অলকানন্দা - পর্ব ১৪ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৪০!!

সার্থকের হাত আলগা হতেই তার বুকে নিজের পিঠ দিয়ে ধাক্কা দিলো মাহা। আকস্মিক ধাক্কাটা সামলিয়ে উঠতে পারলোনা সার্থক। পিছিয়ে গেলো কিছুটা। মাহা মর্গের দরজাটা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার সমস্ত চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ওড়নাটাও শরীরে নেই। হাতে রক্তের মাখামাখি। হলদেটে ফর্সা মুখটা লালবর্ণ ধারণ করেছে। উন্মাদের মতন আচরণ করছে মাহা। কাজল কালো চোখে অদ্ভুত আকুতি। ছলছল করছে নেত্র যুগল। নিজেকে সামলিয়ে মাহাকে আবার আঁকড়ে ধরলো সার্থক।
 
"মাহা, আমার অলকানন্দা। আমার বুকটা ঝাঁঝড়া করে দাও। তবুও এমন পাগলামি করোনা। আমার যে কষ্ট হয়।"

নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে মাহা। সার্থকের কথাগুলো আদোও তার কানে গিয়েছে কিনা সন্দেহ! ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে মাহার গালে চড় বসিয়ে দিলো সার্থক। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে মাহা। বামহাতটা গালে দিয়ে অশ্রু মিশ্রিত চোখে সার্থকের দিকে তাকালো সে। সার্থক কিছু বলবে তার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মাহা। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। মনের সব কষ্ট গুলোকে অশ্রু হিসেবে বের করার বৃথা চেষ্টা যেন। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো মাহা। দেয়ালে মাথা হেলিয়ে কেঁদে যাচ্ছে একমনে। 
"চৈতি। চৈতি রে। আল্লাহ। আমার আপন মানুষগুলোকে তুমি কেন কেড়ে নাও আল্লাহ।"

সার্থক অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। অতঃপর নিজেও বসে পড়লো মাহার পাশে। পাশ থেকে কালো ওড়নাটা উঠিয়ে হাতে নিলো। ওড়নাটা আলতো করে দিয়ে দিলো মাহার উপরে। মাহা ভুলে গেলো সকল বাঁধা। ঝাঁপিয়ে পড়লো সার্থকের বুকে। এই বুকটা কি একান্তই নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছে মাহা? মাহার উষ্ণ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে সার্থকের সাদা শার্ট। একেকটা অশ্রুর ফোঁটা কাঁটার মতো বিঁধছে বুকটায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সার্থক আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তার অলকানন্দা কে। এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো কি? কেটে গিয়েছে সহস্র বছর, সহস্র মাস, সহস্র ঘন্টা। ঘোরের মাঝেই ছিলো দুজনে। একসময় ঘোর কাটলো সার্থকের। মাহা তার বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সার্থক নিজের নরম ঠোঁট দুটোর উষ্ণ ভালোবাসা দিলো মাহার কপালে। অতঃপর কোলে তুলে নিলো তাকে। একেবারে মিশিয়ে ফেললো বক্ষে। হেঁটে যাওয়ার পথে মানুষজন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের। চার বছর হয় হসপিটালে জয়েন করেছে সার্থক। এই চারবছরে কোনো দিন কোনো নারী পেশেন্টের সাথে অতিরিক্ত কথা পর্যন্ত বলেন নি ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। তাহলে আজ? কে এই মেয়ে? এই মেয়ের প্রতি এতটা টান কেন ডক্টর ফায়রাজের? 
 হসপিটালের প্রতিটা স্টাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সার্থক কে দেখে মুইংচিন দৌড়ে এলো তার কাছে। মাহার দিকে একবার তাকালো সে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
 "সাতক, মেয়েটা কে?"

প্রথমে জবাব দিলোনা সার্থক। মুচকি হাসলো একটু। অতঃপর হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিসিয়ে বললো,
"আমার পবিত্রা।"

মুইংচিন কি বুঝলো কে জানে। আরেকবার হাসিরা এসে ধরা দিলো তার মুখে। তার ছোট ছোট চোখ দুটো হাসির কারণে আরো ছোট হয়ে গেলো। কুঁচকে উঠলো চোখের দুপাশ। সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করলোনা সার্থক। সে নিজের মতো হেঁটে চলে গিয়েছে দূরে। বহুদূরে।

!!৪১!!

"জানেন জিনিয়া ম্যাডাম, সার্থক স্যার একটা মেয়ের জন্য কি যে চোটপাট দেখাইলো। মেয়েটার মাথায় সমস্যা। কেমন পাগলামি করে। ঐ মেয়েরে আবার স্যার কোলেও নিছে।"

ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম। সার্থকের সহকর্মী। নার্স নাজমার কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো জিনিয়া। অদ্ভুত সুরে বললো,
"সার্থক আর কোলে?"
"ইয়েস, ম্যাডাম।"
"আপনি যে কি বলেন না নাজমা আপা। এটাও পসিবল!"
"সত্যি বলছি ম্যাডাম। বিশ্বাস না হলে আপনি অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।"

চেয়ারে হেলান দিয়ে কতক্ষণ নাজমার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো জিনিয়া। বিগত তিনটা বছর ধরে সার্থকের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় আছে জিনিয়া। সার্থক কোনোভাবেই তার ডাকে সাড়া দেয়নি। মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই অজানা মেয়েটাকে দেখার ইচ্ছে পোষণ করলো জিনিয়া। যে মেয়ে পাথরের বুকে ফুল ফুটায় তাকে তো একবার দেখতেই হয়!

_________________

"অফিসার মোবারক আপনি একটা টিম নিয়ে সিলেট যাবেন। সিলেট পুলিশের সাথে কথা বলে আগুন পাহাড় সহ আশেপাশের জায়গা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবেন। আশা করছি কোনো সূত্র আমরা পাবোই।"
"ঠিক আছে মিঃ রেজওয়ান। ভিক্টিমের পরিবার কি হসপিটালে পৌঁছেছে?"
"জ্বি। আমি বের হবো এখনই। দ্রুত হসপিটালে যাওয়া প্রয়োজন।"

প্রয়োজনীয় কথা বলা শেষে থানা থেকে বের হয়ে গেলো রেজওয়ান। প্রাণপাখিটার জন্য মন কেমন করছে তার। 

"স্যার, আমার একটু সমস্যা হয়েছে বাসায়।"

কনস্টেবল মুন্সিকে ফোন দিয়ে এসব কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো রেজওয়ানের। যথাসম্ভব ঠান্ডা সুরে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,
"আপনি আমায় না বলে চলে গেলেন কেনো মুন্সি সাহেব?"
"স্যার, আপনি তো বড় স্যারের কার্যালয়ে আসলে অনেকক্ষণ থাকেন। এমন কি রাতও হয়ে যায়। আর আমার বাসা থেকে হঠাৎ ফোন করলো...
"আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি আপনার কাজ শেষ করে পরে আসুন।"
"সালাম স্যার।"

গাড়ি নিয়ে নিজেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রেজওয়ান। 

রাস্তায় জ্যাম নেই তেমন। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রেজওয়ানের মনটা বোধহয় উড়ে চলে গেছে তার প্রাণপাখির কাছে। একটা ফোন করেও কোনো খোঁজ নেয়নি সে। মাহা কি রেগে আছে তার প্রতি? হঠাৎ মনের মানসপটে ভেসে উঠলো সেই হলুদ ফর্সা মায়াবী মুখটা। কোঁকড়া চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে আছে। মোহিত করা অক্ষি যুগল। ভারী ভারী নেত্রপল্লব। আর সুর! কি মনোমুগ্ধকর! কি অভূতপূর্ব গলার সুর। সৃষ্টিকর্তা কি সমস্ত মিষ্টতা মেয়েটার গলায় দিয়েছে? রেজওয়ানের এখনো মনে পড়ে। তখন মাহার বয়স কত! তের কি চৌদ্দ। কি অভূতপূর্ব বীণা বাজাতো মাহা। প্রতিদিন ভোরে মাহাদের ছাদে লুকিয়ে থাকতো রেজওয়ান। মাহা যখন এলোমেলো চুলে মন খুলে ছাদের একপাশে বসে বীণা বাজাতো, কি মনোমুগ্ধকর লাগতো তার!

কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে জোরে ব্রেক কষতে হয় রেজওয়ানকে। সামনে মানুষের জটলা বেঁধেছে। 
"স্যার, স্যার।"

একটা বৃদ্ধ লোকের ডাকে গাড়ি থেকে নামলো রেজওয়ান। 
"কি হয়েছে চাচা?"
"মাইয়াটার হাতে ছুরি দিয়া ফোস দিছে পরে মোবাইল লইয়া ছিনতাইকারী ভাগছে স্যার।"
"দেখি সাইড দেন।"

উঁচু গলায় বললো রেজওয়ান। ইউনিফর্ম পরনে পুলিশ অফিসার দেখে মানুষ জন সরে জায়গা করে দিলো। সাথের বৃদ্ধ লোকটা বললেন,
"এই স্যারেরে সাইড দেন আফনারা, সাইড দেন।"

লাল থ্রি পিস পরনে একটা মেয়ে বাম হাতে ডান হাতের কব্জিতে চেপে ধরে রাস্তায় বসে আছে।
"আপনি ঠিক আছেন ম্যাডাম?"

রেজওয়ানের প্রশ্নে মুখ তুলে মেয়েটা।

!!৪২!!

দিনার ভাগিনী এশাকে দেখে খানিকটা অবাক হয় রেজওয়ান। মাহাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে মেয়েটা। শ্যামলা গাঁয়ের বর্ণ। দীঘল কালো হাঁটু সমান চুল। 
"এই তুমি এশা না?"

নিজের প্রিয় মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে কান্নাগুলো বেরিয়ে আসে স্পষ্ট ভাবে। কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায় এশা। রেজওয়ানের কষ্টই লাগে দেখে। 
"আচ্ছা, কান্না করোনা। উঠে দাঁড়াও।" 
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় এশা। হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে তার। ছুরির টানে অনেকটা কেটেছে বোধহয়। 

"হাত থেকে রক্ত পড়ছে তো। চলো আমি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।"

ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রেজওয়ান বললো,
"এভাবে তামশা না দেখে মেয়েটাকে একটু সাহায্য করলেও তো পারতেন আপনারা!"

এশা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে। রেজওয়ান এশাকে ইশারায় আসতে বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এশা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো তার পিছুপিছু। রেজওয়ান গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসলো। এশা বসলো তার পাশে। বিড়বিড় করে বললো,
"হাত কেটে যদি আপনার পাশে বসা যায় তাহলে আমি এমন একশবার নিজের হাত কাটতে রাজি রেজওয়ান।"

________________

ঘুমন্ত মাহার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে সার্থক। কি মায়বী তার অলকানন্দা! কোঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে আছে সারা মুখে। 
"মেয়েটা কি স্পেশাল কেউ? ডক্টর ফায়রাজ?"

জিনিয়ার প্রশ্নে তার দিকে একবার তাকায় সার্থক। অতঃপর চোখ ফিরিয়ে আবার মাহার পানে তাকিয়ে বলে, 
"হয়তো।"
"তা সেও কি ডক্টর?"
"কেন?"
"না, মানে ডক্টর ফায়রাজ তো আর সাধারণ কাউকে ভালোবাসবে না। মেয়েটা কে দেখে বয়সে আপনার থেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। মেয়েটা কি মেডিকেল স্টুডেন্ট? কোন মেডিকেলে পড়াশোনা করে?"
"ওর নাম মাহা। মাহা বলে ডাকলেই খুশি হবো ডক্টর জিনিয়া। তাছাড়া ডক্টর রা কি শুধু ডক্টরদেরই প্রেমে পড়ে?"
"না, না। আমি তো তা বলিনি?"

গলা উঁচিয়ে বললো জিনিয়া। খয়েরী চুলগুলো পোনিটেল করা। লেডিস শার্ট এবং জিন্স পেন্টের উপরে ডাক্তারী এফরন। সাদা ফর্সা গাঁয়ের রঙ। চেহারায় দাম্ভিকতা। 
"আস্তে কথা বলুন ডক্টর জিনিয়া। একজন পেশেন্ট এখানে ঘুমাচ্ছে।"

সার্থকের কথায় থমথমে হয়ে উঠলো জিনিয়ার মুখটা। কিছু না বলেই স্থান ত্যাগ করলো সে।

"ভালোবাসার গহীনে তুমি আমাকে টেনেই নিলে অলকানন্দা!"

শীতের রেশ কাটছে ধীরে ধীরে। বসন্তের আগমন ঘটবে ধরণীতে। নির্জীবতা কে দূরে ঠেলে দিয়ে সজীব হয়ে উঠবে ধরণী। গাছে গাছে গজাবে নতুন পাতা। রঙিন ফুলে মুখরিত হবে চারপাশ। নতুন প্রেমের হাওয়া লাগবে মনে। ঊনত্রিশ বছর শেষে শুষ্ক মরুভূমি তে এবার কি ফুটবে ফুল? ছড়িয়ে দিবে তার সৌরভ? 
.
.
.
চলবে.......................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন