উমা - পর্ব ০৮ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


খুজতে খুজতে পুরানো কাঠের আলমারির ভাঙ্গা ড্র্যারে এক গুচ্ছ কাগজ পেলো শাশ্বত। উপরে লেখা, “কমলাপট ব্রীজ”। গ্রামের দক্ষিনের নদীর নাম কমলাপট। শাশ্বতের বুকে সূক্ষ্ণ আশার ডহেঊ উঠলো। যেই কাগজ টা নিতে যাবে অমনি দরজা খোলার ধ্বনি কানে এলো। আকস্মিক ঘটনায় বুকটা ধক করে উঠলো শাশ্বতের। শিরদাঁড়ায় কাঁটা দিলো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। শুকনো ঢোক গিলে পিছনে তাকাতে দেখে চা হাতে উমা দাঁড়িয়ে আছে, তার অপলক তীর্যক সরু দৃষ্টি শাশ্বতকেই দেখছে। উমাকে দেখে ভয়ার্ত হৃদয়ের কম্পন ধীর হতে লাগলো। হৃদযন্ত্র আর একটু হলে হয়তো থেমেই যেতো। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাশ্বত। সাংবাদিকতা করে এসেছে আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর হতে চললো, আজ অবধি অনেক বিপদের মুখে যেয়ে তথ্য জোগাড় করেছে সে। কিন্তু এই প্রথম মরন ভয় তাকে কম্পিত করছিলো। বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলো সে। গলাটা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে এসেছে। এক গ্লাস পানি পে্লে ভালো হতো, শাশ্বত কাগজ গুলো হাতে নিয়ে আলমারি বন্ধ করে দিলো। উমার কৌতুহলী দৃষ্টি উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে বের হতে যাবে তখন কর্ণগুহে আলোড়ন জাগালো উমার তীক্ষ্ণ কন্ঠের প্রশ্ন,
“বাবার অগোচরে এখানে কি করছিলেন আপনি?”

উমা তাকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসবে সেটা ভাবতে পারে নি শাশ্বত। মেয়েটিকে ভীত পাখির বাচ্চা ভেবেছিলো। যে পাখির বাচ্চা উড়তে শেখে নি, যাকে শিকল বেধে আটকে রাখা হয়েছে রুদ্রের আকর্ষনীয় খাঁচায় তার অবাধ্য চাহিদা পুরণের জন্য। সময় সময় খাবার দেওয়া হয়, প্রয়োজনীয়তা পূরন করা হয়। মেয়েটিকে দেখলেই শাশ্বতের মূকাভিনয় শিল্পীর স্মরন হয়। যাদের মুখে বুলি থাকে না। কিন্তু শাশ্বতের সকল চিন্তাকে ভুল প্রমান করে দিলো উমা। শাশ্বতে ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে এলো। শাশ্বতের উত্তর না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো উমা,
“বললেন না যে এখানে কি করছিলেন?”
“মামার কাজে এসেছিলাম” 
“যদি তার কাজেই এসে থাকেন তবে আমায় দেখে ভয় পেলেন কেনো?”

উমার কন্ঠে সন্দেহের সূক্ষ্ণ ছাপ। সে শাশ্বতকে সন্দেহ করছে। শাশ্বত অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে। এতো পারদর্শী সাংবাদিক কি না একজন ষোড়শীর প্রশ্নে কুপকাত। শাশ্বত হাজার চেষ্টা করেও উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তাই এখন দ্বিতীয় উপায় অবলম্বন করতে হবে, চড়াও হলে মেয়েটি ভয় পাবে। তাই কন্ঠের জোর বাড়িয়ে বললো,
“এভাবে ভুতের মত আসলে যে কেউ ই ভয় পাবে। তা তুমি এখানে কি করছো? মামা মশাই তো নেই, মামীও হেসেলে।“

শাশ্বতের কথায় মৃদু হাসলো উমা। তারপর বললো,
“আমি আপনার মতো চুরি করতে আসি নি, মায়ের চা খানা দিতে এসেছি। সিংহের ঘরে চুরি করতে নেই। একবার ধরা পড়লে জীবন থেকে হাত ধুতে হবে। এই নাকি আপনি সাংবাদিক। যাক গে এই আপনার একখান কাগজ পড়ে গেছে।“

চায়ের কাপটা রেখে নিচে পড়া কাগজটা তুলে এগিয়ে দিলো উমা। শাশ্বত থতমত খেয়ে গেলো। মেয়েটি নিপুনভাবে তার চুরি ধরে ফেলেছে দেখে বিস্ময়ের সপ্তম আসমানে চলে গেলো সে। কে বলবে এই মেয়েটি গ্রামের একজন সাধারণ ঘরের বউ, যার কাজ শুধু হেসেল ঠেলা। মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা যেকোনো সাধারন মেয়ের ন্যায় নয়। কিঞ্চিত আহত ও হলো শাশ্বত, এই মেয়েটি যদি আজ পড়াশোনা করার সুযোগ পেতো তাহলে বেশ ভালো করতো। শাশ্বত নিজের মনোভাব সঙ্গোপনে রেখে নির্বিকার কন্ঠে বললো,
“ওটা আমার নয়”
“এই কাগজটা আপনার নয় ঠিক ই, কিন্তু কাগজটা আপনার কাজের। এটা “কমলাপট ব্রীজ” সংক্রান্ত।“

শাশ্বত আরোও অবাক হলো। চোখ কুচকে বলল,
“তুমি কিভাবে জানো আমি ব্রীজের কাগজ খুজছি।“
“জানতাম না, এই কাগজটা আপনার হাত থেকেই নিচে পড়েছিলো। আমি দেখেছি। আর এখানে “কমলাপট ব্রীজ” উল্লেখ করা। সেটাই পড়েছি।“
“তুমি ইংরেজি পড়তে পারো?”
“বলতে, লিখতে, পড়তে, বুঝতে পারি। নিন কাগজটা। আর অতিসত্তর এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আমি জানি আপনি ছুটি কাটাতে আসেন নি। আপনি সবাইকে মিথ্যে বলেছেন। বাবা যদি জানতে পারে আপনি তার আলমারি থেকে কিছু নিয়েছেন, রক্ষা থাকবে না আপনার। আপনি আমার শুভাকাঙ্গী, আমি শুনেছি সেদিন জ্বরের অবস্থায় আপনি আমাকে ছাঁদ থেকে নামিয়েছিলেন। তাই আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক। এটাকে আমার তরফের ধন্যবাদ মনে করবেন।“

উমা ধীর স্বরে কথাটা বললো। তারপর শাশ্বতের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে শাশ্বত ধীর স্বরে বললো,
“Every ambition is a gamble---- ইংরেজীতে এই কথাটা আছে। এর অর্থ জানো তো? প্রতিটা উচ্চাকাঙ্খাই জুয়ার মতো। জুয়াতে কিছু না কিছু বাজী রাখতেই হয়। আমি নাহয় আমার জীবন বাজী রাখছি। তবে এই চেয়ারম্যান বাড়ির রহস্য উম্মোচন করবোই। আমার জন্য তুমি এটুকু করছো এটাই অনেক। ধন্যবাদ।“

শাশ্বত এর ঠোঁটে স্মিত হাসি। সে উমার উত্তরের অপেক্ষা করলো। উমার হাতের কাগজটা নি্যে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। উমা চেয়ে রইলো শাশ্বতের যাবার পানে। শাশ্বতের কথাটা কর্নকুহরে প্রতিধ্বনি উৎপন্ন করছে,
“Every ambition is a gamble”

উমার ও অনেক উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে। সেও তার জীবনে অনেক বড় হতে চায়, এই গ্রামের গন্ডি পার হতে যায়। ভালো কলেজে পড়তে চায়। একজন ভালো চিকিৎসক হতে চায়। কত মানুষ এখনো গ্রামে অন্ধবিশ্বাসে ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। প্রসবের সময় কত নারী বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে বরন করে নেয় হাসতে হাসতে। মাসিকের সময় কত কিশোরীর চিকিৎসার অভাবে কঠিন রোগ হয়। উমা চায় এই অন্ধকারের সোনালী প্রভা হতে। শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বল করতে এই গোপিনাথপুরের ভবিষ্যত। কিন্তু এই উচ্চাকাঙ্খাটা কলি থাকতেই উপড়ে ফেলা হয়েছে। এখন উমা কেবল ই একজন জীবন্ত লাশ। তার নেই কোনো স্বপ্ন, নেই কোন উচ্চাকাঙ্খা। বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার জন্য লড়েছিলেন। রংপুর জেলার গ্রামের এই নারী লড়েছেন। কারণ তার পাশে তার স্বামী ছিলেন। কিন্তু আফসোস উমার সেই স্বামী ভাগ্য নেই। রুদ্র কখনোই তার ঢাল হতে পারবে না। যে তাকে বুঝেই না সে কি করে তার ঢাল হবে! উমার লড়াই তার নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু উমা কি পারবে এই লড়াই করতে??

গভীর রাত, 
বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে উমা। রুদ্র এখন বাড়িতে ফিরে নি। তার তিনদিনেই ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু সেই তিন দিন গড়িয়ে এখন সপ্তাহ হতে চললো। আজ খাবার টেবিলে এই নিয়ে কথা তুলেছিল লক্ষী রানী। কিন্তু অভিনব সিংহ উত্তর দেন নি। তার মুখটা থমথমে হয়ে ছিলো। রুদ্রের অনুপস্থিতিতে ঘরটা নিরব হয়ে আছে। তার উগ্র আচা্রণের বিন্দুমাত্র ছাপো নেই। এই সপ্তাহ খুব একান্ত সময় ব্যয় হয়েছে উমার। মানসিক অশান্তি ছিলো না, ছিলো না কোন উচাটন। তবুও কেনো যেনো একটা শূন্যতা ছিলো। এক অদ্ভুত শুন্যতা। এই শুন্যতার কারন জানা নেই তার। অযথাই বিষন্নতায় মন ছেয়ে যাচ্ছিলো। ঘরের মধ্যে একা একা জীব থাকতেও দমবন্ধ লাগছিলো। এপাশ অপাশ করেও ঘুমের দেখা মিললো না। তাই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। থমথমে রাত। হাওয়া যেনো আন্দলন করেছে, সে বইবে না। আমপাতাগুলো দুলছে না। আকাশটাকে নিগাঢ় কালো লাগছে। নিকষ কালো আকাশে এক টুকরা শ্বেত চাঁদের চিকন ফালি উকি দিচ্ছে। কাতর চোখে তাকাল উমা, কেনো যেনো ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ব্যাথিত মনে গুনগুন করে উঠলো,
“চক্ষে আমার তৃষ্ণা
ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে
চক্ষে আমার তৃষ্ণা
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন।।
সন্তাপে প্রাণ যায়,
যায় যে পুড়ে
চক্ষে আমার তৃষ্ণা”

হঠাৎ একজোড়া শীতল হাত তার কোমল ছুলো। আকস্মিক স্পর্শে চমকে উঠলো উমা। শরীরটা ঈষৎ ঝাকুনি দিলো। ভীত সন্ত্রাশিত চক্ষু জোড়া পেছনে চাইতেই রুদ্রের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী নজরে পড়লো। আকুল কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আপনি?”

রুদ্রের হাসিটা প্রসারিত হলো। মানুষটার হাসিটা মারাত্নক সুন্দর। নারীর হাসি সুন্দর হয়, পুরুষের সুন্দর হয় কান্না। কিন্তু রুদ্রের হাসিটা ব্যাতিক্রম। নিষ্ঠুর মানুষের হাসি কি এতো মায়াবী হতে পারে। রুদ্র কি সত্যি এসেছে? তাহলে শব্দ কানে এলো না কেনো? রুদ্র উমার সন্দীহান দৃষ্টি দেখে উচ্চস্বরে হাসলো। তারপর বললো,
“আমি সত্যি এসেছি। তুমি যখন ওই চাঁদের দিকে চেয়েছিলে তখন। তুমি আকাশের চাঁদ দেখছিলে আমি আমার চাঁদকে।“

উমার মনে হলো তার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রুদ্র তার কাঁধে থুতনি রাখলো। আদরে গলায় বললো,
“বউ, আমাকে স্মরণ করছিলে তাই না?”
“…….”
“তুমি উত্তর না দিলেও আমি জানি তুমি আমাকে স্মরণ করছিলে।“
“খেয়েছেন?”
“না খাওয়া হয় নি?”
“চলুন, খাবার দিচ্ছি।“

রুদ্রকে এড়িয়ে যেতে চাইলে তার স্পর্শ গভীর হলো। আকুল স্বরে বললো,
“এই একটা সপ্তাহ কিভাবে কেটেছে আমি জানি। আমার বুকের কুঠরে হাহাকার শুরু হয়েছিলো। আমি সত্যি নেশাখোর। দেখো না, মদ ছেড়ে তোমার নেশায় মত্ত হয়েছি। আর এই নেশাটা মারাত্নক। রক্তে মিশে গেছে। তুমি ছাড়া জীবনটা যে ক্ত অসহায় সেই ঝলক পেয়েছি। চাইলেও তোমার কন্ঠ শুনতে পারছিলাম না, তোমার কোমল মুখখানা দেখতে পারছিলাম না। লোকে বলতো আমি নাকি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কিন্তু আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এই রুদ্র সিংহ ও প্রেমে পড়েছে। উমার প্রেমে, বড্ড ভালোবাসি তোমায় বউ…………

রুদ্রের ঈষৎ কম্পিত কন্ঠের প্রেম নিবেদন শুনে থমকে যায় উমা। কি উত্তর দিবে, জানা নেই। উমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে……

—————

রুদ্রকে এড়িয়ে যেতে চাইলে তার স্পর্শ গভীর হলো। আকুল স্বরে বললো,
“এই একটা সপ্তাহ কিভাবে কেটেছে আমি জানি। আমার বুকের কুঠরে হাহাকার শুরু হয়েছিলো। আমি সত্যি নেশাখোর। দেখো না, মদ ছেড়ে তোমার নেশায় মত্ত হয়েছি। আর এই নেশাটা মারাত্নক। রক্তে মিশে গেছে। তুমি ছাড়া জীবনটা যে ক্ত অসহায় সেই ঝলক পেয়েছি। চাইলেও তোমার কন্ঠ শুনতে পারছিলাম না, তোমার কোমল মুখখানা দেখতে পারছিলাম না। লোকে বলতো আমি নাকি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কিন্তু আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এই রুদ্র সিংহ ও প্রেমে পড়েছে। উমার প্রেমে, বড্ড ভালোবাসি তোমায় বউ”

রুদ্রের ঈষৎ কম্পিত কন্ঠের প্রেম নিবেদন শুনে থমকে যায় উমা। কি উত্তর দিবে, জানা নেই। উমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রুদ্র খানিকটা আহত হয়। এক অজানা হাহাকার বুক চিরে ফেলছে যেনো, নীল বিষাদ দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে অন্তরটাকে। এতদিন কেবল মন নিয়ে পুতুল খেলাটাই জানাছিলো তার। কখনো মনের আদান প্রদানের খেলাটি তার খেলা হয় নি। মনের আদান প্রদান যে এই ভুবনের সবথেকে ভয়ংকর খেলা। একবার এই খেলায় আসক্ত হলে পৃথিবীর সবথেকে অকর্মন্য পদার্থে পরিণত হয় এই মানুষ। যেমনটা রুদ্র হয়েছে। মারাত্মক গুরুত্বপূর্ন কাজ ফেলে সে চলে এসেছে তার প্রেয়সীর নিকট, এই আশায় যে প্রেয়সীর সন্নিকটে শান্তির পরশ পাবে। কিন্তু প্রেয়সীর মনের দরজায় কড়া নাড়া কি এতই সহজ! যে প্রেয়সীর কাছে রুদ্র কেবল ই দুঃস্বপ্ন। উমার নীরবতাকে উত্তর রুপে গ্রহন করলো রুদ্র। তার কোমড় ছেড়ে ভেতরে চলে গেলো সে। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। বড্ড ক্লান্ত সে, ক্লান্তির ভারে চোখ বুঝে আসছে বারংবার। কাজের ভারে তিন দিন যাবৎ চোখ এক করে নি সে। এই ক্লান্তি এখন যম রুপে তার সামনে প্রকট হচ্ছে। ভগ্ন হৃদয়ের চিনচিনে ব্যাথা যেনো ক্লান্তিকে আরোও বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। বারান্দা ছেড়ে উমা পাশে বসে তার। আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,
"খাবেন না?"
"ক্ষুধা নেই"
"দেরি হলো যে আসতে?"
"কাজের চাপ ছিলো বড্ড, চাইলেও শেষ নামাতে পারি নি।"
"অহ"
"কিছু বলবে?"

কপালে বাহু ঠেকিয়ে রেখেছে রুদ্র। রুদ্রের প্রশ্নে উমা কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। মনের কথাগুলো জট পাকাচ্ছে। ঠিক সাজানো মুশকিল হয়ে উঠছে, রুদ্রের প্রতিক্রিয়া ও তার অজানা। লোকটি যে কখন কি করে তা এই দু মাসেও আন্দাজ করতে পারে নি সে, মুহুর্তে গোখরার ন্যায় বিষাক্ত তো মুহুর্তেই শ্বেত পদ্মের ন্যায় কোমল এবং স্নিগ্ধ। উমার নীরবতা দেখে হাত সরিয়ে উঠে বসলো রুদ্র। চোখ কুঞ্চিত করে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"কি হয়েছে? কুলুপ আটলে যে বড়?"
"আসলে..."
"কি?"
"আমি কলেজে ভর্তি হতে চাই।"

আড়ষ্টতা কাটিয়ে একদমে কথাটা বললো উমা। রুদ্রের নয়ন সংকুচিত হলো। মুখোভাব বদলালো কিঞ্চিত। উমা উত্তরের অপেক্ষায় বসে রয়েছে। এক ক্ষীন আশা জন্মালো, রুদ্র তাকে ভালোবাসলে এই আবদারটুকু রাখা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। অন্যদিকে, মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ প্রবল ভাবে বিরোধ করছে রুদ্র কখনোই তার ইচ্ছার দাম দিবে না। সে কেবল ই তার পার্থিব শরীরটাকে ভালোবাসে। অন্তঃরাত্মাকে ভালোবাসার রহস্য তার অজানা। উমার চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে রুদ্র বলে উঠলো,
"পড়তে ভালো লাগে তোমার?"
"প্রচন্ড"

জড়তা কাটিয়ে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে উঠলো উমা। উমার উৎসাহিত উজ্জ্বল মুখখানা দেখে রুদ্র খানিকটা অবাক হলো। যাকে ভালোবাসে দাবী করছে তার ইচ্ছার ভনক পেতে তার এত সময় লেগে গেলো। রুদ্র স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
"আমি বাবার সাথে কথা বলবো দেখি। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। রাত হয়েছে।"

বলেই পুনরায় গা এলিয়ে দিলো রুদ্র। উমার মনের আঙ্গিনায় যেনো কোমল, স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে গেলো। এ যেনো এক অন্য আনন্দ। রুদ্র নামক ব্যাক্তিটিকে সত্যি ই বুঝতে পারে না সে। মস্তিষ্ককে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে অন্তরটা বলে উঠলো,
"সে আমাকে আশাহত করে নি। তার ভালোবাসাটা হয়তো একাংশ হলেও সত্যি"

১১!!

গতরাতে শিশির পড়েছিলো বেশ। ঘাসগুলো ভিজে আছে, পা দিলেই শিশিরবিন্দু পা জোড়া আটকে ফেলছে। নগ্ন পায়ে শীতল স্পর্শ মন্দ লাগছে না উমার। সূর্যমামা বেশ আলসেমি করছে আজ৷ কিন্তু উমার আলসেমি করলে চলবে না। সে তার সময় মতো ফুল তুলবে। পুজোর ফুল তুলতে ভালো লাগে তার। নিরব কোলাহলবিহীন পরিবেশে একান্ত সময় কাটাতে মন্দ লাগে না। এর মাঝেই পা ঘষার শব্দ কানে আসে উমার। পেছনে তাকাতে দেখতে পায় সফেদ পাঞ্জাবীতে শাশ্বত হাটাহাটি করছে। উমাকে দেখেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। এগিয়ে এসে বললো,
"নগ্ন পায়ে হাটাহাটি কি তোমার অভ্যাস?"

উমাও প্রতিত্তরে হেসে বললো,
"ফুল তোলাটা আমার অভ্যাস। আপনি তো ছাদে হাটেন, আজ এ মুখো?"
"শিশিরের ছোয়া পেতেই এখানে আসা। সেদিন বলছিলে তুমি পড়তে জানো, কতদূর পড়ালেখা করেছো?"
"স্কুল পাশ করেছি এই বছর।"
"সামনে পড়ার ইচ্ছে আছে?"
"ইচ্ছে তো আছেই, কিন্তু সেই ইচ্ছে বাস্তবায়ন কবে হবে সেটার অপেক্ষা। আমার কথা ছাড়ুন। আপনি যে জন্য এখানে এসেছেন সেই কাজ কি পূরণ হলো?"

শাশ্বত চুপ করে কিছুক্ষন উমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। প্রত্যন্ত গ্রামের ষোড়শীর বুদ্ধিতে সে সত্যি অবাক। এই বাংলার আনাচে কানাচে কত মেধা লুকিয়ে আছে। শুধু তাদের চাই সামান্য পথপ্রদর্শন। শাশ্বত মুচকি হেসে বললো,
"তুমি খুব বুদ্ধিমান মেয়ে জানো তো?"
"মনগড়া কথা সব"

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো উমা। শাশ্বত তাকে আশ্বত করে জোর দিয়ে বললো,
"সত্যি, বিশ্বাস হচ্ছে না?"
"নাহ"
"তোমাকে দেখলে আমার একটা চরিত্রের কথা খুব মনে পড়ে জানো তো"
"কোন চরিত্র?"
"বিনোদিনী"
"সেটা কোন চরিত্র?"
"চোখের বালি পড়ো নি?"
"পাঠ্যপুস্তক কিনতে পেরেছি এই কত!"
"আমার কাছে আছে, নিও ক্ষন"
"আমার ফুল তোলা শেষ, যেতে হবে"
"রক্তজবা তুলেছো?"
"তুলেছি। আপনার ভালো লাগে?"
"খুব, রক্তজবা আমার এতো ভালো লাগে কেনো জানো, কারণ জবার মাঝে এক শক্তি আছে, এক অন্যরকম শক্তি। যে একই সাথে কোমল আবার কঠোর। তাই তো এই জবা নারীর খোঁপার অলংকার হয় আবার হয় অসুর বধের আভুষণ" 

শাশ্বতের কথা বরাবর ই অবাক করে উমাকে। এই অরাজকতায় এতো স্নিগ্ধ মানুষ কি করে হয় ভেবে পায় না সে। মুচকি হেসে বলে,
"থাকুন তবে, আজ আসি"
"এসো"

অমায়িক হাসি দিয়ে শাশ্বত কথা বললো৷ উমা অপেক্ষা করলো না। পা বাড়ালো অন্দরে। শাশ্বত হাসিটা স্থায়ী করে সামনে এগোলো। তাদের এই ক্ষণটার সাক্ষী হলো বাগান, নীল আকাশ এবং এক জোড়া রক্তিম চোখ।

অভিনব সিংহ পায়চারী করছেন। রাগ দমানোর চেষ্টা বারংবার ব্যার্থ হচ্ছে। তার শক্ত চোয়াল এবং রক্তিম চোখ দেখে যে কেউ ভয় পাবে। কিন্তু রুদ্রের মনে ভয় নেই। সে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রের সামনে এসে বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠেন,
"একটা কাজ তুমি ঠিক ভাবে করতে পারো না। একটা কাজ ও না। কি দরকার ছিলো ওই অফিসারকে ছোড়া মারার কি দরকার ছিলো। ভাগ্যিস দীপঙ্কর ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। তোমার কোনো আন্দাজ আছে তুমি কি করেছো? আমার ক্ষমতা আছে বলে তুমি যা খুশি করবে?"
"বেঁচে আছে তো জানোয়ারটা তাহলে কিসের সমস্যা?"

রুদ্রের বেপোরোয়া উত্তরে আরো ও মেজাজ বিগড়ে গেলো অভিনব সিংহের। তেড়ে এসে সজোড়ে আঘাত করে বসলেন তিনি। আকস্মিক ঘটনায় ধাতস্থ হতে কিছু সময় লাগলো রুদ্রের। অভিনব সিংহ এর পর যা করলেন তাতে রুদ্র বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেলো। রুদ্রের ঘাড়টা শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রেখে বললেন,
"আমার এখন ইচ্ছে করছে তোর অবস্থাও ওই লোকের মতো করতে। ভুলে কেনো যাস তোর নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতা নেই। আমি না বলা অবধি শ্বাস ও নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এই শেষ বারের মতো বলছি, আমার বলার আগ পর্যন্ত কিছু করবি না তুই।"

অভিনব সিংহের কথাগুলো শুনে থমকে গেলো রুদ্র। নিবৃত্ত চিত্তে ছাই চাঁপা আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। রাগ সংযত করার জন্য চোখ বুজে নিলো সে। পরমুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তার। শক্ত হাতে অভিনব সিংহের হাত সরিয়ে নিলো। তারপর তার চোখে চোখ রেখে বললো.......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন