হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ০১ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০১!! 

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে গেস্টরা চলে যেতেই গট গট করে পা ফেলে রুমের দিকেই পা বাড়ালো প্রজ্ঞা। কাজের লোকেরা কিছু বলতে গিয়েও শেষমেষ ভয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেও একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। ওরাও বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে এই মূহুর্তে প্রজ্ঞার রাগটা জ্বালামুখীর রূপ নিয়েছে। ধূসর বাসায় ফিরে সমস্ত ব্যাপারটা কি করে সামলাবে সেটা ভেবেই সবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ওদেরই একজন সাহস করে ধূসরকে কল করেছিল একবার৷ কলটা রিসিভ না হওয়ায় আর কেউ সাহস করে নি আরেকবার কল করার বা প্রজ্ঞাকে এই নিয়ে কিছু বলার। পুরো বাড়িটা কেমন খা খা করছে এই মূহুর্তে। আর পুরো বাড়িটায় কেমন যেন একটা অসহ্য নিস্তব্ধতা খেলা করছে। কোনো শব্দই যেন আজ এই নিরবতা ভাঙতে পারবে না। কেমন একটা গা ছমছম করা গুমোট ভাবে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বাড়িটায়। 

ধূসর বাড়ি ফিরে সব কজন কাজের লোক চুপচাপ এদিক ওদিক হতাশ ভঙ্গিতে গালে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে অবাকই হলো। ধূসরকে দেখে বাড়ির মেইড সার্ভেন্ট সবাই তড়িঘড়ি করে ধূসরের কাছেই ছুটে এলো৷ ধূসর একটু বিব্রত হেসে ওদেরকে খাওয়া দাওয়া শুয়ে পড়তে বলে রুমের দিকেই ছুটলো। আজকে যে তার কপালে নির্ঘাত শনি আছে সেটা ধূসর খুব ভালোই টের পাচ্ছে। অন্তত পুরো বাড়ির এতো এতো ডেকোরেশনের পরও এই নিস্তবতা অন্তত সেটাই বলছে। অবশ্য নিজের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানেই মিসিং থাকার পানিশমেন্টটাও যে বড়সড়ই হবে এটা বেশ ভালোই জানে ধূসর। শাস্তিটা কতো বড় হতে পারে সেটার জন্যই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েই রুমে ঢুকলো ধূসর। প্রজ্ঞা রুমে নেই দেখে ধূসর আর দেরি না করে ওয়াশরুমে ঢুকে দুই মিনিটের মধ্যেই চোখেমুখে কোনোমতে একটু পানি ছিটিয়ে নিয়েই টাওয়াল দিয়ে মুখটা মুছে নিলো। তারপর বারান্দার দিকে পা বাড়ালো৷ তার পাগলিটা যে গাল ফুলিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা খুব ভালো করেই জানে ধূসর৷ ধূসর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পিছন থেকে প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরে প্রজ্ঞার কাঁধে চিবুক ঠেকালো। প্রজ্ঞা কিছুটা বিরক্ত হয়ে নিজেকে ধূসরের হাতের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। রাগে একটা কথা পর্যন্ত বলছে না মেয়েটা, শুধু ধূসরের শক্ত বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আর প্রজ্ঞার এমন অভিমান ভরা ছটফটানি দেখে ধূসর সব ভুলে হেসে ফেললো।

-প্রজ্ঞা? সরি না? প্লিজ মাফ করে দাও আজকের মতো? আর কখনো হবে না বাবা প্রমিস? 

-এতো কষ্ট করে তুমি বাসায় আসতে গেলে কেন? আজকে নাহয় অফিসেই থেকে যেতে---। সেটাই তো ভালো হতো তাই না মিস্টার ধূসর?

-সরি তো বউ? ভিষণ ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল--। সত্যি বিলিভ মি।

-রাত সাড়ে ১০ টার সময়ও তোমার কি এমন ইম্পর্ট্যান্ট কাজ থাকতে পারে হ্যাঁ? তাও আবার আমাদের ফার্স্ট এনিভার্সারির দিনেও---? কাজ শিখাও তুমি আমাকে? নাকি ব্যস্ততার অযুহাত দেখাও?

-সত্যি অনেক জরুরি ছিল কাজটা--।

-সে তো বুঝতেই পারছি। অনুষ্ঠানও শেষ, আর তোমার জরুরি কাজও শেষ। 

-এই প্রজ্ঞা? শোনো না?

-কাল সকাল থেকেই তো আবার জরুরি কোনো কাজ থাকবে তোমার৷ তাই না ধূসর? এখন যাও এখান থেকে। ছাড়ো?

-রাগ করে বললে ছাড়বো না তো ম্যাডাম--।

-ধূসর? ছাড়ো বলছি---।

-প্রজ্ঞা? এই বউপাখিটা? সরি তো? এমন করো কেন সবসময় বলো তো? তুমি তো জানো আমি এসব ফর্মালিটি পছন্দ করি না--। আর আমাদের এনিভার্সারি সেলিব্রেট আমরা করবো। বাকিদের কাজ কি আমাদের পারসোনাল স্পেইসে?

-আমি কাউকে আসতে বলি নি ধূসর--। কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা এলে তো তাদেরকে আমি 'সরি আমার স্বামী এসব অনুষ্ঠান পছন্দ করে না' বলে তাড়িয়ে দিতে পারি না--। আর এমন নয় যে তারা তোমাকে না বলে এসেছে বাড়িতে---। কি ভেবে গেল সবাই বলতে পারো? তোমার আমার রিলেটিভরা?

-প্রজ্ঞা? বাদ দাও না ওদের কথা?

-হ্যাঁ--বাদই দিয়েছি--। ছাড়ো এখন। আর কিচ্ছু বলবো না আমি। পরেরবার থেকে কেউ আমাকে যেন তোমার কথা জিজ্ঞেস না করে সেটাও বলে দিও সবাইকে--।

-আচ্ছা বাবা। বলে দিবো। কেউ কিচ্ছু বলবে না তোমাকে। জিজ্ঞেসও করবে না---।

-তা করতে যাবে কেন? আমি কে?

-আরে! কি মুশকিল! সবই দেখছি তুমি নিজেই বলছ! এটা কিন্তু ঠিক না বুঝসো মেয়ে?

-সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে--। ক্ষমা করুন এবারের মতো? এবার ছাড়ুন? আমি সারাদিন আপনার মতো এতো ইম্পর্ট্যান্ট কাজে ব্যস্ত না থাকলেও কিছু হলেও কাজ করেছি--। টায়ার্ড লাগছে--। ঘুমাবো--।

-আরে? প্রজ্ঞা? শোনো তো?

-কারো নিজের বিবাহ বার্ষিকীর কথা মনে না থাকতে শুনেছি সারাজীবন। কিন্তু ইচ্ছে করে নিজের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে না আসতে শুধু তোমাকেই দেখেছি। আবার এখন সে আমাকে শোনাচ্ছে তার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল---।

-সত্যি বলছি---।

-এই এই? কি সত্যি হ্যাঁ? কি সত্যি? তুমি অফিসেই ছিলে না আজকে সন্ধ্যার পর। আবার কথাও বলতে আসছো---?

-আরে! আমি কখন বললাম অফিসে কাজ ছিল!

-ও হ্যাঁ তাই তো! আপনার তো অফিসের বাইরেও কতো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। কত ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং থাকে আপনার অফিসের বাইরে। তাই না মিস্টার ধূসর?

-প্রজ্ঞা?

-একটাও কথা বলবা না তুমি। আমি বুঝসি তো---। আমাকে এখন আর ভালো লাগে না৷ তাই কতো অজুহাত তৈরি হবে এখন---।

-প্রজ্ঞা? এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা--। মানছি আমি দোষ করেছি না এসে--। কিন্তু--।

-তুমি দোষ করো নি। তুমি আসবে সেটা আশা করে আমিই দোষ করেছি। বোকার মতো আশা করে বসেছিলাম-- কারো পথ চেয়ে--।

-এই প্রজ্ঞা? কথাটা তো শোনো আমার?

প্রজ্ঞা আবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল । ধূসরের উষ্ণ স্পর্শে একবার কেঁপে উঠে প্রজ্ঞা আবার সরে আসার চেষ্টা করতেই ধূসর প্রজ্ঞাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে ধরলো। প্রজ্ঞার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু বিন্দুতে চোখ পড়তেই ধূসর আলতো হাতে প্রজ্ঞার চোখের পানিটা মুছে দিয়ে দু হাতের আঁজলায় প্রজ্ঞার মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।

-ইটস ওকে বউপাখিটা৷ রাগ করেই থাকো নাহয় আরো কিছুক্ষণ। এখন আপাতত আমাকে বাধা না দিয়ে চলো---। একটু ঘুরে আসি--।

-অসম্ভব--। আমি যাবো না কোথাও।

-প্রজ্ঞা প্লিজ? বাধা দিও না? আমাদের এনিভার্সারিটা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি--। ঘড়ির কাটায় হিসেব করলেও আরো একটা ঘন্টা সময় আছে হাতে। আর তুমি এটা জানতে চাও না কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আমার আসতে দেরি হয়েছে? হুম?

ধূসরের কথাটা শুনে প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে ধূসরের মুখের দিকে তাকিয়েই অবাক হলো। ধূসর নেশা জড়ানো চোখে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে প্রজ্ঞারও কেমন ঘোর লাগতে শুরু করেছে। ধূসর কিছুক্ষণ অপলকে প্রজ্ঞার অভিমানি, হতভম্ব, ঘোরলাগানো মুখটার দিকে চেয়ে থেকে আলতো করে প্রজ্ঞার কোমড় পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে নিজের সাথেই জড়িয়ে নিল। ধূসরের এমন নিবিড় আলিঙ্গনে প্রজ্ঞার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে অন্য কোনো জগতে। কথাটা মনে আসতেই আবার ধূসরের উপরে অভিমানটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো মেয়েটার। ধূসরের নিবিড় বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে একটু উশখুশ করতেই ধূসর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আলতো করে প্রজ্ঞার কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কিছুটা দূরত্ব রেখেই দাঁড়ালো প্রজ্ঞার পাশে। 

-এখনই আমাকে এতোটা ব্যাকুল করো না মেয়ে? আগে কাজটা কমপ্লিট করি---। তারপর যত ইচ্ছে হয় তোমার চোখের সাগরে ভাসিয়ে নিও। যত ইচ্ছে ঠোঁটের আদরে হারাতে দিও---। যত ইচ্ছে তোমার আদুরে শরীরে ভালোবাসার ছবি আঁকতে দিও---। কিচ্ছুটি বাধা দিবো না তখন---। আর তুমি বাধা দিলেও মানবো না---।

ধূসরের কথার কোনো জবাব না দিয়ে প্রজ্ঞা রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই এবারে ধূসর ব্যস্ত হাতে প্রজ্ঞার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে পা বাড়ালো বাইরের দিকে। প্রজ্ঞা ধূসরের গলা জড়িয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। এই লোকটার মাথায় কখন কি চলে বোঝা মুশকিল। আর ধূসর ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে প্রজ্ঞাকে নিয়েই নেমে এলো রুম থেকে। তারপর একেবারে বাইরে এসে প্রজ্ঞাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে স্টিয়ারিং ধরলো ধূসর। ধূসর প্রজ্ঞার একদম কাছে এসে সিটবেল্টটা বেঁধে দিয়ে সরে এসে নিজের সিটবেল্ট বেঁধে নিয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিলো। আর প্রজ্ঞা একমনে বসে ভাবার চেষ্টা করছে ওরা যাচ্ছেটা কোথায়।

দশ মিনিটের মাথায় ধূসর গাড়িটা একটা বিশাল বাংলো টাইপের বাড়ির সামনে থামাতেই প্রজ্ঞা অবাক হয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো। এই বাড়িটা কার বা কোথায় সেটা বুঝতে পারছে না মেয়েটা। কিন্তু পুরো বাড়িটায় এতো আলো জ্বলছে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো অনুষ্ঠান চলছে বাড়িতে। মনে হচ্ছে  কোনো বিয়ে বাড়িতেই নিয়ে এসেছে ওকে ধূসর। অথচ কোথায় কার বিয়ে! বাড়িটার আশেপাশেও একটা মানুষের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। প্রজ্ঞা গাড়ি থেকে নামতে নামতেই চারদিকটা দেখে নিচ্ছে অবাক চোখে। এখানে কেন এনেছে ওকে ধূসর সেটাই বুঝতে পারছে না। কিন্তু বাড়ির ফটকের বাইরে একটা নাম দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রজ্ঞার পা যেন থমকে গেল। থতমত খেয়ে আরেকবার নামটা পড়লো প্রজ্ঞা। আলোর ঝিকিমিকির মাঝেও নামটা আবার স্পষ্ট পড়তে পারলো প্রজ্ঞা।

"স্বপ্নকুটির"।

০২!! 

