৩৯!!
সকাল থেকেই মায়ার আশেপাশেই ঘুর ঘুর রাহাত। মায়া দেখেও রাহাতকে পাত্তা দিলো না। সারাদিনই নিজের মতো কাজ করেছে মেয়েটা। রাহাতও অবশ্য থেমে নেই। আগ বাড়িয়ে মায়াকে টুকটাক কাজে হেল্প করতে যাচ্ছে। মায়া অবশ্য রাহাতকে কিছু বলারও সুযোগ দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে রাহাত মোটামুটি নাকানি চুবানি খাচ্ছে মায়ার রাগ ভাঙাতে গিয়ে। দেখতে দেখতে দুপুরও গড়িয়ে গেছে। দিয়া আর মিহানের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে পশ্চিম বীচে। বীচের বালুচরে একটা ছোটোখাটো স্টেজের মতো করে সাজানো হয়েছে। ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো স্টেজেই দিয়া আর মিহানের বিয়েটা হলো। মেয়েরা সবাই শাড়ি পড়েছে আর ছেলেরা পাজামা পাঞ্জাবি। এমন কি দিয়াও হাফ সিল্কের একটা শাড়ি পড়া ছিল। সাজটাও একদম নরমাল। সব মিলিয়ে বিয়ে কম ট্যুরই মনে হচ্ছে বেশি। অফ সিজন তাই মাথা ওদের এই অদ্ভুত বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামানোর ও কেউ নেই।
বিয়ের যাবতীয় ফর্মালিটি শেষ হলে সবাই মিলে হুটোপুটি করে একচোট ভিজলো। মায়াই চুপচাপ পাড়ে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাহাতও তাই আর সাগরে নামলো না৷ মায়ার পিছেই ঘুর ঘুর করলো সারাক্ষণ। সবার ভিজাভিজা শেষ হলে পাশেই একটা লজ থেকে ওরা চেইঞ্জ করে নিয়ে লজের রেস্টুরেন্টে খেয়ে দিলো দল বেঁধে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ স্টেজে বসে সবাই মিলে আড্ডা দিলো। সৈকতে রোদের তেজটা একটু কমে আসতে মিহানদের প্রাশ একশ জনের দলটা চললো দক্ষিণ দিকে, দ্বীপের একদম শেষ প্রান্তে। গন্তব্য সেন্টমার্টিনের বিশেষ আকর্ষণ ছেঁড়াদ্বীপ। পশ্চিম বীচ দিয়ে ছেঁড়াদ্বীপে যাওয়ার রাস্তাটা একটু কঠিন, কিন্তু ভ্যানে বা সাইকেলে যাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর। দলটার একদম শেষে অন্যমনস্ক হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল মায়া। বীচের পাথুরে জমিটায় হঠাৎ কিছুতে আটকে পড়ে যেতে যেতে চোখ বুজেই টের পেল কেউ একজন মায়াকে আঁকড়ে ধরে ফেলেছে। মায়া চোখ মেলে তাকিয়েই রাহাতকে দেখে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে এলো।
-একটু সাবধানে দেখে পা ফেলো মায়াবতী। এখন পা ভেঙে বসে থাকলে তো বিপদে পড়তে হবে।
-পা ভাঙলে আমার ভাঙ্গবে। আপনার তাতে কি? আর আপনার কাছে কি হেল্প চেয়েছি আমি? পড়লে পড়তাম। এর পর আমি পড়ি মরি যাই হোক না কেন আপনি হেল্প করতে আসবেন না একদম৷ আপনার হেল্প চাই না আমার৷ দয়া করে আমাকে আমার হালে ছেড়ে দিন প্লিজ?
-এভাবে বলো না মায়া? রাগ করে আছো জানি। কিন্তু প্লিজ রাগটা ভাঙ্গানোর একটা সুযোগ দাও? প্লিজ?
-আপনি আমার সামনেই আসবেন না আর। অসহ্য।
মায়া গটগট করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে রাহাতও ছুটলো মায়ার পিছনে। এই মেয়ের রাগ এতো সহজে কমবে বলে তো মনে হচ্ছে না৷ মায়ার রাগটা কিভাবে ভাঙ্গানো যায় সেটা নিয়েই রাহাত বেকায়দায় পড়ে গেছে এখন। সারাদিন ছেলেটা মায়াকে যতই মানানোর চেষ্টা করে মায়া ততই যেন আরো বেশি করে ইগনোর করে ওকে। এসব করতে করতেই সবাই মিলে ছেঁড়াদ্বীপে সূর্যাস্ত দেখলো অবাক বিস্ময়ে। বিশাল কমলা রঙের সূর্যটা স্বচ্ছ সাগরের জলে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার নিকষ কালো অন্ধকার নামিয়েছে সাগর পাড়ে। পশ্চিম বীচ দিয়ে আসলেও ফেরার সময় ওরা পূর্ব বীচের দিক দিয়েই ফিরলো। বীচে সবাই মিলে হৈ হৈ করে আড্ডা দিলো। সাথে সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউ তো আছেই। বীচে সবাই মিলে আরো কিছুক্ষণ গান বাজনা করে আড্ডা দিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নীল দিগন্তে রিসোর্টে ফিরলো। সকাল থেকেই সবাই এতো ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে যে যার রুমে ফিরলো। মায়াও প্রতিদিনের মতো দিয়ার জন্য দরজা খোলা রেখেই হাত মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। কান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইছে মেয়েটার। হঠাৎ চুলে কারো হাতের স্পর্শ লাগতেই মায়া চমকে উঠে বিছানায় উঠে বসলো। সামনের দিকে তাকিয়ে অজান্তেই গলা দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে এলো।
-আপনি?
রাহাত তাড়াতাড়ি মায়ার মুখ চেপে ধরে চুপ করালো। মায়া রাহাতের হাত সরিয়ে দিলো রাগ করে।
-আরে! আস্তে চিল্লাও বাবা! উফ! পুরো রিসোর্টের সবাইকে রুমে জড়ো করবা নাকি?
-আপনি আমার রুমে কি করছেন? আপনাকে না বললাম আমার সামনেও না আসতে? আপনি যদি ভেবে থাকেন যে এসব করলে আমি আপনাকে মাফ করে দিবো তাহলে ভুল ভাবছেন। প্রত্যেকবার আপনি এমন করবেন আর আমি আপনাকে মাফ করে দিবো তা তো হতে পারে না তাই না?
-সেই এক জেদ ধরে বসে আছো। এটা কি ঠিক হচ্ছে বলো তো মায়াবতী? কোথায় এই মায়াবী রাতে সাগরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে একটু মিষ্টি করে ভালোবাসার কথা বলবা তা না। শুধু শুধু রাগ করে ওয়েদার আর সময় দুটোই নষ্ট করছ। ধ্যাত।
-আপনি এক্ষুণি এই রুম থেকে বের হবেন। নইলে -নইলে কিন্তু।
-হুম হুম। জি ম্যাডাম। নইলে কি?
-নইলে আমিই চলে যাবো এখান থেকে।
-আরে বাবা! কি মুশকিলে পড়লাম! এমন পাগলামি করো না শোনো? এই দেখো কান ধরছি। আর কখনো এমন হবে না। প্রমিস।
-আপনাকে যেতে বলেছি তো আমি? শুনতে পান না কথা?
-তুমি নিজেই তো দরজা মেলে রেখেছ। আমি তো তাই এলাম। এখন যদি আবার নিজেই এভাবে তাড়িয়ে দাও ব্যাপারটা কেমন দেখায় বলো?
-আমি কি আপনার জন্য দরজা খুলে রেখেছি? দিয়া আপুর জন্য দরজা খোলা রেখেই শুয়ে পড়েছি। আর আপনার এতোটুকু কমনসেন্স নেই যে একটা মেয়ের রুমে এভাবে নক না করে, না বলে আসতে হয় না যে?
-এই যে শোনো? আমি অন্য কোনো মেয়ের রুমে আসি নি ওকে? আমি আমার মায়াবতীর কাছে এসেছি। আর বলছি কি আমাকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছ না বলে কি মেজাজ বেশিই খারাপ নাকি গো ম্যাডাম?
-কি?
-এই যে দিয়ার জন্য দরজা খুলে রেখেছ। দিয়া কি মিহানের সাথে এতো সুন্দর একটা সময় কাটানো বাদ দিয়ে তোমার সাথে ঘুমাতে আসবে। ওদের তো বিয়েটাও হয়ে গেছে এখন----।
-প্রতিদিনের অভ্যেস তাই খেয়াল ছিল না। আপনি যান তো এখন। ঘুমাবো আমি।
-হাহ! গত কয়েকটা দিনে দিয়াও তোমার অভ্যেস হয়ে গেল গো মায়াবতী। শুধু আমিই তোমার অভ্যেস হতে পারলাম না এখনও। রাগ তো ঠিকই করতে পারো, কিন্তু সামনে এসে জেদ করে বলতে পারো না যে যত যাই করো না কেন, আমাকে ছেড়ে এক পা ও কোথাও যেতে পারবে না। বা ভুল করলে রাগ না করে আগেরবারের মতো তোমার মিষ্টি ঠোঁটের পরশ দিয়ে সেটা উসুল করে নিতে পারো। সেটা তো করো না। খালি কথা বলবা না, পালিয়ে বেড়াবা আমার থেকে। এসব কি মায়াবতী?
-এতো বড় বড় কথা যে বলছেন আমার জায়গায় আপনি থাকলে পারতেন সব ভুলে গিয়ে ক্ষমা করে দিতে? পারতেন আপনাকে ছেড়ে অন্য কাউকে চয়েজ করলে ছেলেমানুষি বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে? পারতেন আপনি বারবার কাছে আসার চেষ্টা করতে দেখেও অন্য কারো কাছে আপনাকে পাঠাতে চাইলে?
রাহাত মায়াকে এক ঝটকায় নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। মায়ার মুখটা নিজের দু হাতের মধ্যে তুলে ধরে তাকালো মায়ার মুখের দিকে। মায়া চমকে গেলেও কিছু বললো না।
-শেষবারের মতো মাফ করে দাও না প্লিজ মায়াবতী? তোমাকে ছাড়া যে আমার চলবে না মায়া। এক মূহুর্ত চলবে না, একটা সেকেন্ড চলবে না তোমাকে ছাড়া। মাফ করে দাও এবারের মতো? প্লিজ?
মায়া রাহাতকে ধাক্কা দিয়ে সরে এলো। রাহাত মায়ার রাগে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাকই হলো। এতোটা রাগ কি জন্য মেয়েটার? একটু রাহাতের দিকটাও কি বুঝতে পারে না মেয়েটা?
-কি মনে করেন আপনি? আমি কি আপনার কথা শুনতে বাধ্য? আপনি যা বলবেন সেটাই শুনতে হবে আমাকে? যখন ইচ্ছে এসে বলবেন আপনার মনে আমি কখনোই ছিলাম না, সেটাও মানতে হবে। আবার কখনো এসে বলবেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন, সেটাও মানতে হবে। আবার কখনো অন্য কারো সাথে---। কি ভেবেছেন টা কি আপনি? আমি পুতুল? আপনার খেলার পুতুল আমি? যখন যা ইচ্ছে হয় নিজের মতটা আমার উপরে চাপিয়ে দিবেন? কেন? ভালোবাসি আপনাকে। তাই বলে কি এতোটাই ফেলনা আমি? নিজের মতামতের মূল্য নেই আমার? করবো না মাফ আপনাকে আমি। আজ না, কাল না, কক্খনো মাফ করবো না। আপনিও আমাকে আপনার কথা মানাতো বাধ্য করতে পারবেন না মিস্টার রাহাত চৌধুরী।
রাহাত এবারে ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকা হাসি ফুটিয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে এলো।
-যদি বলি তুমি এখনো বাধ্য? এখনো কিন্তু তুমি-----।
-আপনি হয়তো ভুলে গেছেন মিস্টার রাহাত। আমার উপরে আপনার কখনো কোনোরকমের কোনো অধিকার ছিল না, নেই, আর থাকবেও না। হ্যাঁ, একটা সময় আমি আপনার পি.এ ছিলাম। কিন্তু--।
-ছিলে বলছ কেন? অফিশিয়ালি তুমি এখনো আমার পি.এ আছো। তুমি রেজিগনেশন দিয়েছ ঠিকই কিন্তু বললেই তো আর এভাবে ইস্তফা দিয়ে দেয়া যায় না মায়া।
-মানে?
-মানে হলো রেজিগনেশন দেয়ার পর সেটা এ্যাপ্রুভ তো হতে হবে তাই না? তো এ্যাপ্রুভাল লেটারে আমার সাইন লাগবে, তোমারও সাইন লাগবে যে তুমি নিজের ডিসিশন চেইঞ্জ করো নি। তারপর না সেটা লিগালি প্রুভ হবে----।
-দরকার হলে আমি আমি আরো একশ বার রেজিগনেশন দিবো। দরকার হলে একবার না একশ বার আপনার এ্যাপ্রুভাল পেপারে সাইন করে নিজের ডিসিশানের কথা জানিয়ে দিবো। তবু আপনার পি.এ হয়ে থাকবো না না না।
-ভেবে বলছেন তো ম্যাডাম? পরে কিন্তু হাজার মাথা কুটলেও জবটা ফিরত পাবেন না। এটাই লিগাল রুল।
-ভেবেই বলছি। আমি ঢাকায় পৌঁছেই আপনার সব পেপারে সাইন করে দিবো।
-সে তো আরো দুটো দিন লাগবে। দুইদিন অপেক্ষা করার কি দরকার? আমার কাছে পেপারগুলো রেডি করাই আছে৷ তুমি সাইন করে দাও। তাহলেই হবে---।
-দিন কোথায় সাইন করতে হবে। এক্ষুণি সাইন করে দিচ্ছি। আপনি সাইন নিয়েই চলে যান আমার রুম থেকে----।
-তা তো যাবোই।
রাহাত নিজের রুম থেকে একটদ ফাইল নিয়ে এসে মায়ার দিকে এগিয়ে দিলো। মায়া রাগে ফাইলটা টেনে নিয়ে পেইজ উল্টিয়ে দেখবে এমন সময় রাহাত মায়ার হাতে একটা কলম ধরিয়ে দিলো।
-হ্যাঁ হ্যাঁ। সময় নিয়ে প্রত্যেক লাইন বাই লাইন পড়ে সাইন করো। আমার এতো তাড়া নেই। তুমি পেপারগুলো চেক করতে করতে আমি একটা ঘুম দিয়ে উঠি কি বলো? তুমি ভালো করে ক্লজ এন্ড কন্ডিশানগুলো চেক করে নিও কেমন?
মায়া রাগের চোটে এক নিঃশ্বাসেই পেপারগুলোয় সাইন করে দিলো। ফাইলটা রাহাতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানার উপরে বসে পড়লো মায়া। রাহাত একবার মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে পেপারগুলোয় নিজেও সাইন করলো।
-আরেকবার চেক করে নিবেন ম্যাডাম? আমি সবগুলো সাইন ঠিকঠাক মতো করেছি কিনা?
-আপনি যাবেন এখন?
-ওকে ওকে রিল্যাক্স মায়াবতী। শান্ত হয়ে ঘুমাও। আজ আর বিরক্ত করবো না। সকাল সকাল বের হতে হবে। লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো কেমন? আর ম্যাডাম এবারে প্লিজ দরজাটা বন্ধ করে নিবেন ঠিক করে। গুড নাইট মায়াবতী। এন্ড লাভ ইউ সো মাচ।
রাহাত মায়ার কপালে ছোট্ট একটা চুমো এঁকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মায়াও থতমত খেয়ে রাহাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। আর প্রায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়েও পড়লো। আর এদিকে রাহাত নিজের রুমে এসে ফাইলটা লাগেজে রেখে নিজেও শুয়ে পড়লো। মায়াবতীকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা আর ওকে তাড়া করবে না আজকের পর থেকে। এখন রাহাত নিজের সমস্ত ফোকাস মায়াকে নিজের করে পাওয়ার দিকে দিতে পারবে। দেখা যাক কতটুকু সফল হয় সে। নিজের ভালোবাসা থেকে কতোক্ষণ পালাতে পারে মায়াবতী সেটাও দেখা যাক।
৪০!!
একদম ভোরে মায়ার ঘুমটা ভাঙ্গলো দরজায় নকের শব্দে। ঘুমঘুম চোখে মেয়েটা কোনমতে উঠে বসে আড়মোড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আবার দরজায় নক হলো। এতো সকালে কে আসতে পারে ভেবে মায়া বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখার চেষ্টা করলো। সেন্টমার্টিনে আসার পর থেকে মোবাইলটা এই একটা কাজেই ব্যবহার করতে পেরেছে বেচারি। মোবাইলে যে একটা সিম আছে, আর সেটা দিয়ে যে কল করা যায় সেই কথাটাও সম্ভবত মায়ার মনে নেই। অবশ্য মনে থাকার পিছনে দোষরা মায়ার নয় যদিও। কক্সবাজার আসার পর মায়াবতীর প্রিয় সিমের নেটওয়ার্ক ইন্তেকাল ফরমাইয়েছেন। তাই আপাতত মোবাইলটা এলার্ম ক্লকের কাজ করছে গত সাতদিন ধরে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মায়া ঘড়িতে সময় দেখে আঁতকে উঠলো। ঘড়িতে পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। মায়া তাড়াতাড়ি উঠে রুমের লাইটের সুইচ অন করে দিয়ে এসে রুমের দরজা খুলে হা হয়ে গেল। দরজার বাইরে তো কেউই নেই। হয়তো রিসোর্টের স্টাফদের কেউ ডাকতে এসেছিল ভেবে মায়া দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে লাগেজে অগোছালো কাপড়গুলো ভরে নিয়েই বের হতে ছুটলো। ছয়টার মধ্যে ওদের রিসোর্ট ছাড়ার কথা আজকে। তাই এতো তাড়াহুড়ো।
মায়ার বের হতে কিছুটা দেরিই হয়ে গেছে। বেশিরভাগ গেস্টই জেটির দিকে রওনা হয়ে গেছে আগেই। মিহান, দিয়া আর কয়েকজন রিসোর্টের রিসিপশনে আছে শুধু। চারদিকে একবার নজর ঘুরিয়ে মায়ার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। অজান্তেই কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল কৌতূহলী চোখ জোড়া৷ মানুষটাকে না পেয়ে মন যতটা না খারাপ হলো, তারপর বেশি রাগ হলো মায়ার। রাগটা নিজের উপরে নাকি রাহাতের উপরে সেটা মায়ারও জানা নেই। মায়া ভ্যানে করে জেটিতে পৌঁছেছে বাকিদের সাথে। তারপর সেইফটির জন্য লাইফজ্যাকেট পড়ে নিয়ে ট্রলারে উঠতে হয়েছে এবারে। মায়া উদাস দৃষ্টিতে সাগরের বিশাল ঢেউগুলো দেখছিল এমন সময় টের পেল কেউ একজন মায়ার কাঁধের উপর দিয়ে নিজের হাতটা নিয়ে ট্রলারের একটা অংশ চেপে ধরেছে। মায়া মানুষটার স্পর্শ পেল না ঠিকই, কিন্তু লোকটা যে মায়াকে প্রটেকশনের জন্য কাজটা করেছে সেটা বুঝতেও তেমন বেগ পেতে হলো না ওকে। মায়ার মেজাজটা এমনিতেই খারাপ হয়ে ছিল আগেই। এবারে এমন পেঁচিয়ে ধরা হাতটা দেখে রাগটা আর সামলাতেই পারলো না। ধাক্কা দিয়ে হাতটা সরিয়ে দিয়ে পাশে তাকাতেই মানুষটাকে দেখে মায়া থতমত খেয়ে গেল।
-আপনি!?
-আমি তো তোমাকে টাচও করি নি। শুধু হাতটা দিয়ে রেখেছি। তবু এমন করছ কেন?
মায়া রাহাতের দিক থেকে মুখটা সরিয়ে নিয়ে আবার সাগরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। মানুষটাকে পাশে দেখে মায়ার মধ্যে কি চলছে মেয়েটা নিজেও হয়তো জানে না। মায়াকে এভাবে নিরব দেখে রাহাত আবার একটু সাহস করে আগের মতো হাতটা রাখলো যাতে ঢেউয়ের দাপটে মায়ার পড়ে যাওয়ার ভয়টা না থাকে। বেশ কিছুটা সময় পর মায়া নিজেকে সামলে নিয়ে রাহাতের হাতটা সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো।
-হাতটা সরান রাহাত। আমার সেইফটি নিয়ে আপনাকে এতো টেনশন করতে হবে না।
-হাত সরিয়ে নিবো। ওকে। তুমি আমার জায়গায় এসে বসো। কর্ণারে বসতে হবে না।
-কোনো প্রয়োজন নেই। হাত সরান।
-সাঁতার তো শুনলাম জানো না, এই উত্তাল সমুদ্রের অবস্থা দেখে ভয় করছে না তবু?
-ভয় পাবার কি হলো? পড়ে যাবো না। আর পড়লেও লাইফ জ্যাকেট তো আছেই।
-বেশি বকবক না করে সাগরের কানে তালা লাগানো গর্জন শোনো। তোমার এই লাইফ জ্যাকেট কি কাজে আসবে জানি না। কিন্তু আমার এই শক্ত হাতের বাঁধন থেকে তোমাকে টেনে নেওয়ার শক্তি কারো নেই মায়াবতী৷ এই সাগরেরও না, তোমারও না।
-সরুন তো। কি করছেন?
রাহাত মায়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এমনভাবে আঁকড়ে ধরলো যাতে মায়া নড়াচড়াও করতে পারলো না। মায়ার কোনো কথাই যেন কানে ঢুকছে না এমন একটা ভাব করে রাহাত উত্তাল সাগরের ঢেউগুলো অনুভব করতে লাগলো। মায়া আবার সরে আসার চেষ্টা করতেই রাহাত মায়াকে নিজের সাথে আরো শক্ত করে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কয়েকটা কথা বললো।
-এমনভাবে নাচানাচি করলে সবাই কিন্তু বুঝতে পারবে তোমাকে কেমন করে নিজের সাথে বেঁধে রেখেছি। সেটা কি ভালো দেখাবে বলো? এর চেয়ে চুপচাপ আমার কাঁধে মাথা রেখে সাগরের সৌন্দর্যটা উপভোগ করো মায়াবতী। কেমন? ঘুমিয়ে পড়ো না যেন আবার। তিন ঘন্টার মতো সময় লাগবে। বাসে ঘুমাতে পারবে৷ কষ্ট করে এই তিনটা ঘন্টা একটু জেগে থাকো। কেমন?
-আমাকে তো ভূতে ধরেছে তাই না? এতো শব্দে কারো ঘুম আসবে কি করে?
-তোমাকে ভূতে ধরেছে কিনা জানি না। তবে আমাকে একটা মায়াপরীতে ধরেছে বুঝলে? সেই পরীটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারলে আবেশেই চোখে ঘুম নামে।
-আপনি একটা অসহ্য। চুপ করুন তো।
মায়া খুশিমনে সাগরের ঢেউগুলো দেখায় মন দিলো। আর রাহাত তার মায়াবতীকে দেখায় ব্যস্ত হয়ে রইলো। ঘন্টা তিনেক পরে সকাল নয়টার দিকে ট্রলারে করে ওরা টেকনাফে এসে পৌঁছেছে। জেটি ঘাটেই বাকিরাও পৌঁছে গেছে ততক্ষণে। বাসের ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখা ছিল। একে একে সবাই বাসে উঠে বসলো। মায়া একটা বাসে উঠে মোটামুটি শেষের দিকে একটা সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ট্রলার থেকে নামার পর রাহাত কোনদিকে গেছে সেটা মায়া খেয়াল করে উঠতে পারে নি। এখন পাশের সিটে কে বসবে ভাবতেই মনটা আবার খারাপ হতে শুরু করলো মায়ার। গেস্টদের প্রায় সবাই হয় জুটিতে এসেছে, নয়তো দল বেঁধে ট্যুরিস্টদের মতো করে। বেশিরভাগের সাথেই মায়ার পরিচয়ও হয়নি। তাই পাশে কে বসবে সেটা ভেবে বিরক্তই লাগছে মায়ার। মায়া ভাবনার জগতে আরো কিছুদূর এগোনোর আগেই পাশে কেউ বসছে টের পেয়ে চমকে একটু সরে বসে পাশ ফিরে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মায়া চোখ পিটপিট করে বোঝার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা স্বপ্ন নাকি সত্যি। মায়ার কোলের উপরে একটা খাবার ভর্তি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে আয়েশ করে বসেছে রাহাত। মায়াকে এভাবে থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রচন্ড মজা লাগছে রাহাতের। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে সিটে গা এলিয়ে দিল আবার।
-এভাবে হা করে তাকিয়ে কি দেখছ মায়াবতী? সকাল থেকে তো কিছুই খাওয়া হয়নি। খেয়ে নাও।
-আপনি কোথা থেকে এলেন?
-কোথা থেকে এলাম মানে কি? আমিও তো ঢাকা ব্যাক করছি তোমার সাথে। এলাম তো রিসোর্ট থেকে। তাও তোমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। এতো তাড়াতাড়ি ভুলেও গেলে?
-না--। মানে----।
-নাকি জানতে চাইছ কোথায় গিয়েছিলাম? এতো ভোরে তো রিসোর্টে খাওয়ারের ব্যবস্থা ছিল না। তাই খাবার কিনে আনতে গিয়েছিলাম। লম্বা একটা জার্নি। পুরোটা রাস্তা না খেয়ে থাকবে নাকি?
-ওহ!
-তুমি কি ভেবেছিলে তোমাকে রেখে আমি চলে যাব? সেটা হচ্ছে না ম্যাডাম। আপনি যেখানেই যান না কেন আমিও ঠিক হাজির হবো। কথাটা মাথায় রাখবেন ওকে?
মায়া আবার বাইরের দিকে ফিরে তাকালো। বাস চলতে শুরু করেছে। দ্রুত গতিতেই উত্তাল সাগরটা ওদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আবার কখনো এই লোনা জলের সাগরটা দেখার সময় হবে কিনা কে জানে। তাই চোখ বুজে এই কোলাহল, সাগর পাড়ের বাঁধনহারা বাতাস, এই স্নিগ্ধ অনুভূতিগুলো গায়ে মাখছিল মায়া। সাগরের এরিয়া পেরিয়ে ব্যস্ত রাস্তায় বাস চলা শুরু করলে রাহাত প্যাকেট থেকে মায়াকে খাবার বের করে এগিয়ে দিলো। মায়া একবার রাহাতের দিকে তাকিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে দেখে রাহাত হাত বাড়িয়ে ছোট্ট জানালার পর্দাটা টেনে দিলো। মায়া বিরক্ত হয়ে রাহাতের দিকে ফিরলো এবারে।
-এটা কি হলো? পর্দাটা টানলেন কেন?
-বাইরের মানুষজন, রাস্তাঘাট দেখতে তো তোমাকে মানা করি নি তোমাকে আমি। কিন্তু তুমি নাস্তা না খেয়ে হা করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকবে, সেটা তো আমি মানবো না। নাস্তা করো। তারপর যত ইচ্ছে দেখো আমি বাঁধ সাধবো না।
-আপনার নাস্তা আপনি খান। আমি খাবো না। আর শুনুন? আমি কি করবো না করবো সেটা কি আপনি ঠিক করে দিবেন নাকি? আর ঠিক করে দিলেও আমি শুনবো ভেবেছেন? ইম্পসিবল।
-এই মেয়ে? ঝগড়া ছাড়া আর কিছু পারো না তুমি?
-না পারি না। আমি তো সারাদিন সবার সাথে ঝগড়াই করি। তাহলে আমার পাশে এসে বসেছেন কেন? আমি কি আপনাকে বলেছি আসতে? নাকি বলেছি প্লিজ আমার পাশে বসুন। আপনাকে ছাড়া ভালো লাগে না। বলেছি আমি?
-বলো নি?
-কখন বলেছি হ্যাঁ? কখন বলেছি? আন্দাজে একটা বলে দিলেই হলো নাকি?
-এই এখনই তো বললে আমাকে ছাড়া তোমার ভালো লাগে না। তবু কেন ঝগড়া করছ গো মায়াবতী?
-আপনি একটা অসহ্য! আমি মোটেও এসব কিছু বলি নি।
-বলেছ বলেছ। মুখে না বললেও মনে মনে হলেও বলেছ। তাই তো আমিও চলে এসেছি তোমার কাছে। তোমার না বলা ইচ্ছেগুলোও আমি বুঝে নিয়ে পূরণ করবো। কোনো সমস্যা নেই। এখন খাও তো। বারো ঘন্টা আমার পাশে বসে থাকবা, ঝগড়া করবা। এনার্জি লাগবে না?
-অসহ্য!
মায়া আর কিছু বলার আগেই মায়ার মুখে খাবার গুঁজে দিয়ে নিজেও খাওয়ার মন দিলো রাহাত। মায়া একটু বিরক্ত হয়ে চুপচাপ খেয়ে নিয়ে পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। একটু পরেই কানের কাছে রাহাতের গুনগুন শুনে মায়া পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো রাহাত একদম কাছে ঘেঁষে বসে নিজের মনে গুনগুন করছে। রাহাত ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে সোজা মায়ার চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে গানটা গাইছে। মায়া কয়েক সেকেন্ড থমকে রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চমকে সরে আসার চেষ্টা করলো। রাহাত মায়াকে সরে আসার সুযোগ না দিয়ে নিজের আরো কাছে টেনে নিলো। মায়া থতমত খেয়ে সরে আসার চেষ্টা করতেও যেন ভুলে গেছে। রাহাতও সুযোগটা ছাড়লো না। মায়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো।
-কি করছেন? ছাড়ুন?
-দখিনের হাওয়াকে মনের কথা বলছি। কেউ তো আমাকে বুঝলো না। অন্তত এই লাগামহীন বাতাসটা আমার মনের কথাটা নাহয় কারো কানে গিয়ে বলে দিক।
-ছাড়ুন তো। সবাই দেখছে।
-কেউ দেখছে না। সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। আর দেখলেই বা কি। আমি আমার মায়াবতীকে বুকে টেনে নিয়েছি। কার অধিকার আছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার?
-আমি আবার আপনার মায়াবতী হলাম কবে?
-তুমি তো সেই প্রথমদিন থেকেই আমার মায়াবতী। যাকে প্রত্যেকবার বোকার মতো হারিয়ে ফেলি। কিন্তু এবারে তোমাকে বেঁধেছি মায়াবতী। হারাতে দিবো না।
-যখন হারিয়ে যেতে চাই নি তখন তো ধরে রাখতে চান নি। এখন হারিয়ে যেতে চাইলে ধরে রাখতে পারবেন?
-যে বাঁধনে বাঁধতে চলেছি তোমায় সেই বাঁধনটা ছিঁড়ে হারাতে চাইবে না তুমিও।
-কি?
রাহাত ইচ্ছে করেই এবারে মায়ার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। মায়াকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে চুলো বিলি কেটে দিতে লাগলো রাহাত। রাহাতের এই আলতো ছোঁয়ায় মায়ার চোখে ঘুম এসে ভর করছে৷ রাহাতের কথাগুলো মাথায় কেমন জটলা পাকিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য রাহাতের শব্দের জালের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর আগেই রাহাতের মৃদু কণ্ঠের গানে হারিয়ে গেল মায়া। ফুরফুরে বাতাসে গা এলিয়ে প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে তার কণ্ঠে গান শোনার অনুভূতিটা এতো তীক্ষ্ম সুখের হয় সেটা জানাই ছিল না মায়ার। এদিকে রাহাতও মায়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আনমনেই গুনগুন করছে। দখিনা বাতাসের তোড়ে গানের সুরটা যেন একটা হৃদয় ভেদ করে অন্য হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে।
-"শোন গো দখিনো হাওয়া, প্রেম করেছি আমি
লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি
মনেতে লুকানো ছিল সুপ্ত যে পিয়াসা
জাগিল মধু লগনে বাড়ালো কি আশা
উতলা করেছে মোরে, আমারি ভালবাসা
অনুরাগে প্রেম শরীরে ডুব দিয়েছি আমি
শোনগো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি
দহনো বেলাতে আমি, প্রেমেরো তাপসী
বরষাতে প্রেম ধারা, শরতের শশী
রচিগো হেমন্তে মায়া, শীতেতে উদাসী
হয়েছি বসন্তে আমি বাসনা বিলাসী
শোনগো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি
লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি।"