০১!!
"দেখুন! আমার এই বিয়েতে মত নেই৷ আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি একজনের সাথে গভীর সম্পর্কে লিপ্ত আছি। ইভেন তার অংশ আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে।"
কথাটা বলে আমি হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকসের স্ট্রো-টা ঘুরাতে থাকি আর আড়চোখে সামনে বসে থাকা ব্যক্তিটির দিকে তাকাতে থাকি। বুঝার চেষ্টা করি তার প্রতিক্রিয়া। আমি যে মাত্র তাকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা জানালাম আদৌ কি সে আমার কথা শ্রবণ করেছে কি না সন্দেহ। কেন না সে দিব্বি ফোন গুতিয়েই চলেছে। তার মধ্যে কোন ভাবান্তর এই নেই। মনে তো হচ্ছে যে এই মোবাইল গুতানো ছাড়া এই পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর দুটো নেই। অথচ তার জায়গায় এখন অন্য কেউ থাকলে নির্ঘাত হার্ট ফেল করতো। আমি এক রাশ বিরক্তি আর হতাশা নিয়ে কোল্ড ডিংক্সের স্ট্রো-টা চিবুতে শুরু করি আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রই। মিনিট দুই-এক এর মাঝেই সে মোবাইলটা অফ করে নিজের পকেটে ভড়ে নেয়। বা হাত দিয়ে নিজের চুল ঠিক করে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে উঠে,
-- তা আজ হলুদের দিন এসে কথাটা বলার কারণ?
কথাটা শুনে আমি মুখ থেকে স্ট্রো-টা সরিয়ে নেই। একটু নড়েচড়ে বসে চেহেরায় মলিন ভাব এনে বলি,
-- সময় ও সুযোগের অভাবে আগে বলতে পারি নি। আজ কোন মতে পার্লারে যাওয়ার নাম করে এইখানে এসেছি আমি।
আমার কথাটা শুনে তার ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। সে দৃঢ় গলায় বলে,
-- তা এখন আমি কি করতে পারি?
-- আমি চাই আপনি বিয়েতে নাকচ করে দিন। মানে আপনার পক্ষ থেকে বিয়েটা ভেঙ্গে দিন।
সে ভ্রু কুঁচকে রেখেই জিজ্ঞেস করে,
-- আর আমি তা কেন করবো?
তার কথা শুনে আমি বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। এমন এক ফালতু প্রশ্ন করার জন্য মনে মনে শ'খানেক গালিও দিয়ে ফেলি।কর্কশ কন্ঠে বলে উঠি,
-- আপনি কি বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা? আমি অন্য কাউকে ভালবাসি। আপনার ধারণারও বাইরে যে আমাদের সম্পর্কটা আসলে কতটা গভীর।
-- সেটা কি আমার ধারণা করার কথা?
-- না! আপনার ধারণা করার কথা না। কিন্তু তাও আমি আপনাকে ধারণা দিতে চাচ্ছি৷ আমার ফ্যামিলিকে আমার সম্পর্কে জানানোর আগেই তারা আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে এবং তখন চেয়েও আমি কিছু বলতেও পারছিলাম না। সবকিছু এত দ্রুত হচ্ছিল যে আমার কি করা উচিৎ তা বুঝে উঠতে সময় লেগে যায় আর বিষয়টা এত দূর এগিয়ে যায়।
কথাটা বলে আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। মনে মনে, দোয়া-দরুদ পড়তে থাকলাম যাতে ব্যাটা আমার কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নেয়। কিন্তু হ্যায় ভাগ্য! সে তো আমার দিকে এখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন সে আমার কথায় বিন্দু মাত্র বিশ্বাস করে নি। সে কিছুক্ষণ আমার মুখ পানে চেয়ে থেকে হঠাৎ 'চ' শব্দ উচ্চারণের মত করে উঠে। বা হাত দিয়ে নিজের কপালের কিনারা ঘষতে ঘষতে বলে,
-- অহ আচ্ছা।
আমি তার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলি,
-- অহ আচ্ছা কি?
সে হঠাৎ সোজা হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-- তা তোমার এই প্রেমিক পুরুষের নাম কি?
তার এমন প্রশ্ন শুনে আমি ভড়কে খেয়ে যাই। আমি আমতা আমতা সুরে বলি,
-- ইয়ে মানে..
