৬৩!!
আয়ান কিছুক্ষণ মায়ের পাশে বসে থেকে নিজের রুমে এলো। মায়রা গভীর মনোযোগ দিয়ে কাবার্ডে কিছু একটা দেখছে। আয়ান আস্তে করে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে মায়রাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মায়রার কাঁধে চিবুক রেখে নিজেও দেখার চেষ্টা করলো কাবার্ডের দিকে। আয়ানের এমন হুট করে জড়িয়ে ধরায় মায়রা বেশ চমকে উঠেছিল। আলতো করে আয়ানের হাতে আদরের কিল বসিয়ে দিলো মায়রা। আয়ানও সুযোগ পেয়ে মায়রার কানে আলতো করে কামড় বসিয়ে দুষ্টুমি করতে শুরু করেছে। মায়রা এবারে চমকে উঠে সরার চেষ্টা করলে আয়ান আরো শক্ত করে মায়রাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
-বউসোনা এমন ছটফট করো কেন সবসময়? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে তোমাকে খেয়ে ফেলবো?
-কি করছো কি তুমি?
-দেখছো না কি করছি? তুমি কি করছিলে পরীটা? তোমাকে না ফ্রেশ হয়ে এসে কিছুক্ষণ ঘুমাতে বললাম? না ঘুমিয়ে কি এমন গুপ্তধন খুঁজতে আসলে কাবার্ডের ভিতরে?
-না আসলে ভাবছি শাওয়ার নিয়ে নিই একেবারে। আরশিকে একটু কোলেও নিতে পারলাম না।
-ওরে দুষ্টুটা। শাওয়ার নাও সমস্যা নেই। শাওয়ার নিয়ে একটা লম্বা ঘুম দাও। তারপর পিচ্চিটার কাছে যেতে পারবা। তার আগে না।
-এমন করো কেন? আর ঘুমাবো মানে কি? আরিশা আপুরা এসেছে। নাস্তাও দিতে দিচ্ছ না ওদেরকে। এমন করলে কি ভাববে সবাই? ছি!
-সে তুমি ছি বলো আর যাই বলো। এখন রুম থেকে বের হওয়া নিষেধ। আরিশা তো মেহমান না। তুমি এখন ওকে জোর করে মেহমান বানাতে চাইলে তোমার উপরেও ক্ষেপবে মেয়েটা। এমনিতে আমার উপরে যা রেগে আছে! তোমার উপরেও রাগ উঠলে আর রক্ষে নেই বাপু---।
-আপু তোমার সাথে রাগ করেছে কেন?
-কি জানি! মনে হয় কোনো ভাবে মা যে তোমার উপরে রাগ করেছিল সেটা আরু জেনে গেছে। তাই হয়তো। কিন্তু কে বললো সেটাই বুঝতে পারছি না----।
-হুম। আরিশা আপু তো মায়ের সাথেও কথা বললো অনেকক্ষণ--।
-তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেল। ও কথা বলে কাউকে কনভেন্স করতে পারবে না সেটা আজ পর্যন্ত হয় নি।
-তাই?
-হুম। শুধু তাওহীদ ভাই ছাড়া আর কি---।
-হি হি--। ভালোবাসা সব জয় করতে শেখায়। তাই তাওহীদ ভাইয়াও আরুআপিকে জয় করে নিয়েছে নিজের ভালোবাসা দিয়ে।
-খুব হাসি পাচ্ছে না? যাও শাওয়ার নাও? তাড়াতাড়ি?
-হুম। শাড়িটা নিই----।
-লাগবে না। আমি তোমার জন্য ড্রেস বের করে রাখছি। তুমি শাওয়ারে যাও। আর কথা একটু কম বলো---।
-আমি কথা কমই বলি জনাব---।
-ও আচ্ছা? তাই নাকি?
-আরে? কি করছ? সরো?
আয়ান দুষ্টুমি করে মায়রার ঘাড়ের কাছের চুল সরিয়ে দিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই মায়রা শিউরে উঠে ছুটে পালালো। আয়ান হেসে কাবার্ড থেকে নিজের একটা অফ হোয়াইট শার্ট বের করে কাবার্ড লক করে ওয়াশরুমের দরজায় এসে নক করলো। মায়রাও লক্ষী মেয়ের মতো দরজা খুলে দিতেই আয়ান হাত বাড়িয়ে মায়রাকে শার্টটা দিয়ে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো। আয়ানের শার্টের দিকে চোখ পড়তেই মায়রা থতমত খেয়ে গেল।
-এটা কি? তোমার শার্ট দিয়ে কি করবো আমি?
-কি করবা আর? পড়বা আর কি।
-তোমার মাঝে মাঝে কি হয় আমি বুঝি না। এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করো কেন?
-অদ্ভুত কান্ডের কি দেখলে? অহেতুক শাড়ি পড়ে জড়সড় হয়ে ঘুমানোর কি দরকার বলো? ঘুমাবাই যখন রিল্যাক্স হয়ে ঘুমাও। আর আমাদের বেডরুমে কেউ তো দেখতে আসছে না তুমি কি পড়ে ঘুমাচ্ছ--।
-ধ্যাত---। অন্যকিছু দাও তো। একটা থ্রিপিস এনে দাও তাহলে--।
আয়ান মায়রার কথার জবাব না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। মায়রা এক পা পিছিয়ে গেল আয়ানের এগিয়ে আসায়।
-আরে? তুমি কেন আসছ?
-ওমা! শাওয়ার নিবো না?
-তোমাকে কি বললাম আমি?
-আরে বাবা! এতো কথা না বলে শাওয়ার নিয়ে লক্ষী মেয়ের মতো শার্টটা পড়ে নাও। আমারও দেখা হবে, আর তোমারও রিল্যাক্স মুডে ঘুমানো হবে----।
-তোমাকে আমি?
-হুম হুম? কি ম্যাডাম?
এভাবে কিছুক্ষণ দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি করতে করতে শাওয়ার নিলে দুজনে মিলে। মায়রা গাল ফুলিয়ে আয়ানের শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে শেষমেশ। এভাবে ওকে এতো লজ্জায় ফেলার মানেই বুঝে না মায়রা। লোকটা এমন কেন? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরেকবার লজ্জায় লাল হয়ে যায় মায়রা। মায়রার লাজুক মুখটা দেখে আয়ান মায়রার চুলে টাওয়াল জড়িয়ে দিয়ে মায়রার গালে আলতো করে চুমো খেল।
-তুমি যাও পরীটা। আমি আসছি।
-হুম----।
দু মিনিট পরে আয়ান ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে মায়রার কাবার্ড টানাটানি দেখে হেসে ফেললো। আয়ানকে দেখে বেচারি আরেকবার লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বিছানায় গিয়ে চুপটি করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। আয়ান কাবার্ড খুলে একটা টি শার্ট নিয়ে সেটা পড়তে পড়তে এসে মায়রার পাশে এসে বসলো। মায়রার চুল থেকে টাওয়ালটা খুলে নিয়ে চুল মুছে দিতে গিয়ে হেসে ফেললো আয়ান।
-ম্যাডাম? এই জন্যই আপনাকে আগে রুমে পাঠিয়েছি। কি করেন সেটা দেখার জন্য। চুল মোছারা নাম নেই, কাবার্ডের পিছনে পড়লে--। এটা কি ঠিক বলো তো? ঠান্ডা লেগে যাবে না?
-তুমি একটা খুব খারাপ।
-জি ম্যাডাম জানি তো। আপনি এখন ঘুমান। ঘুম ভাঙলে তারপর চেইঞ্জ করতে পারবেন। তার আগে না।
-হুহ---।
মায়রা তবু গাল ফুলিয়ে বসে আছে দেখে আয়ান হেসে মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েই শুয়ে পড়লো। মায়রা আস্তে করে আয়ানের বুকে মাথা রাখলে। আয়ান আলতো করে মায়রার চুলে বিলি কেটে দিল।
-মায়ু? এই পাগলীটা? কি এতো চিন্তা করছ?
-আরিশা আপু আর তাওহীদ ভাইয়া এলো বাসায়। আর আমি ঘুমাবো! ব্যাপারটা কেমন দেখায়?
-আরে বাবা! তুমি সারা রাত একা একা জেগেছিলে। আমাকেও ডেকে দাও নি। তাই এটা তোমার শাস্তি--।
-আমার ঘুম পায়নি একটুও। বিশ্বাস করো।
-আচ্ছা বাবা। বিশ্বাস করলাম। কিন্তু ম্যাডাম। এভাবে সারা রাত জাগাটা একদম ঠিক না। তাই চুপটি করে ঘুমাও এখন।
-মা রাগ করবে তো উঠলে----।
-একদম রাগ করবে না সোনাপাখি। আর এসব ভাবা বাদ দিয়ে ঘুমাও তো। তুমি ঘুমালে আমি মায়ের কাছে গিয়ে বসবো কিছুক্ষণ। ওকে?
-হুম---।
-এতো ভাবতে হয় না রে পাগলীটা। দেখি? চোখ বন্ধ করো?
মায়রা আয়ানের বুকে গুটিগুটি শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েও পড়লো। আয়ান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর মায়রাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিয়ে ড্রইংরুমে এলো। আরিশা রান্নাঘরটা দখল করে নিজের মতো কাজে ব্যস্ত। আর তাওহীদ আরশিকে কোলে নিয়ে সেখানেই ঘুরঘুর করছে দেখে আয়ান একটু সাহস করে সামনে এগিয়ে এসে তাওহীদের পাশে দাঁড়ালো।
-ভাই? আবহাওয়া কেমন এখন?
আরিশা কটমট করে আয়ানের দিকে তাকাতেই আয়ান চুপ করে গেল।
-আবহাওয়ার খবর ওকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আবহাওয়া অফিসে ফোন করে জেনে নে ভাগ।
-আরু?
-তুই এখন আমার সামনে থেকে না গেলে আমিই চলে যাবো বলে দিলাম।
-এমন করছিস কেন? এই দেখ কান ধরছি তো? মাফ করে দে না প্লিজ?
-তোকে মাফ করার প্রশ্নই আসে না। তুই এই মূহুর্তে আমার সামনে থেকে বিদায় হ বলে দিচ্ছি আয়ান---।
-একটা ভুল করেছি বলে এমন করবি? শোন না? তুই না আমার বেস্ট বেস্ট বেস্ট ফ্রেন্ড?
-তোর বেস্টফ্রেন্ডের নমুনা তো দেখছি। তার খবর আমার আরেকজনের কাছ থেকে জানতে হয়। হাহ। আবার বলতে আসছে--।
-কার থেকে কি জানলি? আমি আবার কখন কি করলাম?
-তুই নিজেই ভাব-----।
-আরে বল না বাবা।
-সায়না আমাকে আন্টির পুরো ব্যাপারটা বলেছে। ও আমাকে সরি বলার জন্য কল করেছিল। নইলে আমি জানতেও পারতাম না কখনো--।
-সরি রে আরু। আসলে--টেনশনে তোকে আর বলা হয়নি---।
-হ্যাঁ সেটাই। আমি তোর কে যে বলবি? তাই না?
-আরু? কিসব বলিস?
-যা তুই আমার সামনে থেকে। টেনশন শিখাইতে আসছে সে আমাকে। যা তো---।
-আমমম। আরশিকে নিয়ে যাই প্লিজ?
-একদম না। আমার মেয়েও তোর সাথে আড়ি। যাবি তুই?
-আরে শোন না? ওই ড্রামাকুইন? আর এমন এংগ্রিবার্ড হয়ে থাকিস না প্লিজ?
-কাজ করছি চোখে দেখিস না? কাজ শেষ হলে তোর বিচার হবে। আঙ্কেল আসুক আগে---।
-হুম---।
-যা তো। কাজ করতে দে--।
আয়ান একটু মন খারাপ করে মায়ের রুমের দিকে চলে গেল। বেচারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না এই সাইক্লোনটাকে সে সামলাবে কি করে! আরিশার রাগ সাইক্লোন থেকে কম কিসের! মেয়েটার রাগ ভাঙ্গাতে কি করতে হবে শেষে কে জানে! আর কি যে আছে কপালে আল্লাহ মালুম।
৬৪!!
-কি রে ব্যাটা? মায়ের খেয়াল রাখতে এসে নিজেই দেখি ঘুমে কাদা! এসব করে আমার বউয়ের সেবা করা হচ্ছে? তাই না?
মায়ের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে থাকতে থাকতে কখন চোখটা লেগে গেছে টেরই পায়নি আয়ান। তাই হঠাৎ করে বাবার গলা শুনে চমকে তাকালো আয়ান। আয়ানের এমন চমকে উঠায় হা হা করে হেসে ফেললেন আয়ানের বাবা। ছেলেকে চমকে দিয়ে যেন দারুণ মজা পেয়েছেন তিনি। আয়ান চেয়ার ছেড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
-বাবা? তোমার তো আজ রাতে ফেরার কথা? এখন ফিরলে কি করে?
-একজন এদিকে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে আমি কাজে মন দিই কি করে বল তো? এখন ছাড় তো বাবা। তোর মা দেখছি সুস্থই আছে। আমাকে অহেতুক এতো টেনশন দিলি কেন তুই বদমাইশ ছেলে?
-মানে কি? মায়ের কাল কতো শরীর খারাপ ছিল জানো তুমি? আমি আর মায়রা কত ভয় পেয়ে গেছিলাম--।
-অসুস্থ বলেই তোর মা এখন মুখ টিপে হাসছে তোর আর আমার দিকে তাকিয়ে---। এই মহিলাকেও বলি হারি! দুটো দিন কাজের জন্য বাইরে যেতে না যেতেই অসুখ বাঁধিয়ে বসে আছো? তোমাকে নিয়ে যে করি সাহেবা?
আয়ান বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো মা মিটিমিটি হাসি মুখে তাকিয়ে হাসছে। আয়ান নিজেও হাসলো।
-মা? এখন শরীর কেমন লাগছে?
-আমি ঠিক আছি রে বাবা। তোরা এতো চিন্তা করিস না? আর তুই এখানে বসে বসে ঝিমাচ্ছিস কেন? যা রুমে যা--।
-ওমনি না? বাবাকে দেখেই আমাকে ভাগিয়ে দেয়া হচ্ছে? আমি যে এতোক্ষণ ধরে তোমার পাশে বসে ছিলাম সেটা কিছু না?
-মারবো ধরে আয়ান। যাবি তুই?
-হা হা। যাচ্ছি। তোমরা কথা বলো। বাবা তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আর কি খাবে বলো?
আয়ানের বাবা বিছানায় বসে মাথা নাড়লেন।
-আসার সময় পথেই আমি নাস্তা করে নিয়েছি। এখন আর খিদে নেই।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-তুইও যা কিছুক্ষণ রেস্ট কর। আমি তোর মায়ের কাছে আছি।
-আচ্ছা বাবা।
আয়ান বের হয়ে যেতেই আয়ানের বাবা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে স্ত্রীর চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলেন।
-সাহেবা? তোমাকে না বারণ করেছি রাতের বেলা বারান্দায় গিয়ে বসে থাকবে না? ঠান্ডায় জ্বর বাঁধিয়ে কি মজা পেলে বলো তো? রাতের হিম শীতল বাতাসটা তোমার সহ্য হয় না। তবু কেন এমন ছেলেমানুষি করো বলো তো?
-বকছ কেন ইমতিয়াজ? আর কে বলেছে তোমাকে আমি বারান্দায় বসে ছিলাম? আমার যেন কাজ নেই!
-এই যে মহারাণী? আপনার সাথে ত্রিশ বছরের সংসার আমার। আপনার নাড়ি নক্ষত্র সব আমার জানা। আপনি কোনটা করতে পারেন। আর কোনটা পারেন না সব জানি আমি।
-এই শোনো? তোমার আমার বিয়ের ত্রিশ বছর এখনো হয়নি হ্যাঁ? ছয়মাস বাকি আছে এখনো। আর ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে দেখো। ভাইরাল ফিভার হয়েছে। হুহ। আর সরো তো। ধরো না তো? ডাক্তার বলেছে----।
ইমতিয়াজ আহমেদ একটু ঝুঁকে স্ত্রীর কপালে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলেন।
-ডাক্তার বলেছে আপনার আশেপাশে কেউ না আসতে। এটা কোনো ছোঁয়াচে রোগ হতে পারে। ব্লা ব্লা ব্লা---। তাই তো?
-তোমাকে এসব কে বললো?
-আমাকে কে বলবে? উল্টো সাইফ আমার শেখানো বুলি বলেছে তোমার ছেলে আর ছেলের বউকে।
-মানে কি? কেন?
-এমনি--। তোমাকে দেখাতে চাইলাম আর কি। যে যুগে সন্তানরা নিজের অসুস্থ বাবা মাকে রাস্তায় ফেলে যেতেও দ্বিধা করে না। সেই যুগেই আমাদের সন্তানরা আমাদের সব বিপদ থেকে ঢাল হয়ে আগলে রাখতে চাইছে। এমন সন্তানদের কষ্ট দেয়া কি ঠিক তুমিই বলো সাহেবা?
সাহেবা শোয়া থেকে ওঠার চেষ্টা করেও গায়ে তেমন শক্তি না পাওয়ায় ইমতিয়াজ নিজেই সাহেবাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। সাহেবা এবারে স্বামীর বুকে মাথা রাখতেই তার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
-আমার ভুল হয়েছে ইমতিয়াজ। তখন মাথায় কি চেপেছিল কে জানে! আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ?
-আরে!
ইমতিয়াজ আহমেদও পরম স্নেহে সাহেবার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
-ছেলে মেয়ে তো ভুল করবেই বলো? আমাদের মা বাবার উচিত ওদের ভুলটা শুধরে দেয়া। রাগ করে দূরে ঠেলে দিয়ে সম্পর্কে দূরত্ব বাড়িয়ে লাভ কি বলো? তুমি চাইলেই সহজে মেয়েটাকে মায়ের স্নেহে শাসনও করতে পারো। কিন্তু কি জানো তো? শাসনের সাথে সাথে ভালোবাসাটাও জরুরি।
-হুম। আমি সত্যি অনেক লজ্জিত ইমতিয়াজ---। আমি---।
-আচ্ছা এসব বাদ দাও। মায়রা কোথায়? ওকে তো দেখলাম না। আরিশা রান্না করছে দেখলাম। ব্যাপার কি?
-মেয়েটা সারা রাত জেগে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। একটুও ঘুমায় নি জানো? যতবার চোখ খুলেছি দেখেছি মেয়েটা মাথার পাশে বসে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আয়ান তো কতো করে বললো মেয়েটাকে ঘুমাতে। ও কিন্তু জায়গা থেকে নড়েও নি---।
-হুম। তাই এখন অসুস্থ শাশুড়িকে রেখে ঘুমাচ্ছে। বাসায় মেহমান এসেছে তাকে দিয়েই রান্না করাচ্ছে! ছি ছি ছি!
-ইমতিয়াজ! টিজ করবা না বলে দিলাম--। ভালো হবে না কিন্তু তাহলে--।
-আচ্ছা বাবা সরি---। সাহেবা। তুমি একটু রেস্ট করো। আমি ফ্রেশ হয়ে নেই কেমন?
-আচ্ছা--। অনেক গল্প আছে। শুনলে অবাক হয়ে যাবে তুমিও--।
-কি?
-আরে বাবা ফ্রেশ হয়ে এসে বলছি। তুমি শুয়ে থাকো---।
এদিকে আয়ান রুমে এসে মায়রার পাশে শুয়ে ঘুমন্ত মায়রার মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা দেখে শান্তি লাগছে আয়ানের। ইচ্ছে করছে একদম বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে। নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেললো আয়ান। মায়রাকে বুকে হালকা করে জড়িয়ে নিলো যাতে মেয়েটার ঘুম না ভাঙ্গে। মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিতেই আয়ানের চোখ জুড়েও নামলো রাজ্যের ঘুম। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে। আয়ানের ঘুমটা ছুটে গেল মায়রার আস্তে আস্তে সরে আসার চেষ্টা করাতে। আয়ান মায়রাকে বিছানা থেকে ওঠার সুযোগ দিলো না। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। মায়রা আর কি করবে! উঠতে না পেরে আয়ানের হাতের বাহুতে মাথা রেখে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
-ছাড়ো না? অনেকক্ষণ তো ঘুমিয়েছি। এবার তো উঠি--।
-আবার নাচানাচি শুরু করে দিয়েছ? চুপচাপ ঘুমাও। আমার ঘুম হয়নি এখনো---।
-তুমি ঘুমাও না? আর আমি নিচে যাই। আরিশা আপু কি করছে একা একা। আর মাকে দেখে আসবে--।
-মায়ের কাছে এখন যাওয়া লাগবে না সোনাপাখি। বাবা আছে মায়ের পাশে।
-সে কি? কি বলো?
-আরে! এমনভাবে ভয় পেয়ে লাফানোর মতো কি হলো?
-ছি ছি ছি! বাবা কি ভাবলো? সব তোমার কারণে হয়েছে। মা অসুস্থ আর আমি নাকি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি--। যাও তো ছাড়ো বলছি ছাড়ো?
-আরে! মায়রু? এমন করছ কেন? থামো থামো?
-না না না। ছাড়ো বলছি? ছাড়ো ছাড়ো ছাড়ো?
মায়রা আয়ানের শক্ত বাঁধন থেকে ছুটতে না পেরে আয়ানের বুকে কিল বসাচ্ছে। আয়ান তাতেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। হাসতে হাসতেই এক সময় আয়ান মায়রাকে বিছানায় ফেলে মায়রার হাতদুটো বিছানার সাথে চেপে ধরে মায়রার দিকে ঝুঁকলো। মায়রার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে চোখ বুজে নিলো।
-এবারে কোথায় পালাবে গো লাজুক পরী?
দুপুরবেলা শাশুড়িকে খাইয়ে দিয়ে এসে মায়রা আর আরিশা মিলে সবাইকে খাবার সার্ভ করলো।আয়ান, আয়ানের বাবা আর তাওহীদ তিনজনেই টুকটাক গল্প করতে করতে খাচ্ছে। অনেকদিন পর আবার আগের সেই হৈ হৈ ভাবটা ফিরে এসেছে বাড়িটায়। আর সেটা দেখে অসম্ভব ভালো লাগছে মায়রার। মনে হচ্ছে এতোদিনে ও আবার নিজের সংসারটা ফিরে পেয়েছে। ওর ছোট্ট হাসিখুশি পরিপূর্ণ সংসার।