অচেনা অতিথি - পর্ব ১৯ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


মাহাদের এমন ব্যবহারে তিতির যেন দুমড়ে মুচড়ে গেল। নিলিপ্ত গলায় বলে উঠল, আপনি ঠিকি বুঝছেন। আমি আপনাকে ছেড়েই যাবো এমন কিছু ঘটলে..............

      ভালোবাসা.......
কি অদ্ভদ জিনিস তাইনা?
কারো কাছে জিবনটা সাজিয়ে দেয়, খুশিতে ভরিয়ে দেয়।
আবার কিছু মানুষের!!!!
পুরো পৃথিবীটাকে তছনছ করে ফেলে।
তখন তা আর ভালোবাসা না......
মন্দবাসায় পরিণত হয়।
দোষ কার?
সেই মানুষের?????
নাকি!! প্রতিনিয়ত ভালোবেসে নিজেকে
অপর দিকের মানুষের কাছে সস্তা
প্রমান চাওয়া সেই মানুষের। 
                                    (রাই)

তিতির রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো। মাহাদ তিতিরের যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। এখন মাহাদ আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেনা। মাহাদ কাজটা যে ঠিক করে নাই সেটা হারে হারে টের পাচ্ছে। রাত বাড়ছে সিগারেট পোড়ার সংখ্যাও বেড়েই চলছে। সিগারেট জ্বলার মত বুকটাও জ্বলে যাচ্ছে কিন্তু সেটা দৃশ্যমান নয়। খারাপ লাগার সমস্ত আয়োজন চলছে মাহাদের মনে। রাতটা মাহাদের নির্ঘুমই কেটে গেল। সকালের দিকে এসে চোখ মহাশয় বিদ্রোহ করতে লাগলো। কারন এখন অন্তত তাকে বিশ্রাম দেওয়া হোক।  মাহাদ ঘুমিয়ে পড়লো।


তিতির প্রতিদিনের মত ভোরে  উঠে সালাত আদায় করে বই নিয়ে বসলো। আজ ৪ টা ক্লাস আছে। ফিরতে হয়তো দেরি হবে। আজকের যেসব অধ্যায় গুলো আলোচনা করা হবে ক্লাসে, সেগুলো অধ্যায়ে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো তিতির। তারপর বইগুলো গোছগাছ করে ব্যাগে ভরে গোসল সেরে রেডী হয়ে রুম থেকে বের হলো। 

নিচে এসে দেখে সাবিনা সকালের নাস্তাগুলো টেবিলে সাজাচ্ছে।

" সাবিনা দুটো পরোটা আমায় বক্সে একটু ভরে দিবে! আমার খাওয়ার সময় নাই।"

" আফা কলেজ যাবেন বলে একটা মুচকি হাসি দিলো সাবিনা।"

এই বাঙ্গালীদদের এক খারাপ অভ্যাস আর গেলোনা। সাবিনা জানে তিতির ভার্সিটিতে যাবে তবুও কাজ না করে তিতির কে প্রশ্ন করেই চলছে।
সাবিনার কোন হুসই নাই তিতির কি বলল। বাধ্য হয়ে তিতির রান্নাঘরে গিয়ে একটা টিফিন বক্স নিয়ে এসে দুইটা পরেটা আর ভাজি নিয়ে বক্সটা ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

এই বাসায় মোট পাঁচটা গাড়ী। হয়ত তাদের বললে তিতিরকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে আসবে কিন্তু সবাইতো আর এক না। সবাই তো আর তিতিরকে  পছন্দ করেনা।

হয়তো চট করে কথা শুনিয়ে দিবে তাই তিতির কখনো এগুলোর আসা করেনা। পরের জিনিসের উপর লোভ করতে নেই। কাল রাতে মাহাদের সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই অভিমানে মাহাদের কোন টাকা ছুয়েও দেখেনি তিতির। সোজা পায়ে হেঁটে ভার্সিটিতে রওনা দিলো তিতির।

♦♦

 সকালে সবাই নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করছে শুধু তিতির আর মাহাদ বাদে।
বাতাসি শুধু নাস্তা নাড়ে চাড়ে কিন্তু মুখে তোলেনা। বাতাসির এমন আচরনে তার বাধ্য পুত্র দেওয়ান মো. কামরান আহনাফ বেশ  চিন্তিত সুরে বলে উঠল,, " আম্মা আপনি খাচ্ছেন না কেন! আপনার শরীর ভালো আছে তো?"


