বসন্ত নয় আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিল অবহেলা।
ভেবেছিলাম অনেকগুলো বর্ষা শেষে শরতের উষ্ণতা মিশিয়ে এলো বুঝি বসন্ত!
দরজা খুলে দেখি আমাকে ভালোবেসে এসেছে অবহেলা।
মধ্য দুপুরে তীর্যক রোদের মত অনেকটা নির্লজ্জের মত আমাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা।
আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম আমার দীন দশায় কারো করুণা বা আর্তিব পেখম ছড়িয়ে আছে কী না!
ছিলো না।
বৃষ্টিহীন জনপদে খড়খড়ে রোদ যেমন দস্যুর মত অদমনীয়
তেমনি অবহেলাও আমাকে আগলে রেখেছিল নির্মোহ নিঃসঙ্কোচিত......।
-প্রায় ঝরঝর করে "দর্পন কবিরের" কবিতাটি পাঠ করে শশুড়ের দিকে চাইলো তিতির। চোখ জোড়া দিয়ে অঝরে জল ঝড়ছে তার। কামরান সাহেবও চুপ করে বসে আছে পুত্র বধূর পাশে।
বাবা আমি আমার সারা জিবনে শুধু মানুষের অবহেলা আর বঞ্চনার বোঝা টেনে এসেছি। আমার জিবনে মাহাদ ছাড়া আর কেউই আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসেনি। ভালোবাসা কি জিনিস বুঝতামইনা। আমার মায়ের মৃত্যুর পর দুনিয়াটা আমার কাছে থমকে যায়। প্রতিটা সময় আল্লাহর কাছে চাইতাম তিনি যেন দ্রুত আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। কত কষ্ট কত ত্যাগ স্বীকার করে এই জায়গায় এসেছি। আপনাদের মত একটা পরিবার পেয়েছি। সব কিছুর উর্দ্ধে আলহামদুলিল্লাহ্।
তিতির কিছুক্ষন থেমে আবার বলল,
~" বাবা, আপনার এমন নিরবতা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক। কিছুতো বলেন......!"
খোলা প্রান্তর, চারদিকে আবছা কুয়াশা। শিশির ভেজা ঘাসের উপরই আসন পেতে বসে আছেন কামরান সাহেব। ঘন্টা খানেক আগেই তার ছোট বেলার বন্ধু নির্মলকে তার দু'হাত দিয়ে কবরে রেখে এসেছেন। সেই শৈশব থেকে এই বৃদ্ধ বয়স অবদি একসাথে তারা কাটিয়েছে। হঠাৎই সে হার্টফেল করে মারা যায় আজ সকালে। বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যাথ্যাটা তীব্র ভাবে বেড়েই চলছে। এতক্ষন কাঁদতে পারেনি সে কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎই হুহু করে কেঁদে উঠলো কামরান সাহেব। চোখের পানির বাঁধ যেন তার মানছেনা। ছেলের বৌ সামনে আছে, সেই দিকে তার হুসই নেই।
মাহাদ বলেছিল, আজ বাবা যখন বাসায় আসবে তাকে নিয়ে যেন বাহিরে আসা হয়। তিতির জিঙ্গাসা করেছিল, হঠাৎ এমন অদ্ভুদ বায়না কেন মাহাদের! মাহাদ শুধু বলেছিল সেখানে গেলেই সব প্রশ্নের জবাব পাবে।
হ্যাঁ এবার বুঝতে পেরেছে তিতির। তাই বাবা বলে ডাকতেই কামরান সাহেব বিড়বিড় করে বলে উঠলেন-
~" জানো মা, নির্মল হঠাৎ করে আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে বুঝতেই পারিনি। আমাদের পৃথিবীতে আসার হয়ত সিরিয়াল থাকে কিন্তু যাওয়ার কোন সিরিয়াল নেই। ওর থেকে দু'বছরের বড় আমি। তবুও দেখ, সেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল।"
মৃত্যুতো অবধারিত। মৃত্যুর স্বাধ প্রতিটা প্রানীকে গ্রহন করতেই হবে। মনে করেন আমার সময় ফুরিয়ে গেছে, তখনকি আমি আর একমুহুত্ত্বও এই মায়ার দুনিয়াতে থাকতে পারবো! আমার রুহকে শরীর ছেড়ে তো যেতেই হবে। তাই উত্তম কর্ম দ্বারা আমাদের রুহ্ কে সুন্দর করে সাজাতে হবে।
মন যে মানে মা বলেই কামরান সাহেব ফিকরে উঠলো। তিতির আর কিছু না বলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। কিছু একটা দেখেই সেদিকে দৌড়াতে লাগলো। তিতিরের এমন ব্যবহারে কামরান সাহেব হচকিয়ে উঠলো। দ্রুত বসা থেকে উঠেই স্বশব্দে বলে উঠলো-
~" তিতির কি হয়েছে মা! ওভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?"
তিতির কোন কথা না বলেই ওর লক্ষ্যর দিকে দৌড়াতে লাগলো। তারপর একটা খেঁজুরের গাছের নিচে গিয়ে দাড়ালো। কামরান সাহেব এমন দৌড় জিবনেও দেয়নি। ছেলের বৌ রিতিমত তাকে অনেক দৌড় করালো। তিতির পিছন ফিরে মুচকি হাঁসি দিয়ে বলল-
~" বাবা, কত দিন ধরে খেঁজুরের রস খাননি!"
কামরান সাহেব তিতিরের কাছে এসে দাড়িয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে হাঁপাতে লাগলো। ঐ অবস্থায় বলে উঠলো-
~" প্রায় ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে রস খাওয়া হয়না মা!"
মা বলে যখন ডাকেন তাহলেতো ছেলের এই আশা টা আমাকেই পুরুন করতে হবে দেখছি বলেই তরতর করে খেঁজুর গাছ বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তিতিরের এমন কান্ড দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল কামরান সাহেবের। এই তুমি কি করছো! পড়ে যাবা তো? তোমার কিছু হলে আমার ছেলে আমাকেই জ্যান্ত মাটিতে পুতে ফেলবে। নামো, নামো বলে চেঁচিয়ে উঠলো কামরান সাহেব।
তিতির কোন কথা না শুনে উপরে উঠে গিয়ে রসের হাড়ীটা সাবধানে নেমে নিয়ে এলো। তারপর মুচকি হেসে বলল-
~" অনেক রস, এখন খাওয়া নিরাপদ নয়। ফুটিয়ে খেতে হবে। তাছাড়া নিপা ভাইরাস হতে পারে!"
~" তুমি গাছে উঠতে পারো!"
ঢের পারি। চিন্তা করেছি এবার দাদীকে নিয়ে রাত বিরাতে বাসা থেকে বের হব। দাদীকে নাকি আপনার ফুফু, চাচারা খুব অত্যাচার করতো! তাই রাত বিরাতে তাদের বাসায় হামলা করবো। এভাবেই দাদীর অপমানের শোধ নিব। প্লান টা কেমন হল বাবা বলে ভ্রু জোড়া নাচালো তিতির।
তিতিরের কথা শুনে টাস্কি খেয়ে গেল কামরান সাহেব। তার পুত্র বধুর যে এত গুন সেটা কামরান সাহেবের জানা ছিলোনা। ব্যাপারটা বেশ লাগছে তার। তিনিই এবার সুযোগটা নিলেন। একবার প্রতিবেশী এক চাচার গাছের বরই চুরি করার কারনে গনধোলাই খেয়েছিলেন। তার শোধ তোলার দিন এসেছে। বৌমার এমন অফার তিনি নিজেই লুফে নিলেন। তিতিরকে নিয়ে তিনি গাড়ীতে উঠেই গাড়ী স্টার্ট দিলেন।
তিতির এবার কৌতুহলী হয়ে বলল-
~" বাবা, আমার কোথায় যাচ্ছি!"
~" এক জোচ্চোরের বাসায় ডাকাতি দিতে।"
ওয়াও বলেই তিতির ব্যাপক খুঁশি হয়ে গেল। ছোট বেলায় যা করতে পারেনি সেটা সে এখন করতে পারছে। তাও আবার তার শশুড়ের মত ঠান্ডা স্বভাবের মানুষের সাথে। তিতির ফোনটা হাতে নিয়ে শাশুড়ীকে কল দিয়ে বলল, বাবা তার কাছে আছে। সাদ আর অতিথীকে যেন দেখে রাখে।
গাড়ী এসে থামলো একটা বাসার সামনে। তিতির ফিসফিসিয়ে বলল-
~" আমরা কোথায় এলাম!"
কামরান সাহেব ওর কথার সঠিক জবাব না দিয়ে বরং ওকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো-
~" দেখতো! ঐ পাঁচিলটা টপকাতে পারবে কিনা!"
তিতির পাঁচিলটাকে ভালো করে দেখে মাথা উপর নিচ করে বলল-
~" এটা টপকানো আমার কাছে কোন ব্যাপারই না। আদেশ করুন শুধু, কি কি করতে হবে আমায়।"
এইতো বাপকা বেটি। শোন, পাঁচিল টপকে গিয়ে বাসার ভিতর দেখবা বিশাল একটা রাজ বরইয়ের গাছ আছে। এটা কিন্তু আমার এক বন্ধুরও বাসা। ছোট বেলায় বরই চুড়ি করে ওকেই খেতে দিয়েছিলাম। জানতামনা এটা ওদের বাসা ছিলো। বরই চিনতে পেরে স্যারকে দিয়ে তো কেলানি খাওয়াইছে, তারপরও ব্যাটা ওর বাবাকে বলে দিয়েছে। ওর বাবা এসে সবার সামনে আমার বাবাকে অপমান করেছে তার জন্য গনধোলাই খেয়েছি। ১মাস স্কুলে যেতে পারিনি। সেদিন থেকে মনে মনে রাগ পুশে রেখেছি যেদিন নিজের হাতে পারবো সেদিন এই গাছ দারাই ওকে অপদস্ত করবো। মনে হয় সঠিক সময় চলেই এসেছে। আমি কি জানতাম তুমি গাছে চড়তে পারো! আগে জানলে শালাকে ঠিকিই শায়েস্তা করতাম। শালা কথাটি বলেই উনি জ্বীভে কামড় দিলেন। তারপর মিন মিন করে বলতে লাগলো। না মানে, তোমার অফার পেয়ে হঠাৎ পুরনো কথা মনে পড়লো। তুমি পারবাতো কাজটা করতে? ৫৫ বছর পর প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেলাম। কি কি করতে হবে, সেটা কি তোমায় বলতে হবে!
নাহ্ আর বলতে হয়! এবার দেখেন আমি কি কি করি বলেই তিতির গাড়ী থেকে নামলো। সাথে কামরান সাহেবও নামলো গাড়ী থেকে। তিতির দ্রুত পাঁচিলের উপর উঠে দেখলো সত্যিই বিশাল বড় গাছটা। পাঁচিল থেকেই গাছের ডালে উঠে পড়লো। তারপর যত গুলো পারলো বরই শশুরের দিকে ছুড়ে মেরে ইশারা করে বলল, ওগুলো কুড়াইতে। কিন্তু এত বরই যে, এই গাছ দিয়ে তাকে অন্তত শিক্ষা দেওয়া যাবেনা। তাই বাসার ভিতর ভালো করে দেখতে লাগলো। হ্যাঁ সে পেয়েছে। পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে কমলার গাছের দিকে এগিয়ে গেল তিতির। খুব বড় কমলার গাছ নয়। মনে হচ্ছে উন্নত জাতের কমলা। বাসার লাইটের আলোয় কমলা গুনতে লাগলো। মোট ১২টা কমলা। কোন কথা না চিন্তা করেই সব কমলা ছিড়ে গাছের তলায় রেখে দিয়ে কেবল পাঁচিলে উঠতে যাবে এমন সময় দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তিতির থমকে দাড়ালো।
এই রে সেরেছে বলেই ঘাপটি মেরে এক কোনে দাড়িয়ে রইলো।
মোতাহের মাস্টার রুম থেকে বের হয়েছে। গাছ ভর্তি বরই তাই রাতে কয়েকবার বের হয়ে দেখতে হয়। এলাকার প্রায় ছেলেদের দলগুলো এসে বরই পেড়ে নিয়ে যায়। একটু আগে কিছু একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। টর্চ লাইট নিয়ে বের হতেই তিতির আর কিছু না ভেবে দ্রুত পাঁচিলে উঠেই লাফ মারলো।
ঐ কেরে কে ওখানে বলেই লুঙ্গির গোছা ধরে মোতোহের মাস্টার লাইট নিয়ে দ্রুত ছুটে এলো। এসেই মেন গেট খুলেই দেখতে পেল কারা যেন ছুটে যাচ্ছে। একটা মেয়ে আর পুরুষ। পুরুষটা দৌড়াতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যেতেই তার কোছা থেকে কি যেন পড়ে গেল। লোকটা আবছা আলোতেই হাতরে হাতরে সেগুলো খুজতে লাগলো এবং কোছাতে ভরতে লাগলো। মেয়েটা হাত ধরে তাকে টেনে তুলেই আবার দৌড় দিল। আরও একটা কান্ড দেখে মোতাহের মাস্টারের চোখ চড়ক গাছে উঠলো। তাদের সাথে ভিআইপি গাড়ীও আছে।গাড়ীতে উঠেই গাড়ী স্টার্ট দিল তারা।
ঐ চোরের দল খাড়া কইছি বলেই মোতাহের মাস্টার ভো দৌড় দিল। কিন্তু তার আগেই বিরোধী দল পগাঢ় পার। আল্লাহ্ এরা কেমন চোর যে গাড়ী নিয়ে চুরি করতে নামে বলে চেচাতে লাগলো। কি দিনকাল পড়লো আল্লাহ্, তাই বলে গাড়ী নিয়ে বরই চুড়ি করতে নামবে! এই জিবনে আর কত কি দেখাইবা আল্লাহ্!
মাস্টার মসাইয়ের চিৎকারে তার বাসার সকলে উঠে বের হয়ে এলো। মোতাহের সাহেব রাগে গজরাতে গজরাতে এসে বাসায় ঢুকেই লক্ষ্য করলো তার সখের কমলা গাছে একটা কমলাও নেই। হানতান করে দৌড়ে এসে দেখে সব কমলা গাছের তলায় শোভা পাচ্ছে। তিনি সব কটা কমলা কুড়িয়ে কারো সাথে কোন কথা না বলে নিজের ঘরের ভিতর এসে চুপ করে বসে পড়লো। কে এমন কাজ করতে পারে বলে মনের ভিতর অংক কষতে শুরু করে দিলেন।
♥
তিনদিন পর,
মৌতুসির বিয়ে উপলক্ষ্য তিতির ওর দুই সন্তানকে নিয়ে মৌয়ের সাথে এসেছে। রুপালী, মৌ সহ রাতিশা, রেজওয়ান আর তিতির এসেছে। বাসা থেকে আর কেউ আসতে পারেনি। আজ মৌতুসীর গায়ে হলুদ। তিতিরকে আমেনা ফুফু খুব অনুরোধ করেছে আসার জন্য। শুধু পায়ে ধরা বাঁকি ছিলো। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই দুই বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। মৌয়ের বাবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি।
বাসা ভর্তি মানুষ। তিতিরকে আলাদা রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে আমেনা বেগম। তিতির ফ্রেস হয়ে আসতেই দেখলো একটা লোক তার বাচ্চাদের আদর করছে। পিছন থেকে বুঝতে না পেরে দ্রুতই সাদের কাছে আসতেই থমকে দাড়ালো। মুখ দিয়ে বেরই হয়ে গেল, বাবা......
এরশাদ চট করে তিতিরের দিকে চেয়েই চুপ হয়ে যায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো এরশাদ। সাদের সামনে অনেক খেলনা আর জিনিসপত্র। কিন্তু সাদ এখনো সেগুলোতে হাত দেয়নি। মায়ের অনুমতি ছাড়া ও কখনো সেগুলোতে হাত দিবেনা।
তিতিরই নিরবতা ভেঙ্গে সালাম দিয়ে বলল-
~" কেমন আছ বাবা!"
এরশাদ চুপ করেই রইল। তিতির সাদকে ডেকে বলল-
~" বাবা, ইনি তোমার নানাভাই। তিনি আমার বাবা।"
নানাভাই বলেই খুঁশিতে এরশাদকে আবার সালাম দিয়ে বলল-
~" আপনি কেমন আছেন নানাভাই!"
এরশাদ আর থেমে থাকতে পারলোনা। সাদকে বুকে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। তারপর খুব দ্রুত সাদের কপালে কয়েকটা চুমা খেয়ে বলল-
~" আমার ভাইতো অনেক সুন্দর আর ভদ্র!"
এমন সময় রুমে ঢুকে একটা মেয়ে বলল-
~" আপু মৌতুসী আপু আপনাকে ডাকছে এখুনি।"
আচ্ছা বলেই আর কথা বলার সুযোগ না পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল তিতির।
♥
রাত ৩টা বাজে,
তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে তিতির অপেক্ষা করছে মাহাদের কলের জন্য। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয়না। তিতির কোন একটা বিষয়ে খুব চিন্তিত। সে এমন কিছু শুনেছে যার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। মাহাদকে বিষয়টি কি ভাবে জানাবে সেটা ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
আরও কিছুক্ষন পর মাহাদ ভিডিও কল দিল। মাহাদই প্রথমে সালাম দিল। সালামের জবাব নিয়েই তিতির আগে ছেলে মেয়েকে দেখালো। তারপর নিজে ক্যামেরার সামনে এল।
তিতিরের শুকনো মুখ দেখেই মাহাদ তিতিরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল-
~" মৌয়ের বাবা কি আবার তোমায় কিছু বলেছে?"
মাহাদের কথা শুনেই তিতির ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো। মাহাদ বার বার বলছে কি হয়েছে তার কোন জবাব দেয়না তিতির। মাহাদ এবার বিরক্ত হয়ে গেল ওর উপর। তিতিরের এমন কান্ড দেখে মাহাদ ওকে জোড়ে একটা ধমক দিতেই ও কেঁপে উঠলো। এবার মাহাদ রেগে গিয়ে বলল-
~" এই চুপ করবা! কখন থেকে বলছি কি হয়েছে কি হয়েছে কোন জবাব না দিয়ে শুধু কেঁদেই চলছে। এতই যদি কাঁদার সখ জাগে তাহলে আমি লাইন কেঁটে দিচ্ছি। যতখুশি তত কেদে তারপর আমাকে কল দাও।"
এবার তিতির চুপ হয়ে গেল। মাহাদ কখনো চায়না তিতির ওর বাবার সাথে সম্পর্ক রাখুক। এমন কি বাবা মারা গেলে তাকে কবর দিতেও যেতে দিবেনা সেখানে। মাহাদ তিতিরের পুরো পরিবারকেই ঘৃনা করে। কান্না করতে চায়না তবুও চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।
~" আবার শুরু করছো! ওকে প্রমিস করছি, আপাতত আর বকা দিবোনা। আমার বউয়ের কি হয়েছে, যার জন্য তার চোখ দুটোকে এত কষ্ট দিচ্ছে!"
তবুও তিতিরের কোন জবাব আসেনা। মাহাদ এবার মুচকি হেসে সুরালো কন্ঠে বলে উঠলো,
" বাতাসে বহিয়েছে প্রেম,নয়নে লাগিলো নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে, বসন্ত এসে গেছে...
মধুরও অমৃতবানী বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিলো বাজি, বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের ধুলি মাখা চরনের
মাথা নত করে রব.........।"
গানের মাঝেই তিতির ওর জামাটা সম্পূর্ন খুলে পাশ ফিরে মাহাদকে ওর পিঠটা দেখালো।
মাহাদ এমন দৃশ্য দেখেই সাথে সাথে ওর চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই দৃশ্যটা মাহাদ একদমই সহ্য করতে পারেনা। এই একটা কারনেই মাহাদ ওর শশুরকে ঘৃনার চোখে দেখে।
মাহাদ কঠোর স্বরে বলে উঠলো-
~" তিতির........!"
তিতির পাশ ফিরেই আবার জামাটা পড়ে চোখ মুছে স্থির হয়ে মাহাদের সামনা সামনি বসে মাহাদের দিকে চাইলো। তারপর মাথা নিচু করে বলল-
~" আমি জামা পড়েছি মাহাদ।"
এবার মাহাদ চোখ খুলল আর সাথে সাথে ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝড়ে পড়লো। এবার বেশ ঝাঝালো গলায় বলল-
~" তোমার বাবা কি এখানে এসেছেন!"
তিতির মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো শুধু। কিন্তু কোন কথা বললোনা। মাহাদও আর এই সম্পর্কে কিছু না বলে কল কেটে দিল।
মাহাদ কল কেটে দিতেই তিতির ডুকরে কেঁদে উঠলো। পুরো রাতটাই ওর নির্ঘুমে কাটালো।
এভাবেই একদিন কাটলো। মৌতুসীর বৌভাতে যাওয়ার জন্য তিতির কেবল রেডী হচ্ছিল এমন সময় মাহাদের কল আসলো। তিতির রিসিভ করে সালাম দিতেই মাহাদ চেতে উঠে বলল-
~" আর কতদিন এখানে থাকতে হবে! বাসায় কি হচ্ছে তোমার সেটা খেয়াল আছে! এক্ষুনি বাসায় যাও। আমার মন বলছে সাবিনার কিছু একটা হয়েছে। ও কাঁদতে কাঁদতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলো কিন্তু তার আগেই ওর কাছ থেকে কেউ যেন ফোন কেড়ে নিল। আমার মন বলছে সাবিনা ঠিক নেই। আমার কলও বাসার কেউ রিসিভ করছেনা।"
সাবিনার এমন কথা শুনে তিতির আর এক মুহুত্বও দেরী না করে দুই সন্তানকে নিয়ে বাসার পথে রওনা দিল।
♥
সকাল থেকে প্রায় ৫ বার সাবিনার গায়ে হাত তুলেছে নিসা। এবারও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। বরং একটু বেশিই হলো। ওর চুলের মুঠি ধরে গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল -
~" এই কার সাথে এমন নোংরামি করে পেট বাধাইছিস! এই বাসার মানুষ তোকে এত ভালোবাসে আর তাদের মান সম্মানের কথা একবারও ভাবলি না! তুই মানুষ না কি!"
ভাবী অ্যারে ছাইড়া দ্যান। অ্যার খুব কষ্ট হইতাছে বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো সাবিনা।
ঘটনাটি টের পেয়েছে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে। হঠাৎ সাবিনা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বমি করা সহ ওর মাথা ঘুরতেছিলো। বাতাসি বিবি পুরনো আমলের মানুষ। সকল লক্ষন দেখে ওর সন্দেহ হয়। তারপর কথাটি লাবীবাকে বলতেই নিসা ঘটনাটি জানতে পেরে কোন রিক্স না নিয়েই আজই ওকে হসপিটালে নিয়ে যায়। সব পরীক্ষা করে নিঃশ্চিত হয় সাবিনা সত্যিই প্রেগন্যান্ট।
নাহ্ সাবিনা কোন মুখ খোলেনা। ওমন চঞ্চল মেয়েটাও যেন আজ ভয়ে চুপসে গেছে। চোখ মুখ ভিষন ফুলে উঠছে। সকাল থেকে কম নির্যাতনের শিকার আর হয়নি সে।
বাসায় কোন ছেলে মানুষ ছিলোনা। ফুয়াদকে আসতে বলেছে। কিছুক্ষন পর ফুয়াদও বাসায় আসলো। সেও অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু সাবিনার মুখ থেকে কিছু বের করতে পারলোনা। শেষে নিসা চিৎকার দিয়ে বলল-
~" দাড়াও, ওরে এক্ষুনি বাসা থেকে বের করে দিব।"
এমন কথা শুনে সাবিনা আৎকে উঠলো। ফিকরে উঠে বলল-
~" অ্যারে একবার শুধু মাহাদ ভাইজানের সাথে কথা কইতে দেন। উনি যা কইবো তাই আই মেনে নিব। তার সাথে একবার কথা কইতে দেন ভাবী.....।"
আবার তোর ঐ নোংরা মুখে মাহাদের নাম নেস বলে লাবীবা বেগম চিৎকার দিল। কিন্তু সাবিনা এবার এমন কথা বলল যে, সকলের গলা অবদি শুকিয়ে গেল।
সাবিনা চিৎকার দিয়ে বলল-
~" এই বাচ্চার বাবা একমাত্র মাহাদ ভাইজান। অান্নেরা শুনবার পাইছেন! মাহাদ ভাইজান অ্যারে এই অবস্থা করচে।"
সাবিনা কথা বলা শেষ করেই দরজার সামনে তিতিরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। তিতির এমন কথা শুনে স্থির হয়ে গেছে। সাথে সাথে নিজেকে সামলিয়ে তিতির বলল-
~" এই সাবিনা, তুমি কি সব বলছো!"
আই ঠিকি কইছি আপা, আন্নের যতটুকু হক আছে ততটাই অ্যারও এই বাড়ীতে হক আছে। আই কইছিতো, মাহাদ ভাইজানের সাথে একবার কথা কইতে দেন। তাকেই জিঙ্গাসা করে দেহেন, এই বাচ্চা কার!
সাবিনার এমন জোরালো কন্ঠ শুনে তিতিরের বুক কেঁপে উঠলো। শুধু তিতির না, বাসার সকলের কলিজায় টান পড়লো।