বকুল ফুলের মালা - পর্ব ১৭ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩৩!! 

সাগরের পাড়ে বিশাল পাথরের খন্ডগুলোর উপরে বসে আছে আয়ান। একটু পর পর কান ফাটা গর্জন করে ঢেউগুলো তেড়ে এসে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে গাবার্ডিংয়ের নিচের বেশ অনেকটাই ভিজিয়ে দিয়েছে৷ তবু এই উত্তাল ঢেউগুলো আয়ানকে নিজেদের দিকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। কারণ আয়ানের দৃষ্টি একটা লাল পরীর দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে। টকটকে লাল ফ্লোরটাচ গাউনটার নিচের অংশ পাড়ের বালি আর পানিতে ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গেছে। সেদিকে একদম হুঁশ নেই তার। একটু পর পর গর্জন করে আসা ঢেউগুলো দেখেই দু হাতে গাউনটা একটু উঁচিয়ে ছুট লাগাচ্ছে সে ঢেউয়ের বিপরীতে। মনে হচ্ছে সাগরের ঢেউয়ের সাথেই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। মেয়েটা যে বারবার এই ঢেউয়ের কাছে হেরে যাচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য। আর পায়ের পাতায় ঢেউগুলো আছড়ে পড়লে তার খিলখিল হাসির শব্দে পুরো বীচটা যেন মুখরিত হয়ে উঠছে। আয়ান মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্যই দেখছে। অন্য কিছু আজ তার নজর এই পরীটা থেকে কিছুতেই সরাতে পারবে না। 

-মায়রা? চলো না? অনেক তো হলো? আর কতোক্ষণ?

-আর একটু না প্লিজ? 

-আর একটুও না। আসবে কিনা বলো?

-উঁহু----। এখন যাবো না--।

-থাকো তাহলে। আমি বাবুকে নিয়ে চললাম--। তোমার সাগর প্রেম শেষ হলে রুমে ফিরো--। বায়---।

-আরে?

এতোক্ষণে আয়ানের খেয়াল হলো। সে একা বসে নেই। ছোট্ট একটা পুতুলের মতো বাচ্চা তার কোলে বসা। টকটকে লাল ফ্রক পড়া মেয়েটাকে দেখে একেবারে দেবশিশুর মতো লাগছে আয়ানের কাছে। বাচ্চাটা আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে দেখে আয়ান মেয়েটার সারা গাল চুমোয় ভরিয়ে দিলো। 

-দেখেছিস মামনি? মাম্মাকে বেশি আদর করায় কতো পচা হয়ে গেছে? আজকে আর একটুও আদর করবো না। তুইও আদর দিবি না খবরদার। ওকে?

-ওকে পাপ্পা---।

-চল--। তোর মাম্মা থাক। আমরা রুমে গিয়ে না খেয়েই ঘুমাই। কে আর আমাদের কষ্টটা বুঝবে বল? হাহ-। চল চল---।

-হি হি। পাপ্পা--। চক্কেট---।

-হ্যাঁ রে মামনি--। আজ চকলেট খেয়েই থাকতে হবে। খিদেয় মরে গেলাম৷ তাতে কার কি এসে যায়? চল যাই---।

আয়ান মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করতেই টের পেলো মায়রা আবার গাউন আগলে ছুটে ওদের দিকে আসছে। এক সময় আয়ানের নাগাল পেয়ে আয়ানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো মায়রা। 

-এমন করো কেন? আমি কি সবসময় আসি? কতোদিন পরে এলাম বলো তো? 

-জি---। থাকুন না। মানা করলো কে? 

-ইশ! রাগ করে বললেই হলো? 

-তুমি তোমার সাগরের প্রেমেই হাবুডুবু খাও। আমাদের বাপ বেটির তোমার সাথে আড়ি---। বউ আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে এটেনশন দিবে! উঁহু--। মানি না আমি---।

মায়রার খিলখিল হাসির শব্দে আবার সাগর পাড়ের আকাশ, বাতাস মুখরিত হয়ে উড়লো। মায়রা আয়ানের সামনে এসে মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই বাচ্চাটা 'মাম্মা' বলে মায়রার কোলে লাফিয়ে পড়লো। এবারে আয়ান নিজেও হেসে ফেললো। আলতো করে বাবুটাকে সহ মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। বাচ্চাটা দু হাতে তালি বাজিয়ে খিলখিল করে হাসছে। আর মায়রাও হেসে এক হাতে বাচ্চাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে আয়ানের কাঁধে হাত রেখে আয়ানের মুখের দিকে তাকালো। আয়ানও অপলকে তার লালপরীটার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু পরেই পিচ্চিটা আয়ানের বুকে হাত আছড়ে "পাপা পাপা" করতে শুরু করে দিলো। আর একটু পরেই আয়ানের মনে হলো ডাকটা অস্পষ্ট থেকে আরো অস্পষ্টতর হয়ে যাচ্ছে। যেন অন্য কোন দুনিয়া থেকে আসছে সেই ডাক। আরো একটু সময় পর আয়ানের কানে অন্য কোন শব্দ বাজছে। সেটাও যেন অন্য কোন দুনিয়ার শব্দ। একটু দুর্বোধ্য, একটু অস্পষ্ট, আর একটু চাপা কণ্ঠস্বরের ডাক। তবে কণ্ঠস্বরটা আয়ানের কাছে ভিষণ পরিচিত। কিন্তু এই মূহুর্তে একদমই মনে করতে পারছে না কে ডাকছে। একটু পরে কোথাও কিছুতে আঘাতের শব্দ হলো। আর সাথেই কিছু কথা ভেসে এলো আয়ানের কানে।

-আয়ান---? আয়ান? দরজা খোল? আয়ান?

আয়ান শোয়া থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলো বিছানায়। বুঝতে পারলো এতোক্ষণের পুরো ব্যাপারটাই ছিল ওর স্বপ্ন। দারুণ একটা সুখি পরিবারের স্বপ্ন। যেই স্বপ্নটা যে কোন মূল্যেই বাস্তবে পেতে ইচ্ছে করছে আয়ানের। আরেকবার দরজায় নকের শব্দে চমকে উঠলো আয়ান। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে এসে দরজা খুলে দিতেই আরিশা আর তাওহীদের উদ্বিগ্ন মুখ চোখে পড়লো আয়ানের। আরিশা ঠাস করে আয়ানের হাত থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।

-আরে? মারছিস কেন আরু?

-শয়তান ছেলে--। এতোক্ষণ ধরে ডাকছি। দরজাটা খুলছিলি না কেন? আরেকটু হলে টেনশনে আমি মরে যেতাম---। উফফ---।

-আরে বাবা! একটা কি সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম। দিলি তো মাটি করে? 

-তুই স্বপ্নই দেখ হারামজাদ পোলা। 

-হ্যাঁ রে আরু---। সুখের স্বপ্ন দেখতেও সুখ রে--। আহ! কি দেখেছি জানিস? আমি, মায়রা আর আমাদের পুঁচকে মেয়েকে নিয়ে একটা বীচে----।

-ওই? তোকে আমি বলছি আর তুই কি বকবক করছিস? স্বপ্নের জগত থেকে বাস্তবে আয় বেদ্দপ ছেলে। এদিকে যা হয়েছে তা শুনলে দু মিনিটে মাথা থেকে ভূত নেমে যাবে তোর। 

-এই ভূত এতো সহজে নামবে না রে আরু--। স্বপ্নটা পূরণ না করা পর্যন্ত শান্তি পাবো না---। ওফ!!

-আয়ান? মায়রা চলে গেছে---।

-চলে গেছে? চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে? 

-চট্টগ্রামেই---। মামা মামির কাছে। কতো করে মানা করলাম আমি আর তাওহীদ। শুনলোই না মেয়েটা। তোর জন্য এই চিঠিটা দিয়েই চলে গেছে-।

-আমাকে ডাকবি না তুই একবারও? উফ?

-ডাকবি না তুই না? একটা থাপ্পড় লাগাবো ঠিক কানের নিচে। কতোক্ষণ ধরে ডাকছি সে হুঁশ আছে তোর? থাকবে কি করে? তুমি তো সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে একেবারে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছিলা--। আবার আমাকে বলতে আসছে সে---।

-ওকে বেবি--। কুল কুল। আচ্ছা বাবা সরি--। যদিও তুই ডেকেছিস কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে--। তবু মেনে নিলাম--।

-এই? কি বললি তুই? কি বললি আবার বল?

-কানের ডাক্তার দেখা তো বেডি যা। এখন চিঠিটা দে--। মেয়েটা কোনদিন আমারে পাগল করে ছাড়বে আল্লাহ! উফ!!

-ধর--। তুই একটা ব্যাশকাবিল, তোর মায়রাও আরেক কাবিল। 

-আমরা প্যাকিং করতেসি--। তুইও কর--।

-তাওহীদ ভাই আপনারা ব্রেকফাস্টটা সেরে নিন আগে--। আমি দেখছি ব্যাপারটা--।

-আয়ান? তুই----।

আরিশার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আয়ান চিঠিটা নিয়ে রুমের চলে গেল। আরিশা বিরক্ত হয়ে গটগট করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আর তাওহীদ বেচারা এই দুই বন্ধুর মাঝখানে কাবাব হয়ে কনফিউজড হয়ে ভাবার চেষ্টা করছে এবার কি করবে। 

আয়ান রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মায়রার চিঠিটা খুললো। চিঠিটা মেলে ধরে মুখের কাছে নিয়ে বড় করে শ্বাস নিলো আয়ান। যেন চিঠিতে এখনো মায়রার স্পর্শ আর গন্ধ লেগে রয়েছে। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আয়ান চিঠিটা আবার মেলে ধরে পড়া শুরু করলো।

"আয়ান,

এভাবে হুট করে চলে যাচ্ছি বলে অবাক হয়েছ নিশ্চয়ই? হুট করেই সিদ্ধান্তটা নেইনি। রাতে তুমি যতক্ষণ রুমে ছিলে ততক্ষণ মাথায় একটা কথাই চলছিল। তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু তোমাকে চোখের সামনে এতোটা কাছ থেকে দেখার পরও কি করে দূরে থাকবো বলো? আমি চাইলেও কি তুমি থাকতে দিবে দূরে? না তো। আগের মতো হাত বাড়িয়ে ভালোবাসায় আগলে রাখতে চাইবে তো? কিন্তু সেটা তো সম্ভব না আয়ান। একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকো পা বাড়িয়েছি। সেখানে তোমাকে টানতে পারবো না কিছুতেই। জানি তুমি নিজের সবটা উজাড় করে আমাকে আগলে রাখবে। কিন্তু সব মায়রাদের তো আয়ান থাকে না, তাই না? তাদের জন্য হলেও আমাকে লড়াইটা করতে হবে আয়ান। 

আর কি বলো তো? এক সপ্তাহ পর সাইনিংয়ের ডেইট পড়েছে। তখন তো নামের পাশে পার্মানেন্টলি 'ডিভোর্সি' শব্দটা জুড়ে যাবে। আর একটা মেয়ের জন্য এই ট্যাগটা কতোটা ভারি সেটা তুমি বুঝবে না। হয়তো এই ট্যাগটা থাকা স্বত্বেও তুমি হাসিমুখে গ্রহণ করতে চাইতে আমাকে। কিন্তু --। কিন্তু আমি চাই তুমি সবটা ভুলে নতুন করে শুরু করো আয়ান। ভেবে নিও মায়রা নামের কেউ তোমার জীবনে কখনো ছিলই না। 

ইতি,

মায়রা।"

চিঠিটা পড়া শেষ হলে আয়ান ভ্রু কুঁচকে দু মিনিট কিছু একটা ভাবলো। তারপর বিরক্ত হয়ে মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে কিছু একটা করায় লেগে পড়লো। কাজটা শেষ হলেই আয়ান নিজের ব্যাগ প্যাক করায় লেগে পড়লো। ছেলেটার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে। মায়রা নামের কেউ ছিল কি ছিল সেটাও এবারে আমি তোমাকে হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দিবো। আবার হুট করে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার মজাটা সুদে আসলে টের পাবে মায়রা। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মায়রার কপালে কি শনি অপেক্ষা করছে কে জানে। 

৩৪!! 

আয়ান ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মোবাইলে কিছু একটা চেক করে নিয়ে নিজের কটেজ থেকে বেরিয়ে আরিশাদের কটেজে এসে দরজায় নক দিলো। তাওহীদ এসে দরজা খুলে দিলে আয়ান কটেজে ঢুকলো। আরিশা বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিল। এবারে আয়ানকে দেখে একটু উঠে বসলো। আয়ানের হাতের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল আরিশার।

-আয়ান? কি রে? তোর প্যাকিং শেষ? আমরা তো---।

-আরু--। আমি আজই বাসায় ফিরবো--। তোর কয়েকটা দিন থাক--। সবে কালই তো এলি--। কয়েকটা দিন থাক। ভালো লাগবে--।

-ওই ছেলে? তুই চলে যাবি আর আমরা থাকবো মানে কি? ফাইজলামি পাইছিস নাকি? আমরা তোর মুড ফ্রেশ করার জন্য এলাম। আর তুই চলে যাবি আর আমরা--?

-আরু প্লিজ? আমার জন্য তোদের প্ল্যানটা নষ্ট করিস না--। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। নইলে হয়তো আরো কয়েকটা দিন আমিও থাকতাম---।

-আয়ান?

-তাওহীদ ভাই? আমি আসলে আপনার গাড়িটা নিয়ে যেতে চাইছিলাম। বাসে যেতে একটু লেইট হয়ে যাবে---।

আয়ানের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তাওহীদ পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা বের করে আয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলো।

-আয়ান? তুমি পাঁচটা মিনিট ওয়েট করো--। আমাদের প্যাকিং করতে সময় লাগবে না বেশি--। সব গোছানোই আছে। শুধু ব্যাগে নিয়ে নিবো--।

-নাহ ভাই---। আপনারা কয়টা দিন থাকুন। রিল্যাক্স করুন--। মেয়েটা এমনিতেও বাসায় অনেকদিন ধরে বোর হয়ে যাচ্ছিল। একবার যখন এসেছেন কিছুদিন থাকুন--। আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক আছি--। আর এই ড্রামাকুইনের কথা এতো সিরিয়াসলি নিয়েন না---। টানা জার্নি করলে ওর নিজেরই শরীর খারাপ হতে পারে--। 

-তবুও--। সবাই একসাথে ব্যাক করলে ভালো হতো না?

-সত্যি কাজ আছে ভাই--। আর এই যে ম্যাডাম--। সেন্টি খাইস না। পরে আবার আসবো সবাই মিলে-। টর্চার করার আরো অনেক সময় পাবি--। এখন আসছি বুঝলি? আসছি ভাই।

আয়ানের দিকে রাগী চোখে একবার তাকিয়ে চুপ করে আবার বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো আরিশা। এই মূহুর্তে প্রচন্ড রাগে কারো সাথেই কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর। তাওহীদ আয়ানকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে আরিশার পাশে বসলো। এদের দুই বন্ধুর মাঝখানে বরাবরই বেচারা তাওহীদ ফেঁসে যায়। এখনও বেচারা ফেঁসে গেছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে আরিশার রাগ ভাঙানোতেই মন দিলো তাওহীদ। মেয়েটার রাগ না পড়লে আবহাওয়া কোন দিকে মোড় নিয়ে ঝড় ওঠে বলা মুশকিল।

এদিকে আয়ান খুব শান্ত হয়ে গাড়ি ছুটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আয়ানের এক সপ্তাহের প্ল্যান ছিলো কক্সবাজারে। কিন্তু একদিন কাটতেই ফিরে আসায় উনারাও বেশ অবাক হলেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আয়ান মায়ের সামনে এসে বসলো। আয়ানের বাবা মা দুজনেই থমকে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন ছেলে কি করতে চাইছে। আয়ান কিছু না বলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সেটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা করায় মন দিলো। 

-আয়ান? তুই কি কিছু বলবি? আর ফিরে এলি যে? তোদের না কয়দিন থাকার কথা ছিল?

-একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে মা। তাই চলে এসেছি--। আর তোমাদের সাথে একটা কথা ছিল--। ভাবলাম সেটাও সামনাসামনি বসেই আলোচনা করলে ভালো হবে--।

-বল না? কি কথা?

-তোমরা অনেকদিন ধরেই তো চাইছিলে বিয়ে করি--। তাই এবারে ঠিক করলাম বিয়ে করবো---।

-সত্যি!! হঠাৎ কি মনে করে? আচ্ছা বাদ দে--। তুই যে বিয়েতে রাজি হয়েছিস সেটাই অনেক--। এখন তো অনেক কাজ--। মেয়ে পছন্দ করতে হবে--। ইশ! শায়লা আপাকে ফোন করতে হবে--। কোনো ভালো মেয়ে আছে কিনা পরিচিতদের মধ্যে--। তোর কাউকে পছন্দ আছে বাবা? থাকলে বল-মেয়ের বাড়িতে--।

-মা!? মা? রিল্যাক্স--। এই ছবিটা দেখো---। এই মেয়েটাকে বিয়ে করবো--। একজন কলিগ ছবি দিয়েছে--। আমারও পছন্দ হয়েছে। এবার তোমরা দেখো কেমন লাগে--।

-আরে! বাহ! মেয়ে তো মাশাল্লাহ! তা কি করে রে? বাবা মা কি করে? বাসা কোথায়? বাড়ি---? 

-মা? এতো প্রশ্ন একত্রে! মাই গড! শুধু বলো চলবে কিনা ওকে তোমাদের?

-আরে বাবা! তোর পছন্দই আমাদের পছন্দ --। আর মেয়ে তো মাশাল্লাহ দেখতে শুনতে সুন্দর। কি মায়াভরা মুখটা! ১০০ বার চলবে, হাজার বার চলবে--। এবার ঠিকানাটা দে--। 

-আম--। মা-। এখনই না--। আমি নিজে কিছুদিন ওর সাথে কথা বলে দেখি--। এভাবে হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে যদি মনে হয় কাজটা ভুল হয়েছে তখন তো আর ভুলটা শোধরানো যাবে না--। তাই আগেই শিওর হয়ে নিতে চাই সি ইজ পারফেক্ট ফর মি, অর নট। সেটা শিওর হয়ে গেলে আমি নিজেই তোমাদেরকে ওর বাসায় নিয়ে যাবো--। 

-কিন্তু-- আয়ান?

-মা প্লিজ? বাবা বলো না মাকে--। বেশি জোরাজোরি করলে কিন্তু আর বিয়েই করবো না বলে দিলাম--।

-আরে!! 

আয়ান আর কিছু না শুনেই রুমের দিকে পা বাড়াচ্ছে দেখে মা পিছন ডাকলেন আয়ানকে।

-আরে? আয়ান? ওর নামটা তো বলে যা?

মায়ের প্রশ্নটা শুনে আয়ানের ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা দেখা দিলো। পিছনের দিকে না ফিরেই আয়ান অস্ফুট স্বরে নামটা নিজের মনেই যেন আওড়ালো।

-মায়রা।

এদিকে মায়রা বাসায় ফিরে নিজেকে অনেকটা বন্দীর মতো করে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রয়েছে। আয়ানকে চিঠিতে কথাগুলো লেখার সময় নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে বাস্তবতাটাকে মেনে নেয়ার চেষ্টা করেছিলো। এখন মামার বাসায় ফিরে একলা ঘরে বন্দি হয়ে মায়রার নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে কাজটা না করলেই ভালো হতো। সকাল থেকে একবারও আয়ানের একটাও কল পর্যন্ত আসে নি। তাই আরো কান্না পাচ্ছে মায়রার। লোকটা কি আসলেই বাস্তবতা বুঝে পিছিয়ে গেছে? না চাইতেও বারবার মোবাইলটা হাতে নিচ্ছে মায়রা। কল বা মেসেজের আশায়। বারবার হতাশও হতে হচ্ছে ওকে। একা একটা রুমে মায়রার এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে জীবনটা ওর প্রতি এতো নির্দয় না হলেও পারতো। সুখ হয়ে ধরা দিতে না পারুক, অন্তত এতোটা কষ্ট হয়ে জীবনে আসারও কি খুব দরকার ছিল?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন