১!!
সিঁথি ভর্তি সিঁদুর নিয়ে প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে উমা। বিস্ময়ে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তার সম্মুখে মাতাল রুদ্র ঢুলছে, মুখে পৈশাচিক হাসি। এতোদিনের মনোবাসনা পূরণের আত্নতৃপ্তি যেনো মুখশ্রীতে ছলকে উঠছে। সালটি ২০০৪, কিছুক্ষণ পূর্বে গোপিনাথপুর গ্রামের সকল সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের সিঁদুর খেলা উৎসবের মাঝে হুট করেই রুদ্রের উপস্থিতি। একরাশ সিঁদুর মুঠো করে রাঙ্গিয়ে দেয় উমার সিঁথি। উমা সহ উপস্থিত সবার আশ্চর্যের অন্ত নেই। চেয়ারম্যান অভিনব সিংহ রায় ছেলের এমন কার্যে খুব একটা খুশী হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। বরং চোখ গরম করে তাকিয়ে রইলেন রুদ্রের দিকে। এদিকে রুদ্রে মা শ্রীমতী লক্ষী দেবী স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চেয়ারম্যান পত্নী হবার দরুন তার দাপট গ্রামে বেশ। আজ রুদ্রের এমন কাজে যেনো মুখে ঝামাঘষা পড়লো তার। রুদ্র এখনো হাসছে। পেটে সিদ্ধি পড়লে মাথাটা তার কাজ করা বন্ধ করে দেয়। মাতলামো সে হরহামেশাই করে, এটাই তার স্বভাব। রুদ্রের গুনের বর্ণনা সারা গ্রাম ই জানে। বাপের পয়সা উড়ায়, মাতলামী করে, মেয়েনেশা, যত খারাপ গুন একটা মানুষের মাঝে থাকা যায় সে তাই। তার কাছে কারোও অনুভূতির দু পয়সার দাম নেই। কিন্তু আজ সব স্পর্ধা যেনো মাত্রা ছাড়ালো। পুজো মন্ডবে রিরি লেগে গেলো। মানুষের কথার ঢল পড়লো। উমা এখনো হতবিহ্বল। মাথায় হাত পড়তেই বাস্তবকে যেনো আরোও ভালো করে বুঝতে পারলো সে। সব নারীদের কানাগোসা শুরু হলো। "উমার সিঁথি রাঙ্গালো চেয়ারম্যান পুত্র রুদ্র"-- এটা হবে আগামীকাল ভোরের আলোচনার টপিক।
রতী দেবী ছুটে এলেন, রক্তচক্ষু প্রয়োগ করলেন উমার দিকে। যেনো দোষটা উমার, অবশ্য যে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা; এই প্রবাদের উল্লেখ্য উদাহরণ এই নারী। সৎ মেয়ে উমাকে তার কেনো যেনো সহ্য হয় না। একেবারেই না, তার মতে এই ষোড়শী তার সংসারের অন্ন ধ্বংস করছে। তাকে ঘাড় থেকে থামাতে পারলেই যেনো মঙ্গল। তাই তার সাথে অনর্থ ঘটলেও তার ই দোষ। তিনি পরিবেশের গাম্ভীর্য না বুঝেই উমার বাহু ঝাকিয়ে বললেন,
"মুখপুড়ি এ কি অলুক্ষনে কান্ড করলি? দিলি তো, দিলি সবার আনন্দে জল ফেলে! শুধু শুধু বলি তুই সর্বনাশী?"
তিনি রেডিও শুরু করলেন, উমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। রুদ্র তার তাল রাখতে পারলো না। ধড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ছেলেকে লুটিয়ে পড়তে দেখে লক্ষী দেবী ছুটে এলেন, সবাইকে আদেশ দিলেন,
"তোলো আমার বাছাকে কেউ তোলো।"
রুদ্রের বন্ধুমহল তাকে কোনো মতে ধরাধরি করে তুললো। তারপর রওনা দিলো চেয়ারম্যানের বাড়ি। লক্ষী দেবী পিছন পিছন গেলেন।
গ্রামে রুদ্রের এমন আচারণ নতুন না। সে মাতাল হয়ে যেখানে সেখানে লুটিয়ে পড়ে। তার বন্ধুরা তাকে তুলে। তারপর চেয়ারম্যানের বাড়ি দিয়ে আসে। চেয়ারম্যানরা এই গ্রামের আদি জমিদার। জমিদারি চলে গেলেও দাপট যায় নি। স্বাধীন বাংলায় অভিনব সিংহের বাবা এই গ্রামের চেয়ারম্যান হন। সেখান থেকে এখনো চলে আসছে এই চেয়ারম্যানের অধিপত্য। গত শীতে রকিব মাস্টার দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু ভোট সেই পড়লো অভিনব সিংহের ভাগেই। কেনোই বা দিবে না, গ্রামের বিত্তবান মানুষের একজন অভিনব সিংহ। পুলিশ ও তাকে ভয় করে। গ্রামের যেকোনো সমস্যা তিনিই দূর করেন। রকীবুল মাস্টার লোক ভালো কিন্তু তার কাছে কোনো ক্ষমতা নেই। তাহলে কেনো হবে না অভিনব সিংহ চেয়ারম্যান!
এদিকে, ভাসানে যাবে প্রতিমা। দশ দিনে দুর্গোৎসবের আজ সমাপ্তি। আজ প্রতীমা ভাসিয়ে দিবে তারা। ফলে আসছে বছর যেনো আবার ফিরে প্রতীমা। অভিনব সিংহ গলা খাকারি দিলেন, রুঢ় স্বরে বললেন,
"মা কে তোলো, ভাসানে যাবো"
সনাতন পুরুষেরা একত্রিত হলেন, প্রতিমাকে যেভাবে আনা হয়েছিলো সেভাবেই নিয়ে যাচ্ছে নৌকার কাছে। গ্রামে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। নিখিল বাবু নতমস্তকে মন্দিরের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছেন। মঙ্গলের তিথিতে অমঙ্গল ঘটলো। অভিনব সিংহ যাবার পূর্বে হিসহিসিয়ে বললেন,
"এখানে যা ঘটেছে তা নিয়ে কাল সকালে আলোচনা বসবে৷ পুজোর রাত, সক্কলে ক্লান্ত।"
"জ্বে আচ্ছা"
নিখিল বাবু মাথা কাত করে কথাটা বলেন। নিখিল বাবু ছা পোষা মানুষ। গ্রামের বাজারে মুদি দোকান তার। কিছু কিছু মানুষের স্বভাব শুধু অপর মানুষের নির্দেশ পালন করা। নিখিল বাবু তেমন ই একজন। কখনো কাউকে উচ্চস্বরে কিছুই বলতে পারেন না। তাই তো মেয়ের সাথে এতো বড় কান্ড হবার পর ও তিনি শুধু ঘাড় কাত করে "জ্বে আচ্ছা" টুকুই বলেছেন।
রাত দশটা,
প্রতিমা ভাসানো হয়ে গিয়েছে৷ মাথা ভর্তি সিঁদুর নিয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে উমা। নিখিল বাবু বাড়ি ফিরতেই রাজশ্বী পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করলেন তিনি। রতী দেবীর বচন এখনো শেষ হয় নি। তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করছেন। আর একটু পর পর এসে উমার মাথায় গাট্টা দিচ্ছেন।
"বলেছিলুম, বাড়ি থাক। যাস নে মন্দিরে। শুনলো তোমার মেয়ে? না যেতেই হবে তার। মানুষকে ধিঙ্গিপনা না দেখালে যে নয়। হলো তো, শান্তি। এখন আর কি, কাল আসছে উনারা। সিঁদুরদান হয়ে গিয়েছে এবার বাপু রীতি মেনে বিয়ে হবে ব্যাস।"
"মা আমি বিয়ে করবো না।"
এতোক্ষণে মুখ খুললো উমা। টানা টানা আঁখি জলে ভেসে যাচ্ছে। রুদ্রকে তার ইহজীবনে পছন্দ নয়। এমন মাতাল, চালচুলোহীন, আওয়াড়াকে কোনো মেয়েই পছন্দ করবে না। আর বহু দিন হলো তার নজর উমার দিকে। স্কুলে যেতেই তার সাথে দেখা হয়। ছলেবলে ডাকে এটা সেটা দিতে, উমা ভীত চোখে তাকায় তারপর পালিয়ে যায়। উমার চেয়ে বেশ বড় সে। উমার কথাটা যেনো কানে বাজছে রতী দেবীর। চুলের মুঠি ধরে হিনহিনে স্বরে বলে,
"তোর ভাগ্য ভালো সে শুধু সিঁথি রাঙ্গিয়েছে। তুলে নিয়ে গেলে কি করতাম? ভেবেছিস একবার ও?"
উমা দমে গেলো। এমনিতেই তার কথা এখানে শোনার কেউ নেই। নিখিল বাবু মেয়ের চুল ছাড়ালেন। ধীর স্বরে বললেন,
"নিজের ঘরে যা, তোর মার সাথে কথা আছে।"
উমা মাথা কাত করেই নিজের ঘরে চলে গেলো। দরজা আটকে দিলো। বুকটা যেনো ভারী হয়ে গিয়েছে। উথাল পাথাল করে কান্না পাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তার কি দোষ ছিলো। সখীদের সাথে সিঁদুর ই তো খেলেছে। তা কি খুব অন্যায়! হাটু আকড়ে বিষাদ জোয়ার ছেড়ে দিলো সে। চাপা স্বরে বললো,
"মা, তুমি কেনো ছেড়ে গেলে আমায়"
উমার মা, শিবানি দেবী নবজাতক উমাকে রেখে পাড়ি দিয়েছেন পরলোক। জীর্ণ শরীরটা প্রসবের ধকল নিতে পারে নি। সেদিন উমার ঠাম্মা খুব কেঁদেছিলেন। শিবানি নাকি অন্নপূর্ণার রুপ ছিলো। তাই তিনি নাতনীর নাম রাখেন উমা। শিশু উমা মা ব্যাতীত থাকতে পারবে না বলেই নতুন মা আনেন নিখিল বাবু। কিন্তু রতী দেবীর চক্ষুশূল হলো উমা। ছোট উমার প্রতি দরদ ছিলো প্রথমে, কিন্তু উনার প্রথম সন্তান রাজশ্বীর যখন মৃতপ্রায় দশা হলো এই উমার জন্য তখন থেকে তার দুচোখের বিষ হলো চার বছরের উমা। অবশ্য রাজশ্বী বেঁচে গিয়েছিলো। এখন তার বয়স পনেরো হবে। একটা ছোট ছেলে ও হয়েছে নিখিল বাবু এবং রতী দেবীর। তার নাম গোপাল, তার বয়স এখন ছয়। ঠাম্মার গত হবার পর থেকে যেনো মাথা হাত বুলানোর কেউ ই নেই উমার। বাবা থেকেও নেই। তবে ভাইবোন দুজনের সাথে বেশ খাতির। রাজশ্বী তো উমা ভক্ত। তার দিদি ই যেনো তার সব কিছু। মন খারাপ উঁকি দিলেই ভাই বোনের কাছে ছোটে উমা। কিন্তু এই মন খারাপ যে সে মন খারাপ নয়। এতো কঠিন পরীক্ষা এসে ভিড়েছে তার সামনে। কিভাবে মোকাবিলা করবে উমা! সে যে পড়তে চায়, নিজের পায়ে দাঁড় হতে চায়; বিয়ে নামক বন্ধনে আটকে থাকতে চায় না উমা_________
সকাল ১০টা,
সূর্যের তীর্যক কিরণ পর্দা ভেজ করে আছড়ে পড়ছে। ঠান্ডা ঘরটি উষ্ণতার আবেশে পরিপূর্ণ। অবশেষে ঘুম ভাঙ্গলো রুদ্রের। গতকাল একটু বেশি নেশা করেছিলো সে। এখন গা গুলোচ্ছে। নেশাটা কাটে নি। মাথা ঝিমঝিম করছে। এর মাঝে ফুলির মা কটাশ করে শব্দ করে লেবুজলটা রাখলো। বিরক্তির স্বরে বললো,
"বাবাজী উঠে পড়ো, বরদের এতো বেলা করি শুতে হয় না। উঠে যাও"
ফুলির মার কথায় হতবাক দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্র। হুংকার ছেড়ে বলে,
"কিসের বর, কার বর?"
"এ বাবা মনে নেই নাকি? কাল যে উমার সিঁথি রাঙ্গিয়ে দিলে! কর্তা গেছে নিখিলদার বাড়ি। পুরোহিত ও গেলো সাথে।"
রুদ্রের মাথায় যেনো বাজ পড়লো। এ কি শুনছে সে, তবে উমার সিঁথিতে সিঁদুরদান স্বপ্ন ছিলো না। তবে এই বিস্ময়ে ভয়ংকর হাসির রুপ নিলো, যে পাখিকে এতোদিন বশ করতে পারছিলো না এখন সে হাতের মুঠোতে। একটাই আফসোস, বিয়েটা তাকে করতে হবে।
নিখিল বাবুর বাড়িতে আসর বসেছে। রতী দেবী আক্রোশের স্বরে বললেন,
"সিঁদুর দান কি ছেলেখেলা! একবার সিঁদুরদান হয়েছে এবার রুদ্রকে বিয়েটা করতেই হবে। নয়তো আমার মেয়েকে কে বিয়ে করবে!"
"হ্যা, ঠিক ঠিক। গ্রামের মান সম্মানের ব্যাপার।"
রতী দেবী চোখে জল এলে বললেন,
"মেয়ে আমার লাখে একটা, এমন মেয়েকে নিয়ে এভাবে না খেললেই তো পারতো রুদ্র।"
অভিনব সিংহের কপালে চিন্তার রেখা ভেসে উঠে। ছেলের কীর্তিতে সে উচ্চবাচ্য করতে পারছে না। চেয়ারম্যান সে, একটা ভুল সিদ্ধান্ত আর পদ চলে যাবে অন্যত্র। টাকা দিয়ে আর যাই হোক সকলের মুখ একসাথে বন্ধ করা যায় না। রুদ্রের উপর যে বেজায় ক্ষেপে আছেন। আরে বাবা, মেয়েকে ভোগ করবি কর না, রাতের অন্ধকারে কর। তাই বলে সকলের সামনে সিঁদুর পড়াতে গেলি কেনো! সবার সামনে নিজের মুখখানা তো রাখতেই হবে, তাই উচ্চস্বরে বললেন,
"তুমি চিন্তা করো না নিখিল বউ, উমাই হবে আমার পুত্রবধু। লক্ষী পুজোর দিন হবে উমা এবং রুদ্রের বিয়ে"
কথাটা শুনেই অন্দরমহলে থাকা উমার বুক ধক করে উঠলো। ষোড়শীর স্বপ্নগুলো একত্রে কাঁচের মতো ভাঙ্গতে লাগলো অচিরেই। ভেতরে থাকা স্বপ্নগুলোকে কেউ গলা চেপে হত্যা করতে লাগলো যেনো_______
২!!
লক্ষীপুজোর দিন,
নিখিল বাবুর আঙ্গিনাতে মন্ডব সেজেছে। রঙ্গিন কাগজ দিয়ে ঘর সাজানো হয়েছে। হিন্দু মুসলমান সকলের দাওয়াত পড়েছে। চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়ে, আড়ম্বরতার কমতি নেই। লাল বেনারসিতে উমাকে দেবীর ন্যায় লাগছে। টানা টানা চোখে সুন্দর করে কাজল দিয়েছে, ফর্সা গায়ে লাল রঙটি যেনো মিশে আছে। কোমড় অবধি কোকড়ানো চুল খোঁপা করেছে, তার উপর শিউলির মালা। সাদা পা জোড়ায় আলতা পড়ানো হয়েছে। শুধু ঠোঁটের কোনে কেউ হাসি একে দিয়ে পাড়ে নি, পারে নি চোখের কোনের জল মুছে দিতে। গোপাল তার বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা সাউন্ডবক্স জোগাড় করে এসেছে। সেখানে বাজছে,
"লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে"
এরই মাঝে হট্টগোল শোনা গেলো। বাহিরে গোল লেগেছে। রতী দেবী ছুটে গেলেম বাহিরে। এর মাঝেই উমার কানে এলো,
"পুলিশ এসেছে, বিয়ে এবার বন্ধ"
—————
এরই মাঝে হট্টগোল শোনা গেলো। বাহিরে গোল লেগেছে। রতী দেবী ছুটে গেলেম বাহিরে। এর মাঝেই উমার কানে এলো,
"পুলিশ এসেছে, বিয়ে এবার বন্ধ।"
কথাটা শুনতেই বুক চিরে স্বস্তির এক দীর্ঘশ্বাস বের হয় উমার। সত্যি কি বিয়েটা বন্ধ! সে কি তবে মুক্ত হতে পেরেছে। এক আকাশ সমান আশার বীজ উঁকি দিলো ষোড়শী উমার মনে। কিশোরীর মনের এই ইচ্ছাটা খুব নিপুণ ভাবেই আড়াল করলো সে। নিজের ঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে নজর দিলো আঙ্গিনায়। পুলিশ সত্যি এসেছে। শুধু তাই নয়, এক যুবকের কন্ঠও শোনা যাচ্ছে। বেশ সুমধুর কন্ঠ, কিন্তু বেশ জোড়ালো। সে সরাসরি অভিনব সিংহের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে,
"একজন নাবালিকার বিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন কি ভেবে মামা মশাই? বিয়েটা কি ছেলে খেলা? রুদ্র মাতাল অবস্থায় সিঁদুর পড়িয়েছে! এই সিঁদুরের কি মূল্য? না মন্ত্রপাঠ, না কোনো রীতির বালাই! অহেতুক আপনাদের অজ্ঞতার জন্য একটা নিস্পাপ মেয়ের জীবনটা বিষিয়ে যাবে!"
"বড্ড বেশি কথা হচ্ছে না শাশ্বত? তুমি ভুলে যেও না দুখানা বই পড়ে কেউ বিদ্যাধারী ঈশ্বরচন্দ্র হতে পারে না।"
যুবকের নাম শাশ্বত চ্যাটার্জি। রাজধানীর নামী পত্রিকার সাংবাদিক সে। হ্যা এটা ঠিক, তাকে মানুষ অনেক অংশে এই অভিনব সিংহ ই করেছেন। শাশ্বত এর মা মালিনী দেবী অভিনব সিংহের একমাত্র বোন। বোনের প্রতি তার দরদ একটু বেশি হবার জন্য তিনি বিধবা হবার পর তার সংসারে কিছু টাকা দিতেন। সেভাবেই শাশ্বতের আজ শিক্ষিত হওয়া। কিন্তু এতো দুধকলা দিয়ে এতো দিন কালসাপ পোষার মতো হাল হলো, যারটা খেলো তাকেই ফোস করছে। শাশ্বতকে সাংবাদিক করার উদ্দেশ্য ছিলো যেতো অভিনব সিংহের ঢাল হতে পারে। কম চোরা কারবারি তো করে না সে। কিন্তু শাশ্বত হয়েছে একেবারেই বিপরীত। সৎ মানুষ প্রচন্ড ভয়ংকর, সে অন্যায়কে ভয় না পেলেও অন্যায় তাকে ঠিক পায়। রুদ্রও খুব ভয় পায় তাকে। এই পুজোর কটা দিন যখন গ্রামে থাকে সে রুদ্র এবং অভিনব সিংহের মনে ত্রাস জন্মায়। তাদের প্রতিটা কদম বেশ মেপে চলতে হয়। নয়তো শাশ্বত কথা বলা ছাড়ে না। এই কদিন বেশ ক'বার মামাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো শাশ্বত। কিন্তু লাভ হলো না, উলটো মা মালিনী দেবী ছেলেকে গালমন্দ করলেন। কিন্তু আজ যখন অবিচার সীমা ছাড়াচ্ছে তখন আর থেমে থাকতে পারলো না শাশ্বত। সরাসরি পুলিশ নিয়েই হাজির। প্রথমে পুলিশ একটু টু টা করছিলো বটেই কিন্তু সাংবাদিক ট্যাগটা খুব কাজের। অমনেই বাধ্য হয়ে পদ বাঁচাতে এখানে ছুটে আসা। শাশ্বত কঠিন স্বরে অভিনব সিংহকে বললো,
"এ অন্যায় করবেন না, মামা মশাই। সিঁদুর দিয়েছে বিয়ে হয় নি। একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন, সে একটা মানুষ। তাকে নিয়ে এভাবে খেলবেন না।"
শাশ্বত এর কথায় সায় মেলালো রকিবুল মাস্টার। জোড়ালো স্বরে বললো,
"অভিনব সাহেব, আপনার ছেলে ভুল করেছে। মাতাল ছিলো, সিঁদুর পড়ালে বিয়ে হলে তো সিনেমার সবাই বিবাহিত থাকতো। মেয়েটা মাত্র ষোল বছর, তার সামনে অদূর ভবিষ্যৎ। সে পড়াশোনায় বেশ ভালো। হয়তো একটু চেষ্টা করলে আরোও ভালো হবে। এই বিয়েটা দিবেন না। একাবিংশ শতাব্দীতে এসে এখন এই মতবাদ আমরা ছাড়ি। এ অন্যায়।"
"ন্যায় অন্যায় কি তুমি শিখাবে আমায়! জানো তো না কচু। আইনে মেয়ের বয়স ষোল হয় নি। কিন্তু মেয়ের বয়স ষোল হয়ে গিয়েছে। মেয়ের বাবা বলেছে। স্কুল কলেজে একটু কমিয়ে দেওয়া হয়। এ আমরা সবাই জানি। জন্ম নিবন্ধন কি তবে ভুল? আর সিঁদুর দান কি ছেলে মানুষী! বাপু বিয়ে খেতে এসেছো খাও। অহেতুক বাগড়া দিচ্ছো কেনো?"
অভিনব সিংহের চ্যালা বাবুল বলে উঠে এই কথা। রকিবুল মাস্টার দমেন। কিন্তু শাশ্বত দমার পাত্র নয়। সে বলে উঠে,
"একটা ভুলকে হাওয়া দিলে সেই ভুল চরম পর্যায়ে চলে যায়৷ রুদ্র কেমন গ্রামের কারোর অজানা নয় তাই সে ভুল করেছে। তখন তার হুশ ছিলো না, আমরা সেই ভুলটাকে কেনো হাওয়া দিবো? সিঁদুর দান বেশ মূল্যবান মানছি, কিন্তু রুদ্র মাতাল ছিলো। আইন এ বিয়ে মানে না। সই সাক্ষর হয় নি, মন্ত্রপাঠ হয় নি, না হয়েছে সাত পাক। তবে কিসের জন্য একটা মরীচিকার পেছনে ছুটবেন মামা। এমনটা করবেন না।"
এবার অভিনব সিংহ পুনরায় মুখ খুললেন। তিনি নিখিল বাবু এবং রতীকে ডাকলেন। কড়া স্বরে বললেন,
"নিখিল মেয়ে তোমার, এবার সিদ্ধান্ত তোমার। এই গ্রামে এমন অনেক মেয়ে রয়েছে যার বিয়ে ষোল বছরে হয়। আর বাংলাদেশে কত মেয়ের বিয়ে স্কুল পাশ করে হয় তা তো তোমাদের জানাই আছে। এমন অনেক মেয়ের বাচ্চাও আছে। আর আমার ছেলের বউ হওয়া তোমার মেয়ের ভাগ্য। এবার সিদ্ধান্ত তোমার।"
নিখিল বাবু শুকনো ঢোক গিললেন। এখন হয় করো নয় মরো। শাশ্বত গ্রামে আর ক দিন, এর পর সে পাড়ি দিবে ঢাকা। তাই তার ভরসায় বসে থাকা অত্যন্ত বোকামী। আর রকিবুল মাস্টার, সে তো বাবুলের কথায় দমে যায়। সে কি পারবে চেয়ারম্যানের সাথে টক্করে! সে এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। চেয়ারম্যানের পুত্রকে ফিরিয়ে দিলে সেটা হবে অভিনব সিংহের অপমান। অভিনব সিংহ কি মানবেন? জীবনটা ঝাঝড়া হয়ে যাবে তার পরিবারের। রতী তার পেটে কেনো দিয়ে স্বর খাঁদে নামিয়ে বলে,
"কি ভাবছো! এই গ্রামে তোমার থাকতে হবে। ভুলে যেও না আমাদের আরেকটি মেয়ে আছে। চেয়ারম্যানের সম্বন্ধী মানে আমাদের ই লাভ"
নিখিল বাবু শুকনো গলায় বললেন,
"আমার মেয়ের জন্ম ১৯৮৬ তে। এখন সাল ২০০৪ সেই অনুযায়ী এখন তার বয়স আঠারো। তাই মেয়ে আমার সাবালিকা। আর রুদ্র ছেলেটা খারাপ না, একটু আধটু বেওয়ারা পুরুষ মানুষ হয় ই। বিয়ে হলে শুধরে যাবে। দারোগা সাহেব আপনি আসতে পারেন। বিয়েটা রুদ্রের সাথেই হবে।"
"তবে থাকে ডাকা হোক। সে যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক, তার মতামতের একটা দাম তো আছে।"
"আমার মেয়ের মতামত আছে বিয়েতে।"
অভিনব সিংহের মুখে প্রশান্তির হাসি। নিখিল তাই করেছে যা সে চেয়েছে। এদিকে রুদ্র হাসছে, হাসছে নিজের জিতের জন্য নয় বরং শাশ্বতের হারের উপর। শাশ্বতকে কোনো কালে তার পছন্দ নয়। ছেলেটা অতিরিক্ত সাধুপনা দেখায়। বড্ড এসেছিলো তার বিয়ে ভাঙ্গতে। পরাজিত শাশ্বত চেষ্টা করতে গেলে রতী দেবী তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
"বাছা, মেয়ে আমার। ভালোমন্দ বোঝার জ্ঞান তো আছে নাকি। তুমি কটা বই গিলে নিজেকে কি ভাবছো বলো দেখি! শোনো, শুভ কাজে ব্যাঘরা দিতে নেই। অতিথি মানুষ, দুটো খেয়ে যেও।"
উমা মেয়েটাকে না দেখেই তার জন্য করুনা হচ্ছে শাশ্বতের। পৃথিবী কোথায় এসে ঠেকেছে সেখানে ক্ষমতার কাছে ন্যায়কে মাথা নত করতে হচ্ছে! কোথায় গিয়েছে তাদের চিন্তাধারা! মনে মনে বললো,
"বিবেক ধ্বংসস্তুপ, তবুও বড়াই করি আমরা মানুষ"
আঙ্গিনার ঘটনাগুলো কাতর চোখে দেখলো উমা। বিষাদের নীল বিষ বুকটাকে জ্বালিয়ে ফেলছে। সদ্য উদ্দীপ্ত আশার কিরণটা ধপ করে নিভে গেলো। তাকে এই জঞ্জাল থেকে মুক্ত করার কেউ নেই! সত্যি কেউ ই নেই! কেউ সত্যি বলেছে,
"জীবনের গল্পের রাজকন্যাদের সাদা ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার বাঁচাতে আসে না, তাদের নিয়তির টানাপোড়েন হয় নিজেদেরকেই দূর করতে হয় নয় তারা এই জঞ্জালে আটকে থাকে চিরটাকাল"
উমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিয়তি কঠিন হলে তাকেও কঠিন হতে হবে! সিংহরায় বাড়িতে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। ভয় পেলে কাপুরুষ হয়ে যাবে সে। সব কিছুর মোকাবিলা করে টিকে থাকাটা বীরত্ব। উমা কাপুরুষ নয়। সে বীরঙ্গণা হতে চায়! তার জীবনের গল্পটায় এক নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। দেখা যাক অদূর ভবিষ্যৎ তার জন্য কি লিখে রেখেছে বিধাতা!
বিয়েটা হলো, বিয়েটা হলো তার সঠিক লগ্নে। মন্ত্রপাঠ হলো, রীতি মানা হলো, সাত পাক ও হলো। অগ্নিকুন্ডের সামনে বসে রইলো স্তব্দ উমা। চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে কিন্তু অগ্নির তাপে তা বোঝা যাচ্ছে না। টোপর মাথায় মানুষটার দিকে এক দফা তাকাতেও ইচ্ছে হলো না তার। তাকিয়ে বা কি হবে! শারীরিক সৌন্দর্য কি সব কিছু! যে মানুষের মনটাই ধরা ছোয়ায় বাহিরে তার দিকে তাকিয়ে কি বা হবে। আগুনটা জ্বলছে, দাও দাও করে। উমার ভেতরটাও জ্বলছে। "মেয়েদের এতো কষ্ট কেনো?"
প্রশ্নটা তাকে ভাবাচ্ছে, তাদের মুখ থাকতেও তারা বলার অধিকার পাচ্ছে না। উমারা কি এভাবে অত্যাচারিত হবে এই পৃথিবীতে। অজ্ঞতা, মূর্খতা এভাবেই কি তাদের শিকলে জড়াবে! তাদের মুক্তি কবে হবে! স্রষ্টা নারীদের বানিয়েছেন অসীম ধৈর্য দিয়ে। তাই তো এই রুদ্র এবং অভিনব সিংহের মতো মানুষেরা তাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়। তার উমা আড় চোখে নিখিলের দিকে চাইলো। নিজের বাবাকে তার কাছে পোকার নেয় মনে হলো। শিরদাঁড়াহীন পোকা। যাদের ক্ষমতার সামনে নত হওয়াটাই স্বভাব। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আবার। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটের কোনে উদ্দীপ্ত হলো। তাচ্ছিল্য এই সমাজের প্রতি।
পকেটে হাত গুজে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকলো শাশ্বত। তার গাটা রাগে কাঁপছে। সে চেয়েও মেয়েটিকে বাঁচাতে পারলো না। এমন কতো উমারা আমাদের সমাজে রয়েছে, যাদের জীবন পিষিয়ে দেয় সমাজে অধিক জ্ঞানী মানুষেরা। যাদের মতামত টুকু নেওয়া হয় না। তাদের বাবা মাই তাদের বিয়ে দেন। সেটাই হয় তাদের ভাগ্য। রকিবুল মাষ্টার এসে দাঁড়ালো তার পাশে। করুন স্বরে বললো,
"তোমার মামার সাথে কেউ পারে না শাশ্বত। হেরে গেলে তো। নিখিল ভয় পেয়েছে। দারোগার কাছে তার কথাই শেষ কথা। উমার জন্য কষ্টই হচ্ছে৷ মেয়েটা বড্ড সরল। কিন্তু আমাদের হাতে কিছুই নেই। তোমার প্রসার বাড়ছে, টাকা বাড়ছে। সব কালো টাকা।"
কালো টাকা শুনতেই শাশ্বতের দৃষ্টি যায় রকিবুল মাষ্টারের দিকে। রকিবুল মাষ্টার ধীর স্বরে বলে,
"তোমার মামা ততটা সাধু নন যা সবাই দেখে.........