২৭!!
বাসার সামনে পৌঁছে আয়ান মায়রার চুলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে আলতো করে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। মায়রার আবেশে ঘুম এসে ভর করছে চোখ জুড়ে। মানুষটা হয়তো ভাবছে মায়রা ঘুমিয়ে গেছে। তাই হয়তো ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মায়রা তো জেগে থেকেই প্রিয় মানুষটার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণটা নিজের গায়ে মেখে নিচ্ছিলো। এভাবে এতোটা কাছে মানুষটা আবার কবে পাওয়া হবে কে জানে! তাই মায়রার সরতে একটুও ইচ্ছে করছে না।
-মায়রু? এই যে লাজুক পরী? বাসায় যাবা না?
-উহু------।
-জেগেই ছিলে বুঝি এতোক্ষণ?
মায়রা ঘোরের মধ্যে 'উহু' বলে ফেলেছিল। মানুষটার কাছে ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেল বেচারি৷ একটু সরে আসার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রাকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মায়রা চুপ করে আয়ানের বুকে মুখ ডুবিয়ে বসে রইলো।
-মায়ু? একটা কথা বলবো?
-হুম---।
-সবসময় আমার এমন লাজুক পরীটা হয়ে থেকো কেমন? কখনো বদলে যেও না প্লিজ--। কখনো কিছু নিয়ে রাগ হলে বা বিরক্ত হলে সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবা। কোনো ভুল বোঝাবুঝি যেন আমাদের ছোট্ট সংসারে আসতে না পারে। কেমন?
-হুম----।
-আর যতই অভিমান করে থাকো, বা রাগ করো সবসময় আমাকে বলবা। মন খারাপ হলে বলবা, খুশি থাকলে বলবা-সব শেয়ার করবা কেমন? কাজের প্রেশার বাড়লে হয়তো তোমাকে এতোটা সময় দিতে পারবো না--। তখন কিন্তু অভিমান করে বসে থাকতে পারবা না। কাজের প্রেশার বেশি হলে আমি প্রায় সময়ই বাসায় ফিরতাম না--৷ মা বাবা খুব চিল্লাপাল্লা করতো--। কিন্তু তুমি এলে হয়তো তোমার থেকে দূরে একটা রাতও কাটাতে পারব না ঠিকই--। তবে সময়টাও হয়তো ঠিকমতো দিতে পারবো না। তখন কিন্তু অভিমান না করে হুটহাট এসে এভাবে বুকে ডুব দিয়ে থাকবা। যত ইচ্ছা বিরক্ত করবা-কিন্তু রাগ করে দূরে সরে যাবা না। প্রমিস?
-হুম--। প্রমিস---।
-হয়তো ভাবছো এসব কেন বলছি-। আমার সাথে থাকতে থাকতে টের পাবা কাজের সময় আর কিছুই চোখে পড়ে না আমার--। তুমি যদিও আমার লাইফে সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট-। তবুও আগেভাগে আমার এই বদঅভ্যেসটার জন্য রেডি থাকো--।
-আচ্ছা--। আমি রাগ করবো না।
-এইতো গুড গার্ল---।
আয়ান আলতো করে মায়রার মুখটা তুলে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তারপর বেশ অনেকটা সময় নিয়ে মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সারাটা দিন এই মায়া ভরা মুখটা দেখা হবে না। তাই চোখের শান্তি করে নিচ্ছে আগেভাগে। মায়রা লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল। মানুষটার এমন চাহনিতে মায়রার ভিতরে কিসের এক ঝড় উঠে। আর এভাবে এতোক্ষণ চোখে চোখে তাকিয়ে থাকা যায়? লজ্জা পায় না বুঝি? আয়ান আবার হেসে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো আলতো করে।
-এই যে ম্যাডাম? আজকে বুঝি বাসায় যাবেন না?
-এই তো---। যাচ্ছি--। আপনি অফিসে যাবেন এখন?
-হুম--। তুমি বাসায় যাও। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো। কেমন? আমি ফ্রি হয়ে কল দিবো-। ওকে?
-আচ্ছা-----।
মায়রা সরে আসার আগেই আয়ান মায়রাকে বসিয়ে দিল হাত ধরে টেনে।
-আরে দাঁড়াও--। এক মিনিট--। শাড়িগুলো নিয়ে যাও---।
-এসব এখন নিয়ে কি করবো! আপনি নিয়ে যান বাসায়---। বিয়ের জিনিসের সাথেই নাহয় পাঠাবেন---?
-উম--। আচ্ছা---। তবে এটা নিয়ে যাও--।
-কি আছে?
-একটা শাড়ি। এটা তোমার কাছে যত্ন করে রেখে দাও। আমাদের বিয়ের পর বেনারসি বদলে এটা পড়ে নিবে--। আমি রুমে আসার আগেই--। মনে থাকবে ম্যাডাম?
মায়রা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল। এই শাড়িটা এখন দেয়ার কি ছিল! লোকটা কি যে করে!
-এটাও নিয়ে যান না?
-উহু-। এটা খুব স্পেশাল একটা শাড়ি--। রুমে গিয়ে দেখলেই টের পাবে--।
-হুম? আচ্ছা---।
-এখন তাহলে আসি পরীটা?
-আচ্ছা। সাবধানে যাবেন--।
-ওক্কে মহারাণী----। আপনিও বাসায় যান--।
মায়রার কপালে আলতো করে আরেকটা চুমো দিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই মায়রা গাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাসায় ঢুকলো। আর আয়ানও অফিসের দিকে গাড়ি ছুটালো।
মায়রা বাসায় গিয়ে ঘড়িতে দেখলো ৩ টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকালো মায়রা। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলেও মায়রার মা ওকে কিছুই বললো না। আগের মতো চড় বসালেন না গালে ঠিকই। তবু মায়রার কেন জানি মনে হচ্ছে নিজের বাসায় থেকেও কোন অপরিচিতদের দুনিয়ায় চলে এসেছে ও। এখানে ওর জন্য যেন কারো কোন অনুভূতি নেই। আছে কি মরেছে! খেয়েছে কি না সেই কথাটা জিজ্ঞেস করারও কারো কোন আগ্রহ নেই। মায়রা গুটিগুটি পায়ে নিজের রুমটায় চলে গেল।
অহেতুক মন খারাপ করে বসে না থেকে আয়ানের দেয়া শাড়ির প্যাকেটটা খুলে দেখলো মায়রা। প্যাকেট থেকে শাড়িটা বের করেই মায়রার চোখ কপালে উঠার জোগাড়! কি দেখছে মায়রা! শপিংমলে দেখা পুতুলের পড়নের সেই রয়েল ব্লু কালারের জামদানি শাড়িটা এখন মায়রার হাতে। হাত বুলিয়ে শাড়িটার মসৃণ জমিনে, আঁচলে, পাড়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে মায়রা৷ রয়েল ব্লু শাড়িটায় ক্রিম কালারের সুতোর কাজগুলো যেন একেবারে ফুটে উঠেছে। মায়রা কি করবে বুঝতে পারছে না৷ অবাক হবে নাকি হতবাক হবে! অতিরিক্ত খুশিতেই কিনা কে জানে মায়রার খুব কান্না পাচ্ছে। মায়রা কোন রকমে আয়ানের নাম্বারটা ডায়াল করলো। রিং হতেই কলটা কেটে গিয়ে মায়রার নাম্বারেই কল এলো ফিরতি। মায়রা কলটা রিসিভ করে মোবাইলটা কানে লাগালো।
-হ্যালো?
-------------------------------
-সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো মায়রামনির?
-------------------------------
-মায়রা? কথা বলবা না?
মায়রা কোনমতে নিজেকে সামলে নিল। কান্না এসে গলাটা আটকে যাচ্ছে বেচারির। কি আর বলবে!
-শাড়িটা--শাড়িটা কখন নিলেন?
-কাঁদছ কেন? শাড়ি পছন্দ হয়নি?
-ভিষণ পছন্দ হয়েছে-। কিন্তু এতো শাড়ি নেয়ার পর আবার এটা কেন?
-বারে! আমার পরীটার একটা জিনিস পছন্দ হয়েছে আর আমি সেটা নিবো না পরীর জন্য! কিন্তু ম্যাডাম--। কোন কিছু পছন্দ হলে নিজের বরকে বলতে হয় বুঝসেন?
কথাটা শোনামাত্র মায়রার বুকের ধুকপুকানিটা বেড়ে গেল। নিজের বর! আসলেই তো লোকটা ওর নিজের বর! কয়দিন বাদেই এই লোকটার সাথে নতুন একটা দুনিয়া শুরু হবে মায়রার৷ ভাবতেই ভালো লাগছে মায়রার।
-ও হ্যালো ম্যাডাম? এভাবে ধুমধাম সাইলেন্ট মুডে চলে যান কেন?
-জি শুনছি তো---।
-শুধু শুনলে তো হবে না ম্যাডাম--। বলতে হবে তো আমাকে। আমি তখন তোমার দিকে না তাকালে তো বুঝতেই পারতাম না শাড়িটা তোমার এতো পছন্দ হয়েছিল। অথচ কিছু বলো নি। এটা কখনো করবা না।
-কি করবো!
-উমমমম---। কিছু পছন্দ হলে সোজা আমার কাছে আবদার করবা। গলা জড়িয়ে ধরে ঝুল খেতে খেতে আদুরে কন্ঠে বলবা, ওগো শোনো না--এইটা খুব পছন্দ হয়েছে--। নিয়ে দাও---।
আয়ানের কথাটা শুনেই মায়রা হেসে ফেললো। মানুষটা কি বলে এসব! গলায় ঝুলে ঝুলে আবদার ধরবা! বউ নাকি বাঁদর! এই কাজ মায়রাকে দিয়ে জীবনেও হবে না।
-আরে! এখানে হাসির কি হলো? সিরিয়াসলি বলছি---। তুমি আমার গলায় ঝুলে আবদার করবা। আর আমি বলবো, তাহলে আগে আমার পাওনা বুঝিয়ে দাও--। তাহলেই এনে দিব--।
-কিসের পাওনা!
-ওমা! বউকে পছন্দের জিনিস কিনে দিবো বউও তো একটু আধটু সাপোর্ট দিতে হবে। দাম না চুকালে কেমনে কি!
-মানে! কিসের দাম? কি বলছেন?
-মানে হলো---। পছন্দের জিনিসের আবদার করবেন বরের কাছে৷ কোন সমস্যা নেই। তবে তার দাম চুকাতে হবে আদর দিয়ে---। ধরো, কিছু একটা চাইবে তুমি-। এসে আমার গলা জড়িয়ে ঝুলে বলবে সে কথা--। আমি তোমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে তার দামটা উশুল করে নিবো---।
মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে মেয়েটার। লোকটা মাঝেমাঝে কিসব বলে ওর বুকের কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এমন করলে চলে! মনে মনেই তো খুন হয়ে যায় এমন কথা শুনলে। মানুষটা কেন যে বুঝে না এসব শুনলে মায়রার লজ্জায় মাটির মধ্যে ঢুকে যেতে মনে চায়! এতো লজ্জায় ফেলে কি এতো মজা পায় উনি!
-আরে! কি মুশকিল! আবার সাইলেন্ট মুডে চলে গেলে কেন? এখনই না তো। আগে বিয়াটা হোক। তারপর--। তবে এই শাড়িটার কিন্তু দাম উশুল করা হবে-। বাসর রাতে যখন এসে শাড়িটা পড়নে দেখব---। আচ্ছা বাকিটা সাসপেন্স থাক-। তবে শাড়িটা পড়া চাই কিন্তু সেদিন-। সরি সেরাতে--।
মায়রা কি বলবে ভেবে পায় না। এভাবে আয়ানের ভালোবাসা, কেয়ারিং আর মায়রার লজ্জায় লাল নীল বেগুনি রঙে কাটছে ওদের দিনগুলো। দুজনেই অধীর আগ্রহ নিয়ে সামনের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষায় বসে আছে৷ সুখের স্বপ্নগুলো ভাবতেও অনেক সুখ সুখ লাগছে মায়রার৷ এবার যদি মেয়েটার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনটায় একটু ভালোবাসা নামের আলো ফুটে আর কি।
২৮!!
আজ সন্ধ্যায় মায়রার গায়ে হলুদ। গত দুটো সপ্তাহ বেশ ভালোই কেটেছে ওর। আয়ানের মা, বাবা, আর তিথির সাথে বিয়ের বেনারসি কিনতে গেছে, গয়নায় ডিজাইনটা দেখাতে উনারা মায়রাকে নিয়ে জুয়েলারি শপে গেছে। এছাড়া খুঁটিনাটি একেবারে তুচ্ছ জিনিসটা কিনতেও মায়রাকে সাথে করে নিয়ে গেছে ওরা। কখনো আয়ানের বাবা মা, কখনো তিথি তিয়াশ, আবার কখনো আয়ান-এসব করেই কেটেছে মায়রার গত চৌদ্দ পনেরোটা দিন। দেখতে দেখতে আজ গায়ে হলুদ আর মেহেদির অনুষ্ঠানটা চলে এসেছে। এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে ছিল এতোদিন। তবে আজ ভিষণ কান্না পাচ্ছে মায়রার৷ এতো কেয়ারিং একটা পরিবার, যেখানে প্রত্যেকটা মানুষ ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে, ছায়ার মতো পাশে থেকে আগলে রাখে-তাদের পেয়ে তো মায়রার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা।
ঠিক খুশি হওয়ার কথা না, মায়রা একটু আগ পর্যন্তও ভিষণ খুশি ছিল। এখন কানে মায়ের বলা কয়েকটা কথা বাজছে।
"হুট করে যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু হাতে পেয়ে গেলে বুঝে নিতে হয় জিনিসটায় সাংঘাতিক রকমের কোন ঘাপলা আছে। তোর মতো একটা মেয়েকে কোন দেনাপাওনা না করে একেবারে বিনা খরচে ঘরে তুলছে, এটা তোর মনে খুশির জোয়ার তুলতেই পারে--। তবে একটা কথা মাথায় রাখবি এখন যতটা মাথায় তুলছে তেমনি ততটাই জোরে মাটিতে আছড়ে ফেলতে তাদের দেরি নাও হতে পারে। সেদিন আবার পোড়া মুখ নিয়ে এ বাড়িতে এসে জুটিস না। বহু বছর তোকে পায়ের উপর পা তুলিয়ে গিলিয়েছি। আর পারবো না--। গেলে একেবারের জন্যই যা, যাতে তোর এই অলক্ষী মুখটা আর দেখতে না হয় কখনো।"
মায়ের কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বিছানায় মুখ চেপে ডুকরে কাঁদছে মায়রা। এতোটা নিষ্ঠুর কি করে হয় মানুষগুলো? আয়ানের বাবা মা তো কোন কিছুই দাবি করেন নি তাদের কাছে। বিয়েতে যা কিছু খরচ হবে ওইটুকুই। মায়রার বিয়েতে একটা সুতোও কিনতে হচ্ছে না তাদের। তবুও কেন! মেয়ে হওয়া এতোটাই বড় অপরাধ! আর দশটা মা মেয়ের মতো কেন নয় ওদের সম্পর্কটা? উপরওয়ালা কি মায়ের সাথে ওর বন্ধনটা আর দশটা মা মেয়ের মতো করে গড়তে পারতেন না? কি এমন ক্ষতি হতো তাতে!
কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে গেছে মায়রা। ঘুমটা ভাঙলো মোবাইলের রিংটোনে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখে কাঁদছিলো মায়রা। কখন ঘুমিয়ে গেছে টেরই পায় নি। এখন ঘাড়ে মাথায় ভিষণ যন্ত্রণা করছে। তবুও তাড়াহুড়ো করে উঠে মোবাইলটা খুঁজে নিয়ে কলটা রিসিভ করলো।
-হ্যালো? লাজুক পরী? কই আপনি? সারাদিন খবর নেই একদম?
-আম-। নাহ মানে--। ঘুমিয়ে গেছিলাম---।
-আহারে! ঘুমটা ভেঙে দিলাম নাকি পরীটার?
-নাহ---। সমস্যা নেই---।
-কাঁদছিলে কেন?
-হুম? কই? না তো---।
-একটা মাইর লাগাবো বুঝসো? গলা কেমন ভারি হয়েছে সেটা তুমি টের না পেলেও আমি কিন্তু ঠিকই টের পাচ্ছি---। কি হয়েছে বলো না?
-নাহ--। আসলে---।
-আহাগো! কাল বিয়ে বলে এখন থেকেই কান্নাকাটি করা শুরু করে দিলে? বিয়ে করতে চাচ্ছো না নাকি? তেমন হলে এখনই বলে দাও--।
-কেন!
-ওই যে বলেছিলাম না? তুলে নিয়ে আসবো-। তোমাকে ছাড়া তো আমার চলবেই না ম্যাডাম--।
আয়ানের কথায় মায়রা হেসে ফেললো। মানুষটা মাঝেমধ্যে কেমন সব উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে!
-শোনো? যত কান্নাকাটি করার আজকের মধ্যেই করে নাও---। কাল থেকে সে সুযোগ আর পাবা না।
-কেন!
-বারে--। বিয়ের পর কান্না করার সুযোগ পাবা কোথায়! আমার সামনে তো একটু কাঁদতে দিবো না। আর বাড়ির জন্য তো অসম্ভব--। ১০০ বার বায়না ধরলেও বাড়িতে আসতে দিবো না। নিজের বেড ছাড়া আর কোথাও একদম ঘুম হয় না আমার--।
-তো? অন্য কোথাও ঘুম হয়না আপনার তার সাথে আমার বাড়ি আসার বা না আসার সম্পর্ক কি?
-সেকি! জানো না? কাল শুধু বিয়েটা হতে দাও-। এর পর আমাকে ছাড়া এক পা ও কোথাও নড়তে দিব না। একেবারে বুকের ভিতরে লুকিয়ে ফেলবো--। কোথাও যাওয়া চলবে না আমাকে রেখে---।
-------------------------------
-এই শোনো পরী?
-হুম?
-সন্ধ্যা হয়ে আসছে--। উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও? তিথি আসছে-। তুমি হালকা কিছু খেয়ে নাও--। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে তো একটু পরে--।
-হুম----।
-আচ্ছা--। এখন রাখছি? কেমন?
-আচ্ছা---।
কল কাটতেই মায়রার উঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। এখন একটু শান্তি লাগছে হাতে মুখে পানি দিয়ে। বিয়েটা হওয়ার পরে কি হবে সেটা নিয়ে আর ভাবতে চাচ্ছে না মায়রা। আয়ানের পরিবার বিয়ের পরে হুট করে বদলে গেলে কিইবা আর হবে? এই বাড়িতে কাটানো প্রতিটা দিনের থেকে তো আর খারাপ হবে না। সর্বোচ্চ কি হবে? মারবে! সে তো অভ্যেস আছেই মায়রার। এতোদিন মা বাবার মার খেয়ে এসেছে, তখন নাহয় নিজের স্বামী বা শাশুড়ির হাতে মার খাবে। তফাতটা তো বেশি কিছু না। তবু এই প্রতিদিনকার অকথ্য খোঁটা থেকে তো মুক্তি পাবে।
মায়রা মনটা খারাপ করে এসব ভাবছিল। হঠাৎ কারো জড়িয়ে ধরায় চমকে উঠলো। কান্নার জলে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এসেছিল। তাই জড়িয়ে ধরা মানুষটাকে আধো ঝাপসা দেখলেও চিনতে পারলো মায়রা। এটা তিথি। এই মেয়েটাও ঠিক তার ভাইয়ের মতো পাগল! কখন কি করে, কি বলে একটুও হুঁশ থাকে না।
-ভাবিইইইই? এতো গভীর মনোযোগ দিয়ে কি ভাবো? আমি এলাম তুমি সেটা খেয়ালই করছো না। এটা কোন কথা?
-নাহ আপু--। আসলে ঘুম থেকে উঠলাম তো সবে----।
-ওহো! আসলেই বিয়ের সময় বেশি ঘুম পায় না গো ভাবি!
-হি হি---। হয়তো--। কেন গো তিথিমনি?
-আমারও ইদানিং খুবববববব ঘুম পায়----।
মায়রা কিছু বলার আগেই দরজার সামনে থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।
-তা আপনারও কি সামনে বিয়ে নাকি ম্যাডাম-? তা দাওয়াত পাচ্ছি তো?
-আপনাকে তো আমি!
তিথি তিয়াশের দিকে তেড়ে গেল। তিয়াশ বেচারাও আর দাঁড়িয়ে না থেকে পালালো তিথি আসার আগেই। তিথি কি মনে হতেই দাঁড়িয়ে পড়লো।
-এই ভাবি? প্যাকেটটায় তোমার জন্য শাড়ি আর লেহেঙ্গা পাঠিয়েছে ভাইয়া। এখন শাড়িটা পড়ে নাও। আমি বাপু শাড়ি টাড়ি পড়াতে পারি না---।
-আমি পড়ে নিচ্ছি--।
-তুমি শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নাও--। আমি একজনের খবর নিয়ে আসি--। হি হি।
মায়রা হেসে ফেললো তিথির কথাটা শুনে। মেয়েটার বাচ্চামি স্বভাব দেখতে বেশ লাগে। এতো কেন পাগল কে জানে! মায়রা হেসে তিথির দেখানো প্যাকেটটা খুললো। একটা প্যাকেটে আয়ানের সেদিনের দেয়া লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি, সাথে ফুলের গয়না। কাঠ বেলি, গোলাপ আর বেলি ফুলের গয়না। আর সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট।
"ফুলের সাজে নিশ্চয়ই ফুলকুমারি লাগবে আমার লাজুক পরীটাকে। আফসোস দেখা হবে না। তবে কেউ চাইলে হলুদের সাজে তাকে সবার আগে দেখার সুযোগটা করে দিতে পারে। আমি নাহয় তার ছবির অপেক্ষায় থাকবো!"
মায়রা হেসে রেডি হওয়ায় মন দিলো। যত্ন করে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পড়ে ফুলের সাজ করলো। তারপর চোখে কাজল টেনে কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ আর একটু হালকা লিপস্টিক দিয়ে সাজটা শেষ করে কয়েকটা সেল্ফি নিলো। ছবিগুলো বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারপর হোয়াটসএ্যাপে আয়ানের নাম্বারে পাঠালো। সাথে সাথেই সেটা সিনও হলো। মায়রা মানুষটার রিপ্লাইয়ের অপেক্ষায় বসে রইলো। বেশ কয়েকবার টাইপিং লেখা উঠছে। কি এতো লিখছে সেটাই বুঝতে পারছে না মায়রা। আয়নায় নিজেকে দেখে ভাবার চেষ্টা করছে মায়রা। কোন কিছু অপূর্ণ আছে কিনা! নাকি দেখতে খারাপ লাগছে! নাকি মানুষটার পছন্দমতো হয়নি!
এদিকে তিথি তিয়াশের খোঁজে এদিক সেদিক একটু উঁকিঝুঁকি মারছে। বাসায় বেশ মানুষ জন আছে। তবে তারা সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। কিন্তু তিয়াশের কোন খবর নেই। কোথায় যে গেল লোকটা! বেশ কিছুক্ষণ খুঁজেও যখন তিয়াশকে পেল না তখন তিথি মুখ কালো করে ফিরে আসতে পা বাড়ালো। কিন্তু একটা রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার আগেই কেউ হাত ধরে টান দিয়ে রুমটায় ঢুকিয়ে ফেললো তিথিকে। তিথিও বুঝতে পারলো কাজটা কার। তবু দুষ্টুমি করে একটু চিল্লানি দেওয়ার অভিনয় করলো। সাথে সাথেই তিয়াশ এক হাত দিয়ে তিথির মুখটা চেপে ধরলো।
-আরে! চেঁচাও কেন! আমি তো---?
-ওহ আপনি! আমি তো ভাবলাম কোথাকার কে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে---। বাবারে বাবা!
-আমি ছাড়া তোমাকে এভাবে কাছে টানার সাধ্য কারো আছে? তোমার নখটা ছুঁলেও তাকে আমি খুন করে ফেলবো না?--------।
তিথির মুখটা দেখে আর তিয়াশ কথাটা শেষ করতে পারলো না। তিথিকে দেখে স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন হুর পরী লাগছে! হলুদ রঙের একটা ফ্লোরটাচ গাউন পড়েছে মেয়েটা। সাথে ভারি সাজ। কুচকুচে কালো আইলাইনারের কারণে চোখজোড়া যেন আরো বেশি মায়াময় লাগছে তিথির। আর টকটকে লাল লিপস্টিকের রঙটা তিয়াশের চোখে ঘোর লাগাচ্ছে। সব মিলিয়ে তিথিকে দেখে তিয়াশ একেবারে থ হয়ে তাকিয়ে রইলো। এমন হুর পরী টাইপের তিথিকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসছে না তিয়াশের। আর তিয়াশের এমন চাহনিতে তিথি ব্লাশের গোলাপি আভার মধ্যেও আরো এক শেইড বেশি লাল হয়ে যাচ্ছে।