অচেনা অতিথি - পর্ব ০৪ - সিজন ২ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


মাহাদ সাথে সাথে ঐ অবস্থায় পাশ ফিরে তিতিরের দিকে কঠিন চোখে চাইতেই তিতির স্থির হয়ে যায়। এ যেন শিকার  শিকারীর কাছে স্ব-ইচ্ছায় ছোবল খাওয়ার মত অবস্থা।

পুরোদিন কি হয়েছে সেটাতে মাহাদের কিছু যায় আসেনা। কিন্তু রাত হলে ওর এই মানুষটাকে চাই চাই। মাহাদের কঠিন চোখ দেখে তিতির মাহাদের কাছ থেকে হাত দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরলো। তারপর চুপ হয়ে রইলো। 

মাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিতিরকে টেনে ওর দিকে  আনতেই তিতির মাহাদের ট্রীশার্ট খামচে ধরে কঠোর গলায় বলল-

~" আপনি আমাকে মাটিতে পুতে ফেলবেন? আপনার সাহস কি করে হয় এধরনের কথা বলা! আপনার কাছ থেকে আমাকে আলাদার করার কথা আপনি কিভাবে বলতে পারলেন? আপনি কি জানেননা! আপনাকে ছাড়া আমি তিতির অচল!"

মাহাদ ওর কোন কথার জবাব না দিয়ে তিতিরের বাম হাত চেপে ধরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। সেটা দেখে তিতিরের হাতটা একটু মুচরে ধরে বলল-

~" বন মানুষের মত নখ রেখেছ কেন? তোমার অযুও তো সঠিকমত হবেনা। শরীরে আঙ্গুল ছোয়ার আগে নখ ছুবে তখন। তাছাড়া অতিথীর শরীরে আচড় লাগারও সম্ভবনা থাকবে। এগুলো কেন রেখেছ?

~" আপনাকে খামচি দেওয়ার জন্য। আপনি উল্টা-পাল্টা কথা বললেই আক্রমন।"

অহ্ তাই বলেই তিতিরকে একটা হ্যাচকা টান দিতেই তিতির মাহাদের আয়ত্বে চলে যায়। ওর নড়ার আর ক্ষমতা নেই। কিন্তু মুখতো আর বন্ধ নেই। 

~"দেখেন মাহাদ, কোন কিছুতে আজ  কিছুই হচ্ছেনা। তাই চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। আমি আপনার কাছে আর ধরা দিচ্ছিনা।"

মাহাদ তিতিরের ঠোট ছুতে যেতেই তিতির মুখ সরিয়ে অন্যদিকে চাইলো। যেটা মাহাদের আক্রোশ আরো বাড়িয়ে দিল। তিতিরকে আরো জোড়ে ধাক্কা দিয়েই একটু উচু করল, তারপর মাহাদ ওর গলায় মুখ ডুবাতেই তিতিরের ফোনের আর্লাম বেজে উঠলো। তাহাজ্জুদের জন্য আর্লাম দিয়ে রেখেছিল তিতির।

মাহাদ কোন কারন ছাড়াই দ্রুত তিতিরকে ছেড়ে দিয়েই রাগে ফোনটা গায়ের শক্তি দিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। বিকট শব্দে ফোন ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। সাথে সাথে তিতির উঠে বসেই বলল-

~" আমার ফোন.....!"

এমন সময় ফোন ভাঙ্গার শব্দে অতিথী নড়ে উঠতেই মাহাদ তিতিরের মুখ চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল-

~" চুপপপপ.....! "

কথাগুলে বলেই মাহাদ অতিথীর দিকে তাকালো। অতিথী একটু আলতো করে চোখ মেলেই আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো। মেয়ে ঘুমানোর সাথে সাথে মাহাদ তিতিরের দিকে চেয়ে ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে মৃদু স্বরে বলল-

~" ফোনে আর্লাম দিয়ে রেখেছিস কেন? আমাকে যাতে তাহাজ্জুদে না ডাকতে হয় তার জন্য আর্লাম দিয়েছিস! আমার সাথে কথা বলতে চাসনা তাইতো! তোর সাহস দেখছি বড্ড বেড়ে গেছে।"

তিতির শেষ, আজ আর রেহাই নেই। এতঘন্টা না কথা বলার শাস্তি যে কতটা কঠিন সেটা আজ মাহাদ ওকে দিয়েই ছাড়বে। তাছাড়া ফোনের ব্যাপারটা সে ধরে ফেলেছে। আর কোন কথাই চলবেনা। কথা বললেই অতিষ্ট করে ফেলবে তিতিরকে। তাই শান্ত চোখে মাহাদের দিকে চাইতেই মাহাদ ওর কপালে একটা কিস করেই বলল-

~" আর কোন কথা বলবি! আর জ্বালাবি আমায়!"

