খাগড়াছড়ি পৌঁছে গেছে ১০ মিনিট হলো তাদের। এবার চাঁন্দের গাড়ি ঠিক করতে গেছে জায়েদ আর ইউসুফ। সাবিত সবার সাথে দাঁড়িয়ে। তখন পাশ থেকে নুশরা বলল,,
---"সাবিত ভাইয়া আর কত সময় লাগবে?"
সাবিত ঘড়ি দেখে বলল,,
---" বেশী সময় লাগবে না আর।"
বুশরা বলল,,
---" আমার খুদা লাগচ্ছে।"
মিহুও তাল মিলালো।কুহু বলল,,
---" কেক আছে খাবি তোরা?"
হুর বলল,,
---"কেক টেক খেয়ে পেট খারাপ করতে চাই না।"
পাশ থেকে মিশু বলে ফেলল,,
---" আমাদের হজম শক্তি এতো কম না।"
হাসির রোল পড়ে গেল তখন। হুরতো রেগে মেগে আগুন। ইউসুফ আসতে কেঁদে কুটে বিচার দিয়া শুরু করে দিল সে। ইউসুফ তখন পড়ল মাইনকার চিপায়। তবুও ফেইক রাগ দেখিয়ে বলল,,
---"এই তোরা এমন করিস কেন? আর যাতে না শুনি!"
মিশু মুখ টিপে হেসে বলল,,
---",ওলে বাবুলে লাগ কলছে!"
হাসতে লাগলো আবার। কুহু মুখে হাত দিয়ে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। হুর তখন হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। ইউসুফ রাগে এক ধমক দিয়ে গাড়িতে বসতে বলল সবাইকে।
একে একে গাড়িতে সকলেই উঠে বসতেই গাড়ি ছাড়লো। ঘন্টা দুয়েকের মাঝে তারা সাজেক পৌঁছে গেল। সাজেক নেমেই ইউসুফ, জায়েদ আর সাবিত গেল হোটেল ঠিক করতে। কুহু আশ-পাশটা দেখে যাচ্ছে। কি সুন্দর অপরূপ সাজেকের। চারিদিকে এখনো সাদা কাঁশফুল দেখা যাচ্ছে।
কুহু মুগ্ধ নয়নে চারিদিকে চোখ বুলালো। মেঘার ভেলা এদিক ওদিক ছুটো ছুটি করছে।
ঠিক কুহুর মতোই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে ইউসুফ তাউ কুহুর দিকে বাতাসে তার এলো মেলো চুল গুলো আরো এলো মেলো হচ্ছে। ঠোঁটের কোনের মৃদু হাসি ইউসুফের বুকের মাঝে ধুকপুক ধুকপুক করে তাল তুলছে। মন চাইছে ছুটে তার বাবুইপাখির কাছে যেতে। জড়িয়ে ধরে সাজেকের মেঘমালা দর্শন করতে।
---" কিরে এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখিস?"
জায়েদের ধাক্কায় ভাবনা থেকে বের হয় ইউসুফ। তার দিক তাকিয়ে কাঁধে আবার ব্যাগ তুলতে তুলতে বলল,,
---" প্রকৃতির রূপ দেখি!"
জায়েদ চোখ মেরে বাঁকা হেসে বলল,,
--"তাতো আমি দেখছি! "
ইউসুফ মাথা নেড়ে পা বাড়ালো আর সবাইকে তাদের নির্দারিত রুমে যেতে বলল।
রুমে এসে যে যার রুমে ফ্রেস হতে চলে গেল।মিশু আর কুহুর রুম পড়লো একটাই। ঘন্টাখানিক পর ডাক পড়লো খাবারের। কুহু তখন ওয়াশরুমেই। মিশু বাহির থেকে ডেকে বলল,,
---" কুহু আমি বাহিরে যাচ্ছি তুই জলধি আয়।"
কুহু ভিতর থেকে আচ্ছা বলতেই মিশু কাঠের সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। আসার আগে দরজাটা চাপিয়ে ছিল সে।
ইউসুফের রুমটাও পড়েছিল তাদের পাশেই। আসার সময় দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ যেতেই দেখতে পায় কুহু জামা পড়তে গিয়ে যুদ্ধ করছে। হাসলো ইউসুফ ছোট বেলা থেকেই কুহুর বদ অভ্যাস ভেজা চুলে জামা পড়তে গিয়ে আটকে পড়ে চুলে। ইউসুফ নিঃশব্দে এগিয়ে গেল রুমে দরজা খুলতেই কুহু মিশু এসেছে ভেবে অসহায় ভাবে বলল,,
---"বড়পু হেল্প। চুলে আটকে গেছে জামায়।"
ইউসুফ কিছু না বলে কাছে গেল আলতো হাতে জামার চেইন থেকে চুল ছুটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কুহু ইউসুফের নিশ্বাসের সাথে পরিচিত। মুহূর্তেই বুঝে গেল তার ইউসুফ ভাই। কুহু একদম নিরব হয়ে গেলো। কতটা কাছে তার ইউসুফ ভাই সেই মাতাল করা ঘ্রাণ উফ!
ইউসুফ চুল ছাড়িয়ে দিয়ে নিচু কনরঠে বলল,,
---" এখানো এ অভ্যাস গেলো না।"
কুহু চমকালো না। তার সামনে থাকা আয়নায় ইউসুফের প্রতিবিম্ব দিক তাকিয়ে বলল,,
---" কিছু অভ্যাস কখনো চেঞ্জ হয় না ইউসুফ ভাই।"
কুহুর কথায় ইউসুফের সব মনে পড়লো শক্ত গলায় বলল,,
---"হে ঠিক। আবার কিছু অভ্যাস অগোচরেই বদলে যায়। যা ধরতে পাড়া যায় না।"
ইউসুফের কথায় চোখে জল আসতে দু সেকেন্ড লাগেনি। কিছু মুহূর্তে ছলছল করে উঠলো।ইউসুফ তা দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল।কুহু তার চোখের কোনে জমে থাকা জল টুকু ছেড়েই দিলো।
—————
খাবার শেষে ঠিক হলো এবার ঘুরতে বের হবে তারা। কাল সকাল সকাল ঘুরতে যাবে আলুটিলা রিচাং ঝরনা, ঝুলন্ত ব্রিজ আর কংলাক পাহাড়ে। সবাই বের হলো ঘুরতে। কুহু হেটে হেটে সাজেকের রংবেরঙের কটেজ দেখছে। তার সামনেই আছে একটি গির্জা। কিছু দূর আছে আদিবাসীদের কাঠের তৈরি ঘর। কি সুন্দর তাদের জীবন যাত্রা। সাজেকে বিদুৎ নেই সোলারে চলে সব। কুহু আরেকটু হেঁটে হেলিপ্যাডে এসে দাঁড়ালো। তখনি মৃদু আওয়াজে কায়া নামে কেউ ডাকছে তা ভেসে এলো।কুহু আওয়াজের উৎস খুঁজতেই এদুক ওদিক তাকালো। দেখতে পেল একটি ছেলে দৌড়ে এদিকে আসচ্ছে। কুহু ভ্রূকুচকায়। ছেলেটে কাছে এসে পড়েছে ততখনে। কাছে এসে দু হাটুতে ভড় দিয়ে হাঁপাতে শুরু করলো। খানিকটা জিরিয়ে মাথা তুলে বলল,,
---" কিরে কখন থেকে ডাকছি তোকে? শুনতে পাশ নি?"
কুহু ঠোঁটের হাসিটা প্রসারিত করে বলল,,
---"আশিক তুই এখানে?"
আশিক বুকে হাত দিয়ে ছোট শ্বাস ছেড়ে বলল,,
---" থ্যাংক গড চিন্তে তো পেরেছিস? আমি ভাবলাম চিন্তেই পারবি না..!"
---"কি যাতা বলিস তোকে কেন চিনবো না? তা এখানে কার কবে এলি? গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে আসলি নাকি?"
আশিক হেসে ফেলল,,
--" হে মানে না মানে!"
--"হইছে আর বলতে হবে না, জানা আছে কতটা প্লে বয় আপনি। বিয়ে করে নে এবার!"
--"করতে তো চাইছি তুই তো রাজি হচ্ছিস না?"
কুহু হেসে ফেলল। বলল,,
---"মজা করাও ছাড়লি না আর।"
আশিক তখন বিড়বিড় করে বলল,,
---"আমায় কবে বুঝবি তুই কায়া!"
---" কিছু বললি?"
আশিক মাথা নাড়ায় সে কিছু বলছে না।এভাবে আরো কিছুক্ষণ কথা হতে থাকে তাদের মাঝে।
এদিকে হুর ইউসুফকে টেনে আনে হ্যালিপেডে মূলত সে দেখেছিল কুহুকে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে। তাই ইউসুফকে তিল থেকে তাল বানিয়ে বলেছে হুর। ইউসুফ কুহু একটি ছেলের সাথে এভাবেকথা বলতে দেখে হুট করেই রাগ উঠে গেল।সে সেখান থেকে চলে গেল।
সকলেই সূর্য ডোবা দেখার জন্য যখন হ্যালিপ্যাডে এলো তখন আশিক বায় বলে চলে গেল। ইউসুফ তখন কোথা থেকে ধপাধপ পায়ে কুহু কাছে এসে টেনে নিয়ে গেল তাদের হোটেলের পিছন দিকটায়। আপাদত সবাই সূর্য ডোবা দেখতে গেছে। কুহু ইউসুফ এমন কাজে বিস্মিত। ইউসুফ তখন রাগে থরথর করে কাঁপছে।সে বলল,,
---" প্রেমিকেও পিছন পিছন নিয়ে এসেছিস?"
কুহু আকাশ থেকে পড়লো যেন।বলল,,
---" কি বলছেন এসব?"
ইউসুফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
---" লজ্জা করে না তোর তাই না,? বড় ভাই বোন দের সামনে এভাবে প্রেমিকে উপর লুটেপুটে যাচ্ছিস।"
---" আপনি কি সব বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পাড়ছি না।"
ইউসুফ এবার রাগে কুহু গাল চেপে ধরে বলল,,
---"প্রেম করিস ভাল আমার চোখের আড়ালে করবি আরেক বার ওই ছেলেকে এখানে দেখলে ভাল হবে না তোর জন্য?"
কুহু রেগে এবার এক ধাক্কা দিলো। ইউসুফ কিছুটা দূরে সরে গেল। কুহু চেচিয়ে বলল,,
---" আমি যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে কথা বলি? আপনার কি? আপনার বলার কোনো রাইট নেই? বুঝেছেন? "
কুহু কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। এ ব্যথা আর সহ্য হচ্ছে না তার। মরে যেতে ইচ্ছে করছে খুব।
—————
---"আর কত খাবি?এবার ছাড়?"
জায়েদের কথায় হেলদোল হলো না তার। সে আবার বলল,,
---"ইউসুফ এবার ওভার হচ্ছে কিন্তু ছাড়?"
টেনে নিলো মদের বোতল। ইউসুফ ফুপিয়ে উঠল তখন। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,,
---" ও আমাকে ভালোবাসা না কেন? কি দেই নি আমি? বলনা?"
জায়েদ ইউসুফকে সামলাতে সামলাতে বলল,,
---" সে তোর যোগ্য না ভাই!"
ইউসুফ আবার বলল,,
--"যোগ্যতা তো আমার নেই থাকলে আজ সে আমার থাকতো৷ বল না সেই আশিক ওরে কি দিল? যা আমি দিতে পারলাম না? বল না?"
এবার হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। না পেরে জায়েদ সাবিতকে ডাকলো। সাবিতও ব্যর্থ কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। ইউসুফের গা এবার গরম হয়ে এলো। কিছু মুহুর্তে হরবরিয়ে বমি করে ফেলল।এই কনকনে শীতে রাগের মাথা পানিতে দু তিন ঘন্টা গোসল করেছে ইউসুফ।জায়েদ রিসিপশনে কল করে লোক পাঠাতে বলল রুম পরিস্কারের জন্য। পরিস্কার করে যেতেই।সাবিত বলল,,
---"মিশুকে ডাক?"
মিশু এসে কি করবে ভেবে পেল না। হতাশ হয়ে ভাইয়ের পাশে বসে রইলো।জায়েদ ডাক্তার ডাকতে গিয়ে ব্যর্থ হলো এত রাতে ডাক্তার পাবে না তার। মাঝ রাত তখন।ইউসুফ তখনো জ্বরের ঘরে কুহুকে ডাকছে৷ মিশু না পেরে কুহুকে ডাকলো। তাতে রাগে আগুন হয়ে হুর বাঁধা দিলো। মিশু শুধু বলল,,
---" তোমার সাথে এ মুহূর্তে কোনো কথা বলতে চাইছি না। সরে দাঁড়াও। আগে আমার ভাই!"
কুহু এসে ইউসুফের হাত চেপে ধরলো। লোকটিকে এত কষ্টে দেখে বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে তার। কুহু বলল,,
---"ইউসুফ ভাই এইতো আমি!"
ইউসুফ নিভু নিভু চোখে তাকালো। চোখ গুলো তার ভিষণ লাল। বলল,,
---" আমায় ছেড়ে যাবি না তো?"
কুহু এবার কেঁদেই দিল। মাথা দুলিয়ে না করলো। বলল,,
---"খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার।জ্বর বাঁধালেন কিভাবে?"
ইউসুফ তার হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,,
---" কাঁদিস না কুহু।হালকা জ্বর, তুই এসেছিস ঠিক হয়ে যাবো। আমার মাথাটা খুব জ্বালা করছে কুহু। মাথায় হাত বুলিয়ে একটু ঘুম পারিয়ে দিবি? "
কুহু মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
রুম থেকে ততক্ষণে সবাই চলে গেছে। কুহুর কোলে মাথা পেতে কোমর জড়িয়ে শুয়ে আছে ইউসুফ। কুহুর আজ অনেক শান্তি লাগচ্ছে। ভালবাসার মানুষটি আজ কত কাছে।কুহু জলপট্টি কাঁপালে দিয়ে, ইউসুফের মাথার চুল টেনে দিতে দিতে খালি গলায় গান ধরলো গুনগুন করে কুহু।
"ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান, ঘুমাও আমার কোলে.....
ভালবাসার নাও ভাসাবো,ভালবাসি বলে....
তোমার চুলে হাত বুলাবো,পূর্ণ চাঁদের তলে .....
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার,জোসনা পড়ুক কোলে.....
আজকে জড়ায় ধরবে,তোমার মনকে আমার মন....
গাইবে পাখি, গাইবে জোনাক ;গাছ গাছালি বন....
এত ভালবাসা গো জান,রাখিও আঁচলে....
দোলাও তুমি, দুলি আমি, জগত বাড়ি দোলে .....
শব্দ ঘুমের মূর্ছনাতে,বাতাসও সুর তোলে.....
ভালবাসার শিশির কণা,পড়বে ও আঁচলে....
এত ভালবাসা গো জান,রাখিও আঁচলে....
দোলাও তুমি, দুলি আমি ;জগত বাড়ি দোলে .....
ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,ঘুমাও আমার কোলে.....
ভালবাসার নাও ভাসাবো,ভালবাসি বলে."