সাদ ফুফিয়ে কাঁদছে। বাসার নতুন মালিটি সাদকে ঐ অবস্থায় দেখে দৌড়ে এলো। আতঙ্কিত গলায় বলল-
~" বাবা তুমি এখানে কি করছো!"
মানুষ যতই শক্তি সামর্থ্য হোকনা কেন, কবর আর মৃত্যুর কথা শুনে তাদের শরীর কেঁপে উঠবেই। নতুন মালী আফাজ মিয়ার শরীরও থরথর করে কাঁপছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে তার ভিতর আকাশে মেঘ জমেছে। সো সো বাতাস বইছে।
ভয়ে ভয়ে সাদের কাঁধে হাত দিতেই চমকে উঠলো। সাদ অঝোরে কাঁদছে। তিনি আর দেরী না করে, দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে সাদকে কোলে নিয়ে নিজেই কেঁদে ফেললেন। বাবা-মা ছাড়া সন্তানের দেখাশোনা কেউ করেনা ঠিকমত। বাসার মানুষ কি মরে গেছে! এতটুকু বাচ্চা বাসা থেকে বের হয়েছে তার খেয়াল কেউই রাখেনি? সবাই জানে তার পরিবারের সাথে কি হয়েছে তবুও তাকে দেখে শুনে রাখবেনা!
আফাজ মিয়া চিৎকার দিতে দিতে দরজার কাছে আসতেই একটা কাজের ছেলে সহ নান্নুর মা বের হয়ে এল। পিছনে বাতাসি আর কুসুম ও আসলো। বাতাসিকে দেখে আফাজ মিয়া নিচু গলায় বলল-
~" মা মাফ করবেন, সাদ বাসা থেকে কেমনে বের হয়! বাচ্চাটা ওর বোনের কবরের পাশে বসে কাঁদছিল। দিনকাল যা খারাপ। এই ভর সন্ধ্যায় ও কবরের পাশে কেন! ভয়ে আমরা যেখানকার ছায়াও মারায় না। সেখানে ও বসেছিল। আপনারা ওর দেখাশুনা না করতে পারলে ওর বাবারে কল দেন। যার সন্তান তাই নিয়ে যাবে। ওর মা-বাবা থাকলে কি এমনটা হতে দিত?"
~" ঐ ফকন্নির বাচ্চা, মুখোত লাগাম দে। অামাগো শিখাইতে আইছোস ছাওয়াল ক্যামনে মানুষ করতে হয়! পাগলের ছাওয়াল পাগলই হইছে। পাগল না হইলে এই সময় কব্বরের পাশে বইয়া থাকে? ওরে দিয়ে কিচ্ছু হবে। খালি খালি মাহাদের টাহা পয়সা নষ্ট করতাছে।"
বাতাসির মুখের এমন ভাষা শুনে উপস্থিত সবাই হতবম্ভ হয়ে গেল। একে মানুষ বলা যায়! পশুর চেয়েও অধম। আফাজ মিয়া ভালো করেই জানে, মা পাশে না থাকার যন্ত্রনা কি রকম! ছোটকালে মা মারা গেছে। মা যদি বেচে থাকতো তাহলে তার জিবনটা হয়ত অন্য রকম হতো। চোখের পানি মুছে ওখান থেকে চলে গেলেন তিনি।
কবরের পাশে বসে ছিল বলে ভয়ে সাদের পাশে কেউ যাচ্ছেওনা। শেষে কুসুম এসে ওকে ভিতরে নিয়ে যেতেই উপর থেকে নিসা বলে উঠলো-
~" এই ওকে গোসল করে বাসায় ঢুকাও। আর আমার মেয়েদের কাছে যেন ও না ভিড়ে। যাও জলদি করো।"
নিসার এমন কথা শুনে বাতাসি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। গলার তেজ বাড়িয়ে দিয়েই নিসেকে কথার জালে আষ্টে-পৃষ্ঠ করে জড়িয়ে ফেলল।
~" ঐ কি কইলি, আর একবার ক! অ্যার বংশের বাত্তিরে এত্ত বড় কথা কস? তোর সাহস তো কম লয়। সাপুন্নীর বেডি কাল নাগীন। খাড়া আজ তোর ভাতার আসুক, তারপর কি কইতে হয় হেইডা কমু।"
নিসাও মুখ চালালো। আমি আপনাকে ভয় পাই নাকি! আপনি ওরে কত কথা বললেন! তার বেলায়? এখানে সবাই শুনছে আপনি কি কি বলছেন?
