আমার একটাই যে তুই - পর্ব ০১ - সিজন ২ - সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি - ধারাবাহিক গল্প


কিছুক্ষণ আগেই ইউসুফ ভাইয়ার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছে। অনেকটা সিনেমেটিক টাইপ বলতে পারেন।  বউ সাজে আমাকে সং সাজিয়ে বসিয়ে রেখে গেছে আমার ভাই-বোনরা । এখন আমি বসে আছি তার  রুমটিতে।বিশাল ব্যয়বহুল এই রুমটিতে কখনো আসতে দেননি উনি আমাকে। আজ এলাম তাও তার বউ হয়ে। চারিদিকে নিভু টিমটিম আলো। কাঁচা ফুল গুলোর সুভাসে মৌ মৌ করছে পুরো ঘর জুড়ে।ঘরটি কতই না রোমান্টিক করে তুলেছে। অথচ আমার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নেই এসবে কোনো হেলদুল। আমি খাটের এক কোনে "দ" ভঙ্গিমায় বসে ফুপাচ্ছি। আজ দিনটি অন্য রকম হতো! হতে পাড়তো সুন্দর সুশ্রী দিন। আমি আজ থাকতাম আশিকের বাহু ডোরে।  হাতে হাত রেখে পালিয়ে যেতাম দূর বহু দূর।কিন্তু সব পাল্টে গেলো। ঠোঁটের হাসি কেঁড়ে নিয়ে বিষাদের ঘুর্ণিপাকে ফেলে দিলো ইউসুফ ভাই। কেন করলেন উনি? উনি কি জানেন না? নাকি বুঝতে চান না? আমি তাকে ভালবাসি না।উহু হুম একদম-ই না। আমার সবটা জুড়ে যে আশিকের বসবাস।ভেবেই বুক ফেঁটে কান্না আসতে লাগলো। ভেসে উঠলো কিছু ঘন্টা আগের ঘটনা গুলো চোখের পাতায়....!

আজ সকালেই জানতে পারি ইউসুফ ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পা থেকে মাটি সরে গেছে যেন। আমি দৌড়ে উপরে এলাম।  আশিককে কল করে বললাম,,,

---" আশিক আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও! আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"

আমার কন্ঠ কাঁপচ্ছে। চোখের জল টপ টপ করে বলি হচ্ছে। কঠিন শীতের মাঝেও ভ্যাপসা গরম লাগচ্ছে। ওপাশের মানুষটির উত্তরের কি হবে জানার জন্য চাতক পাখির মতো অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। আজ ছয় মাস চলছে আমাদের সম্পর্কের। দেখা হয়েছিলো ফাগুনের সেই দিনটিতে। ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান চলছিলো তখন। চারিপাশে মানুষে গিজ গিজ করছিলো।দূর থেকে মাইকের আওয়াজ আসচ্ছিলো। হুট করে আশিক সেদিন সকলের সামনে প্রাপোজ করে বসে। মনে মনে তখন আমিও চাইতে লাগি। সেদিন ফিরিয়ে দি নাই তাকে। হাত হাত রেখে পথ চলার স্বপ্ন আঁকি বুকে। ওপাশ থেকে আশিক উতলা কন্ঠে বলে উঠলো,,

---" কি বলছো এসব? হুট করে কিভাবে কি হলো? তুমি তোমার পছন্দের কথা জানাও নি!"

আমি চোখের জল টুকু মুছে নিলাম। ঠোঁট ভিজিয়ে কন্ঠ স্বাভাবিক রাখতে চাইলাম।  বললাম,,

---" মা সব জানে! বলেছিলো বাবাকে বলবে। কাল-ই কথা হলো মার সাথে। আর আজকেই..!"

আর স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না নিজেকে। হাউ-মাউ করে কেঁদে দিলাম। আশিক আমাকে থামাতে চাইলো,,

---" কান্না করো না।  আমি কিছু প্লেন করে তোমাকে টেক্সট করছি। চিন্তা করো না আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।"

আশিকের কথায় কিছুটা শান্ত হলাম। ধাতস্থ করে নিলাম আর যাই হোক এ বিয়ে কখনো করবো না আমি। মরে গেলেও না। 

মিনিট দশেক পর আশিকের টেক্সট আসে। আশিক নামটি দেখেই মুখে হাসি ফুঁটে উঠে আমার। সময় নষ্ট না করে মেসেজ ওপশেন ওন করতেই  খুশিতে চক চক করে উঠলো আমার চোখ জোড়া। ১০ মিনিটের মাথা সব গুছিয়ে বের হয়ে যাই লুকিয়ে বাসা থেকে।বাস স্টেশনে যথা সময় অপেক্ষা করতে থাকি আশিকের। নিজেকে এক মুক্ত পাখি মনে হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল আর কিছুটা সময় তারপর আমি স্বাধীন। ঘন্টা খানেক পার হতেও যখন আশিক এলো না, মাথায় দুটি ভাজ পড়লো চিন্তার। কেন আসচ্ছে না সে...! বিপদ হলো না তো তার? ফোন বের করে লাগাতার কল করতে থাকি আমি,  কিন্তু ওপাশ থেকে বলে যাচ্ছে " নাম্বারটি বন্ধ আছে"। হু হু করে উঠলো বুক। সূর্য তার সময় মত লুকিয়ে গেছে। রেখে গেছে অন্ধকারময় এক রাতের সুচনা।  কি করবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। বাসায় ফিরবো? নাকি চলে যাবো অন্য কোথাও? মাথায় আসচ্ছিলো না। শুধু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,,

---" কেন আসচ্ছো না তুমি আশিক?  ধোকা দিলে আমায়? মিথ্যে হয়ে গেলো আমাদের ভালবাসা? "

কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর  মিলাতে পারলাম না আমি। কি করবো কোথায় যাবো? দিশেহারা হয়ে গেলাম। পর পর চারটি বাস চলে গেছে। আশেপাশের উৎসুক জনতা দেখে নিজেদের মাঝে কথা বলে যাচ্ছে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জানতে চাইছে,," কি হয়েছে! কান্না করছো কেন? তোমার সাথে কেউ নেই? "

মুখ ফুঁটে কিছু বলতে পারছি না আমি। মাটিতে বসে সকলের দিক তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে চলছি।  ধীরে ধীরে সবাই চলে গেলো। খালি বাস স্টেশনে বসে রইলাম।  চোখ দুটি শূন্য আমার। নিষ্প্রাণ - নিশ্চল দেহ খানা টেনে উঠাতে পড়লাম না। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে এ মুহূর্তে।  
 তখনি কোথা থেকে ইউসুফ ভাই এসে হাজির হয়। 
ইউসুফ ভাই আমার মাথায় বন্দুক তাক করলেন। চোখ-মুখে তার উত্তপ্ত আগুনের ফুলকি ভেসে উঠেছে। হিংস্রের মতো তিনি টেনে হিচরে নিয়ে এলেন বাসায়। সকলের সামনে বললেন,,

---" এই মুহূর্তে কবুল বলবি। এক মিনিট সময় তোর হাতে। নয়তো এ বন্দুকের গুলিতে তুই আগে মরবি তার পর মরবে তোর সেই নাগর!"

আমি কাঁদতে লাগলাম। আকুতি-মিনতি করে বললাম,,

---" এমন কেন করছেন ভাইয়া? কি ক্ষতি করেছি আমি? কেন এত বড় শাস্তি  দিচ্ছেন?"

উনি আমার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। সে হাসিতেও হিংস্রতা পুটে উঠেছে। ভয় কাঁপছি আমি থর থর করে। উনি বললেন,,

---" সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তুই করেছিস আমার! সারা জীবন গোলাপ গাছ চাষ করলাম। গোলাপ ফোটার অপেক্ষা বছরের পর বছর করলাম। সেই ফুল ফুটতেই অন্য কেউ নিয়ে বলবে ফুল তার? তা তো হচ্ছে না? কখনো না? আমি তা হতেও দেব না।"

আমি কাঁদতেই লাগলাম। তার কথা বোধগম্য  হলো না এ মুহূর্তে। আর বুঝতে চাইছি আমি শুধু পালাতে চাই।পালাত চাই বহু দূর। ইউসুফ  ভাইয়ের নাগালের বাহিরে...!

খট খট শব্দ করে দরজা খুলে গেলো। ভাবনার জগত সেখানেই কেঁটে গেলো। সামনে এসে দাঁড়ালেন ইউসুফ ভাই। তার ঠোঁটে বিজয়ের বাঁকা হাসি। গা জ্বলে যাচ্ছিলো আমার। আমি  ঠাই বসে রইলাম। উনি ভ্রু কুঁচকালেন।  ঠোঁটের হাসি আরেকটু টেনে বললেন,,

---" বাসর রাতে স্বামীকে সালাম করতে হয় জানিস না? উঠে আয়! "

আমি তার কথায় আরো রাগতে লাগলাম।  এমানুষটিকে আমি যেখানে ভালবাসি না! যার জন্য আমার মনের কোণে সম্মানের ছিঠা ফোঁটাও নেই। তাকে করবো সালাম? নো নেভার!

ইউসুফ ভাই এবার রাগী কন্ঠে বললেন,,

---" কি বলছি? কথা কানে যাচ্ছে না?"

আমি তাকাল তার দিক। উনার মুখ খানা গম্ভীর।কিছু মুহূর্ত আগের হাসি মিলিয়ে গেছে।  আমি উঠে এসে দাঁড়ালাম তার দিক। চোখে চোখ রেখে আমার ভেজা কন্ঠে বললাম,,

---" এমনটি না করলে হতো না ইউসুফ ভাই? কেন করলেন? বলুন না..! আপনি জানতে না? আমি আশিকে ভালবাসি! তাহলে? এত বড় শাস্তি কেন দিলেন আমাকে?"

আমার কথায় ইউসুফ ভাইয়ার কোন পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। উনি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন আমার দিক। আমি কিছুটা দূরে পিছিয়ে এলাম। আবার বলা শুরু করলাম,,

---" জানি কোনো উত্তর দিবেন না আপনি। আমার চাইও না আপনার উত্তর।  আমি শুধু আশিকে ভালবাসি, তাকেই ভাসবো।  আপনি চাইলেও তার নাম মুছতে পারবেন না কখনো না বুঝলেন??"

ইউসুফ ভাইয়ার চেহারা এবার পরিবর্তন হতে লাগলো। শুভ্র মুখ খানা মুহূর্তে লাল হয়ে গেলো। চিকন লাল পাতলা ঠোঁট জোড়া কাঁপতে লাগলো। তার বিলাই চোখ জোড়া রক্তিম ধারণ করলো। তার সেই তিরিক্ষি নজরে ভস্ম করে দিতে চাইলো যেন এই মুহূর্তে।  আমি ভয়ে পিছিয়ে যেতে নিও গেলাম না। উল্টো তার কাছে এসে। তার প্যকেট থেকে বন্দুকটি হাত নিয়ে বললাম,,

---" এটি দেখিয়ে সবাইকে দমাতে পাড়লেও আমাকে পারবেন না। আমি আজ হোক কাল হোক পালিয়ে যাবে এখান থেকে।  আমার আশিকের কাছে।  সুখের সংসার করবো আমরা। আর আমাদের ফুটফুটে  বাচ্চা.."

বলতে পাড়লাম না আর।  ইউসুফ ভাই এবার আমার গায়ে হাত তুলেই ফেললেন। তার পুরুষালী শক্তপোক্ত হাতে থাপড় খেয়ে মাথা  ভো ভো করতে লাগলো যেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি আমার চুলের মুঠি ধরে কাছে টেনে নিলেন। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। তার থেকে ছুটার আসায় কাতরাতে লাগলাম কিন্তু আমি ব্যর্থ।  উনি আমার দিকে এবার ঝুকলেন।রাগে ক্ষোভে তার ঠোঁট জোড়া কাপচ্ছে। উনি হিসহিস করে বললেন,,

---" তুই মানিস আর নাই মানিস তুই আমার বউ। আমার বাবুইপাখি। যতদিন এ দেহে প্রান আছে। ততদিন তোর আমার হাত থেকে মুক্তি  নেই। সো দোয়া কর মরে যাই তাড়াতাড়ি।  নয়তো তোর ইচ্ছে এ জীবনে ইচ্ছেই থাকবে। দুনিয়ার যে প্রান্তেই চলে যাস না কেন।  ঘুরে ফিরে এ ইউসুফকেই পাবি কথা দিলাম!"

আমি ইউসুফ ভাইয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। এই কি ছিল আমার ভাগ্য? যার থেকে দূরে বহু দূর থেকেছি সেই হয়ে উঠলো আমার অর্ধাঙ্গ? আগে কি হবে আমার.......! 

—————

ইউসুফ কঁপাল কুঁচকে দু আঙ্গুলে চেঁপে ধরে বসে আছে। কঁপালের রগ দপ দপ করে ব্যথা করছে। তার চোখ নিবদ্ধ কুহুর পিঠের দিক।তার লাল টুকটুকে বউ কি সুন্দর শান্তিতে ঘুমাচ্ছে । আজ নাকি তাদের বাসর রাত!তার ছোট বউ, তার বাবুইপাখি তার কাছে,  কত কাছে। তবুও তাকে ছুঁতে পারছে না, আদর করতে পারছে না, বুকে জড়িয়ে ঘুমতে পারছে না, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ভালবাসার পরশ দিতে পাড়ছে না, না পাড়ছে কাঁজল কালো চোখ দুটির লেপ্টে যাওয়া কাঁজল আর বিন্দু পানি টুকু মুছে দিতে।  ইউসুফ ছোট শ্বাস ছাড়লো। বিড়বিড় করে আওড়ালো,,

---" আমাকে কবে বুঝবি তুই বাবুইপাখি! "

"ঠক ঠক ঠক"

মধ্যরাতে ইউসুফের দরজায় নক হতেই বেড়িয়ে আসে সে। সামনে কাঁচুমাচু ভাবে দাঁড়িয়ে আছে কবির। তার ভয়ার্থ মুখটা দেখে ইউসুফের হাসি পেলো।বলল,,

---" কি ব্যাপার কবির বাবু?"

 ইউসুফে ঠাট্টা করাতেও ভয় পেলো কবির।কবির নতজানু হয়ে বলল,,

---" স্যার সব রেডি!"

ইউসুফ তার বিখ্যাত হাসি বিস্তার করে বলল,,

---"চলো!"

কবিরও পিছন পিছন যেতে লাগলো। ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে সে। অথচ আজ পর্যন্ত ইউসুফ হাসি মুখ ছাড়া কথা বলেনি তার সাথে। তার মতো সফল নেতাকে ময়মনসিংহের প্রতিটি মানুষ সম্মান করে। কিন্তু কবির? সে ভয় পায়।  এ মানুষটিকে বাঘের মতো ভয় পায়। 

ইউসুফের সামনে রক্তাক্ত অবস্থা লুটিয়ে আছে আনিস। মুখ, নাক ফেঁটে রক্ত বয়ে যাচ্ছে এখনো। ইউসুফ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। মুখে সেই বিখ্যাত হাসি। ইউসুফ বলল,,

---" তো আনিস সাহেব? দু নৌকায় পা দেয়ার আগে আমার মুখটি একবার-ও চোখে পড়েনি?এতেই কি খারাপ দেখতে আমি? কি কবির?  বলো তো? আমার চেহারা কি মনে পড়ার মতো না?"

কবির এখন-ও নতজানু।  থেকে থেকে শুকনো ঢুক গিলছে। ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে কাঠ। ইউসুফে হাসিতে সে সহ উপস্থিত সকলেরই রক্ত হীমশীতল হয়ে যাচ্ছে। কবির জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,,

---"হে স্যার । আপনার চেহারা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না।"

ইউসুফ হাসলো।  ঘর কঁপানো হাসি।সেই হাসির শব্দে আনিসের ভয়ে গলা শুকিয়ে আসচ্ছে। এতই মার খেয়েছে যে বেচার উঠে বসতেও অক্ষম । তবুও খুব কষ্টে হাত দুটি এক করে বলল,,

---"স্যার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দিন!"

---" আমার ডিকশিনারিতে ক্ষমা বলতে কিছু নেই।" ভাবলেশহীন ভাবে বলল ইউসুফ।

আনিস কাঁদতে লাগলো। হাউ-মাউ করে। ব্যথাতুর শরীরটা টেনে টেনে ইউসুফে পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বলল,,

---" প্লীজ স্যার আমায় ছেড়ে দিন। আমার ছোট ছোট বাচ্চা আছে। ওদের উপর তো দয়া করুন?"

লোকটি কাঁদছে। কিন্তু ইউসুফের বুকে এক ফুটো মায়া হলো না। সে অন্য চিন্তায় মগ্ন। আচ্ছা তার এই সুন্দর চেহারার কি আদো দাম আছে? যেখানে ময়মনসিংহের সকল মেয়েরা তাকে কাছে পেতে চায়, হোক সে এক রাতে জন্য! সেখানে তার বাবুইপাখি তাকায়-ও না একটি পলক। তাকে কি ভালবাসার যায় না?

---" স্যার প্লীজ যেতে দিন!"
অানিসের প্যাচ প্যাচ ইউসুফের ভালো লাগেনি।তার চিন্তায় ভাঙ্গন ধরেছে। সে বিরক্তি নিয়ে বলল,,

---" এর প্যাচ প্যাচ ভালো লাগচ্ছে না। কাসেম মুক্তি দিয়ে দে।"

বলেই ইউসুফ উঠে বাহিরে পা বাড়ায়। পিছন থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ আর চিৎকার।

কারো বিকট এক চিৎকারে কুহু ধড়ফড়িয়ে উঠে। ভয়ে তার প্রাণ যায় যায়। এমন চিৎকার এ বাসায় সে আরো শুনেছে।  এ বিষয়ে যখন দাদুকে  বলতো তখন তিনি বলতেন,,

---" এ বাড়িতে তেনাদের বসবাস আছে। তাই রাত-বিরাতে বের হবি না ঘর থেকে!"

ছোট কুহু ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যেত। মাথা কাত করে হে বলতো। আজও তেমন চিৎকার ভেসে এলো।  এ যে কোনো মানুষের চিৎকার স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। কোনো জ্বিন-ভুত এর ধারের কাছেও নেই। কুহু বিছানা থেকে নামে। পা টিপে টিপে দরজা খুলে।  আশেপাশে ইউসুফ কেন তার ছায়া-ও নেই সে কৌতুহল নিয়ে বের হতে নিতেই কারো সাথে ধাক্কা কায়। মস্তিষ্কে তখন জানান দিচ্ছে তেনারা এলেন না তো? কিন্তু নাকের মাঝে পরিচিত এক পার্ফিউমের গন্ধ তীর তীর করে বাড়ি খাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকায় কুহু। ইউসুফকে দেখে হকচকিয়ে উঠে। ইউসুফ কঁপাল কুঁচকে কুহুকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে বলল,,

---" পালাতে চাইছিলি?"

কুহু আমতা-আমতা করে বলল,,

---" না তো! পালাবো কেন? "

---"তাহলে?" সন্দিহান ইউসুফ। 

কুহু ঝটপট বলল,,

---" বাহির থেকে কারো চিৎকারের অাওয়াজ শুনলাম!"

ইউসুফ হাসলো বলল,,

---" এর থেকে ভালো এক্সকিউজ খুঁজে পেলিনা?"

কুহু চোখ বড় বড় করে বলল,,

---" আমি মিথ্যা বলছি না।"

ইউসুফ আর কথা বাড়ালো না ঘরে এসে সটান করে বিছানা শুয়ে পড়লো। কুহু তার পিছন পিছন এলো। বলল,,

---" আমার কিছু কথা আছে!"

---" হুম।"

---" আপনি শুনচ্ছেন?"

---" হুম!"

---" আমার ডিভোর্স চাই!"

ইউসুফ এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলো। ডিভোর্সের কথা উঠে বসে পড়লো। কুহুর দিক ভয়ানক এক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে,  চেঁচিয়ে উঠলো,,

---" এখন আর এই মুহূর্তে বিছানায় ঘুমুতে আসবি। আর একটি কথা বললে তোকে বাড়ির পিছনে সেই জঙ্গলে ফেলে আসবো।"

কুহুর মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। টুপ করে জল টুকু নিচেও পড়ে গেল। বাড়ির পিছনে আছে গহীন জঙ্গল আর তার মাঝে আছে একটি রাজ বাড়ি।প্রায়-ই সেখান থেকে ভেসে আসে নুপুরের শব্দ। আর যাই৷ হোক সে ভুতরে বাড়ির দর্শন সে করতে চায় না। সে দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুতে উঠে পরে বিছানায়। তা দেখে ইউসুফ মুখ টিপে হাসে।

সকাল বেলা ইউসুফের দাদু এসে হাজির। সাথে এসেছেন তার ছোট চাচি আর তার দুই মেয়ে। ইউসুফের বাবারা দুইভাই। মহসিন আর তুহিন। মহসিন ময়মনসিংহ শহরের মেয়র। আর৷ তুহিন তাদের গ্রামের চেয়ারম্যান।  বছর ছয় মাস ইউসুফের দাদু রোকেয়া বানু দুই ছেলের কাছে থাকেন। তার নাতি হুট করে বিয়ে করেছে শুনে সে নারাজ। তিনি পান মুখে পুরে বললেন,,

---" তোর পোলা কই মনিশা? না জানায় বিয়ে দিলি নবাব কি এখনো শুনে নাই আমি আইছি?"

মনিশা তার শাশুড়ীকে ভয় পান খুব৷ তিনি খ্যাক করে গলা পরিস্কার করে বলেন,,

---" শুনছে আম্মা। আসচ্ছে। বুঝেনি তো বিয়ের রাত!"

রোকেয়া বানু খেঁত করে উঠেন,,

---" নাতি না হয় ঘুমায়, নাতি বউ ও কি ঘুমায় নি? এত বেইল হইলো। ডাকো যাও। শুনো বউ মা বউ গো এতো লাই দিতে নাই। পড়ে কান্দে উইঠা নাচবো!"

মনিশা মাথা কাত করে সম্মতি দেয়। আওয়াজ তুলে কাজের মেয়ে রূপালিকে ঢেকে পাঠায় দেয় ইউসুফ কুহুকে ডাকতে।

কুহুর তখনো ঘুম ভাঙ্গেনি। ইউসুফের বুকের মাঝে বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে আছে। কুহুর নিশ্বাসে ইউসুফের বুকের চুল গুলো উড়ছে। ইউসুফ এক হাতে কুহুকে আকড়ে ধরে তাকিয়ে আছে তার নিষ্পাপ,  বাচ্চা বউটির দিকে। দাদু এসেছে, নিচে যেতে বলেছে এ নিয়ে চারবার বলে গেলো রুপালি।  কিন্তু ইউসুফের উঠতে ইচ্ছে করলো না। না কুহুকে জাগাতে চাইলো। তার ঘুম পরি বাবুইপাখিটি ঘুমন্ত অবস্থায় তার বুক দখল করে আছে। ঘুম ভাঙ্গলেই আবার ছুটে  পালাবে!

রুপালী আবার ডেকে গেলো। এবার কুহুরও ঘুম ভাঙ্গলো। রোকায়া বানু এসেছে শুনে তার মুখ শুকিয়ে গেছে। মহিলাটি তাকে দু চোখেও দেখতে পায় না। সে জলধি উঠে বসলো। ইউসুফ তখন জুতো পড়চ্ছে। কুহুকে দেখে হেসে বলল,,

---" ঘুড মর্নিং বাবুইপাখি! "

কুহু মুখ বাঁকালো ইউসুফকে পাত্তা না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। 

----" এই মাইয়ার সাথে শেষ পর্ডন্ত বিয়া দিলি মনিশা? কেন আমার চান্দের লাখান নাতির মাইয়ার অভাব পড়ছিন?"

রোকেয়া বানু তেজে ফেঁটে যাচ্ছেন।তার নাতির জন্য কত মেয়ের সন্ধান না করেছিলেন তিনি। সব রিজেক্ট করলো ইউসুফ।  লাষ্ট পর্যন্ত মুদির দোকানের মেয়ে ঘরে তুললো? ভেবেই নাক ছিটকায় তিনি। কুহু সব হজম করে। চোখের কোনে জল টলমল করে। মুরব্বিদের মুখে তো কথা বলতে পারবে না সে। তখনি ইউসুফ নিচে নেমে আসে।  উপর থেকে কুহুর কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বসে থাকতে দেখে,  বুঝতে দেড়ি হয়নি কটুকথা শুরু করে দিয়েছে তার দাদু। সে এগিয়ে এসে বলে,,

---" দাদু, এসেছো, নিজের মতো থাকো। অন্যকারো লাইফে বাম হাত ঢুকিও না।"

রোকেয়া বানু ইউসুফকে কিছুটা ভয়ও পান। তিনি হেসে আদুরে কন্ঠে বলে,,

---" এমন কউ কেরে আমিতো তোমার ভালার লাগি কইছি!"

ইউসুফ হেসে ফেলে। বলে,,

---" দাদু আমার ভালো আমি বুঝতে শিখেছি আজ ১২ বছর। তোমার চিন্তা না করলেও চলবে।"

দাড়ালো না আর ইউসুফ কুহুকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। রোকেয়া বানু রেগে যান। রাগের মাঝে ঘী ঢালেন ছোট চাচি বলে,,

---" দেখলেন আম্মা? কেমন ব্যবহার? আমার ছেলে-মেয়ে এমন করলে জুঁতা খুলে মুখে মারতাম!"

রোকেয়া বানু জ্বলে উঠে। মনিশাকে বলে,,

---" তোর ছেড়াডা এখনি হাত ছাড়া হইয়া গেলোরে মনিশা!"

মহিশা নিরবে শ্বাস ত্যাগ করে ছয় মাস এই ক্যান ক্যান তার সইতেই হবে।

গুরত্বপূর্ণ এক মিটিংয়ে বসে আছে ইউসুফ। বিরোধী দলের সাথে। তখনি ফোনের মাঝে রিং বাঁজতে থাকে লাগাতার। বাসা থেকে কলটা এসেছে দেখে চিন্তার ভাজ পরে। ইউসুফ ফোন রিসিভ করে।  ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ।  ইউসুফের বুক খ্যাত করে উঠে, বাবুইপাখি ঠিক আছে তো?? অপর পাশ থেকে তখন চাপা অর্তনাদ ভেসে আসে তার মার,,

---" ইউসুফ কুহু....!"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন