!!৫২!!
"উরুর দিকে ক্ষতটা দেখছেন মিঃ রেজওয়ান?"
"হুম।"
ছোট রুমের রেফ্রিজারেটর এর ভিতর থেকে বহু পুরানো ফ্রোজেন একখানা পায়ের খন্ড বের করলেন ডক্টর ওয়াসিফ। গ্লাভস পরিহিত হাতে সেটা নিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। সাদা পলিথিনে মোড়ানো পায়ের খন্ডটা পর্যবেক্ষণ করার কালেই মুখ খুললেন তিনি।
"এটা ২০১২ সালের শেষের দিকে প্রাপ্ত। হবিগঞ্জে একটা আবর্জনা স্তূপ থেকে। ক্ষতগুলো দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?"
ডক্টর ওয়াসিফের এমন হেয়ালি তে বিরক্ত রেজওয়ান। বহুদিনের পুরানো শরীরের খণ্ডাংশ। তারউপর হালকা বরফের আস্তরণ। এখানে কি কোনো ক্ষত আদোও বিদ্যমান! আর তা থাকলেও সেটা কি রেজওয়ান বুঝতে পারবে! সূক্ষ্ম ক্ষত নিয়ে তো তার ধারণা থাকার কথা না। মোবাইলটাও কাজ করছেনা। মায়ের সাথে কথা হয়নি আজ। মাহার খোঁজও তো নেওয়া হলোনা। কপালে বিরক্তির দুই তিনটা রেখা ফুটে উঠলো রেজওয়ানের।
"চুপ করে আছেন যে মিঃ রেজওয়ান ?"
"ডক্টর আপনি খোলাসা করে বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম।"
"সূক্ষ্ম পরিবর্তন মিঃ রেজওয়ান , সূক্ষ্ম পরিবর্তন।"
আশ্চর্য লোক। রাত সাড়ে বারোটা ছুঁইছুঁই। রাস্তার পাশ থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। নিরবতার মাঝে অদ্ভুত শুনাচ্ছে সে আওয়াজ। ডক্টর ওয়াসিফের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে নির্ঘাত ধমক খেতো রেজওয়ানের কাছে। কিন্তু রেজওয়ান নিজের মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে। বর্তমানে একটা ক্লু মানেও অনেককিছু। রেজওয়ানকে নিরব দেখে আলতো হাসলেন ডক্টর ওয়াসিফ। গলা উঁচিয়ে ডাক দিলেন,
"জুলফিকার, নিয়ে এসো।"
নিরবতা। কুকুরের ডাক থেমে গিয়েছে রাস্তায়। শুরু হয়েছে নিশুতি রাতের কান্না। অদ্ভুত, বিচ্ছিন্ন সে আওয়াজ। এই আওয়াজ বর্ণনা করা যায়না, বিশ্লেষণ করা যায়না। কেবল অনুভব করা যায়। রাতের গভীরে কান পেতে শুনতে হয়। কখনো কখনো তারও প্রয়োজন নেই। সেই সুর আপনা-আপনি ধরা দেয় শ্রোতার কানে। ক্যাড়ক্যাড় আওয়াজ করে কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো জুলফিকার। নিশুতি রাতের কান্নার বিশাল ব্যাঘাত ঘটালো সে। হাতের উপরে একটা কাঁচের ট্রে। তাতে চৈতির পায়ের খন্ড। ছিপছিপে গড়নের ছেলেটার শরীরে এত শক্তি দেখে খানিক অবাক হলো রেজওয়ান। নির্লিপ্ত জুলফিকার পায়ের খন্ডাংশ রেখে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো রেজওয়ান। ঘোর ভাঙলো ডক্টর ওয়াসিফের কন্ঠে।
"এদিকে খেয়াল করুন মিঃ রেজওয়ান ।"
অবাক হলো রেজওয়ান। খানিকটা হকচকিয়ে গেলো বোধহয়। নিজেকে ধাতস্থ করে তাকালো ছোট টেবিলটার পানে।
"ক্ষত দুইটা কিন্তু সামান্য মিঃ রেজওয়ান।"
"মানে?"
"ফ্রোজেন খন্ডটার দিকে খেয়াল করুন। উরুর দিকে কাটা দেখে মনে হচ্ছে আঁকা বাঁকা।"
অতঃপর সামান্য হেসে ওয়াসিফ বললেন,
"ছন্নছাড়া ক্ষত।"
হাসিটা খেয়াল করেছে রেজওয়ান। এই লোকের সাথে মাত্র কিছুদিনের পরিচয় রেজওয়ানের। সবাই বলে ডক্টর নাকি পাগলাটে ধরনের লোক। তবে কাজ করার সময় তেমন কোনো পাগলাটে রূপ দেখেনি রেজওয়ান। এখন লোকের কথাগুলোই সঠিক মনে হচ্ছে রেজওয়ানের। এই ডক্টরের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে।
"রাত বাড়ছে ডক্টর। হেয়ালি না করে একটু খুলে বলুন।"
বিরক্তির প্রকাশ না চাইতেও বেরিয়ে এলো খানিকটা।
"ধৈর্য রাখুন মিঃ। চাকুরীতে নতুন। আপনার পেশায় ধৈর্য বড়ই প্রয়োজন।"
এমন অপ্রকৃতস্থ কথাবার্তা ভিষণ অদ্ভুত ঠেকলো রেজওয়ানের কানে। মানুষ কত ভিন্ন প্রাণী। চোখের সামনে বিরাজমান কিছুদিনের পরিচিত ডক্টর ওয়াসিফকেও ভিন্ন ঠেকছে রেজওয়ানের নিকট।
!!৫৩!!
"নতুন প্রাপ্ত খন্ডখানা এককোপে কাটা। কোনো ধারালো জিনিস দিয়ে দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ধরুন ছুরি কিংবা চাপাতি। কিন্তু ফ্রোজেন খন্ডখানা সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে কাটা। কোনো সিরিয়াল কিলার অতন্ত্য যত্নের সহিত কেটেছেন। আঁকাবাঁকা, ছন্নছাড়া ভাবে নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন হয়তো।"
এবার ভালোভাবে তাকালো রেজওয়ান। সত্যি! তাইতো! কিন্তু তার কাছে বোধগম্য হলোনা সম্পূর্ণ বিষয়।
"তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন মাতব্বর শরীফের সাথে নতুন প্রাপ্ত পায়ের খন্ডের কোনো সম্পর্ক নেই?"
"সেটা তো বলতে পারছিনা। কে বা কারা ঘটাচ্ছে এই বিষয় উন্মোচন করার দায়িত্ব আপনার। আমার মনে হচ্ছে খুন দুইটা করেছেন ভিন্ন ব্যাক্তি। দুইটা কেটেছেনও ভিন্ন ব্যাক্তি।"
হেয়ালিগুলো বড্ড অদ্ভুত ঠেকলো রেজওয়ানের কানে। ক্লু খুঁজতে এসে আরো জটলা বেঁধে গেলো যেন। ডক্টর ওয়াসিফ কে আর প্রশ্ন করলোনা রেজওয়ান। উনি সবকিছুতেই হেয়ালি করেন। তার প্রশ্ন তো থেকে যায়। দুইখুন যদি দুই ব্যাক্তি করে থাকে তাহলে কে তারা? মাতব্বর শরীফ কি দোষী না! কারা করছে এসব। আরো শতশত প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে রেজওয়ানের। কি উত্তর সেসব প্রশ্নের!
_______________
গুলশানের বহুতল বিল্ডিংয়ে সার্থকের ডুপ্লেক্স বাসা। মাহাকে কোলে নিয়ে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। বোন নিভা বসে আছে সোফায়। দুইজন গৃহ পরিচারিকা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন। একজন ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। অপরজন হাতে ট্রে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নিভার দিকে। গাড়িতে থাকতেই ফোন করে সার্থক বলেছিলো মেইন দরজা খুলে রাখতে। তাই বিশাল কাঠের দরজা খুলে রেখেছিলো নিভা। একটা মেয়েকে সার্থকের কোলে দেখে চমকে গেলো সকলে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সার্থকের দিকে। নিভা কিছু বলারও সুযোগ পেলোনা। সার্থক হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। পিছুপিছু এলো নিভাও। নিজের খাটে মাহাকে আলতো করে শোয়ালো সার্থক। আস্তে করে উষ্ণ ভালোবাসার পরশ দিলো ঠোঁটে। সরে পাশে বসতেই দরজায় হালকা টোকা পড়লো। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে ইশারা করলো শব্দ না করতে। নিভা আস্তে আস্তে প্রবেশ করেছে ঘরে। সার্থকের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,
"মেয়েটা কে ভাইয়া?"
ভোরের সূর্য উঠার মতো হাসির রেখার সন্ধান মিললো সার্থকের ফর্সা মুখে। ঝাঁকড়া চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে সার্থক বললো,
"আমার বিশেষ একজন।"
"আমার ভাবী বুঝি?"
"ধরে নেও তাই।"
নিভার মুখেও হালকা হাসি। পরক্ষণেই চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
"কি হয়েছে ওর?"
"একটু দুর্বল। নাহারকে গিয়ে বলো স্যূপ করতে,
সাথে আনারের জুস।"
"তোমার জন্য?"
"আমার জন্য এক মগ কফি।"
"ঠিক আছে।"
ঘুমন্ত মাহার হলদে বর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো নিভা। সার্থক কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে মাত্র বেরিয়েছে। গোঙাচ্ছে মাহা। তোয়ালেটা সোফায় ফেলে রেখে মাহার দিকে দৌড়ে গেলো সার্থক। মাথায় স্পর্শ করে দেখলো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। ভেতর কেঁপে উঠলো সার্থকের। পরিচারিকা খাবার দিয়ে গিয়েছে ক্ষণিক পূর্বে। টি টেবিলে ঢেকে রাখা।
!!৫৪!!
বাথরুম থেকে একবালতি কুসুম গরম পানি নিয়ে এলো সার্থক। জ্বর মেপে দেখলো প্রায় ১০৪° ফারেনহাইট! চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা দেখা দিচ্ছে সার্থকের মুখে। মেয়েটাকে এখন ঔষধ খাওয়ানো প্রয়োজন। একটা পাতলা কাপড় দিয়ে মাহার সারা শরীর মুছিয়ে দিলো সে। মাহার মুখে পানি হালকা করে ছিটিয়ে দিলো। আলতো করে নরম করে চাপড় মারলো গালে। ডাকলো,
"মাহা, এই মাহা। আমার রাণী। উঠো।"
কিন্তু মাহার জ্ঞান ফিরছেনা। চিন্তারা এসে ভিড় জমাচ্ছে সার্থকের মাথায়। স্বামী হিসেবেই মাহার কাপড় পাল্টে যথাসম্ভব শালীনতার সাথে নিজের টাউজার আর টি-শার্ট পরিয়ে দিয়েছে সার্থক। দ্বিতীয়বার পানির ছিঁটা দিতেই আলতো করে চোখ খুললো মাহা। এই জগৎ দুনিয়ার কিছুই হয়তো সে বুঝতে পারছেনা। সার্থক প্রায় জোর করেই স্যূপটুকু খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো মাহাকে। তারপরই মাহা ঘুমে বিভোর। কফিটা নিয়ে নিজের বিশাল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সার্থক। আকাশে চাঁদ এখনো ঝকঝক করছে। হালকা হিমেল হাওয়া বইছে। দূর থেকে ভেসে আসছে হাসনাহেনার ঘ্রাণ। মৃদু হেসে কফিতে চুমুক দিলো সার্থক। আজ সবকিছুই ভালোলাগছে তার।
চিরপরিচিত ঘর, বারান্দা সবকিছু যেন মুখরিত হয়ে আছে। এই জড়বস্তুগুলোর মাঝেও আনন্দের ছড়াছড়ি। বহুদিন বাদে যেন তাদের আপনকেউ ফিরে এসেছে তাদের মাঝে। সাদা কম্বলে অর্ধশরীর ঢাকা মেয়েটার পানে বারান্দা থেকেই ফিরে তাকালো সার্থক। নিজের পোশাকে প্রেয়সীকে দেখতে অনন্যময়ী লাগছে তার কাছে। কোঁকড়া চুলগুলো বালিশের দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হলদে মুখে ভয়াবহ বিষণ্ণতা। কিসের যেন কষ্ট। কি চলে যাওয়ার বেদনা। সার্থক বিড়বিড় করে বললো,
"আমার রাণী। আমার রাজপ্রাসাদে আর কোনো দুঃখ থাকবেনা তোমার। কোনো কষ্ট তোমায় ছুঁতে পারবেনা অলকানন্দা।"
কফির কাপটা টি-টেবিলে রেখে খাটের দিকে এগিয়ে এলো সার্থক। টি-শার্ট খুলে উন্মুক্ত বুক নিয়ে বিছানায় শরীর হেলিয়ে দিলো। মাহাকে টেনে নিলো বুকে। ঠিক হৃদপিণ্ড যেদিকটায় থাকে সেদিকে। মাহাও বোধহয় শক্ত আশ্রয় খুঁজে পেলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। সার্থক মাহার এলোমেলো চুলে চুমু খেলো। অতঃপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহার কোঁকড়া চুলের অরণ্যে।
_________________
"আমাদের কাজে যদি ব্যাঘাত ঘটে?"
"ঘটবেনা।"
তারপরের কথোপকথন গুলো হলো ইংলিশে। একজন বললো ব্রিটিশ এক্সেন্টে অপরজন মিশ্র।
"তুমি এতোটা সিউর কিভাবে?"
লম্বা, ফর্সা ছেলেটা হাসলো। হেসে বললো,
"এত সহজ সবকিছু? এত বছরের রাজ্য ছেড়ে রাজা কোথায় যাবে! তাছাড়া আসক্তি বড়ই খারাপ রোগ, আলবার্ট।"
সামনে থাকা যুবকটার কথায় আলতো হাসলো আলবার্ট নিজেও। সত্যিই তো! এত সহজ সবকিছু! ঘরটা নিরব। ঢকঢক আওয়াজ হচ্ছে কেবল। নিরবে মদ্য পান করছে দুই মানব। বাইরে যত রাত বাড়ছে ততই নিশুতি রাতের কান্নাও গাঢ় হচ্ছে। মানব দুজন যতই বলুক তারা ভয়ে নেই। বিষয়টা ভুল। উভয়ের মনেই শঙ্কা। ভয়ংকর শঙ্কা। আস্তে আস্তে শঙ্কাগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে কড়া নেশার প্রকোপে। কিন্তু আবার তো ফিরবে তারা!
.
.
.
চলবে.............................