~" আই আর বংশর বাত্তিরে যা ইচ্ছা তাই কমু। তুই কওয়ার কে হে! ফকিন্নির বাচ্চা জমিদারনীর ভ্যান ধরস! তোর চোপায় ভাঙ্গমু। কত্ত বড় সাহস ও অ্যার বংশের এক লত্তি বাতিরে এই রকম কতা কয়! আই বাতাসি মরি নাই। খালি মুখ দিয়া আর একবার কতা বের কর তার পর দেখ আই বাতাসি কি করতাম। চুলের মুটি ধরে ছিচড়েই তোরে নিচে নামামু। খালিতো মাইয়া জন্মাই ঠিকি দেস, মরদ জন্মাই দেখা দিনি!
যেমন মা তেমন মাইয়া। একটা মাইয়ারেও মানুষ করতে পারেনাই। সব কটা বিছাতু। মন চায় এহোনি বাড়িত থাইকা বাইর কইরা দেই।"
কুসুম বাতাসির ব্যবহারে খুব খুঁশি। তাই বাতাসির কানের কাছে গিয়ে বলল-
~" আপনার নাতী বউতো একটা ঘঁষেটি বেগম। বিয়াদপ্প মহিলা একটা। এই রকম মায়ে সন্তানরে কেউ বিয়ে করলে এই মহিলায় যথেষ্ঠ মেয়ের সংসার ভাঙ্গাতে।"
বাতাসি বিবি কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার ফিসফিসিয়ে বললো-
~" হ্যা রে কুসুম, ঘঁষেটি ডা কে রে! বড় ডাহাত নাকি?"
~" ডাকাতের থেকেও খারাপ। আপনি শুধু তারে একবার ঘঁষেটি বলে দেখেন। তারপর যাদু দেখবেন। "
কুসুমের কথা বাতাসির খুব পছন্দ হলো। তাই সাথে সাথে জোড় গলায় বৃদ্ধ কাজের লোক ফজলারে ডাকলো। এই ফজলা কই আছোস, অ্যার সামনে আয়।
ফজলা আধা দৌড়ে এসে বলল-
~ " ভাবীসাব কিছু কইবেন?"
~" কওয়নের লাইগাইতো ডাকছি। শোন বাজার থাইকা একখান বড় পাঙ্গাস মাছ, পল্টি মুরগি, সাদা মুলা লইয়া আয়। আজ এই বাড়ীত আকীকা হইবো। পাঙ্গাস আর পল্টি মুরগি জবাই দিয়া নিসা কালডাকনীর নাম বদলাইয়া আজ ঘঁষেটি বেগম রাখুম। আকীকার মাছ, মুরগী, মুলা দিয়া খিচড়ি পাকামু। তারপর এলাকার সক্কল কুত্তাদের আজ মেহমান বানামু। পেট পুইড়া খাওয়ামু। যা যা জলদি কর। হাতে সময় নাই। "
নিসা কোন কথা না বলে রুমের ভিতর গিয়ে ভাঙ্গচুর করতে লাগলো। বিয়াদপ মূর্খ মহিলা, আমার জিবন তছনছ করে ফেললো। আমি এক মুহুত্বও এই বাসায় থাকবোনা। আপনার মত চুকাল মহিলারে শুধু আপনার ছেলেই পূজা করবে। আপনারে কেউ দেখতে পারে? মুখ দিয়ে শুধু চলাফেরা করেন। আমার ক্ষমতা থাকলে আপনাকে জুতাপেটা করে বাসা থেকে বের করে দিতাম। কব্বরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তবুও মুখের বচন কমেনা।
নিসার এসব কথার মাঝেই কামরান সাহেব, লাবীবা আর ফুয়াদ বাসায় এসে পড়ে। কামরান সাহেব সব কথা নিজের কানে শুনে রেগে গেল। বাতাসি বিবি ছেলের মনের আগুন বাড়িয়ে দিল মুখে আচল পুরে কেঁদে কেটে। দেখ, দেখ আই নাকি ওর লগে একলা লাগি! মুরব্বিদের নাকি জুতিপেটা করবো। তোর পোলাতো একখান মাগীর ভ্যাড়া, বউ যা কইবো তাই শুনবো। অ্যার কপাল খারাপ না হইলে দুই দিনের মাইয়া অ্যারে এভাবে মানহানি করে! মাহাদের পোলার সাথে যে ব্যবহারডা করলো, কোন মাইয়া মানুষ এমন করে না। বজ্জাদ মহিলা তোর বুক খালি হলে বুজবি ছাওয়াল কি জিনিস। আল্লায় তোর বিচার করবো।
দাদীর কথাগুলো ফুয়াদের বুকে এসে লাগলো। সে তৎক্ষানাত উপরে উঠে গিয়েই নিসাকে ধরে কয়েকটা ঠাস ঠাস করে চড় বসালো। নিসারও পাল্টা ধমক মারলো ফুয়াদকে। বুড়ীর কুটনামো শুনে আমার সাথে লাগো কাপুরুষের দল। ঐ একজন সবার মথায় উঠে নাচে আর তোমরা সেটা মেনে নিলেও আমি মানবোনা।
ফুয়াদ রেগে গিয়ে নিসার হাত ধরে টেনে রুম থেকে বের করে বলল-
~" এক্ষুনি তুমি বাসা থেকে বের হয়ে যাও। আমি যদি কখনো তোমাকে ফিরে আনতে যাই তো আমি আমার বাবার সন্তানই না। এক্ষুনি বের হও।"
আমি কিছু বলিনি বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো নিসা। তুমি সবাইরে জিঙ্গাসা করে দেখ! উনি আগেই আমার সাথে লেগেছে।
~" তুমি ঠিক কি কি বলতে পারো সেটা আমার থেকে কেউ ভালো জানেনা। একটা ছোট্ট বাচ্চাও তোমার ক্রোধের শিকার হয় কি ভাবে! আমাকে চেনাতে হবে তুমি কি জিনিস! বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করলে এই হবে। যেমনটা আমি এখন উপভোগ করছি। আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও।"
আমার এসব ভালো লাগছেনা। থামবে তোমরা? একটা মেয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে আর তোমাদের মনে ফুর্তি জেগেছে! কথাগুলো বলে কামরান সাহেব সাদকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।
সাদও সাথে সাথে বলল-
~" দাদাজান আমি তো অপবিত্র হয়ে গেছি। অথীর কবরে বসে ছিলাম। আমি গোসল দিয়ে আসি?"
কে বলেছে আপনি অপবিত্র হয়ে গেছেন ভাইজান! আপনাকে পেয়ে আমরা কত সৌভাগ্যবান সেটা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেও শেষ করা যাবেনা। কামরান সাহেব সাদকে অনেকগুলো চুমা খেয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
সাদ ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে দাদাভাইয়ের চোখ মুছে দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো।
♥
রাত ৯টার দিকে তিতিরকে রেখে মাহাদ বাসায় এলো। আফাজ মিয়া মাহাদকে কল দিয়ে সব কথা বলেছে। সব কিছু গুছিয়ে আসতে মাহাদের একটু দেরীই হয়েছে। বাবাকে দেখে সাদ আর একমুহুত্বও দেরী না করে বাবার কোলে যেন ঝাপিয়ে পড়লো। ছেলেটা বাবাকে পেয়েই ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। বাসার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। ছেলেকে নিয়ে আর একমুহুত্বও দেরী করলোনা। বাসা থেকে বের হতেই কামরান সাহেব পথ আগলে দাড়িয়ে বলল-
~" আমরা কি এত অপরাগত হয়েছি যে সাদের খেয়াল রাখতে পারবোনা!"
মাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
~" আমি আমার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে এখানে মোটেও আসতে চাইনি। আপনি আসতে বাধ্য করেছেন। আমার সন্তান একমাত্র আমার কাছেই নিরাপদ। আর ও আমার কাছে থাকতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। আমি যদি বাসায় থাকতাম তাহলে আমার মেয়েকে অন্যজায়গায় রাখতাম। কি করবো! আল্লাহর ইচ্ছা একটু অন্য রকমই ছিল।"
মাহাদের কথা কামরান সাহেব সহ সবার মনে ব্যাপক আঘাত করলো। বাতাসি বিবি তো মুখ ফুটে বলেই ফেলল-
~" আমাগো আওলাদ-দুনিয়া, আর আমগো তার জন্য মায়া হবেনা! কি কস তুই?"
~" বলতে তো অনেক কিছুই চাই। কিন্তু ধৈর্য্য ধরা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। আমরা শুনি একটা আর আড়ালে হয় অন্যটা।"
কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাদকে নিয়ে মাহাদ চলে গেল বাহিরে। বাহিরে এসে খানিকক্ষণ দাড়ালো। তারপর ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল-
~" তুমি অতিথীর কাছে কেন গিয়েছিলা বাবা!"
~" আমার এক্সামের রেজাল্ট দেখাইতে।"
সহজ-সরল জবাব দিল সাদ। মাহাদ অতিথীর কবরের দিকে হাটা দিল। কবরের কাছে এসে ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে বলল-
~" অথীকে দেখতে এসেছিলে, কিন্তু খালি হাতে এসেছিলে কেন? ওকে তো কিছু উপহার দেওয়ার উচিত ছিল তোমার।"
~" কি দিতে হয় বাবা!"
মাহাদ ছেলেকে হাত তুলে ধরতে বলল। তারপর স্নেহের সাথে বলল-
~" মন যা চায় তাই আল্লাহ্কে বলতে পারো বাবা। মনে করো আল্লাহ্ তোমার সামনে আছেন। অতিথীর জন্য দোয়া করো।"
ছেলেকে উপদেশ দিয়ে ও একটু জোড়ে জোড়ে বিভিন্ন দোয়া পড়ে কবর জিয়ারত করতে লাগলো। খানিক বাদে কামরান সাহেবও শামিল হল তাদের সাথে। সব কাজ শেষে দাদাকে সালাম দিয়ে সাদ ওর বাবার সাথে চলে গেল মায়ের কাছে।
রাস্তার মধ্য যতটা পারলো ছেলেকে খুঁশি রাখার চেষ্টা করলো। তারপর দোকান থেকে অনেকগুলো চকলেট নিল এবং রাতের খাবার খাইয়ে হসপিটালে নিয়ে গেল।
কয়েকদিন পর সাদ গোলাবকে দেখেই ছুটে এলো। আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?
সাদকে দেখে গোলাব ফ্লোরেই কয়েকটা পলট খেয়ে খুঁশিতে কেউ কেউ শব্দ করে গলা মিলালো। তিতির অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সাদ আর গোলাব দু'জনেই খুঁনশুটিতে মেতেছে। সবাই আছে কিন্তু মেয়েটা নেই। সাদকে সোফার উপর শোয়ার জায়গা করে দিতেই গোলাবও সেখানে জায়গা করে নিল। ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে তিতিরের কাছে সুয়ে পড়ল। তিতিরকে বুকের ভিতর নিয়ে মাহাদ চুপ করে রইলো। ঘুম আর ওর আসলোনা। চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে পড়তে লাগলো।
♥
পরের দিন সকালে হসপিটালের সব কাজ শেষ করে তিতির আর ছেলেকে নিয়ে বাসায় রওনা দিলো। তিতির বরাবরই চুপ করে ছিল। ওকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে মাথা বাদে পুরো শরীর মুছে দিয়ে কাপড় পাল্টিয়ে বেডে এনে সুয়ে দিয়ে কুসুমকে ২টা প্লেটে করে খাবার আনতে বলল।
কুসুম খাবার আনলে সাদকে খাবার খেতে বলে তিতিরের মুখে এক লোকমা ভাত দিতেই তিতির না করলো।
মা খাবারগুলো খুব ভালো। আপনি খান না বলতেই তিতির সাদের দিকে চেয়ে রইলো কিন্তু খাবার খেলোনা। মাহাদও আর জোর না করে বাহিরে চলে গেল। আধাঘন্টা পর বিভিন্ন মাখা টকের ভর্তা, ফুচকা, বিরিয়ানী সহ ফাস্টফুড এনে তিতিরের সামনে ধরতেই ওর চোখে মুখে হাসির ঝলক দেখা দিল। সাদ ততক্ষনে স্কুলে চলে গিয়েছে।
মাহাদ তিতিরের মুখে খাবার তুলে দিতেই ও মাহাদের গাল ছুয়ে দিল ওর হাত দিয়ে। মাহাদ সাথে সাথে চোখ বন্ধ করলো। ওর চোখ ছলছল করে উঠলো। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল-
~" খাও....!"
