হসপিটালের কথা শিফা তাহলে জেনেই গেছে। তাতেও কি? শিফার আরো জানা উচিত ছিল।
দিগন্তের মধ্যে হেলদোল দেখা দিলো না। কারণ জানে, শিফাকে বলে লাভ হবে না। তাই বলাও
বৃথা! শিফা কতটা উড়তে পারে? ধৈর্য্যের ও তেজ
কতদিন থাকে? ওর চোখের আড়ালে আরো কি কি করতে পারে? ক্ষমতা, বুদ্ধি, জোর, জেদ কত দিন থাকে? এসব দেখতেই ওকে ছেড়ে রেখেছে।
সব রকমের সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়েছে। যদিও ডানা কাটার সময় চলে এসেছে। প্রস্তুতও আছে! শুধু মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা। তারপর বরবাদ।
এই গতকালই তো, স্বপ্নীলকে শুটের পারমিশন দিয়েছে। তবে, বুকে নয় হাতে। সহজে মরে গেলে মজা আসবে না। মজা ছাড়া খেলাও জমে না। স্বপ্নীলের কিছু করতে মায়াও লাগে। বেচারা খুব ভীতু! কিন্তু কিছু করার নেই। করাও অাবশ্যিক।
শিফাকে খোঁচাতে হলে স্বপ্নীলকে আঘাত করতে হবে। নয়তো শিফা রাগবে না। আর না রাগলে ভুলও করবে না। কিন্তু ভুল করাটা খুব দরকার।
দিগন্ত চাচ্ছে, শিফাকে রাগাতে। নয়তো অনেক কিছুর হদিস পাবে না। সব ওর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তা কি আর হতে দেওয়া যায়? উহুম, না মোটেও না। শিফা যত রাগবে তত ভুল করবে। অথচ মেয়েটা রাগছেই না। বরং শান্ত হয়ে বসে আছে। আহা, কি সুন্দর করে কথা বলছে। যেন হসপিটালের কথা বললে সে থতথম খাবে। হ্যাঁ, রয়েল হসপিটালটা তার। আর নিজের জিনিসে
নিজের নাম থাকবে; এটাই স্বাভাবিক। মেয়েটা গাধী একটা! সহজ কথাটা বুঝছে না। দিগন্তকে হাসতে দেখে শিফা পুনরায় বলল,
-'মালিককে গুম করে হসপিটালটা নিজের নামে করে নিলেন। দারুন ব্যাপার। আচ্ছা, আপনার কি বিবেক বলে কিছু আছে?'
দিগন্ত একহাতে চুলে হাত বুলিয়ে শিষ বাজিয়ে গাড়ির গতি অনেকটাই কমিয়ে দিলো। তারপর
বামে মোড় নিয়ে শিফার দিকে তাকিয়ে বলল,
-'হুম নিলাম। তাতে কী? আর কি বললে, বি বি হ্যাঁ বিবেক। বাপ্রে, কী কঠিন শব্দটা। যাই হোক, এটা আবার কি?'
-'না চেনারই কথা। ওটা তো মানুষদের থাকে।'
-'আমাকে গরু মনে হয়?'
-' গরু হবেন কেন? আপনি, আপনি তো হলেন অমানুষ। হ্যাঁ, এই একটা শব্দ'ই আপনার জন্য পারফেক্ট। পছন্দ হয়েছে শব্দটা?'
-'হুম খুব-ব। এজন্য কাছে এসো একটা আদর দেই।'
শিফা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। পশুর চামড়াও নেই এর শরীরে। নয়তো এত বেহায়া, নিলজ্জ, হতো না। একে অমানুষ বলতেও রুচিতে বাঁধে।
এরচেয়েও নিকৃষ্ট সে। শিফা ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। থুথু ছুঁড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু এটা করাও সম্ভব নয়। শিফার মুখভঙ্গি দেখে দিগন্ত হাসল। তার শরীরে রক্ত ফুটছে। তবুও স্বাভাবিক আছে।
অবলীলায় অপমান করল। না, মেয়েটাকে কিছু করা দরকার। আজকাল একটু বেশি মুখ ছুটছে। দিগন্ত দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিলো। হাবভাব এমন, শরীরের আলসেমী ঝারছে। না, করলেই নয়। শিফা ঘুরে এদিকে তাকাতে; দিগন্তের কনুঁই লাগল, ঠোঁট বরাবর। ব্যস, দাঁতে লেগে ঠোঁটটা কেটে রক্ত গড়িয়ে গেল। শিফা ঠোঁট চেপে ধরল।
আচমকা স্বজোরে লাগাতে মাথাটাও ঘুরে গেছে। জ্বলছেও খুব। দিগন্তের ইচ্ছেকৃত করা বুঝতে ওর বাকি নেই। শিফা নিশ্চুপ! দিগন্ত মুখটা বাঁকিয়ে বলল,
-'সরি, ইস রে, খুব ব্যথা পেয়েছো?'
-'না, চাইলে আবার দিতে পারেন।'
-'এটা আগে হজম করো মনে করে পরে দিবো।'
কথাটা বলে দিগন্ত হাসল। শিফা চুপ করে হাতে লেগে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের রক্ত! তবে ভুলে ব্যথাতুর শব্দটুকু করল না।ওর ঠোঁটটা ফুলে গেছে। এটা দেখেও দিগন্ত হাসছে। আজকে ওকে হাসির রোগে ধরেছে। না চাইলেও হাসি পাচ্ছে। প্রথমে নিঃশব্দে হাসলেও পরে শব্দ করে হাসতে লাগল। হাসতে বেশ লাগছে।
_________________________________
বেশ কিছুদিন পর,
দিগন্ত এখন হসপিটালের কাজে প্রচুর ব্যস্ত। তা কিসের এত ব্যস্ততা? কেবল সেই জানে! কাউকে বলেও না। বাসাতে আসা-যাওয়ারও ঠিক নেই।
হুট করে আসে; চলেও যায়। শিফাও কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে দেখে যায়। তবে দিগন্ত আঘাত করতে ছাড়ে না। সুযোগ পেলেই হেসে কাজ সেরে ফেলে। আঘাত করার ধরণও নেই! মানসিক বা শারীরিক! যে কোনো একটা হলেই হয়। তবে হ্যাঁ,
আঘাতটা করেই ছাড়ে। এখন নিত্যদিনের কাজ হয়েই দাঁড়িয়েছে। এটা করে সে বেশ মজাও পায়।
তবে শিফা প্রত্যুত্তরে কিচ্ছু বলে না। দিগন্তকেও খোঁচায় না। সে আগের তুলনায় থম মেরে গেছে৷ চঞ্চলতাও নেই! যে যা বলে মুখ বুঝে মেনে নেয়। শাশুড়ি আর নিহার মতো সংসারে মন দিয়েছে। স্বামীর সেবাতেও মগ্ন থাকে। দিগন্ত উস্টা দিলেও, উঠে দিগন্তের কাছ ঘেষেই দাঁড়ায়। ওর কটু কথা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, সব সহ্য করে নেয়। এই শিফা যেন অন্য কোনো শিফা। তেজী ও সাহসী শিফা নয়। কেউ যেন জাদুর প্রভাবে ওকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। পূর্বের তেজী রুপটাও চাপা পড়ে গেছে। এহন পরিবর্তনে দিগন্তের মাথাব্যথা নেই। সময় কোথায় ? সে আছে নিজের ভুবনে। বাকি সবাই
ওর কাছে ফিঁকে। শিফা মরুক, বাঁচুক, তাতে ওর কী! উটকো ঝামেলা একটা!
এভাবেই সময়গুলো কাটল লাগল। রাত পেরিয়ে দিন। আর এক একটা দিন পেরিয়ে মাস গড়াতে লাগল। দিগন্ত অপমান করলে শিফা মাথা নিচু করে থাকে। অশ্রু ঝরায়! তবে ভুলেও প্রত্যুত্তর করে না। সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়াতে বললে তাই'ই করবে। ওর কোনো কথার হেড়ফের করবে না। তাই দিগন্ত আর কিছু বলে না। এসব নখরা ওর বরাবরই অপছন্দ। তাছাড়া, অহেতুক সময় ব্যয়ের মানেই হয় না। সময়ের মূল্য বোঝে সে। এভাবেই কেটে গেছে আরো তিনটা মাস।
সময় অতিবাহিত হচ্ছে সাথে জীবনের মোড়ও।
এই তিনমাস ধরে স্বপ্নীল নিখোঁজ। তাও আহত অবস্থায়। কোনোভাবেই সন্ধান মিলে নি। শিফা কানাডায় গিয়ে হন্ন হয়ে খুঁজেছে। কিন্তু পায় নি।
সাফা নেই আর স্বপ্নীলও নিঁখোজ। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে সাফার বাবার হার্ট এ্যার্টাক হয়।
হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পথে উনি মারা যান।
সাফার আম্মু এখন শয্যাশায়ী! কিছু বললে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। যেন উনার সব কথা ফুরিয়ে গেছে। কিছু বলার শব্দ খুঁজে পান না। সুখ-দুঃখ আর হারানোর শোকে বাকশক্তি হারিয়েছেন। সাজানো সংসারটাকে নিঃশেষ হতে দেখেছেন। মেয়ে এবং স্বামীর লাশ দেখে বাঁচার ইচ্ছেটুকুও শেষ। কলিজার টুকরো ছেলেও পাশে নেই। সেও হয়তো.....! ছেলে, মেয়ে, স্বামী, সুখ, আর কিছুই তো নেই। উনি থেকেই বা কি করবে?
তাই দিন-রাত নিজের মৃত্যু কামনা করেন। উনি মৃত্যুকে গ্রহন করতে প্রস্তত!
বর্তমানে উনি হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। উনার অবস্থাও যায় যায়। মনোবল না থাকলে যা হয় আর কি! শিফা রোজ দু'বার করে দেখে যায়।
এসবের মধ্যেই তনয়কে অপহরণ করা হয়েছিল।
তিন দিন আটকে রেখেছিল। টাকা বা অন্যকিছু
দাবিও করে নি। শুধু তনয়ের বাম হাতটা কবজি অবধি কেটে দিয়েছে। ছোট্ট বাচ্চাটা নিজের হাত দেখে কাঁদে। কেউ নাকি ওর সঙ্গে খেলে না।ওকে দেখে হাসে! চঞ্চল, প্রানবন্ত, তনয়ও এখন শান্ত হয়ে থাকে। এই ঘটনায় ছোট্ট বাচ্চাটার জীবনের রং বদলে গেছে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অাহত তনয়ের পকেটে শিহাব কালো কাগজের চিরকুট পেয়েছিল। তাতে
সাদা কালিতে লিখা ছিল,'শিফার উড়নচণ্ডীর উপহার।'
তখন থেকে শিফা জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছে।
জীবনের খৈই হারিয়ে ফেলেছে। সাহস ও জোর বিসর্জন দিয়েছে। শিফা সেদিন দিগন্তের পায়ের কাছে মাথা নিচু করেও বলেছে,
-'আমার সবকিছু ফিরিয়ে দেন। আর লড়াইয়ের কথা মুখেও আনব না। সারাজীবনের জন্য হার স্বীকার করব।'
দিগন্ত প্রত্যুত্তরে কিছু বলে নি। শুধু শিফার পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। মুখে তার বাঁকা হাসির রেশ।
তারপর থেকে'ই দিনগুলো এমন যাচ্ছে। শিফাও
আর লাগতে যায় নি। কমকিছু তো হারালো না।
আর কত? ওর আপনজনগুলোই নাহয় ভালো থাকুক।
দিগন্ত কেবল বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। রাত তখন দুইটা সতেরো। অনেক রাতেই ফিরে। শিফা এগিয়ে দিগন্তের চুল মুছিয়ে কফির মগটা হাতে দিলো। বেলকনিতে তেয়ালে মেলে দিগন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
-'আর কিছু লাগবে?'
-'হুম! উষ্ণ আদর কলঙ্কের ন্যায় ছড়িয়ে দিতে চাই; তোমার সর্বাঙ্গে।'
-'এমন তো কথা ছিল না, ঘুমান।'
-'উহুম, আমার সুখময় আদরে আজ ঝলসে যাক তোমার হৃদয়। আমি যত্ন করে রেখে দিবো, আমার বক্ষপিঞ্জিরায়।'
শিফা দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। কিছু বলার নেই ওর। দিগন্ত হেসে ওকে কাছে টানছে। গাল দু'টো ধরে দিগন্ত ওর চোখে চোখ রাখল। শিফাও চুপ করে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে। এই দু'চোখেতে অসীম মায়া। অথচ মনটা এত কঠিন কেন? এত পাষাণ কেন এই মানুষটা? এর
হৃদয়ের আনাচে-কানাচে কী একটুও মায়া নেই? কেন নেই? থাকলে তো গল্পটাও অন্যরকম হতে
পারত! দিগন্ত একদৃষ্টিতে শিফার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দু'টো দিগন্তকে খুব আকৃষ্ট করে। লোভও হয়! ওর বৈধ অধিকার আদায়ের লোভ। তখন শিফা বলল,
-'এত পাষাণ কেন আপনি?'
-'জানি না। বাঁধা দিবে না নয়তো রেগে যাবো।'
-'মনের টান নেই। সেখানে শরীর ...!'
-'আগে শরীরের হিসাবটা চুকায় তারপরে নাহয় মনেরটা।'
দিগন্ত ওর ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করতেই শিফা ডুকরে কেঁদে দিলো। মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করে, মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। বুকে ধাক্কা দিয়েও সরানোর বৃথা চেষ্টা করল। তবে পারল না। কারণ দিগন্ত পুরো ভরটুকু ওর উপরে ছেড়ে দিয়েছে। শিফার নড়ার ক্ষমতা নেই। চেষ্টাও বৃথা। দিগন্ত শুধু মিটিমিটি হাসছে। একপর্যায়ে শিফা হাল ছেড়ে নিশ্চুপ হয়ে রইল। পুরুষের শক্তির কাছে নারীর শক্তি বৃথা! এটা মানতে বাধ্য! সেও পারল না। সত্যি বলতে, মন ও শরীর আর জোরও নেই। বেঁচে আছে এই ঢের! এখন সহ্য করা আর অশ্রু ঝারানো ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। শিফাকে কাঁদতে দেখে দিগন্ত শব্দ করে হেসে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো। খুব
শক্ত বাঁধনে! যেন শরীরের মধ্যেই ঢুকিয়ে নিবে। শিফা খুব ব্যথা পেলেও প্রকাশ করল না। লাভও হতো না। শিফা শেষ চেষ্টাটুকু করেও ব্যর্থ হলো।
দিগন্ত শিফাকে আর সুযোগ দিলো না। নিজের কাজে মগ্ন হলো। পুরুষালি শক্তির কাছে শিফাও হার মানল। অশ্রু ঝরিয়ে গ্রহন করল ভাগ্যকে!
দিগন্ত ততক্ষণে তলিয়ে গেছে এক অনিন্দ্য সুখ রাজ্যে। বদ্ধ উন্মাদের মতো! একপর্যায়ে শিফাকে দিগন্তের আদর নামক কলঙ্ক'ই মাখতে হলো; ওর পুরো সর্বাঙ্গে।