-তুমি আমার জীবনে এসে আমার অগোছালো জীবনটাকে স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর করে সাজিয়েছ বলেই আমার স্বপ্নের এই ড্রিম হাউজটার নাম হয়েছে স্বপ্নকুটির। ইচ্ছে ছিল ছোট্টো একটা কুঁড়ে বানিয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু এই ব্যস্ত শহরে এই বিশাল বাড়িটার চেয়েও একটা ৮ ফুট বাই ১০ ফুটের কুঁড়ে বানানো আরো বেশি অসম্ভব কাজ, বুঝলে? তাই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে এসে তোমার জন্য এই বাড়িটাকেই পছন্দ করতে হলো। সো মিসেস প্রজ্ঞা সালেহিন দিস ইজ ইওর ওয়েডিং এনিভার্সারির গিফ্ট।

স্বপ্নকুটিরের নেইমপ্লেটের সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে নামটা মুগ্ধ চোখে দেখছিল প্রজ্ঞা। মার্বেল পাথরে বাঁধানো 'স্বপ্নকুটির' নামটা মিটিমিটি জোনাকি বাতির আলোয় স্বপ্নের চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছে না প্রজ্ঞার কাছে। এর মধ্যেই ধূসর এসে একটা হাত টেনে বাড়ির সাজানো গেইটটার ভিতরে ঢুকে বাড়ির মেইন ডোরের দিকে পা বাড়িয়ে কথাগুলো বলছে। প্রজ্ঞা তখনো কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই ছিল যেন। ধূসরের সাথে পা জোড়া চলছে ঠিকই কিন্তু মনটা পড়ে আছে 'স্বপ্নকুটির' লেখাটাতেই। মেইন ডোরের সামনে এসে ধূসর প্রজ্ঞাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পাশ থেকে কিছু একটা নিয়ে প্রজ্ঞা হাতে ধরিয়ে দিল। প্রজ্ঞা এতোক্ষণে খেয়াল করলো মেইন ডোরের সামনে ফিতে বাঁধা। প্রজ্ঞা ধূসরের দিকে অবাক চোখে তাকাতেই ধূসর নিজের হাতটা বাড়িয়ে প্রজ্ঞার হাতে দেয়া কেঁচিটা ধরে দুজন মিলে একসাথে ফিতাটা কেঁটে ছোটোখাটো উদ্বোধন অনুষ্ঠান করলো। ফিঁতেটা কাঁটা হয়ে যেতেই ধূসর পকেট থেকে একটা চাবি বের করে সেটা আগের মতো প্রজ্ঞার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দরজার লক খুলতেই বাড়িটার মেইন করিডোরটা উন্মুক্ত হলো। ধূসরের এমন পাগলামি দেখে প্রজ্ঞা এবারে হেসেই ফেললো। এর পরে ভদ্রলোক কি করে সেটা দেখার অপেক্ষা না করে বাড়ির ভিতরে পা বাড়াতেই ধূসর প্রজ্ঞার হাত টেনে ধরে থামালো। প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে ধূসরের দিকে তাকালো। ধূসরও মিষ্টি করে একটা হাসি প্রজ্ঞাকে সামনের দিকে তাকাতে ইশারা করলো। ধূসরের দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রজ্ঞাও তাকালো মেইন ডোরের ভিতরের দিকে।

-মিসেস আহমাদ একটু দেখে শুনে পা ফেলুন বুঝলেন। স্বপ্বকুটিরের আনাচে কানাচে আরো বহু সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। তাই এতো তাড়াহুড়ো না করে আগে জুতো জোড়া খুলে নিন। প্রথমবার নিজের বাড়িতে পা রাখছেন এই মূহুর্তটাকে আজীবনের জন্য স্মৃতির পাতায় বন্দি করে রাখতে হবে না?

-মিস্টার হাজবেন্ড এনিভার্সারির সারপ্রাইজ দেয়ার চক্করে এটা ভুলে গেছেন যে বাড়ি থেকে গাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা আমাকে তিনি কোলে করেই নিয়ে এসেছেন। জুতো পড়ার সময় পেলাম কোথায়?

-ওহো! ভেরি ব্যাড। গেইট থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা বউটাকে খালি পায়ে হাঁটিয়ে এনেছি! তাও আবার আজকের দিনে? শিট!

-আরে ধ্যাত। ব্যাপার না। এবার যাওয়া যাক?

-ইয়েস ম্যাডাম। একটু সাবধানে ডান পা আগে বাড়ান বাড়ির ভিতরে। এই যে ক্লে ডিস্ক আমার পায়ের পাশেই পা বসাও।

-এটা কি ধূসর! ক্লে ডিস্কটা কোথা থেকে এলো?

প্রজ্ঞার আরো প্রশ্ন বানে জর্জরিত হওয়ার আগেই ধূসর প্রজ্ঞার সাথেই এক পা এগিয়ে এসে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লো। ভদ্রলোক কথা বলার ফাঁকেই নিজের জুতো খুলে নিয়েছে। বাড়ির ভিতরে পা ফেলতেই ধূসর নিচু হয়ে ঝুঁকে চারকোণা ক্লে ডিস্কটা তুলে নিতেই প্রজ্ঞা অবাক হয়ে দেখলো ডিস্কটা সুন্দর করে ফ্রেমের আদলো বাঁধানো আছে। ধূসর প্রজ্ঞার দিকে একনজর তাকিয়ে হেসে দেয়ালের এক পাশে ফ্রেমটা টাঙিয়ে দিল। দেয়ালে আরো বেশ কয়েকটা ফটো ফ্রেম ঝুলছে দেখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আরেকটা আশ্চর্য হলো প্রজ্ঞা। একটা ফ্রেমেও কোনো ছবি নেই, সবগুলো ফ্রেমেই সাদা ব্রাকগ্রাউন্ড ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। শুধু শুধু এতোগুলো খালি ফ্রেম দেয়ালে ঝুলছে দেখে বেচারি অবাক হলো নাকি বোকা বনে গেল কে জানে। ধূসর অবশ্য প্রজ্ঞার এমন বোকা হয়ে তাকানো দেখে হাসি চেপে রাখতে পারলো না। আনমনে হেসে ফেলে প্রজ্ঞার হাত ধরে সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা রুমে এসে হাজির হলো ধূসর। ঝকঝকে আলোয় পরিপাটি করে সাজানো রুমটা দেখে একটা লাক্সারি বেডরুম বলা যায়। রুমের মাঝামাঝিতে বিশাল সাইজের একটা বেড, বেডের এক পাশে ড্রেসিং টেবিল আর আলাদা দুটো আলমারি, কাবার্ড। আর রুমটার এক ধার ঘেঁষে বসার জন্য কম্পফোর্টএবল সোফা। বেশ ছিমছাম অথচ ভিষণ শৌখিনতার ছোঁয়া ফুটেছে রুমটার প্রতিটা কোণায়। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে প্রজ্ঞার।

-ম্যাডাম, হাতে সময় কম। ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করে নিন। বারোটা বাজতে চললো, অথচ ডিনার করাই হয়নি এখনো।

-আরে? তুমিও তো কিছু খাও নি এখনো!

-শশশশশ। চুপ। কথা কম। কাবার্ডে তোমার জন্য ছোট্ট একটা গিফ্ট রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করে নাও জলদি। হাতে কিন্তু সময় নেই। আর প্রচন্ড খিদেও লেগেছে।

-হুম।

ধূসর ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিতেই প্রজ্ঞা সেদিকেই পা বাড়ালো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে ধূসরকে আর রুমে পেল না প্রজ্ঞা। ভদ্রলোক আবার কোথায় গেল সেই চিন্তা বাদ দিয়ে প্রজ্ঞা কাবার্ডের ড্রয়ার খুলতেই একটা শপিং ব্যাগ পেয়ে সেটা নিয়েই বিছানায় এসে বসলো।  শপিং ব্যাগটা খুলতেই প্রথমেই একটা শাড়িতেই চোখ আটকে গেল প্রজ্ঞার। কালো তাঁতের উপরে মিষ্টি কালারের কারুকাজ করা জামদানি, কালো আর মিষ্টি কালারের মধ্যে হলুদ সুঁতোর নকশাটা জোনাকি বাতির মতোই ঝিলমিল করছে। ভারি মিষ্টি কালারের পাড়ের সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজও আছে দেখে শাড়িটা পড়াতেই মন দিল প্রজ্ঞা। মিনিট দশেকের মধ্যেই শাড়ি পরা শেষ হলে চুলগুলো সেট করতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আটকানো একটা স্টিকি নোটের উপরে চোখ পড়লো প্রজ্ঞার। হলুদ কালারের ছোট্টো চিরকুটটা আয়না থেকে হাতে নিয়ে লেখাটা পড়েই হেসে ফেললো প্রজ্ঞা।

"শাড়ি, চুড়ি আর কাজলের সাজে কাউকে দেখবো বলে ছাদে বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। একটু তাড়াতাড়ি এসো ওকে?"

এই লোকটা এতো পাগল কেন ভাবতে ভাবতেই ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা কালো খাঁজকাঁটা রেশমি চুড়িগুলো দুহাতে পড়ে নিল প্রজ্ঞা। সাবধানী হাতে চোখে আলতো কাজলের ছোঁয়া বুলিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য ছুটলো প্রজ্ঞা। দোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে পৌঁছে আরেকবার অবাক হতে হলো প্রজ্ঞাকে। ছাদে আসার আগে ভাবছিল এই অন্ধকারে ধূসরকে ছাদে কোথায় খুঁজবে, এদিকে ভদ্রলোক পুরো ছাদটা আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে শত শত মোমবাতির আলোয়। লাল, নীল, সাদা, হরেক রকমের মোমবাতিগুলো এমনভাবে সাজিয়েছে ধূসর যেন দূর থেকেই একটা বিশাল হার্ট শেইপ বোঝা যায়। ছাদের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে মোমবাতির এই ভালোবাসার নকশা, আর তার ঠিক পাশেই ছোট্টো একটা টেবিলকে ঘিরে দুটো চেয়ার রাখা। সেখানেও বেশ বড় সাইজের দুটো মোমবাতি জ্বলছে। প্রজ্ঞা মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে আসতেই ধূসরও ঘোর কাটিয়ে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে প্রজ্ঞাকে বসার জায়গা করে দিল। অন্ধকার রাত, মিটিমিটি মোমবাতির আলোয় খোলা চুলে এক জামদানি কন্যা। আর সে যদি হয় নিজের স্বপ্নের রাজকন্যাটি, তাহলে মুগ্ধ হতে, বা ঘোর লাগাতে কোনো দোষের কিছু নেই নিশ্চয়ই। প্রজ্ঞাকে মু্গ্ধ হয়ে দেখার ফাঁকে ফাঁকে টেবিলে খাবার সার্ভ করছে ধূসর। আর ধূসরের এসব পাগলামি কান্ড দেখে প্রজ্ঞা কিছু লাজুক হাসছে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে। 

-বারোটা বাজতে আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি ম্যাডাম। মিটিমিটি দুষ্টু হাসিতে আমার কনসেনট্রেট নষ্ট না করে খাওয়ায় মন দিন। এবার আশা করি ম্যাডাম বুঝতে পেরেছেন কি এতো ইম্পর্ট্যান্ট কাজে ব্যস্ত ছিলাম সারাদিন।

-উঁহু। বুঝি নি এখনো। হুট করে এই বাড়ি গিফ্ট দেয়ার কথা মনে হলো কেন জনাবের? বাকি সারপ্রাইজগুলো তো বাড়িতেও দেয়া যেত। ওটাও তো আমাদেরই বাড়ি।

-উঁহু। একটু তো পার্থক্য আছেই ম্যাডাম। ওই বাড়িটা বাবা আমার নামে কিনেছি। আমাদের বাড়ি বলতেই পারো, বা তোমার হাজবেন্ডের বাড়িও বলতে পারো।।বাট ওই বাড়িটা বাবার দেয়া, উনার পছন্দ মতো ডেকোরেট করা, আর তোমার জন্য এই স্বপ্নকুটিরটা আমি নিজের হাতে সাজিয়েছি। বিয়ের পর আমরা নতুন বাড়িতে শিফ্ট হওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে এই স্বপ্নকুটিরের প্রত্যেকটা দেয়াল সাজিয়েছি তোমার কথা ভেবে।

