পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে। আকাশ যেন লাল আভায় সাজতে আজ বড্ড ব্যস্ত। জানালার কাচ গলে তীক্ষ্ণ সূর্যের আলোক রশ্মি তিতিরের ডান গালে পড়েছে। স্কীনের রংটা মনে হয় পাল্টে গিয়ে হলুদ বর্ন ধারন করেছে। তিতির ফুফিয়ে কাঁদছে। তার কাছ থেকে বাচ্চাটাকে কেন কেড়ে নেওয়া হল। তাকে তো সে আর মারেনি বা বাবুটাও কাঁদেনি ওর কোলে। তাহলে কেন এমন ব্যবহার!
লাবীবা বেগম রুমে প্রবেশ করতেই কাচের একটা টুকরো তার পায়ে সামান্য গেঁথে গেল। উনি আহ্ বলেই নিচে বসে পড়লেন। তিতিরের সেদিকে খেয়াল নেই। বরং সে ঝাজালো কন্ঠে বলে উঠলো-
~" মা, আমি বাহিরে যাবো।"
তিতিরের এমন ব্যবহারে লাবীবা খানিকটা রেগে গিয়ে ওকে ধমক দিয়ে বললেন-
~" রুমে এত জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো কেন?"
আপনিও বকছেন বলেই বিরবির করে কি যেন বলতে লাগলো তিতির। তারপর ঐ অবস্থায় কাচের উপর দিয়েই আধা দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। লাবীবা বেগম অনেকবার ডাকার পরও সে পিছন ফিরে তাকালো না। লাবীবা বেগম ক্ষেপে গিয়ে জোড়ে জোড়ে কুসুমকে ডাকতে লাগলো।
তিতির এক দৌড়ে নিচে এসে দরজার সামনে যেতেই মৌ তিতিরকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে উত্তজিত কন্ঠে বলল-
~" এই তোর পায়ে কি হয়েছে! আর এভাবে কই যাচ্ছিস!"
মৌকে জোড়ে একটা ধাক্কা দিয়েই তিতির রগচট কন্ঠে বলল-
~" একদম আমাকে ধরতে আসবে না। আমার মেয়ের কাছে যাব আমি।"
তিতিরের মুখ থেকে কথাটি বের হতেই বাহিরে থাকা গার্ড সাথে সাথে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। এই এই বলে দরজায় গিয়ে ধাক্কাতে লাগলো তিতির। দু'হাত দিয়ে দরজা থাবড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল-
~" দরজা খোল বলছি। আমি আমার মেয়ের কাছে যাব। তোমরা সবাই এমন করো কেন আমার সাথে! আমার কষ্ট হয়না বুঝি!"
তিতিরের হৃদয় বিদারক কন্ঠ শুনেও বাহির থেকে দরজা খুলে দেওয়া হলোনা। শেষে তিতির জোড়ে জোড়ে দরজায় লাথি দিয়ে চিৎকার করতে লাগলো। আমি যদি বাহিরে একবার বের হতে পারি তাহলে তোমাদের কিন্তু খবর করে ছাড়বো।
তিতিরের পাগলামি দেখে রুমকির স্বামী আর রেদওয়ান ড্রয়িংরুমে এলো। আবার সেই পাগলামি বলে রেদওয়ান মুচকি হেসে এমন দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো।
সম্রাট রেদওয়ানের দিকে চেয়ে তার মুখে হাসি দেখে ভ্রু কুচকালো কিন্তু মুখে কিছুই বললো না। মৌ বা কুসুম কেউ তিতিরকে আটকাতে পারছেনা। শেষে নান্নুর মা এসে ধরতেই সম্রাট আর চুপ করে থাকতে পারলো না। রুমকি বাবুকে ভাবীর কোল থেকে ওভাবে কেড়ে না নিয়ে যদি ভালো কিছু কথা বলে নিত, তাহলে এমন ব্যবহার ভাবী কখনো করতো না। সম্রাট এগিয়ে গিয়ে কেবল তিতিরের হাত ধরেছে অমনি তিতির হিতাহিত বোধটুকু ভুলে কষে একটা চড় মারলো সম্রাটের গালে। এমন কান্ডে, সবাই তিতিরকে ছেড়ে দিয়ে ভয়েই সরে দাড়ালো। এর মাথা পুরোটাই গেছে বলে মৌ বির বির করতে লাগলো
সম্রাট তো লজ্জায় সরে এসে চোখমুখ শক্ত করলো। বাসার জামাইয়ের গায়ে হাত তোলা! এতবড় অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। রেদওয়ান দাঁত কিড়মিড় করে শার্টের হাত ফোল্ড করতে করতে এগিয়ে আসতেই মৌ রেদওয়ানকে ধরে বলল-
~" দেখো, ওর মাথা ঠিক নেই। আমরা ওকে শান্ত করছি। ছেলে মানুষ ওর গায়ে হাত দেওয়াতে ও ক্ষেপে গেছে হয়তো। মাহাদ সকালেই বলে গেছে ওর গায়ে যেন কোন ছেলে মানুষ হাত না দেয়। আমারই সেই কথা বলতে মনে ছিলো না। এবারের মত ওকে ছেড়ে দাও।"
রেদওয়ান রেগে গিয়ে সবার সামনেই মৌকে ঠাশ্ ঠাশ্ করে দু'টো থাপ্পড় মেরে বলল-
~" বোনের তরফদারি করা হচ্ছে! ওর সাহস কি করে হয় সম্রাটের গায়ে হাত তোলা! পাগল হয়েছে! ওর পাগলামি ছোটাচ্ছি।"
মৌ গাল ধরে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। কিন্তু রেদওয়ানের ভয়ে একটা শব্দও করতে পারলোনা। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলা ছাড়া ওর কোন উপায় নেই।
কিন্তু রেদওয়ানের মনে অন্য প্লান চলছিল তখন। সেদিন রেদওয়ানকে তিতির চড় মেরেছিল এবং কাধে পা তুলে দিয়েছিল। তার উত্তর দেওয়ার একটা মক্ষম সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ কখনো সে হাত ছাড়া করবে না বা করতেও চায় না। তাই এগিয়ে যেতেই তিতির যা কান্ড করলো সেটা রেদওয়ান ভাবনাতেই আনতে পারেনি যে, সবার সামনে এমন ভাবে ওকে অপদস্ত হতে হবে। তিতির রেদওয়ানের হাটু বরাবর গায়ের শক্তি দিয়ে জোড়ে একটা লাথি দিল, রেদওয়ান কোন শব্দ ছাড়াই ওখানে বসে পড়লো।
সবার সামনে ছেলে হয়ে মেয়ে মানুষের হাতে মাইর খাওয়া যে কতবড় অসম্মানের ব্যাপার সেটা রেদওয়ানের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। রেদওয়ান বরাবর ঠান্ডা মাথার মানুষ কিন্তু আজ নিজের অপমান সে কিছুতেই সহ্য করতে পারলো না। ও উঠে দাড়াতে দাড়াতে তিতির দৌড়ে গিয়ে সোফার টি-টেবিল থেকে ফুলদানী টা হাতে নিয়ে রেদওয়ানের সামনে গিয়ে দাড়ালো। তারপর রাগী স্বরে বলল-
~" শুধু আমার দিকে পা বাড়িয়ে দেখ! এটা দিয়ে তোর মাথা ফাঠিয়েই তোকে হসপিটালে পাঠাবো। আয় এবার, দেখি তোর হাতে জোড় কত!"
রেদওয়ান কিছু বলতে যাবে এমন সময় রুপালী এসে রেদওয়ানের হাত ধরে বলল-
~" কি শুরু করেছিস! পাগলের সাথে তুইও পাগল হয়েছিস! চল এখান থেকে।"
মায়ের কথা শুনে রেদওয়ান আর কিছু বললো না। সেখান থেকে চলে যেতেই রুপালী বলল-
~" আজ কামরান আসুক তারপর কথাগুলো তুলবো। কখনো জামাইয়ের গায়ে হাত তোলে কখনওবা ছেলের গায়ে হাত তোলে। ও পাইছেটা কি! সব জায়গায় পাগলামো! ওর পাগলামি আমি মানি না।
এর যদি বিচার না হয় তাহলে আমি নিজেই পাগলের বিচার করবো।"
.
সাদ ওর হোম টিচারের কাছে পড়ছিলো। মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনেও মন অন্যদিকে রেখে চুপ করে পড়ছে। এমন সময় খোড়াতে খোড়াতে সাদের দাদী রুমে আসলো। তারপর সাদকে ডাকতেই সাদ উঠে দাদীর কাছে কিছু না শুনেই ছুটে গেল মায়ের কাছে। কখন থেকে ছেলেটা ছটপট করছে। তার মা ভিষন অসুস্থ তাই বাবা বলেছে মায়ের খেয়াল রাখতে।
সাদ এসে দেখলো, ওর রুমকি ফুফি তার মাকে বকছে। সাদ দৌড়ে গিয়ে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। মা আপনার পায়ে কি হয়েছে। পা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে তো!
এবার সবার চোখ পড়লো তিতিরের পায়ের দিকে। ওর পায়ের পাতা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। কিন্তু তিতির রাগে ফুসেই চলছে। তিতিরের চেহারা দেখে বাতাসি বিবি মুখে আঙ্গুল পুরে চুপ করে আছে। এই মাইয়া যে ভিতরে ভিতরে এত্ত ভয়ঙ্কর হেইডা আমরা জানতাম নাকি! মনের ভিতর রাগ দমন করে এত্তদিন সংসার করছে। এমন রুপ দেখলে তো মোর সোয়ামীই ভয় পাইতো। আল্লাহ্ গো অ্যারে কার পাল্লায় ফেলাইলা। আই দেকচি বুইড়া বয়সে লাতীর বউয়ের হাতে পিটুন খামু। অ্যারে বাপের বাড়ী দিয়া আয় কামু। আই এহানে থাকুম না। অ্যার জিবনের মায়া আছে বহুত। তগো নাই তোরা পাগলরে লইয়া বসবাস কর। অ্যার শহীদ হওয়ার কোন সখ নাই। হেই মাইয়া তো দিন দিন অ্যারে ফাপড় দিয়াই চলছে।
বাতাসির কথার মধ্যই লাবীবা বেগম নিচে এসে তিতিরের হাত ধরে বলল-
~" রুমে চলো। নিজে তো মরবা সাথে আমার ছেলের জিবনটাও শেষ করে ছাড়বা। সাদ তোমার মাকে নিয়ে রুমে যাও।"
সাদ ওর মায়ের হাত থেকে ফুলদানী নিয়ে রেখে এসে মাকে নিয়ে ওদের রুমে চলে গেল। কুসুমকে মেডিসিন বক্স নিয়ে উপরে তিতিরের কাছে যেতে বলে লাবীবাও চলে গেল তার রুমে। তিতিরের কাছে যাওয়া শুনে কুসুম ভয়ে বলল-
~" আমি ওনার কাছে যাবোনা। যা ওনার শক্তি আর মাথা খারাপ! এক চড়ে আমায় বান্দরবন পাঠাইবে। আমি আর যাই তার কাছে!"
কেউ যখন তার কাছে যেতে রাজি না তখন মৌ তিতিরের রুমে চলে গেল। এসে দেখে সাদ ফ্লোর থেকে কাচের টুকরো পরিষ্কার করছে। এই বাবা তুমি করছো কেন এসব! হাত কেটে যাবে তো! সরো আমি করছি বলে ও সব পরিষ্কার করে তিতিরের পায়ে মেডিসিন দিয়ে গজ দিয়ে বান্ডেজ করে বলল-
~" সাদ তোমার টিচার অপেক্ষা করছে। যাও তুমি গিয়ে পড়ো। আমি দেখছি তোমার মাকে।"
সাদ কথা না বাড়িয়ে চলে যেতেই মৌ দেখলো দরজায় গোলাব দাড়িয়ে আছে। কিন্তু ভিতরে সে ঢুকছেনা। এদিকে মাগরিবের আযান পড়তেই মৌ চলে গেল। এইটার অপেক্ষায় যেন তিতির করছিলো। রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সোজা ব্যালকোনিতে গিয়ে নিচের অবস্থান দেখে একটা শাড়ী এনে রেলিং এ বেধে তা দিয়ে নিচে নেমে গেল। এখন তাকে আর কেউ আটকাতে পারবেনা।
পায়ে কেটে যাওয়ার জন্য জোড়ে হাটতে পারছেনা তবুও প্রান পনে মেয়ের কবরের পাশে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। কবরটা পুরো বেধে দেওয়া হয়েছে তিতিরের জন্য। সেদিন মাটি খোড়ার কারনে মাহাদ মিস্ত্রী এনে কবর বেঁধে নিয়েছে।
কবরের দু'ধারে পোতা খেঁজুরের ডাল শুকিয়ে গেছে। কবরে একটু আধটু ঘাস জন্মেছে। তিতির কবরে হাত বুলিয়ে দিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠলো। মা তুমি কোথায় গেলে! আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছিনা। আমি তোমাকে ভুলতে পারছিনা। তোমার বাবাও আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। আমি তোমাকে কেমন করে তার কোলে এনে দিব বল! তোমার বাবা বলছিল, তুমি নাকি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর খেলার সাথী হয়ে গেছ। তিনি কি আমার মত তোমাকে আদর করে, ভালোবাসে? আমিতো কিছুই দেখতে পাইনা। আমার বুকে খুব কষ্ট হয়। মনে হয় সব সময় তোমার পাশে সুয়ে থাকি। তিতির কাদছে আর ওর মেয়ের কাছে সবার বিরুদ্ধে নালিশ করছে।
চারদিকে নিস্তব্ধ আধার নেমেছে। দু-একটা জোনাকি পোকা গাছের ডালের ফাকে ফাকে উকি দিচ্ছে। বকুল ফুলের গন্ধে চারপাশটা মো মো করছে। তিতিরের গায়ে মশার দল এসে বসে রক্ত শুষে নিচ্ছে তবুও যেন ওর হুশ নেই। কবরের গায়ে হেলান দিয়ে চুপ হয়ে রইলো।
♥
মাহাদের গাড়ী বাসায় ঢুকতেই ওর চোখ গেল মেয়ের কবরের দিকে। যখনই বাসায় ঢোকে তখনই মেয়েটার কবরের দিকে ওর চোখ পড়ে । কিন্তু অন্ধকারের মধ্য মনে হলো কবরের পাশে কেউ বসে আছে। মাহাদ গাড়ীতে বসেই ভালো করে আবার দেখার ট্রাই করলো, সত্যেই কি সেখানে কেউ আছে, না মনের ভূল! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গাড়ী থেকে নেমে ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে সে দিকে অগ্রসর হতেই ও স্পষ্ট দেখতে পেল, তিতির কবরের পাশে সুয়ে আছে। তিতির বলেই মাহাদ দৌড়ে গেল ওর কাছে। এই তুমি এখানে কেন বলে চিৎকার দিতেই তিতির ধড়পড় করে উঠে বসলো। মাহাদের দিকে চেয়ে ও বড্ড ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু মাহাদ জোড়ে ধমক দেওয়াতে ওর জেদ চেপে গেল। ও ওভাবেই বসে রইলো সেখানে।
তিতিরের এমন জেদ দেখে মাহাদ তিতিরের হাত ধরতেই তিতির হাত ঝটকিয়ে ফেলে দিলো। মাহাদ তিতিরের কাছে বসে পড়লো। তারপর ধীরস্থির হয়ে বলল-
~" তিতির আমার শরীর খুব খারাপ। এখন তুমিও যদি আমার সাথে এমন করো তাহলে কিন্তু আমিও অতিথীর মত একেবারে চলে যাব। ব্যাপারটা কি খুব ভালো হবে!"