তিতিরের মুখে খাবার পুরে দিতেই ও মাহাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতটা বাড়িয়ে দিল। মাহাদ জানে তিতির কি চাচ্ছে। তাই উঠে দাড়াতেই তিতিরের চোখ ছলছল করে উঠলো। ভাবলো, মাহাদ চলে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। কিন্তু মাহাদ উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করতেই তিতিরের মুখে আবার হাসি ফুটলো। আবার মাহাদের দিকে ওর হাত বাড়িয়ে দিল। মাহাদ সাথে সাথে হাতের পিঠে শব্দ করে একটা কিস করলো। মুখের খাবার খতম করতেই আবার ওর মুখে খাবার পুরে দিতেই ও মুচকি হেঁসে ওর গালটা এগিয়ে দিল। মাহাদ সাথে সাথে গালে কিস করলো। নাহ্ এতে ওর মন ভরছেনা যেন। আবার গাল এগিয়ে দিল মাহাদের দিকে। মাহাদ আবার ওর গালে কিস করলো। এভাবে বার বার মাহাদের দিকে গাল বাড়িয়ে দিচ্ছে আর মাহাদ প্রতিটা লোকমাতে ওরে কিস করে যাচ্ছে। এটাই যেন ওর কাছে শান্তি। শেষে মাহাদ খাবার রেখে পুরো দমে তিতিরের উপর চড়াও হয়ে বলল-
~" কোন কোন জায়গায় লাগবে আমাকে শুধু বলো। তারপর দেখ আমি কি করি।"
তিতির যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিলো। ওর জামাটা খুলে মাহাদের কাছে বসে বলল-
~" সব জায়গায় চাই।"
তিতিরে হঠাৎ পরিবর্তনে মাহাদ নিজেই শর্ক খেয়ে গেল। এত পরিবর্তন কি করে সম্ভব! এটাতো স্বাভাবিক নয়! মাহাদ ভ্রু কুচকে বলল-
~" আর ইউ সিরিয়াস! তুমি সব জায়গায় চাও?"
তিতির মুচকি হেসে মাথা উপর নিচ করে সায় দিল মাহাদের কথায়। বরং ও নিজেই মাহাদের দিকে এগিয়ে গেল। মাহাদ ওর সমস্ত কষ্ট যেন নিমিষেই ভুলে গেল। এতদিনের কষ্ট সব কিছু ভুলে গিয়ে তিতিরের উপর ঝাপিয়ে পড়লো এবং ঠোটের ছোয়া দিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। সেকেন্ডেই যেন কয়েকটা করে কিস পড়ছে। প্রায় হাজার দু'য়েকের মত কিস করে মাহাদ মুখ তুলে বলল-
~" আর চাই?"
তিতির কোন কথা না বলে মাহাদের ট্রীশার্টের ভিতর ঢুকে ওকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো। এভাবে কিছুক্ষন থাকতেই নিচে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেল ওরা। মাহাদ তিতিরকে নিয়েই বিছানা থেকে উঠে বলল-
~" আবার কি হল! তুমি থাকো, আমি যাব আর আসবো।"
তিতির শুধু ঘাড় নাড়িয়ে মাহাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতেই মাহাদ নিজেকে ঠিক করেই দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে দেখলো, বাতাসি আফাজ মিয়ার সাথে ঝগড়া লেগেছে। বাতাসি চিল্লায় বলছে-
~" সত্যি করে ক আফাইজ্জা, কাল মাহাদরে কে কল দিয়ে বাড়িতে আনছে!"
আফাজ কোন কথা না বলে ভয়ে চুপসে গেছে। অসহায় ভাবে মাহাদের দিকে তাকাতেই মাহাদ নিচে নেমে এসে বলল-
~" কি হয়েছে! এত চিৎকার চেঁচামেচি কিসের? বাসায় একজন অসুস্থ আর তুমি গলার স্বরে ধার দিচ্ছো? মেয়ে মানুষের কন্ঠ এত জোড়ে হবে কেন?"
মাহাদের ধমকে বাতাসি মুখে কুলুপ এঁটে রইলো। তারপর আবার বলল-
~" সোয়ামী আপনি কখন আইছেন? ঐ তোরা কইবিনা! অ্যার সোয়ামী বাড়িত আইছে!"
মাহাদ চোখ গরম করে বাতাসির দিকে চেয়ে রুমের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করতেই বাতাসি সুড়সুড় করে ওর রুমের দিকে পা বাড়ালো। আফাজ মিয়া যেন জান নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসা হতে বের হতে পারলেই বাঁচে। বাতাসি রুমের কাছে গিয়ে আবার পলট ফিরে মাহাদের দিকে চাইতেই দেখলো, মাহাদ ওভাবেই চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। বাতাসি বিরবির করে বলল-
~" বউ পাগল হইয়া গেছে। পুরুষ মানুষ, শেষে পাগল বৌরে ছাইড়া অ্যার উপর না হামলা করে। বাতাসি পালা, আপন প্রান বাচা......।"
♥
লাবীবা বেগম তিতিরকে দেখার জন্য রুমে ঢুকতেই ও চমকে উঠলো। মাহাদ রুমে নেই এই সুযোগে তিতির ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অতিথীর কবরের দিকে। আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে এবং চোখ মুছছে। লাবীবা উচ্চ কন্ঠে বলল-
~" তিতির, ওখানে কি করছো তুমি! ওখান থেকে চলে আসো!"
তিতির চট করে ওর শাশুড়ীর দিকে চাইলো। তিতিরের চোখ অস্বাভাবিক লাল দেখাচ্ছে। ওর চোখ যেন অন্য কথা বলছে। মাহাদ ওর মায়ের কাছে এসে দাড়াতেই তিতিরের চেহারা স্বাভাবিক হয়ে গেল। মাহাদও বিশ্ময়ের সাথে বলল-
~" ওখানে কি করছো তুমি! রুমে আসো?"
তিতির মাহাদের কথা শুনে মাথা নিচু করে রইলো কিন্তু ভিতরে আসলোনা। শেষে মাহাদ ওর কাছে যেতেই তিতির একটু সরে গিয়ে কিছু লুকানোর চেষ্টা করতে লাগলো। একটা ছায়ার মত কিছু সরে গেল ওখান থেকে। মাহাদ এটা দেখে রেগে গিয়ে বলল-
~" গোলাব, তোরে যদি আর একবার দেখছি এভাবে তিতিরের কাছে আসা, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। বের হয়ে আয় বলছি!"
মাহাদের কথায় ঝোপের আড়াল থেকে সত্যই গোলাব বের হয়ে এলো। মাহাদ ভিতরে আসতে বলেই তিতিরকে নিয়ে রুমে ঢুকলো। লাবীবা নিচু গলায় বলল-
~" ওরে একটু দেখে দেখে রাখিস বাবা।"
~" হুম....।"
এভাবেই পুরো দিন কেটে গেল।
.
রাত ১১টার দিকে সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার রুমে চলে গেল। মাহাদ বেডে বসে হাত দুটো মাথার উপর রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। এমন সময় তিতির এসে মাহাদকে ঐ অবস্থায় জড়িয়ে ধরতেই মাহাদ ওর দু'হাত নামিয়ে তিতিরকে জড়িয়ে ধরল। মাহাদের এমন ভালোবাসা পেয়ে তিতিরে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো।
~" কি হয়েছে বৌ!"
~" অতিথীকে খুব মিস করছি।"
মাহাদ তিতিরের চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলল-
~" তোমাকে একটা পবিত্র ওয়াদার কথা বলবো! তুমি কি শুনবে তা!"
~" হুম...।"
তাহলে শোন,
♥ যখন কারও সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদেরকে ডেকে বলেন যে, 'তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জান কবয করে ফেলেছ?' তারা বলেন - 'হ্যাঁ।' আল্লাহ তা’আলা বলেন, 'তোমরা তার কলিজার টুকরার জান কবয করে ফেলেছ?' তারা বলেন - 'হ্যাঁ।' আল্লাহ তা’আলা বলেন, 'আমার বান্দা কি বলেছে?' তারা বলেন - 'আপনার বান্দা এই বিপদেও ধৈর্য ধারণ করে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে।' তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, 'তোমরা আমার এই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ কর এবং তার নামকরণ কর “বাইতুল হামদ” অর্থাৎ প্রশংসার গৃহ।♥'
__সুবহানাল্লাহ্
তাছাড়া তুমি জানো, আমরা নামায পড়ি এবং কত আমল করি তা প্রভু কবুল করেন কি করেননা সেটা আমরা জানিনা। কিন্তু আমাদের এই অতিথী কাল কিয়ামত মাঠে, যখন আমরা স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে চিনতেও পারবোনা তখন আমাদের এই মেয়ে ঠিকি আমাদের হাত ধরবে। যতক্ষন না আমাদের নাজাতের মাধ্যমে বেহেস্তে প্রবেশ করানো হয়। সেই আমাদের জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াবে। আমাদের ছাড়া সে কিছুতেই বেহেস্তে যাবেনা। তাহলে দেখ, আল্লাহ্ আমাদের কত বড় সৌভাগ্য দান করেছেন।
__সুবহানাল্লাহ
তিতির একটু উঠে মাহাদের দিকে চেয়ে ফুফিয়ে আবার কাঁদতে লাগলো। মন মানছেনা যে মাহাদ!
মাহাদ তিতিরের কপালে আদরের পরশ বুলিয়ে বলল-
~"♥ (হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ "তোমরা তোমাদের মধ্যে কাকে নিঃসন্তান বলে গণ্য কর?" একজন বলেন, 'আমরা যার সন্তান হয় না তাকেই নিঃসন্তান মনে করি।'
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, "সে ব্যক্তি নিঃসন্তান নয়। বরং সেই ব্যক্তি-ই নিঃসন্তান, যে তার কোন সন্তান আগে পাঠায় নি (অর্থাৎ যার জীবদ্দশায় তার সন্তান মৃত্যুবরণ করে নি)।"♥
কথাগুলো বলার এক ফাকে তিতির ঘুমিয়ে পড়ে মাহাদের বুকে। মাহাদ তিতিরকে ভালো করে সুয়ে দিয়ে সাদের রুমে গেল। সাদ ও গোলাব ঘুমিয়ে পড়েছে। সেখান থেকে ফিরে মাহাদ সুয়ে পড়লো।
♥
মাঝরাত্রি, আকাশে অনেক মেঘ জমেছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি হতে চলেছে। একসময় মুষুল ধারে বৃষ্টি পড়তে লাগলো।
সাদ স্বপ্নে দেখছে, অতিথী একটা গাছের নিচে খেলা করছে। গাছটি পুরো নূরের আলো দ্বারা তৈরি। সাদ অতিথীকে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু সেখানে ও যেতেই পারছেনা। এমন স্বপ্ন দেখে সাদ ধপ করে বিছানা থেকে উঠে বসলো। পাশে চেয়ে দেখলো, গোলাব নেই। সাদ ভয় পেয়ে গোলাব ভাইয়া বলে ডাকতে লাগলো। শেষে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে বাবার রুমের কাছে এসে দেখলো দরজা খোলা। রুমে ঢুকেই দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে ওর বাবাকে ডাকতে লাগলো। বাবা, বাবা দেখেন, মা আর গোলাব ভাইয়া নেই বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
ছেলের ঝাকুনিতে মাহাদ ধড়পড় করে উঠে বসলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বলল-
~" বাবা তুমি এখানে! কি হয়েছে?"
~" বাবা, গোলাব ভাইয়া আর মা নেই। কোথায় যেন চলে গেছে।"
কিহ্ বলেই মাহাদ ওর পাশে চেয়ে দেখলো সত্যিই তিতির নেই। কিছু একটা ভেবেই দেরী না করে দ্রুত ব্যালকোনিতে এসে দেখলো, অতিথীর কবরে কারা যেন কি সব করছে। ওটা কে মাহাদের আর বুঝার বাঁকি রইলোনা।
আল্লাহ্ রক্ষা করো তাকে বলে ছেলেকে ফেলেই মাহাদ পাগলের মত ছুটে গেল বাহিরে। তারপর অতিথীর কবরের কাছে এসে দেখলো, গোলাব আর তিতির বাঁশের বেড়া খুলে দু'জনেই মাটি খুড়ছে। তিতির কাঁদছে আর বলছে, আমার মেয়ে ভিজে গেল। মা আমিতো আছি। আমি থাকতে তোমার ভয় কি! তোমার কষ্ট হচ্ছে মা! এই তো হয়ে গেছে.....।
মাহাদ দ্রুত তিতিরকে ওখান থেকে টেনে আনতেই গোলাব কবরের উপর সুয়ে কান্নার রবে ডাকতে লাগলো।