-আরেকটা বাড়ির কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল ধূসর? এমনিতেই আমাকে নিয়ে বাড়িতে অশান্তির সীমা নেই, তার মধ্যে মা বাবা যদি জানতে পারে তুমি এতো বড় বাড়িটা আমাকে এনিভার্সারিতে গিফ্ট হিসেবে দিয়েছ, তাহলে তো শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার শেষ আশাটাও বাদ দিতে হবে।

-প্রয়োজন ছিল তো বটেই। সেদিন মা যখন তোমাকে বলছিল বউকে নিয়ে তো ঠিকই বাবা দেয়া বাড়িতেই উঠেছে। কথাটা অনেক গায়ে লেগেছিল আমার। বাট মায়ের মুখের উপরে কিছু বলতে ইচ্ছে করে নি। 

-সেসব তো অনেক দিন আগেই মিটে গেছে। মা বাবা তো প্রতিদিন কল করে বাড়িতে ফিরে যেতে। তুমিই তো রাজি হচ্ছো না। কেন যে জেদ করে বসে আছো আমি বুঝি না।

-বাবা মা না থাকা কারো দোষের মধ্যে পড়ে না এটা যারা বুঝেও না বোঝার ভান করে প্রতিনিয়ত তাদের ছেলের বউকে টন্ট করতে পারে তাদের কাছে আবার ফিরে যেতে বলছ? ভালোবেসে তোমাকে বিয়ে করেছি প্রজ্ঞা। তাই বলে তোমাকে এভাবে প্রতিনিয়ত কারণে, অকারণে অপমানিত হতে তো দেখতে পারি না। ভালোবাসাটাও দোষের কিছু না, আর ভালোবেসে বিয়ে করাটাও দোষের কিছু না, এটা যেদিন বাবা মা বুঝতে পারবে সেদিন বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভাববো। তার আগে নয়।

প্রজ্ঞার আর কোনোরকম তর্ক না করে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে ছাদের ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো। জীবন ওকে একদিক দিয়ে যতটা না দিয়েছে অন্যদিক দিয়ে হয়তো ততটাই কেড়েও নিয়েছে। মধ্যেবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলেও বাবার রাজকন্যা হয়েই ছিল বলা যায়। বছর খানেক আগে একটা ছোট্টো এক্সিডেন্ট, আর চোখের সামনে বাবার স্নেহ, মায়ের আদর আজীবনের জন্য হারিয়ে যায় প্রজ্ঞার জীবন থেকে। সেই দুর্যোগের সময়টাতে সব আত্মীয় স্বজনরা হাত খাড়া করে দিলেও ছায়ার মতো পাশে ছিল ধূসর। আগলে রেখেছে, নিজের পরিবারের সবার অমতে বিয়ে করে সুন্দর একটা সংসার উপহার দিয়েছে প্রজ্ঞাকে। সেখানেও চাওয়া আর পাওয়ার হিসেবটা করে বারবার ঠকে যায় প্রজ্ঞা। কেন এই সুখেরা হঠাৎ করে এসে আবার হঠাৎ করেই হারিয়ে যায় ওর জীবন থেকে? জীবনের এসব অগোছালো হিসেব করার ফাঁকেই ধূসরের একটা কথা শুনে চমকে পিছন ফিরে তাকালো প্রজ্ঞা। ধূসরের বলা কথাটা হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারে নি, তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। আর ধূসর? সে ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি একটা রহস্যমাখা হাসি ফুটিয়ে প্রজ্ঞাকে দেখছে। আর প্রজ্ঞার মাথার তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে ধূসরের বলা কথাটা।

-বাড়িটা তোমাকে গিফ্ট করেছি সেটাও একেবারে ঠিক না। জানি তুমি বহু বাহানা করবে, আমার নামে কেন, নিজের কখনো নিজের চেষ্টার, পরিশ্রমে, অর্জন করতে পারলে তবেই নিজে বাড়ি কিনবো। ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই বাড়িটা আমি প্রত্যুষার নামে কিনেছি। প্রত্যুষা ধূসর আহমাদ, ওনার অব স্বপ্নকুটির।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন