৩১!!
"তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের ভীড়ে
ছিলনা কিছু ঠাই দুচোখের নীড়ে
স্বপ্নগুলোকে হঠাৎ কেড়ে যে নিলে
আমাকে যে আধাঁর পথে ঠেলে দিলে।"
হাতে ছোট্টো একটা চিরকুট নিয়ে থ হয়ে একটা সোফায় বসে আছে রাহাত। রাহাতের পাংশু মুখের দিকে কিছুটা অবাকই হয়েছে দিহান। আধ ঘন্টা আগের ঘটনাটা মনে হতেই হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসতে চাইছে দিহানের। ঠিক সময় গাড়িটা ব্রেক করতে না পারলে কি যে হতো তখন! কিন্তু রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস হচ্ছে না দিহানের। আর কিছু না ভেবে রাহাতের পাশে বসে কাঁধে হালকা করে ঝাঁকিয়ে রাহাতের ঘোর কাটানোর চেষ্টা করলো দিহান। রাহাত চিরকুটটা থেকে চোখ সরিয়ে এবারে সোজা দিহানের দিকে তাকালো। দিহানের কেন জানি মনে হচ্ছে রাহাত ওর দিকে তাকিয়েছে ঠিকই কিন্তু যেন দিহানকে দেখতেই পাচ্ছে না ছেলেটা। সামনের দিকে তাকিয়েও যেন দূরে কোথাও অন্য কারো খোঁজ করছে ছেলেটার চোখ জোড়া। দিহান এবারে আবার রাহাতের কাঁধ চেপে ঝাঁকি দিলো। এবারে রাহাত একটু কেঁপে উঠে দিহানের দিকে চোখ পড়তেই কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়লো।
-আরে? দিহান? তুই কখন এলি? সরি রে আসলে একদমই খেয়াল করি নি আমি-----।
দিহান কয়েক মূহুর্ত রাহাতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। রাহাত কি মেন্টালি স্ট্রেসড? নাকি এর পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে? কিছুক্ষণ আগে বলতে গেলে ভাগ্যের জোরে বড়সড় একটা এক্সিডেন্টের হাত থেকে বেঁচে গেছে ছেলেটা। এখন দিহানের সাথে দিহানের বাসার ড্রইংরুমে বসে থেকে বলছে দিহান কখন এসেছে! এটা কি কোনো সুস্থ মানুষের লক্ষণ হতে পারে?
-আরে? চুপ করে আছিস কেন? কতদিন পর দেশে ফিরলি? মাথা থেকে তোর বৃষ্টিবিলাসীর ভূতটা নেমেছে তাহলে শেষমেশ? হা হা হা। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বিয়েটা সেরে নে এবারে বুঝলি?
-রাহাত? তোর কি হয়েছে? এমন পাগলামি করছিস কেন?
-পাগলামির কি করলাম আমি?
-পাগলামি নয়? তুই জানিস এই মূহুর্তে তুই কোথায় আছিস?
-কোথায় আর থাকবো? আমার বাসাতেই তো----? আরে! আমি তোর বাসায় কি করছি? আমি তো--। আমি তো মায়াদের ওখানে গেছিলাম? এখানে এলাম কি করে?
রাহাত দিহানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ড্রইংরুমে চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলো এটা দিহানের বাসা। কিন্তু ও তো মায়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। এখানে আসলো কি করে? দিহান রাহাতকে টেনে আবার সোফায় বসিয়ে দিতেই রাহাত দিহানের দিকে তাকালো।
-ইজ এভরিথিং অল রাইট রাহাত? তোকে এতোটা চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? আর কি নিয়ে এতো টেনশন করছিলি বল তো? আরেকটু হলেই তো আমার গাড়ির নিচে পড়তি তুই। আমি সময় মতো আজকে গাড়ির ব্রেক কষতে না পারলে কি হয়ে যেত ভাবতে পারছিস?
-আমার মায়াবতীকে হারিয়ে ফেলেছিরে ভাই। ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
-এই মায়াবতীটা আবার কে? ওয়েট এ মিনিট? তোর পি.এ ছিল যে সেই মেয়েটার কথা বলছিস নাকি? মায়া না কি যেন নাম?
-হ্যাঁ রে ভাই। আমার মায়াবতী। রাগ করে চলে গেছে। অনেক দূরে। ওকে কোথায় খুঁজবো আমি এখন? এইজন্যই স্মৃতি হয়তো বারবার বলছিলো ওকে আটকাও। হারিয়ে যাওয়ার আগে আটকাও। আমি কেন স্মৃতির কথাটা মেনে রাতেই মায়াকে একবার কল করে সরি বললাম না। এখন তো ওর নাম্বারটাও অফ শো করছে---। শিট!
-আমি বুঝতে পারছি না। আঙ্কেলের কাছে তো শুনলাম স্মৃতি নাকি মারা গেছে। আর মায়ার গায়ে হলুদে কিছু একটা প্রবলেম হয়েছিল। এখানে মায়া স্মৃতি কি গোলমাল করছিস আবার তুই?
-আজ স্মৃতির কবর জিয়ারত করে দুপুরের দিকে মায়াদের বাসায় গিয়ে দেখি ওদের বাসায় তালা ঝুলছে। আর এই নোটটা জানালার কবাটে দিয়ে চাপা দেয়া ছিল। ওদের প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলেও কোনো লাভ হয়নি। কেউ জানে না মায়া ওর মাকে নিয়ে কোথায় চলে গেছে। দ্বীপ যার সাথে মায়ার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ওই লোকটাকে কাল পুলিশে দিয়েছে মেয়েটা। সেটা নিয়ে এলাকার লোকজন অনেক কথা বলেছে নাকি। মায়া নাকি তাই ওর মাকে নিয়ে সকালেই বাড়িতে তালা দিয়ে চলে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না কিছু। আমার কাছে শুধু এই চিরকুটটাই পড়ে রয়েছে ওর।
রাহাত এগিয়ে দেয়া চিরকুটটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে কিছুক্ষণ দেখলো দিহান। ছোট্ট একটা কাগজের দুইপাশেই চারটে করে লাইন লেখা। এক পাশের লাইনগুলো পড়ে অন্য দিকটা উল্টে চারটা লাইনও বিড়বিড় করে পড়লো দিহান।
"নিজের মতো ভাল থেকো,
ছেড়ে দিলাম পিছুটান।
বাঁচবো না হয় সারাজীবন,
নিয়ে প্রিয় অভিমান।"
-কোথায় যেতে পারে বলে মনে হয় তোর? ওর কোনো রিলেটিভস বা ফ্রেন্ড এমন কারো সম্পর্কে জানিস কিছু?
-আমি কিচ্ছু জানি না দিহান। আই জাস্ট ওয়ান্ট হার এট এনি কস্ট।
-ভালোবাসিস নাকি মেয়েটাকে?
এতোক্ষণ পাগলের মতো ছটফট করলেও এবারে দিহানের প্রশ্নটা শুনে চুপ করে গেল রাহাত। এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে ও? আসলেই কি ও মায়াবতীটাকে ভালোবাসে? ভালোবাসতে শুরু করেছে? নাকি ভালোবাসতে চায় বলে পাগলের মতো খুঁজছে? নাকি নিজের অপরাধবোধ থেকে মায়ার জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়ার তাড়নায় এমন করছে? কোনো প্রশ্নেরই স্পষ্ট কোনো উত্তর জানা নেই রাহাতের। ভালোবাসুক বা না বাসুক মায়াকে ওর প্রয়োজন। বড্ড বেশিই প্রয়োজন। দিহানও রাহাতের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। রাহাতের কাঁধে হাত রেখে রাহাতকে নিজের দিকে ফিরালো দিহান।
-তা ভালোবাসিস কিনা সেটা আগে শিওর হয়ে নে। আর আমাকে দুইটা দিন সময় দে। আমি দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
-কিন্তু মেয়েটা একা ওর মাকে নিয়ে কোথায় যেতে পারে--। কোনো বিপদ হলে----?
-আরে ভাই! এতো টেনশন করিস না। এমনিতেই আরেকটু হলে আজকে আর টেনশন করার অবস্থাতেই তো থাকতি না। মাঝখান থেকে আমি বেচারা ফেঁসে যেতাম। এখনও বিয়েটাই করতে পারলাম না। আর তুই ব্যাটা আমাকে খুনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতে চাইছিস?
-আরে ভাই! মায়াকে কোথায় খুঁজবো সেই টেনশনে কি করেছি সেটাও খেয়াল নেই। আমার গাড়িটাও হয়তো মায়াদের গলির সামনেই রয়ে গেছে।
-আরে না না। গাড়ি নিয়ে ভাবিস না। আমি তো আর তোর এই দেবদাস দশার খবর জানতাম না দোস্ত। কিন্তু একটু আক্কেল খরচ করে তোকে নিজের গাড়িতে করেই বাসায় নিয়ে চলে এসেছি। আর আঙ্কেলকে বলে দিয়েছিলাম তোর গাড়ির লোকেশনটা। আঙ্কেল এতোক্ষণে হয়তো ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছে গাড়ি আনার জন্য।
-ওহ!
-তা কি খাবি বল। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস বলে।
-আরে না না। কিছু খাবো না এখন। মায়াকে খুঁজতে বের হবো-----।
-ভাইরে ভাই! এতো বড় শহরে তুই তোর মায়াবতীকে খুঁজে পাবি বলে মনে করছিস? আর এমনও তো হতে পারে ও ঢাকাতেও নেই। তখন তো পুরো শহরে চিরুনি অভিযান চালিয়েও কোনো লাভ হবে না।
--------------------------
-দেখ ভাই? প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। যাচ্ছিলাম অফিসে। সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছে বলে না খেয়েই বেরিয়েছিলাম। খাওয়ার সময়ই পাই নি। প্লিজ? ব্রেকফাস্টে জয়েন করে আমাকেও কিছু খাওয়ার সুযোগ করে দিন স্যার প্লিজ?
-আরে! দিহান! তুই খেয়ে না যা। আমার খিদে নেই একদমই। সত্যি বলছি ইয়ার।
-ভাই! তুই না খেয়ে উপোস করলেই কি মায়া ফিরে আসবে? এরচেয়ে খেয়ে দেয়ে একটু এনার্জি স্টোর কর। তোর মায়াবতীকে খুঁজতে কোন কোন দুনিয়ায় যেতে হয় কে জানে!
-এভাবে ছেলেমানুষি করিস না দিহান। আই কান্ট লুজ হার দিহান। স্মৃতিকে হারিয়েছি। মায়াকে হারাতে পারবো না এবারে।
-রিলাক্স ব্রো। দুই দিনের মধ্যে তোর মায়াবতীকে দায়িত্ব আমি নিলাম। এখন প্লিজ একটু খাওয়ার সময় দে মেরি ভাই! না খেয়ে কাজ করলে মন পেটের চারদিকেই ঘুরঘুর করবে। তাহলে কিন্তু সময় আরো বেশি লাগবে----।
-ড্রামাবাজ একটা! চল? আন্টির চাওমিনের ঘ্রাণটা এখান থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। আমারও খিদে পেয়ে গেল।
দুই বন্ধুতে মিলে ডাইনিং টেবিলে একসাথে বসে নাস্তা করছে। দিহানের মা রাহাত আর দিহান দুজনকেই নাস্তা পরিবেশন করছেন আর এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন পাশে দাঁড়িয়ে। অনেকদিন পর ছেলে দুটোকে একসাথে বসে আয়েশ করে খেতে দেখে ভালো লাগছে উনার কাছেও।
-আমাদেরকে তো একেবারে ভুলেই গেছিস রাহাত। দিহান বিদেশে যাওয়ার পর আজ প্রথমবার এই বাড়িতে আসার সময় পেলি তাহলে? তোরা দুজনেই এমন করবি আমি ভাবতেও পারি নি। অন্তত তোর কাছে এমনটা তো আশাই করি নি আমি রাহাত।
-আন্টি--। ভুল হয়ে গেছে গো। এবার থেকে প্রায়ই আসবো দেখো। তখন কিন্তু রান্না করতে করতে বিরক্ত হতে পারবে না বলে দিলাম।
-তোরা কেমন আর খাস যে রাঁধতে গিয়ে বিরক্ত হতে হবে? শোন? তুই কিন্তু আজকে যেতে পারবি না। আমি রান্না চাপিয়েছি। দুপুরে খাবি, রাতে সবাই মিলে খেয়ে দেয়ে জমিয়ে আড্ডা দিবো সবাই মিলে----।
-আন্টি? আজকে না প্লিজ?
-আমি রান্না বসিয়ে দিয়েছি। আর কোনো কথা শুনছি না। আমি রান্নাঘরে গেলাম। কিছু লাগলে ডাকিস।
-আরে!
-আর হ্যাঁ। তোমার বন্ধুটিকে একটু বোঝাও তো। হয় নিজে মেয়ে পছন্দ করুক, নয়তো আমাদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করুক। একা একা এতো রাজ্যের কাজ আমি করতে পারবো না আর। এতো বড় দামড়া ছেলে ঘরে আইবুড়ো হয়ে বসে থাকবে, আর মা কিনা চাকরানির মতো কাজ করবে? সেসব আর হচ্ছে না। আর আগেরবারের মতো জেদ দেখিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিতে বলো। নইলে কিন্তু এবারে জোর করেই বিয়ে দিবো বলে দিলাম।
দিহানের মা একটা খুন্তি হাতে নিয়ে রাহাত আর দিহান দুজনকেই শাসিয়ে দিয়ে নিজের কাজ করতে চলে গেল। রাহাত আর দিহান নিজেরা দু মিনিট ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে নিজেরাই হো হো করে হেসে ফেললো। লাঞ্চ না করে যো কোনোভাবেই এখান থেকে বের হতে পারবে না সেটাও বেশ বুঝতে পারছে রাহাত। এদিকে মায়ার চিন্তাটাও মাথায় চেপে বসছে রাহাতের। মেয়েটা হুট করে কোথায় গেল, কোনো বিপদে পড়েছে কিনা এসব চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রাহাতের। আর এদিকে দিহান ভাবছে মায়ের বলা কথাগুলো। আগেরবার তো বিদেশে ব্যবসার নাম করে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছিল। কিন্তু এবারে কি করবে? লিজা কি সময় থাকতে নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে পারবে? নাকি ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে?
৩২!!
রাতে কখন ঘুমিয়েছে রাহাত নিজেও জানে না। যতক্ষণ জেগে ছিল কয়েক মিনিট পর পর মায়ার নাম্বারে লাগাতার কল করেই গেছে রাহাত। দুটো দিন পেরিয়ে গেছে এর মধ্যেই। অথচ মায়ার কোনো হদিশই দিতে পারে নি কেউ। এমন কি দিহানও না। মায়াকে খুঁজে না পেয়ে নিজেকে বেশ অসহায় লাগছে রাহাতের কাছে। কেন সে আগেই মায়াকে আটকালো না? অবশ্য হারিয়ে ফেলার পর আফসোস করার কোনো মূল্য যে নেই সেটাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রাহাত। এসব ভাবতে ভাবতে বেশ রাত হয়ে গেছে গতকাল। আজ খুব ভোরে মায়াকে কোথায় কোথায় খুঁজবে সেটার প্রায় সব প্ল্যানিংই করে ফেলেছে রাহাত। মায়াকে ও একাই খুঁজে বের করবে। কারো সাহায্যেরই দরকার নেই রাহাতের। অবশ্য এতো বিশাল বিশাল প্ল্যানিং করেও সকালে দু চোখ থেকে ঘুমের রেশটাই কাটাতে পারছে না বেচারা। গত কয়টা রাত প্রায় নির্ঘুম কেটেছে রাহাতের। তার উপরে গতকালও ঠিক মতো ঘুমায় নি। এখন তাই কানের কাছে মোবাইলটা সশব্দে বাজছে শুনেও দুহাতে কান চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে রাহাতের। কিন্তু এতো সকালে কে কল করবে ভাবতেই প্রথম যে কথাটা রাহাতের মাথায় এলো সেটা হলো মায়া কল করেছে। কথাটা মনে পড়তেই রাহাত পড়িমরি করে উঠে বসে কলটা রিসিভ করে মোবাইলটা কানের কাছে ধরলো।
-হ্যালো? মায়া? মায়াবতী? কোথায় তুমি? তোমার ফোনটা সুইচড অফ ছিল কেন? তুমি ঠিক আছো? মা ঠিক আছে তো? কি হলো কথা বলছ না কেন? প্লিজ টক টু মি-----।
-রাহাত? আমম। আমি দিহান।
-দিহান?
দিহানের কণ্ঠ শুনে রাহাত কিছুটা হতাশ হলেও ততক্ষণে চোখের ঘুমটা কেটে গেছে রাহাতের। মনের কোণে একটা ছোট্ট আশা আবার উঁকি দিতে শুরু করেছে রাহাতের। এবারে যদি কোনো খবর পায় তার মায়াবতীর। মায়ার কোনো খোঁজ পেয়েছে কি না প্রশ্নটা করতে গিয়ে গলা দিয়ে একটা শব্দও যেন বের হচ্ছে না রাহাতের। এই অনুভূতিটার সাথে রাহাত বেশ ভালোই পরিচিত। হারানোর ব্যথাটার সাথে নতুন পরিচয় নয় রাহাতের। তাই নতুন করে আরেকবার 'না' শব্দটা শোনার সাহস হয়তো রাহাতের নেই এবারে। তাই কানে মোবাইলটা চেপে ধরে চুপ করে থাকা আর কিছুই যেন করতে পারছে না রাহাত।
-রাহাত? লাইনে আছিস? আমাদের এক্ষুণি রওনা দিতে হবে। আশা করি হাফ এন আওয়ারের মধ্যে বের হতে পারবো---।
-দিহান? কোথায় রওনা দিবো? তুই মায়ার কোনো খোঁজ পেয়েছিস? ও কোথায় গেছে জানতে পেরেছিস কিছু?
-এতো কথা বলার এখন সময় নেই রাহাত। তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ প্যাক করে নে। আমি ঠিক আটটার সময় তোকে বাসা থেকে পিক করে নিবো। বাকিটা নাহয় যাওয়ার পথেই শুনিস। আমার নিজেরও প্যাকিং করা বাকি এখনো।
-কোথায় যাবো সেটা অন্তত বল?
-আপাতত টেকনাফে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ওঠ। আমি রাখছি। বায়।
-দিহান? টেকনাফে কেন?
দিহান অবশ্য রাহাতের বাকি কথাগুলো শোনার অপেক্ষা না করেই কলটা কেটে দিয়েছে। রাহাত মোবাইলটা হাতে নিয়েই অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। ঘড়িতে সময় এখন সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিট। এতো সকালে টেকনাফে যেতে হবে কেন? মায়াও কি টেকনাফেই আছে? প্রশ্নটার উত্তরের অপেক্ষা না করেই এক লাফে বিছানা ছাড়লো রাহাত। মায়াকে খুঁজে পাওয়ার যে ক্ষীণ সম্ভবনাটা দেখতে পেয়েছে সেটা কিছুতেই হারাতে চায় না রাহাত। দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে শাওয়ার সেরে নিলো রাহাত। তারপর নেভি ব্লু জিনসের সাথে প্রিয় ধবধবে সাদা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে স্লিভসটা ভাঁজ করে নিলো কনুই পর্যন্ত। কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলোকে সেট করে নিজেকে আয়নায় এক নজর দেখে নিয়ে প্যাকিং করার চেষ্টা করলো রাহাত। হাতের কাছে যা ই পেল কোনোরকমে লাগেজে ঢুকিয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হলো রাহাত।
ঘড়ির কাঁটায় বরাবর আটটা বাজতেই দিহান গাড়িতে বসে থেকেই হর্ন বাজালো পরপর দু বার। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাহাতও লাগেজ হাতে বেরিয়ে এলো বাড়ির ভেতর থেকে। দারোয়ান ইতস্তত করে লাগেজটা নেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু রাহাত তাকে গেইটটা খুলতে বলে নিজেই লাগেজ হাতে এগিয়ে গেল। গেইট খুলে দিতেই রাহাত তড়িঘড়ি করে লাগেজটা দিহানের গাড়ির পিছনের দিকে ফেলে দিহানের পাশের সিটে বসে পড়লো। আর দিহানও সাথে সাথেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। বাড়ির গেইটে আজীজ মাহবুব চৌধুরী, রহিম চাচা, নয়না সহ আরো কয়েকজন ওদের চলে যাওয়ার দিকে হাসিমুখে চেয়ে রইলো। এবারে রাহাত নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে মায়াবতীকে ফিরিয়ে আনবে এটাই সবার বিশ্বাস।
এদিকে গাড়িতে বসেও রাহাত দু দন্ড শান্তি পাচ্ছে না। বারবার দিহানকে বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আর দিহান বেচারাকে বিন্দুমাত্র পাত্তাই না দিয়ে ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে রাহাতের চেয়ে দিহানেরই টেকনাফে পৌঁছানোর তাড়া বেশি। এবারে রাহাত কিছুটা বিরক্ত হয়ে দিহানকে ধমকেই উঠলো। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকায় রীতিমতো রাগ উঠে যাচ্ছে রাহাতের।
-দিহান? চুপ করে আছিস কেন তুই? আমরা টেকনাফ কেন যাচ্ছি বলবি তো নাকি? মায়া কি টেকনাফে আছে? ওর কোনো রিলেটিভের বাসা কি ওখানে? তুই এড্রেস পেয়েছিস ওর? কোথায় আছে বল না প্লিজ?
-শালা টেকনাফ যাচ্ছি তোর বউকে আমি বিয়ে করবো বলে। চুপ করে থাক তো এখন। ঘন্টাখানেকের মধ্যে টাউন এরিয়া থেকে বের হতে না পারলে কি জ্যামে পড়বো সেই খেয়াল আছে তোর? তাহলে টেকনাফ পৌঁছাতে ১০ ঘন্টার বদলে আরো ২-৩ ঘন্টা বেশি লাগবে। এমনিতেই শালা সকাল থেকে খাওয়ার সময়টাও পেলাম না। চুপ করে বসে থাক। মাথা খারাপ করিস না আমার।
দিহানের ধমকটা শুনে এবারে রাহাতের মুখটা একটু ছোটো হয়ে গেল। দিহানও তো গত দুটো দিন ধরে হন্যে হয়ে মায়াকে খোঁজার কাজে ওকে সাহায্য করছে। দিহান গাড়ি চালাতে চালাতে একবার রাহাতের দিকে তাকালো। কোথাকার রাগ কোথায় ঝাড়ছে ও। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের বকা খেয়ে এসেছে বেচারা। আরো ঘন্টা দুয়েক পরে বাসা থেকে বের হলে খুব একটা আহামরি কিছু ক্ষতি হতো না যদিও। শুধু বাসা থেকে কোনোমতে পালিয়ে আসতেই এতো তড়িঘড়ি করে না খেয়েই বের হয়েছে দিহান। রাহাত বাইরের যানজটহীন রাস্তাটার দিকে তাকালো।
-সরি রে দিহান। তোকেও অনেক প্রেশার দিয়ে ফেলছি। আসলে কি বল তো প্রচন্ড ভয় হচ্ছে আমার। আর সেই ভয়টা থেকেই কিসব পাগলামি করছি। নিজেও প্যানিক করছি আর বাকিদেরকেও ব্যতিব্যস্ত করে তুলছি।
-আম সরি রাহাত। সকাল সকাল মায়ের রাগটা তোর উপরে ঝেড়ে ফেলছি। সরি রে।
-কেন রে? আবার কি হয়েছে? আন্টি কি আবার তোর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে নাকি? তো বিয়েটা করে ফেলছিস না কেন? নাকি এখনও সেই মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছিস?
দিহান চট করে একবার রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ড্রাইভিং এ মন দিলো।
-অপেক্ষা? ঠিকই বলেছিস। এই জীবনে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি ই বা করার আছে?
-সত্যিই অপেক্ষা করছিস কি? শুনলাম আমার পি.এর পিছনেও ঘুরঘুর করেছিস কয়দিন?
-তাতেও লাভ কি হলো? কপাল এতোটাই মন্দ যে এবারেও পাত্তা পেলাম না।
-তাহলে কি এবারে নতুন কাউকে খুঁজে নিবি নাকি?
দিহান একবার রাহাতের দিকে রাগী লুক দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই মিষ্টি করে হাসলো। রাহাত দিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
-এবারে এমন কাউকে খুঁজে নিবো যে তোর আর তোর পি. এ র হুঁশ উড়ে যাবে দেখিস। বিয়ে করলে নিজের পছন্দ করা মানুষটিকেই করবো দেখে নিস। কারো পছন্দ করে দেয়া মানুষকে নয়। আর জোর করে আমাকে বিয়ে করাবে এমন মানুষ দুনিয়াতে এখনও পয়দাই হয় নি। বুঝেছিস?
-বাহ! গুড ডিসিশান। তা ভাই আপনার মেজাজটা ঠান্ডা হলে দয়া করে বলবেন আমরা টেকনাফ কেন যাচ্ছি?
-বিয়ে এটেন্ড করতে।
-বিয়ে? কার?
-আমার এক বন্ধুর। পরিচয় আছে তো তোর সাথে। মিহান? তুই আয়ারল্যান্ডে চলে যাওয়ার পর ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়। মিট করিয়েছিলাম না তোর সাথে?
-ইয়াপ! তুই তোর বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছিস বুঝলাম। আমাকে এর মধ্যে টানছিস কেন? মায়াকে আমার খুঁজতে হবে দিহান---।
-তোর মায়াও সেখানেই আছে রাহাত। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। মিহানের বিয়ে আর মায়ার জন্য চিরুনি তল্লাশি। হা হা হা।
-মায়া টেকনাফে?
-আরে না রে ভাই। সেন্টমার্টিনে।
-হোয়াট? সেন্টমার্টিনে কি করছে? আর তুই ই বা এতো শিওর হয়ে কি করে বলছিস?
-আরে ওসব খোঁজ বের করা কোনো ব্যাপারই না এই দিহান শেখাওয়াতের জন্য৷ মায়ার প্রতিবেশীদের কাছ থেকেই খোঁজ নিয়েছি। সহজে মুখ খোলে নি, তাই একটু টেকনিক্যালি হেন্ডেল করতে হয়েছে ব্যাটাদের।
-কিন্তু সেন্টমার্টিনেই বা কোথায় খুঁজবো ওকে? আর ও হঠাৎ সেন্টমার্টিনে কেনইবা আসবে? তুই শিওর মায়ার নেইবাররা ঠিক বলছে?
-আগে যাই তারপর দেখা যাবে কি করা যায়। এমনিতেই আজকে দিনটা পৌঁছাতেই কেটে যাবে। মায়াকে খুঁজতে হলে কালকে থেকেই মাঠে নামতে হবে। কবে নাগাদ খুঁজে পাবো সেটাও-----। ততদিন মিহানের বিয়েটা ইন্জয় করাই যায়। আর কেন এসেছে সেটা ওকে খুঁজে পেলেই জানা যাবে।
-ওহ। তাও ঠিক।
-চল রাহাত। কোন রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা সাইড করে কিছু খেয়ে নেই। তুইও তো মনে হয় সকাল থেকে কিছুই খাস নি।
-ওকে।
দিহান একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করে রাহাতকে ভিতরে যেতে বললো। রাহাত রেস্টুরেন্টের ভিতরে চলে যেতেই দিহান কাউকে কল করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে কথা বলা শেষ করে নিজেও রেস্টুরেন্টের ভিতরে চলে গেল। খাওয়া শেষ করে দুজনে আবার টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কখনো দিহান আর কখনো রাহাত ড্রাইভ করে প্রায় বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে টেকনাফে এসে পৌঁছালো। নামারবাজার ব্রিজের কাছেই একটা গ্যারেজে গাড়িটা রাখার জন্য আগেই কথা বলে রেখেছিল দিহান। এখান থেকে আর গাড়িতে সামনে এগানো সম্ভব নয়। এর পরের রাস্তাটুকু ওদের ট্রলারে করেই যেতে হবে। জুলাই মাসের এই সময়টায় জাহাজে করে সেন্টমার্টিনে যাওয়া সম্ভব নয়। এই সময়টায় জাহাজ পাওয়া যায় না। তাই কিছুটা রিস্ক নিয়েই ট্রলারে করেই ওদের যেতে হবে।
তিন ঘন্টা বর্ষার উত্তাল সমুদ্র পার করে সেন্টমার্টিনের দ্বীপে এসে যখন নেমেছে ততক্ষণে ঘড়িতে প্রায় নয়টার কিছুটা বেশিই বাজে। সাগেরের বুকে জেগে থাকা দ্বীপে অন্ধকার নেমেছে অনেক আগেই। তীরে ছোটো ছোটো জটলা করে টুরিস্টরা আড্ডায় মেতে আছে। ছোট এই দ্বীপটার এতো ভিড়ের মধ্যে মায়াকে কোথায় খুঁজবে এখন রাহাত? ভ্যানে করে এবারে দক্ষিণ বীচের দিকে নীল দিগন্তে রিসোর্টের দিকে যাত্রা করেছে রাহাত আর দিহান। জেটি থেকে বেশ খানিকটা দূরে রিসোর্টটা। ভ্যানে করে পৌঁছাতেও বেশ খানিকটা সময় লাগবে। এদিকে প্রায় ১৩/১৪ ঘন্টা জার্নির পর ওদের দুজনেরই শরীর নেতিয়ে পড়েছে কিছুটা। তবু এই প্রবাল দ্বীপের স্নিগ্ধ বাতাস যেন নতুন উদ্দম তৈরি করে দিচ্ছে দুজনের মনে। এই উদ্দমটাই হয়তো নতুন কোনো পথের দিশা দেখাতে চলেছে ওদেরকে।