হঠাৎই যেন মস্তিষ্ক একদম ফাঁকা হয়ে যায়। মনের মধ্যে হাজার জোর দিয়েও কোন ভালো নাম খুঁজে বের করতে পারলাম না। হঠাৎ একটা ওয়েটারের নেম প্লেটের দিকে নজর যেতেই আমি চট করে বলে উঠি,
-- সাব্বির! আমার প্রেমিক পুরুষের নাম সাব্বির।
কথা বলে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে,
-- অহহ আচ্ছা। তা তোমার কি আর কিছু বলার আছে?
আমি সোজাসাপটা উত্তর দিয়ে বলি,
-- না নেই।
-- ওকে দ্যান। আমার কাজ আছে বায়।
বলেই সে উঠতেই নিলে আমি চট জলদি বলে উঠি,
-- আরেহ আমার উত্তর? দেখুন আপনি কিন্তু আমার শেষ ভরসা। আপনার উপর কিন্তু এখন চার চারটা জীবন নির্ভর করছে৷ দেখেন এই বিয়ে হলে কিন্তু আমি আপনি কেউ এই সুখী হবো না৷ তার উপর আমার করা এই পাপের দায়ভার আপনি কেন নিবেন?
সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
-- কে বলেছে তোমাকে আমি কোন পাপের দায়ভার নিচ্ছি?
কথাটা শুনে আমি একটু উৎফুল্ল সুরেই বলে উঠি,
-- তার মানে আপনি এই বিয়ে করছেন না তাই না?
সে বাঁকা হেসে বলে,
-- বিকেলে উত্তরটা পেয়ে যাবে।
আমি চটজলদি বলে উঠি,
-- আপনার নিকট আরেকটা রিকুয়েষ্ট। আমাদের যে দেখা হয়েছে আর এতক্ষণ যাবৎ ধরে যা যা কথা হয়েছে তা যেন আমার বাসার কেউ না জানে।
সে আবার তার সেই বিখ্যাত ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রয়। অতঃপর ছোট করে 'হুম' বলে সে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে যায় আর আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেই। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে দীর্ঘ হাসি। অতঃপর মনে মনে বলে উঠি,
-- কি ভাব রে ভাই। ভাব দেখলে বাঁচি না।
কথাটা,ভেবে যেই না ভেংচি কাটতে যাব ঠিক এমন সময় হৃদি আপু আমার পিঠে এক চাপড় মেরে বলে,
-- এই মেয়ে! এই বাচ্চা কোথ থেকে লডিং হলো?
আমি চোখ মুখ কুঁচকে হৃদিপুর পিঠেও চাপড় মেরে বলি,
-- প্লে-স্টোর থেকে। তুমি উৎসাহ দিলে ঠুস করে ডাউনলোড ও করে ফেলবো।
হৃদিপু আমার পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-- আস্তাগফিরুল্লাহ!
কথাটা শুনে আমি হেসে ফেলি। আমার সাথে তাল মিলিয়ে হৃদিপুও হেসে উঠে। কিছুক্ষণ পর হৃদিপু বলে উঠে,
-- তা কি মনে হয়? বিয়েটা ভাঙ্গবে তো?
আমি নিশ্চিন্তে বলি,
-- না ভেঙ্গে যাবে কই?
হৃদিপু একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন,
-- কিন্তু পোলা তো কোন রিয়েকশনই দিল না। আমার জানা মতে হলুদের দিন এসে নিজের হবু বউয়ের মুখ থেকে এইসব শুনার পর কোন ছেলের এই ঠিক থাকার কথা না কিন্তু এইখানে তো সে ঠান্ডা মাথায় বসে ছিল। আচরণ অতি স্বাভাবিক ছিল। তাই কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।
-- আরেহ ধুর! পোলা হয়তো শোকডের ঠ্যালায় কোমাতে চলে গেসিল। তাই রিয়েকশন দিতে ভুলে গেসিল হয়তো। হয় এমন ব্যাপার না।
-- বাই দ্যা রাস্তা পোলাটা কিন্তু কিউট ছিল সিয়া। শ্যামলা হলেও দেখতে কিন্তু সেই। চাইলে বিয়েতে রাজী হলেই পারতি।
কথাটা শুনে আমি রেগে গিয়ে বলি,
-- আপু তুমি জেনে শুনে এইসব কেন বলছো? তুমি ভালো করেই জানো আমি এখন বিয়ে করতে রাজী না। এই বিয়ে নামক প্যারায় আমি এখন জড়াতে চাই না। তার উপর আমার যে কিছু মানুষদের প্রুভ করার আছে।
হৃদিপু আমার একপাশ জড়িয়ে ধরে বলে,
-- আই নো মাই বইনা। চিন্তা করিস না সব ঠিক হবে। শুধু এখন আল্লাহ এর কাছে দোয়া কর পোলাটা যাতে বাসায় কিছু না জানায়। নাহলে চাচ্চু তোকে...
