হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ০২ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৩!! 

-তুমি আবার শুরু করলে ধূসর? বারবার 'প্রত্যুষা, প্রত্যুষা' করো, কিন্তু জিজ্ঞেস করলে একদিনও বলো না এই প্রত্যুষাটা কে। আজ আবার নিজের নাম লাগাচ্ছ ওর নামের সাথে? প্রত্যুষা ধূসর আহমাদ! বলি ব্যাপারটা কি তোমার? কে এই প্রত্যুষা?

ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে দূর নীলিমার দিকে মুখ করে অভিমানী কণ্ঠে ধূসরকে প্রশ্ন করলো প্রজ্ঞা। ধূসর ততক্ষণে এগিয়ে এসে আলতো করে প্রজ্ঞার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো ধূসর। অন্ধকারেও মেয়েটার অভিমানী ছলছলে চোখ জোড়ার কাঁপন ঠিকই চোখে পড়লো ধূসরের। ধূসর এবারে শব্দ করেই হেসে ফেললো প্রজ্ঞার এমন অভিমানী মুখটা দেখে। প্রজ্ঞা এবারে রাগ করে সরে আসার চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞার কোমড়টা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে প্রজ্ঞাকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঠোঁট নিল। 

-একটা মানুষ এতো বোকা হয় কি করে বলো তো প্রজ্ঞা? প্রত্যুষার নামের সাথে নিজের নামটাও জুড়ে দিলাম তোমার বোঝার সুবিধার জন্য। তবুও যদি না বুঝতে পারো তাহলে আর কি করার আছে বলো? সরাসরি বললে তো লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। তাই ডিরেক্টলি আমাদের মেয়ের নামটা একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললাম, ম্যাডাম তো বুঝলেনই না কিছু। কি কপাল আমার! বোকা একটা বউ জুটেছে কপালে!

-এই একদম বাজে কথা বলবে না বলে দিলাম ধূসর। আর প্রত্যুষা কি ধরনের নাম? প্রত্যাশা নাম হয় জানি।

-এই যে মিসেস বকবকানি, আমার মেয়ের নাম প্রত্যুষাই হবে ওকে? তোমার নামের সাথে মিল রেখে নাম, প্রজ্ঞা, প্রত্যুষা। আমাদের ফার্স্ট বেবির নাম প্রত্যুষাই হবে, আর বাদ বাকি পরের বেবিদের নাম তোমার যা ইচ্ছে রাখতে পারো। বাই দা ওয়ে, প্রত্যাশাও কিন্তু দারুণ নাম। এক কাজ করো, প্রত্যুষার ছোটো বোন হলে ওর নাম প্রত্যাশা রাখা যাবে। প্রত্যুষা, প্রত্যাশা। 

-মেয়ের খবর নেই, উনি এসেছেন মেয়েদের নাম ঠিক করতে। সরো তো, যত সব পাগল আমার কপালেই জোটে না?

-এই প্রজ্ঞা? কি বললে তুমি? আমি পাগল? তোমাকে তো আমি-----।

-পাগল নয়তো কি? মেয়ে দুনিয়াতে আসার খবর নেই, আর জনাব আছেন মেয়ের নামে বাড়ি কিনতে। 

-পারলে সেটাই করতাম বুঝলে? বাট আমার লইয়ার বন্ধুটা শালার কিছুতেই মানলো না আমার কথা। শেষে স্বপ্নকুটিরের মালিকানা তোমার নামেই হস্তান্তর করতে হলো। কি আর করা? বাট আমাদের ছোট্টো প্রত্যুষা একটু বড় হলেই স্বপ্নকুটির কিন্তু ওর হয়ে যাবে, বুঝলে।

-চুপ করো তো? দুনিয়ার যত আজগুবি কথাবার্তা এই লোকটার মাথায় ঘোরে। এখানে ছাদে এতো ক্যান্ডেল জ্বালিয়েছ যে, এগুলোর কি হবে এখন?

-কি আর হবে? মোমবাতিরা আগুনের স্পর্শে গলে গিয়ে ভালোবাসার জীবন উৎসর্গ করবে। সবাই তো আর ওদের মতো ভালোবাসার জন্য এতো বড় ত্যাগ করার সুযোগটা পায় না। 

-মোমবাতির জন্মই হয়েছে নিজে জ্বলে, পুড়ে, আরেকজনকে আলোর পথ দেখানো। এখানে ভালোবাসার চেয়ে দায়িত্বটাই বেশি বুঝলেন জনাব?

-ভালোবাসাটাই দায়িত্ব নিতে শেখায় প্রজ্ঞা। নইলে শুধু দায়িত্ব পালন করতে নিজের সর্বস্ব উজার করে দিতে কেউ পারে না কোনোদিন। শুধু ভালোবাসার টানেই এই আত্মত্যাগটা করা সম্ভব হয়, বুঝলেন ম্যাডাম? 

-আপনার সাথে তর্ক করে জেতা আমার পক্ষে অসম্ভব জনাব। হার মানছি। 

-হার তো মানতেই হবে ম্যাডাম। রাইট ইজ অলওয়েজ রাইট। তর্ক করলেই তো ঠিক কথাটা ভুল হয়ে যাবে না।

-ওফ! এই লোকটাকে একটা কথা বলে শান্তি নেই। একটা কথা বলে আরো পঞ্চাশটা কথা শুনিয়ে দেয়। কি যে করি এই লোকটাকে নিয়ে আমি!

-বেশি কিছু করতে হবে না ম্যাডাম। আমার পিচ্চি প্রত্যুষাকে এনে দাও জলদি করে। তাহলেই আর একটুও জ্বালাবো না তোমাকে।

-জ্বালাবে না ঘোড়ার ডিম। বাপ মেয়ে দুজনে মিলে আমাকে পাগল বানিয়ে পাবনা পাঠাবে, জানি না আমি?

-ইশ রে এভাবে বলতে হয় নাকি বউ? আমরা বাপ বেটিতে মিলে কি কি করবো তার বিশাল একটা লিস্ট করে রেখেছি। আসার সময়ে দেখলে না প্রত্যুষার জন্য পুরো দেয়ালটা খালি পড়ে রয়েছে এখনও? আমার সাথে প্রত্যেকটা খালি ফ্রেমও আমাদের পিচ্চিটার আসার অপেক্ষা করছে।

-ওই খালি ফ্রেমগুলো? তুমি সত্যি পাগল হয়ে গেছো ধূসর। 

-জি ম্যাডাম। আমার প্রত্যেকটা পাগলামিই তোমাকে আর আমাদের ছোট্ট পরীটাকে ঘিরে। ওর জন্য আরো কতো প্ল্যান জমা করা আছে জানো? ও প্রথমবার যখন বাড়িতে আসবে, তখন ওর পায়ের আর হাতের ছাপগুলো দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখবো। প্রথম হামাগুড়ি দেয়ার, প্রথমবার হাঁটার মূহুর্তটা, প্রথম কথা বলার সময়টা, প্রত্যেকটা মূহুর্ত আমি ক্যামেরার বন্দি করতে চাই। আমাদের ছোট্ট স্বপ্নকুটিরের প্রত্যেকটা পরতে পরতে আমাদের ভালোবাসার গল্পগুলোর সাথে আমাদের প্রত্যুষার বেড়ে ওঠার গল্পটাও মিশে থাকবে। বাবু আসার খবরটা পাওয়ার দিন থেকে শুরু করে ওর জন্ম, হাসি কান্না, বেড়ে ওঠা, হাঁটা, সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়া, সাঁতার শিখতে গিয়ে পানিতে হাবুডুবু খাওয়া, প্রতিটা মূহুর্তে আমি ওর পাশে থাকতে চাই প্রজ্ঞা। 

-জীবনে কখন কি হয় বলা মুশকিল ধূসর। কিন্তু আমিও মনে প্রাণে প্রার্থনা করি তোমার এই ছোটো ছোটো পাগলামিভরা ইচ্ছেগুলো পূরণ হোক। এভাবেই পাগলের মতো ভালোবাসবে তো সবসময় ধূসর? কখনো ছেড়ে যাবে না বলো? 

-উমমমমম? যেতে তো হবে তাই না? 

-মানে? কোথায় যেতে হবে?

ধূসরের ভারি গলায় হঠাৎ এমন কথা শুনে প্রজ্ঞা একটু ভয়ই পেয়ে গেল। এতোক্ষণে ধূসরের শক্ত হাতের বাঁধনটা শিথিল হয়ে গেছে। প্রজ্ঞা মুখে তুলে তাকাতেই দেখলে ধূসর একটু সরে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রজ্ঞার ভীতু মুখটার দিকে চোখ পড়লেও ধূসর শান্ত, ঠান্ডা গলায় কথাটা বললো আবার।

-কোথায় যাবো মানে? সারাদিন কি বাসায় বসে থাকবো নাকি? অফিসে যেতে হবে না আমাকে? অফিসে কতো কাজ জানো তুমি? মাঝে মাঝে কেমন বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করো তুমি আমি বুঝি না বাবা।

-ধূসররররররর। তোমাকে তো আমি? আমি এতো সিরিয়াসলি একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম, আর এই লোকটা আমার সাথে ইয়ার্কি করছে। তোমাকে আমি আজকে মেরেই ফেলবো, একবার ধরতে পারি দাঁড়াও না? আমার সাথে ফাইজলামি করা হচ্ছে?

ধূসর কঠিন একটা মুখের ভাব করে শান্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলেই হো হো করে হেসে ছুট লাগিয়েছিল। প্রজ্ঞা একবার ধরতে পারলে যে একটা চুলও আস্ত থাকবে না সেটা ভালো করেই জানা আছে ওর। ধূসর এতোক্ষণ ইচ্ছে করে ওর সাথে মজা নিচ্ছিল বুঝতে পেরে প্রজ্ঞাও ধূসরকে ধরার জন্য পিছনে ছুটলো। ততক্ষণে ধূসর বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছিল। প্রজ্ঞা বেশ কিছুক্ষণ ধূসরকে ধরার চেষ্টা করেও বিফল হলো। বেশ কিছুক্ষণ ছোটোছোটির পর প্রজ্ঞা হাঁপিয়ে গেছে দেখে ধূসর নিজের দৌঁড়ানোর গতি কিছুটা আনলো, আর প্রজ্ঞাও এবারে ধূসরকে ধরতে পেরে ইচ্ছে মতো কিল ঘুষি বসালো ধূসরের বুকে। ধূসরের বুকে ধুপধাপ কিল বসিয়ে রাগের চোটে মেয়েটা কথাও বলতে পারছে না দেখে ধূসর একটু ঝুঁকে প্রজ্ঞার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। ধূসরের এমন কাজে প্রজ্ঞা রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। আর ধূসরও প্রজ্ঞাকে আরেকটু চমকে দেয়ার সুযোগ পেয়ে কি আর হাত ছাড়া করে? স্তব্ধ হতবাক প্রজ্ঞাকে এক টানে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকেই পা বাড়ালো ধূসর। আর প্রজ্ঞা ধূসরের গলা দু হাতে জড়িয়ে ধরে গানের কথাগুলোই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। যতবার গানটা শুনছে, ততবারই বোধহয় এই একরোখা পাগল লোকটার আর তার কণ্ঠের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। নিঝুম রাতে নিরবতায় গানগুলো বারবার প্রতিধ্বনি তুলে প্রজ্ঞার কানেই গুনগুন করছে ধূসরের স্বরটা।

"পৃথিবীর যত সুখ
আমি তোমারই ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি,
মনে হয় তোমাকেই
আমি জনম জনম ধরে চেয়েছি।
শুধু যে তোমারই সাথী হতে
আমি তো এসেছি এ জগতে
এ জগতে চোখ মেলে চাইবার
তুমি ছাড়া আজ কিছু নাই আর,
তোমারই পাসে আমি রয়েছি
ও... জীবনে মরনে সাথী হয়েছি।
মনে হয় তোমাকেই
আমি জনম জনম ধরে চেয়েছি।।"

০৪!! 

ধূসর প্রজ্ঞাকে বিছানার উপরে বসিয়ে দিতেই প্রজ্ঞা যেন বাস্তব জগতে পা রাখলো। এতোক্ষণ ধূসরের গানে মেয়েটা এতোটাই মুগ্ধ হয়ে ছিল যে খেয়ালই করে নি কখন ধূসর ওকে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে এসে এই আধো আলো আঁধারি খেলা করা রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। রুমের ড্রিম লাইটের আবছা আলো-আঁধারির খেলায় প্রজ্ঞা দেখলো ধূসর বেড সাইড টেবিলের উপর রাখা একটা মোমবতি জ্বালাচ্ছে। দেখতে দেখতে বেড সাইড টেবিলটা ছোটো ছোটো ছয়টা জেলি ক্যান্ডেলের রঙিন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে একটা মোহনীয় আবেশ তৈরি করলো। ধূসর এবার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটিয়ে বেডের অপর পাশেও ঠিক ছয়টা জেলি ক্যান্ডেল জ্বালালো। রঙ বেরঙের এই এক ডজন ছোট্টো ছোট্টো মোমবাতির আলোয় রুমটাকে কোনো এক কল্প জগত বলেই মনে হচ্ছে প্রজ্ঞার। রুমটা যে আগেরবারের আসা রুমটা নয় সেটাও বুঝতে দেরি হলো না এবারে প্রজ্ঞার। প্রজ্ঞা বেশ কৌতূহল নিয়েই অপেক্ষা করছে ধূসরের এবারের সারপ্রাইজটার জন্য। কিছু একটা তো ভদ্রলোক রেডি করেছেন এই রুমে, কিন্তু কি সেটা? প্রজ্ঞা কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ধূসর এসে প্রজ্ঞার পাশে বিছানায় বসে প্রজ্ঞার একটা হাত নিজের মুঠোর পুরে জ্বলিয়ে ধরলো। প্রজ্ঞাও এবারে মিষ্টি হেসে ধূসরের গায়ে হেলান দিয়ে বসলো। 

-রুমের ডেকোরেশনটা কেমন লেগেছে ম্যাডাম? কিছুই তো বললে না? আমি যে সারাদিন নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে ম্যাডামের জন্য পুরো বাড়িটা নিজের হাতে ডেকোরেট করলাম, অথচ ম্যাডামের কোনো রিএকশনই নেই। এমনটা হবে জানলে তো বাড়িতেই পার্টি এটেন্ড করতাম। সেটাই বোধ হয় ভালো হতো।

-আরে ধূসর! কি বলছো? স্বপ্নকুটিরের ডেকোরেশন অনেক সুন্দর হয়েছে। জনাব যে এতো ভালো ডেকোরেট করতে পারেন জানতাম না তো?

-থাক, থাক। আমার মন রাখার জন্য মিছিমিছি সুনাম করতে হবে না। ডেকোরেশন সবটা না দেখেই শান্তনা দিতে এসেছে। আমি যেন বুঝি না?

-আরে! কি মুশকিল! মিথ্যে শান্তনা দিতে যাবো কেন? আসার সময় বাইরের ব্লিঙ্ক লাইট, ছাদের ক্যান্ডেল দিয়ে হার্ট শেইপ, রুমের এই মিনি জেলি ক্যান্ডেল সেট। সবই এতো সুন্দর আমি বলেও তোমাকে বোঝাতে পারবো না। যদিও আমার গুরুতর সন্দেহ আছে সবটা তুমি একা নিজে করেছ সেই বিষয়ে।

-জি ম্যাডাম। আমিই করেছি। আর ডেকোরেশন এতোই ভালো লাগলে তারার ব্যাপারটাও দেখতে। ভালো লাগে নি বলেই খেয়াল করো নি।

-তারা? তারা কোথা থেকে এলো? আকাশের দিকে খেয়াল করিনি তো একদমই। জনাব পাশে থাকলে আকাশের দিকে নজর যাবে কি করে বলুন? আর যতটুকু মনে পড়ছে, আজ আকাশে চাঁদ তারা কিছুই ছিল না। অন্তত এই মাঝরাতে কালো আকাশে তারা চোখে পড়ার মতো অন্তত ছিল না।

-এতোক্ষণ যখন খেয়াল করো নি, এবারে দেখো?