এবার বাতাসি জোড়ে বিনিয়ের সাথে মরা কান্না জুড়ে দিলো। বাপ তোরে আর কি কমু। কপাল খারাপ।  লসিব খারাপ আমার।

" আমা যায় আম কুড়াতে
   কপাল যায় সাথে
  আমার গরু গাব পড়েছে
  আমা মরে ভাতে।" 
ছড়াটা বলেই শাড়ীর আচল দিয়ে চোখ মুছলো বাতাসি।


মো. কামরান আহনাফ হয়রান হয়ে গেল তার আম্মাজানের কথা শুনে। ব্যাপার খানা বুঝতে না পেরে বলল,,," কি হইছে আম্মা! খুলে বলেন।"
আপনাকে কেউ কি কষ্ট দিয়েছে?


নাস্তার প্লেটটা সামনে থেকে সরিয়ে বাতাসি বলল,,,

"তোর কুলাঙ্গার পোলা মাহাদ আরে কাল দুপুর রাইত্তে ধুয়ে দিছে। সখ করে ওর ঘরে গেছি তার জন্য আরে কি না শুনাইলো। আজ এর বিচার তোরেই করতে হবে।"


বাতাসির কথা শুনে রুমকি ফোঁস করে উঠলো। তুমি রাত -দুপুরে মানুষে ঘুম হারাম করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে আর মানুষ তোমাকে ছেড়ে দিবে! তোমার যা স্বভাব, সেটা আমাদের সকলের ভালো করে জানা আছে। ভাই যা করেছে বেশ করেছে। 


ঐ, তুই চুপ থাক! সারা দিন খালি কানের কাছে খ্যাচ খ্যাচ করতেই থাকোস! তুই কদ্দিন এই বাড়ি থাইকা যাবি বলতো! যেদিন যাইবি সেদিন জুম্মাতে দুই টাকার মিলাদ দিমু।"


আম্মা আপনি থামবেন? মেয়ে আমার দু'দিন পর চলে যাবে আর আপনি এখনো তারে কথা শুনাইতে ছাড়ছেন না। আপনার এতো কঠিন জিবন হয় কি করে। মনে হয় আপনি দুনিয়ার দায় সারানোর জন্য ছেলে-মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখছেন। আমি আপনার মত কঠিন হৃদয়ের মানুষ একটাও দেখি নাই। রুপলী কথাগুলো বলে বা'হাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছলো।

নাস্তার টেবিলে এক প্রকার ট্রাজেডি নিয়েই, সবাই যার যা নাস্তা শেষ করলো।

♦♦♦♦♦

মৌ ওর মেয়েকে নিয়ে বসে আছে। রেজওয়ান অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে লকার থেকে একটা ব্যাগ বের করে মৌয়ের হাতে দিয়ে বলল,,, " এখানে ২৫লক্ষ টাকা আছে। রুমকির বিয়ের জন্য ব্যাংক থেকে উঠে নিয়ে আসছি। টাকাগুলো সাবধানে রেখ।


মৌ মেয়েকে রেজওয়ানের কোলে দিয়ে খুশি মনে টাকাটা নিয়ে আলমারিতে রেখে দিল। উফ্ এত টাকা আমার হাতে কোনদিনও আসেনি। এখান থেকে কিছু টাকা সরিয়ে নিজের হাতে রাখা যাবে।
কিন্তু মৌয়ের চিন্তার মাঝে রেজওয়ান বোমা ফাটালেন। মৌ, টাকাগুলো আজ আম্মার হাতে দিও। আম্মাকে বলে রেখেছি। কাল কিছু লোক আসবে তাদের হাতে টাকাগুলো সব দিতে হবে। পরশু থেকে বাসায় কাজ শুরু হবে।

মৌয়ের মুখ এবার দেখার মত। বাংলার পাঁচের মত মুখ করে দাড়িয়ে রইলো।


রেজওয়ান মেয়েকে আদর করতে ব্যস্ত। মেয়ে বলতে অঙ্গান রেজওয়ান।  প্রচন্ড ভালোবাসে মেয়েকে। মেয়ের জন্য সে সব করতে পারে। রাতিশার গালে আরো কিছু কিস করে রেজওয়ান অফিসে চলে গেলো।


বাসার পুরুষেরা যখন বাহিরে চলে গেল তখন বাতাসি বিবি তার খেল শুরু করলো। সাবিনারে ডেকে বাতাসি বলল,,,'" ঐ ছুড়ি আমার ব্যাগ গোছায় দে তো!"

