৩৫!!
মায়া শাওয়ার নিয়ে হালকা গোলাপি রঙা একটা থ্রি পিস পড়ে নিলো। তারপর ডাইনিং থেকে রাহাত আর নিজের জন্য দুই প্লেট খাবার নিয়ে এলো। নিজের খাবারটা রুমে ঢেকে রেখে রাহাতের রুমের দরজায় কিছুক্ষণ নক করলো মায়া। ভেতর থেকে না কোনো শব্দ আসছে, না রাহাত দরজা খুলছে। মায়া একটু অবাকই হলো এবারে। লোকটা কি সত্যি সত্যি শাওয়ার নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? নাকি শাওয়ার নেয়া কমপ্লিট হয় নি এখনো? আরো কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে মায়া প্লেটটা নিয়েই নিজের রুমে ফিরে এলো। রাহাতের খাবারটাও ঢেকে রেখে রাহাতের অপেক্ষা করতে লাগলো। একটু পরই হয়তো লোকটা এসে খাবার দেয়ার জন্য ডাকাডাকি করবে। কথাটা ভেবে মায়া রুমের দরজাটা খুলেই রাখলো। কিন্তু লোকটা যদি ঘুমিয়ে গিয়ে থাকে? আরেকবার কি ডেকে দেখবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজা বন্ধের শব্দে মায়া চমকে সামনের দিকে তাকিয়ে রাহাতকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। রাহাত মায়ার রুমের দরজাটা বন্ধ করে ভ্রু নাচিয়ে মায়ার পাশে এসে বসলো। কয়েক মূহুর্তের জন্য মায়া যেন বুঝতেই পারলো না কি রিএ্যাকশান দিবে। শাওয়ার নেয়ার পর লোকটা ধবধবে সাদা একটা টিশার্ট জড়িয়েছে গায়ে। শাওয়ারের পানিতে সাদা টিশার্টটা গায়ের সাথে মিশে আছে লোকটার। আর ভিজে মুখটা দেখতেও এতো স্নিগ্ধ লাগছে যে মায়া কয়েক মিনিটের জন্য রাহাতের উপরে যে অভিমান করে ছিল সেটাও ভুলে গেছে।
-দেখুন মিস মায়াবতী। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। এখন এভাবে হা করে না থেকে খাবারটা খেতে দিন। দেখাদেখি পর্ব খাওয়া শেষ করেও করা যাবে।
-জি? আপনি? আমার রুমে এলেন কি করে? আমি তো এই দরজাটা আগেই বন্ধ করে গিয়েছিলাম?
রাহাতের খাবারের প্লেট থেকে ঢাকনা সরিয়ে সামুদ্রিক মাছের ঘ্রাণ নেয়া দেখে মায়া চমকে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এবারে রাহাত মায়ার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। মায়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্লেট থেকে এক টুকরো শশা নিয়ে মায়ার মুখে গুঁজে দিলো রাহাত। মায়া থতমত খেয়ে রাহাতের মুখের দিকে তাকাতেই রাহাত উঠে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে রুমে এসে প্লেটে খাবার মাখিয়ে মায়ার মুখের সামনে প্রথম লোকমা ধরলো। রাহাত এবারে মায়ার মুখের দিকে তাকালো।
-দেখো মায়া? খাইয়ে দিচ্ছি লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নাও। পরে নাহলে সারা রাত না খেয়েই ঘুমাতে হবে। তখন আমাকে দোষ দিতে পারবে না কিন্তু।
-আপনি খান। আমি নিজেই খেয়ে নিচ্ছি---।
-কথা কম বলো বুঝসো? এমনিতেই তুমি আমাকে না বলে এসে কাজটা ঠিক করো নি। এখন না খেয়ে বকবক করলে কিন্তু শাস্তির পরিমাণটা আরো বাড়বে। পরে দেখা যাবে তোমাকে শাস্তি দিতে দিতে ভালোবাসার সময়টাই পাবো না।
-মানে কি? কিসের শাস্তি? আর আমি আপনাকে বলে আসতে যাবো কেন? আমি আপনার কে? আরে?
রাহাত মায়ার কথার মাঝেই ভাতের লোকমাটা মায়ার মুখেই পুরে দিলো। মায়া ভ্রু কুঁচকে রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলো। কি চলছে লোকটার মনে কিছুই বুঝতে পারছে না মেয়েটা। রাহাত নিজে এক লোকমা খেয়ে আবার অন্য লোকমা মায়ার মুখের সামনে তুলে ধরলো। এবারে মায়া নিজেই আর ঝামেলা করলো না। এমনিতেই দিয়া আর মিহানের হলুদের চক্করে সন্ধ্যা থেকে যে খায় নি সেটাই মনে ছিল না এতোক্ষণ। এখন তাই প্রচন্ড খিদে পেয়েছে মায়ার। তার উপরে রাহাতের সাথে তর্ক করে যে কোনো লাভ হবে না সেটাও মায়া বেশ ভালো করেই জানে।
-এইতো গুড গার্ল। তুমি আমার কে জানতে চাইছিলে না? শুধু এখন তোমার কাজিন ব্রাদারের বিয়ে বলেই প্রশ্নটা করার পরও তুমি এতোদূরে এই সাগরের বুকে ভেসে থাকা প্রবাল দ্বীপটায় আমার সামনে বসে থাকতে পারছ। নইলে এতোক্ষণে সোজা কাজী অফিসে মাওলানার সামনে বসে ম্যারেজ রেজিস্ট্রিতে সাইন করতে আর কবুল বলতে।
-মানে কি! কিসব বলছেন?
-মানে বুঝো নি? তাহলে নেক্সট উইকে কবুল বলার পর বুঝিয়ে দিবো। কয়টা দিন অপেক্ষা করো।
-বললেই হলো আর কি? আপনাকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। হুহ।
-আমাকেই বিয়ে করবে সেটা কখন বললাম? তার মানে তুমি নিজেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো এখনো? বাহ! তাহলে তো আর কষ্ট করে তোমাকে বিয়ের জন্য রাজি করানোর ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলাম।
-আপনি একটা! আহহহহ। সরুন। খাবো না আমি আর।
মায়া আবার বিছানা থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই রাহাত মায়াকে ধমক দিয়ে পাশে বসিয়ে দিলো। মায়া গাল ফুলিয়ে বসে আছে দেখে রাহাত ভ্রু কুঁচকে মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার খাইয়ে দেয়া শুরু করলো। মায়াও এবারে কিছু না বলে খাচ্ছে। কিন্তু একটা কথাও বলছে না। রাহাতের কেন জানি মায়ার এমন চুপ করে থাকাও পছন্দ হলো না। আবার তাই ধমক লাগালো।
-সমস্যা কি তোমার? তুমি কি চাইছ এখনই তোমাকে নিয়ে আমি ঢাকায় ফিরে যাই?
-আমি কি করলাম?
-কথা বলছ না কেন? এমন থ হয়ে বসে আছ কেন? আজব?
-কি করবো তাহলে? আর আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন এভাবে?
-ধমকাবো না তো কি আদর করব? তোমার সাহস হয় কি করে না বলে চলে আসার? আবার তর্কও করছ আমার মুখের উপরে? বেশি সাহস হয়েছে আপনার মায়াবতী?
-এখানে সাহসের কি হলো? আমার ভাইয়ের বিয়ে, আমি এসেছি। আপনাকে বলে আসতে হবে কেন?
-প্রথমবার বলে মাফ করে দিলাম এবারের মতো। এরপর থেকে কোথাও যেতে হলে পারমিশন নিতে হবে অবশ্যই। নইলে কোথাও যাওয়ার কথা ভুলে যাও।
-আপনার কাছ থেকে পারমিশন নিতে আমার ঠেকা পড়েছে নাকি? আমি আপনার জব করি না স্যার যে সবকিছুতে আপনার পারমিশন নিতে হবে?
-আচ্ছা? তাই নাকি? জব না করলে কথা শুনবে না? এটা কেমন কথা?
-আমার খাওয়া হয়ে গেছে স্যার। আমি আর খাবো না।
-আরে? মায়া? আর একটু?
-না স্যার। প্লিজ আর না।
রাহাত নিজেও খাওয়া শেষ করে মায়ার মুখ মুছিয়ে দিয়ে প্লেট রেখে নিজেও হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো মায়া রুমে নেই। রাহাত নিজেও এবারে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মায়া প্লেটগুলো ডাইনিংয়ে রেখে রুমে এসে হা হয়ে গেল। রাহাত হাত পা ছড়িয়ে মায়ার বিছানায় শুয়ে আছে। মায়া রুমের দরজা বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে রাহাতের দিকে তাকালো। লোকটার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? রাহাত মায়াকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো ভালো করে।
-হ্যালো ম্যাডাম? এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে এখানে এসে বসুন। একটু কথা বলি।
-আপনি শুয়ে পড়লেন কেন? খাওয়া হয়েছে গেছে না আপনার? এখন নিজের রুমে গিয়ে ঘুমান। অনেক রাত হয়েছে। আমারও ঘুম পাচ্ছে।
-তো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো?
-এসো মানে কি? আর আপনি যাবেন এখান থেকে?
-যেতে পারছি না ম্যাডাম সরি। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তোমার ঘুম না পেলে সারারাত আমাকে পাহারা দাও। এমনিতেই কয়েকদিন তো বেশ মনের সুখে ঘুমালে। আজ নাহয় রাত জেগে সেবা যত্ন করো। গুড নাইট।
-আরে! স্যার?
রাহাত আবার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ছে দেখে মায়া তাড়াতাড়ি রাহাতের মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো। রাহাতও এবারে মায়ার একটা হাত টেনে ধরে মায়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মায়ার কোলে মাথা রাখলো। মায়া চমকে সরার চেষ্টা করলেও রাহাত ততক্ষণে মায়ার হাত ধরে নিজের মাথায় রাখলো।
-সারাদিন জার্নি করে শরীরটা ভিষণ টায়ার্ড লাগছে গো মায়াবতী। একটু চুলগুলো টেনে দাও। আজকে একটু শান্তিতে ঘুমাই।
-আরে? স্যার আপনি এখানে শুয়ে পড়লেন কেন? ভাবি তো ফিরে আসবে একটু পরে। আর দিহান ভাইয়াও তো আপনাকে খুঁজতে আসবে।
-বড্ড বেশিই বকবক করো তুমি মায়াবতী। ঘুম পাচ্ছে তো। একটু হাত বুলিয়ে দাও না?
-আপনি প্লিজ নিজের রুমে যান। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি প্রমিস।
-ওকে। এসো তাহলে?
-আরে? কি করছেন?
-তুমি তো বললে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। তো তার জন্য তো রুমে যেতে হবে নাকি? ঘুমানোর আগে তোমার সাথে গল্প করি কিছুক্ষণ।
-হুম।
রাহাত মায়ার সাথে নিজের রুমে এসে আবার আগের মতো মায়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এবারে মায়া রাহাতের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের মনেই ভাবতে লাগলো। এই লোকটার সাথে তো মায়া রাগ করে আছে। তবু কেন রাগটা দেখাতে পারছে না? এভাবে নিজেই হার মেনে নিলে লোকটা তো আরো মাথায় চেপে বসবে? আবার হয়তো দূরে ঠেলে দিবে। তখন মায়া কি করে নিজেকে সামলাবে?
-মায়া? মিহান তোমার কেমন কাজিন? আই মিন--।
-মিহান ভাইয়া এতো বড় একজন বিজনেসম্যান আর আমি নিজের আর মায়ের ভরণপোষণের জন্য সামান্য একটা জব করি। মানে জব করতাম আপনার অফিসে। তাই জিজ্ঞেস করছেন তো?
-আসলে সেরকম কিছু না মায়া। আমি জাস্ট জানতে চাইছিলাম ও তোমার কেমন রিলেটিভ। ওর সম্পর্কে কখনো তো বলো নি।
-মিহান ভাইয়ার বাবা আমার বাবার আপন ছোটো ভাই। দাদু বাবা চাচ্চু দুজনকেই তার যতটুকু সামর্থ্য ছিল পড়িয়েছেন। দাদুর স্বপ্ন ছিল বাবাকে মাস্টার বানাবেন, আর চাচ্চুকে ডাক্তার। তো বাবা আমাদের শহরেরই একটা কলেজ থেকে পাশ করে এলাকার একটা স্কুলে মাস্টারি শুরু করে। আর চাচ্চু নিজের পড়ালেখা করতে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে উনি ডাক্তারি পড়তে ভর্তি না হয়ে একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। দাদু সেটা নিয়ে রাগ করে চাচ্চুর সাথে কথা বলাই ছেড়ে দেন। পাঁচ ছয় বছর পরে চাচ্চু চাচীকে আর মিহান ভাইয়াকে নিয়ে নাকি দেশে গেলে দাদু তাদেরকে মেনে নেন নি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাদু চাচ্চুকে মাফ করেন নি। আর বাবাও দাদুর মৃত্যুর পর চাচ্চুকে মেনে নিলেও দুই ভাইয়ের সম্পর্কটাও তেমন ভালো হয়নি কখনো। চাচ্চু নিজের আর উনার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের চেষ্টায় একটা ব্যবসা শুরু করেন। আর বাবা পড়ে রইলেন গ্রামের স্কুলটা নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে বাবা গ্রামের একমাত্র স্কুলের হেডমাস্টার হন, আর চাচ্চু সফল ব্যবসায়ী। চাচ্চুর সাথে যোগাযোগ থাকলেও বাবা কখনো নিজের বাবার আদর্শ থেকে সরে শহরে আসতে রাজি হন নি। তাই বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদেরকে জোর করলেও আমরাও চাচ্চুর সাথে না থেকে নিজেদের মতো করে এই ব্যস্ত শহরে টিকে থাকার চেষ্টা করছি।
মায়া অন্যমনস্ক হয়ে কথাগুলো বলতে বলতে রাহাতের কোনো রেসপন্স না পেয়ে রাহাতের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো মায়া। লোকটা ঘুমে একেবারে কাদা হয়ে গেছে এতোক্ষণে। মায়া একটু সাবধানে রাহাতের মাথাটা বালিশে রেখে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলো। ধীর পায়ে রাহাতের রুমের দরজার লক খুলে হালকা করে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে নিজের রুমে এলো মায়া। কানেক্টিং ডোরটা আটকে দিয়ে এসে এবারে নিজেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো মায়া। চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম এসে জমা হয়েছে মায়ার। আর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে একটা তৃপ্তির হাসি।
৩৬!!
মাঝখানে আরো একটা দিন কেটে গেছে। গতকাল দিয়া মিহানের মেহেন্দি অনুষ্ঠানে রাহাত প্রায় পুরোটা সময় মায়ার পিছে পিছেই ঘুরেছে। মায়াও দু হাত ভর্তি করে মেহেদি পড়েছে। আর রাহাত মায়ার কখন কি লাগবে সেটা নিয়েই মেতে ছিল পুরোটা সন্ধ্যে। মায়ার হাতের মেহেদীটা শুকিয়ে টকটকে লাল রঙ আসার পরও রাহাত মায়াকে নিজের হাতে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়েছে। মুখে ভালোবাসি বলা না বললেও রাহাত প্রতিটা মূহুর্তে নিজের কেয়ার দিয়ে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই মায়া আজকের দিয়া মিহানের সংগীতের অনুষ্ঠানে রাহাত কি করে সেটাই দেখার চেষ্টা করছে৷ বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে অনুষ্ঠানটা শুরু হওয়ার। নীল দিগন্তে রিসোর্টের কটেজগুলোর খোলা মাঠে প্যান্ডেলের মতো সাজিয়ে গোল করে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে আজকে। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে আজকের সংগীতের অনুষ্ঠানের। মুখোমুখি হয়ে বসায় একটু পর পরই রাহাত আর মায়ার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। আর ব্যাপারটায় মায়া কিছুটা লজ্জা পেলেও রাহাত যে ভিষণ মজাই পাচ্ছে সেটা ওর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
হঠাৎ করে সবার হাত তালির শব্দে মায়া চমকে তাকিয়ে দেখলো পয়েন্টার বোতলটা এবারে মায়ার দিকে ঘুরে আছে। মিহান এবারে মুখে দুটো আঙ্গুল দিয়ে সিটির মতো করে বাজালো। মায়া ভ্রু কুঁচকে মিহানের দিকে তাকালো।
-কি?
-বহুদিন পর তোকে বাগে পেয়েছি রে মায়া৷ এবারে তোর কোকিল কন্ঠের একটা গান শুনিয়ে সবাইকে ধন্য কর। তাড়াতাড়ি স্টার্ট।
-ধুর। গান টান গাইতে পারবো না।
-গান ন গাইতে পারলে সবার সামনে 'কালা চশমা' গানে নেচে দেখাতে হবে। ওপশন দুটোই আছে কিন্তু।
-মানে কি! জোর জবরদস্তি নাকি?
-যা ভাবিস তাই। তাড়াতাড়ি শুরু কর। গানে গানে মনের কথা বলে ফেললেও আজকে আমরা কেউ মাইন্ড করবো না কিন্তু।
-মিহান ভাইয়া?
-ইওর টাইম স্টার্ট নাউ ম্যাডাম। ১০ গোনার আগে গান না গাইলে কিন্তু 'কালা চশমা' শুরু হবে মায়ারাণী। ওকে? কাউন্টডাউন স্টার্ট হচ্ছে। ১০, ৯, ৮, ৭, ৬-----।
মায়া অসহায় ভঙ্গিতে একবার দিয়ার দিকে তাকাতেই দিয়াও ইশারা করলো মায়াকে গান শুরু করার জন্য। মায়া এবারে একটু হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে একবার রাহাতের দিকে তাকালো। তারপর মুখ নিচু করে নিজের মতো করে গান শুরু করলো।
-"বলনা একবার তুমি যে কে আমার
তুমিহীনা মন, কেন অকারণ করে অস্থির আচরণ
তোমাকে প্রয়োজন, তুমিই জীবন করো বিশ্বাসে বিচরণ
পৃথিবী জানে, তুমি আমার প্রেম-সাধনা
জীবন থাকতে তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না
তুমিহীনা মন, কেন অকারণ করে অস্থির আচরণ
তোমাকে প্রয়োজন, তুমিই জীবন করো বিশ্বাসে বিচরণ
চোখের সামনে তোমাকে ছাড়া কাউকে খুজি না,
যেখানে থাকো, কাছে দূরের বাধা মানি না
তুমিহীনা মন, কেন অকারণ করে অস্থির আচরণ
তোমাকে প্রয়োজন, তুমিই জীবন করো বিশ্বাসে বিচরণ
বলনা একবার তুমি যে কে আমার"
মায়ার গান শেষ হতেই সবাই মিলে হাততালি দেয়া শুরু করেছে। আর বেচারি লজ্জায় আর মুখ তুলে তাকাতেই পারলো না। মায়ার পরে আরো দুজন গান গাওয়ার পর এবারে পয়েন্টার রাহাতের দিকে ঘুরলো। রাহাতকে অবশ্য মায়ার মতো এতো সাধাসাধি করতে হলো না। গান রাহাতের ভাবাই ছিল। সাথে মায়ার প্রশ্নের উত্তরও। পাশে একজন গিটারে টুংটাং সুর তুলছিল দেখে রাহাত তার কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য গিটারটা নিয়ে নিজেই সুর তুললো গিটারে। সোজাসুজি মায়ার দিকে তাকিয়ে গানের কথাগুলো সুর হয়ে বেরিয়ে এলো রাহাতের কন্ঠ দিয়ে।
-"তুমি, ভাবনায় ডুবে থাকা
দূর আকাশের নীলিমায়।
তুমি,হৃদয়ে লুকোনো প্রেম,
মিশে থাকা গভীর মুগ্ধতায়।
তুমি এলে - মন ছুঁলে
অন্যরকম হয়ে যাই।
ইচ্ছে গুলো - জড়োসড়ো,
ভালোবাসি বলে তাই।
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি !
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি !
চিলেকোঠায় ইচ্ছে গুলো
নেইতো কোনো দাড়িকমা।
বুক পকেটে,তোমার জন্য,
রেখেছি , ভালোবাসা জমা।
শিশির রোদের লুকোচুরি,
তোমার হাসি ফোটা বকুল।
ছোঁয়া পেলে স্বপ্ন হাজার,
আনমনে হয়ে যাই ব্যাকুল।
তুমি এলে - মন ছুঁলে
অন্যরকম হয়ে যাই।
ইচ্ছে গুলো - জড়োসড়ো,
ভালোবাসি বলে তাই।
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি !
আমার আমি বলতে তোমায় জানি!
ঐ আকাশ জানে তুমি আমার কতোখানি ! "
রাহাতের গানটা শেষ হতেই মায়া মুখ তুলে তাকাতেই আবার দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। রাহাতের ঠোঁটের কোণে ফুটে থাকা অদ্ভুত হাসিটা দেখে মায়া আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না রাহাতের দিকে। ততক্ষণে আবার সবাই হাত তালি দিয়ে সংগীতের অনুষ্ঠানটা আগে বাড়িয়েছে। মায়া দিয়াকে কিছু একটা বলে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে রাহাতও গিটারটা ফেরত দিয়ে রিসোর্টের দিকে পা বাড়িয়েছে। মায়াকে নিজের মনের কথা জানানোর এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রাহাত উদয়াচল কটেজের সামনে আসতেই হঠাৎ হাতে টান খেয়ে দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে ফিরলো।
-দিহান? কি রে? তুই কোথায় থাকিস বল তো সারাদিন? তোকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না আজকাল। কাহিনী কি?
-শালা! আমার কাহিনী কি নাকি তোর কাহিনী কি? বন্ধুর বিয়ের চক্করে আপনার মায়াবতীকে ভুলে বসে আছেন আপনি? হ্যাটস অব টু ইউ ইয়ার! হ্যাটস অব!
-মানে! কি বলছিস এসব?
-নয়তো কি? আমি গত দুদিন ধরে কামলার মতো তোর মায়াকে হন্যে হয়ে খুঁজে মরছি, আর তুই কিনা এখানে মিহানের বিয়েতে সবাইকে গিটার বাজিয়ে আর গান শুনিয়ে ইন্টারটেইন করছিস! মায়াকে খোঁজার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তোর আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
-আরে! দিহান? কিন্তু মায়াকে তো----।
-হ্যাঁ সেটাই। মায়াকে খোঁজার জন্য তো এই দিহানটা আছেই। তুই তো মিস্টার মাহবুব চৌধুরী। তুই কেন এই সেন্টমার্টিনে এসে মায়াকে খুঁজতে রিসোর্টে রিসোর্টে ঘুরবি তাই না?
-দিহান! কিসব বলছিস? আমার কথাটা তো শোন ভাই?
-না ভাই। তুই আমার কথা শোন। তুই হয়তো বিশ্বাসই করিস নি যে মায়া সেন্টমার্টিনে এসেছে, তাই না? তাই তো মায়াকে খোঁজার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই তোর। তাই তো আসতেও চাইছিলি না তুই? রাইট? এবারে তাহলে ব্লু মেরিন রিসোর্টে গিয়ে নিজে দেখে আয়। তোর মায়াবতীকে খুঁজে বের করেছি। এবারে তুই ওর সাথে কিভাবে ডিল করবি সেটা তুই নিজেই সামলা।
রাহাত কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে দিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়া তো নীল দিগন্তে রিসোর্টেই আছে। তাহলে দিহান কাকে খুঁজে বের করলো? আর কিসব উল্টাপাল্টা বকছে ছেলেটা! দিহান অবশ্য রাহাতকে পাত্তা না দিয়ে আশেপাশে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। রাহাত এবারে দিহানের কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালো।
-দিহান তুই কিসব বলছিস আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু ক্লিয়ার করে বলবি প্লিজ? আর মায়া তো?
-দেখ ভাই। তোর মায়াবতী না কে তাকে আমি দেখি নি আগে। দেখলে ওকে অবশ্যই তোর কাছে ধরে নিয়ে আসতাম। তাই ওর সাথে বাকি কি কথা বলবি সেটা তোকে নিজেই গিয়ে বলতে হবে। বন্ধুর বিয়েতে এসে এভাবে প্রোগ্রামগুলোয় মিসিং থাকলে কেমন দেখায় বল?
-কিন্তু মায়া-----।
-ভাই আমি তোর জন্য ভ্যানের ব্যবস্থাও করে ফেলেছি। এই ১০ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। ভ্যানে চেপে সহজেই ব্লু মেরিনে পৌঁছে যেতে পারবি----।
-তুই এভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে কি খুঁজছিস বল তো? আমার দিকে তাকা? কি হয়েছে তোর?
-আমার কি হবে? খুঁজছি মায়াকে। তুই মায়াকে কোথাও দেখেছিস?
-কি?
-আরে মিহানের কাজিন। মায়া। ওকে দেখেছিস কোথাও? মিহান তো বললো এদিকেই এসেছে। তুই দেখিস নি না?
-ওকে খুঁজছিস কেন?
-খুঁজছি কেন? উমমমম। একচুয়েলি কথাটা মায়াকে বলার আগে তোকে বলা ঠিক হবে কিনা--। বুঝতে পারছি না।
-ভনিতা না করে বলে ফেল তো দিহান। কোনো কাজ আছে মায়ার সাথে?
-ভাবছি আজই মায়াকে প্রপোজ করবো।
-হোয়াট?
-আরে! এতো অবাক হলি কেন? সবাই বিয়ে করে ফেলছে। এই দেখ মিহানের কাল বিয়ে, তুইও তোর মায়াবতীকে পেয়ে যাবি আজকে। তাই ভাবলাম মায়াকে প্রপোজটা করেই ফেলি। মেয়েটা ভালোই। দেখতেও যেমন সুন্দর, তেমনি কথাবার্তা, কাজকর্ম, আচার আচরণ সবই ভালো। আরো কয়েক বছর আগে হলে প্রেম ট্রেম করা যেত, এখন আর প্রেমের প্যারায় যেতে চাচ্ছি না। সোজা বিয়ে, তারপর নাহয় চুটিয়ে প্রেম করবো। মায়ার মতো এমন লক্ষী মিষ্টি একটা মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়া নেহায়েতই ভাগ্যের ব্যাপার। কি বলিস?
-হ্যাঁ?
-আরে রাহাত! কি ভাবতে বসলি তুই? শুনছিস কিছু? দেখেছিস ওকে কোথাও?
রাহাত থতমত খেয়ে দিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বলবে বেচারা কিছুই বুঝতে পারছে না। দিহানের ঠোঁটের কোণে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে আছে আজ। হাসিটার মানেটা রাহাত ধরতে পারছে না। ছেলেটাকে দেখে বেশ খুশিই মনে হচ্ছে রাহাতের। তাই নিজের কথাগুলো রাহাতের গলাতেই যেন আটকে গেল। রাহাত কিছু বলার আগে দিহান আবার বলা শুরু করলো রাহাতের দিকে তাকিয়ে।
-তবে জানিস তোর মায়াবতীকে খুঁজতে এসে রিসোর্টেই মায়াকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। বেশ ক বছর আগে একবারই তো মাত্র দেখেছিলাম। তবু চিনতে অসুবিধা হয়নি। ঠিক আগের মতোই আছে মেয়েটা এখনো। শান্ত, চুপচাপ, হাসিখুশি। তবে এবারে ওকে দেখে ক্রাশ খেয়েছি বলতে পারিস। তোর মায়াবতীর কথাটা মনে আসতেই একটু ভয়ও পেয়েছিলাম অবশ্য। ভাবলাম এই বুঝি ক্রাশ খাওয়ার দু মিনিটের মধ্যে আবার তিন নাম্বার ছ্যাঁকাটাও খাবো। যাক। শেষমেশ যে ছ্যাঁকা খেতে হয়নি সেটাই বা কম কিসের! ভাগ্যিস এই মায়াই তোর মায়াবতী নয়, নইলে হয়তো এবারে ডিপ্রেশনে চলে যেতাম সোজা। হা হা হা।
-দিহান? কি বলছিস?
-হ্যাঁ রে ভাই। খুব জোর বাঁচা বেঁচে গেছি। উফ! তুইও তোর মায়াবতীর সাথে প্যাঁচআপ করে ফেলিস ভাই। নইলে কে আবার তোর মায়াবতীকে নিয়ে পালায় বলা মুশকিল।
-কিন্তু দিহান? লিজা? ওকে তো তুই---।
-আর ধুর! বাদ দে তো ওই মেয়ের কথা। একটা মানুষের পিছে এতোদিন ঘুরঘুর করার পরও যদি পাত্তা না দেয় তাহলে আর কি করবো? সারাজীবন ওর জন্য বসে থাকবো নাকি? এমনিতেই মা বিয়ে বিয়ে করে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে। এর চেয়ে মায়াকে প্রপোজট করে ফেলি। কেন জানি আমার মন বলছে মেয়েটা রাজি হবে।
------------------------------
-রাহাত? তোর ভ্যানটা আসার আগে আমাকে একটু হেল্প কর প্লিজ? আমি এদিকটা দেখি, তুই কটেজের ভিতরে দেখ মায়া আছে কি না।
-হুম----।
-আর শোন? প্রপোজের কথাটা কিন্তু ওকে বলিস না। সারপ্রাইজ দিতে চাই আমি ওকে। আচ্ছা খুঁজে পেলে আমাকে জানাস। আমি এদিকটায় আছি।
রাহাতকে কথাগুলো বলতে বলতে দিহান সংগীতের অনুষ্ঠানের প্যান্ডেলের দিকে চলে গেল। আর রাহাত! সে বেচারা থ হয়ে দিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো এবারে কি করবে। বন্ধু নাকি নিজের ভালোবাসা, কোনটাকে বেছে নিবে রাহাত? সময় এ কেমন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে রাহাতকে! যাকেই বাছুক না কেন প্রিয় দুজন মানুষের একজন আঘাত পাবেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উদয়াচল কটেজের ভিতরের দিকে এগিয়ে চললো রাহাত। প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সিদ্ধান্ত নেয়া যেন আরো দুষ্কর মনে হচ্ছে ওর। কি হবে কে জানে!