আমি হৃদিপুকে বলতে না দিয়ে বলি,
-- তেমন কিছুই হবে না আপু। আর যদি হয়ও তাহলে বড়োজোর কি হবে? মারবে বা বকবে। ব্যাপার না।
-- মন খারাপ করিস না।
-- করছিও না।
হৃদিপু আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার ফোন বেজে উঠে। হৃদিপু ফোনের দিকে তাকাতেই জিভ কেটে বলে,
-- উপস! চাচী আবার ফোন দিয়েছে। এই সিয়া চল! চল! এইভাবেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
আমি ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলি,
-- হুম চলো।
______________________
"তোমার ভাঙ্গা গাড়িতে আমি যাব না
কারোর ঘরের ঘরণী আমি হব না
করব না তো কোনদিন ও বিয়ে"
বাসায় ঢুকতে ঢুকতে এই গানটা গুন গুন করে গাইছিলাম ঠিক এমন সময় কর্কশ এক কন্ঠে কানে এসে বারি খায়।
-- বিয়া করবি না তো কি আমার পোলার ঘাড়ে বইসা বইসা ওর জীবন নড়ক করবি? আমার সংসার তো ধ্বংস করসোস এই, এইবার তো রেহাই দে আমগো। আর কত করবি? এইবার বিদায় হ।
কথাটা শুনে আমি থমকে যাই। পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি সোফায় পায়ের উপর পা তুলে নাসরিন বেগম পান কাটছেন আর কর্কশ কন্ঠে আমায় কথাগুলো বলছেন। আমি দুই পা এগুতেই নিলেই হৃদিপু আমার হাত টেনে ধরে। আমি একবার হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলি,
-- কেন আমাকে দেখি আপনার পিত্তি জ্বলে নাকি? জ্বলে বলুন তাতে আরেকটু ঘি ঢেলে দেই। আর এইটা আমারও বাড়ি আর আমার বাড়িতে আমি থাকবো কিনা সেটা আমার ব্যাপার।
নাসরিন বেগম তেতে উঠে বলে,
-- মুখে মুখে আবার কথা কস। দেইখা যা ওসমান! দেইখা যা! তোর মাইয়ার কান্ড দেখে যা। অপয়া তো ছিল এখন নির্লজ্জ,বেহাইয়াও হইসে।
নাসরিন বেগমের চিৎকার শুনে রুম থেকে আম্মু, রেহানা চাচী আর মালিহা ফুপু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রুম থেকে বড় বাবাও বেড়িয়ে আসে। তার পিছু পিছুই নিজের চশমা ঠিক করতে করতে বাবা বেড়িয়ে আসে। সবাই একসাথে জড়ো হতেই বাবা কঠোর গলায় নাসরিন বেগমকে জিজ্ঞেস করে,
-- মা কি হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?
নাসরিন বেগম ন্যাকা কান্না জুড়ে দিয়ে বলে,
-- দেখোস না তোর মাইয়া আমার লগে কেমনে কথা কয়। আমার মুখে মুখে তর্ক করে।
বাবা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
-- এইসব কি?
আমি কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। হৃদিপু পিছন দিক দিয়ে আমায় ইশারা করতে থাকে কথা বলার জন্য কিন্তু আমি আগের ন্যায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রই। বাবা আবার বলে উঠে,
-- কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমায়। এইসব কি হচ্ছে?
আমি তাও কোন কথা বলছি না। নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। তা দেখে বাবা রেগে যায় আর হুংকার দিয়ে আমার নাম উচ্চারণ করে উঠেন,
-- সিয়াশা! কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি তোমায়৷
আমি এইবার বাবার দিকে ঘুরে স্মিত হেসে বলি,
-- যে বিচার দিয়েছে তার থেকেই না হয় পুরো ঘটনাটা শুনে নিন।
বলেই আমি রুমের দিকে এগুতে থাকি৷ আমার পিছু পিছু হৃদিপুও চলে আসে৷ এরই মধ্যে পিছন থেকে নাসরিন বেগম বলে উঠে,
-- দেখছিস মাইয়া কতটা নির্লজ্জ হইসে। বড় গো সামনে কেমনে কথায় কয়। এই অপয়াকে যত দ্রুত সম্ভব বিদায় কর। ছিঃ ছিঃ কি দিন আইলো গো। আগে দেখতাম বিয়ার দিন আইলে মাইয়ারা কাইন্দা কুল পায় না আর এই নির্লজ্জ মাইয়া রে দেখো।
বড় বাবা বলে উঠে,
-- আহা মা! থাম তো। এই রেহানা যাও মায়ের জন্য এক গ্লাস লেবু শরবত নিয়ে আসো।
রেহানা চাচী দৌঁড়ে চলে যায় রান্নাঘরে দিকে লেবু পানি আনার জন্য। রুমে ঢুকার আগে শুধু বাবার কথাটা শুনতে পারলাম,
-- এই মেয়েকে বিদায় করতে পারলে বাঁচি। রোজ রোজ আর তামাশা ভালো লাগে না।
আমি রুমে ঢুকে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে মাথা চেঁপে ধরি। মাথায় আপাতত আগুন ধরে আছে। সবকিছু এখন ভাঙ্গচুর করতে পারলে শান্তি হতো। হৃদিপু আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শান্ত কন্ঠে বলে,
-- তুই কেন দাদীর সাথে লাগতে গেলি আজ? তুই জানিস না সে কেমন?
আমি চোখ খুলে হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে বলি,
-- আর সে যে আমায় বললো তার বেলায় কিছু না? একটা মানুষ আর কত সহ্য করতে পারে আপু? তুমি বলো!
হৃদিপু কিছু বলতে যাবে তার আগেই মা রুমে এসে বলে,
-- সহ্য না হলেও করতে হবে তোকে। আর তুই কেন বার বার তাদের কথা বলার সুযোগ করে দিস বলতো?
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলি,
-- তাদের মুখের বলি কি আর নতুন করে ফুটেছে নাকি?
মা আমার পায়ের কাছে বসে বলে,
-- যেভাবে যা চলছে তা চলতে দে না। কথা কেন বলতে যাস তুই? তুই জানিস না তুই একটা বললে তোকে দশটা কথা শুনানো হবে।
-- তাই বলে কি চুপ করে থাক নাকি?
-- যদি থাকতে হয় তাহলে থাকবি।
আমি এইবার মলিন মুখ করে বলি,
-- মা তুমিও এখন আমায় দূরে সরিয়ে দিচ্ছ?
মা আলতো করে আমার পায়ে বারি দিয়ে বলে,
-- ধুর পাগল! আমি কেন তোকে দূরে সরিয়ে দিব। আমি তো শুধু তোকে বুঝাচ্ছি। মা তো সবসময় তোর ভালোই চায় রে৷ তাই বলছি চুপ থাকতে। আর তো একদিন। এরপর তো চলেই যাবি।
আমি মুখ ফোঁসকে বলে উঠি,
-- আর যদি না যাই?
কথা বলতেই হৃদিপু আমার হাত চেপে ধরে। আমি একবার আপুর দিকে তাকিয়ে মায়ের দিকে তাকাই। মা হালকা হেসে বলে,
-- তখনেরটা তখন দেখা যাবে৷ তা তুই এখন রেস্ট নে। বিকেলে পার্লারের মেয়েরা আসবে তোকে সাজাতে।
কথাটা বলে মা রুম থেকে বেরিয়ে যান। আর আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলি,
-- বিয়েটা তো হচ্ছে না মা।
_______________________
বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা হতে এসেছে। বাসার পরিবেশ এখনো সর্বশান্ত। আমি রুমের ভিতর পায়চারী করছি আর হৃদিপু বিছানায় বসে নখ কামড়াচ্ছে। আমি আর থাকতে না পেরে হৃদিপুকে বলে উঠি,
-- আপু তুমি প্লিজ একবার বাইরে গিয়ে দেখে আসবে? এতক্ষণে তো বাসায় তোলপাড় লেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু কিছু হচ্ছে না কেন?
হৃদিপু তেতে উঠে বলে,
-- এই নিয়ে পাঁচবার ঘুরে আসছি। কোন খোঁজ নাই। আবার বলছিস যেতে তুই? বাইরে যে কত পোলাপান আছে জানিস? চাচ্চুর আমায় এইভাবে ঘুরঘুর করতে দেখলে আমার ইন্না-লিল্লাহ ভাই।
আমি এইবার বিপাকে পড়ে যাই। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঠিক এমন সময় দরজায় কড়া আঘাত পরে। হৃদিপু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। দরজা খুলতে হুর হুর করে দুই-তিনটা মেয়ে রুমের ভিতর ঢুকে পরে এবং তার পিছু পিছুই আম্মু আর রেহানা চাচী রুমে এসে হাজির হয়। তাদের হাতে সাজসজ্জার ডালা। মা আমার সামনে এসে হলুদের লেহেঙ্গাটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-- যা তারাতাড়ি রেডি হয়ে নে। একটু পরই সকল মেহমানরা আসতে শুরু করবে।
০২!!
রুমের অবস্থা নাজেহাল। সবকিছু এলোমেলো অবস্থায় মেঝেতে পরে আছে। দুই এক জায়গায় কাঁচের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুমোট অন্ধকার চারদিকে। আমি বিছানার সাথে লাগানো দেওয়ালে পিঠ করে হাটু গুঁজে বসে আছি। গায়ে এখনো হলুদের লেহেঙ্গাটি জড়ানো। হাতে পায়ে হলুদের ছোঁয়া। কাঁচা ফুলের গহনাও দুই একটা এখনো শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। আর বাদ বাকি সব মেঝেতে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নয়ন দুটি আমার শুষ্কতা বজায় রেখে রক্তিম লাল হয়ে উঠেছে। বাইরে দরজায় একের পর এক কড়া আঘাত পড়ছে। হৃদিপু ডাকছে। কিন্তু সেইদিকে আমার কোন ধ্যান নেই। আমি এক ধ্যান জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। জানালার বাইরে ঝুলানো মরিচ বাতির রঙ্গিন আলোটা চোখে বিঁধছে খুব। যা ক্ষণে ক্ষণে আমার চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মাথার চুল চেপে ধরলাম। সবকিছুই এখন আমার কাছে অসহ্য লাগছে।
কিছুক্ষণ আগেই আমি হলুদের পর্ব চুকিয়ে এসেছি। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সকলের সামনে সঙ সেজে বসেছিলাম। শুধু মাত্র এই আশায় হয়তো এখন খবর আসবে, "পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। এই বিয়ে আর হবে না।" কিন্তু সে গুড়ের বালি। চারদিকে গান-বাজনা। কোলাহলময় পরিবেশ। আত্নীয়স্বজনরা মেতে উঠেছে গল্পে। বাড়ির ছোকরারা ছুটোছুটি করছে এদিক ওদিক। কাজ বুঝাচ্ছে সকলকে। এত কোলাহল,ধ্বনি ও শব্দের মাঝেও আমায় সেই অতি কাঙ্ক্ষিত ধ্বনিটি কেউ শুনাতে পারি নি, যার জন্য আমি চাতক পাখি হয়েছিলাম। হৃদিপু মিনিট দুয়েক বাদেই আশ্বাস দিয়ে গেছেন, "খবর হয়তো এখনই আসবে। তুই চিন্তা করিস না।" তার কথায় আমি একটু ভরসা খুঁজে পেলেও যখন ছেলেপক্ষের সকলকে হাসি মুখে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে দেখলাম তখনই সব ভরসা উবে যায়। নীরব দৃষ্টিতে সব দেখতে থাকি। তারা আসলো হলুদ ছোঁয়ালো, মিষ্টি মুখ করালো,আশির্বাদ করলো। বিয়ের ডালা বুঝিয়ে দিলো। আর আমি! নির্বিকার চেয়ে রইলাম। অতঃপর তারা বিদায় নিতেই আমিও উঠে চলে আসলাম নিচে। পিছু নিলো মা আর হৃদিপু। পিছনে শুরু হলো তথাকথিত সেই আত্মীয়স্বজনদের কানাঘুষা। কিন্তু সে সবে কি আদৌ আমার কিছু যায় আসে? দরজা ভিজিয়ে নিজের ক্ষোভ ঝাড়লাম নিরিহ রুমটির উপর। এরপর নিথর হয়ে বিছানায় বসে পড়লাম।
কথাটা ভেবেই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। গা-টা বড্ড জ্বালা করছে। একেক জায়গা খিঁচে উঠছে। ফ্রেশ হওয়া দরকার। আমি উঠে দাঁড়াই। দরজার অপাশ থেকে শুনা যায় হৃদিপু, মা, চাচী আর ফুপুর আতঙ্কে কম্পিত কন্ঠ। আমি নিজেকে সামলে চেঁচিয়ে উঠি,
-- আমি ঠিক আছি।
কথাটা বলার সাথে সাথেই অপাশটা নীরব হয়ে যায়। হয়তো এতক্ষণ আমার এই "ঠিক আছি" শুনার জন্যই তাদের এত অস্থিরতা। আমি শব্দহীন পায়ে এগিয়ে যাই আলমারিটার দিকে। এক সেট জামা নিয়ে এগিয়ে যাই ওয়াশরুমের দিকে।
___________________
ফ্রেশ হয়ে এসে আমি দরজাটা খুলে দিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়ি। মনে মনে কল্পনা আঁটি কিভাবে এই বিয়েটা বন্ধ করতে পারি। পালানো সম্ভব না। আর আমি পালাতে চাইও না। কিন্তু এর বাদে উপায়টা কি? যখন আমি এই আকাশ-কুসুম ভাবছি তখন হৃদিপু খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে রুমে আসে। আমার পাশে বসে প্লেটটা বিছানার উপর রেখে আমার হাত দুইটি তার কোলে টেনে বলে,
-- দেখ জীদ করিস না। এখনো সময় আছে। লাস্ট মোমেন্টে এসেও বিয়ে ভাঙতে পারে।
আমি হৃদিপুর দিকে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে বলি,
-- কিভাবে ভাঙ্গবে শুনি? আর কেই বা ভাঙ্গবে বিয়েটা? ওই আমার সো কোল্ড হবু বর নাকি তোমার শ্রদ্ধেয় চাচাজান?
হৃদিপু আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-- আচ্ছা সে সব কথা পরে হবে আগে খেয়ে..
আমি হৃদিপুর কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,
-- কথা ঘুরাচ্ছ কেন তুমি?
হৃদিপু স্থির হয়ে বলে,
-- কথা ঘুরাচ্ছি না। জাস্ট বলছি আগে খেয়ে নে। এইভাবেই তুই দুপুর থেকে কিছু খাস নি। তার উপর তুই তখন ওইভাবে উঠে চলে আসায় মেহমানদের মাঝে কানাকানি শুরু হয়ে গিয়েছে। চাচী কোনমতে বিষয়টা সামলিয়েছে।
আমি মুখ ঘুরিয়ে বলি,
-- এদের তো কাজই অনুষ্ঠানে এসে খুঁত ধরা আর কানাঘুষা করা। এ বাদে তাদের কাজ কি? আজ পর্যন্ত তারা কখনো উপকারে এসেছে? সবসময় তো মানুষের অপকারই করতে জানে এরা। দাওয়াত কেন দেয় এদের? অসহ্য!
হৃদিপু প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলে,
-- পরে এদের গোষ্ঠী উদ্ধার করিস আগে হা কর!
কথা বলে এক লোকমা ভাত আমার মুখের সামনে ধরে। আমি কিছু না বলে খাবারটা মুখে তুলে নেই। হৃদিপু খায়িয়ে দিতে দিতে বলে,
-- বিয়েটা করে ফেললে হয় না সিয়া? এই জেলখানা থেকে যখন মুক্তি পাচ্ছিস তো মুক্ত হয়ে যা না। একটা কারণের জন্য..
আমি আপুর কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,
-- একটা কারণ না আপু। অনেক কারণ আছে। শুনবে? মাস খানেক আগেই তো উনিশে পা দিয়েছি। বয়সের দিকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেও আমি মানসিক দিক দিয়ে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নই। এই সংসার নামক বেড়াজালে নিজেকে আবদ্ধ হওয়ার মনোবল নেই আমার। তার উপর মাস খানেক পরেই আমার এডমিশন এক্সাম। কোন কোচিং ভর্তি হওয়ার আগেই তোমার সো কোল্ড শ্রদ্ধেয় চাচু আমার জন্য ছেলে ধরে বেঁধে নিয়ে আসলো। তাও কি তার কোন বন্ধুর ছেলে। কথা নাই, বার্তা নাই সোজা এসে আংটি পড়িয়ে চলে গেল। আমি নিজেই ঘটনাক্রমে স্তব্ধ ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কি থেকে কি হচ্ছে। এরপরই মধ্যে বিয়ের ডেট ফাইনাল করে দিল। আর দিবেই বা না কেন? কোন ডিমান্ড ছাড়াই ঘাড়ের বোঝা সরাতে পারছে, এমন সুযোগ কি কেউ হাত ছাড়া করে? আর এইদিকে আমি এখনো পর্যন্ত ছেলের নাম আর পেশা বাদে কিছু জানি না। ইজ দিস নট গ্রেট?