"" সাবিনা গালে হাত দিয়ে বলল,," দাদী আন্নে কই যাইবেন?"

"" যেহানে ইচ্ছা সেই হানে যাই। তোরে ব্যাগ গোছাইতে কইছি তুই ব্যাগ গোছা।"

সাবিনা বাতাসির কথা মত ব্যাগ গোছাতে লাগল। বাতাসি যা যা বলছে সাবিনা সব এক এক করে ব্যাগে ভরে দিচ্ছে।


 লাবীবা বাতাসি বিবির রুমে এসে দেখলো সাবিনা ব্যাগ গোছাচ্ছে। লাবীবা ভ্রু কুচকে বলল,,"আম্মা আপনি কোথায় যাবেন!"


 বনবাসে যামু বনবাসে।  তোমাদের চক্ষুশূল হইয়া আর কতদিন এইহানে থাওন যায়! আমি কইয়া দিলাম বৌ, আমারে কিন্তু আটকাবানা। আজ যদি আটকাইছো তাহলে বাড়ি মাথাত তুলে তোমাগো সবাইরে নাচামু। 


শাশুড়ীর কথা শুনে লাবীবা রুম থেকে বের হয়ে রুপালীর কাছে গেল।

আপা দেখেন তো আম্মা এসব কি শুরু করছে। ব্যাগ গুছাইয়া কোথায় জানি বের হচ্ছে।


রুপালি মৌয়ের সাথে কথা বলছিল। লাবীবার কথা শুনে দ্রুত নিচে এসে দেখে তার আম্মাজান তল্পাতল্পি বেঁধে কোথায় যেন যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে। রুপালী কান্নামুখে বলল,,,,
"আম্মা আপনি আবার কি শুরু করছেন বলেন তো! ক'দিন বাদে রুমকির বিয়ে আর আপনি এসব শুরু করছেন!"


 বাতাসি বিবি হুংকার দিয়ে উঠল। আর বিয়া না তোর বেটির বিয়া! তাই আর থাকুন লাগবো!
তোর শয়তান, খাবিস্ বেটি বিয়া কইরা ভাতারের বাড়িত যাবে। না,,,  বিয়া করবেনা বলে সেই দুঃখে কাঁঠাল গাছের সাথে গলায় দড়ি দিবে সেটা আর কি! ঐ সব কথা আরে একদম কইতে আইবিনা।  আর একবার কইয়া দেখ খালি! তোগো মা-বেটিকে ঝেঁটিয়েই সোজা করুম।


নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে রুপালী খুব কষ্ট পাইলো। মা তার দিন দিন বদ মেজাজি আর রাগী হয়ে যাচ্ছে। মুখে যা আসে তাই বলে যায়। তাই বলে আমার একটা মেয়েকে গলায় দড়ি দেওয়ার কথা বলবে! এ কেমন মা বলে রুপালী কাঁদতে লাগলো।

মা মেয়ের ঝগড়া শুনে মৌ লাবীবাকে বলল,," মামী মাহাদ ভাইয়া বাসায় আছেনা! ওনারে ডেকে নিয়ে আসুন। উনি ছাড়া নানীরে কেউ সোজা করতে পারবেনা।


লাবীবা দেরি না করে মাহাদের রুমে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগল। এত জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো যে, মনে হয় বাসায় ডাকাত পড়েছে।


প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কির শব্দে মাহাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এমনি পুরো রাত ঘুমাইনি তার উপর এই কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাহাদ ঘুমকাতর চোখে ঢুলতে ঢুলতে এসে দরজা খুলে দিয়ে বলল,," মা আমার ঘুমের সাথে বরাবরই তোমার শত্রুতা। কেনো এমন করো বলতো?"
দরজা খুলে রেখে এসে আবার সুয়ে পড়লো মাহাদ।


বাসায় এলাহীকান্ড চলছে আর তোর ঘুম! সারা রাত কি করিস? চৌকিদারী করোস পুরো মহল্লায়? ওঠ বলছি ওঠ। তোর দাদী বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কাল রাতে তোর দাদীরে কি বলেছিস তার জন্য তোর দাদী বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে?


মাহাদের ঘুম ছুটে গেল এক নিমিষেই। দাদী কি সব কিছু বলে দিছে সবাইরে? 
গায়ে তাড়াহুড়ো করে ট্রী শার্টটা জড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো মাহাদ।

হুম সত্যি!  বাতাসি কোথায়ও যাওয়ার উদ্দেশ্য বের হয়েছে। মাহাদ কিছু না বলে সোজা গিয়ে সোফায় বসে বাতাসির কর্মকান্ড দেখছে।


বাতাসি চাচ্ছে মাহাদ ওর হাত-পা ধরুক আর বলুক ওর ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু মাহাদও কম ঠ্যাটা না যে বাতাসির পা হাত-পা ধরবে। 
যখন বাতাসি দেখলো মাহাদের কোন পরিবর্তন নাই তখন সাবিনার উপর গলা চালালো। আরে  থাকতে কস কোন দুক্কে! বানের জলে ভাইসা আসা খড় কুটারও জায়গা হয় এই বাড়িতে কিন্তু আই বাতাসির জায়গা হয়না এই বাড়িতে। বাড়ির সগ্গলে আর শত্রু হয়ে গেছে। থাকুম না আর এই বাড়িতে। 

♥ 

বানের জলের খড় কুটা যে কাকে বলা হয়েছে সেটা অন্য কেউ না বুঝলেও মাহাদ ঠিকি বুঝেছে। মাহাদ সাবিনারে ধমক দিয়ে বলল,,," তুই এখানে দাড়ায় রইছিস এখনো! যা সব বেডিং পত্র নিয়ে  একদম বাসার বাহিরের গেট পর্যন্ত আগায় দিয়ে আসবি। ভাল করে গেট লাগিয়ে দিবি। বাতাসি যেন ব্যাক করতে না পারে। উচ্ছন্নে যাক বাতাসি। 


এবার বাতাসির আগুনে যেন ঘি পড়লো। নিজের আঁচলটা কোমড়ে পেঁচিয়ে মাহাদের দিকে এসে চিল্লায় বলল,," আই উচ্ছন্নে যামু! তুই যা। আর যারে লইয়া আইছোস তারেও লইয়া যা ছ্যাচড়া.......


 ছেলেকে ডেকে আনলো শাশুড়ী যাতে বাসা ছেড়ে না যায়।  কিন্তু ছেলে আরো যাওয়ার জন্য ১০হাত এগিয়ে দিল। এতো দেখছি মহাবিপদ! এতে হিতে বিপরীত হয়ে গেল। লাবীবা বাতাসির কাছে এসে বলল,,," আম্মা আপনের দুইটা পা ধরি তবুও ঝগড়া ঝাটি করেন না। এরকম ঝগড়া মানুষে শুনলে কি বলবে। বাসার এতগুলো কাজের লোকের সামনে না চিৎকার করলেই কি নয়!


অ,,,, আই খালি একা ক্যানাহাটি করি আর তোমার পুত্র! হেই ধোয়া তুলসি পাতা তাই না? সগ্গলরে আর চিনা হইয়া গেছে। নিজের পুত রে কিচ্চু কইবে না কিন্তু আর ভুল  ঠিকি ধরবা। আই থাকতামনা এই ভিটায়। বনবাসে যামু। কথায় আছেনা!
" আপনের থেকে পর ভালো
 পরের থেকে জঙ্গল ভালো।
তাই জঙ্গলে যামু।


রুমকি উপর থেকেই বলে উঠল, বাতাসী নানী তুমি সুন্দরবন যাও। তোমার যা বাঘিনীর স্বভাব। আমাদের জাতীয় বাঘ মামা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাথে গিয়ে সংসার করে খাও। বাঘ আর বুইড়া বাঘিনীর সংসার। তোমাদের বাচ্চা কাচ্চা হইলে আমাদের জানাইও। আমরা বনে ফ্যামিল ট্যুরে যাবো তোমাদের সংসার দেখতে।


তুইও না রুমকি, অবুজের মত কেন কথা বলিস!  কোন বনেই তেনার সীতার বনবাস হবেনা। দেখ গিয়ে, তেনার আদরের ভাই বুদুনের বাসায় গিয়ে উঠবে। বেচারা বুদুনও ইনার জন্য বউদের হাতে ঠেঙ্গানি খাইবে। সেগুলো দেখে বাধ্য হয়ে এই বাসায় চম্পট হয়ে আসবে। দেখ শুধু সময়ের অপেক্ষা। মাহাদ কথাগুলো বলে লম্বা একটা হামি দিয়ে ওর মাকে বলল," আমায় যদি আর ডাকছো এই সব সিনেমা-নাটক দেখার জন্য তাহলে আমিই বাসা ছেড়ে চলে যাবো।"
যার যেখানে যাওয়ার সখ উঠেছে সে সেখানে যাক। এমনি দু'দিন পর বাসায় ফিরে আসবে। এই বৃদ্ধ বয়সে নিজের সন্তান ছাড়া কেউ কাউকে দেখবেনা। মাহাদ উপরে চলে গেল ঘুমাতে।


বাতাসি আর কারো কথাই শুনলোনা। সাবিনারে নিয়ে বাসা হতে বের হয়ে চলে গেলো। রুপালী বা লাবীবা কারো কথা কানে নিলনা। 

♦♦♦♦

তিতিরের দুইটা ক্লাস শেষ হইছে কিন্তু খাবার খাওয়ার মত কোন প্লেস খুজে পাচ্ছেনা। শেষে ক্যান্টিনে চলে গেল। ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স আর পানির বোতলটা বের করেই বলল,," মামা, কড়া করে এক কাপ চা দেন তো!
চা আসতে দেরী হতেই তিতির একটা পরোটা বের করে খেতে লাগলো। তারপর চা আসলে পরোটা আর চা দুটোই খেতে লাগলো। এতক্ষনে পেটের ভিতর খুদা গুলো যেন গোল্লাছুট খেলছিল। 

কোথা হতে তিনটা ছেলে এসে তিতিরের সামনে বসলো। ফর্সা করে ছেলেটি বলল,," হ্যালো ম্যাম, আপনার সাথে কি, একটু কথা বলতে পারি?"  


ওদের আসা দেখেই তিতিরের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আর কথা শুনেই তিতির বিষম খেল।
ছেলেটি বাঁকি দুই ছেলেকে বলল,," তোরা যা আমি আসছি।"
ছেলেটি পানির বোতল তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল।
কিন্তু তিতির পানি না খেয়ে উঠে যেতেই হিচকি উঠে গেল। তাই বাধ্য হয়ে বসে পানি খেল।


দেখেতো মনে হয় ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে। কিন্তু কেউ ভালো করে কথা বললে তার জবাব দিতে হয় সেটা আপনাকে কেউ শিখাইনি?


ছেলেটির কথা শুনে, তিতিরে চেহারা মুহুত্তেই লাল বর্ন ধারন করলো। কিন্তু শান্ত গলায় বলল,,," আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো! আমি আপনাকে দেখছি , কয়েকদিন থেকে আপনি আমার পিছে ঘুর ঘুর করছেন।"
আর ভদ্রতা! সেটা কি আপনার ভিতর আছে? আমার অনুমতি না নিয়েই আমার পাশে এসে বসেছেন তাও যখন আমি আমার নাস্তা খেতে ব্যস্ত ছিলাম। 
আগে নিজে জানুন ভদ্রতা কাকে বলে। তারপর অন্যকে ভদ্রতা শিখাতে আসুন বলে টিফিন বক্স গুছিয়ে ব্যাগে উঠাইয়ে পানির পটটা হাতে নিয়ে চায়ের বিলটা পরিশোধ করে তিতির চলে আসতেই ছেলেটি আবার তিতিরের সাথ ধরলো।


আমি বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়েছে কিন্তু আমার কথাটাতো শুনবেন???
কিছু নোটস্ লাগতো আপনার কাছ থেকে। যদি আমায় সাহার্য্য করতেন তাহলে আমার খুব ভালো হত। আমার পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো না যে প্রাইভেট পড়বো। একটু সাহার্য্য করবেন?


এবার তিতির থেমে গেল। দেখেন আপনি সত্য বলছেন না মিথ্যা বলছেন জানিনা। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে একদম কথা বলতে আসবেন না। কী দরকার বলুন.......!

♥ 
ব্যাষ্টিক অর্থনীতির আজকের যেই ক্লাসটা হলো সেটার যেগুলো নোট করলেন ওগুলো আমার দরকার ছিল। প্লিজ বলবেন না পুরো ক্লাসের সময় আমি কি করেছিলাম। আমি অন্যকাজে ব্যস্ত ছিলাম।


তিতির খাতাটা বের করে দিয়ে বলল,,," আমার হাতে সময় নাই, আপনি এটা গিয়ে ফটোকপি করে নেন। আমি এখানে দাড়িয়ে রয়েছি।"


আমার নাম আরমান খান দিপু। আমাকে তুমি দিপু বলেই ডেক। স্যরি ক্লাসমেট বলে তুমি বলে ফেললাম।


তিতির রাগী চোখে তাকাতেই দিপু আর কথা বলার আর সাহস পেল না। তিতির অনেকক্ষন ধরে দাড়িয়ে আছে কিন্তু দিপুর আসার কোন নাম নাই। কেন যে ছেলেটার কথা শুনতে গেল তিতির সেটাই বুঝতে পারছেনা।  দুরে একটা দু'টি ছেলে মেয়ে দাড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা প্রেমিক-প্রেমিকা।  ছেলেটা মেয়েটার কেয়ার নিতে ব্যাস্ত। খুব যত্নে মেয়েটাকে ফুচকা খাওয়াই দিচ্ছে। ভার্সিটিতে পাবলিক প্লেসে এসব ঘটনা কোন ব্যাপারই না। 
তিতির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়ে বলল,," প্রেমিক আর স্বামী দুটাই আলাদা। মেয়েরা প্রেমিককে যতটা কেয়ারিং অবস্থায় পায়, স্বামীকে কখনোই সেই অবস্থায় পায়। সেই প্রমিকই স্বামী রুপে আকাশ-পাতাল  ফারাক হয়।

এমন সময় দিপু হাপাতে হাপাতে এসে বলল,,," দুঃখিত তিতির তোমাকে এতক্ষন ওয়েট করে রাখার জন্য।"


 তিতির কোন কথা না বলে খাতাটা নিয়ে অর্থনীতি ডির্পাটমেন্টের দিকে হাটা শুরু করে দিল। পিছে দিপুও। কিন্তু তিতির এই দিপু ছেলেটার সাথে কথা বলতে নারাজ।
ক্লাসরুমে এসে দেখল ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তিতিরের প্রচুর রাগ লাগছে।  এই ছেলেটার জন্য তার দেরি হয়ে গেল। ক্লাসে মনোযোগ দিল তিতির।

♦♦♦♦

৩য় বর্ষের মাস্তান টাইপের মেয়ে রিপা তিতিরের ক্লাসের বাহিরে তিতিরের জন্য অপেক্ষা করছে। তিতির ক্লাস শেষ করে বের হতেই রিপার দুই চ্যালা তমা আর জুথি এসে তিতিরকে ডেকে নিয়ে গেল রিপার কাছে।

রিপা আগা গোড়া তিতিরকে দেখছে। তিতির আগাগোড়া বোরখা পড়া। চেহারাটাও দেখতে পাচ্ছেনা। রিপা কিছুটা কড়া ভাষায় বলল,,," মাহাদ ভাইয়ার তুমি কে হও?"


এমনি তিতির গতকালের থেকে মাহাদের উপর ক্ষেপে আছে তার ভিতর অন্য মেয়ের মুখে মাহাদের নাম শুনে চটে গেল।
কিন্তু নিজেকে কন্টোল করে বলল,,," তার কথা কেন জিঙ্গাসা করছেন? আপনি কি ওনাকে আগে থেকে চেনেন?"


এবার রিপা ক্রোধে ফেটে পড়ল। এই মেয়ে নিজেকে কি ভাবিস তুই হুম? ভাল স্টুডেন্টস হইছিস বলে আমাকে দেমাগ দেখাস! একে বারে খেয়ে ফেলবো তোরে। আমাকে তুই চিনিস? তোর লাশও কেউ খুঁজে পাবেনা। আমার মুখে মুখে তর্ক করিস? যা বলছি তার জবাব দে!


আপনি সভ্য ভাষায় কথা বলুন। এভাবে তুই-তোকারি করে কথা বলার আপনি কে? আর আপনি কোন মন্ত্রী মিনিষ্টার আসছেন যে, আপনাকে আমার চিনতে হবে? 
ওদের সামনে পুরো ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রী এসে জড় হয়ে গেছে। 


জুথি রিপাকে ধীরে ধীরে বলল,,," রিপা তোর তো ক্ষমতা অনেক।  এতগুলো স্টুডেন্টেরর সামনে ওরে চড় বসিয়ে দে। তোর নাম আরো বাড়বে। এই কলেজে তোর পাওয়ারই বেড়ে যাবে। মার মেয়েটাকে।

জুথির কথা শুনে রিপা হঠাৎ করে  তিতিরের গায়ে হাত তুলতেই তিতির রিপার হাতটা ধরেই মোচড় দিয়ে বলল,,,

" আমি যে খাবার খাই, তারাও আমাকে দেখে উপহাস করবে , আপনার এই চড়টা যদি আমার গালে পড়তো।
তারা হয়তো বলত, কুলাঙ্গের হাতে যদি মারই খাস তাহলে আমাদের খাস কেন!"
আমি কিন্তু খাবারের কাছে অপমান হতে একদম রাজি নয়।

তিতির তাচ্ছিল্যর সাথে বলল,,,"অন্যকে  বিনা অপরাধে অপমান করতে আসলে নিজেই অপমানিত হতে হয়। ভবিষ্যতে আজকের এই দিনটির কথা মনে রাখবেন।"

আর শোনেন,  নিজের বুদ্ধিতে ফকির হওয়া ভালো কিন্তু পরের বুদ্ধিতে বাদশা হওয়া ভালো নয়। প্রকৃত পক্ষে কেউ কারো ভালো চায়না যেমনটা চায়না আপনার ঐ দুই দুষ্ট প্রাকৃতির বান্ধবীরাও। মেয়েরা একটু হিংসা পরায়ণ হয়। কারো উন্নতি দেখলে হিংসায় তাদের অন্তর জ্বলে যায়। 

তিতির রিপার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল,," আপনি আমার দুই ইয়ারের বড়, তাই সম্মান দিতে শিখুন আর নিতেও শিখুন।"

আজকের দিনটাই খারাপ ছিল তিতিরের জন্য তাই এমন ঘটনা গুলো ঘটছে বার বার। রিপার চাহোনি দেখে তিতির এটা বুঝল ও আজ যুদ্ধের সূচনা করে ফেলেছে। তবুও নিজেই নিজেকে শান্তনা দিল। 
"" আল্লাহ্ সুবহানাতালা যদি কারো অনিষ্ট করতে চায় তাহলে দুনিয়ার কারো সাধ্য নাই তাকে রক্ষ করতে। আর তিনি যদি কাউকে রক্ষা করার জন্য মনোঃস্থির করেন,  তাহলে কাহারো সাধ্য নাই তার কোন ক্ষতি করার। তাই যাহা হবে ভালোর জন্যই হবে। আল্লাহ্ ভরসা।

বাঁকি একটা ক্লাস করে তিতির বাসার পথে রওনা দিল।  ভার্সিটির গেট পার হতেই দেখলো মাহাদ গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে তিতিরের জন্য। 

কিন্তু তিতির সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলোনা। মাহাদের কারটা ক্রস করে সোজা রাস্তার ধার দিয়ে হাটতে শুরু করলো।


মাহাদ বুঝলো তার সহোর্ধমিনী এখনো এই সাহেবের উপর প্রচন্ড রেগে আছে। মাহাদের মাথায় দুষ্ট একটা বুদ্ধি চলে এল। তার এখন রাগান্বিত স্ত্রীর ভালোবাসা পাওয়ার লোভ হচ্ছে। এতে একটু গাড়ীর ক্ষতি হবে কিন্তু স্ত্রীর ভালোবাসার কাছে সেটা একদম তুচ্ছ। যেই কথা সেই কাজ।  মাহাদ গাড়ী নিয়ে তিতিরের সামনে দিয়ে ড্রাইভ করে দুরে একটা গাছের সামনে গিয়ে ধাক্কা মারলো। আর তাতে খুব জোড়ে একটা শব্দ হলো। মাহাদ সামান্যই আঘাত পেল। 

কিন্তু মাহাদের এই প্লানের কুপ্রভাব   পড়লো সম্পূর্ন তিতিরের উপর। তিতিরের ভিতরের প্রান পাখিটা যেন খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেল। মাহাদ বলেই কোন কিছু না ভেবেই ছুটে রাস্তা পার হয়ে মাহাদের কাছে আসতেই কোথা হতে এক প্রাইভেট কার এসে তিতিরকে লক্ষ্য করে  ধাক্কা মারলো। আর সাথে সাথে ছিটকে পড়ে গেল তিতির।  

রক্তাক্ত তিতিরের যতটুকু শক্তি ছিল ততটুকু দিয়েই মাথা তুলে একটু দেখতে চাইলো, তার প্রিয় মানুষটা ঠিক আছে কিনা! কিন্তু সেই সুযোগটাও আর পেলনা............

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন