৬৯!!
সকালের নরম রোদটা চোখে এসে পড়ায় ঘুম ভাঙলো সায়নার। অলসভাবে পাশ ফিরে সম্পূর্ণ অচেনা একটা রুমে নিজেকে আবিষ্কার করায় রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বসলো মেয়েটা। কোথায় আছে সেটা মনে পড়লেও এই রুমের বিছানায় কি করে এসেছে সেটা কিছুতেই মনে পড়ছে না সায়নার। লাস্ট যতটুকু মনে পড়ছে বসারঘরে সীমান্তের সাথে কথা বলছিল। তারপর লোকটা উঠে যেতে এতো টায়ার্ড লাগছিলো যে চোখ খুলে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল সায়নার জন্য। কিন্তু এই রুমে আসলো কি করে! নিজের দিকে তাকিয়ে গায়ে জড়ানো চাদরটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো সায়না। তাহলে কি সীমান্তই ওকে রুমে নিয়ে এসেছে? কথাটা ভাবতেই আপনাআপনি সায়না গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে মাউথওয়াশ দিয়ে গার্গল করে ফ্রেশ হয়ে সীমান্তকে খুঁজতে রুমের বাইরে বের হলো সায়না। কোথাও একটা থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে শুনে সেদিকেই পা বাড়ালো সায়না। আর পৌঁছেই আবিষ্কার করলো সীমান্ত রান্নাঘরে কিছু একটা করায় ব্যস্ত। মানুষটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক মনে ভাবছে সায়না। এই লোকটা কি সত্যিই মায়রার সাথে নির্দয়ের মতো আচরণগুলো করতে পেরেছে? তাকে দেখে কেন যেন ব্যাপারটা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ হচ্ছে সায়নার। এই মানুষটা আসলেই কি কাউকে কষ্ট দিতে পারে!
-একটা মানুষ বসে থাকতে থাকতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে কি করে ঘুমিয়ে যেতে পারে সেটা আমার জানাই ছিল না। টেকনিকটা আমাকে শিখিয়ে দিবেন প্লিজ? আজকাল ঘুম নিয়ে মহা ঝামেলায় আছি---।
-জি?
-আমি স্যুপের বাটিটা রেখে গিয়েই দেখি কেউ একেবারে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি কি করে ঘুমিয়ে পড়লেন বলুন তো? সিক্রেটটা আমাকে শিখিয়ে দিবেন প্লিজ?
-আরে! কিসব বলছেন?
-এভাবে নিশ্চিন্তে দু মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে পারাটা সত্যি একটা আর্ট ম্যাডাম। নইলে এমনও মানুষ দেখেছি যে কিনা রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিত---।
-কার কথা বলছেন?
-জি? না কিছু না। আমম। আপনি একটু বসুন। আমি ব্রেকফাস্টটা রেডি করে ফেলি। একটুখানি বাকি। ব্রেকফাস্টটা কমপ্লিট করে আপনাকে আপনার বাসায় ড্রপ করে দিয়ে অফিসে যাবো আমি---।
-আচ্ছা? আপনি এত বড় বাড়িটাতে একা থাকেন?
-জি---। দোকা নেই। তাই আপাতত একাই থাকি---।
-ভয় করে না?
-ভয়? কিসের? ভূতের? নাকি চোর ডাকাতের?
-না মানে---। একটা প্রশ্ন করবো? যদি কিছু মনে না করেন--।
-করুন। মনে করবো না কিছু।
-আচ্ছা? কাবার্ডে শাড়িগুলো কার ছিল?
-শাড়ি দুটো? একজনের জন্য কিনেছিলাম। দেয়া হয়নি। তাই নিজের কাছেই রয়ে গেছে।
-কাকে দেয়ার জন্য কিনেছিলেন?
-ছিল একজন। তার কথা বলা শুরু করলে আজ আর আপনার বাসায় যাওয়া হবে না।
-আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো? আপনি কি সত্যিই সীমান্ত?
-আমি এতো পপুলার জানতাম না তো? অপরিচিতা সুন্দরীর মুখে নিজের নামটা শুনে আমি রীতিমতো বিস্মিত। তা এই অধমকে আপনি কিভাবে চিনেন যদি বলতেন?
-আমি আপনাকে ঠিক চিনি না। উমমম। মায়রাকে চিনি। আপনাদের বিয়ের ছবি দেখেছিলাম---।
-ওহ আচ্ছা। তাহলে মায়রার ফ্রেন্ড হন আপনি?
-উঁহু---। না---। রিলেটিভ বলতে পারেন। মায়রা আমার কাজিনের ওয়াইফ--।
-হোয়াট! কবে বিয়ে হয়েছে? কেমন আছে এখন ও?
সীমান্তের রিএ্যাকশনটা কিছুতেই বোধগোম্য হলো না সায়নার। এক্স ওয়াইফের বিয়ের খবর শুনে কোনো ছেলে এতোটা খুশি হতে পারে সেটা সায়নার জানা ছিল না। তাই সায়না বোকার মতো সীমান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সীমান্ত বোধ হয় অতিরিক্ত এক্সসাইটমেন্টের কারণে ঠিক মতো কাজও করতে পারছে না। রীতিমতো হাত কাঁপছে লোকটার। আর সীমান্তের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে সায়না ভাবার চেষ্টা করছে। কিছু একটা তো গোলমাল আছে। তবে কি সেটা? সীমান্ত কিছুক্ষণের মাঝে নিজেকে সামলে নিতে সফল হলো। প্লেটে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে নিয়ে সায়নাকে ধরিয়ে দিয়ে নিজেও একটা প্লেট তুলে পা বাড়ালো ডাইনিং টেবিলের দিকে। সায়নাও কিছুটা থতমত খেয়ে সীমান্তের পিছু নিলো।
-আপনার নামটা এখনো জানা হয় নি মিস----।
-সায়না।
-যদি ভুল না করে থাকি তবে আপনার কাজিনের নাম আয়ান? রাইট?
-জি---। আপনি জানলেন কি করে?
সীমান্ত কিছু না বলে হাসলো একটু। তারপর খাওয়ায় মন দিলো।
-ইউ নো মিস সায়না? মিস তো নাকি মিসেস?
-নাহ। মিস----।
-তো যা বলছিলাম মিস সায়না। কাউকে ভালোবাসলে তাকে সবটা দিয়ে ভালোবাসতে হয়। তার জন্য নির্দ্বিধায় নিজের জীবনটাও কোরবান করার সাহসটা বুকে রাখতে হয়। আর কখনো তার ভালোর জন্যই তাকে ছাড়তে হলেও সেটাও মেনে নিতে হয়। তার সুখের জন্য নাহয় তার চোখে আজীবনের জন্য অপরাধীই হলাম। ক্ষতি কি বলুন? পাওয়াটাকেই তো সবসময় সুখ বলা চলে না বলুন? সুখ হলো অর্জনে। আর মাঝেমাঝে সুখ নির্দয় বিসর্জনেও--।
ব্রেকফাস্ট করতে করতে বেশ অনেক কথা হলো দুজনের। সায়নার সবটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। লোকটার চোখ জোড়া বলে দিচ্ছে সে মিথ্যে বলছে না। মিথ্যে বললে হয়তো সায়নার চোখে চোখ রেখে সবকিছু এতো সহজে স্বীকার করতে পারতো না সীমান্ত। কিন্তু সীমান্তের কথাগুলো শুনে সায়না ঠিক কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তাই সীমান্তের পাশে গাড়িতে বসে থাকলেও কিছু না বলে একমনে কিছু একটা ভাবছে। সীামন্ত ড্রাইভ করতে করতে সায়নার চিন্তিত মুখটা দেখছে। মেয়েটা কি এতো ভাবছে সেটা একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছে সীমান্ত। তাই সে নিজেও কিছু বলছে না। এভাবে নিস্তব্ধতায় সময়টাও হুট করে কেটে গেল। সায়নার দেয়া ঠিকানার প্রায় কাছাকাছিই চলে এসেছে। এভাবে নীরবতায় আর কতক্ষণ থাকা যায়! তাই সীমান্ত নিজেই একটু কেশে গলা পরিষ্কার করতেই সায়না চমকে সীমান্তের দিকে তাকালো।
-ম্যাডাম কি এতো ভাবছেন?
- না মানে আসলে। আমি বুঝতে পারছি না-----। আপনি? আপনি সত্যি-----। আপনার একটুও কষ্ট হয়নি?
-I loved her enough to let her go.
-এটা কেমন ভালোবাসা? কখনো অধিকার ফলালেন? কখন পুতুলের মতো নাচালেন? আর কখনোবা তার সুখের জন্য তাকে দূরে ঠেলে দিলেন? এটা ভালোবাসা বলে? নাকি ছেলেমানুষি?
সীমান্ত কিছু না বলে হাসলো। গাড়িটা গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে এতোক্ষণে। গাড়ি থামিয়ে সায়নার দিকে তাকালো সীমান্ত।
-আপনার বাসায় পৌঁছে গেছি মিস সায়না। এই বিল্ডিংয়েই তো থাকেন?
-হুম।
-হ্যালো? ম্যাডাম?
সীমান্ত হালকা করে সায়নার কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে ডাকলো। সায়নাও চমকে সীমান্তের মুখের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।
-জি? কিছু বলছিলেন?
-আপনার বাসা তো চলে এলো? নামবেন না? নাকি আমার সাথে অফিসে যাওয়ার প্ল্যান আছে?
-আরে! সরি--। আমি একদমই খেয়াল করি নি।
-এতো গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবলে খেয়াল করবেন কি করে বলুন?
-আমম। না আসলে---। আসছি তাহলে?
-হুম--।
সায়না ভাবছে এরপর এই মানুষটার সাথে কি আর কখনোই দেখা হবে না? লোকটার সাথে পরিচয়টা কি শুধু এই হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার হয়েই থেকে যাবে ওর জীবনে? সায়নার মাথায় আপাতত একটা লাইনই ঘুরছে।
"এই তবে কি গো শেষ দেখা, হে প্রিয়?"
সায়না এসব ভাবতে ভাবতে কয়েক পা গিয়েই গাড়ির হর্নের শব্দে চমকে পিছনে তাকিয়ে সীমান্তের ঠোঁটের কোণের হাসিটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো।
-একটা ছোট্ট হেল্প চাইলে করবেন?
-কি?
-আমাকে জাস্ট দুটো মিনিটের জন্য মায়রার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? প্লিজ?
-কে-কেন!?
-ওকে সামনে থেকে একবার দেখতে চাই। প্লিজ? শুধু ২ মিনিটের জন্য?
-আমমম। আচ্ছা। আমি চেষ্টা করবো।
-আমমমম? মিস তাহলে আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা পাওয়া যাবে কি?
-নাম্বার?
-যোগাযোগ রাখার আর তো কোনো মাধ্যম দেখছি না। আর আপনাকে জানারও তো বাকি আছে নাকি?
সীমান্ত মাথা চুলকে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললো। আর তার মুখের একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গি আর কথা বলার ধরণটা দেখে হেসে ফেললো। সীমান্তের মোবাইলে নিজের নাম্বারটা তুলে দিতেই সীমান্ত একবার কল করে নিজের নাম্বারটাও আদান প্রদান করে একটু নিঃশব্দে হাসলো। হাত নাড়িয়ে সায়নাকে বিদায় দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো সীমান্ত। আর সায়না সীমান্তের গাড়িটা যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটার সাথে আলাপটা এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। তাতেই প্রচন্ড খুশি লাগছে সায়নার। নাহয় এই সূত্র ধরে আলাপের পথটা আরেকটু দীর্ঘই হলো।
৭০!!
গত তিনটা দিন একদম অন্যরকম কেটেছে মায়রার। মনে হয়েছে যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ একসাথে এসে ধরা দিয়েছে ওর ঝুলিতে। তেমন আহামরি ব্যাপার কিছুই না। আরিশার বাসা থেকে পরের দিন সকালে বাসায় ফিরে বিকেলেই এতো বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল মায়রার জন্য যা মায়রা কল্পনাও করতে পারে নি। লাঞ্চ করে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল মায়রা। বিকেলে ঘুম ভাঙ্গতেই ড্রইংরুম থেকে একটা ছোটখাটো গুঞ্জন ভেসে আসছিলো শুনতে পেয়ে নিচে আসে মায়রা। এসেই বেচারির চোখ কপালে ওঠার দশা। আভা, সামি, আরিশা, তাওহীদ, তাথৈ, রিহান, মায়রার শ্বশুর শাশুড়ী, সবাই সোফায় বসে মিনি আলোচনা সভা করছে যেন। আর আয়ানের কোল থেকে আরশিকে নেয়ার জন্য বাঁধন রীতিমতো ছুটোছুটি করছে। মায়রা হা করে এই মিনি পুনর্মিলনসভা দেখছে। কেউ যেন ওকে দেখছেই না। সবাই নিজেদের মতো আলোচনায় মজে আছে। শুধু যে আলোচনা চলছে তা ও না। রীতিমতো টি টেবিল ভর্তি নাস্তা সামনে রেখে যেন কোনো সিক্রেট মিটিং হচ্ছে। ঠিক সিক্রেট বললেও ভুল বলা হবে। আলোচনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হচ্ছে। শুধু আলোচনার বিষয়বস্তু মায়রার অজানা। মায়রা অবাক হয়ে বড় বড় চোখে সবাইকে দেখতে দেখতে আয়ানের কাছে এগিয়ে আসে। ততক্ষণে আরশিকে বাঁধন নিজের কোলে নিতে পেরে যেন রাজ্য জয় করে ফেলেছে এমন খুশি হয়ে আরশির সাথে দুষ্টুমিতে মন দিলো। আয়ান মায়রাকে দেখে হালকা করে টেনে বাইরে বাগানে নিয়ে এসে কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
-আরে? আয়ান? কি করছ?
-কি করবো? এতোক্ষণে ম্যাডামের ঘুম ভাঙ্গলো তাহলে? সেই কখন থেকে তার জন্য ওয়েট করছি আমি! সে তো গভীর ঘুমে বিভোর----।
-আরে? কি করছ?
-কি আর করবো বলো? একটু ছুঁয়ে দেখছি তুমি আসলেই এসেছ নাকি স্বপ্ন দেখছি তোমার অপেক্ষা করতে করতে---।
-মামা মামি, আপু, ভাইয়া, আরিশাআপু, তাওহীদ ভাইয়া সবাই আজ হঠাৎ? কোনো প্রোগ্রাম আছে আজকে?
-হুম আছে তো---।
-কি! কিসের? আমাকে বলো নি কেন?
-উমমমম। তেমন জরুরি কিছু না। তাই বলি নি।
-মানে! জরুরি না মানে কি? বাবা মায়ের এনিভার্সারি তো নেক্সট উইকে। তোমার বার্থডে এখন না। তাহলে?
-ভাবো ভাবো---।
-বলো না প্লিজ?
-তেমন কিছু না রে পাগলি। এমনি সবাই মিলে বীচে যাবো। একসাথে সময় কাটাবো।
-হ্যাঁ? কি?
-জি ম্যাডাম। আপনাকে বললে তো আপনি বাবা মায়ের কে খেয়াল রাখবে, এটা সেটা বলে প্ল্যান ক্যানসেল করিয়েই দিবেন। তাই একদম সবাইকে সাথে নিয়েই মিনি হানিমুনে যাবো।
-যাহ! কিসব বলে!
-কক্সবাজার যাওয়া যেত। এতোটা জার্নি আমাদের পিচ্চি আরশির জন্য ঠিক হবে না। তাছাড়া আগামী সপ্তাহে বাবা আর মায়ের বিবাহবার্ষিকীর জন্য প্ল্যানিং, শপিং, ডেকোরেশন, হাবিজাবি বহু কাজ করতে হবে। তাই---। কিন্তু হানিমুনটাও তো মিস করা যাবে না কি বলো?
-তুমি দিনদিন এতো বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ কেন হ্যাঁ? বাঁধন আরশিকে নিয়ে খেলছে। এক্ষুণি এদিকে চলে আসবে---।
-হ্যাঁ তো? আসুক না। সমস্যা কি? বড় হয়ে বউকে আদর করতে হবে না? বাচ্চারা তো আমাদেরকে দেখে দেখেই শিখবে না?
-অসভ্য একটা লোক! ছাড়ো ছাড়ো ছাড়ো!
-আহা! এখনই এতো লজ্জা পাচ্ছেন ম্যাডাম? আমি তো আমার খুদে বাহিনীর সামনেও তোমায় আদরে ভরিয়ে রাখবো। তখন?
-তুমি একটা-----।
তিনদিনের জন্য সীবিচের কাছেই একটা আবাসিক হোটেলে ৫ টা রুম বুকিং করা ছিল ওদের জন্য। সবাই মিলে এক গাড়িতে না যেতে পারলেও বেশ মজা করেছে সবাই মিলে। তাওহীদ স্পেশাল পারমিশন নিয়ে প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত বিচে আড্ডা দিয়েছে সবাই মিলে। দিনে আশপাশে ঘুরেছে, বীচের কাছাকাছি শপিংমলে গিয়ে শপিং করেছে, সন্ধ্যায় হোটেলের ইয়ার্ডের বারবিকিউ পার্টি করেছে, সন্ধ্যার পরে সাগরের ঢেউয়ের সাথে ছুটোছুটি করেছে, বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে তারপর হোটেলে ফিরেছে ওরা। আর রাতগুলো তো মায়রার স্বপ্নের মতো কেটেছে। সময়গুলো চিন্তা করেই মায়রার সারা শরীরটা রোমাঞ্চিত হয়ে গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। একটু পরেই কানে আলতো করে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো মায়রা। পিছন ফিরে তাকাতেই আয়ানকে দেখে লাজুক হাসলো মায়রা। আয়ান মায়রার হাসি দেখে আরেকটু যেন প্রশ্রয় পেয়ে গেল। এক পা এগিয়ে এসে মায়রাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজলো।
-হানিমুনের সময়টা মিস করছেন ম্যাডাম? নাকি আদরগুলো মিস করছিলেন? একবার মুখ ফুটে বললেই তো হতো। আমি তো আপনার সেবার চব্বিশ ঘণ্টা নিয়োজিত ম্যাডাম---।
-তুমি এতো অসভ্য কেন বলো তো? সারাদিন এসব ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না?
-হাহ। সেটাই। আমিই খারাপ। কেউ আমার টিশার্ট বুকে জাপটে রেখে রাতের স্মৃতিটা মনে আগলে লজ্জায় লাল হতে পারে। আর আমি বেচারা সেটা মুখে বললেই খারাপ! ভালো ভালো! তা ম্যাডাম? এতো আদর খেতে মন চাইলে তো আদর দিতেও হবে। কতো আর হুট করে এসে লুট করবো আপনাকে? কখনো তো এগিয়ে এসে ধরা দিতে পারেন---?
-আমি বুঝি ধরা দিই নি জনাব?
-কোথায় আর ধরা দিলেন বেগম? এখনো আদর করা শুরু করলেই কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায় আপনার---। এই যেমন ধরো এখন যদি----।
-চুপ করো তো। কোথাও একটা যাবো বলে এখন আবার তার দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেছে।
-ওহো! এই মেয়েটা খালি খালি রোমান্সের সময় ডিস্টার্ব করে সবসময়। তোমাকে রাতে দেখাবো দাঁড়াও। কিন্তু লাজুক পরীটাকে এতো মায়াবী লাগছে যে শপিং এ যেতে তো ইচ্ছে করছে না গো। ইচ্ছে করছে পরীটাকে ভালোবাসায় মাতাল করে তুলতে----।
-দেরি হচ্ছে কিন্তু আয়ান? সন্ধ্যা হয়ে গেলে কিন্তু আমি যাবো না বলে দিলাম। কতো কাজ পড়ে আছে---।
-বাপরে বাপ! চলুন ম্যাডাম। আপনার কাজ তো পরে দেখছি আমি---।
গাড়িতেও আয়ান মায়রাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বিরক্ত করতে করতে শপিং সেন্টারে এসে পৌঁছেছে। মায়রাকে নিয়ে বেশ ঘুরোঘুরি করে বাবা মা আর নিজেদের জন্য কেনাকাটা করলো আয়ান। আয়ান মায়রার জন্য বেশ কতোগুলো শাড়িও অর্ডার করেছে। সেগুলো ট্রায়াল দিতে দিতে বেচারির হয়রান হওয়ার অবস্থা। শাড়িগুলো প্যাকিং করিয়ে দোকানে ব্যাগগুলো রেখে একটা জুয়েলারি শপে ঢুকলো ওরা। এখানে আয়ান মায়রার জন্য নেকলেস চয়েজ করতে গিয়ে মোটামুটি হিমশিম খেয়ে গেল। যা দেখছে তাই ভালো লাগছে। একটা একটা করে মায়রার গলায় পড়িয়ে দেখছে। আগেরটার চেয়ে পরেরটা আরো বেশি সুন্দর লাগছে। সব মিলিয়ে বেচারার তো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। অবশ্য শেষমেশ একটা নেকলেস সেট আয়ানের প্রচন্ড পছন্দ হলো। সেটা মায়রার গলায় পড়ার পর আয়ান যেন চোখ ফেরাতেই পারছিলো না মায়রার উপর থেকে। যেন এই নেকলেসটা শুধু মায়রার গলার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। মায়রার জন্য স্বর্ন কেনা শেষ হলে এবারে মায়ের জন্যও কাছাকাছি ডিজাইনের নেকলেস সেট পছন্দ করলো দুজন মিলে। নেকলেস দুটো প্যাকিং করা হয়ে গেলে বিল দিয়ে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালো দুজনে।
-মায়ু? তুমি ৫ মিনিট এখানে ওয়েট করো। আমি বাকি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে আসি কেমন?
-এই প্যাকেট দুটো তো দিয়ে যাও? ওখানে কত্তোগুলো বক্স!
-আরে বোকা? আমি কি সবগুলো নিয়ে আসবো নাকি? ওদের স্টাফরা বক্স নিয়ে গাড়িতে রেখে আসবে--। আর ম্যাডাম? আপনাকে কোন কষ্ট করতে হবে না। শুধু একটু ধৈর্য্য ধরে ৫টা মিনিট দাঁড়িয়ে থাকো এখানে চুপ করে। আর কিছু কেনা বাকি থাকলে চিন্তা করে নাও। কিন্তু খবরদার এক পা ও নড়বা না এখান থেকে---। ওকে?
-আচ্ছা---।
-এক্ষুণি আসছি আমি----।
-হুম---।
আয়ান শাড়ির দোকানের দিকে চলে যেতেই মায়রা একটু হেসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। জুয়েলারি দোকানটার বাইরেই করিডোরে দাঁড়িয়ে নিচের তলার দোকানগুলোরও একটা অংশ বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। মায়রা সেই দোকানগুলোয় লোকজনের আসা যাওয়া আর কথা বলার ভঙ্গি দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কয় মিনিট কেটেছে কে জানে! আয়ান আসছে না কেন সেটা ভেবে একটু বিরক্তও লাগছে মায়রার। রেলিঙের থেকে সরে একটু সামনে এসে দেখার চেষ্টা করলো আয়ান আসছে কি না। আয়ানকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা মানুষকে দেখে মায়রার হাত পা যেন প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল। লোকটা মায়রার থেকে প্রায় আট দশ ফিট দূরে দাঁড়ানো। মায়রার দিকেই এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছে। মায়রা কিছু ভাবারও যেন সময় পেল না। ভয়ে নাকি আতঙ্কে চোখ মুখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো মেয়েটার। কারো গায়ে ঢলে পড়ার মূহুর্তে মায়রার কানে কারো কণ্ঠস্বর এসে বাজলো। সেই মানুষটাও ব্যাকুল কণ্ঠে মায়রাকেই ডাকছে। ডাকটা ক্ষীণ হতে হতে একসময় চারদিকে সুনসান নীরবতা নেমে এলো যেন। ততক্ষণে মায়রাও এলিয়ে পড়েছে কারো বুকের উপরে।