মায়াবতী (পর্ব ০৪)


০৭!! 

-এই মায়া? এটা কি খাচ্ছো তুমি? দাও আমাকে?

রাহাত মায়ার হাত থেকে ক্যানটা একটানে নিয়ে ফেলে চোখ লাল করে মায়ার মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু ততক্ষণে বিপদ যা হওয়ার হয়ে গেছে। রাহাত ক্যানটা হাতে নিয়েই বুঝতে পারলো ক্যানটা এলরেডি ফাঁকা করে দিয়েছে মেয়েটা। রাহাতকে এভাবে রাগ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এতোক্ষণ লোকটা কি সুন্দর করে হেসে হেসে কথা বলছিল। এখন এতো রেগে যাচ্ছে কেন? এই লোকটার এমন অদ্ভুত আচরণ মায়া কখনোই বুঝতে পারে না। কেন যে লোকটা এমন! একটু মিষ্টি করে হাসলে তো লোকটাকে কতো কিউট লাগে! আর এই কালো কালারের স্যুটের ভিতরে সাদা ফরমাল শার্টে! আহ! মারডালা! অথচ লোকটা এতো এমন কেন? হুতুম পেঁচার মতো সিরিয়াস মুডে কেন সারাদিন থাকতে হয় তার? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চিন্তাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে মায়ার মাথার ভিতরে। চোখটা কিছুটা ঝাপসা হতে শুরু করেছে বলে ভালো করে মানুষটাকে দেখতেও পাচ্ছে না। মায়া কোনমতে চোখ ডলে চোখের সামনের কুয়াশার আস্তরণটা সরানোর চেষ্টা করলো। তাতে লাভের লাভ কিছু হলো বলে মনে হলো না যদিও।

-মায়া? তোমাকে না আমি কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে গেলাম? এই ক্যানের ড্রিংকস খেতে বলেছিলাম আমি?

-আরে! এতোজন মিলে বকছেন কেন? আমি তো--। আমার তিয়াস লেগেছে বললাম না? এই যে কোকাকোলার ক্যান! এদ্দম খালি হয়ে গেছে। আর এখানে এত্তো গরমমমম। আমি তো ওই যে--ওই লোকটাকে বললাম কোকাকোলা দিতে। ও তো দিলো না। জুলি আপু কি সুইট! আমাকে দিয়েছে কোকাকোলা। অনেক মজ্জা খেতে। আরেকটু খাবো---।

-থাপ্পড় খাবা মায়া। তোমাকে আর তোমার এই জুলি আপু-দুটোকেই ধরে সমানে থাপড়ানো দরকার। কোকাকোলার ক্যান চিনো না তুমি? গাধা মেয়ে কোথাকার! আর কোনটা সফ্ট ড্রিংকস আর কোনটা অ্যালকোহল বুঝতে পারো না? টেস্ট সেইম লাগে তোমার?

-মজা তো। একটু গন্ধ গন্ধ। কিন্তু মজাআআ। 

-মায়া! তোমাকে আমি? আর এই জুলি? তোর কি মাথা খারাপ? ফাইজলামি করার একটা সীমা থাকা উচিত। ও কখনো এসব খেয়েছে? মেয়েটার নেশা হয়ে যাবে না এখন? নূন্যতম কমনসেন্স নেই তোর? এই ভরা পার্টিতে মেয়েটাকে হ্যারাস করার ইচ্ছে হয়েছে তোর? ছি!

জুলি রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আর ভয়ে কিছু বলতে পারলো না। জানে এখন কিছু বলতে গেলেই আরো ঝাড়ি খেতে হবে। এদিকে শয়তান সোহানটাও ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে কোথায় গিয়ে মরেছে কে জানে! এই হাঁদারামের মাথায় কি আর কোনো ভালো একটা বুদ্ধি এলো না? ওর কথায় মায়াকে ড্রিংকসটা দিয়ে পুরোই ফেঁসে গেছে এবারে। ভেবেছিল কি আর হয়ে গেল কি! ধ্যাত! এদিকে রাহাত জুলির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মায়ার দিকে তাকাতেই দেখলো মায়া ওর দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু একটা হিসাব করার চেষ্টা করছে। রাহাত তাকাতেই মায়া একটু ভয় পাবার ভঙ্গি করে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। অবশ্য কাজটা করতে সফল হলো না। পাশ থেকে জুলি তাড়াতাড়ি মায়াকে ধরে ফেললো। মায়া ততক্ষণে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো হাসতে শুরু করেছে। 

-একটা রাহাত, দুইটা রাহাত, তিনটা রাহাত, চারটা রাহাত--। আআআআ! এই এই? আপনি কি ম্যাজিক জানেন? এতোগুলো কি করে হয়ে গেলেন? আমাকে শিখিয়ে দিবেন? তাহলে আমি আরো চটপট কাজ করে দিতে পারবো। আপনি আর বকতে পারবেন না আমাকে---। হি হি।

-জুলি ওকে ছাড় তুই। যা করার তা তো করেই দিয়েছিস। এখন আজাইরা দরদ দেখিয়ে লাভ কি? মায়া? চলো আমার সাথে। বাসায় যাবে---।

-নাআআহহ। আমার আর আপনার ডান্স বাকি। ওই যে গান প্লে করেছে। আমি ডান্স করবো তো---।

-এখন না মায়া। পরেরবার পার্টিতে ডান্স করো। এখন চলো---।

-নাআআআ। আমি ডান্স করবো--।

-মায়া? তোমার ডান্স আমি রাস্তায় বের করছি। চলো নইলে কিন্তু এখানে রেখেই চলে যাবো। তখন বুঝবে মজা। 

-ইশ! বললেই হলো? আমি তো আপনাকে ধরে আছি। যেতে দিবো না। আর আমি জানি আপনি যাবেনও না। আপনি তো এত্তোগুলো ভালো। এত্তো সুইট।

-জানলে চলো এখন আমার সাথে? অনেক রাত হয়েছে না? বাসায় আন্টি টেনশন করছে তো?

-আন্টি কেন বলছেন? মা বলুন?

-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। মা টেনশন করছে বাসায়। চলো এখন?

-হুম----। কিন্তু আপনি তো এতোগুলো হয়ে গেছেন। আমি কার সাথে যাবো? আপনার সাথে? নাকি আপনার সাথে? নাকি-----।

-মায়া? তুমি আমার সাথে এসো প্লিজ? প্লিইজ? লক্ষী মেয়ে না? এসো?

-হুম। আচ্ছা। একটু আস্তে আস্তে হাঁটুন তাহলে। আমার পায়ে ব্যথা--।

-আচ্ছা আমার হাত ধরে এসো?

-হুম----।

রাহাত আলতো করে মায়ার হাত ধরে অফিসের দরজার দিকে পা বাড়ালো। মেয়েটার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে সেটা রাহাতও বুঝতে পারছে। কিন্তু এই ভরা পার্টিতে সবার সামনে দিয়ে মেয়েটাকে তুলে নিতেও পারছে না। দরজার কাছাকাছি আসতে সোহানের সাথে দেখা হয়ে গেল রাহাতের। মায়াকে এমন টলমলে পায়ে হাঁটতে দেখে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো এমন ভান করলো।

-কি রে? শেষমেশ এই মেয়েটাকে পুরো মদের নেশায় বুদ করে চুপিচুপি পালিয়ে যাচ্ছিস? কি ভাই? এসব প্ল্যান ছিল তাহলে?

-সোহান? মুখ সামলে--। কি ঘটেছে সেটা তোর পেয়ারের জুলিকে গিয়েই জিজ্ঞেস কর। আর পার্টিটা এখানেই শেষ কর। আমার পক্ষ থেকে সবাইকে সরি বলে দিস। 

-আচ্ছা যা। কি আর করা যাবে? কোথায় ভাবলাম বহুদিন পর সবাই মিলে একটু এনজয় করবো---! তুই তো এখন আখের গুছিয়ে পালাচ্ছিস।

-আমার ঘাট হয়েছে তোদের কথায় পার্টির এ্যারেঞ্জ করে। আক্কেল থাকতে জীবনে আর এই ভুল করবো না। 

-ভাই? এভাবে বলতে পারলি?

-তোদের দুটোকেই আমি কাল দেখে নিচ্ছি। ওয়েট।

-হা হা। যা যা। আজ তো তোরই সময় রে ভাই। 

রাহাত আরেকবার একটা রাগী লুক দিয়ে মায়াকে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রাইভার গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। রাহাত তাকে কিছু টাকা দিয়ে বাসায় চলে যেতে বলে মায়াকে সামনের সিটে বসিয়ে দিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। রাহাত আপাতত চাইছে না মায়া কোনো পাগলামি করলেও সেটা কেউ দেখুক। যদিও মেয়েটা আপাতত চুপ করে চোখ বুজে আছে। ঘুমিয়ে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না যদিও। তবে আপাতত ঘুমিয়ে গেলেই মঙ্গল ওদের দুজনের জন্যই। 

এদিকে রাহাত মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই সোহান জুলির পাশে এসে দাঁড়ালো। জুলিও সোহানকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো। সোহান জুলির গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিলো। 

-রাহাত খুব বকেছে না আমার পাগলিটাকে? হুম? 

-কাজটা কি আমরা ঠিক করলাম সোহান? যদি ভুলভাল কিছু হয়ে যায়?

-রাহাতের রিএ্যাক্টগুলো দেখছ না? ড্রিংকসটা খাইয়েছ মায়াকে, আর টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছে রাহাত। এই ছেলেটা নিজের ফিলিংসগুলো কবে বুঝবে তার জন্য বোকার মতো ওয়েট করে থাকার কোনো মানে হয় বলো? আজ মায়া নিজের ফিলিংস ওকে জানিয়েই ছাড়বে দেখো। 

-আর রাহাত যদি না মানে? আমরা যেমন ভাবছি তেমন যদি না হয়? তখন? তখন তো শেষ চান্সটাও হারাবো আমরা। ছেলেটাকে স্বাভাবিক জীবনে তো ফিরিয়ে আনতে হবে বলো?

-আরে বাবা! আর ভেবো না তো। গত ছয়মাসে মায়া ওকে কতোটা বদলে দিয়েছে দেখেছ? আমরা এই কয়টা বছর চেষ্টা করেও যা পারি নি মেয়েটা সেটা কয়েক দিনেই করে ফেলেছে। এই মেয়েটাকেই তো রাহাতের জীবনের হাল ধরতে হবে বলো? আর রাহাত মানবে না মানে? ওর ঘাড় মানবে। বেচারা দিওয়ানা আশিক! আমার এতো হাসি পাচ্ছিল বিশ্বাস করবে না---। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলাম---।

-হুম----।

-জুলি? আর টেনশন করো না প্লিজ? ওরা দুজন নিজেদেরকে একটু বুঝে নিক। আপাতত আমরা নিজেদের নিয়ে ফোকাস করি? কি বলো?

-কি?

-উড ইউ লাইক টু ডান্স উইথ মি ম্যাম? প্লিজ? 

-ইয়া---। আই উড লাইক টু।

জুলি হেসে সোহানের বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত রাখতেই সোহান ওকে টেনে একটানে একদম নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। নাচের তালে হারিয়ে গিয়ে সব চিন্তা মাথা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করলো জুলি। আর সোহান জুলির ভাবুক মুখটায় হাসির ছোঁয়া ফিরিয়ে আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কখনো আলতো করে জুলিকে ছুঁয়ে দিয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে সোহান। আবার কখনো জুলিকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মূহুর্তটুকু অনুভব করে গোপনে দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করছে। কেমন যেন একটা লুকোচুরি খেলা চলছে এই দুজনের মধ্যে। একজন জানে সামনের মানুষটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে বলে কোনো কষ্ট দিতে চায় না। আর অন্যজন জানে এই ভালোবাসা নিরেট এক তরফা। অন্যপাশের মানুষটার মনের রাজ্যে বিচরণ করছে আরেকজন। এই লুকোচুরি খেলায় দুজনেই ক্লান্ত ওরা। তবু জীবনের রঙ্গমঞ্চে তো অভিনয় চালিয়ে যেতেই হয়। ওরাও তাই অভিনয়টা চালিয়েই যায়। একবার, দুবার, বারবার। বারবার।

০৮!! 

'যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।' এই প্রবাদটা আজকের সিচুয়েশনের জন্য একদম খাপে খাপে সত্যি মনে হচ্ছে রাহাতের কাছে। একে তো মায়াকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার তাড়া, তার উপরে রাস্তায় আজ আবার লম্বা জ্যাম। যদিও মায়া শান্ত হয়েই ঘুমিয়ে আছে রাহাতের পাশে। তাই অন্ধকারের মধ্যে মেয়েটার মুখটা দেখতে না পেয়েও কিছুটা রিল্যাক্স মুডে আছে রাহাত। অবশ্য মায়াকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার আগে এই রাস্তার মাঝেই মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গে তাহলে যে কি পরিমাণ পাগলামি করবে সেটা ভেবে কিছুটা ভয়ও করছে রাহাতের। এই ভয়ের কারণেই কি না কে জানে রাহাত একটু পর পর একবার নিজের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর একবার রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে। প্রায় আধ ঘন্টার মতো সময় ধরে সামনের গাড়িটা এক ইঞ্চিও নড়ে নি রাহাতের সামনে থেকে। রাহাত কিছুটা বিরক্ত হয়েই একবার হর্ন বাজিয়ে সাথে সাথেই আবার চমকে হর্নের সুইচের উপর থেকে হাত সরিয়ে পাশের সিটে মায়ার দিকে ফিরলো। হর্নের শব্দে মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যাবে, কথাটা ওর মাথাতেই ছিল না। গাধার মতো একটা কাজ করে নিজেই বিপদে পড়ে গেল বেচারা। মনে মনে নিজেকে গালি দিতে গিয়ে আরেকটা সাংঘাতিক ঘটনা লক্ষ্য করলো রাহাত। মায়ার যে শুধু ঘুম ভেঙ্গেছে তাই নয়, মেয়েটা বাইরের অন্ধকারের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। ভয় পাওয়ার বিষয়টা হলো মায়ার নীরবতা। মায়ার এই চুপ করে থাকা রাহাতের কাছে ঝড়ের পূর্বাভাসের সংকেতের মতো লাগছে। তাই বেচারা বুঝতে পারছে না মায়াকে ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করবে, নাকি মেয়েটা যেমন আছে তেমনই থাকতে দিবে। 

-রাহাত? আপনি এতো খারাপ কেন বলুন তো? 

মায়ার শান্ত কণ্ঠে নিজের নামটা শুনে রাহাতের বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। এর আগে তো মায়া কখনো রাহাতের নাম ধরে ডাকে নি। সবসময়ই আধো কাঁপা গলায় 'জি স্যার, হ্যাঁ স্যার' করে গেছে মেয়েটা। আজ সেন্সে নেই বলে এভাবে কথা বলছে? নাকি এর পিছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে? রাহাত কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করে নি মায়া কখন নিজের সিটবেল্ট খুলে রাহাতের একদম কাছে চলে এসেছিল। এবারে মায়া রাহাতের কোটের কলারের এক কোণা নিজের দিকে টেনে ধরায় রাহাতের প্রায় মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়ায় জোগাড়। কোনমতে মায়ার হাত থেকে নিজের কোটটা ছাঁড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই মায়া রাহাতের দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে গেল। 

-কিছু জিজ্ঞেস করছি তো আপনাকে? জবাব দেন না কেন হ্যাঁ?

-মায়া? আমি আবার কি করেছি? আর এই পাগলি মেয়ে? কি করছ? পাগল হলে?

-হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি। বলুন আপনি এতো খারাপ কেন? কেন কেন কেন? কেন এতো খারাপ বলুন?

-কি মুশকিল! আমি কি করেছি? আমি তো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছি। খারাপের কি করলাম!

-করেন নি? আমি যে কখন থেকে রাগ করে বসে আছি আপনি একবারও আদর করে আমাকে জিজ্ঞেস করেন নি কেন রাগ করেছি। রাগ ভাঙ্গানোরও চেষ্টা করেন নি একবারও। কেন? এতো খারাপ কেন আপনি? হ্যাঁ?

রাহাত কি বলবে ভেবেই পাচ্ছে না। মেয়েটা সেন্সে থাকলে জীবনেও এমন কথা বলতো না রাহাত সেটা খুব ভালো করেই জানে। মায়াবতীটাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না রাহাতের। কিন্তু সেসব নিয়ে আফসোস করার সময় এখন আর নেই। তাই কোনোমতে মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো রাহাত। নইলে বাসায় গিয়েও এমন পাগলামি করতে থাকলে ওর মা কি ভাববে! দৃশ্যটা কল্পনার করার চেষ্টা করতেই রাহাতের হাত পা প্রায় ঠান্ডা হতে শুরু করলো। ততক্ষণে মায়া সিটের উপরে বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি হয়ে দু পা তুলে বসে রাহাতকে ধরে রেখেছে। সামনের দিকের জ্যামটা কিছুটা ক্লিয়ার হওয়ায় সেটা খেয়াল করতে পারলো না রাহাত। কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার পর আবার জ্যামে আটকা পড়লো।

-এই? আপনি তো খুব পচা! এখনো একবারও জানতে চান নি আমি কেন রাগ করেছি। আপনি একটা খুব খারাপ, খুব খারাপ, খুব খারাপ। 

-মায়া? আচ্ছা বলো? রাগ করেছ কেন? আমি কি করেছি?

-এভাবে জিজ্ঞেস করলে হবে না। বলবো না তাহলে---।

-তাহলে কিভাবে জিজ্ঞেস করবো?

-আদর করে জিজ্ঞেস করেন। তাহলে বলবো  নইলে বলবো না।

-মায়া?

-আআআআআ। আমাকে আবার বকছে উনি। আমি তো এট্টুখানি খেয়েছি। তবু জুলি আপু দিয়েছে বলে। তবু আমাকে আপুর সামনে বকেছে। আআআ। আমি কান্না করবো।

-মায়া? শোনো প্লিজ? এভাবে কান্না করো না প্লিজ? সবাই কি ভাববে বলো তো?

-সবাই ভাববে আপনি আমাকে বকেছেন। সত্যি তো ভাববে সবাই। আপনি তো বকছেনই আমাকে। তাই সবাই যা ইচ্ছে হয় ভাবুক। আমি আরো কাঁদবো। আআআ।

-মায়া? মায়া? প্লিজ? লক্ষী মেয়ে না তুমি? আচ্ছা আর কখনো বকবো না। প্রমিস।

-সত্যি! উমমমম! তাহলে আদর করে দিন?

-উফফ! মায়াআআআ? এই মেয়েটার চক্করে আজ আমি নিজেই পাগল হয়ে যাবো। এই মেয়ে? সরে বসো বলছি? এক্ষুণি সরে গিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসো?

-হুম? আচ্ছা। হুহ। 

মায়া রাহাতের দিকে একবার বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকিয়ে একটু সরে এসে রাহাতের কোটটা ছেড়ে দিলো। রাহাত দু হাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরেছে এমন সময় মায়া রাহাতের হাতে হালকা করে একটা ধাক্কা দিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করলো।

-ওই যে দেখুন? এই রাস্তাটা আমাদের বাসায় যাওয়ার শর্টকাট। এতো লম্বা জ্যামে বসে থাকতে থাকতে তো রাত হয়ে যাবে? চলুন না এই রাস্তা দিয়ে যাই?

-তুমি শিওর? ওটা দিয়ে শর্টকাটে যাওয়া যায়? কিন্তু ওই রাস্তায়ও জ্যাম থাকলে?

-আরে নাহ! ওদিক দিয়ে তো তেমন একটা গাড়ি যায়ই না। উঁহু। জ্যাম কক্খনো থাকে না ওটায়। 

-শর্টকাট হলে গাড়ি তেমন যায় না কেন?

-কি জানি!

রাহাত ডানপাশের টার্নিং পেরিয়ে সোজা চলে যাওয়া রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিল মায়ার কথায় রাস্তাটায় যাওয়া উচিত হবে কিনা। যদিও রাস্তাটা যতদূর চোখে পড়ছে জ্যামের অস্তিত্বও নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে যা ঘটলো তার জন্য রাহাত একটুও প্রস্তুত ছিল না। রাহাতের ভাবার সময়টা মায়া খুব সুন্দর করে কাজে লাগিয়েছে। একেবারে সোজা এসে রাহাতের কোলে বসে রাহাতের গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে রাহাতের কাঁধে মাথা রেখেছে। রাহাত চোখ বড় বড় করে মায়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো যা হচ্ছে সেটা রাহাতের স্বপ্ন নাকি বাস্তব। ব্যাপারটা যে স্বপ্ন নয় সেটা বুঝতেও রাহাতের বেশি সময় লাগলো না। আর এটাও বুঝতে পারলো এখন মায়ার এই বাঁধনটা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়াও সম্ভব না রাহাতের পক্ষে। তাই রাহাত এক হাতে আলতো করে মায়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে রাখলো যাতে হঠাৎ মেয়েটা পড়ে না যায়। মায়া একটু পর একটু গাল ফুলিয়ে রাহাতের মুখের দিকে তাকালো।

-চলুন না বাসায়? ঘুম আসছে তো আমার।

-হুম। তুমি চুপটি করে লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো কেমন? আমি বাসায় পৌঁছলে তোমাকে ডেকে দিবো কেমন?

-উমমমম। আচ্ছা। 

মায়া আবার চুপ করে রাহাতের বুকে মুখ লুকিয়ে নিতেই রাহাতও পিছনের গাড়িটাকে সিগনাল দিয়ে ডান দিকের রাস্তায় গিয়ে ঢুকলো। রাস্তাটার দুপাশে কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরি ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছে না রাহাতের। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় একটা কুকুর বেড়ালও চোখে পড়ছে না রাহাতের। এই জনশূন্য রাস্তা দিয়ে মায়া প্রায়ই একাএকা বাসায় ফিরে কথাটা ভাবতেই রাহাতের কেন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই জনমানবহীন রাস্তায় মেয়েটার কিছু একটা হয়ে গেলেও তো কেউ কখনো কিছু জানতেও পারতো না। মেয়েটার এই সামান্য বুদ্ধিটুকু কি নেই! রাহাতের ইচ্ছে করছে মায়াকে ধমক দিয়ে এখনই কথাটা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু আরেকবার মায়ার পাগলামিগুলো হজম করতে হবে মনে পড়তেই আর সাহস করলো না রাহাত। এদিকে রাহাত গাড়ি চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। এই পথটা বুঝি আজ আর শেষই হবে না। রাস্তার কথা খেয়াল করতেই আরেকটা চিন্তাও এবারে রাহাতের মাথায় উঁকি দিলো। মায়ার কথায় ভুল পথে গাড়ি নিয়ে আসে নি তো রাহাত? এদিকে মায়ার মা বাসায় নিশ্চয়ই টেনশনও করছে। সব মিলিয়ে রাহাত আবার দ্বিধায় পড়লো। গাড়িটা কি ঘুরিয়ে ইউটার্ন করে আগের রাস্তায় যাবে? নাকি এই ভূতুড়ে উদ্দেশ্যহীন রাস্তা ধরেই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে? কোটি কোটি টাকার টেন্ডার জমা দেয়ার সময়ও রাহাতের আজকের মতো এতো টেনশন হয়েছে কিনা সন্দেহ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন