২১!!
পরের দিন আদালতের ফর্মালিটি শেষ হতে হতেই বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। কিশোর দুপুরে লাঞ্চ করে কিছুক্ষণের জন্য একবার বাইরে থেকে ঘুরে এসে মায়ের রুমে গেল। আসার আগে রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো তামান্না দীপ্তির চুল বেঁধে দিচ্ছে। কিশোরকে রুম ঢুকতে দেখে হাসিমুখে বিছানায় উঠে বসেন ফালেহা চৌধুরী। কিন্তু কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা হকচকিয়ে যান।
-কিশোর? কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন বাবা?
-কিছু না মা। আমি একটু পরে বের হবো। তাই তোমাকে বলতে এলাম-।
-বের হবি মানে? কোথায় যাবি?
-ঢাকায় ফিরবো মা। কতো কাজ পড়ে আছে--। একদিনের জন্য এসে তো অনেকদিন থাকলাম এবার--।
-কাজটা কি তুই ঠিক করছিস কিশোর? কালই তোদের বিয়েটা হয়েছে। অন্তত তামান্নার কথাটা চিন্তা করে হলেও আর কয়েকটা দিন---।
-মা---। কাজটা কি তুমিও ঠিক করেছিলে?
-আমি? আমি কি করেছি?
-দীপ্তি হঠাৎ আদালতে সবার সামনে তামান্নাকে মামনি কেন বলেছিল?
-আমি কি জানি! ও তো ছোট শিশু---।
-মা?
-আচ্ছা যা। মানলাম আমিই দীপ্তিকে বলেছি তামান্না যদি ওর মামনি হয়ে যায় তাহলে কেউ তামান্নার আর তোর কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। আর তামান্নাও তাহলে কখনো ওকে রেখে কোথাও চলে যাবে না--।
-কাজটা কি ঠিক করেছ মা?
-কেন? তামান্না মেয়েটা তো ভালোই--। আর দীপ্তিও আমাদের কাছেই আছে। সেটাও তামান্নার সাথে তোর বিয়েটা হয়েছে বলেই--।
-এখানে ভালো খারাপের প্রশ্ন আসছে না মা। দীপ্তির কাস্টাডি কেইসটা আমাদের সমস্যা। সেই সমস্যার মাঝে তামান্নাকে টানার কি দরকার ছিল? শুধুমাত্র আমাদের কথা ভেবে, দীপ্তির কথা চিন্তা করে মেয়েটা বিয়েটা করেছে---। আমার নিজের উপরে রাগ হচ্ছে মা। নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখার জন্য আমি জাস্ট তামান্নাকে ইউজ করেছি---।
-কিশোর? কিসব বলছিস? তামান্না কি তোকে কিছু বলেছে এসব---।
-মা? যে মেয়ে আমাদের কথা চিন্তা করে নিজের ভবিষ্যৎ না ভেবেই বিয়ের মতো একটা কাজ করতে পারে, তোমার কি মনে হয় সেই মেয়ে আমাকে এসব বলবে? আমার কি নিজের বোধবুদ্ধি নেই?
-কিশোর?
-ওর দিকে তাকালেই আমার মনে হয় কি করে পারলাম এমনটা করতে? কি করে পারলাম ওকে ঠকাতে?? ----আহহহহ।
-কিশোর এমন করছিস কেন?
-জানো মা? তামান্না কাল কি বলেছে? বলেছে ও কোন কিছুতেই অধিকার ফলাবে না। আজীবন ও তামান্নার গভর্নেস হয়েই থাকবে--৷ আমি যেন নতুন করে নিজের জীবনটা শুরু করি---।
-তো? সমস্যা কোথায় এখানে?
-সমস্যা হলো---। যে মানুষটা আমার জন্য নিঃস্বার্থ হয়ে এতোটা ত্যাগ করছে তাকেই আমি ঠকিয়েছি। আমি তো সুপ্তির মতোই কাজ করেছি মা---।
-কিশোর??
-আমাকে আর কিছু বলো না মা প্লিজ। আমি হয়তো আবার কিছু একটা বলে তোমাকেও কষ্ট দিয়ে ফেলবো৷ আসছি মা। ভালো থেকো--।
-কিশোর শোন বাবা?
মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে কিশোর এসে দেখলো দীপ্তির চুল সুন্দর করে বেঁধে দিয়েছে তামান্না। কিশোরকে দেখেই দীপ্তি ছুটে এসে কিশোরের কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। কিশোর এক নজর তামান্নাকে দেখে দীপ্তিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে দিলো।
-বাবাই? তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?
-হ্যাঁ মামনি--। বাবাইয় ঢাকা যাচ্ছি--।
-আমি আর মামনি যাবো তোমার সাথে!! কি মজা!
-না মা৷ বাবাই তো কাজে যাচ্ছি। আর দীপু মামনির স্কুল আছে না?
-উহ---। আমি আর মামনি যাবো না তোমার সাথে?
-না সোনা।
-তুমি কবে আসবে তাহলে? আমার তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলে? তোমার কোলে চড়তে ইচ্ছে হলে? তখন?
-ওলে আমার বাবাটা! বাবাই শীঘ্রি চলে আসবো মা--।
-ওকে বাবাই। তাত্তাড়ি আসবা। হ্যাঁ?
-ওকে দীপুসোনা---।
-আর আসার সময় আমার আর মামনির জন্য অন্নেকগুলা চকলেট নিয়ে আসবা। কেমন?
-আচ্ছা পাকনি বুড়ি। নিয়ে আসবো--।
কিশোর দীপ্তিকে কোলে করে নিয়েই তামান্নার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতে ধরা একটা প্যাকেট তামান্নার দিকে এগিয়ে দিলো। তামান্না ইতস্তত করেও প্যাকেটটা হাতে নিলো। কিশোর একটু হাসার চেষ্টা করলো তামান্নার দিকে তাকিয়ে।
-তোমার কাছে তো কোন মোবাইল নেই--। তাই ভাবলাম---। আমার নাম্বারটা সেইভ করে দিয়েছি--। সিমও দিয়ে দিয়েছি৷
-কি দরকার ছিল মোবাইলের? আমার---।
-দীপ্তি কথা বলতে বায়না করলে বা তুমি আশ্রমে কথা বলতে চাইলে তখন তো অসুবিধা হতো --৷ একটা মোবাইল থাকলে বরং সুবিধাই---।
-হুম-----।
-আচ্ছা---। আসছি আমি।
-জি-----।
কিছু একটা বলতে গিয়েও তামান্নার গলায় আটকে গেল কথাটা৷ 'যেও না' ছোট্ট এই কথাটুকু বলতেও যে কতোটা অধিকার থাকা লাগে সেটা বেশ টের পাচ্ছে তামান্না। কিশোরও আর কিছু না বলে দীপ্তিকে আরেকবার আদর করে দিয়ে কোল থেকে নামিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। কিশোরের বারবার মনে হচ্ছে তার উপস্থিতি তামান্নার জন্য আরো বেশি কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে এটা জানে না। তার এভাবে হুট করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তামান্নার মনে আরো কতোটা গভীর ক্ষত করে গেছে।
দেখতে দেখতে তিনটা মাস কেটে গেছে। কিশোর আর একবারের জন্যও চৌধুরী ম্যানশনে ফিরে নি। বাড়ি ফিরার কথাটা মাথায় আসতেই একটা সংকোচ কাজ করেছে কিশোরের মনে৷ তামান্নাকে অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলার আশঙ্কায় কিশোর আরো যে বেশি কষ্ট দিচ্ছে সেটা টেরই পায়নি। সামনের মানুষটাকে খুশি রাখায় চেষ্টায় মানুষ কখন যে তাকে আরো বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলে সেটা সে বুঝতেই পারেনা। এই ব্যাপারটাই হচ্ছে কিশোর আর তামান্নার জীবনে। না চাইতেও একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। আর কষ্ট দিচ্ছে প্রিয় মানুষটাকেও। কে জানে এই অস্পষ্ট প্রেমাবেগের শেষ কোথায়?
২২!!
কিশোর সন্ধ্যাবেলা নিজের অফিসের রুমে বসে বসে কাজ করছিল। ঠিক কাজ করছিল বললে ভুল হবে। কাজ করার চেষ্টা করছিল বললেই সম্ভবত মানানসই হবে। গত তিনমাসে অনেকবার সে তামান্নার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কথা যে একেবারেই হয়নি তেমনটাও না৷ কিন্তু কিছু কথা বলতে গিয়েও যেন কিশোরের গলায় আটকে যায়। কথাগুলো আর বলা হয়ে ওঠে না। প্রতিদিনই দীপ্তির সাথে কথা বলার সময় কিশোরের সাথে তামান্নার কয়েক মিনিটের কথা হয়। কখনো বা ভিডিও কলে দীপ্তির সাথে কথা বলার সময় তামান্নার ফ্যাকাশে মুখটাও চোখে পড়ে কিশোরের। আর তখন নিজেকে আরো বেশি অপরাধী মনে হয় কিশোরের কাছে। ঠিক কি করলে তামান্নার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠবে সেসব ভেবে আজকাল নিজের কাজেও মন বসে না কিশোরের। একবার খুব করে কাছ থেকে তামান্নাকে দেখতে ইচ্ছে করে ওর। সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, এবার অধিকার নিয়েই হাত বাড়িয়েছি। ধরবে কি? সেসব আর বলা হয় না। ওই যে, দুজনের মনের কোন একটা তার এখনো যে জোড়ে নি।
হঠাৎ মোবাইলের ভাইব্রেশনে হুঁশ ফিরতে কলটা রিসিভ করলো কিশোর। এতোদিন পর বড় আপা কল করেছে দেখে কিছুটা চিন্তাই হচ্ছে তার।
-হ্যালো? কিশোর সাহেব? কেমন আছেন?
-জি ম্যাম--। ভালো আছি। আপনি?
-এই তো ভালো আছি---। তা কাল আপনারা দীপশিখায় আসছেন তো?
-কেন? কেন ম্যাডাম? কোন দরকার---? আবার কিছু কি হয়েছে?
-আরে না না।---তেমন কিছুই না। কাল তো স্পেশাল দিন। তামান্না তো---।
-স্পেশাল? কি ম্যাডাম?
-আরে? আপনি জানেন না? তামান্না কিছু বলে নি আপনাকে?
-না----।
-ওহ! আপনি বাড়িতে ------?
-না ম্যাডাম। আমি তো ঢাকায়--।
-ওহ!!
-বলুন না ম্যাডাম? কি স্পেশাল দিন কাল?? আপনাদের আশ্রমের কোন----?
-না না। কাল আমাদের তামান্নার জন্মদিন---। প্রতি বছর ও যেখানেই থাকুক এই দিনটাতে দীপশিখায় আসতোই---। আর দীপশিখার সবাই ওর আসার পথ চেয়ে সেই সপ্তাহ খানেক আগে থেকে অপেক্ষা করে বসে থাকতো---।
-বাহ!! দারুণ খবর দিলেন তো ম্যাডাম---। তামান্না কাল যাবে--। আপনি চিন্তা করবেন না----।
-হুম---।
-উমমমম। একটা কাজ করা যায় ম্যাডাম----।
কিশোর বড় আপার সাথে আরো বেশ অনেকক্ষণ কথা বলে কলটা কাটার প্রায় সাথে সাথেই তামান্নার নাম্বার থেকে কল এলো। কিশোর কলটা রিসিভ করতেই দীপ্তির ফোঁপানোর শব্দ শুনে বুকটা যেন ধ্বক করে উঠলো।
-দীপু? দীপু? মামনি কাঁদছো কেন? দীপু? বাবাইকে বলো কি হয়েছে? ব্যথা পেয়েছ কোথাও?
-বাবাই------?
-দীপু মা। বলো প্লিজ? কি হয়েছে?
-মামনি বকেছে আমাকে---। আ--। আ--।হা--আ---।
-হুফ--। কেন বকেছে মামনি? মামনিকে বিরক্ত করেছ নাকি?
-না---।
-তাহলে?
----------------------
-আচ্ছা--। বাবাইকে বলো মা কি হয়েছে?
-মামনি প্রতেক দিন রাতে মন খারাপ করে কতো কাঁদে---। আজকে মামনি একা একা কাঁদছিলো---। আমি জিজ্ঞেস করেছি কতো বার--। বলেই নি---। তোমাকে বলে দিব বলেছি বলে বকেছে--। আ---।
-কাঁদে না মামনি--। তুমি মামনিকে আদর করে দাও--। মামনি তাহলে আর কাঁদবে না কেমন?
-ও বাবাই? তুমি আসো না কেন?
-আসবো সোনা--। মামনিকে বলো না কিন্তু বাবাইকে যে বলে দিয়েছ মামনির কান্নার কথা--। তাহলে আবার বকা দিবে---।
-হুম--। বলবো না---।
-এখন লক্ষী মেয়ের মতো মামনির কাছে যাও--। কেমন??
-হুম-----।
দীপ্তি আর কিছু বলার আগেই কিশোর ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে তামান্নার গলা শুনতে পেল কিশোর। দীপ্তির নাম ধরে ডাকছে তামান্না।
-বাবাই? মামনি ডাকছে--। এখন রাখো--। রাখো--।
-আচ্ছা বাবা---। রাখছি--।
দীপ্তি কলটা ডিসকানেকটেড না করেই ছুটেই তামান্নার কাছে গেল। তামান্না দীপ্তির কান্নাভেজা চোখ মুছে দিয়ে দীপ্তির গালে চুমো খেল।
-সরি দীপুসোনা। মামনি এত্তোগুলো সরি--। আর বকব না আমার দীপুকে--। সরি---।
-হুম---।
-আর কাঁদে না বাবু। কেমন? এখন চলো? আমরা আজ দীপ্তির পছন্দের বার্গার খাবে---? হুম? খুশি?
-ইয়েএএ---। মামনি?
-হুম?
-তুমি কাঁদছিলে কেন তখন?
-কাঁদছিলাম না সোনা--। মামনির চোখে কি যেন পড়েছিল--। তাই চোখে পানি এসে গেছে তখন--। কাঁদবো কেন বলো? আমার এই লক্ষী দীপুসোনা থাকতে আমি কাঁদতে পারি---?
-হি হি--। হুম----।
কিশোর কলটা এবার কেটে দিলো। তামান্নার কাঁপা কণ্ঠটা শুনে বেশ বুঝতে পারছে মেয়েটা একটু আগেও কোন কারণে কান্না করেছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে কিশোরের ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠলো। নিজের মনে একটা কথাই ভাবলো কিশোর। মেয়েটার মুখে হাসি ফোটাতে এবার যা করতে হয় সে করবে। আবার কাজে মন দিলো। এখনো বহু কাজ বাকি তার। সেগুলো সারতে হবে জলদি।