০৩!!
সবার সাথে ড্রয়িং রুমে বসে আছে এখন মাইশা। পাশে ওর হাতটা ধরে বসে আছে মেহের নামের সেই মিষ্টি মেয়েটা। মেয়েটাকে বেশ মনে ধরেছে মাইশার। মিষ্টি একটা মেয়ে। মিষ্টি করে কথা বলে। একদম বাচ্চা বাচ্চা চেহারা। অবশ্য এদের সবাই-ই মনে হয় খুব সুন্দর করে কথা বলে। এই যে মেহেরের বাবা। বড্ড আন্তরিক মনে হচ্ছে মানুষটাকে। মাইশার বাবার সাথে একদম বন্ধুর মতো কথা বলছেন৷ মনে হচ্ছে দুই বন্ধুতে বেশ অনেক বছর পর দেখা হচ্ছে। কতো না ভাব দুজনের! কতো কি নিয়ে ছেলেমানুষের মতো আলোচনা করছেন। হাসিহাসি করছেন সামান্য ব্যাপারেও।।
পাশে বসা মেহেরের মা। মাইশার মায়ের সাথে গল্প করছেন। এটা ওটা সেটা নিয়ে। দুজন অপরিচিত মানুষ কিভাবে এতো সহজে একেবারে একটুও ইতস্তত না করে কথা বলতে পারে! সেটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না মেয়েটা৷ আর মুখটা না তুলেই ধ্রুব নামের দুষ্টু লোকটার ইতস্তত দৃষ্টির ঘুরাঘুরি টের পাচ্ছে মাইশা। সেই বেচারাই অসহায়ের মতো চুপ করে বসে আছে শুধু।
এসব ভাবা বাদ দিয়ে অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করছে মাইশা। মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে মাইশাকে ওদের সবারই পছন্দ হয়েছে।। এবার কি তাহলে বিয়ের কথা শুরু হবে? লেনদেন এর ব্যাপার নিয়েও তো কথা হবে তাহলে? না মানে লেনদেন, দেনাপাওনা এসব না ঠিক। আধুনিক বিয়ের গিফটের আলোচনা! বিয়ের উপহার সামগ্রীর আলোচনা! কি কি দিতে হতে পারে বিয়ের উপহারে? একটা চার চাকা গাড়ি? একটা দামি ব্রান্ডের ফ্রিজ? এয়ার কুলার? ওভেন? ইস্ত্রি? সোফা-কাবার্ড-ওয়াড্রব? খাট-পালঙ্ক-বালিশ? আর! আর কি লাগতে পারে উনাদের?
-দেখুন ভাইসাহেব? মেয়ে মাশাল্লাহ আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে। কি বলো সাহেবা??
ধ্রুবর মা সাহেবা তাওহীদ মুচকি হাসলেন। মাইশা উনার দিকেও প্রায় হা করে তাকিয়ে রইলো। এতো লাজুক মিষ্টি হাসি হাসে কেমন করে উনি? মেহের মাইশার কানে কানে ফিসফিস করলো।
-বুঝসো মাইশাপু? তোমাকে একটা সিক্রেট কথা বলি। বাবা মায়ের লাভ মেরেজ বুঝসো? তাই মা এখনো বাবার প্রত্যেক কথায় ষোড়শী ললনার মতো লজ্জা পায়---। হি হি হি।
মাইশাও মুখ টিপে হাসলো। মেয়েটা এতো মিষ্টি কেন! এত্তো কিউট করে কথা বলে!
-ভাই সাহেব--। আপনারাও নিজেদের মধ্যে কথা বলে জানাইয়েন--। আর হ্যাঁ মা?ভালো করে পড়ালেখা করো মন দিয়ে। আল্লাহ রাজী থাকলে এই বুড়া বুড়ি তোমাকে একেবারে মেয়ে করেই নিয়ে যাবে-----।
-আপনারা একটু বসেন ভাই। মাইশার মা একটু আসো--।
মাইশার মা মাইশাকে নিয়ে রুমে আসলেন। এবার অবশ্য মেহের আসে নি। মাইশা অবশ্য বুঝতে পারছে বাবা এবার কি বলবে। এতোদিন যাও একটা আশা ছিল এখন তো সেটাও বাকি নেই। পড়াও তো প্রায় শেষ। এবার দেরি করার মতো না কোন বাহানা আছে, না আছে বাহানা দেয়ার মতো কোন প্রয়োজন। কিন্তু এই মানুষগুলোও যদি---!
-মাইশু মা! তোকে কি বলবো বুঝতে পারছি না---। এতো তাড়াতাড়ি তোকে প্রেশার দিতে চাই নি। কিন্তু এই মানুষগুলোও তো বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে, তাই না বল মা? তবে এটুকু বলতে পারি- ছেলেটার সম্পর্কে খবর যা নিয়েছে সব কিছুই পজিটিভ লেগেছে---।এখন তুই আগে যা বলিস...।
-আমার পছন্দ হয়েছে বাবা--। তোমাদের পছন্দ হলে আগে কথা বলতে পারো----।
-কিন্তু রাতুল যদি আবার ফিরে আসতে চায়-----!
-বাবা----? উনাদেরও যদি লম্বা কোন উপহারের লিস্ট থাকে তবে প্লিজ আর কথা বাড়িয়ো না----। প্লিজ?
মাইশাকে রুমে বসিয়ে বাবা মা দুজনে আবার ড্রয়িং রুমে গেলেন। মাইশা একলা বসে ভাবছে। তার জীবনটা হুট করেই এমন হয়ে গেল কেন? পাঁচ-পাঁচটা বছর একটা নাম মনের পাতায় এঁকে কাটিয়েছে ও। সেই কলেজের সময়টা থেকেই।রাতুল! নামটা কি এতো সহজে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে ও? আর ধ্রুব? এই লোকটাও কি কোন অংশে রাতুল থেকে আলাদা হবে? তার জীবনে যাওয়ার আগে সবটা ক্লিয়ার করে নেয়াটা কি উচিত নয়? আর আধৌ এই লোকটার জীবনে যাচ্ছে কি মাইশা? সেটাও তো জানা নেই ওর।।
আচ্ছা? বাইরে বসার ঘরটায় কি কথা হচ্ছে বাবা মায়ের সাথে মানুষগুলোর? তাদের উপহার চেয়ে লিস্টটা কতোটা বড়? তাদের চাহিদা! তাদের ডিমান্ডগুলো! কতোটা পূরণযোগ্য মাইশার বাবার পক্ষে?
-এই যে মিষ্টি আপি? তোমাকে আমি ভাবি বলে ডাকলে কি তুমি রাগ করবা?
০৪!!
এই মূহুর্তে মেহেরের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে মাইশা। কি বললো মেয়েটা? এই মিষ্টি মেয়েটার মুখে 'ভাবি' শব্দটা বড্ড বেশি কানে এসে লাগছে। আরো একবার শুনতে ইচ্ছে করছে ডাকটা। কিন্তু এতোটাও লোভ করা কি ঠিক হবে? রাতুলের ছোট্ট বোন রিধিটাও তো এই একই নামে ডাকতো ওকে। সেই জায়গাটা মেহেরকে কি কখনো দিতে পারবে ও? নাকি নিজের জীবন থেকে রাতুলের নামটা মুছতে পারবে? আর এই মানুষগুলোরও তো সবটা জানার অধিকার আছে। এদেরকে ঠকাবে কেমন করে মাইশা?
-ও আপি? বলো না? ডাকি ভাবি বলে?
-আচ্ছা---।।
-জানো ভাবি! তুমি এত্তোগুলা কিউট---।
-তুমি আরো বেশি কিউট মেহেরমনি......।
-হি হি----। চলো চলো---। সবাই ডাকছে---।
-মেহের একটা কথা বলার ছিল..।
-পরে আরো এক গাট্টি কথা হবে গো ভাবি---। এখন চলো---।
মেহেরের সাথে আবার ড্রয়িং রুমে এসে বসেছে মাইশা। এক নজর মুখ তুলে বাবা মা দুজনকে দেখে নিলো ও। তাদের মুখটা হাসি হাসি। এ কয়দিনের চিন্তাটা এখন আর নেই মুখে। এদের সাথে কি কথা হলো বুঝতে পারছে না মাইশা। তবে যাই হোক-পজিটিভই হবে হয়তো। অন্তত মুখ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে মাইশার।
-মাইশা মা--। তোমাকে আমাদের এই চারজনেরই ভিষণ পছন্দ হয়েছে। তোমার বাবা মারও কথা আগে বাড়াতে আপত্তি নেই। তুমি কি বলো মা?
মাইশা মাথা নিচু করে চিন্তা করছে। কি বলবে? কি বলা উচিত? এখনই সবটা ক্লিয়ার করা উচিত? নাকি--?
-বেয়াই সাহেব--। মাইশার আপত্তি নেই। আমরা কথা আগে বাড়াতে পারি---।
-আলহামদুলিল্লাহ। তবে তো ভালোই।মাইশা মামনির ফাইনাল পরীক্ষা সামনে যেহেতু--। এখন আর এসব ঝামেলা না করাই ভালো। ছটা মাস ওরাও সময় নিক--। একজন অন্যজনকে বুঝুক--। আমরাও যোগাড় যন্ত করি--। কি বলেন বেয়াই-বেয়াইন?
-বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান-লোকজন-লেনদেন-- ব্যাপারগুলো ক্লিয়ার করে নিলে ভালো হতো না ভাই?
-আরে বেয়াই মশাই--। লোকজন আমার ক জন আসবে সেটা তো আমি জানিই না। প্রেম করে বিয়ে করেছি। না সাহেবার পরিবার কখনো মেনে নিয়েছে, না আমার---।। ছেলে মেয়ে দুটোর জন্মের পর ভেবেছি তাদের মন গলবে--। গলে নি--। এখন ছেলের বিয়েতে তাদের মনের বরফ গলবে সে আশা করি কি করে? আর শুধু তো আপনার মেয়ের বিয়ে না ভাই। আমারও ছেলের বিয়ে--। দুই বেয়াইতে মিলে সবটা সামলে নিতে পারবো ইনশাআল্লাহ---।
-আর? বিয়ের উপহার? কি কি----?
-আরে বেয়াই সাহেব--। বিয়েতে খুব দামি একটা উপহার চাই আমাদের--।
-কি?
-আপনার মেয়েকে---।
------------------------------
-দেখুন বেয়াই সাহেব--। আল্লার রহমতে আল্লাহ ভালোই দিয়েছেন। ছেলের জন্য বউ করে আপনাদের মেয়েকে নিতে চাইছি--। ও ই তো আমাদের কাছে সেরা উপহার--।
মাইশা উনাদের কথা শুনে অবাক চোখে একবার একজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ওর হাত ধরে বসে থাকা মেহের ফিসফিস করে কতো কিছু বলে যাচ্ছে। এখন সেসব আর মাইশার কানে ঢুকছে না।
-ভাবি? দেখো না? ভাইয়াটা কেমন হ্যাবলার মতো তোমাকে দেখছে--। হি হি---।
মেহেরের কথায় ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে মুখটা তুলতেই ধ্রুবের চোখে চোখ পড়লো মাইশার। চোখাচোখি হতেই মৃদু হেসে ছেলেটা চোখ নামিয়ে নিলো। মাইশাও হঠাৎ কি করবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে ভাবতে লাগলো। ব্যাপারগুলো তো আরো ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। কি করবে ও এখন?
-মা তোমার আঙুলে হয় কিনা দেখো?----। বেয়াই সাহেব? ধ্রুব আংটিটা মাইশা মামনির আঙুলে পড়িয়ে দিক?
-হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইসাহেব--। দাও বাবা--।
ধ্রুব সোফা থেকে উঠে এসে দাঁড়ালো আংটি হাতে। মাইশা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ও যে উঠে দাঁড়ানো উচিত সেটাও বেমালুম ভুলে গেছে বেচারি। মনে হতে লাগলো ব্যাপারটা একদম ঠিক হচ্ছে না। একদমই না।
মাইশার মা আর মেহের মুচকি হেসে মাইশাকে ধরে দাঁড় করালো। বাম হাতের অনামিকায় ধ্রুবের পড়ানো আংটিটা ঝলমল করে নিজের অস্তিত্ব জানাচ্ছে।মাইশার হাতেও মা একটা আংটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। একটু পরেই খেয়াল হলো মাইশার। ধ্রুবর আঙুলেও একটা আংটি ঝিলিক দিচ্ছে থেকে থেকে। রাতুলের জন্য আনা আংটিটা যেন ধ্রুবের আঙুলে একেবারে খাপেখাপেই মানিয়ে গেছে।সেটা খেয়াল হতেই বুকের ভিতর যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো মাইশার।