দিয়ে পানি পর্যন্ত গড়ে পড়ল। কোন যুদ্ধ ছাড়াই মাহাদ যেন আজ জয়ী হয়ে গেল।