শেষের কথাটা একটু ক্রোধেই বললাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি,।
-- এইসব না হয় বাদই দিলাম কিন্তু আমার যে এখনো আসল কাজটাই রয়ে গেসে। আমাকে যে নিজেকে প্রুফ করতে হবে। আর এর জন্য হলেও আমাকে এই বাসায় থাকতে হবে। এট লিস্ট পড়ালেখা শেষ করার আগপর্যন্ত।
হৃদিপু আমার কথা শুনে বলে,
-- সেটা তুই অন্য জায়গায় থেকেও করতে পারবি। দ্যাট ইজ নট এ বিগ ইস্যু। কিন্তু আমার মতে চাচ্চু হয়তো তোর বিয়ে আরেকটু পরে দিত কিন্তু তোর বেপরোয়া ভাবটার জন্যই..
আমি হৃদিপুকে বলতে না দিয়ে বলি,
-- যেই ঘড়ির সুতোর টান ছেড়েই দেওয়া হয়েছে তা কি আর নিয়ন্ত্রণে থাকে?
হৃদিপু দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আমায় খায়িয়ে দিতে থাকে। খাওয়া শেষে আমি পানির বোতলটা নিতে যাব তখনই বাবা এসে আমার রুমে হাজির হয়। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কর্কশ কন্ঠে গর্জে উঠে,
-- নতুন কি তামাশা লাগিয়ে দিয়েছ তুমি?
আমি বাবার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলি,
-- কিসের কথা বলছেন আপনি?
কথাটা শেষ না করতেই পিছনে বড় বাবা,রেহানা চাচী,মা, ফুপু আর নাসরিন বেগম এসে হাজির হয়। বাবা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে,
-- অনুষ্ঠানের মাঝ থেকে উঠে আসার মানে কি? মেহমানেরা কিসব বলছে তার কোন খবর আছে তোমার?
আমি নিজের দৃষ্টি বাবার উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে বলি,
-- খারাপ লাগছিল তাই চলে এসেছি।
আমার কথাটা শুনে নাসরিন বেগম বলে উঠে,
-- খারাপ লাগতাসিল নাকি আমগো অপনাম করবার লিজ্ঞা তুই ওমনেই উইঠ্যা আইসোস? আমাগো কি তুই শান্তি মত বাঁচবার দিবি না? আর কত ধ্বংস করবি আমগো? অপয়া জানি কোনহানকার। আর কত জীবন খাবি তুই?
আমি নাসরিন বেগমের কথা শুনে তেতে উঠি। তীক্ষ্ণ গলায় কিছু বলতে নিব তার আগেই বড় বাবা বলে উঠে,
-- আহা মা চুপ করো তো। বাসা এখনো মেহমানের আনাগোনা আছে। সেদিকে একটু খেয়াল রাখো।
কথাটা শুনে বাবা হেসে বলে,
-- মাকে চুপ করিয়ে কি লাভ ভাইজান। ভুল তো কিছু বলে নি। এই মেয়ে তো সবকিছুর মূলই। আমাকে মাটির সাথে না মিশানো পর্যন্ত ও হাল ছাড়বে না। মুখ তো আমার এইভাবেই রাখেনি। এখন বাদ বাকি যা একটু সম্মান ছিল তাও ডুবিয়ে মারবে এই মেয়েটা৷ সত্যি আজ বলতেও গা ঘিনঘিন করছে এইটা আমার মেয়ে। আসলেই মেয়ে নামে ও কলঙ্ক।
বাবা কথা শেষ করতে মা চেঁচিয়ে উঠে,
-- এইসব কি বলছ তুমি? মাথা ঠিক আছে?
বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-- যা বলছি ঠিকই বলছি। আমার এই কথাগুলো আরও আগে বলা উচিৎ ছিল কিন্তু বলতে দেরি করে ফেলেছি।
-- বেশি বারাবাড়ি করছো কিন্তু তুমি।
নাসরিন বেগম মায়ের উদ্দেশ্যে চড়া গলায় বলে উঠে,
-- মাইয়ার ভালবাসায় অন্ধ হইয়া গেসো নি তুমি? মাইয়ার দোষ আসে জানবার পরও তুমি ওর হইয়া কথা বলার সাহচ দেখাও কেমনে?
বাবা আমার দিকে চেয়ে হাত জোর করে বলে,
-- তোমার সামনে হাত জোর করে বলছি সব সুন্দর মত হতে দাও আর মানহানি করো না আমার। আর মাত্র আজকের দিনটা। বিয়ের পর আমরা আমাদের রাস্তায় আর তুমি তোমার রাস্তায়। এরপর তুমি মরো নাকি বাঁচো সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের শান্তি মত বাঁচতে দাও। আর কোন ঝামেলা করো না। এত অপমান, অপবাদ শুনতে ভালো লাগছে না। নিত্যনতুন তোমার জন্য একেক ঝামেলায় জড়াতে হয় আমাদের। এইবার তো রেহাই দাও।
কথাটা বলে তিনি ক্ষান্ত হোন। আর আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে সকলের মুখে পানে তাকিয়ে আছি। একমাত্র মা ব্যতীত কাউরো চোখে আমার জন্য কোন ভালবাসা নেই। যা আছে তা হচ্ছেএক রাশ বিরক্তি আর ঘৃণা। আমার কানে এখনো বাবার বলা একেকটা কথা প্রতিধ্বনি হচ্ছে। নিজের বিবেক এই বার বার আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে এইখানে পরে থাকার জন্য। নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ মন-মস্তিষ্ক বলে উঠে, "দরকার নেই কাউকে কিচ্ছু প্রুফ করার। এদের কিছুই যায় আসে না সিয়াশা। কিছুই না। তুই চলে যা এইখান থেকে। নিজের জীবন নিজেই গড়ে নে।"
কথাটা মস্তিষ্কে আসতেই মূহুর্তেই তা আমায় নাড়িয়ে দেয়। নিজের ভ্রম ভাঙিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই আমি। নিষ্পলক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলি,
-- আমার বাবা হওয়া সুবাদে আপনার এই ইচ্ছা আমি রাখব। আপনি যা চান তাই হবে। বিয়ে হওয়ার আগপর্যন্ত কোন ঝামেলা হবে না। কিন্তু মনে রাখবেন এইটাই হচ্ছে আমার কাছে আপবার শেষ চাওয়া-পাওয়া। শেষ দেনা-পাওনা। এরপর থেকে আপনার সাথে আমার আর কোন সম্পর্কই থাকবে না। আমার কবুল বলার সাথে সাথেই আপনার সাথে আমার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাব। তাও চিরতরের জন্য।
কথাটা বলে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। আর কারো মুখ দেখার বা কথা শুনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমি এখন নিতান্তই একা থাকতে চাই। একটু শান্তি চাই। তাই কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলাম,
-- সকলের মহান বক্তৃতা শেষ হলে আসতে পারেন। আমি এখন ঘুমাবো। আফটার অল আমি ব্রাইড। কালকে সবচেয়ে সুন্দর আমাকেই লাগতে হবে তাই না? আপনাদের মত মানুষদের জন্য কি আমি এখন না ঘুমিয়ে চোখের নিচে গর্ত করবো নাকি?
আমার কর্কশ কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে সবাই একেক করে চলে যায়। নাসরিন বেগম যাওয়ার আগে আমায় কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে চলে যায়। কিন্তু তার কথা আমলে নেয় কে? সবাই চলে যাওয়ার পর রয়ে যায় শুধু মা আর হৃদিপু। হৃদিপু এতক্ষণ নির্বিকার ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে সাধারণত বড়দের মুখের উপর কথা বলে না। বলতে গেলে সে হচ্ছে এই বাড়ির অতি ভদ্র মেয়ে। আর আমি? আমি তো এই বাড়ির সবচেয়ে অভ্রদ,বেয়াদব,নির্লজ্জ আর ওই যে বুড়ির কথা অনুযায়ী অপয়া মেয়ে। এইতো আর কি?
মা আমায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই আমি বলে উঠি,
-- মা তুমি যাও। তোমার সাথে সকালে কথা হবে। আর হৃদিপু তুমিও চলে যাও। সকালে কথা হবে।
কথা বলেই আমি ধীরে সুস্থে দুইজনকে বের করে দিলাম। অতঃপর দরজা ভিজিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে দিলাম। চোখ প্রচন্ড জ্বালা করছে। মাথাও কেমন ভনভন করছে। ক্লান্ত লাগছে খুব। ঘুমালে হয়তো ভালো লাগবে। অবশ্য আজ আমি শান্তির ঘুম ঘুমাবো। এই রুমে,এই বাসায়,এইখানে আজ আমার শেষ রাত বলে কথা। না ঘুমালে হয় নাকি? আমি ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।হঠাৎ ঘুমে ধরেছে খুব। গভীর ঘুম।