তিতির সাথে সাথে মাথাটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে না বলল। তিতিরের এমন ব্যবহারে মাহাদ মুচকি হেসে বলল-

~" গুড, আসা করি আমার কাজে আর বাধা আসবেনা।"

তিতির চট করে মাহাদের ঠোট ছুতেই মাহাদ পলট দিয়ে তিতিরকে ওর নিচে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষন তিতিরের দিকে চেয়ে থেকে ওর দিকে আরো খানিকটা ঝুকে ফিসফিসিয়ে আদুরে গলায় বলল-

~" স্যরি বউ! তখন মাথা ঠিক ছিলোনা। আর সেই কথা মনে রেখে যদি তুমি আমাকে এভাবে শাস্তি দাও তাহলে তো প্রতি মুহুত্বে মুহুত্বে আমি মাহাদ মারাই যাবো। এমন করতে হয়না বউ!"

এবার তিতির কিছুটা সাহস পেয়ে ছলছল চোখে মাহাদের দিকে চেয়ে বলল-

~" তাই বলে ওমন কথা বলবেন আপনি!"

বললামতো বাবা স্যরি...... আর আবার তোমার মুখে বুলি ফুটেছে! বলেছিনা কোন রকম বাধা না দিতে! মাহাদ কথাগুলো বলতেই তিতির ওর দু'হাতে মাহাদের গলা জড়িয়ে ধরে একদম কাছে টেনে ঠোট মেলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ব্যাপারটা মাহাদের প্রচন্ড ভালো লাগলো। ও পাল্টা আক্রমন করে তিতিরকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলল। পবিত্র ভালোবাসার মিলন অত্যান্ত তীক্ষ্ণ হয়। 


একমাস পর,

মাহাদ অতিথীকে বুকে নিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে উষ্ণ  পানিতে গোসল করে দিচ্ছে। অতিথীর গায়ে হালকা গরম পানি পড়তেই ও খিলখিল করে হাসছে। যেটা দেখে সাদের খুব ভালো লাগছে।
 সাদ মাহাদের সাথে একটু কম কথা বলে। সাদ বাবাকে প্রচন্ড ভয় করে কিন্তু খুব ভালোবাসে। বোনকে বাবার সাথে এমন করে গোসল করতে দেখে ও ওয়াসরুমের দরজায় দাড়িয়ে বলল-

~" বাবা, আমি আপনার সাথে একটু গোসল করি?"

মাহাদ সাদের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিতেই সাদ বুঝতে পেরে দ্রুত ওয়াসরুমে ঢুকে পড়লো।

সাদও বাবার গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে। মাহাদের শরীর থেকে পানি পড়ছে আর সেই পানিতে সাদ ওর শরীর ভিজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমন সময় কামরান সাহেবের আগমন। দরজায় দাড়িয়ে থেকে মাহাদের সব কাজ দেখছিল। ছেলেটা একদম বাবার হাত পেয়েছে। আমিও এমন করে মাহাদকে কোলে নিয়ে গোসল দিয়ে দিতাম আর ফুয়াদ আমার পাশে দাড়িয়ে এভাবেই গোসল করতো। কথাগুলো ভাবতেই মাহাদ বলল-

~" বাবা, আপনি কখন আসলেন?"

মাহাদের কথায় কামরান সাহেবের ধ্যান ভাঙ্গল। কামরান সাহেব অপ্রস্তুত গলায় বলল-

~" এই তো, একটু আগে আসলাম। একটা কাজে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম দেখা করেই যাই।"

সাদ বাবাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে এসে তার দাদুকে জড়িয়ে ধরে একটা লম্বা সালাম দিল। কামরান সাহেবও সাদকে কোলে তুলে নিয়ে সালামের জবাব দিয়ে অভিমানী সুরে বলল-

~" ভাইজান কি আমাকে ভুলে গিয়েছিল! কারন গত তিনদিন ধরে ভাইজান আমার সাথে কথা বলেনি। মনে খুব কষ্ট পেয়েছি।"

সাদ আর কিছু না বলে ঐ ভেজা শরীরেই দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো। সাদ তার দাদুকে প্রচন্ড ভালোবাসে। এমন দৃশ্য দেখে মাহাদ সাদকে বলল-

~" বাবা, তুমি ভেজা শরীরে কেন দাদুর কোলে উঠেছ! ওনিতো অফিসে যাবেন। ওনার ড্রেসগুলো ভিজে যাচ্ছে।"

বাবার কথা শুনে সাদ দাদুর কোল থেকে নামার চেষ্টা করতেই কামরান সাহেব ছলছল চোখে সাদকে নিয়ে তিতিরের কাছে চলে গেল। তিতির এদের এমন ভাবে দেখে একটা টাওয়াল এনে শশুড়ের হাতে দিতেই কামরান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেনন-

~" তোমার হ্যাসব্যান্ড দিনদিন কিন্তু আমার শত্রু হয়ে যাচ্ছে তিতির! আমার যেখানে সুখ সেখানেই সে আঘাত করবে। তাকে নিষেধ করে দিবে, সে যেন এমনটা আর না করে।"

কামরান সাহেবের কথা শুনে তিতির শুধু মুচকি হাসি দিল। তারপর আশ্বাসের স্বরে শশুরকে বলল-

~" বাবা চিন্তা করেন না তো! সবথেকে সাদের উপর অধিকার শুধু আপনারই। ওরকম একটা দু'টো কথায় যায় আসেনা। এমন কথা বললে কি সব পাল্টে যাবে নাকি? আপনি ওকে নিয়ে টেবিলে বসেন। সকালে শুধু বলেছি দাদু আসবে আর এতেই সে খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে আপনার অপেক্ষায় আছে। ওর বাবাও ওকে খাওয়াতে পারেনি।"

তিতিরের কথা শুনে কামরান সাহেব চোখে আর পানি ধরে রাখতে পারলোনা। সাদকে অনেকগুলো চুমু খেয়ে বলল-

~" মা, এই বৃদ্ধ বয়েসে আমাদের আর কত কষ্ট করতে হবে? আমাদের কষ্ট কি কোনদিনও শেষ হবেনা! না আমরা মারা গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।"

শশুরের এমন কথা শুনে তিতিরের বুকে যেন পরপর কয়েকবার সুচ বিঁধল। বাবার আদর কি জিনিস তিতির তা জানতোনা। অথচ এই মানুষটার কাছে দেখেছে বাবার ভালোবাসা কতটা শক্তিশালী আর সৌন্দর্যময়। তিতির অপরাধী চোখে শশুড়ের দিকে তাকিয়ে বলল-

~" বাবা, আজ ওনাকে আমার সামনেই কথাগুলো বলেন। আমি আগে বলেছি কিন্তু এ বিষয়ে কোন কথায় বলেননি আমার সাথে। আজ আর একবার চেষ্টা করে দেখি আমরা! আমারও তো ভালো লাগেনা আপনাদের ছাড়া এভাবে থাকতে।"

~" মা, তুমি বললে একবার কেন! বার বার কথাটি তুলবো তার কাছে। তুমি একটু হ্যা এর সাথে হ্যাঁ মিলাইও।"

জ্বী বাবা বলে টেবিলে নাস্তা দিয়ে তিতির মাহাদকে ডাকতে গেল। কারন বাবা বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। এত ব্যস্ততার মধ্য যে সময় করে এখানে এসেছেন সেটাই বা কম কিসের? এদিকে কামরান সাহেব সাদকে নাস্তা করাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

খানিক বাদে একটা পাঞ্জেবী হাতে নিয়ে মাহাদ বাবার কাছে আসলো। ততক্ষনে সাদের খাওয়া শেষ। তিতির সাদকে ডাকতেই সাদ মায়ের কাছে চলে গেল। সাদ কাছে এলে তিতির ওকে বলল-

~" বাবা, বোনটা আপনাকে চাচ্ছে। আপনি একটু তার দেখাশোনা করেন।"

আচ্ছা মা বলে সাদ ছোট বোনের কাছে চলে গেল। সাদ যেতেই তিতির মাহাদের পাশে দাড়িয়েই শশুড়কে ইশারা করলো কথাটা বলতে।

পুত্রবধূর সম্মতি পেয়ে কামরান সাহেব অনেক আশা নিয়ে বললেন-

~" মাহাদ, এবার বাসায় ফিরে চলনা বাবা! তোর মা প্রতি রাতে আমাকে অভিযোগ করে। আমি কেমন বাবা যে, নিজের ছেলেকে মানাতে পারিনা। তোর মাকে আর অভিযোগ করার সুযোগ দেসনা বাবা। আমার কথাটা একবার শোন!"

বাবার চোখের জল দেখে মাহাদের দয়া হলো কিনা বোঝা গেলোনা কিন্তু অতি যত্নে বাবার কোট সহ শার্টটা খুলে পাঞ্জেবীটা পড়িয়ে দিয়ে বলল-

~" বাবা, ইদানিং আপনি বেশি সিগারেট খান আর ব্যালকুনিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে রাত কাটান। শরীরের হাল এ কি করেছেন? এগুলো করা কি ঠিক!

মাহাদের এমন আদুরে মাখা কথায় কামরান সাহেবের মনে হচ্ছে তার বাবা ইমতিয়াজ সাহেব ছেলের পরিচর্যা নিচ্ছেন। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও তিনি ছেলের পরিচর্যা নিতে কখনো ভুলতেননা। তার আম্মাজান ঠিকি বলেন, মাহাদের ভিতর তিনি আব্বাজানের ছায়া দেখতে পান। কামরান সাহেব চোখের পানি মুছে বলল-

~" একদম ঠিক না। আমি আর এমন কাজ কখনো করবোনা। আর ব্যালকুনিতে দাড়িয়ে রাত জাগবোনা। বেশি বেশি সিগারেটও খাবোনা। তোর সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো বাবা। তবুও বাসায় ফিরে চলনা বাবা! তোর মা প্রায় রাতে কান্নাকাটি করে।"

মাহাদ ওর বাবার পাঞ্জেবীর বোতাম লাগিয়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-

~" বাবা, আমরা ওখানে গেলে পুরনো আগুন আবার জ্বলে উঠবে। আমি চাইনা আবার সেই ঘনাটাগুলোর পুনরাবৃত্ত ঘটুক। আমি এ বিষয়ে একটাও কথা বলতে চাইনা। আমার সন্তানদের আপনার দেখার ইচ্ছা হলে আপনি ও মা উভয়ে দেখা করতে আসবেন। কিন্তু ওখানে আমাদের যাওয়ার কথা একদমও মাথায় আনবেন না। 
তিতিরকে যখন একা রাতে বাসা থেকে ওরা বের করে দিয়েছিল আমার অনুপস্থিতিতে, তখন আপনি কই ছিলেন? আপনিতো জানতেনইনা তিতির কোথায় ছিল, কিভাবে ছিল! আমার মা একজন মেয়ে হয়ে একটা মেয়েকে কিভাবে ঐ রাতে বাসা থেকে বের করে দেয়! মা জানতোনা, তিতির এই শহরের কিছুই চিনতোনা! তাহলে কেন তিনি এমন ব্যবহার করেছিলেন? শুধু একবার করেই ক্ষান্ত হোননি! একাধিক বার তিতিরের ক্ষতি করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। আর নিসা, রেদওয়ান, ফুপু এবং দাদীর কথা না হয় বাদই দিলাম। তাদের মানুষের কাতারে ধরতেও আমার লজ্জা হয়। তারা পারেনা এমন কোন কাজ নেই।
তাই প্লিজ বাবা! আমি আর রিক্স নিতে চাইনা। আমি আমার স্ত্রীর ব্যাপারে কারো উপর ভরসা করিনা। এমন কি আপনার উপরও না.....!"

কামরান সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। কারন মাহাদের প্রতিটা কথার যুক্তি আছে। আম্মাজান সহ বাসার এমন কোন স্ত্রীলোক নেই যে তারা তিতিরকে কষ্ট দেয়নি। এমনকি মারার প্লানও করেছিল। হায়াত ছিল বলে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে মেয়েটা। তারপর দীর্ঘ বিচ্ছেদ.......
নিজের ছেলাটাকে চোখের সামনে ভেঙ্গে যেতে দেখেছে। অনেক কষ্টে আজ সে সুখী। তাই হয়ত তার মনে আবার ভয় জেগেছে তিতিরকে হারানোর। কামরান সাহেব আর কিছু না বলে মলিন মুখ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।

তিতির এতক্ষন মাথা নিচু করে ছিল কিন্তু শশুড় চলে যেতেই মাহাদের দিকে চেয়ে দেখলো, মাহাদ কেমন যেন চাহোনি করে বাবার চলে যাওয়ার পথে চেয়ে আছে। মনে সাহস সঞ্চয় করে মাহাদকে মিনমিন করে বলল-

~" বাবাকে ওভাবে না বললেও পারতেন। চলেননা আমরা আবার একসাথে বসবাস করি! অভিবাবক ছাড়া কখনো জিবন পরিপূর্ন হতে পারেনা। আমাদের সব সময় চিন্তা করা উচিত, আমরাও বৃদ্ধ হবো। তাই আমাদের এমন কাজ করা উচিত নয় যে, পরবর্তীতে তা আমাদের দুঃখের কারন হয়ে দাড়ায়!"

~" ম্যার খাওয়ার কি খুব শখ জেগেছে তোমার! সেদিন থেকে এই একই কথা বলে আমাকে জ্বালাতন করছো। আমি কিন্তু তোমার কথায় খুব কষ্ট পাচ্ছি তিতির!"

ব্যাস হয়ে গেল, মাহাদের এতটুকু কথা শুনেই তিতির আর কোন কথা বলতে পারলোনা। তার বর মসাইকে সে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্য। এখন আর এসব কথা কখনো মুখে কেন! মনেও তুলবেনা। সে এই একটা মানুষের প্রতি ভিষন দুর্বল। আল্লাহ্ ছাড়া যদি কোন মানুষকে সিজদাহ্ করার অনুমতি থাকতো, তাহলে সে সকাল-বিকাল এই মানুষটাকে সিজদাহ্ করতো। 


সাত দিন পরে,
মাহাদ অফিস থেকে বিকেলে এসে তিতিরের হাতে একটা খুব সুন্দর কালো রঙ্গের বোরখা ধরিয়ে দিয়ে বলল-

~" এটা জলদি পড়ে নাওতো! আমরা আজ বাহিরে যাচ্ছি।"

মাহাদের কথা শুনে তিতির অবাক হয়ে বলল-

~" আমরা কোথায় যাচ্ছি? তাও বিকেল প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। অতিথীকে নিয়ে এই সময় বের হওয়া ঠিক নয়।"

~" তিতির ভুলে যেওনা অতিথী কিন্তু আমারও মেয়ে!  ওর ব্যাপারে অবশ্যই আমি সচেতন। তাই কোন কথা নয়। যাও রেডী হয়ে নাও।"

তিতির আর কথা না বাড়িয়ে, বাবার কোলে মেয়েকে দিয়ে রেডী হতে লাগলো। কিছু সময়ের মধ্য রেডী হয়ে বলল-

~" মাহাদ এই কাপড়ের লেজগুলো কোথায় বাধবো? আমিতো এগুলো বাঁধার কোন নিয়ম জানিনা।"

একটু অপেক্ষা করো বলে অতিথীকে বিছানায় রেখে মাহাদ এসে বোরখার ডিজাইন করা সব লেজগুলো জায়গা মত বসিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে তিতিরকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

~" বাহ্, আমার বউকে তো দারুন লাগছে?"

তিতির খানিকটা অবাক আর বিশ্ময়ের সাথে মনে ঢেকুর তুলে বলল-

~" কি ব্যাপার মাহাদ, এত সাজসজ্জা কেন হুম? মনে হচ্ছে আমরা বিয়ে করতে চলছি।"

 তিতিরের এমন কথায় মাহাদ দুষ্টুমির একটা হাঁসি দিয়ে বলল-

~" আমাকে বিয়ে করার কি তোমার আবার শখ জেগেছে! আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নেই। তুমি যদি চাও তাহলে প্রতিদিন তোমার সাথে বিয়ে বসতে রাজি আছি আমি। এতে বরং বউকে প্রতিদিন নতুন অবস্থায় পাব।"

মাহাদ পুরো দুনিয়ার কাছে একজন কঠোর ও দাম্ভিক মানুষ। কিন্তু সে তার স্ত্রীর ভালোবাসার কাছে এতটা কোমল যে, মানুষ যদি তার ভালোবাসার পাগলামোগুলো দেখে তাহলে বাহিরের মাহাদ আর ভিতরের মাহাদের ভিতর বিশাল পার্থক্য দেখবে। এ যেন এক মাহাদের দ্বিতীয় সত্ত্বা। 
তিতির সাদকে ডেকে ওর কাপড় বের করতেই সাদ সেগুলো নিয়ে অন্যরুমে চলে গেল। সাদ চলে যেতেই মাহাদ ওর শার্টটা খুলে অন্য পোষাক গায়ে জড়াতেই তিতির বলল-

~" মাহাদ, আপনি কারো সামনে জামা খোলেননা কেন! এমনকি সাদের সামনেও খালি গায়ে থাকেন না। আমি ছাড়া কারো সামনে শার্টও পরিবর্তন করেননা। সব পুরুষদের দেখি তারা অনায়াসে ছেলে-মেয়েদের সামনে শার্ট পরিবর্তন বা খালি গায়ে থাকে। কিন্তু আপনার বেলায় উল্টোটা। এটা কেন?"

মাহাদ শার্টের হাত গুটিয়ে নিতে নিতে বলল-

~" আমি চাইনা, আমার স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ আমার শরীর দেখুক। সেটা আমার নিজের সন্তানের 
বেলায়ও কার্যকর।"

মাহাদের কথায় তিতির মুখে হাঁসি ফুটিয়ে সাদের কাছে চলে গেল। এদিকে মাহাদ অতিথীকে রেডী করে ওকে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেল । ডাইভার সজল গাড়ী নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। তিতির সাদকে নিয়ে আসতেই মাহাদ ডোরটা খুলে দিতেই ওরা গাড়ীতে উঠলো। সাথে গোলাবও উঠে পড়লো। ডোরটা বন্ধ করে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে মাহাদও গাড়ীতে উঠে পড়লো। তারপর সিটবেল্ট বেঁধে বলল-

~" সজল চল।"

জ্বী স্যার বলে সজল গাড়ী স্টার্ট করলো। গাড়ী চলছে তার আপন গতিতে। এমন সময় সাদ বলল-

~" বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?"

মাহাদ তার চার বছর ছেলের মুখে এমন কথা শুনে  মুচকি হেঁসে বলল-

~" বাবা, তোমার আর তোমার মায়ের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। আমরা সেদিকেই চলছি। আর একটু সময় লাগবে।"

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গাড়ী চলছে তার আপন গতিতে। অতিথী এতক্ষন ঘুমিয়ে ছিল। গাড়ীর ঝাকুনিতে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। দু'হাত সহ শরীর মোচর দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে মাহাদের দিকে চেয়ে রইলো। মাহাদও পরম আদরে মেয়েকে কয়েকটা চুমা খেতেই গাড়ী থেমে গেল। ডাইভার সজল বলল-

~"স্যার আমরা এসে গেছি।"

ডাইভারের কথায় তিতির সামনে দিকে তাকিয়ে দেখলো, অনেক লোকজন সামনে। মনে হচ্ছে একটা বিয়ে বাড়ী। তিতির আরও ভালো করে দেখলো বাড়ীটা। এটাতো মাহাদদের বাসা। ৬ বছর হবে সে এই বাসায় পা দেয়নি। বিয়েটা খুব গোপনেই সেরেছিল তারা। তাও একবার নয়। পরপর দুইবার। তাহলে আমরা আজ থেকে এখানেই থাকবো! কথাগুলো ভাবতেই তিতিরের মুখে হাসি ফুটলো। তিতির হাঁসিমুখে মাহাদের দিকে চাইতেই মাহাদ ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বলল-

~" সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?"

তিতির কিছু বলবে এমন সময় একদল মেয়ে এসে ডোর খুলে তিতিরকে বাহিরে নিয়ে গেল। আর মাহাদ আস্তে সুস্থে সাদ আর অতিথীকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন