বকুল ফুলের মালা - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!! 

সকালে ঘুম ভাঙলে মায়রাকে না দেখে সীমান্ত উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। মায়রাকে ড্রইংরুমের ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে দেখে এগিয়ে গিয়ে মায়রার কাছে গিয়ে বসলো সীমান্ত। আলতো করে মায়রার মুখের উপরে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিলো। তারপর আলতো করে মায়রার মুখে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে ডাকলো।

-মায়রা? উঠো না?

সীমান্তের ডাক শুনে মায়রার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলে চট করে উঠে বসলো মায়রা। 

-জি?

-এখানে ঘুমিয়েছিলে কেন রাতে? ঠান্ডা লাগানোর শখ হয়েছে খুব? ঠান্ডা লাগিয়ে পরে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পড়ে থাকতে?

-সরি---। তবে অসুস্থ হয়ে আপনার বিপদ বাড়াবো না-। ভয় পাবেন না।

-দেখেছ? আবার তেড়ামো শুরু করে দিয়েছ? আমাকে না রাগালে হয় না তোমার?

-----------------------

-আচ্ছা--। বাদ দাও। এখন উঠো? ফ্রেশ হয়ে নাও প্লিজ--। আর শোনো? সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো কেমন? সারপ্রাইজ আছে---।

মায়রা কিছু না বলে এক মিনিট সীমান্তের মুখের দিকে তাকালো। সীমান্তের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি খেলা করছে। সেটা তাচ্ছিল্যের নাকি বিরক্তির নাকি সত্যিকারের হাসি সেটাই বুঝতে পারছে না মায়রা৷ অবশ্য খুব যে বোঝার চেষ্টা করছে তাও নয়৷ সীমান্ত আরেকবার হেসে উঠে দাঁড়িয়ে মায়রাকে টেনে তুললো। তারপর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। মায়রা ভ্যাবাচ্যাঁকা খেয়ে সীমান্তের দিকে তাকালো। সীমান্ত মায়রার মুখটা দু হাতে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।

-আজকে না খেয়েই অফিসে যাচ্ছি। আজই প্রথমবার আর আজই শেষবার। কেমন? আর নিজেও না খেয়েই আছো। নিজেও খেয়ে নিবা কেমন? আসছি বউটা। বায়।

সীমান্ত চলে গেলেও মায়রা কিছুক্ষণ  চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ড্রইংরুমেই। কিছুক্ষণ পর উঠে বেডরুমে এসে নিজের ব্যাগ গোছানোয় মন দিলো মায়রা৷ এই বাসাটায় আর একটা সেকেন্ডও থাকতে ইচ্ছে করছে না মায়রার৷ অন্তত গতকালের ঘটনাটার পরে তো নয়ই। ব্যাগ গোছানো শেষ হলেই নিজের পার্স আর ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো মায়রা। দরজাটা লক করেই বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো মায়রা৷ এই সমস্ত টানাপোড়ন থেকে ওর কিছুক্ষণের জন্য ছুটি চাই। অন্তত নিজের জন্য হলেও কয়েকটা দিন এই বাড়ির, এই মানুষটার দুমুখীতার থেকে দূরে থাকা দরকার। 

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে কয়েকবার কলিংবেল বাজাতেও মায়রা দরজা খুলছে না দেখে সীমান্ত বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে বাসায় ঢুকলো।

-মায়রা? কি এমন করছো যে দরজা খোলার সময় পর্যন্ত পাচ্ছ না? মায়রা? মায়রা?

সীমান্ত কথা বলতে বলতে বেডরুমে এসে মায়রাকে না দেখে রান্নাঘরে এসেও মায়রাকে না পেয়ে আবার বেডরুমে ফিরে এলো। মায়রাকে সারা বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে সীমান্তর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মায়রা কোথায় গেছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না সীমান্তের। ব্যাগ রেখে গাড়িতে গিয়ে বসলো সীমান্ত। ফুল স্পিডে গাড়ি স্ট্যার্ট দিয়ে আবার চোয়াল শক্ত করলো সীমান্ত। এই কাজটার জন্য কি শাস্তি অপেক্ষা করছে মায়রার কপালে সেটা কেবল সীমান্তের মনেই আছে। এমন শাস্তি দিবে মেয়েটাকে যাতে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা আর কল্পনাতেও কখনো না ভাবে। 

এদিকে মায়রা বিকেলেই বাড়ি ফিরে নিজের পুরোনো রুমটায় এসে দরজা আটকেছে। মা কয়েকবার করে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। মায়রা সেসবের উত্তর না দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সীমান্ত বাসায় ফিরে এসে কি করবে সেটা নিয়ে মায়রার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। ওর মনের কোণে অন্য একজনের নাম ঘুরঘুর করছে। মানুষটাকে দেখে না মায়রা বহুদিন। একটা বার মানুষটার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত শোনা হয় নি এতোগুলো মাস ধরে। চাইলে যে মানুষটার গলাটা শোনা যেত না তেমনটাও নয়। কিন্তু মায়রা আর নিজের আর আয়ান দুজনের জন্যই পরিস্থিতিটা আরো ঘোলাটে করতে চায় নি। কি হবে কথা বলে? ও তো অন্য কারো সম্পত্তি হয়ে গেছে। আর আয়ান? সে হয়তো মনে প্রাণে ঘৃণা করে মায়রা নামটাকেও। 

আয়ানের কথা ভাবতে ভাবতে আর কাঁদতে কাঁদতেই কখন ঘুমিয়ে গেছে মায়রা। হঠাৎ দরজার নকের শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসলো মায়রা। কোথায় আছে সেটা বুঝতেই কিছুক্ষণ লাগলো ওর। নিজের রুমটা চিনতে পেরে উঠে এসে দরজা খুলে দিলো। মায়ের থমথমে মুখটা দেখে মায়রা সরে এসে আবার রুমে ঢুকে পড়লো। 

-বলো মা? কি হয়েছে? ডাকছিলে কেন?

-রাত অনেক হয়েছে মায়রু। খেয়ে নে। তারপর ব্যাগপত্র গোছা--। 

-ব্যাগ গোছাবো মানে?

-সীমান্ত তোকে নিতে এসেছে---।

-হ্যাঁ--তো? আমি আজই বিকেলে এলাম বাড়িতে। আর তুমি এখন বলছ ও নিতে এসেছে তাই চলে যাবো? না মানে? নিজের বাড়িতে এসেছি তো আমি? 

-মায়রা? তুই রাগ করে এসেছিস আর ছেলেটা নিজের কাজ ফেলে তোকে নিতে এসেছে--।

-নিতে আসলেই আমাকে যেতে হবে মা? ওই রকম একটা মানুষের সাথে থাকা যায়? যার কাছে আমার দু পরসার মূল্য নেই---। আরে মানুষ তো কুকুর বেড়ালের সাথেও এর চেয়েও ভালো ব্যবহার করে--। ও কি করেছে তুমি জানো?

-কি করেছে? মেরেছে তোকে? নাকি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে? কি করেছে বল?

-মা? হাতে মারাই কি সব? নাকি বাড়ি থেকে বের করে দিলেই সেটাকে শুধু অপমান বলে? লোকটা যে আমাকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর যন্ত্রণা দিচ্ছে সেটা কিছু না? নিজের দিকে তাকাতে আজকাল ঘৃণা হয় আমার মা। তারপরও তুমি----।

-শোন মায়রা। এমন ছোটখাটো রাগারাগি, কথা কাটাকাটি, মন কালাকালি সব সংসারেই হয়। তুই নিজেই ছেলেটার সাথে মানিয়ে নেয়ার সামান্য চেষ্টাটুকুই করছিস না। কেন রে? আয়ানকে ভুলে নিজের স্বামীর দিকে মন দিলে তবে তো --।

-মা?

-শোন মায়রা। তোর শ্বশুরবাড়ি থেকেও অনেক কথা শুনেছি। লজ্জায় তো আমার মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা--। তবুও যে ছেলেটা এতোরাতে তোকে নিতে পাগলের মতো ছুটে এসেছে সেটাই তো আমাদের চৌদ্দ গুষ্ঠির ভাগ্য। তাড়িয়ে না দিয়ে ওরা তোকে মাথায় তুলে রাখতে চাইছে। আর তুই কিনা?

-মা? আমি কি এমন করেছি যে তোমাদের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে? বলবে প্লিজ?

-কি করেছিস জানিস না তুই? আমার জবান লড়াস নিজের মায়ের সাথে? শোন মায়রা। তোর বাবা বলে দিয়েছে জামাইয়ের সাথে বেড়াতে আসবি এ বাড়িতে। মেয়ে আর জামাই দুজনেরই যোগ্য সম্মানটা করার চেষ্টা করবো আমরা৷ কিন্তু এটা ভাবিস না তুই যে রাগ করে বা ঝগড়া চলে আসবি, আর আমরাও তোকে সেটায় সাপোর্ট করবো--। 

-সীমান্ত কি বলেছে তোমাদেরকে? 

-যা সত্যি তাই বলেছে জামাই আমাদেরকে। তুই এখন ওর সাথে ফিরবি ঢাকায়। এটাই শেষ কথা। তোর বাবা আর জামাই দুজনকেই খেতে দিয়েছি--। তুইও এসে খেয়ে নে। তারপর রেডি হয়ে নে---। সীমান্ত অপেক্ষা করছে----।

-আমার খিদে মিটে গেছে মা। তুমি তোমার জামাইকেই আদর করে খাওয়াও। আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। তোমাদের বাড়িতে যে আমার জায়গা হবে না সেটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য থ্যাংকস মা--। 

-মায়রা? 

খাবারঘর থেকে মায়রার বাবার ডাক ভেসে আসছে শুনে মায়রার মা আর দাঁড়ালেন না। মা বেরিয়ে যেতেই মায়রা নিজের মুখটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তারপর ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ততক্ষণে সীমান্তের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। মায়রাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সোফা ছেড়ে।

-মায়রা? তুমি কি কয়েকটা দিন থাকবে? আমি পরে এসে নাহয়---?

-তার আর দরকার নেই। চলো? আমি রেডি----। আসছি বাবা। আসছি মা---।

সীমান্ত একবার মায়রার থমথমে মুখটা দেখে নিয়ে এগিয়ে এসে মায়রার বাবা আর মাকে কদমবুসি করে উঠে দাঁড়ালো। মায়রার বাবা মা দুজনেই সীমান্তের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর মায়রার বাবা মায়রার মাথায় হাত রেখে একবার হাত বুলিয়ে দিলেন।

-মা মায়রা৷ ছোটখাটো ঝামেলা সব সংসারেই হয়। তাই বলে কি এমন নিজের সংসার ফেলে চলে আসতে হয় মা? রাগ হলে নিজেদের মধ্যে কথা বলে ব্যাপারটা ঠিক করে নাও। এমন পরিবার পর্যন্ত কথা টানা কি ঠিক বলো মা? আর তুমি তো আমার লক্ষী মা। তোমাকে আলাদা করে বোঝানোর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। মন দিয়ে সংসার করো মা। কেমন?

মায়রা বাবার কথায় মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে সীমান্তের গাড়িতে গিয়ে বসলো। ব্যাগটা পিছনের সিটে রেখে সামনে এসে বসে পড়লো চুপ করে। সীমান্ত আরো কিছুক্ষণ শ্বশুর শাশুড়ির সাথে কথা বলে এসে গাড়িতে বসলো। মায়রার দিকে এক নজর তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো সীমান্ত। গন্তব্য ঢাকায় ওদের বাসায়। যে বাসাটা থেকে কয়েকটা দিনের ছুটি চেয়েছিল মায়রা৷ ২৪ টা ঘন্টা পার হওয়ার আগেই সেখানেই ফিরতে হচ্ছে ওকে। একেই হয়তো বলে পরিহাস। বিধাতার পরিহাস।

১০!! 

সারাটা রাস্তা মায়রা সীমান্তের সাথে একটা কথাও বলেনি। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই এক সময় ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। আর সীমান্তও চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় ফিরার পথ ধরলো৷ বাড়ির সামনে পোঁছাতে পোঁছাতে ঘড়িতে রাতের তিনটা বাজে। সীমান্ত বাড়ির গ্যারেজে গাড়িটা পার্ক করে এসে মায়রার দিকে গাড়ির দরজাটা খুলে দিলো। তারপর আলতো করে মায়রার গালে হাত ছুঁইয়ে ডাকলো।

-এই মায়রা? উঠো? বাসায় চলে এসেছি তো? এই মায়রা? মায়রা?

সীমান্তের ডাক শুনে মায়রা চোখ মেলে তাকিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নামলো। সীমান্ত মায়রার ব্যাগটা হাতে নিয়ে মায়রার পাশে পাশে এগিয়ে গেল বাসার দরজার দিকে। মায়রা দরজটার সামনে এসে দাঁড়াতেই সীমান্ত মায়রার পাশে দাঁড়িয়ে চাবি দিয়ে দরজাটা খুললো। মায়রা ঘরে ঢোকার পরেই সীমান্তও ঢুকলো বাসায়। তারপর হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো। মায়রা ঘুরে রুমের দিকে পা বাড়াতেই সীমান্ত মায়রাকে টেনে নিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। হঠাৎ সীমান্তের এমন ব্যবহারে চমকে  গেল মায়রা৷ আর সীমান্তের চোখে চোখ পড়তেই আরো একবার আঁতকে উঠলো মায়রা। মানুষটার চোখে মুখে একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠেছে দেখেই ভয় হতে লাগলো মায়রার। অজান্তেই ঢোক গিললো মায়রা। 

-তোমাকে আমি যাওয়ার সময় কি বলেছিলাম মায়রা? বলেছিলাম রেডি হয়ে থাকতে। তাই না? কিন্তু তুমি কি করলে? পালাতে চাইলে আমার কাছ থেকে? খুব সাহস বেড়েছে না তোমার? মাহিবদের সাথে যেতে মানা করেছি বলে একা একাই বাড়ি চলে গেছ? এতো সাহস তোমার? 

-ছাড়ো সীমান্ত---। লাগছে আমার। 

-লাগছে না? আজ তোমাকে তো আমি অবাধ্য হওয়ার শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো। পরের বার আমার কথার অবাধ্য হওয়ার ফল কি হয়---।

-লাগছে আমার--। ছাড়ো--প্লিজ?

-ছাড়বো? হ্যাঁ ছাড়বো তো--। আগে নিজের জেদের শাস্তিটা তো ভোগ করো--। তারপর তো ছাড়বো তোমাকে--।

মায়রা কিছু বলার চেষ্টা করতেই সীমান্ত মায়রাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বেডরুমের বিছানার উপরে ছুঁড়ে ফেললো। মায়রা কিছু বুঝে উঠার আগেই সীমান্ত নিজের কোমড় থেকে বেল্টটা খুলে নিয়ে মায়রার পিঠে কষিয়ে কয়েক ঘা মারলো। মায়রা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। সীমান্ত ইচ্ছে মতো চামড়ার বেল্ট দিয়ে মায়রাকে পেটালো। তারপর রাগে বেল্টটা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে বিছানার উপর থেকে মায়রার হাত চেপে ধরে টেনে উঠিয়ে বসালো। মায়রা ব্যথা সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেললো। সীমান্ত দাঁতে দাঁত চেপে মায়রার গাল টিপে ধরলো। 

-আর কখনো আমার কথার অবাধ্য হওয়ার চিন্তা মাথায় আসলেও আজকের দিনটার কথা মনে করো কেমন মায়রা? তাহলে আশা করি আর আমাকে না বলে বা আমার কথার বাইরে কিছু করার সাহস তোমার হবে না---। 

-তুমি!! তুমি এসব করে-কি প্রমাণ করতে চাইছো সীমান্ত?

সীমান্ত ঠোঁটের কোণে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে মায়রার পাশে হেলান দিয়ে শুয়ে মায়রার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে আসলো।

-কিছুই প্রমাণ করার নেই আমার মায়রা। আমি তোমাকে নিয়ে তোমার সাথে নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। বেশি কিছুই চাই না তো আমি। আমি চাই তুমি শুধু আমার মতো থাকবে। আমার কথা শুনবে। আমি চাইলেই আমার কাছে ধরা দিবে, আমি চাইলেই---।

-আমাকে কি তোমার পুতুল মনে হয়? যে তুমি যা চাইবে আমি তাই করতে বাধ্য হবো--।

-১০০ বার বাধ্য তুমি। হাজার বার বাধ্য---। আমার সাথে আর কখনো উঁচু গলায় কথা বলার চেষ্টাও করবে না মায়রা৷ কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। নইলে পরিণাম এর চেয়েও ভয়ংকর হবে----।

----------------------

-এখন মায়রা সোনা-। আই ওয়ান্ট ইউ রাইট নাউ---। আমার আজকের রোমান্টিক প্ল্যানটার বারোটা বাজিয়েছ তুমি--। কিন্তু তুমি তো আমার একটা মাত্র লক্ষী বউ। তাই মাফ করে দিলাম। তবে আজকের পর যেন এমনটা কখনো না হয়---। 

-ছাড়ো--। ব্যথা পাচ্ছি আমি---।

-ইশ!! খুব লেগেছে না? আম সরি বউটা৷ এখনই সেরে যাবে-। আদর করে দিচ্ছি কেমন? সরি?

সীমান্তের কথাটা শেষ হতেই কাঁধে আলতো হাতের স্পর্শ অনুভব করতে পারলো মায়রা। সীমান্ত পরম স্নেহে মায়রাকে নিজের একদম কাছে টেনে নিয়েছে। তারপর কাঁধের উপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আলতো করে। মায়রা নিজের দাঁতে ঠোঁট কামড়ে পড়ে রইলো চুপচাপ। আর সীমান্ত! সে নিজের মতো করে মায়রাকে নিয়ে মেতে রইলো। 

সকালের আলো ফোটার পরপরই মায়রা বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি নিয়েই সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। তারপর শাওয়ার ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। আজ পর চোখ দিয়ে আর কান্নার জল গড়াচ্ছে না। শাওয়ারের পানি লেগে বেল্টের আঘাতের ক্ষতে চিনচিনে একটা ব্যথা জাগছে মায়রার। সেটা অবশ্য আর গায়ে লাগছে না মায়রার৷ চুপচাপ এক বিন্দু চোখের পানি না ফেলেই শাওয়ার নিলো মায়রা। তারপর ভেজা শাড়িটা পাল্টে সেটা ধুয়ে দিয়ে গুছিয়ে সাথে আনা শাড়িটা পড়ে নিলো। তারপর ভেজা চুলগুলোকে শুকনো গামছায় জড়িয়ে নিয়ে ভেজা শাড়িটা বারান্দায় শুকাতে দিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো। বেশ সুন্দর করে নাস্তা রেডি করলো সীমান্তের আর নিজের জন্য। 

মায়রার নাস্তা রেডি করা শেষ হওয়ার আগেই সীমান্তের ঘুম ভেঙ্গেছে। সীমান্ত রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মায়রার কাজ করা দেখলো। তারপর গিয়ে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে ডাইনিং রুমে এলো। মায়রা ততক্ষণে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে দেখে আলতো হাতে মায়রাকে নিজের পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো সীমান্ত। 

-রাতের ব্যবহারটার জন্য আম সো সরি মায়রা। আসলে এতো রাগ উঠে গেছিলো-যে সামলাতে পারি নি--। 

-----------------------

-সত্যি সরি মায়রা--। তুমি এভাবে চলে না গেলে হয়তো গতকাল সন্ধ্যেটা আমাদের অন্যরকম কাটতো--। 

-তুমি সরি বলছো কেন? দোষটা তোমার ছিল না। দোষ আমার ছিল। আমিই গাধার মতো----। বাদ দাও। যেটা করে ফেলেছি সেটা বদলাতে তো আর পারবো না। তাই নিজ কাজের ফলটাই না ভোগ করি।

-হোয়াট?

-কিছু না। তোমার দেরি হয়ে যাবে তো অফিসের। খেয়ে নাও?

-হুম----। তুমিও খাও। আর আসার সময় ওষুধ নিয়ে আসবো। 

-লাগবে না। আমি ঠিক আছি।

-রাগ করে বলছো জানি। কিন্তু আগেই বলেছি। আমার জেদটা উঠিয়ো না। কিন্তু----। হাহ। বাদ দাও। যা হয়েছে হয়েছে। এসব নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো হবে।

-হুম--। 

মায়রাও আর কথা বাড়ালো না। কথায় আছে যার যাওয়ার জায়গা আছে সেই গলা উচিয়ে কথা বলতে পারে। যার নিজের বাবার বাড়িতে গিয়ে একবেলা মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়না তাে স্বামীর এমন হাজার ঝাঁটার বাড়ি মুখ বুজে তো হজম করতেই হবে। ভুল তো মায়রা করেছেই। মস্ত বড় ভুল। এমন একটা মানুষকে ছেড়ে আসার ভুল যে কিনা নিজের সর্বস্ব দিয়ে মায়রাকে আগলে রাখতে চেয়েছিল সমস্ত বিপদ আওদ থেকে। এতো বড় ভুলের জন্য এই সামান্য শাস্তিটা তো মায়রার পাওনা ছিলই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মায়রা একটু একটু করে নাস্তা মুখে পুরে চিবাচ্ছে। গলা দিয়ে নামতে চাইছে না খাবারটুকু। তবু নিজের সাথে লড়াই করেই খাবারটুকু গিলে ফেললো মায়রা৷ বেঁচে থাকার জন্য এসব সয়ে তো নিতেই হবে ওকে। এ আর এমন কি!

-এই মায়রা? কোথায় হারালে?

-হুম?

-শরীর বেশি খারাপ করছে? 

-নাহ----। 

-আচ্ছা--। রেস্ট করো। আমি খাবার অর্ডার করে দিবো। বাসায় দিয়ে যাবে--।

-না না। লাগবে না আমি করে নিতে পারবো--। তুমি যাও। 

-হুম। বেশি সমস্যা হলে কল করো। আমি চলে আসবো নাহয় হাফ টাইম নিয়ে--।

-আচ্ছা। ঠিক আছে--। 

-ওকে বায় বউটা--।

সীমান্ত কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে থেমে এলো। মায়রাও সীমান্তের পিছু পিছু আসছিলো দরজা বন্ধ করতে। সীমান্ত দাঁড়িয়ে যাওয়ায় মায়রাও চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। সীমন্ত মায়রার দিকে এগিয়ে এসে আলতো করে বুকে টেনে নিলো।

-সরি? আর সত্যি এমন হবে না। 

-তুমি--। তোমার দেরি হচ্ছে--।

-আচ্ছা--। বাসায় এসে তারপর দেখছি ব্যাপারটা। এখন আসি? সাবধানে থেকো--।

-হুম---।

সীমান্তের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মায়রা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসে টেবিলে থাকা নিজের প্লেটের খাবারটুকু ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। তারপর দুপুরের খাবারের জোগাড় করায় মন দিলো। কি রান্না করা যায় সেটাই ভাবছে মায়রা। নিজের জীবনটা নিয় আর কিছুই ভাবার নেই মায়রার। কেনইবা ভাববে!?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন