বন্ধন - পর্ব ১৭ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩৩‌!! 

সকালে আয়ানের ঘুম ভাঙতেই বুকটা ভারি ভারি লাগছে। চোখ খুলে মায়রাকে বুকে পেয়ে অপলকে মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আয়ান। তার লাজুক পরীটার ঠোঁটের কোণে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে আছে। দেখতে বেশ লাগছে আয়ানের। আয়ানের খুব করে ইচ্ছে করছে পাগলিটার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে দুষ্টুমিতে মাতাল করে তুলতে। অথচ এতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা যে ওর ঘুমটা ভাঙানোর চেয়ে ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা দেখতেই বেশ লাগছে। 

আয়ানের হঠাৎ খেয়াল হলো মাথার কাছে বেড সাইড টেবিলটার উপরে ওর মোবাইলটা ভাইব্রেট হচ্ছে। মায়রাকে বুকে টেনে নিয়ে ডান হাতে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বাম হাতে মোবাইলটা হাতে নিল আয়ান। স্ক্রিনে আরিশার নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল আয়ানের। ঘড়িতে আটটা বাজে। এতো তাড়াতাড়ি আরিশা কল করেছে কেন? কোনো সমস্যা হলো নাকি! কথাটা ভেবেই কলটা রিসিভ করে বাম কানে লাগালো আয়ান। কলটা রিসিভ হতেই ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পেল আয়ান।

-আরু? কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? আরিশা?

-আয়ান। মা?

-কি! কি হয়েছে আন্টির?

-মায়ের হার্ট এ্যাটাক হয়েছে আয়ান--। আমি বুঝতে পারি নি--। 

-সে কি! কখন? তুই ওয়েট কর আমি এ্যাম্বুলেন্স---।

-না রে-। আমি ভোরের দিকে মাকে নিয়ে সেন্ট্রাল হসপিটালে এসেছি--।

-সে কি! এতো কিছু হয়ে গেল তুই বলবি না একবারও কল করে? আজব! আমি আসছি ওয়েট কর--।

-এই নাহ--। তোকে এখন আসতে হবে না। আর এতো সকালে কল করার জন্য সরি আয়ান---।

-একটা থাপ্পড় দিবো ধরে আরিশা। আর সাড়ে আটটা মোটেও এতো সকাল না---।

-বাসরের পরের দিন তো সকালই। তোকে কল দিতাম না এখন। খুব দরকার হলো তাই করলাম।সরি।

-আবার?

-তুই সাড়ে নয়টা করে এয়ারপোর্টে যেতে পারবি একটু? তাওহীদ আসছে--।

-আসছে উনি শেষমেশ?

-হুম। তোর গায়ে হলুদের রাতে কল করেছিল-। হঠাৎ কি মনে করে কাজ টাজ সামলে আসছে-।

-হুম--। ফ্লাইট ল্যান্ড করবে কখন? 

-১০ টায় মে বি--।

-ওকে---। তাওহীদ ভাইকে নিয়ে আমি সোজা হসপিটালে আসবো। কেমন? 

-হুম--।

-আন্টির কি অবস্থা এখন?

-মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো না রে-। নইলে আমি নিজেই যেতাম-।

-এই তুই রাখ তো! এমন ফর্মালিটি করতেসিস মনে হচ্ছে আমি তোর কেউই না। তুই রাখ তো রাখ---। অসহ্য মেয়ে একটা---।

আয়ান রাগ করে কল কেটে দিয়ে মোবাইলটা ধুম করে বেড সাইড টেবিলটার উপরে রাখলো। আয়ানের কথার শব্দেই মায়রার ঘুম ভেঙে গেছে। আয়ানকে দেখে কেমন চিন্তিত লাগছে সেটা দেখে আর মায়রা কিছু বলার সাহস করলো না। আরিশার ব্যাপারে কিছু একটা হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেই চুপ করে আছে মেয়েটা। আয়ানও একটু সময় পর নিজেকে সামলে নিয়ে মায়রাকে দুহাতে বুকে জাপটে ধরলো শক্ত করে। পাগলিটার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণটা নাকে এসে নেশা ধরাচ্ছে আয়ানের মনে। আলতো করে মায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মায়রাকে বালিশে রাখতে গিয়ে টের পেল মায়রা জেগে গেছে। 

-এই যে দুষ্টু মেয়ে? জেগে গিয়েও কথা বলছিলে না কেন?

-আসলে--আপনি তো চিন্তা করছিলেন কিছু একটা--।

-হুম--। আরিশাকে দেখলে না কাল! ওর মা মানে আন্টির এ্যাটাক হয়েছে কাল---। মেয়েটা আমাকে এখন বলছে---। লাগেটা কেমন বলো?

------------------------------

-পরী? আমি একটু এয়ারপোর্টে যাবো। তাওহীদ ভাইয়া আসবে--। তারপর আন্টিকে দেখতে হসপিটাল যাবো---। তুমি আর একটু ঘুমাও কেমন?

-না না--। আমিও উঠে পড়ছি--। আপনি---।

-শশশশশশ---। বেশি কথা বলবা না। বললাম না ঘুমাও--? একে তো সারাটা দিন টায়ার্ড ছিলা, আজও বউভাতের অনুষ্ঠান আছে--। সারাদিন একটু রেস্টেরও সময় পাবা না--। তাই এখন চুপচাপ ঘুমাবা-।

-সমস্যা হবে না তো--। আমি শাওয়ার নিয়ে নাস্তা রেডি করে ফেলি। আপনি খেয়ে তারপর-।

-ওহ আচ্ছা--। শাওয়ার নিবা? ওকে-। আসো?

-আরে? কি করছেন?

-শাওয়ার নিবা না? একসাথে শাওয়ার নিবো--। লম্বা একটা শাওয়ার নেয়া যাক--। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়---।

আয়ান মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। মায়রা বেচারি লজ্জা পেয়ে গায়ের চাদরটা জাপটে ধরে চোখ বুজে আছে। আয়ান মায়রাকে ওয়াশরুমের ফ্লোরে দাঁড় করিয়ে শাওয়ার চালিয়ে দিলো। মায়রা তো লজ্জা পেয়ে চোখও খুলতে পারছে না। আয়ানও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মায়রাকে দেখলো। শাওয়ারের পানিগুলো বিন্দু বিন্দু হয়ে জমা হচ্ছে মায়রার গালে, গলায়। আর ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে মেয়েটা। তবু চোখ খুলতে পারছে না। আয়ান এগিয়ে এসে মায়রাকে দেয়ালের সাথে আটকে দিয়ে মায়রার দিকে তাকালো। লজ্জায় লাল মুখটায় পানি বেয়ে পড়ছে শাওয়ার থেকে। 

আয়ানের স্পর্শ না পেয়ে মায়রা চোখ খুলতেই দেখলো আয়ানও একেবারে ভিজে গেছে শাওয়ারের পানিতে। মায়রার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে মায়রাকে। আয়ান আলতো করে মায়রার হাতে ধরা চাদরের অংশটায় হাত রাখলো।

-জানো লাজুক পরী? তোমার চোখ জোড়া সুন্দর, এই নাকটাও সুন্দর। এই মিষ্টি দেখতে ঠোঁট জোড়া ও মিষ্টি। এই গলা, এই যে তোমার বিউটি বোন, এটার উপরে চিকচিক করা পানির বিন্দুগুলোও ভিষণ সুন্দর। আর ধরো----।

আয়ান আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে দিয়ে মায়রার সাথে কথা বলছিলো। মায়রা কোনমতে আয়ানের মুখে হাত দিল।

-এভাবে বলবেন না প্লিজ? আমার লজ্জা করে---।

-এখনো লজ্জা করে? রাতের এতো আদরেও বুঝি লজ্জা ভাঙে নি আমার লাজুক পরীটার?

আয়ান মুখটা মায়রার দিকে এগিয়ে আনছে দেখে মায়রা লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে চোখ বুজে নিলো। আয়ান মিষ্টি করে হেসে মায়রার হাত থেকে চাদরটা ছাড়িয়ে নিয়ে মায়রার একেবারে কাছে গিয়ে মায়রার বিউটি বোনে জমা পানিটুকু শুষে নিলো। মায়রা কেঁপে উঠে আয়ানের একটা হাত শক্ত করে খামচে ধরেছে দেখে আয়ানও মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। দু সেকেন্ড মায়রার লাজুক লজ্জারাঙা মুখটা দেখে আয়ান মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। 

-এখনো আপনি করেই বলবা আমাকে? তুমি করে বলা যাবে না?

-আসলে---।

-কোন কথা শুনবো না। কেউ শুনলে ভাববে আমি বউটাকে কি রকম টর্চার করি, বউ ভয়ে আপনি ছাড়া কথাই বলতে পারো না। তাই না বলো?

-কি বলে এসব?

-ভাববাচ্যে কথা বলা বারণ---।

-হুম?

-এই যে না আপনি বললা না তুমি। এমন মানবো না। তুমি করেই বলতে হবে-। নইলে কিন্তু সবার সামনে জাপটে ধরে ঠোঁটে কামড় দিবো বলে দিলাম--।

লজ্জায় আর মায়রাকে পায় কে। বেচারির গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। আর সেটা দেখে আয়ান ওকে আরো জ্বালাতন করে লজ্জায় ফেলছে। লাজুক পরীটার লজ্জামাখা মুখটা দেখতে আয়ানের দারুণ লাগে।

-কই বলো?

-কি! কি বলবো?

-উমমমম--। বলো যে আয়ান, আমাকে একটা আদর করো--।

-যাও---।

মায়রা এবারে আয়ানের বুকের ভেতরে মুখ ডুবিয়ে নিলো। আয়ানও হেসে মায়রাকে বুকে শক্ত করে বেঁধে নিলো।

-ইশ রে! লাজুক পরীটা আমার লজ্জা পেয়েছে। শোনো পরী এতো লজ্জা পেলে কিন্তু চলবে না। বলতে হবে--। 

-আমমমমম---। তুমি-তুমি বাইরে যাচ্ছিলা--।

-হুম--। যাবো তো--। বাহ! বউয়ের মুখে তুমি শুনতে কত্তো মিষ্টি লাগছে। এর জন্য তো বউয়ের একটা মিষ্টি পাওনা--।

-হুম?

-আসো দুষ্টুমি করতে করতে শাওয়ার নিই--। আবার তো বাইরে যাবো----। কতোক্ষণ বউকে কাছে পাবো না কে জানে।

আয়ান আলতো স্পর্শে মায়রাকে মাতাল করতে করতে শাওয়ার নিলো বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। তারপর মায়রার গায়ে একটা টাওয়াল জড়িয়ে নিজেও একটা টাওয়াল পড়ে নিলো। মায়রা ওয়াশরুমের দরজার দিকে এগোতেই পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো আয়ান। রুমে এসে মায়রাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে একটা নরম গামছায় চুল জড়িয়ে দিলো মায়রার। তারপর আলমারি খুলে একটা থ্রিপিস বের করে মায়রাকে ধরিয়ে দিলো আয়ান। মায়রা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকালো।

-পরী? এখন এই ড্রেসটা পড়ে নাও। বউভাতের অনুষ্ঠান দুপুরে। আমি এলে তখন রেডি হবা অনুষ্ঠানের জন্য। এখন এই জামাটা পড়ো। কমফোর্টেবল হয়ে ঘুমাও--। 

-নাস্তা---?

-হুম--। আমি নাস্তা নিয়ে আসি। খেয়ে ঘুমাও-।

-আরে! বলছি আমি নাস্তা বানাবো--।

-একটা মাইর দিবো বুঝসো? নাস্তা বানানোর বহু সময় পাবা--। এখন কিছু করতে হবে না---।

-বলছিলাম কি---।

-তুমি কি চাইছো আমি এখন বাইরে না গিয়ে তোমার মাঝে ডুব দেই আবার?

-না মানে---। তুমি--। তুমি যাও-।

-গুড গার্ল---।

আয়ান মায়রা গালে চুমো খেয়ে নিজের গাল বাড়িয়ে দিলো। মায়রার হুঁশ নেই দেখে নিজেই মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো।

-এই যে লজ্জাবতী বউ? আমার রিটার্ন আদর কই? দাও দাও?

-ধ্যাত---পারবো না---।

-আরে! এটা কিন্তু ঠিক না। আদর চাই মানে চাই--।

------------------------------

-আচ্ছা। বাসায় ফিরি তখন বুঝাবো নি---। এখন চেইঞ্জ করো--। আমিও চেইঞ্জ করে তোমার খাবারটা নিয়ে আসছি----।

আয়ান নেভি ব্লু কালরের একটা পাঞ্জাবি আর জিন্স পড়ে রান্নাঘরে গেল। আয়ানের মা নাস্তা রেডি করেই রেখেছিলেন। 

-কিরে আয়ান? এতো জলদি রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছিস বাবা?

-মা আরুর মায়ের হার্ট এ্যাটাক হয়েছে রাতেই। আর তাওহীদ ভাই আসছে। উনাকে রিসিভ করে হসপিটালে যাবো--।

-আহারে! মেয়েটার যে কি আছে কপালে! মায়রা উঠেছে?

-হ্যাঁ মা। ও রান্নাঘরে আসবে বলে জেদ করে বসে আছে--।

-এই নাহ-। কাল সারাদিন মেয়েটাকে শান্তি দিলি না তোরা। আজও দুপুর থেকে অনুষ্ঠান। বিকালে আবার ও বাড়ি যাবে--। এখন খবরদার ওকে রান্নাঘর ঢুকতে হবে না। খাবার নিয়ে যা--। আর তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবা---।

-হ্যাঁ মা---। 

আয়ান খাবার নিয়ে রুমে এসে দেখলো মায়রা রেডি হয়ে বসে আছে। আয়ানকে দেখেই মুখটা কাচুমাচু করে তাকালো। আয়ান মায়রার পাশে বসে খাবার মায়রার মুখে তুলে ধরলো। মায়রাও আস্তে করে আয়ানকে খাইয়ে দিলো। দুজনের খাওয়া শেষ হলে আয়ান মায়রার হাত মুখ ধুইয়ে মুছে দিলো। 

-এই? এখন যাই না রান্নাঘরে?

-হুম---। এখন রুমের বাইরে গেলে মা ই মাইর লাগাবে তোমাকে--।

-উহহহহহহহহ।

-আরেকটু ঘুমাও পাগলিটা--। দেখেছ কতোটা টায়ার্ড লাগছে তোমাকে?  আর আজকে রাতেও একটুও ঘুমাতে দিবো না তো। সেটার জন্য একটু রেডি হও---।

-যাহ--। কি সব বলে---।

-ওরে লাজুক পরীটা। এসে যদি বাইরে দেখি খবর আছে কিন্তু। ঘুমাও সোনামনি--। ওকে?

-হুম--। 

আয়ান আলতো করে মায়রার কপালে চুমো খেয়ে মায়রাকে শুইয়ে দিলো। মেয়েটা বিছানার ফুলগুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে ফেলেছে আয়ান আসার আগেই।আয়ান হেসে মায়রার গায়ে একটা চাদর টেনে দিয়ে কপালে আরেকটা চুমো খেল।

-আসছি বউটা। বায়---।

-বায়--।

আয়ান দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে চলে গেল। আর মায়রাও ক্লান্তিতে চোখ বুজলো। আর প্রায় সাথে সাথেই স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গেল। 

৩৪!! 

আয়ান বেশ তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছে। এসেই দেখলো তাওহীদ বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ানকে দেখেই তাওহীদ এগিয়ে এসে গাড়িতে এসে বসলো। আয়ান হেসে তাওহীদের সাথে হ্যান্ডশেইক করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ছেড়ে দিয়ে দুজনেই সিটবলেন্ট বাঁধার পর আয়ান গাড়ি স্টার্ট দিলো।

-ফ্লাইট কখন ল্যান্ড করলো ভাই?

-এই তো মিনিট ১৫-২০ হবে।

-এখনো তো ১০ টা বাজে নি। আরু তো আমাকে বলেছিল--। ইশ! এই মেয়েটা!

তাওহীদ মুখ টিপে হাসলো।

-তাওহীদ ভাই। আপনি একদম হাসবেন না। আমি আপনার উপরে খুবই রেগে আছি। 

-সরি ভাই। বিয়েতে আসতে পারি নি।

-আসতে পারি নি কথাটা অন্তত আমাকে বলবেন না। সত্যিটা বলেন যে ইচ্ছে করে আসেন নি। 

-আসলে কাজগুলো সামাল দিতে পারি নি---।

-ইচ্ছে করে শিডিউল বিজি করে রেখেছিলেন-। সামাল দিবেন কি করে? তা গায়ে হলুদের দিন কি মনে করে কল করলেন আরুকে? আমি তো ভাবলাম আপনি আর--।

-টিজ করছো রে ভাই?

-টিজ করার মতো কথা না? যাকে ভালোবাসেন তার বিয়ে হবে ভেবেও কেন কোনো স্টেপ নেন নি?

-ওকে তো খুশি দেখতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ও হয়তো তোমার সাথে সুখেই থাকবে।

-এই একটা কথা ভেবে তো গত তিনটা বছর আগেই পালিয়ে গেলেন এমস্টার্ডামে। 

-আয়ান থাক না এসব--। তখন ইমোশনগুলো কন্ট্রোল করতে পারি নি রে ভাই। 

-তাহলে এখন কেন ফিরছেন? আরিশার আর আমার যদি বিয়েটা হয়ে যেত তখন কি করতেন আপনি?

-আসলে আয়ান---। 

-আপনার মতো অদ্ভুত লোক আমি পৃথিবীতে দেখি নি তাওহীদ ভাই। সেদিন কেন কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলেন আপনি? আজকে অন্তত বলুন। প্লিজ?

-তোমাদের তখন নতুন বিজনেসটা শুরু হয়েছিল মনে আছে আয়ান? ফার্স্ট প্রোগ্রেসের পার্টি চলছিল আরুদের বাসায়। দিনটা মনে আছে? কি খুশি ছিল মেয়েটা। ওকে এর আগে এতোটা খুশি আমি কখনো দেখি নি জানো?

-হ্যাঁ খুশি হওয়াটা স্বাভাবিক না? ওর আর আমার দুজনের প্রথম বিজনেসে এতো বড় একটা ডিল পেয়েছি আমরা। আরুর খুশিটা আমিও ফিল করেছি। সাথে এই খুশিটার কারণও জানি-। কিন্তু আপনি কেন----?

-জানো? ওকে সেদিন 'ভালোবাসি' কথাটা বলতে সব ব্যবস্থা করে এসেছিলাম। ওকে সব কষ্ট থেকে লুকিয়ে রাখব, এই ওয়াদাটা করতে চেয়েছিলাম আমি---। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না---।

-মানে? কি হয়েছিল?

-আরুর মা মানে আনায়া আন্টিকে দেখি একটা রুমে কারো সাথে কথা বলছে। আমি চলে আসবো এমন সময় কিছু কথা শুনতে পাই। কি বলছিলো জানো? এবার নাকি আন্টি যে করেই হোক আরিশাকে বিয়ের জন্য রাজি করাবে। প্রয়োজনে ব্ল্যাকমেইল করবে। মেয়েটার একটা সুন্দর জীবন শুরু করার জন্য প্রয়োজনে উনি নিজের মেয়ের চোখেই খারাপ হবে-। তবু মেয়ের জীবনটা উনি শুধরে দিবেন--। আর কথাগুলো বলছিলো কাকে জানো?

-কাকে?

-তোমার মাকে আয়ান-। আমি তখন কি করতাম বলো? তোমাদের দুাজনকেও তো একসাথে আসলেই ভিষণ সুখী লাগছিলো। আর আমি এটা ভালো করেই জানতাম তুমি ওর মনে কখনো কোনো কষ্ট দিবে না। কোনো দুঃখ ওকে ছুঁতে দিবে না।

-আপনি পাগল তাওহীদ ভাই? ওহ গড!

-পাগল বলো আর যাই বলো ভালোবাসার মানুষটার জন্য মানুষ সব করতে পারে। এমনকি কষ্ট হবে জেনেও তার থেকে দূরেও হারিয়ে যেতে পারে---।

-যেমনটা আপনি হারিয়ে গেছিলেন---।

------------------------------

-আপনি হুট করে চলে যাওয়ার পর ওর কি অবস্থা হয়েছিলো সেটা কি একবারও খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? ও নাহয় পাগলী---। নিজের ফিলিংসটাকে নিজেই কখনো বোঝার চেষ্টা করে নি, এখনো করে না। কিন্তু আমরা তো বুঝি--। আপনারও কি বোঝার দরকার ছিল না?

-সরি ভাই----।

-এখন সরি বলে কি করবেন? ওর জীবনের ক্ষতগুলো আরো গভীর করে ফেলেছেন---। এতোদিন মেয়েটার শুধু ধারণা ছিল ভালোবাসা বলে কিছু হয়না। সম্ভবত এখন সেই কথাটা ও বিশ্বাস করে যে আসলেই ভালোবাসা বলে কিছুই হয় না। কজ ভালোবাসলে আর যাই হোক মাঝ রাস্তায় কেউ ওকে ফেলে যেত না। 

-আয়ান------?

-চলে এসেছি ভাই--। আন্টিকে দেখে বাড়ি যাবো। আজকে বৌভাত-। বুঝতেই পারছেন?

-হুম। চলো?

আয়ান আর তাওহীদ হসপিটালে গিয়ে আরিশার মাকে দেখে এলো। তারপর আয়ান, আরিশা, তাওহীদ তিনজনে মিলে হসপিটালের কেন্টিনে বসলো। 

-আরু? কিছুই তো খাস নি। কিছু খা?

-খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমরা খাও।

-আরু? আমি খেয়ে এসেছি।  তাওহীদ ভাই আর তুই খা। বাই দা ওয়ে---। আন্টির হঠাৎ এ্যাটাক হলো কেন? কি হয়েছিল বল তো।

-কি আর হবে? যা হয় সবসময়। তোর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাসায় যেতে তো রাত হয়ে গিয়েছিল অনেক। তাওহীদের বোন তাহিয়ার সাথে অনেকক্ষণ কথা হলো। কলটা কাটতেই দেখি মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তোর বিয়ের কথাটা তো মাকে বলিনি--। মা ফোনে তাহিয়াকে বলার সময় শুনে তো একেবারে রেগে মেগে একটা অবস্থা। 

-আমি তার জন্যই বলেছিলাম আমি নিজে গিয়ে বলে আসি--। আন্টি এতো হাইপার হতো না তাহলে--।

-আরে চুপ থাক তো। বিয়ে নিয়ে এতো লেকচার দিচ্ছিলো যে আমিও রাগের মাথায় বলে ফেলেছি জীবনেও বিয়ে করবো না--। মা শুনে আর কিছু না বলেই রুমে চলে গেছে---। একটু পরে রাগটা কমলে আমার নিজেরই খারাপ লাগছিলো কেন যে মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে গেলাম এটা ভেবে। মাকে সরি বলার জন্য রুমে গিয়ে দেখি মা ফ্লোরে পড়ে আছে--। এতো ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস---?

-আরু? একটু শক্ত হ প্লিজ। আন্টি এখন ভালো আছে-। ডক্টর তো বললো কালকের মধ্যে বাসায় নিতে পারবি।

-কিন্তু আয়ান--আমার জন্যই তো মা------।

-চুপ----। আর এই মেয়ে এতো কিছু হয়ে গেল তুই আমাকে কল করলি না কেন একবারও? ধরে থাপড়াইতে মন চাচ্ছে তোকে আমার এখন---।

-তখন কল করলে তোর বউই আমার চুল টেনে ছিড়তো--। সেদিন কি যে লুক দিলো মেয়েটা--।

-আজাইরা কথা একটু কম বলবি বুঝসিস? আর তোরা তো বৌভাতে যেতে পারবি না মে বি--। 

-না রে--। কি করে যাবো?

-হুম সেটাই---। আমি খাবার পাঠিয়ে দিবো দুপুরে--। কেমন?

-শোন? কষ্ট করতে হবে না--।

-আরেকবার কথা বলবি তো আরিশা----?

আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে তাওহীদের সাথে হ্যান্ডশেইক করলো আরেকবার। 

-ভাই আমি আসছি তাহলে? সন্ধ্যার দিকে আরেকবার এসে আন্টিকে দেখে যাবো--। আপনারা খাওয়া দাওয়া করেন--। আর এই মেয়েটা কথা না শুনলেই থাপড়াবেন।। এমনি বললে কাজ হয় না---।

-আয়ান্যাইয়া----? তোরে তো আমি পরে দেখে নিবো--।

-দেখিস দেখিস--। আমি এখন গেলাম। খেয়ে নে। 

-ওকে বায়। ভাগ সামনে থেকে--।

আয়ান বেরিয়ে গেলে তাওহীদ খাবার অর্ডার করে এসে আরিশার দিকে তাকালো। কতদিন পর সে তার পাগলিটাকে দেখছে! কেমন একটা শুকিয়ে গেছে মুখটা, চোখ দুটো বসে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। তবুও তাওহীদের মনে হচ্ছে এই রূপেও মেয়েটাকে সে সারাজীবন অবাক চোখে দেখতে পারবে। মেয়েটা সামনে থাকলেই  কি এক অদ্ভুত শান্তি খেলা করে ওর মনে। কেন যে মেয়েটা বুঝে না সেটা? কবে যে বুঝবে পাগলিটা তাওহীদ ঠিক কতোটা ভালোবাসে ওকে?

এদিকে আয়ানও বাড়ি ফিরেছে। বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। সাড়ে ১২ টার মতো বাজে। মেয়েটা কি করছে কে জানে! আয়ান একটু এদিকে সেদিক ঘুরে এসেও মায়রাকে না পেয়ে রুমে এলো। রুমেও নেই মেয়েটা। কি মনে হতে বারান্দায় উঁকি দিলো আয়ান। এতোক্ষণে মায়রাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো আয়ান। তার লাজুক পরীটা বারান্দার রেলিঙে হাত দিয়ে এক মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ানও আলতো করে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। মায়রা চমকে উঠলেও কিছু বললো না। আয়ান আলতো করে মায়রার কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে দুষ্টুমিতে মাতলো। মায়রা কেঁপে উঠে আয়ানের হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো।

-বউটা এখানে একা একা কি করছে? হুম হুম?

-তুমি-তুমি তো বললে বাইরে না যেতে---।

-ও আচ্ছা। দেরি করে ফেরায় অভিমান হয়েছে বউয়ের?

-উহু---।

-তাকাও তো এদিকে? দেখি?

-------------------------------

-কই মুখটা দেখি? আমার অভিমানীটার মুখ দেখবো এখন--।

আয়ান মায়রার কাঁধে হাত দিয়ে মায়রাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখটা দেখলো। চোখ জোড়া লাল হয়ে গেছে পাগলিটার। আয়ান আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

-কি হয়েছে আমার লাজুক পরীটার? বাড়ির জন্য মন খারাপ করেছে? নাকি তার পচা বরটা দেরি করায় রাগ করেছে? হুম?

মায়রা কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নিলো লজ্জা পেয়ে। কি জন্য কেঁদেছে ও নিজেই জানে না। ঘুমটা ভাঙার পর এই মানুষটার শূন্যতা যেন ওকে আরো বেশি করে ঘিরে ধরেছে। মানুষটার কাছ থেকে কখনো দূরে যেতে হলে মরেই যাবে মেয়েটা। মানুষটাকে কি করে বুঝাবে ও নিজের মনের কথাটা? আয়ানও মুচকি একটা হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে মায়রাকে দেখছে। পাগলিটার কান্না ভেজা মুখটা দেখে মনে হচ্ছে খুব করে মিস করছিলো পাগলিটা ওকে। এই পাগলিটার কাছ থেকে কি আর দূরে থাকা যায়?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন