অচেনা অতিথি - পর্ব ৫২ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


ফুয়াদ বাসায় ঢুকেই মা বলে একটা চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠলো। তার পর নিসাকে সাথে সাথে বলল," যাও এখুনি শাড়ী পড়ে এস। তোমার এই ড্রেসটা আমার সহ্য হচ্ছেনা।

ফুয়াদকে দেখে বাসার সবাই চমকে উঠলো। রেজওয়ানের তো পিলে চমকে গেল। রেজওয়ান দু'হাত পিছনে চলে গেল ফুয়াদকে দেখে। এ কিভাবে এখানে এল। রেজওয়ানের এতদিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা তাসের ঘর ভেঙ্গে পড়ল এক নিমিশেই।

ফুয়াদের কন্ঠ লাবীবার চিনতে ভুল হয়না। রুম থেকে একদৌড়ে বের হয়ে নিচে নেমে এসে ফুয়াদকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। লাবীবার কান্না আর ফুয়াদকে পাগলের মত চোখে মুখে চুমা খাওয়া দেখে এমন কেউ পারলো না তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে। ফুয়াদ নিধিকে বলল," দেখছ মা, আমার মাও আমাকে কত ভালোবাসে? যতটা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার পরিবারও একটা বেষ্ট পরিবার।"

ফুয়াদ ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে বলল," মা এত মেহমান আসছে সবার নাস্তার ব্যবস্থা কর। এভাবে কাঁদলে চলবে?  ফুফু, মাকে একটু হেল্প করেন তো, আমি বাবাকে দেখে আসছি।"
ফুয়াদ ওর বাবার কাছে চলে গেল। কামরান সাহেব নিথর অবস্থায় পড়ে আছেন। ফুয়াদ ওর বাবার হাত ধরে বলল," বাবা দেখেন আমি ফুয়াদ, আমায় চিনতে পারছেন বাবা? আমি যখন ঐ বিপদ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি তাহলে মাহাদও শিঘ্রই ফিরে আসবে। আপনাকে আমরা সুস্থ দেখতে চাই। আপনি আমাদের মাথার ছাতা। আপনাকে ছাড়া আমরা চলব কি করে বাবা। আমি জানিনা আপনার সাথে কি কি হয়েছে। সবার আগে আমাদের মাহাদকে প্রয়োজন। ও এলে সব ঠিক করে দিবে।"

কামরান সাহেব কথা বলতে পারেনা। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ে যায়। ফুয়াদ ওর বাবার কপালে কিস করে নিধিকে ডেকে বলল," মা তুমি আমার বাবার খেয়াল রেখ। আপাতত তোমাকে তার সব থেকে বেশি প্রয়োজন। দুধের থেকে দুধের সরের মায়া বেশি। তুমি তোমার দাদুকে ভাল রাখার চেষ্টা কর। তোমার চাচ্চু ফিরে এলে সে সব সামলিয়ে নিয়ে।"

ফুয়াদ নিচে আসতে একটা পুলিশ সদস্য এসে বলল," স্যার, আপনার ফোন এসেছে। "

ফুয়াদ সাথে সাথে সব পুলিশ অফিসারদের উদ্দেশ্য বলল," আপনাদের যার যার ফোন আছে দ্রুত বন্ধ করেন। আমাদের আজকের কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। এটা আমাদের কষ্টের সাফল্য। এই চারমাস ধরে যে কষ্টে কাটিয়েছি এটা তার সাফল্য। কারো ফোন রিসিভ করবেন না। সয়ং প্রধানমন্ত্রীও যদি কল করে তাহলে সাথে কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে রাখুন।"

রাত দশটার সময় লাইভ টেলিকাষ্ট শুরু হল। সমস্ত বেসরকারি টিভি চ্যালেনগুলো একসাথে লাইভ সম্প্রচার করল।

প্রথমে ফুয়াদ বলতে শুরু করলো, 
আমরা ৪ টা মাস আমাদের বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান, পরিবার পরিজন থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ৪ মাস আমরা খাবার ঠিকমত খাইনি, নর্দমার পানি খেতে হয়েছে, জিবন বাঁজি রেখে প্রতি মূহুত্ত্বে বিপদের সাথে লড়াই করেছি। আমরা শুধু দেশের জন্য সব কিছু আত্বত্যাগ করে যুবসমাজকে রক্ষা করার জন্য শত্রুর সঙ্গে একি বিছানায় দিনের পর দিন কাটিয়েছি। আমরা দেশের জন্য এত কিছু করি তারপরও আমার নির্দোষ ভাইকে এক মুহুত্তের জন্য ছাড়া হয়নি। পুলিশের কাছে এমন কোন তথ্য নেই যে তারা কোন কেসের সমাধান করতে পারবেনা। আমার উপর ক্ষোভ কেন আমার ছোট ভাই এবং তার স্ত্রীর উপর পড়ল। ফুয়াদের কন্ঠ ধরে আসল। তবুও বলল," মিসেস তিতির মাহাদের উপর যারা এই অবিচার করেছে তাদের একজনেরও ছাড় নেই। প্রতিটা কর্মের বিচার হবে। ১লাখ ইয়াবা পিস কিভাকে ভিটামিনের ট্যাবলেট হয়? আর কত যুবসমাজকে নষ্ট করা হবে এইসব বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের মদদ দ্বারা। 

ফুয়াদ এইসব বলে থেমে যায়। যেসব পুলিশ অফিসার গুলো নিঁখোজ ছিল তারা একে একে এসে তাদের এতদিনের সব কষ্ট আর অভিঙ্গতা শেয়ার করতে থাকে। তারা কিভাবে সেদিন শত্রুর মোকাবেলা করে তাদের লাশকেই ব্যবহার করে পরিবার পরিজনদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষে একজন অফিসার তিতিরের ব্যাপারে সব তথ্য ফাঁস করে দেয়। আমাদের ফুয়াদ স্যার যখন কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলনা তখন তিনি তিতির ম্যাডামকে বেছে নেন। কারন তিতির মেডাম ওনার পরিবার থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন থাকেন। আমাদের একজন বিশ্বাসী কাউকে দরকার ছিল তাই আমাদের সমস্ত তথ্য ও ভিডিও রের্কড তার কাছে প্রেরন করা হত। কিন্তু যখন তিনি চিঠি লিখে সব জানালেন তাকে ফলো করা হচ্ছে তখন আমাদের করার কিছু ছিলনা। ততক্ষনে আমরা শত্রু দলের সাথে মিশে গিয়েছিলাম। আমাদের সেখান থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। যার ফলাফল তিতির ম্যাডামের উপর আক্রমন হয়। আমাদের সমস্ত কাজের তথ্য ম্যাডামের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। কিন্তু আরো কিছু তথ্য আমাদের হাতে আছে সেগুলো হল বলে সমস্ত ভিডিও ক্লিপ লাইভ কাষ্টে দেখানো হল।"

সংবাদ সম্মেলন শেষ হলে ফুয়াদ ওর ফোন খুলতেই একের পর এক মাসেজ আর কল আসতে লাগল। শেষে ফুয়াদ রিসিভ করতেই হুমকি আসলো, তোমাদের এত কিছু করা ঠিক হয়নি। এর প্রতিদান তোমরা সবাই পাবে।"

কুত্তার বাচ্চা আগে তুই নিজেকে বাঁচা তারপর আমাদের দেখে নিস বলে ফুয়াদ কল কেটে দিল। ফুয়াদের বাসায় বাঁকি ৯ জন পুলিশ সদস্যদের পরিবার এসে ভির জমালো। যারা এতদিন জানত এরা মৃত কিন্তু আজ সেই মানুষগুলো ফিরে এসেছে। এ যেন এক মিলন মেলা।

ফুয়াদ সবাইকে রেখে নিসাকে নিয়ে ঐ রাতেই মাহাদের কাছে ছুটে চলে গেল। কতদিন কলিজার টুকরা ছোট ভাইকে দেখেনি সে। এখন তার ভাইকে চাই।
 মাহাদ তখন ঘুমিয়ে ছিল। ফুয়াদ এসেই হঠাৎ একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলল, মাহাদের শরীরে যত চিকিৎসার যন্ত্র সামগ্রী লাগানো ছিল সব টেনে টেনে খুলতে লাগল। নিসা চমকে উঠে ফুয়াদকে আটকাতে গেল কিন্তু ফুয়াদ সবার বাঁধা অগ্রাহ্য করে মাহাদের শরীর থেকে সব কিছু খুলে ফেলে বলল," মাহাদ, এই ভাবে তুই কেন সুয়ে থাকবি। সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করে বের হয়ে আয়। তিতিরের বডি পাওয়া যায়নি মানে কিছুতো চমৎকার ঘটনা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আমার অভিঙ্গতা বলছে হয় তিতির নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে আমাদের কাছ থেকে  না হয় ওর সাথে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি ৯৮% শিউর তিতির এখনও বেঁচে আছে। বাঁকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। ওকে তোকেই খুঁজে বের করতে হবে। তোর অনেক কাজ, সমস্ত বিচার তুই নিজ হাতে করবি। এরকম করে সুয়ে থাকিসনা ভাই।"

ফুয়াদ মাহাদকে বেড থেকে তুলে বাহিরে নিয়ে এল। কোন অক্সিজেন নয় প্রকৃতির শ্বাস নে তুই। তোর ভিতরের মাহাদকে জাগিয়ে তোল। তোকে আমাদের সবার প্রয়োজন। তুই ছাড়া এত কিছুর সমস্যা সমাধান কেউ করতে পারবেনা। মাহাদের দুইটা ফ্রেন্ড সহ ডাক্তার চেষ্টা করছে ফুয়াদকে থামাতে কিন্তু ফুয়াদ থামতে রাজি নয়। ফুয়াদের একই কথা, বাঁচতে হলে  বাঁচার মত বাঁচ মাহাদ। এভাবে মরার মত তোকে বেঁচে থাকার দরকার নেই।

মাহাদ কিছু বলতে পারলোনা। ফুয়াদের বুকেই নেতিয়ে পড়ল। নিসা পিছন থেকে এসে চেঁচিয়ে  বললো, তুমি পাগল হয়ে গেছ। ওর সাথে কেন এমন ব্যবহার করছো? ওকে কি মেরে ফেলবে বলেই ডাক্তারকে চিৎকার দিয়ে ডাকতে লাগল।

মাহাদকে বেডে নিয়ে যাওয়া হয়। ওর অবস্থা খুবই খারাপ।  মুখে অক্সিজেনের মাস্ক দিয়ে বুকে কয়েকটা  শর্ক দিল। প্রতিটা শর্কে মাহাদ ঝাকুনি দিয়ে  ওঠে। অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে গেল। ডাক্তার সাথে সাথে বলল," আমাদের হাতে আর কিছু নেই, আল্লাহ্কে ডাকুন আপনারা।"

আমরা কি আল্লাহ বলে বসে থাকবো নাকি বলে ফুয়াদ ওর মত করে চেষ্টা করতে লাগলো। মাহাদ ওঠ, তুই এত অল্পতে হেরে যেতে পারিসনা ভাই। বুঝছি সময় আমাদের পক্ষে নেই কিন্তু তাই বলে আশা ছেড়ে দিবি কেন ? তোর সাথে তোর এই ভাই আছে। দেখি কে তোর গায়ে এবার হাত দেয়।পুরো রাত ফুয়াদ মাহাদের পাশে বসে কখনো পায়ে ম্যাসেজ করে দেয় কখনো বুকে পাম্প করে আবার কখনো হাতে মাসেজ করে। ডাক্তাররা তাদের মত করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ রাত্রিতে যখন ফযরের আযান দিচ্ছিল তখন হঠাৎ করেই মাহাদের হাত কেঁপে উঠলো। এটা নিসার চোখ এড়ালো না। মাহাদ, এই মাহাদ আমি নিসা আমার সাথে কথা বল বলে নিসা মাহাদকে ঝাকাতে লাগল। মাহাদ ওর চোখটা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু পারছেনা। শুধু কানে আযানের শব্দগুলো ভেঁসে আসছিল। যখন মুয়াজ্জিন, 
♥আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু♥ 
 বলে আযানের বাক্যগুলো মধুর কন্ঠে উচ্চারন করলো তখন শুধু মাহাদ মনে মনে বলে উঠল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি,  নিশ্চয় আল্লাহ্ এক, তার কোন শরীক নেই। তিনিই আমাকে জিবন দান করবেন এবং একদিন আমি তারই ডাকে তার সান্নিধ্য লাভ করব। আল্লাহ্ আমাকে কথা বলার মত একবার শক্তি দাও বলে অনেক চেষ্টা করে অবশেষে ও চোখ খুলেই কাঁপাকন্ঠে  বলল," ভাইয়া আমাকে একটু অযু করে দাওতো, আমি নামায পড়বো। অনেকদিন হল আমি নামায পড়তে পারিনা।"

ফুয়াদ খুশিতে কেঁদেই ফেলল। মাহাদকে বুকে নিয়ে অঝোরে অনেকক্ষন ধরে কাঁদল তারপর বলল," আমি সেই চঞ্চল মাহাদকে দেখতে চাই, এভাবে নিথর দেহ পড়ে থাকা মাহাদকে আমি দেখতে চাইনা। আমি জানিতো তুই সব বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবি।"

 ফুয়াদ সবাইকে রুম থেকে বের করে দিল। তারপর মাহাদের পোষাক চেঞ্জ করল এবং ওকে  অযু মাধ্যমে একদম ফিটফাট করে দিয়ে নিজেও মাহাদকে নিয়ে একসাথে ফযরের সালাত আদায় করলো। মাহাদ অবশ্যই সুয়ে থেকেই সালাত আদায় করল।

সকাল ১১ টার দিকে মাহাদ কিছুটা সুস্থ হয়ে গেল। ফুয়াদের এমন ব্যবহারে হয় মাহাদ চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যেত না হয় ঠিক হয়ে যেত। আল্লাহ্ সুবহানাতালার অশেষ দয়ায় মাহাদ ঠিক হয়ে গেছে।
ফুয়াদ মাহাদকে কোলে করে নিয়েই নিচে নেমে আসলো এবং গাড়ীতে তুলল। মাহাদের ফ্রেন্ডরা ওকে এগিয়ে দিল নিচের গেট পর্যন্ত। সবাই খুব খুঁশি। সবাইকে বিদায় জানিয়ে মাহাদ বাসায় রওনা দিল। 

♦♦♦♦

প্রায় আড়াই ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে মাহাদ দুপুরে ওর বাসায় এসে পৌছাল। নিসা দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে বাসায় ঢুকল যাতে মাহাদের রুমটা পরিপাটি করতে পারে।
নিসাকে দেখে অনেকে রেগে গেলেও শাসন করার মত কারো সাহস হলনা কিন্তু লাবীবা এসে নিসাকে বলল," আমার ছেলে কই?"

নিসা একটা হাঁসি দিয়ে বলল," মা আমাদের মাহাদ আজ বাড়ি ফিরেছে।"
ওর জন্য আপনি নিজ হাতে খাবার বানান। আমি ওর রুমটা ঠিক করি বলেই নিসা দ্রুত উপরে চলে গেল।

এমন সময় মাহাদকে হুইল চিয়ারে করে ফুয়াদ বাসায় ঢুকল। বাতাসির খুব আদরের নাতী ছিল মাহাদ। সবাই একদিকে আর মাহাদ এবং কামরান একদিকে। তাই ও আগে মাহাদের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বলল," কেমন আছোস মাহাদ! তোরে ছাড়া অ্যার ভাল্লাগেনা রে।"

মাহাদ বাতাসির হাতটা ওর হাত থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল," ভাইয়া আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চল।"

ফুয়াদ নিজেও বুঝতে পারলোনা কেন মাহাদ দাদীর সাথে এমন ব্যবহার করলো। ফুয়াদ মাহাদকে ওর বাবার রুমে নিয়ে গেল। নিধি তখনো কামরান সাহেবের কাছে ছিল। নিধি মাহাদকে দেখে সেই খুঁশি হল। দৌড়ে এসে মাহাদের গলায় হাত দিয়ে বলল," চাচ্চু, তুমি কই ছিলা এতদিন?"

নিধির ওমন কথাতে নিসা বলল," নিধি, চাচ্চুকে ছেড়ে দাও মা। উনিতো এখনো অসুস্থ। তোমার ভার সহ্য করতে পারবেনা।"

নিধি মাহাদকে ছেড়ে দিতেই মাহাদ ওর বাবার হাতটা ধরে বলল," বাবা চোখ খোলতো! দেখ, কে এসেছে?"

কামরান সাহেব মাহাদের কণ্ঠ শুনেই চোখ খুললো আর সাথে সাথে মাহাদ ওর বাবার চোখ দেখেই ভয় পেয়ে গেল। বাবা তোমার এই হাল কে করেছে?
নিসা আমার ফোন কই! আমার ফোনটা এক্ষুনি নিয়ে আয়। দেরি করিসনা। বাবার অবস্থা খুব খারাপ। দ্রুত কিছু না করলে বড় রকমের অঘটন ঘটে যাবে।

"মাহাদ কি হয়েছে! বাবার কি কোন সমস্যা হয়েছে?"

ভাইয়া বাবার সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটেছে। আমি যখন স্কোয়াড কমান্ডের ট্রেনিং নিয়েছিলাম তখন শত্রুদের বিপক্ষে একটা মেডিসিন ব্যবহার করা হয়ে থাকত। যা দিয়ে শুত্রুদের মেরে ফেলা হত না কিন্তু বাবার মত তাদের জিন্দা লাশ বানিয়ে রাখা হত। আমার সিক্স সেন্স বলছে এমনই কিছু একটা বাবার সাথে ঘটেছে।

নিসা মাহাদের ফোনটা এনে দিতেই মাহাদ ডক্টর পল্লবকে ফোন দিয়ে ডিটেলস্ বলল। আরও কিছুক্ষন কথা বলল মাহাদ।

"মাহাদ তুই কি শিউর! বাবার সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে?"

"ভাইয়া, আমি শতভাগ শিউর হয়ে বলছি এমনই কিছু ঘটেছে বাবার সাথে।"

বিকেলের দিকে কামরান সাহেবকে ডক্টর পল্লব এসে দেখে ওনাকে দ্রুত হসপিটালে শিফর্ট করতে বলল। পরেরদিন কামরান সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হল। এতকিছু হয়ে গেল কিন্তু বাসার কেউ কিছু জানলোনা কামরানকে কেন হসপিটালে শিফর্ট করা হল। 

রাতে মাহাদ বসে আছে ওর রুমে। ল্যাপটপে একটার পর একটা ছবি দেখছিল তিতিরের। সবই শুধু স্মৃতি এখন। মাহাদের চোখ লাল হয়ে যায়। অজান্তেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝড়লো।

এমন সময় ফুয়াদ মাহাদের রুমে আসতেই মাহাদ চট করে চোখের পানি মুছে ফেললো। ফুয়াদ কাছে এসে বলল," আমি যে বেঁচে ছিলাম তা শুধু মাত্র তিতিরই জানতো। তোকে বলা হয়নি কারন তোর মাথা গরম, নিসাকে বলা হয়নি কারন নিসা আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতো। আর বাবাকে তো চিনিস, সব রেজওয়ানেরর সাথে শেয়ার করতো। মাও একই পথে হাটতো। শেষে ডিসিশন নিলাম তিতিরকে সব বলা যায়। তাছাড়া ও আমাদের কারো সাথে থাকতোনা। ওকে সহজে সন্দেহ করতোনা। আমি ওকে সময় সুযোগ বুঝে সব তথ্য পাঠাতাম। কিন্তু ও যখন আমাকে একটা চিঠি কুরিয়ার করল তখন আমার খুব সমস্যা হয়ে গেল। প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিলাম তাদের কাছে। অনেক কষ্টে ওর চিঠিটা পেলাম। চিঠি পড়ে বুঝলাম ওর উপর যেকোন সময়ে আক্রমন হতে পারে। কিন্তু তখন আমরা এত গভীর জঙ্গল আর গুহার মধ্য থাকতাম সেখান থেকে বের হওয়া সম্ভব ছিলনা। সব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম।  আল্লাহ্ তুমি ওকে রক্ষা করো। তারপর একদিন ওদের মুখেই শুনলাম যে, ফুয়াদের ছোট ভাইকে পুলিশে ধরছে। ওরা এমন ভাবে ছক একেছে সেখান থেকে তুই নাকি কোন দিনও বেরুতে পারবিনা। তখন বুঝলাম তিতিরের কিছু একটা হয়েছে। অবশেষে  আমাদের ফোর্সের একজনকে একবারে পাঠিয়ে দিলাম ওখান থেকে কিন্তু সে মাঝপথে ধরা পড়ল। তাকে ক্রস ফায়ারে মরতে হল। এবার নিজেই রিক্স নিলাম। অনেক কষ্টে সেখান থেকে বের হয়ে এক আদিবাসীকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আবার ঠিক সময় সেখানে ফিরে এলাম। আমরা ছিলাম বান্দরবনে। কিন্তু ঐ আদিবাসীকে দিয়ে রাঙ্গামাটি থেকে চিঠিটা কোরিয়া করে পাঠিয়ে দিলাম আমার এক বিশ্বস্ত কলিগের কাছে। যাতে কেউ সন্দেহ না করতে পারে আমাদের। তারপর আরো মাস খানেক নিজের বুকের উপর পাথর চাঁপা দিয়ে কাজ করতে লাগলাম। জানিনা তখন আমার পরিবার কি অবস্থায় কাটাচ্ছে। অবশেষে মিশন শেষ করে সবাই চলে এলাম। তারপরতো তুই সব জানিস। কিন্তু আমি একটা কথা ভাবতে পারছিনা তিতির জানে ওর সামনে বিপদ  তাহলে ও কেন চুপ করে ছিল। ও তোকে একটি কথাও কেন বলেনি?"

মাহাদ সবকিছু শুনে বলল," তুমি যাদের বিরুদ্ধে এত কাজ করলে তারা কি ধরা পড়েছে?"

না, আমার তথ্য গুলো ছিল দুর্বল। তিতিরের কাছে আসল তথ্য ছিল। ও কোথায় রাখছে সেটা আমরা জানিনা। তাই তাদের আর ধরা সম্ভব হয়নি। তারা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে।

♦♦♦♦

৯ দিন পর,
মাহাদ পুরো সুস্থ। মাহাদ পথমেই প্রফেসর হামিদ আমযাদের বাসায় গিয়ে তিতিরের সব জিনিসপত্র  নিয়ে আসলো। ফুয়াদ সব কিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজল কিন্তু কিছু তথ্য পেলনা। এদের জন্য যখন তিতিরের সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে তখন এদের না দেখে মাহাদ ছাড়ছেনা। মাহাদ মাথা স্থির করে ভাবল কই রাখতে পারে। বাবার দেওয়া বালাটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কই রাখছে ওগুলো। তিতির মাহাদের সাথে শেষ সময় কাটিয়েছে গাড়ীতে। মাহাদ আর একমুহুত্ব দেরী না করে গাড়ী সার্চ করতে লাগল। এই গাড়ীটা মাহাদ ছাড়া কেউ ব্যবহার করেনা। হঠাৎ গাড়ীর সামনের কর্নারে চোখ গেল মাহাদের। তিতির টাকা রাখার জন্য একটা মিনি ব্যাগও ভ্যানেটি ব্যাগের মধ্য রাখত। সেই মিনি ব্যাগ সেখানে রয়েছে। মাহাদ ওটা দ্রুত নিয়ে চেইল খুলে দেখল একটা চিরকুট, বালা আর  কিছু মেমোরি কার্ড। চিরকুট খুলেই পড়তে লাগল,
" মাহাদ, আপনি কেমন আছেন? আমি জানিনা আপনি চিঠি পাওয়ার পর আমি বেঁচে থাকবো কিনা? ব্রেকআপ জিনিসটা খুব কষ্টকর, কারন আমরা আমাদের মনটাই অন্যর হাতে তুলে দেই। তাই হয়ত ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদ এতটা কষ্টকর। সবার চোখের বিষই রয়ে গেলাম। ভাগ্য আমাকে আর পরিবর্তন করতে পারলোনা। দাদী, ফুপু, রেজওয়ান......."

চিঠিতে আর কিছু লেখা নেই।  মাহাদের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। এতকিছুর পেছনে কার কার  হাত ছিল সেটা মাহাদের বুঝতে বাঁকি রইল না। মাহাদ ওগুলো নিয়ে আগে ফুয়াদের হাতে তুলে দিয়ে বলল," ভাইয়া ওদের এমন শাস্তির ব্যবস্থা কর যাতে ওদের ১৪ পুরুষ এই বিচার ব্যবস্থা দেখে কেঁপে ওঠে।"

তারপর মাহাদ বাতাসির রুমে গেল। বাতাসি তখন বসে চা পান করছিল। মাহাদ শান্তশিষ্ট হয়ে বলল," বাতাসী বাবা কি ফিরেছে আজ! আজতো তার আসার কথা। উনিতো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন।"

" বাতাসি ভড়কে গিয়ে বলল," কামুর কতা অ্যারে জিঙ্গাসা করিস কিল্লাই!"

কেন জিঙ্গাসা করি!
সাবিনা! সাবিনা! বলে মাহাদ ওকে ডাকতেই সাবিনা এসে হাজির হল। সাবিনা এক্ষুনি বাবাকে ডেকে আনতো!

সাবিনা একমুহুত্ত্বও দেরী না করে কামরান সাহেবকে ডেকে আনলো। মাহাদ দরজাটা বন্ধ করে এসে বাতাসিকে সোজা প্রশ্ন করলো, " তিতির তোমার কি এমন ক্ষতি করেছে যার জন্য তুমি ওর সাথে এতবড় অন্যায়-অবিচার করলে!"

বাতাসি প্রথমে এই বিষয় নিয়ে অস্বীকার করে মাহাদের মুখে বড় বড় কথা বলতে লাগল কিন্তু মাহাদ যখন বলল," আমি সব জানি, পুলিশের কাছে গেলে এমনি তোমার মুখ দিয়ে সব কথা বের হবে।"

এবার বাতাসি ভয় পেয়ে বলল," অ্যাই তোর বউরে শুধু ধমকায়া দেশ থাইকা বিদায় করতে কইছিলাম রেজওয়ান রে। কিন্তু রেজওয়ান যে এতবড় কান্ড ঘটাবে অ্যার জানা ছিলনা।"

মাহাদ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল," তারমানে  তুমি আগে থেকেই সব কিছু জানতে! কেন আমার এতবড় ক্ষতি করলে। তোমার একবারও মনে হলনা আমি তাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো! তোমার তিতিরের উপর ক্ষোভ আগে থেকেই ছিল কিন্তু আমি! আমার উপর কি তোমার একটুও দয়া হয়নি? তুমি তো আমাকে মেরেই ফেলেছ বাতাসি বলে মাহাদ ফ্লোরে বসে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল ছোট বাচ্চাদের মত।"

মাহাদের কান্না দেখে ওর বাবা মাথা নিচু করে বসে রইল কিন্তু কিছু বলল না। মায়ের উপর সে একটা কথাও বলবেনা। মায়ের বেলায় তার ন্যায়বিচার নেই।

কিন্তু মাহাদ চোখের পানি মুছে দাড়িয়েই গর্জে উঠলো। আমার পরিবারই আমার সবথেকে বড় শত্রু। বাবা আমি আপনার মাকে ছাড়বোনা। এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব বলতেই কামরান কিছু না ভেবেই মাহাদের পায়ে হাত দিয়ে বলল," মাহাদ এতবড় কাজ করিসনা বাবা, যতই হোক সে আমার মা। আমি কোনদিনও চাইনা আমার আম্মাজানের সম্মান নষ্ট হয়ে যাক। আমি বাবা হয়ে তোর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, আম্মাজানরে তুই ক্ষমা করে দে বাবা।"

মাহাদ সাথে সাথে দু'পা পিছে সরে এল। বাবা আপনি এবং মা দু'জনেই আমার আর তিতিরের পায়ে পর্যন্ত হাত দিলেন অন্যায় আবদার রাখতে। মানুষের প্রিয় জিনিসে হাত দিলে কতটা কষ্ট হয় তা এবার সবাই বুঝবে। এমনকি আপনি আর মাও বুঝবেন বলে রুম থেকে বের হল মাহাদ। 

মাহাদ রুম থেকে বের হতেই রুপালীর সাথে ধাক্কা খেল। এই মাহাদ কিছু খাবি! তোকে কিছু বানিয়ে দেই?

মাহাদ শুধু ওর ফুপুর দিকে একবার চাইল তারপর ঘৃনায় মুখটা সরিয়ে নিয়ে কিছু না বলে ওর রুমে চলে গেল। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে বসে রইল। সব কিছু জেনেও মাহাদকে চুপ করে থাকতে হবে! অসম্ভব সে কিছুতেই চুপ করে থাকার মত মানুষ নয়। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় রইল। দু'দিন পর সুযোগও পেয়ে গেল। বাসায় তেমন কেউ ছিলনা। বিকেলের দিকে রেজওয়ান ঘুমাচ্ছিল। মৌ ওর বাবার বাসায় গেছে। মাহাদ রুমের ভিতর ঢুকেই ঘুমন্ত রেজওয়ানের ঘাড়ে চট করে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিল।
সাথে সাথে রেজওয়ান জেগে উঠেই বলল," মাহাদ আমার শরীরে কি দিলি!

মাহাদও শক্ত করে রেজওয়ানের মুখটা চিপে ধরে বলল," আল্লাহ্কে ডাক তিতির যেন ফিরে আসে। যেদিন তিতির ফিরে আসবে সেদিন তোর মুক্তি ঘটবে। না তুই এখন তোর বৌকে ছুতে পারবি না তোর বাচ্চাকে। আমার বাবা তার সন্তানদের বিজনেস না শিখিয়ে তোকে সব কিছু নিজের হাতে শিখিয়েছে, তোরে সন্তানের মত লালন-পালন করলো আর তুই তাকেও শান্তি দিলিনা! শেষে তাকেও তোর শিকার বানালি! তোর মা তোর উপর ভরষা করে এতবড় নোংরা কাজ করেছে তাইনা? তোর এই অবস্থা যখন তোর মা দেখবে তখন বুঝবে প্রিয় মানুষ হারানো কতটা বেদনাজনক।"
 সবাইকে ধরে ধরে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে রেজওয়ান কে ছেড়ে দিয়েই রুম থেকে বের হয়ে এল মাহাদ।

মাহাদ রুমে বসে আছে রুপালীর চিৎকার শুনার অপেক্ষায়।  কিছুক্ষন পড়ে রুপালীর চিৎকার শুনতে পেল মাহাদ। ওর প্রতিটা চিৎকার মাহাদের বুকের দাউদাউ করে জ্বলা আগুন নিভাতে সাহার্য্য করছে। কেউ জানলও না রেজওয়ানের এই অবস্থা মাহাদ করেছে। 
রেজওয়ানের সমস্ত শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। কথা বলার ক্ষমতাও নেই। জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে এখন সারাটা জিবন ধরে।

মাহাদ ব্যস্ত হয়ে গেল তিতিরকে খুঁজতে। পুরো শহর সহ সারা দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই তিতিরকে খুঁজে পেলনা। এদিকে রুপালী একদিন হঠাৎ করেই কামরানের কাছে এসে সব কথা খুলে বলে কাঁদতে লাগল। আমার পাপের ফল আমার ছেলেটা উপভোগ করছে। কামরান সাহেব শুধু চুপ করে শুনল। আল্লাহর শাস্তি সব থেকে কঠিন শাস্তিই হয়ে থাকে। কেউ ভূলেও জানতে পারলোনা এই নিখুত কাজটা মাহাদের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।
কোন ডাক্তার ধরতে পারেনা আসলে রেজওয়ানের কি সমস্যা হয়েছে।

মাহাদ বাতাসির সাথে সম্পূর্ন কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি সে বাতাসির মুখও দেখতে চায়না। আর রেজওয়ান ও রুপালী প্রতিদিন তাদের যন্ত্রনা উপভোগ করেই চলছে। প্রয়োজন ছাড়া মাহাদ ওর মা-বাবার সাথেও তেমন কথা বলেনা। 

♦♦♦♦

তিন বছর পর,

মাহাদ সম্পূর্ন নিজেকে পাল্টে ফেলেছে। কাজের মধ্য সবসময় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। এখন তার জনপ্রিয়তা আরও দশগুণ তুঙ্গে উঠেছে। রাস্তায় সাধারন ভাবে বের হলেও হাজারো ফ্যানরা এসে ভিড় জমায়। সে রাজনীতির পথে আর হাটেনি। বিজনেস নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তিতিরকে এই তিনটি বছর পাগলের মত খুঁজেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ইদানিং মাহাদ আলাদা বাসায় থাকে। আর এটাই হচ্ছে পরিবারকে দেওয়া ওর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তির উপহার। বিশাল বিলাসবহুল বাসাতে কাজের লোক আর সে ছাড়া কেউ থাকেনা। রাতে অন্তত তিতিরকে নিয়ে ভাবতে পারে। কেউ মাহাদকে বিরক্ত করতে আসেনা। মাঝে মধ্য নিসা, নিধি আর ফিহাকে নিয়ে মাহাদের এখানে এসে সময় কাটিয়ে যায়। নিসার আরও একটা মেয়ে হয়েছে যার নাম ফিহা। 

মাহাদ বিজনেসের কাজে বার্সেলোনাতে গিয়েছিল। আজই সকালে দেশে ফিরেছে। মাহাদের পুরো রুম জুড়ে শুধু ওর আর তিতিরে ছবি। বিয়ের ছবি হইতে চিটাগাং এ গিয়ে যেগুলো পিক উঠাইছিল সেগুলো এবং শেষ গাড়ীতে তিতরকে বুকে জড়িয়ে যেগুলো পিক তুলেছিল সব ছবি স্থান পেয়েছে মাহাদের এই রুমে। 

বিকেলে মাহাদ ঘুমাচ্ছিল এমন সময় ফুয়াদের কল আসল। মাহাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম জড়ানো কন্ঠে হ্যালো বলতেই ফুয়াদ বলল," তুই কোথায় আছিস?"

" এই তো বাসায়।"

" দাদীর অবস্থা খুব খারাপ। তোকে দাদী বার বার দেখতে চাচ্ছে।"

" আমি যেতে পারবোনা বলে মাহাদ কল কেটে দিল।"

" ফুয়াদ আবার কল দিল কিন্তু এবার মাহাদ ওর ফোনটাই বন্ধ করে দিল।"

মাহাদ বিছানায় বসে কিছুক্ষন চিন্তা করলো। এই তিনটা বছরে মাহাদ ঐ বাসায় পা দেয়নি। কারো সাথে সম্পর্ক রাখেনি। এমনকি কোন ঈদেও দেখা করেনি। মাহাদ চুপ করে বাতাসি আর ওর ভালো সময় কাটানোর কথা মনে করতে লাগল। মাহাদের কি মনে হল হঠাৎ ফ্রেস হয়ে রেডি হল তারপর নিসাকে কল দিয়ে বলল বাতাসি কই আছে। তারপর হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে রওনা দিল।

মাহাদ হসপিটালে এসে গাড়ী থেকে নামল। পিছন পিছন ৩টা বডিগার্ড ও নামল। মাহাদের নিরাপত্তার জন্যই সরকার থেকে বডিগার্ড রাখার নির্দেশ  এসেছে। তাছাড়াও সরকার থেকে লাইসেন্সকৃত রিভেলভারও দেওয়া হয়েছে। মাহাদ যখন আনমনে হাটছিল তখন দুর থেকে প্রায় আড়াই বছরের একটা বাচ্চা মাহাদের দিকে গভীর ভাবে লক্ষ্য করছিল। বাচ্চাটির যেন চোখের পলকই পড়ছিল না। মাহাদের সেদিকে চোখ পড়ল না। 

মাহাদ কেবিনের দরজায় দাড়িয়ে দেখল রজনী ফুফু আর রূপসা বাতাসির কাছে বসে আছে। আর ও মা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল। মাহাদ রুমে ঢুকতেই বডিগার্ড দরজায় দাড়িয়ে গেল। মাহাদকে দেখে রজনী বসা থেকে উঠে দাড়ালো। তারপর বলল," কি মাহাদ! খুব বড় হয়ে গেছিস তাই না? কারো সাথে সম্পর্ক রাখিসনি। আম্মাজানের যে এরকম হাল তবুও তোর মন গলেনি!"

মাহাদ কিছু না বলে বাতাসির পাশে বসে ওর হাতটি ধরতেই বাতাসি চোখ খুলে মাহাদের দিকে চাইলো। মাহাদকে দেখে বাতাসি ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু পারলোনা। মাহাদ শেষে বাতাসিকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল," কেমন আছ বাতাসি?"

মাহাদের এমন কথা শুনে বাতাসি ডুকরে কেঁদে উঠলো। মাহাদের হাত, চোখমুখ নেড়ে চুমা খেয়ে বলল," অ্যাই ভালা নাই রে মাহাদ, তোরে ছাড়া কি অ্যাই ভালা থাকুম? অ্যারে মাফ কইরা দে। অ্যার সাথে বাড়িত চল ভাই।"

আমি তোমারে অনেক আগেই মাফ করে দিছি। বাসায় আমি যাবোনা। তোমাকে দেখতে আসছিলাম। তুমি ভালো আছ এতেই যথেষ্ট। 

এমন সময় বাহিরে কারো কথা শুনে মাহাদ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো একটা বাচ্চা রুমে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু গার্ডরা ওকে ধরে ফেলেছে। বাচ্চাটা শুধু বলছে, "বাবা যাব।"

"এই মিল্টন, বাচ্চাটা কে! ও এমন করছে কেন?"

" স্যার, আমি জানিনা, কোথা থেকে যে বাচ্চাটা আসল বুঝতে পারছিনা। আমি একটু বাহিরে খোঁজ নিয়ে আসছি।"

"মিল্টন ওকে ভিতরে আসতে দাও। আর তুমি বাহিরে গিয়ে খোঁজ নাও বাচ্চাটা কে। এভাবে এত মানুষের ভিড়ে ছোট বাচ্চাকে কেউ ছেড়ে দেয়!"

মিল্টন বাচ্চাটিকে ছেড়ে দিতেই বাচ্চাটি দৌড়ে মাহাদের কাছে এসে বলল," আসসালামু আলাইকুম বাবা।"

মাহাদের বুকের হৃৎপিন্ডটাই নড়ে উঠল বাবা ডাক শুনে। ছোট পাজামা পাঞ্জেবী পড়া অত্যান্ত সুর্দশন একটা বাচ্চা। সে হয়ত কেঁদেছিল, তার চোখের পানি এখনো শুকাইনি। চোখে পানি নিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে মাহাদের দিকে চেয়ে আছে। গালে ছোট্ট টোল পড়ে তার হাসির সৌন্দর্যকে হাজার গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন