উমার কন্ঠে আজ কোন আড়ষ্টতা নেই, নেই কোনো জড়তা। অভিমানের প্রবল ঝড় তার ভেতরটাকে চূর্নবিচূর্ন করে দিচ্ছে। এতোকাল রুদ্রের কোনো কিছুই তাকে বেদনা দিত না, তবে আজ দিচ্ছে। হয়তো লোকটাকে কোথাও না কোথাও মনে ঠায় দিয়েছে সে। তাই তো এই অসহনীয় যন্ত্রণা সইতে পারছে না সে। রুদ্রের চোখে চোখ রেখে রুঢ় কন্ঠে বললো,
“আজ বলেই দিন কি চান আপনি? আর কতো যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমাকে? সেদিন তো খুব বলেছেন ভালোবাসেন। এই ভালোবাসার নমুনা? আর কতো লুকানো সত্য আছে? আর কতো গোপনীয়তা? আজ আমার উত্তর চাই।“
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“বেশ্, আজ তোমাকে সব খুলে বলবো আমি। তারপর নাহয় তুমি বিবেচনা করবে আমার মত মানুষের সাথে থাকা যায় কি না!”
উমা অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। লোকটাকে বোঝা বড্ড জটিল কার্য। এই দিঘীর জলের ন্যায় শীতল তো এখনোই সমুদ্রের মতো উত্তাল। রুদ্র নামটি যেনো যথার্থ তার জন্য। মহাদেবের ন্যায় তার বহু রুপ। এই যে কিছুক্ষন পূর্বেও কি উগ্র আচারণ ছিলো, অথচ এখন কি ভীষন নমনীয় কন্ঠে কথা বলছে। মনেই হচ্ছে না লোকটির মাঝে কলুষতার ছিটে আছে। রুদ্র খাটে বসলো। উমাকে তোয়াক্ষা না করেই একটা সিগারেট জ্বালালো। এই নিয়ে আজ তার সপ্তম সিগারেট। হবে নাই বা কেনো! কম মানসিক ধাক্কা পার করে নি সে। ইহজীবনে তৃতীয় বারের মতো থানা মুখো হয়েছে সে। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,
“আমি মানুষটা ভালো খারাপের প্রকারভেদে কখনোই পড়ি না। আমি সমাজের ভালো খারাপ দুইকেই নিজেকে ধারণ করে রেখেছি। ভালো মানুষের সাথে আমি ভালো তদ্রুপ খারাপের সাথে আমি জগন্য। আমি শাশ্বতের মতো অন্যায়কে দমন করতে চাই না। বরং অন্যায়ের মাঝে থেকে তাকে রাজত্ব করতে চাই। ছোটবেলা থেকে আমি দেখে এসেছি ক্ষমতা থাকলেই রাজত্ব। আর নারী কেবল ই শরীরের খোড়াক। বাবা কখনো মাকে ভালোবাসেন নি; প্রয়োজনে কাছে টেনে নিয়েছেন, প্রয়োজন ফুরাতেই তাকে দাসীর চেয়েও জঘন্য ভাবে ছুড়ে ফেলেছেন। আমার মায়ের তাতে অভিযোগ নেই। মূখ্য মেয়ে মানুষ কি না, স্বামী মানেই ভগবান। গ্রাম জানে বাবা পুত্রপ্রেমে অন্ধ, কিন্তু আমি জানি আমার সাথে এই অট্টলিকায় কি কি হয়েছে। আমার বাবার কাছে ক্ষমতাই সব, ক্ষমতার জন্য সে সবকিছু করতে পারে। তাই তো নিজের ছেলেকে আধারে আসামীর ন্যায় আটকে রাখতে তার একবার বুক কাঁপে নি। ছোট বেলায় বেশ ক্ষুদ্ধ হতাম, বাবা আমার এমন কেনো? সবার বাবা তো এমন নন। কিন্তু উত্তর পেতাম না। এরমাঝে আমাদের বাসায় শাশ্বতের আগমন ঘটলো। সে আমার মতো উগ্র ছিল না। খুব শান্ত, নমনীয় ছিলো। ওর প্রশংসা সর্বাদাই বাবার কাছে আসতো, আমিও ভালো হতে চাইতাম, কিন্তু কেনো যেনো হয়ে উঠতো না। একবার স্কুলের একটা ছেলের সাথে আমার বাজে ভাবে ঝগড়া বাদে। এক পর্যায়ে আমি ছেলেটার হাতে পেন্সিলের ভাঙ্গা অংশ ঢুকিয়ে দেই। ভেবেছিলাম বাবা খুব চটবেন। কিন্তু উলটো হলো, স্কুলে আমাকে লোকদেখানো বকুনি দিলেও বাড়ি এসে তিনি আমাকে বাহবা দিলেন। বাবার একটা কঠিন বাক্য আছে জানো তো,
“তুমি যদি মানুষকে পিসতে পারো তবেই আগাতে পারবে, নয়তো তোমাকে পিসিয়ে তোমার পেছনের জন এগিয়ে যাবে”
আমার বেড়ে ওঠা এই বাক্যকে কেন্দ্র করেই। বুঝতে পারলাম বাবা আমাকে পশু হিসেবে গড়ে তুলতে চান। বড় হতে লাগলাম, আমার দাম্ভিকতা আকাশ ছুলো। কাউকে পরোয়া করলাম না। কারন আমার বাবার ক্ষমতা তো আছেই আমাকে বাঁচাতে। বাবাও আমার সব কাজেই সন্তোষ প্রকাশ করতে লাগলেন। রাজনীতি আমাকে সর্বদা আকর্ষন করতো। তাই পলিটিক্যাল সাইন্সে ভর্তি হলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিলাম। আমার বেশ দাপট তৈরি হলো। নেতৃত্ব দিতে লাগলাম, সেখানে আমি অভিনব সিংহের পুত্র ছিলাম না। ছিলাম রুদ্র সিংহ রায়। আমার ভয়ে ছাত্ররা কাঁপতো। আন্দোলন, মারপিট যেনো আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ালাম। কিন্তু হুট করেই সব বদলে গেলো।“
রুদ্র থেমে গেলো, উমা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর দীর্ঘ নৈঃশব্দ্যতা। রুদ্র পরিশিষ্ঠ সিগারেটটা দানীতে রাখলো। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“নির্বাচনের জন্য নাম দেবার আগের দিন আমার ঘনিষ্ট বন্ধুর লাশ পাওয়া গেলো, ক্ষত বিক্ষত পানি খেয়ে ঢোল লাশটা পড়ে ছিলো আমাদের হলের পুকুরে। ওই দৃশ্য শুধু হৃদয় বিদারক ই ছিলো না। ছিলো চরম ভয়ংকর। মেরে হাসপাতালে পাঠানো আর পিটিয়ে হত্যা করার মাঝের পার্থক্যটুকু সেদিন বুঝেছিলাম। রক্ত তো আগেও লাগ্তো , পার্থক্য শুধু সেই মানুষের পরাণটা থাকে না। আমার শত্রু কে আমার জানা ছিলো না। তবে এটুকু বুঝেছি এই হত্যা আমাকে করার পরিকল্পনা চলছে। আমার বদলে আমার বন্ধুর জীবন চলে গেছে। আমি রাজনীতি ছেড়ে দিলাম। ওই ঘটনা ভলার জন্য মদ হাতে নিলাম। মাতাল হয়ে পড়ে রইলে মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে থাকে। বাবার কাছে চলে এলাম, বাবার এই কাজে যোগ দিলাম। আমার বাবা সবার কাছে আদরনীয় চেয়ারম্যান সাহেব হলেও তার ক্ষমতা, ঐশ্বর্যের রহস্য অন্যখানে। সে অবৈধ ভাবে বিভিন্ন জিনিস পাঁচার করে থাকেন, মাদকদ্রব্য, হাতিয়ার, বিভিন্ন পার্টস। বেনাপোল বর্ডার এবং মংলা থেকে তার জিনিস আসে। ভূমি দস্যু হিসেবেও তার বিশাল পরিচয়। বেনামী জমি দখলের রেকর্ড আছে। শহরের শেষ প্রান্তে একটা গ্রামের বেশ জমি দখল করে সেখানে তার বিশাল জুট মিল রয়েছে। কিন্তু এগুলো কিছুই বাবার নামে নেই। এই ব্রীজের কাজটাও বাবার কন্সট্রাকশন ই নিয়েছে। আমার কাজ এগুলোকে দেখে রাখা। তবে ব্রীজ ধসের কারণ আমি নই, ইঞ্জিনিয়ার শাহাদাত। সে মাঝে ঘাপলা করে। ও বাবার প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে এই কাজ করে, যেনো বাবা ফেসে যান। উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচনে যেনো বাবা হেরে যান। যখন তার এই কারসাজি ধরা পড়ে যায় তখন সে আমার ভয়ে পলাতক হয়ে যায়। আমি আগেই বলেছিলাম, আমি মানুষটা ভালো নই। তোমার মনে আছে আমি বিয়ের রাতে ঘর থেকে চলে গিয়েছিলাম?”
“জ্বী আছে”
“সেই রাতে আমার বাবার সাথে কিছু কথা কাটাকাটি হয় বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে, আমি বেড়িয়ে যাই। আমার কিছু খেচর আমায় খবর দেয় শাহাদাতের খোঁজ পেয়েছে। প্রথমত আমার মেজাজ খারাপ ছিলো, উপরন্তু শাহাদাতের কথা শুনতেই আমার মাথায় আগুন ধরে যায়। আমার ইচ্ছে হয় ওকে খুন করতে, আমি সময় নষ্ট না করে সেখানে চলে যাই।“
“আপনি কি উনাকে মেরে ফেলেছেন?”
কাঁপা স্বরে উমা প্রশ্নটি করে উঠে। রুদ্র মুচকি হেসে বলে,
“খুন করবো বললেই খুন করা যায় না। বুকে সাহস লাগে, যে মৃত্যু ভুলতে আমার মদের শরনাপন্ন হতে হলো সেই মৃত্যু কি এতোটা সহজ? না ওকে মারি নি। তবে বাঁচার মতো ও ছাড়ি নি। আমার যে মীর জাফরদের পছন্দ নয়”
রুদ্রের শান্ত কন্ঠ গায়ে কাঁটা দেয় উমার। রুদ্রের চোখজোড়া স্থির। সে তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। রুদ্র এবার উঠে দাঁড়ালো, উমার মুখোমুখি হয়ে ধীর স্বরে বলল,
“আমি আগেও বলেছি, আজ আবার বলছি, আমি মানুষটা ভালো নই। খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু আমার নিষ্ঠুরতা তোমার কাছে এসেই থেমে যায়। আমি এই প্রথম কাউকে মারি নি। আমি সেদিন যখন কাজে গিয়েছিলাম, বাবার কাজে তখন ও কাউকে মেরে এসেছি। সেই লোকটা এখন হাসপাতালে। আমি তো মারার জন্য ফেলে আসতে চেয়েছিলাম। দীপঙ্কর ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বললাম। এবার সিদ্ধান্ত তোমার………
——————
রুদ্রের শান্ত কন্ঠ গায়ে কাঁটা দেয় উমার। রুদ্রের চোখজোড়া স্থির। সে তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। রুদ্র এবার উঠে দাঁড়ালো, উমার মুখোমুখি হয়ে ধীর স্বরে বলল,
“আমি আগেও বলেছি, আজ আবার বলছি, আমি মানুষটা ভালো নই। খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু আমার নিষ্ঠুরতা তোমার কাছে এসেই থেমে যায়। আমি এই প্রথম কাউকে মারি নি। আমি সেদিন যখন কাজে গিয়েছিলাম, বাবার কাজে তখন ও কাউকে মেরে এসেছি। সেই লোকটা এখন হাসপাতালে। আমি তো মারার জন্য ফেলে আসতে চেয়েছিলাম। দীপঙ্কর ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বললাম। এবার সিদ্ধান্ত তোমার, যদি তোমার মনে হয় আমি ভুল তাহলে আমি ভুল। আমার কিছুই বলার নেই।“
রুদ্র সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। উমা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ষোড়শীর পরিশ্রান্ত দৃষ্টিত চেয়ে থাকে মাটির দিকে। ঘরে তীব্র নীরবতায় লাল ঘরটা ছেয়ে আছে। শুধু বা পাশের দেয়ালের দোলনঘড়িটার টিকটিক শোনা যাচ্ছে। রুদ্র বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায়, সিগারেটের প্যাকেটটি খুলে একটা নিকোটিনের দলা আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বালায়। সুগাঢ় আধারে ধপ করে একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠে, তার উদাসীন কাতর চাহনীতে তাকিয়ে থাকে আধারের মেঘের মাঝে উঁকি দেওয়া এক চিলতে রুপালী চন্দ্রের দিকে। সিগারেটের জ্বলন্ত নিকোটিনের ধোয়া আধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে রুদ্রের মনের সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস।
১৩!!
টঙ্গে বসে রয়েছে শাশ্বত, অবশেষে শাহাদাতের খোঁজ পাওয়া গেলো। কিশোরগঞ্জের এক প্রতন্ত হাসপাতালে সে ভর্তি। অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরনের জন্য কোমায় চলে গিয়েছে সে। ডাক্তার কিছুই বলতে পারছে না, তার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তবে তার চিকিৎসার কোন ত্রুটিও হচ্ছে না। তাকে একজন অর্থবান ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেই তার চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিয়েছেন। শাহাদাতকে কিশোরগঞ্জের মত জায়গায় পাওয়াটা বেশ অবাক করছে শাশ্বতকে। ডাক্তারদের বক্তব্য সে একটি সড়ক দূর্ঘটনার কারণেই আহত হয়েছে। সঠিক সময়ে তাকে হাসপাতালে আনার কারণে সে বেঁচে গিয়েছে। ব্যাপারগুলো খুব সাজানো লাগছে। যেনো বহির্গত কেউ একের পর এক দাবার ঘর সাজিয়ে রেখেছে। সেই অনুযায়ীই কাজ করা হচ্ছে। সকল ঘটনাগুলো দাবার গুটির মত এক এক কদম করে আগাচ্ছে। বুঝতে পারলেও প্রমান করার উপায় নেই। বাপ ছেলে সুন্দর মত পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। শাহাদাতের দূর্ঘটনাটি হয়েছে রুদ্রের বিয়ের রাতে। সেই রাতে রুদ্র বাড়ি ফেরে নি রাতে। দুপুরে মামামশাই শহরে চলে যান। সবকিছু একই মালায় বাঁধা, অথচ প্রমাণের উপায় নেই। শাশ্বত এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সকলে তাকে উম্মাদ ভাববে। যে কাগজ গুলো সে অভিনব সিংহের ঘর থেকে পেয়েছিলো, তাতে অভিনব সিংহকে হাতে নাতে ধরার কোনো উপায় নেই। এদিকে রকিবুল মাষ্টার ও চুপ মেরে আছে। সে যেনো অন্যায়ের বিপক্ষে থেকেও অন্যায়কেই বাহবা দিচ্ছে। হাতের চায়ের কাপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাই চা টা খাওয়া হলো না শাশ্বতের। এর মাঝেই সুরেলা চিকন কন্ঠ কানে আসে।
“এক খানা কলা পাউরুটির দাম পাঁচ টাকা? একি ডাকাতি করছো গো তৈয়ব ভাই”
“দাম বাড়লে আমি কি করাম, পাউরুটি আসে প্যাকেট বিশ টাকা। পিচ তিন টাকা, কলা দুই টাকা। আমার ও তো পেট বুন্ডি। আচ্ছা যাও আমি তোমারে চার টাকায় দিতাছি, এই বার লইবা?”
“তিন টাকাই আছে আমার কাছে। আমার ক্ষুধা লেগে তাই নিচ্ছি নয়তো এই ডাকাতির শেষ দেখতাম।“
শাশ্বত খেয়াল করলো ছোট মেয়েটি সমানে দোকানীর সাথে দু টাকার জন্য ঝগড়া করে যাচ্ছে। মেয়েটিকে বড্ড পরিচিত লাগছিলো শাশ্বতের, পরমূহুর্তে মনে পড়লো মেয়েটি আর কেউ নেই সেই পেয়ারা বনে খুদে পেত্নী। দোকানী তৈয়ব যখন মেয়েটিকে বুঝাতে অসমর্থ হলো তখন শাশ্বত তাকে বললো,
“তৈয়ব ভাই, ছেড়ে দাও। বাচ্চা মেয়ে, দু টাকার জন্য মাথা খাচ্ছো কেনো? আমি দিয়ে দিচ্ছি”
দোকানীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, আমতা আমতা করে বললো,
“জ্বে আচ্ছা।“
দোকানীর কথা বলার প্রায় সাথে সাথে মেয়েটি তেজী গলায় বলল,
“আমার উপর উদারতা প্রয়োগ করার চেষ্টাও করবেন না। আমার খাবারের দাম আমি ই দিতে পারবো। আপনাদের কাছে এই দুটাকাটা মাথা খাওয়া লাগলেও আমার কাছে এটা আগামীদিনের খাবার কেনার টাকা। ভগবান পয়সা দিছে তো তাই গুরুত্ব নেই। এই হলো এই সমাজের সমস্যা, গরীবের টাকা নেই। ধনীর টাকার মূল্য নেই“
মেয়েটির তীব্র প্রতিবাদে হতবাক হয়ে গেলো শাশ্বত। ছোট মেয়ের এতটা আত্নসম্মান তাকে বিস্মিত করলো। মেয়েটি কলা পাউরুটি নিয়ে হনহন করে চলে গেলো। দোকানী আমতা আমতা করে বললো,
“কিছু মনে কইরো না শাশ্বত দা, রাজীর স্বভাব এমন ই। একটু মুখড়া কি না।“
“কোন বাড়িতে থাকে গো?”
“আরে নিখিল দায়ের মেয়ে, রাজশ্বী। উমার ছোট বোন, দুই বোন দু রকম। একজন শান্ত দীঘি তো অপরজন উত্তল সমুদ্র।"
শাশ্বত কিছু বললো না, হাটু অবধি আটপৌড়ে ভাবে শাড়ী পরা মেয়েটির যাবার পানে চেয়ে রইলো সে। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো। এই হাসির অর্থ তৈয়ব বুঝার উর্ধ্বে।
চুলোর মৃদু আঁচে খাসির মাংস রান্না করছে উমা। আজ তার শ্বশুর মসাই এর বেশ মাংসের ঝোল খাবার ইচ্ছে হয়েছে। তিনি সকালে নিজ মর্জিতে খাসির মাংস কিনে এনেছেন। লক্ষী দেবী উমার হাতে বাজারের ব্যাগখানা ধরিয়ে দিলেন। উমার সাথে পাত্তে কথা বলেন না তিনি। এক শীতল যুদ্ধ চলছে তাদের মাঝে। তার ধারনা তার ছেলেকে হাতিয়ে নেবার বাজে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই ষোল বছরের মেয়েটি। তার পতী বলেছিলেন,
"ছেলে বিয়ে দিলে রুদ্রের উদাসীনতা কমবে।"
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কমার বদলে ছেলেই হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। রুদ্রকে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করার পর ও যে উমাকে নিয়ে কালীগঞ্জে চলে যাবার বায়না ধরেছে। সেখানে নাকি উমার পড়াশোনা ভালো হবে। আরে ভাই পড়াশোনা করে কি হবে! আজ অবধি কি করেছে এতো শিক্ষা দিয়ে। সেই তো হেসেল ই টানবে উমা। উমার উপর সুপ্ত রাগ থেকেই তার সাথে কথা বলা বন্ধ লক্ষী দেবীর। উমা বাধ্য নারীর ন্যায় হেসেলে চলে গেলো। আজকাল মন বড্ড দূর্বল হয়ে গেছে। লড়তেও ইচ্ছে হয় না। রুদ্র এর সাথে কথায়া হয় নি সেদিনের পর থেকে। উমা রান্না ই করছিলো হঠাৎ......
—————
উমার উপর সুপ্ত রাগ থেকেই তার সাথে কথা বলা বন্ধ লক্ষী দেবীর। উমা বাধ্য নারীর ন্যায় হেসেলে চলে গেলো। আজকাল মন বড্ড দূর্বল হয়ে গেছে। লড়তেও ইচ্ছে হয় না। রুদ্র এর সাথে কথা হয় নি সেদিনের পর থেকে। উমা রান্না ই করছিলো হঠাৎ ফুলির মা ছুটে আসলো হেসেলে। তার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। যেনো ভুত দেখে পালিয়ে এসেছেন। তরতর করে ঘামছে সে। উমা ব্যগ্র কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে ফুলির মা?”
“বউ ঘরে চলো, রুদ্র দাদায় ফিট খাইয়ে পইড়ে গেছে”
ফুলির মার কথা শুনে চমকে উঠে উমা। রুদ্র এবং তার সম্পর্কটা সেদিনের পর থেকে যেনো থেমে গিয়েছে। তাদের সম্পর্কটা অন্য সম্পর্কের ন্যায় স্বাভাবিক হবার জন্য গুটি গুটি পা বাড়াচ্ছিলো, উমা তাকে নিজ জীবনের একজন অতপ্রত মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলো। কিন্তু সবকিছু যেনো কাঁচের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। রুদ্রের নির্লিপ্ত চিত্তের স্বীকারোক্তিতে কতটা সত্যতা এবং কতটা ছলনা সেটা বোধগম্য হচ্ছে না উমা, বিমর্ষ আহত হৃদয়টা পুনরায় আহত হবার ভয়ে এক লুকোনো প্রকোষ্ঠ্যে নিজেকে আটকে ফেলেছিলো। কিন্তু ফুলির মার ব্যাগ্র কন্ঠে কথাটা কর্নকুহরে যেতে নিবৃত্ত চিত্ত অস্থির হয়ে উঠলো উমার। চুলোর রান্নাটা সেভাবে রেখে ছুটলো সে রুদ্রের নিকট। নিজ ঘরে পৌছাতেই নজরে পড়লো শ্বশুর, শাশুড়ি এবং পিসি শাশুড়ি সেখানে গোল বেধেছেন। রুদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে রয়েছে, ডাক্তার ডাকার জন্য দীপংকরকে পাঠানো হয়েছে। দীপংকর অভিনব সিংহ এর খুড়তোতো ভাইপো। সে ছোট বেলা থেকেই অভিনব সিংহের কাছেই মানুষ। সে মূলত গুদামে থাকতো। কিন্তু আজকাল ঘরের থাকা শুরু করেছে। অভিনব সিংহ পুলিশি কান্ডের পর ঘর থেকে বের হন না। দীপংকর তাকে সকল কার্যে সাহায্য করে। অপরদিকে রুদ্রের ভাব যেনো এমন যেনো কিছুই ঘটে নি। সে তার মতো কাজে লিপ্ত। কালীগঞ্জের বাড়িতে কাজ শুরু করে দিয়েছে, নিজের দোকানেও মনোনিয়োগ করছে। রুদ্রের এমন পরিবর্তন অভিনব সিংহকে বড্ড ভাবাচ্ছে।
রহিম ডাক্তার এলো। নাড়ি মেপে বললো,
“প্রেসার কম অভিনব বাবু। ছেলে মানুষের এত কম প্রেসার হলে তো মূর্ছা যাবেই। রুদ্রকে এখন থেকে দিনে তিনটে করে ডিম এবং এক পোয়া দুধ খেতে হবে। দুদিন বিছানায় গড়ালেই ঠিক হয়ে যাবে।“
“আচ্ছা”
রহিম ডাক্তারের ফর্দ শুনে খিঁচিয়ে উঠলো রুদ্র। বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আমি কি রাক্ষস নাকি?”
“রাক্ষস হবে কেনো? আমি তাই বললাম যা তোমার শরীরের দরকার। উমা মা, তুমি একটু খেয়াল রেখো তো। রুদ্র যেনো খাবারটা সময় মতো খায়।“
উমা ঘাড় কাত করলো। লক্ষী দেবী মুখ বাকালেন, মনে মনে বললেন,
“ও রাখবে খেয়াল। আমার ছেলেটার মাথা গিলতেই তো এসেছে এই মেয়ে।“
রহিম ডাক্তার যাবার পর অভিনব সিংহ থমথমে গলায় বললো,
“দেখেছো রুদ্র কি হয়েছে? টাগড়া ছেলে কিনা মূর্ছা গেছো। আমি বলি কি কালীগঞ্জ যাবার জিদ ছাড়ো। অতদূরে যেয়ে কি হবে বলো। এর চেয়ে তুমি গুদাম সামলাও। বউ মা না হয় আশেপাশের কোনো কলেজে ভর্তি হবে।“
“আপনি জানেন, আমাদের গ্রামে কলেজ নেই। কলেজ অধিকাংশ শহরের দিকে। ভালো কলেজ একখানা আছে তাও কালীগঞ্জে। আমি উমার পড়াশো্নার সাথে কোনো প্রকার হেলদোল করবো না। আমি আর শাশ্বত তো ঐ কলেজেই পড়েছি। উমাও পড়বে। আমরা তো ওখানেই থাকতাম। আপনি ও জানেন কালীগঞ্জ থেকে গ্রামে আসতে পৌনে এক ঘন্টা লাগে, আর রাস্তাটাও দূর্গম। আমি চাই না উমা প্রতিনিয়ত এতো কষ্ট করে যাতায়াত করুক। তাই কালীগঞ্জে আমার আর উমার যাবার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।“
জড়তাহীন কন্ঠে কথাটা বলে রুদ্র। অভিনব সিংহ কোনো কথা বললেন না। হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন। লক্ষী দেবী হিনহিনে স্বরে বললেন,
“তুমি খোকার কাছে থাকো। আমি হেসেলে গেলুম, ডিম সিদ্ধ পাঠাচ্ছি। খাওয়ায়ে দিবে খোকাকে”
উমা ঘাড় কাত করলো। সকলে চলে গেলে সে বিছানার কাঠ ধরে দাঁড়ালো। রুদ্র কোমল দৃষ্টিতে তাকালো তার ষোড়শী বউ এর দিকে, মেয়েটির শ্বেত মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। হাতে এখনো হলুদ লেগে আছে। হয়তো ছুটার সময় হাত ধোওয়ার কথাটাও স্মরণ ছিলো না তার। রুদ্র নমনীয় স্বরে বললো,
“শুনো”
“কিছু লাগবে?”
“হু”
উমা এগিয়ে গেলো তার কাছে। ব্যস্ত স্বরে বললো,
“কি লাগবে?”
রুদ্র কিছু বললো না, শুধু শান্ত নজরে উমাকে দেখতে লাগলো সে। পাঁচ দিন হয়ে গেছে মেয়েটি তার সাথে কথা বলে না। অন্য সময় হলে তাকে জোর করত, কিন্তু উমার মন যে অবাধ্য। অবাধ্য মন জোর করে দখল করা সম্ভব নয়। মেয়েটির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম খাটে না, খুব অন্য রকম সে। শান্ত দীঘির ভেতরেও সমুদের উত্তলতা তার মাঝে। কেবল একখানা মাংসের দলা নয়, যাকে গায়ের জোরে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসবে রুদ্র। উমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার অন্তরে নিজের দখল অসম্ভব। রুদ্রকে চুপ থাকতে দেখে উমা বলে,
“কি লাগবে বললেন না যে? বলুন, আমি এনে দিচ্ছি”
“বেশ, আমার একটা সুযোগ চাই।“
নির্লিপ্ত চিত্তে কথাটা বলে রুদ্র। তার কাতর দৃষ্টি ছিন্নভিন্ন করছে উমাকে। উমা নত মাথায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখটা জ্বলছে। বুক চিরে এক দলা কান্না পাচ্ছে। বা পাশে প্রচন্ড বিষাদ বেদনা অনুভূত হচ্ছে তার। রুদ্র তার হাতটা টেনে ধরলো। আকুল কন্ঠে বললো,
“আমি কি শেষ সুযোগ পাবার অযোগ্য উমা?”
দ্বিধায় জর্জরিত উমা, কি উত্তর দিবে বুঝে উঠছে না। মস্তিষ্ক বাড়ে বাড়ে বলছে রুদ্র মিথ্যুক, একজন পাষান কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সে বদলাবে না কখনোই। অপরদিকে হৃদয় বলছে, একটিবার সুযোগ দিলে কি খুব ক্ষতি হবে। ষোল বছরের জীবনে খুব কম মানুষই উমার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। রুদ্র তাদের পাশে একজন। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেনো, হয়েছে তো। রুদ্র যেমনই হোক সে উমার সামনে নিজেকে খুলে ধরেছে। তার সকল সত্যি উমাকে বলেছে সে। তবে কি একটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য নয় সে। কাঁপা জড়ানো কন্ঠে উমা বলে,
“আমি সত্যি জানি না, আপনাকে কি উত্তর দিবো। আপনাকে বোঝার ক্ষমতা যে আমার নেই, যতবার বুঝতে চেয়েছি আহত হয়েছি। পুনরায় বিশ্বাস করার সাহস আমার স্নায়ুকোষে নেই। আপনার রাগ, ক্রোধের কোনো সীমা নেই। রাগ হলে আমাকে হয়তো………”
“ আদপি না, নিজের প্রানপাখির ক্ষতি করার মতো সাহস যে আমার নেই উমা”
“তাহলে কেনো বা্রে বারে আমাকে আহত হতে হয়। আজ আপনি এ কথা বলছেন, কাল পুনরায় আপনি হয়তো কাউকে পিঠাবেন, কারোর রক্ত আপনার হাতে লাগা থাকবে। পুলিশ এসে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমার এমন অনিশ্চিত জীবন চাই না রুদ্র। যে জীবনে সুখের মাত্রা ক্ষনস্থায়ী, আমার এমন জীবন চাই না। আমি এই ছোট জীবনে সুখের দেখা খুব কম পেয়েছি। এভাবেই আমি অভ্যস্ত। স্বপ্ন দেখার মনটা আমার মরে গেছে। পুনরায় স্বপ্ন দেখতে ভয় হয়। এই বুঝি আকাশ সমান আখাঙ্খাটা এক ঝটকায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।“
উমা জল ছেড়ে দিলো। কোমল গাল বেয়ে নোনাজলের স্রোত গড়াচ্ছে। উমার জল যেনো তীরের মত বিধছে রুদ্রের বুকে। নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না সে। তড়িৎ গতিতে উমাকে জড়িয়ে ধরলো সে। নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে বললো,
“কথা দিচ্ছি উমা, আর কখনো তোমাকে অভিযোগের সুযোগ দিবো না। কখনো তোমার কাজলকালো চোখে অশ্রুর বিন্দু জমতে দিবো না। কথা দিলাম”
উমা মুখ তুলে চাইলো। রুদ্র তখন পরম আদরে তার অধরজোড়ায় গভীর ছোয়া একে দিলো। আজ কেনো যেনো উমা বাধা দিলো না। অভিমানের প্রাচীর ভাঙ্গছে ধীরে ধীরে। ঘরের নৈঃশব্দ্যতা ভালোবাসার উষ্ণ আবেশে মুখোরিত হলো……………