আর তিতিরকে কিছু বলতে হয়নি। মাহাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠলো। তিতিরের আর্তনাদ দেখে মাহাদও চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা। কান্না কন্ঠেই বলে উঠলো-
~" তুমি যদি এমন করো তাহলে আমার আর সাদের কি হবে! আমাদের কে সামলাবে?"
মাহাদ তিতিরকে দাড় করিয়ে ওকে নিয়ে চলতেই তিতির আহ্ করে উঠলো। মাহাদ সাথে সাথে থেমে বলল-
~" কি হয়েছে! কোথায়ও লাগছে?"
~" আমার পা কেটে গেছে....!"
পা কিভাবে কাটলো বলে মাহাদ তিতিরের হাতে অফিসের ব্যাগ দিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বাসায় চলে আসলো। নিচে তেমন কেউ ছিলোনা। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। শুধু নান্নুর মা দেখে কাছে এসে বলল-
~" মাহাদ, ও তো ঘরে ছিল। ওরে কই পাইলা?"
মাহাদ ওনার কথার জবাব না দিয়ে শুধু বলল-
~" আন্টি একটু গরম পানি নিয়ে আসেনতো!"
মাহাদ ওর রুমের সামনে এসে দরজা বন্ধ দেখে তিতিরের দিকে চেয়ে বলল-
~" এই অবস্থায় তুমি ব্যালকোনি টপকাইছো!"
তিতির ভয়ে কোন কথা না বলে মাহাদের বুকে মুখ লুকালো। মাহাদও আর কিছু না বলে দরজা খুলে ওকে নিয়ে রুমের ভিতর আসলো। ওকে কোল থেকে নামিয়ে না দিয়ে ওয়াসরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাড় করিয়ে বলল-
~" আমি আসতে আসতে যেন তোমার গোসল শেষ হয়।"
মাহাদ তিতিরের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে বেডে রাখতেই কুসুম গরম পানি নিয়ে এল। ভাইজান খুব খারাপ একটা খবর আছে। ভাবী, দুলাভাই আর রেজওয়ান ভাইয়ের গায়ে আজ হাত তুলেছে। সেই থাপ্পড় মারছে দুইজনরে। তাছাড়া নিসা ভাবী আর দাদীর সাথেও তুলকালাম বাধাইছে। বড় সাহেব আসলে রুপালী ফুপি নাকি বিচার দিব। নানা খারাপ ভাষায় ভাবীকে গালাগালি করছে। আরও বড় কথা হলো, নিসা ভাবী সবাইকে বলছে ভাবী নাকি আম্মার গায়ে হাত তুলছে। ডাহা মিথ্যা কথা রটাইছে।
মাহাদ শান্ত গলায় বলল-
~" আচ্ছা তুই যা....।"
কুসুম আরো কিছু কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু মাহাদের কাছে সুবিধা না পেয়ে চলে গেল। মাহাদও রুম থেকে বের হয়ে সাদের রুমে গিয়ে দেখে নামায শেষে হযুরের কাছে আরবি পড়া শিখছে সাদ। গোলাবকে কোথায়ও দেখতে পেলোনা। ওখান থেকে বের হয়ে এসে গোলাব বলে কয়েকবার ডাকতেই গোলাব কোথায় থেকে যেন বের হয়ে এসে মাহাদের সামনে দাড়িয়ে লেজ নাড়াতে লাগলো। মাহাদ রুমে আসতেই গোলাবও পিছু পিছু রুমের ভিতর ঢুকলো। তিতিরের কাছে আসতে নিষেধ করেছে মাহাদ তাই রুমের এক কোনায় দাড়িয়ে রইলো সে।
এদিকে তিতির গোসল সেরে একদম ফিটফাট হয়ে লক্ষী মেয়ের মত চুপ মেরে বেডে বসে আছে। মাহাদ টাওয়াল হাতে নিয়ে তিতিরের পাশে বসলো। তারপর ওর পায়ে হাত দিতেই তিতির আহ্ বলে ঝিকে উঠলো। মাহাদ সাথে সাথে হাত সরিয়ে আদুরে গলায় বলল-
~" কোথায় ব্যাথা লাগছে সোনা!"
এখানে বলে মাহাদের দিকে পা টা এগিয়ে দিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো তিতির। মাহাদ অতি যত্নে পা বান্ডেজ করে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল-
~" তুমি মাগরিবের সালাত আদায় করেছ?"
তিতির খানিকটা লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়িয়ে শুধু না বলল। মাহাদ এবার ওর কাছ থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে উচ্চস্বরে বলল-
~" কাযা নামাযটা পড়ে নাও।"
~" আমার পায়ে লাগছে তো!"
~" চেয়ারে বসে পড়ো।"
~" আচ্ছা।"
মাহাদ ওয়াসরুমে গেছে বলে গোলাবও রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল।
♥
রাত ১০টা বাজে,
কামরান সাহেব আধাঘন্টা আগে বাসায় এসেছেন। একটু রেস্ট নিতে না নিতেই রুপালী, রুমকি আর নিসা এসে কামরান সাহেবকে কথার জালে জড়িয়ে ফেললো। আজ তিতির যা করেছে সেটা অত্যান্ত নিকৃষ্ট কাজ করেছে। আজ এর বিহিত না করলে রুপালী নিজেই ওর বিচার করবে।
রাতের খাবারের আগেই বিচার বসলো। আসামী একমাত্র তিতির। শাশুড়ী সহ এই বাসার জামাইয়ের গায়ে হাত তোলার মত সাহস দেখিয়েছে। সবাই সোফায় বসে আছে আর মাহাদ তিতিরকে নিয়ে সবার সামনে দাড়িয়ে আছে।
তিতির মাহাদের টিশার্টের এককোনা ধরে ওর গা ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে।
সবার দৃষ্টি তিতিরের দিকে। তিতিরকে দেখেই কামরান সাহেব মুচকি হেসে বললেন-
~" কেমন আছো মা! আর পা কাটলো কিভাবে? দুষ্টমি করেছ বুঝি!"
শশুড়ের মিষ্টি কথা শুনে তিতির মাথা নিচু করে শুধু হাসলো কিন্তু কিছু বললোনা।
কেমন বিয়াদপ মেয়ে, গুরুজন কিছু বলছে কিন্তু তার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধটুকু মনে করেনা।
নিসার কথা শুনে ফুয়াদ চোখ বড় বড় করতেই নিসা চুপ হয়ে গেল। কিন্তু রুমকি চুপ করে থাকলোনা। মামা আজ আপনার বিচার করতেই হবে। সম্রাটের গায়ে হাত দেয় কোন সাহসে! আমার স্বামীর সম্মান নেই? যেখানে সেখানে পাগলামি! কথাগুলো বলতে বলতে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলল রুমকি।
রুমকির কান্না দেখে রুপালী দাঁত কটমট করে বলল-
~" রেদওয়ানের বুকে লাথি মারে, সম্রাটের গালে চড়, লাবীবার গায়ে হাত তোলা, ফিহাকে মেরে ফেলার হুমকি, এসব কি! একে নিয়ে আমাদের থাকা তো দায় হয়ে পড়ছে। আম্মার মত মানুষ পর্যন্ত ভয়ে রুম থেকে বের হচ্ছেনা।"
~" আম্মা ভাবীতো মানুষিক রোগী তাই আমার এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। তাছাড়া রুমকি যদি আমাদের মেয়েকে নিয়ে ভাবীর সাথে ওমন ব্যবহার না করতো তাহলে এতদূর জল কখনোই গড়াতো না। বাদ দেননা সব। তার থেকে কোথায় চিকিৎসা করলে ভাবী আগের মত হবে সেটাই আমাদের ভাবা উচিত। তাছাড়া তার অতীত রের্কড খুবই ভালো। কারো সাথে কটু কথা অবদি বলেনি। তাই একটু আমাদের মেনে চলা উচিত তাকে।"
সম্রাটের এমন কথা শুনে রুপালী বলল-
~" বাবা তুমি ওর সমন্ধে এত কিছু জানো না। ওর অতীত রেকর্ড অনেক আছে। তাছাড়া বড় ভাসুরের গায়ে কে হাত তোলে! আর শাশুড়ী, সেটা বাদ দিচ্ছো কেন? লাবীবা কি ওর কম দেখাশুনা করে নাকি! তবুও সে ছাড় পেলোনা!"
সম্রাট আর কোন কথা বললো না। কিন্তু কামরান সাহেব গলা ঝেড়ে বলল-
~" তিতির, সবাই যা বলছে তা কি সঠিক?"
তিতির ততক্ষনে মাহাদের টিশার্টের নিচের দিক খামচে ধরে মোচড়াচ্ছিলো। মাহাদের পেট দেখা যেতেই রুমকি এক দৃষ্টিতে মাহাদের ঐ অংশে চেয়ে রইলো। মাহাদ সাথে সাথে তিতিরের হাত শক্ত করে ধরে বলল-
~" বাবা কি বলছে! জবাব দাও?"
তিতির তবুও কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে রইলো। কামরান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-
~" মেয়েটা অসুস্থ। তার উপর দিয়ে কত বড় ঝড় গেছে। তোমরা সেটা না দেখে ওর বিরুদ্ধে রির্পোট দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছ। এমন ঘটনা যদি তোমাদের সাথে ঘটতো তখন তোমরা কি করতে! দেখ, আমি এ নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। তোমাদের তাকে নিয়ে সমস্যা হলে ওকে এড়িয়ে চলো। আর ও কখনোই আগ বাড়িয়ে তোমাদের সাথে লাগতে আসবেনা, সেটা আমি খুব ভালো করে জানি।"
~" এটা কোন বিচার হলো! ওর এতই যখন সমস্যা তাহলে তাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেন না! এখানে রেখে শুধু শুধু আমাদের শান্তি নষ্ট করছেন কেন? যে মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারে সে সব কিছু করতে পারে। ও বাসায় থাকলে আমি থাকবো না। আজ আমার মেয়েকে মারার হুমকি দিছে। কাল যদি মেরে ফেলে তাহলে কি আপনার এই কথা বলার মুখ থাকবে?"
অনেকের অনেক অভিযোগ শুনে মাহাদ বলল-
~" তিতির তুমি কি মায়ের গায়ে সত্যিই হাত তুলেছ?"
তিতির তবুও কিছু বললো না। মাহাদের হাত আকড়ে ধরে রইলো। কোন জবাব না পেয়ে ওর মাকে বলল-
~" মা সত্যিই কি তিতির তোমার গায়ে হাত তুলেছে?"
লাবীবা বেগম মাথা নিচু করলো। তার মানে সেটা সম্মতির লক্ষন। লাবীবা বেগম মিথ্যা কথা বলল কারন সে আর চায়না তিতির মাহাদের জিবনে থাকুক। ও থাকলে মাহাদের জিবন শেষ করে ছাড়বে। কোন রকম ভাবে সবাই মিলে মাহাদকে চাপাচাপি করলে মাহাদ তিতিরকে পাগলা গারদে রেখে আসতে বাধ্য হবে। আর সাদ, তাকে আমি নিজেই মানুষ করতে পারবো। আপদ বিদায় হলে বাঁচি।
মায়ের সম্মতি দেখে সবার সামনে মাহাদ তিতিরকে কষে একটা থাপ্পড় দিয়ে জোড় করে টানতে টানতে রুমের ভিতর নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। কামরান সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠলো। ছেলে যা রাগী। না জানি মেয়েটাকে আজ কি করে। এত অভিযোগ শুনে কারো মাথায় ঠিক থাকার কথা নয়। আর মাহাদ তো একটা ক্ষত-বিক্ষত মানুষ। এত অভিযোগের মধ্য ও কি নিজেকে শান্ত রাখতে পারবে!