-হুম? রুমের মধ্যে থেকে আকাশ দেখবো? 

-ইয়েস ম্যাডাম। উপরে তাকাও?

ধূসরের আকাশ দেখার অদ্ভুত কথাটা শুনে প্রজ্ঞা কিছুটা বোকাই হয়ে গিয়েছিল। ধূসর অবশ্য ততক্ষণে প্রজ্ঞার চিবুক ধরে মুখটা তুলে ধরে উপরে সিলিঙের দিকে তাকাতেই ইশারা করলো। সিলিঙের শত শত ওয়াল রেডিয়াম স্টারগুলোকে হালকা সবুজ আভা ছড়াতে দেখে প্রজ্ঞা স্তব্ধ হয়ে সেদিকেই চেয়ে রইলো। রেডিয়ামের তারাগুলোর ধিকিধিকি আলো ততটা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল না বলে প্রজ্ঞা আসলেই খেয়াল করে নি যে এতোগুলো তারা একসাথে ওদের মাথার উপরে সিলিং জুড়ে আছে। তারাগুলোর আবছা সবুজাভ আলোটা ততটা প্রখর না হলেও দারুণ লাগছে প্রজ্ঞার কাছে। মনে হচ্ছে এক টুকরো খোলা আকাশের নিচে ওরা সংসার সাজিয়ে বসেছে। কথাগুলো ভেবে ধূসরকে কথাটা বলতে পাশে তাকাতেই দেখলো ধূসর বিছানা ছেড়ে উঠে যাচ্ছে। ধূসর রাগ করেছে ভেবে প্রজ্ঞা তড়িঘড়ি করে ধূসরের হাতটা টেনে ধরলো। ধূসর প্রজ্ঞার দিকে না ফিরেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে ধূসরের হাতটা আরেকটু শক্ত করে টেনে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো। ধূসর অবশ্য একটা টু শব্দও করলো না, প্রজ্ঞার দিকে ফিরেও তাকালো না। 

-এই শোনো না? রাগ করো না প্লিজ? আসলে রুমের রেডিয়াম স্টারগুলোর চেয়ে জেলি ক্যান্ডেলগুলোর আলোটা বেশি তীক্ষ্ণ ছিল। তাই সিলিঙের ডেকোরেশনটা একদমই খেয়াল করি নি। সরি তো? ধূসর? শোনো না? 

-নো প্রবলেম। খেয়াল করো নি, কি আর করা। মাই ব্যাড লাক। তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম, হলো না। তোমার সরি বলা লাগবে না। 

-আরে? এভাবে বলছ কেন? আর তুমিই বা কোথায় যাচ্ছ এখন? এই ধূসর? তাকাচ্ছ না কেন? উফ? এই?

-আজকের মতো শো এখানেই শেষ। সাথে আমার সারপ্রাইজও। তাই ক্যান্ডেলগুলো নিভিয়ে দিই। 

-থাকুক না আর একটু? কি কিউট লাগছে ক্যান্ডেলগুলো! এগুলো কোথা থেকে পেলে? মার্কেটে গেছিলে? নাকি অর্ডার করেছ?

-না না, থাকবে কেন? তাছাড়া অনেক রাত হয়েছে। তোমার মতো সেই কখনই ঘুম পাচ্ছিল। সারাদিন পার্টির আয়েজনে বিজি ছিলে, তার উপরে রান্না করেছ, পার্টিতে রিলেটিভদের এটেন্ড করেছ, অনেক টায়ার্ড বলছিলে না তখন? মোমবাতি জ্বললে রুমটায় একটা ভ্যাপসা গরম হয়ে থাকবে, আর আলোয় তো ঘুমাতেও পারো না। 

-আরে নাহ। প্রবলেম হবে না আমার। 

-জানি। বাকি ডেকোরেশন কাল দেখো। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে। শুয়ে পড়ো তুমি। আমি ক্যান্ডেলগুলো নিভিয়ে এসে শুয়ে পড়বো।

ধূসরের কথাগুলো শুনতে শুনতেই ধূসরের ধরে রাখা হাতটা ছুটে গিয়েছিল। ধূসরের হাতটা ছেড়ে দিতেই ধূসর এক পা এগিয়ে বেড সাইড টেবিলের দিকে পা বাড়াতেই প্রজ্ঞা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। ধূসর ব্যাপারটা টের পেলেও প্রজ্ঞার দিকে একবারও ঘুরে তাকালো না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বেড সাইড টেবিলের একটা একটা করে মোমবাতি সময় নিয়ে, ফুঁ দিয়ে নিভাতে লাগলো। বিছানার এক পাশের ছয়টা মোমবাতি নেভানো হয়ে গেলে ধূসর অন্য পাশটায় চলে গেল। ওর ঠিক কয়েক হাতের ব্যবধানে যে প্রজ্ঞা বসে আছে, বা ধূসরের এমন ইগনোর করাটা যে প্রজ্ঞার চোখের কোণে কষ্টের মেঘবিন্দু জমছে সেটা যেন নজরেই পড়ছে না ছেলেটার। ধূসর উল্টোদিকের বেড সাইড টেবিলের উপরের বাকি ছয়টা ক্যান্ডেলের শেষ বাতিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতেই টুপ করে এক ফোঁটা পানি প্রজ্ঞার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।

 সবগুলো মোমবাতি নেভানোর পর ধূসর ড্রিম লাইটটা নিভিয়ে দিতেই একটা আচমকা অন্ধকার নেমে এলো রুমটায়। অথচ সেই অন্ধকারেও ধূসরের ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসার দৃশ্যটা পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে প্রজ্ঞা। কিন্তু জানালার পর্দা ঢাকা কাঁচ ভেদ করে না আলো আসছে, আর না রুমে কোনো আলোর উৎস চোখে পড়ছে প্রজ্ঞার। এই অনাহুত আলোটা কোথা থেকে আসছে চারদিকে চোখ বুলিয়ে সেটাই খোঁজার চেষ্টা করলো প্রজ্ঞা। আবছা আলোর উৎস খোঁজার ফাঁকেই হুট করে কারো জড়িয়ে ধরায় প্রজ্ঞা চমকে উঠলেও অভিমানে কিছু বললো না। দু মিনিট নিস্তব্ধতার পর ঘাড়ে ধূসরের আলতো ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো প্রজ্ঞা। কিছু বলবে কি বলবে না প্রজ্ঞার মনের এমন হাজার দ্বন্দ্বের মাঝে ধূসর প্রজ্ঞার মাথাটা নিজের বুকের সাথে হেলান দিয়ে কিছুটা এলিয়ে দিয়ে প্রজ্ঞার মুখটা আবার উপরে ছাদের দিকেই ফিরিয়ে দিল। এতোক্ষণে রুমের বিনা উৎসের আবছা আলোর রহস্য স্পষ্ট হলো প্রজ্ঞার কাছে। রেডিয়াম স্টারগুলো আলো ছড়িয়ে রুমটায় সবুজাভ আলো ফুটিয়ে তুলেছিল। মোমবাতির আলোয় তারার যে আলোগুলোকে ম্লান মনে হচ্ছিল, সেই তারাগুলোই অন্ধকারে যেন উজ্জ্বল থেকে আরো উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলছে। সে যেন এক অন্য রকম মুগ্ধ করা দৃশ্য! 

-এবার বুঝতে পারলেন ম্যাডাম আপনি হুটহাট রাগ করে গাল ফুলিয়ে রাখলে, অভিমানী মুখটা আমার থেকে অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলে আমার কেমন লাগে? 

-তার মানে তুমি নাটক করছিলে আমার সাথে? আর আমি কি যে ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো তুমি? 

-জানি তো। আমি তো জানি আমার পাগলিটা আমি রাগ করেছি ভেবে ভয় পাবে।

-জানার পরও আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছিলে? আমি কেঁদে ফেলবো জেনেও একবার তাকাও নি পর্যন্ত। 

-ম্যাডামের ভীত হরিণীর চাহনি আর মুক্তবিন্দুর মতো কান্নার জলগুলো দেখে তো আর শাস্তিটা দেয়ার সিচুয়েশনে তো আর থাকতাম না, তাই না বলো? অবশ্য ভয় পেলে যে তোমাকে এতো কিউট পুতুলের মতো লাগে জানতাম না তো। সবসময় তো রাগী বউ হয়ে ঘুরে বেড়াও, এবার থেকে মাঝেমাঝে এই দুষ্টু হাজবেন্ডকে ভয়ও পেও বুঝলে? তোমার ভীতু টানাটানা চোখ জোড়ার বিব্রত ভঙ্গিটা দেখে তোমার প্রেমে পড়বো নতুন করে। 

-একদম ধরবে না বলে দিলাম। ছাড়ো। সরো? আমার সাথে একটাও কথা বলবা না বলে দিলাম ধূসর। আমাকে ইচ্ছে করে ভয় দেখিয়ে, রাগের অভিনয় করে এখন আবার তার প্রেম উঁতলে পড়ছে। একটু আগে না বললে রাত হয়েছে, ঘুমাও। এখন আমি ঘুমাবো। গুড নাইট।

-ওকে। ঘুমাও। আমি কি তোমাকে ঘুমাতে বারণ করেছি একবারও? তুমি তোমার ঘুমে কনসেন্ট্রেট করো, আমি আমার কাজে মন দিই।

-যা ইচ্ছে করো। বাট আমার সাথে একটা কথাও বলবে না তুমি।

-ওকে মাই ডিয়ার সুইট ওয়াইফি। যাতে বউয়ের মর্জি, তাতেই বরের সম্মতি।

ধূসরের কথাটার জবাব আর কিচ্ছু না বলে প্রজ্ঞা ধূসরের কাছ থেকে সরে এসে বালিশটা ধুপ করে টেনে একদম কোণায় ফেলে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রজ্ঞার বালিশে মাথা রাখার অপেক্ষা আর ধূসরের প্রজ্ঞার গায়েই নিজের গা এলিয়ে দিয়ে প্রজ্ঞার ঘন কালো খোলা চুলে মুখ ডোবানোর দেরি। প্রজ্ঞা যতই ধূসরকে দূরে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করছে, ততই ধূসরের স্পর্শগুলো আরো গভীরভাবে প্রজ্ঞার সমস্ত শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। একটু পরেই ওদের রুমটা অভিমানী দীর্ঘশ্বাসর বদলে দুজনের খিলখিল হাস্যধ্বনিতে ভরে উঠলো। মান অভিমানের পালা শেষে নতুন করে একটা মধুর প্রেমের কাহিনীর রচনা শুরু হলো। 

অন্যদিকে, কেউ একজন বারবার মোবাইলের ডায়েল স্কিন থেকে কারো নাম্বারে কল করছে। একবার, দুবার, পাঁচবার, দশবার। এভাবে কতোগুলো বিফল কলের সংখ্যাই বাড়লো শুধু, অপর প্রান্ত থেকে কেউই একটা কলেরও জবাব দিলো না। শেষে বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ সব মিলিয়ে নিজের হাতের স্মার্টফোনটাকে ছুঁড়ে ফ্লোরে মেরে খন্ড বিখন্ড করলো মানুষটা। মোবাইলের অপর প্রান্তের মানুষটাকেও এভাবে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারলেও হয়তো তার রাগটা কমবে না এই মূহুর্তে। রাগে নিজের চুলগুলো মুঠো করে চেপে ধরে ফ্লোরে মোবাইলের টুকরো অংশগুলোর পাশেই বসে পড়লো সেই অজানা মানুষটা। আর বিড়বিড় করে কয়েকটা কথাই আওড়ে যাচ্ছে।

-কাজটা তুমি একদমই ঠিক করলে না ধূসর। একদমই ঠিক করলে না আমাকে এভাবে ইগনোর করে। এর ফল তো তোমাকে ভোগ করতেই হবে। আর সেটাও খুব জলদিই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন