বাসার ভিতর প্রবেশের জন্য রাস্তা থেকে বাসা অবদি লাল গালিচা বিছানো। গালীচাতে পা দিতেই প্রথমে কামরান সাহেব একটা ফুটন্ত লাল গোলাপ এনে পুত্র বধূর হাতে দিয়ে বলল-
~" শুভ জন্মদিন মা। জিবনের ২৬টা বসন্ত পার করে আজ আবারো আমার ঘরে সৌভাগ্যর দ্বার খুলে পর্দাপন করলে। তোমায় অভিন্দন মা।"
তিতিরের কাছে এ যেন স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। যে অপমানিত হয়ে তিতির রাতে এই বাসা ছেড়েছিল আজ তা বহুগুন সম্মান নিয়ে সেই একই বাসায় প্রবেশ করতে চলছে। ধৈর্য্যর পুরষ্কার বুঝি প্রভু এমন ভাবেই দেয়। প্রতিটা পুরষ্কার সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। শুধু আমরা তাড়াহুড়া করে নিজেদের পাপ বাড়াই।
একে একে আরও ২৫জন মেয়ে তিতিরের হাতে পঁচিশটা গোলাপ ফুল দিল। তিতির হেটে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই সামনে মাহাদকে দেখলো। মাহাদকে দেখে তিতির চমকে উঠলো। ও এতদ্রুত এখানে কি করে!
কালো ও গোল্ডেন কালারের সমন্বয়ে একটা শেরওয়ানী পড়েছে সে। সাথে পাজামা ও গলায় জড়ির ওড়না। তিতির অবাক হয়ে গেল। এ কোন মাহাদকে সে দেখছে। এমনিতেই মাহাদ অত্যান্ত সুদর্শন পুরুষ। আজ এমন সাজে তাকে রাজপুত্রের বেশি ছাড়া কম দেখাচ্ছেনা। মাহাদকে দেখে তিতিরের মনে সেই কিশোরীর উন্মদনা এসে ভর করলো। আজ কিছু হতে চলছে। ইয়েস আজ কিছু হতে চলেছে।
মাহাদ এসে তিতিরের হাত ধরে বাসার ভিতরে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হতেই উপর থেকে শতশত বেলুন আর ফুলের পাপড়ীর বৃষ্টি ঝড়তে লাগলো। এমন কান্ডে তিতির চমকে উঠে মাহাদের হাত শক্ত করে ধরলো। মাহাদের সব ফ্রেন্ডগুলো বেলুন ফাটাতে তখন ব্যস্ত হয়ে গেল। হাতে পিন নিয়ে যে যত পারছে বেলুন ফাটাচ্ছে। চারদিকে বেলুন ফাটার শব্দে যেন মুখরিত। সবাই ছোটবেলায় যেন প্রবেশ করেছে। এ যেন এক কৈশোরসুলভ মিলনমেলা । সবাই নিজেদের শতভাগ ভাবে উপস্থাপন করছে অনুষ্ঠানে। আজ তিতিরের জন্য একটা প্রাপ্তির রাত। কে বলেছে তিতিরকে কেউ ভালোবাসেনা! এত এত মানুষের ভালোবাসা কম নাকি!
এমন সময় হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে উপস্থিত সবার সামনে মাহাদ হাটু ভাজ করে তিতিরের হাত ধরে আদুরে স্বরে বলে উঠলো-
~" তিতির, আমাকে কি আবার বিয়ে করবে?"
সবার সামনে এমন প্রস্তাবে তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। মাহাদ এই পর্যায়ে এসে আবার বিয়ে? আর কতবার বিয়ে করবো?
তুমি চাইলে হাজার বার বিয়ে করতে পারবো বলেই মাহাদ ওর ফ্রেন্ড মিনহাজ হুযুরকে ডাক দিল। এই মিনহাজ কই তুই! আজ যে আবার তোকেই বিয়ে পড়াতে হবে।
সবার ভিড় ঠেলে মিনহাজ হুযুর খুশি মনে ওদের কাছে এগিয়ে এসে বলল-
~" কি সৌভাগ্য আমার। একই জুটির আবার বিয়ে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। এ যেন সোনায় সোহাগা একটা ব্যাপার।"
তিতির সবার দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবাই উপস্থিত। একজনও বাদ নেই। ঠিক তত জনই উপস্থিত যতটা সাত বছর আগে বিয়ের দিনে উপস্থিত ছিল। আনন্দে চোখে অশ্রু এসে জানান দিল আজ তারা কতোটা খুশি। দুইটা মেয়ে মাহাদ আর তিতিরের হাতে ব্লাক, হোয়াইট আর রেড গোলাপের সমন্বয়ে তৈরি দুটি বর মালা দিল।
মাহাদের মেয়ে ফ্রেন্ডরা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো-
~" তিতির দেখ, মাহাদ যেন সহজে তোমায় মালা পড়াতে না পারে। আজ আমরা মেয়েরা জিততে চাই।"
মাহাদ মুচকি হেঁসে বেশ জোড়েই বলে উঠলো-
~" তোদের কাছে আমার বউকে রাখলে তোরা আর ওকে ঠিক রাখবিনা দেখছি। দু'দিনে আমার সংসারে আগুন ধরাবি। এত প্রতিযোগিতা কিসের?"
মাহাদের কথা শেষ হতেই ওর এক বন্ধু বলল-
~" দোস্ত, তুই তিতিরের থেকে অনেক লম্বা তাই তিতির সহজে তোকে মালা পড়াতে পারবেনা। আমরাই বিজয়ী। শুধু একবার হারতে দে ওদের! তারপর দেখ, ওদের কেমন নাগীন ড্যান্স নাচাই।"
এবার তিতির সবার সামনে বলেই ফেলল-
~" শোনেন, আল্লাহর কুদরতি শক্তি নারীদের অসংখ্য গুনে গুনান্নিত করেছেন। এই জন্য নারীরা বড় থেকে বড় কষ্ট সহ্য করেও একটি বংশকে একত্রিত করার ক্ষমতা রাখে। যেটা আপনাদের নেই। তাই আমাদের দুর্বল ভাবার কোন চান্সই নেই। এজন্য সাবধান আমাদের থেকে......! বলা যায়না উল্টে আপনারাই হেরে গেলেন।"
মাহাদের বন্ধুটি আরও কিছু বলতে যাবে এমন সময় মাহাদ সামনে রাখা ফুলের তোরাটি ঐ বন্ধুর দিকে ছুড়ে মেরে বলল-
~" শালা.....তোরা আমার ফ্রেন্ড না শত্রু! জানিসনা, লেডিস ফাষ্ট! এদের ক্ষেপালে বেড আর ডাইনিংটেবিল দুই জায়গায় উপোস করে থাকতে হবে! তোর বউকে কল দিয়ে কি তোরে ফাপড় দেওয়ার ব্যবস্থা করাবো! শুধু একবার হ্যা বল! তারপর দেখ কি হয়! তোর নিজের বাসায় ঢোকার ব্যবস্থা আজ সত্যিই বন্ধ করে দিব।"
সোহাগ দু'হাত তুলে জ্বিভ কেটে বলল-
~" মাফ চাই দোস্ত! তোর মুখে যা শুনবে সে তাই বিশ্বাস করে শেষে আমাকেই নাগীন ডান্স নাচাবে। এরা জাতটাই একটা ভয়ংকর জাত। জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক থাকে। স্বামীদের ফাপড় কিভাবে দিতে হয় এরা সেই বিষয়ে চুড়ান্ত পারদর্শী।"
সব যখন বুঝিস তো ঝামেলা লাগাচ্ছিস কেন? মাহাদ কথাগুলো বলেই তিতিরের কাছে গেল। এবং চোখের পলকে তিতিরের গলায় বর মালা পড়িয়ে দিল। তারপর কোমড়ে হাত দিয়ে কনফিডেন্সের সাথে বলল-
~" আমি না চাওয়া অবদি তুমি আমায় মালাটা পড়াতে পারবানা।"
কথাটা মাহাদ মিথ্যা বলেনি। মাহাদের গলে মালা পড়াতে ওকে কাঠখড় কম পোরাতে হবেনা। তারমধ্যে উচ্চতার কথা না হয় নাই বলা হল।
তিতির মুখটা কাচুমাচু করে মাহাদের দিকে চাইতেই মাহাদ ভ্রুজোড়া নাচিয়েই তিতিরের সামনে হাটু ভাজ করে বসে পড়ল।
অ....হো বলে সবাই চিৎকার দিতেই তিতির দ্রুত মাহাদকে মালা পড়িয়ে দিল।
অবশেষে আবার সেই ৬৫ জনকে সাক্ষী রেখে বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হল। সবাইকে সাক্ষী রেখে আবার তাদের বিয়ে পড়ানো হল। সাত বছর আগে যেমন যেমন ভাবে বিয়ে সম্প্রদান করা হয়েছিল আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা।
শেষে মাহাদ সবার উদ্দেশ্য একটা কথাই বলল-
~" ♥বিয়ে এমন একটি সুন্দর বন্ধন যাতে প্রেম, ভালোবাসা ও মিষ্টতা আছে। এমন মিষ্টতার স্বাধ আর কোন বন্ধনে অনুধাবন করা সম্ভব নয়♥"
ছোট মেয়েটার জন্য তিতির বেশিক্ষণ অনুষ্ঠানে থাকতে পারলোনা। মাহাদের সাথে কয়েকবার ক্যামেরা বন্দি হয়েই তাকে নিয়ে যাওয়া হল মাহাদের সেই রুমে। কি আশ্চর্য, সেই একইভাবে রুম সাজানো আছে। যা দেখে তিতিরের মনে হল, সাত বছরের সেই সময়ের কিছুক্ষন আগে রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আর কিছুক্ষন পরে রুমে আবার ফিরে আসলো। এটা সেই রুম, যেখানে মাহাদের সাথে একটু দেখা করার জন্য ব্যালকুনি পর্যন্ত টপকাতে হয়েছিল তাকে। সমস্ত ভাবনার মাঝেই মনে পড়লো সাদের কথা। সাদ কই?
সাদের কথা জিঙ্গাসা করতেই সাবিনা বলল-
~" আপা, সাদতো আম্মার ঘরে। সাহেব তারে লইয়া ঘুমাই পড়ছে।"
আচ্ছা বলে তিতির অতিথীকে নিয়ে ফিডিং করাতে লাগলো। মেয়েটা ঘুমাবে বলে উস খুস করছে।
♥
বাসার এমন অনুষ্ঠানে সবাই খুশি হলেও নিসা এবং বাতাসি বিবি মোটেও খুশি নন। বরং তারা নানান কটু কথা বলতে লাগলো। এই বয়সে আইসা ঢং। দুই বাচ্চার বাপ-মা হইয়া আবার বিয়ার পিড়াতে বহন লাগবো! খাড়া মাহাদ, আইও কম না। আই ইমতিয়াজ চেয়ারম্যানের বউ। এবার তোরে খেলা দেহামু। ঐ মাইয়া আমাগো কাছ থাইকা তোরে কাইড়া নিছিল এতদ্দিন ধরে। কতবার কইছি বাড়ীত ফিরে আয়। কিন্তু আছোস নাই। এর ফল তো তোর বউরে ভোগ করতেই হইবো।
বাসা ভর্তি মেহমানদের আপ্যায়ন শেষে সবাই চলে যেতে রাত বেশ গভীরই হল। কাজের লোকদের সব কাজ দেখিয়ে দিয়ে মাহাদ নিজের রুমে আসলো। কতদিন পর নিজের রুমে আসলো সে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে রুমটা জড়িয়ে। তিতির খাটে মাথাটা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। হয়ত সে ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরোদিনে ধকলতো আর কম গেলোনা। মাহাদ ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসতেই দেখলো, তিতির দাড়িয়ে আছে। তিতির এত সুন্দর একটা নারী যে, ও যেটা পড়বে সেটাতেই ওকে বেশ মানায়। সুন্দরী নারী-পুরুষদের এটা একটা প্লাস পয়েন্ট।
মাহাদ টাওয়ালটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুতই তিতিরের দিকে এগিয়ে আসলো। তিতিরকে এখন দেখতে ঠিক নববধূর মত লাগছে। যেটাতে মাহাদের বেশ একটা নেশার কাজ করছে। কোন কারন ছাড়াই মাহাদ তিতিরের কাছে গিয়ে ওর কপালে একটা চুম্বন খেল। একটাতে মাহাদের মন ভরলোনা, তাই আরো কয়েকবার চুম্বন খেয়ে নিজের মনকে তুষ্ট করলো। মাহাদের একটা সমস্যা আছে সেটা হল, কোন কাজে যদি ওর তৃপ্তি না মেটে তাহলে তা পরপর আবার করতে থাকে। সেটা যেকোন কাজই হোকনা।
মাহাদের এমন আলিঙ্গনে তিতির খানিকটা লজ্জায় পড়ে গেল। বিয়ের এত বছর হয়ে গেল তবুও মাহাদ তিতিরের লজ্জা ভাঙ্গাতে পারেনি। তিতিরের এমন লজ্জাময় চাহোনি মাহাদকে মাতাল করে তোলে। তবুও মাহাদ নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রনে রেখে উপদেশ স্বরূপ কণ্ঠে বলে উঠলো-
~" দিন শেষে যে স্বামীর নিকট তোমার কাপড় খুলতে হয়, সেই স্বামীর সামনে কেন এত জড়তা, ভয়, লজ্জা, ইগু! কেন এখনো স্বাভাবিক হতে পারোনা? কেন আমাকে সহজভাবে নিতে পারোনা?"
মাহাদের কথা শুনে তিতিরের গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আর এমন দৃশ্য দেখে মাহাদ রাগচটা কন্ঠে বলল-
~" নাহ্ এমন করে হবেনা। দেখছি ওর লজ্জাই আগে ভাঙ্গাতে হবে। দেখি কতক্ষন এই লজ্জার চাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতে পারো। আমিও আজ দেখতে চাই কতক্ষন তুমি এমন ভাবে থাকতে পারো।"
এবার তিতির চোখ বন্ধ করে মাহাদকে আলিঙ্গন করতে লাগলো। এ যেন এক অনবদ্য প্রেমকাহিনী। তিতির ডুবে গেল মাহাদের মাঝে। কিন্তু লজ্জায় চোখ মেলে তার প্রেমিক পুরুষ নামক স্বামীর দিকে তাকাতে সাহস পেলোনা। নাহ্ মাহাদের কাছে ব্যাপারটা বেশ মজারই লাগছে।
এমন করেই এই বাসায় প্রথম রাত কাটলো তিতির আর মাহাদের।
♥
সকালে বাতাসি বিবি তার লাডি খানে ভালো করে সরিষার তেল মালিশ করে চকচকে করে তুলছে। গোলাব যখন এই বাসায় প্রথম এসেছিল তখন বাতাসি বিবি লাডিখান তৈয়ার করেছিল। এতদিন পর আবার সেই লাডিতে তাও মারছে। এবার যদি ভুলেও গোলাব তার ঘরে আসে তাহলে এক বারিতেই ঐ কুত্তারে সে কুপোকাত করে ছাড়বে। এমন সময় সাবিনা ঘরে এসে কৌতুহলী হয়ে বলল-
~" দাদী কি করেন?"
~" কি করি দেখবার পারোসনা! দেইখা আবার জিগাস ক্যান? হারামজাদি কুত্তারে মারার জন্য লাডিখানরে ধার দেই।"
~" দাদী আবার ভুল কতা কইছেন! হেই তো ব্যাটাছাওয়াল কুত্তা। হেইরে হারামজাদা কইতে হয়।"
~" ঐ হইলেই হল একটা। দেখতো, কামু ঘুম থাইকা উঠছে কিনা? হের লগে আজ অ্যার মিটিং আছে। জলদি তারে ডাক।"
যাই দাদী বলে সাবিনা আধা দৌড় দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আর বাতাসি বিবি বেশ তীক্ষ্ণ নজরে তার লাঠিখানা পরীক্ষা করতে লাগলো।
.
সবাই সকালের নাস্তা করতে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। কিন্তু কামরান সাহেব আসতে লেট করলো। ছেলের লেট দেখে বাসার সমস্ত মানুষের সামনে কামু বলে একটা চিক্কুর ছাড়লো বাতাসি বিবি। বেচারা কামরান সাহেব টাই বাঁধতে বাঁধতে আধা দৌড় দিয়ে তার আম্মাজানের কাছে এসে দাড়ালো। তারপর খানিকটা অভিমানের স্বরে বলে উঠলো-
~" আম্মাজান এমন করে সবার সামনে না ডাকলেই কি নয়! আপনার ছেলে একজন দেশের মন্ত্রী। বাহিরের মানুষদের সামনে কেন নাম নিয়ে আমাকে বেইজ্জতি করেন? আপনার ছেলের একটা সম্মান আছেনা? এমন করে সবার সামনে সম্মান নিয়ে যদি টানাটানি করেন তাহলে বাহিরে মুখ দেখাব কেমন করে?"
ছেলের কথা শুনে বাতাসি বিবি মুখে রসগোল্লা পুরে চোখদুটো বন্ধ করে গলায় গম্ভীরতার ভাব এনে বলল-
~" অ্যার সেক্রেটারি সাবিনা, হেই তোরে কিছু কয়নি?"
কামরান সাহেব সাবিনার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের মায়ের দিকে চেয়ে ভয়ে ঢোক গিললো। আল্লাহ্ মাবুদ জানে, তার আম্মাজান আজ তাকে কি সম্মানহানী করার পরিকল্পনা করেছেন। আমার সম্মান নিয়ে খেলতে উনি একটু বেশিই মজা পান। তিনি মিনমিনিয়ে বললেন-
~" জ্বী বলেছে। কিন্তু গোসল সারতে দেরী হয়ে গিয়েছিল তাই আসতে দেরী হল।"
কথাগুলো বলে কামরান সাহেব নিজের চেয়ারে বসে সাদের দিকে হাত বাড়াতেই সাদ ওর দাদুর কাছে গিয়ে চুপটি করে বসে পড়লো। নিজের খাবার থেকে পরম আদরে সাদকে খাবার খাওয়াতে লাগলো। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে বাতাসি বিবি বুঝি একটু বেশিই রেগে গেলেন। তাই কাউকে তোয়াক্কা না করে ভরা বাজারের মাঝখানে বাতাসি বলেই ফেলল-
~" ডুব দিতে এত দেরী হওয়ার কারন! বউরে লইয়া কি গোসলখানায় গোল্লাছুট খেলছোস নাকি! যার জন্য দেরী হইলো। তগো মধ্য তো আবার মাঝেমাঝে দৌড়ানির দাপট চলে। বউরে লইয়া গোল্লাছুট কি কম খেলন যায়না? এই বয়সে আর কত্ত!"
সবার সামনে এমন কথা শুনে লজ্জায় লাবীবা লাল হয়ে গেলেন। তার শাশুড়ী আজ বুঝি সম্মানের গোষ্ঠীর ষষ্ঠী উদ্ধার করেই ছাড়বেন। সব ছেলেরা বড় হয়ে গেছে তার উপর বিয়ে করে ফেলেছে। তাদের সামনে এমন কথা কোন আক্কেলে তার শাশুড়ী বলে! তার কি লজ্জা বলেও কিছু নেই? এমন কথা সবার সামনে কেউ বলে?
শুধু লাবীবা লজ্জা পায়নি সাথে রুপালী, তিতির, মৌ, নিসা সহ সবাই লজ্জা পেয়ে কোথায় মুখ লুকাবে সেটাই ভাবছে। আর কামরান সাহেব সাদকে খাবার খাওয়ানো বন্ধ করে তার মায়ের দিকে ফ্যালফালিয়ে চেয়ে রইল। অলরেডি তার লজ্জায় মাথা কাটা গিয়েছে।
বাতাসির কথা শুনে প্রথমে মাহাদ রেগে গেল। বৃদ্ধ বয়সেও কোন মা তার ছেলের সম্মান নিয়ে টানাটানি করে সেটা বাতাসিকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবেনা। মাহাদ দাঁত কটমট করে বাতাসির দিকে চাইতেই বাতাসি এমন ভাব করলো যেন মনে হয় সে কিছুই বলেনি। তাই চোখ ঘোর করে বলল-
~" ওমন কইরা অ্যারে কি দেহস! অ্যার মত সুন্দরী কাউরে দেখোস নাই! তোরে মানতে হবে, অ্যাই তোর বউয়ের থ্যাইকাও খুব সুন্দর।"
বাতাসির কথায় মাহাদ কিছু বললোনা কিন্তু ঐ ভাবেই চেয়ে রইলো বাতাসির দিকে। মাহাদের এমন রগচটা চাহোনি দেখে বাতাসি বিবি মুখ বেঁকিয়ে আরো কথায় ধার দিয়ে আবার বলল-
~" কিরে ওমন গটগট চোক্কে অ্যারে কি দেহস! অ্যারে কি জন্মেও দেখোস নাই! অ্যারে ভয় দেহাস! আই তোরে ভয় করিনা।"
মাহাদ এবার খাবার রেখে উঠে দাড়াতেই বাতাসি বিবি ভড়কে গিয়ে নিজেকে গুটিসুটি করে অসহায় চোখে মাহাদের দিকে চাইলো। সিংহ তার তেজ প্রথম দিনই দেখাতে শুরু করেছে। বাতাসি বিবি থতমত করে বলল,
মাহাদ, কি করবার চাস বলতেই মাহাদ বাতাসির হাত ধরে টেনে তুলে একপ্রকার জোড় করেই তার রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
মাহাদের এমন কান্ডে রুপালী না হেঁসে আর পারলোনা। এই একমাত্র মাহাদই তার আম্মাজানরে ঠিক করতে পারে। নচেৎ আম্মাজান সবার মাথার উপর ঢোল বাজিয়েই চলে। এবার ঠিক জায়গায় পড়েছে। রেজওয়ান মুচকি হেঁসে বলল-
~ " মা, কথাগুলো ঠিকি বলেছেন। মাহাদ ছাড়া নানীরে কেউ সোজা করতে পারেনা।"
রেজওয়ানের কথা শুনে তিতির বাঁকা চোখে রেজওয়ানের দিকে চাইলো। সত্যিই কি, রেজওয়ান নিজেকে পরিবর্তন করেছে নাকি পরিবর্তন হওয়ার ভান করছে। আগের বার শুধু মাহাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার উপর হামলা করেছিল। হায়াত ছিল বলে এখনো বেঁচে আছি। নাহ্ অনেক হয়েছে। এরা শুধু আমার দুর্বলতা দেখেছে কিন্তু শক্ত তিতিরকে দেখেনি। এবার যদি আমার স্বামী বা সন্তানের কেউ বিন্দু পরিমান ক্ষতি করতে চায় তাহলে তাদের আমাকে আগে ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে। আমিও দেখতে চাই, কে কত খেলা দেখাতে পারে। আর কার কত জ্বালা আছে, সবার জ্বালা আর তেজ এবার মিটিয়েই ছাড়বো।
আল্লাহ্ সুবহানাতালা আমার এত প্রখর মেধা কেন দিয়েছেন! সেটা যদি কাজেই না লাগাতে পারি তাহলে মেধা দিয়ে আমার লাভ কি?
এদিকে বাতাসিকে খাটে বসিয়ে রেখে মাহাদ তার দিকে একটু ঝুকিয়ে যেতেই বাতাসি বিবি লাফিয়ে উঠে বলল-
~ "মাহাদ, ভালো হইতাছেনা কিন্তু! তুই কি করবার চাস?"
বাতাসির এমন ভিতু চেহারা দেখে মাহাদ বেশ মজাই পেল। আমাকে তোমার ভয় পে..তে হবে বাতাসি! বাপের উপরও যে বাপ থাকে সেটা আজ তোমায় দেখাবো। সব জায়গায় ভিমরতি! বাবার সম্মান পযর্ন্ত তুমি রাখোনি তার সন্তানদের কাছে। আজ তোমার সম্মানই রাখবোনা। তোমার সম্মানের আজ ফালুদা বানিয়েই তবে ছাড়ব। এবার মাহাদ দুষ্টুমির একটা হাসি দিয়ে বাতাসির দিকে একটু ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলল-
~" একটা বউরে দিয়ে হচ্ছেনা। তুমিতো আমার পার্মানেন্টলি বউ। তাই তোমায় ছাড়া থাকতে পারি! তুমিই তো বল, আমি নাকি তোমার সোয়ামী! তাই তোমার ভাষায়, তোমাকে সোহাগ করতে আসছি। এত ভয় পেলে চলবে?"
~" অহ্ আল্লাহ্, ও ছিকো, অ খোতে। ইমতিয়াজ চেয়ারম্যান ছিল এক লুচ্চা বেডা। এহন দেহি তার লাতীও লুচ্ছা সহ ছোচনা। অ বাপজান অ্যারে কোন ঘরে বিয়া দিছেন! কব্বর থাইকা একবার উইঠা আইসা দেহেন, আপনের কন্যার কি হাল করছে এই বাড়ীর সগ্গলে। আল্লাহ্ মাফ কইরা দেন। অ্যার লাতী অ্যার সাথে কি আকাম-কুকাম করবার চায়। বাচাও অ্যারে কেউ বাচাও।"
মাহাদ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ওর দাদীকে জোড়ে একটা ধমক দিয়ে শাসিয়ে বলে উঠলো-
~ " বাতাসি, ফের যদি দেখেছি এমন নোংরা ভাষায় কথা বলছো, তাহলে তোমার একদিন নয় আমার একদিন! বাসায় এত ছোটছোট বাচ্চারা রয়েছে আর তুমি ভিমরতির খেলা ধরেছ!
তাদের সামনে তুমি কিভাবে এমন ভাষায় কথা বল! তোমার লজ্জা বলতে কিছু নেই ! এমন কথায় ওরা কি ভালো কিছু শিখবে তোমার কাছে?
আবারও বলছি, বাবার সাথে যেন এমন ভাষায় তোমাকে কথা বলতে না শুনি। তোমার ছেলে হয়ে সে তোমায় মাফ করবে কিন্তু আমি না। তোমার অতীত রের্কড কিন্তু আমি ভুলিনাই। তাই সাবধান!"
কথাগুলো বলে মাহাদ রুম থেকে বের হয়ে এল। তারপর শান্তশিষ্ট ভাবে নিজের নাস্তা শেষ করে অফিসে চলে গেল।
বাতাসি বিবি হয়ত মাহাদ চলে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। মাহাদ চলে যেতেই রুম থেকে বের হয়ে নিজের ছেলের সামনে মরা কান্না জুড়ে দিল। আই হাফ লেডি পুত জন্ম দিছি। যে মায়ের অপমানে কোন কতা কয়না। সব ঐ মাইয়ার জন্য হয়েছে। কই আগেতো মাহাদ অ্যার সাথে এমন কান্ড করে নাই! আর আজ একেবারে ইজ্জতের উপর হামলা! আই ভাগ্গিস বুড়া হইছি। আগের রুপ থাকলেতো অ্যারে আজ ছাইড়া দিতোনা। অহ্ আল্লাহ্ বুড়ী বানাইয়া দিয়া আজ অ্যার ইজ্জত বাচাইছো। আজ মনে হইছে বুড়ী হওনের ফায়দা আছে।
দাদী শাশুড়ীর কথা শুনে ফুয়াদের বউ নিসা বেশ ক্ষেপে উঠে বলল-
~ " দাদী সব সময় কি বেহুদা কথাবার্তা বলেন? বয়স হচ্ছে আর দিনকে দিন আপনার ভিমরতি বেড়েই চলছে। এমন কথা বার বার বললে তো দেখছি, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে থাকা দায় হয়ে পড়বে।"
ব্যস হয়ে গেল। নিসার কথা শুনে বাতাসি চেতে উঠলো। ঐ সাপুড়ার বাচ্চা কালসাপ! আই যা কমু তা তোরে শুনতে হইব। না শুনলে এখুনি বাড়ীত থাইকা বাড় হইয়া যা। তোর তো কায়াই নাই। যারে পাবি তারে ছোবল মারবি। তোর কোন গুনের অভাব আছে! তোর এত্ত গুন থুইয়া তুই অ্যার গুন খুজোস!
উম,,,অ্যারে কয়! অ্যার ভিমরতি জাগছে? বেডি তুই নিজেই একখান ভিমরতির পাঠশালা। আজ আর সোয়ামী মাহাদ আসুক। আগে তোর বিচার হব, তারপর আই ভাত গিলুম।