মাহাদ মোনাজাত শেষ করে হাত নামিয়ে বলল," তিতির আল্লাহ্ সুবহানাতালা আমাদের কথা শুনেছে তো! এখানে খুব শীত পড়ছে, এখন রুমে চল।"
"আল্লাহ্ সুবহানাতালা আমাকে সন্তান দিবেতো মাহাদ!"
"ইনশাল্লাহ্ অবশ্যই দিবেন। এমন ভাবে আল্লাহ্ কে ডাকলে আল্লাহ্ তাকে কখনও খালি হাতে ফেরত দিবেন না। তুমি জানোনা, মোনাজাতে শিশির ভেজা আঁখির মূল্য, আল্লাহ্ স্বয়ন নিজ দয়ায় দেন। মোনাজাতে অশ্রু নিবেদিত ডাক আল্লাহ্ কখনও অগ্রাহ্য করেন না। অনেক সময় অশ্রু বিগলিত মোনাজাত মানুষের ভাগ্যকেও বদলে দেয়।"
"মাহাদের কথা শুনে সাথে সাথে তিতির বলে উঠল, " সুবহানআল্লাহ্।"
মাহাদ জায়নামায থেকে তিতিরকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে রুমে আসল। ওকে বেডে বসিয়ে দিয়ে ব্যালকুনিতে এসে জায়নামায গুছিয়ে থাইটা লাগিয়ে দিয়ে তিতিরের কাছে এসে বলল," ব্যালকুনিতে গিয়ে নামায কেন পড়ছিলে? রুমে পড়লে কি হত? আমার ঘুম না ভাঙ্গার জন্য নামায পড়লে তো, কিন্তু সেই তো আমি ঠিকি উঠে তোমার সাথে মোনাজাতে শামিল হলাম?"
তিতির ওর চোখের পানি মুছে বলল," আপনি কখন উঠেছেন?"
"তুমি যখন ব্যালকুনিতে চলে গেলে তার একটু আগে। উঠে গোসল দিছি, সালাত আদায় করেছি তারপর তোমার কাছে গেছি। ভাবলাম তুমি নির্জনে আল্লাহর কাছে সময় কাটাতে চাও তাই আর বিরক্ত করি নাই।"
"আপনার সব কাজ শেষ?"
"হুম শেষ, ফযরে ডেকে দিওতো বলে মাহাদ ওর পাঞ্জেবী খুলে একটা ট্রী শার্ট পড়ে বেডে শুয়ে পড়ল।"
"আপনি ঘুমাবেন? কিন্তু আমিতো আপনাকে আর ঘুমাতে দিবনা....."
" কেন ঘুমাতে দিবানা......! মনে কি আবার সুমতলব জেগেছে নাকি বলেই মাহাদ একটা মুচকি হেঁসে উঠল।"
" উফ্ আপনি একটু বেশি বোঝেন কেন? আমি যা বলতে বা করতে চাই সেটা আপনি আগেই কেন বুঝে ফেলেন? সারপ্রাইজ বলেও তো কিছু একটা আছে। এভাবে সব কিছু বুঝে ফেললে চলবে কি করে?"
" চলবেনা মানে! তুমি চাইলে তো দৌড়াবে তিতির। আমি তোমাকে বুঝি বলেইতো, আমাদের সমস্যা গুলো আমি মিটিয়ে ফেলতে পারি। আর সমস্যাগুলো যদি তোমার উপর ছেড়ে দিতাম তাহলে মারা গিয়ে কবরে দুর্বা ঘাস উঠে গেলেও তুমি সেগুলো সমাধান করা তো দুরে থাকুক আরও সেগুলো জটিল করে ফেলতে।"
" আপনি আমাকে খোটা দিচ্ছেন?"
" নাহ্, আমি কেন তোমার খোটা দিব! আমার কি তোমাকে খোটা দেওয়ার সাধ্য রয়েছে? আমি তো তোমাকে,,,,,,,,, কোথা থেকে কি শুরু করবো সেটাই ভাবছি।"
" মানে....! কি শুরু করবেন?"
" নাহ্ কিছু তো করবোনা। মাহাদ দুষ্টমি একটা হাঁসি দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।"
" এই এই আপনি চোখ বন্ধ করলেন কেন? আপনি চোখ খোলেন বলছি! আপনাকে চোখ বন্ধ করার অনুমতি তো দেইনি আমি।"
" সব কাজে কি তোমার অনুমতি নিতে হবে! আমার তো মনে হয় কিছু কিছু কাজ বাঁধ ভাঙ্গিয়ে মনের আনন্দে করতে হয়। উম্ মনে কর, তোমার গোলাপি ঠোট যখন দেখি, তখনই মনে হয় আমার মন তোমাকে পাওয়ার জন্য সম্পূর্ন মাতাল হয়ে যায়। তখন নিজেকে সামলানো খুব দায় হয়ে পরে। তখন কি তোমার অনুমতি নিতে হবে!"
"হ্যাঁ, ঢের অনুমতি নিতে হবে। বিনা অনুমতিতে নো টার্চ। সারা শরীরে পোষাক না থাকলেও টার্চ করা যাবেনা।"
" হুম, এতদিনে তুমি আমাকে কত কি করার ট্রাই করেছ তবুও নিজেকে মাঝে মাঝে কন্ট্রোল করে রাখতে আমাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে বলে মাহাদ পাশ ফিরে সুয়ে পড়ল।"
" আপনি আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন? ভালো হচ্ছেনা কিন্তু। আমি আপনার সাথে গল্প করবো এবং ঝগড়া করবো।"
" মাহাদ কোন শব্দ না করেই ঝট করে উঠেই তিতিরের কাছে বসে পড়ল। সাথে সাথে তিতির ভয়ে কেঁপে উঠলো। মাহাদের এমন ব্যবহার তিতিরকে চমকে দেয়। এতে তিতির বেশ ভয় পেয়ে যায়।"
"এইনা তুমি কাছে আসতে বল! আসলাম আর ভয় পেয়ে গেলে?"
" এভাবে কেউ কাউকে ভয় দেখায়?"
" আমি দেখায় বলে মাহাদ তিতিরের শাড়ীর আচল টান দিয়ে গলা আর কাঁধ উন্মুক্ত করে ফেলল। মাহাদের দৃষ্টি ঐ গলার নিচে তিলটার প্রতি। ♥বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম♥ বলে মাহাদ তিতিরের গলায় মুখ ডুবাল। মাহাদের কাছে মনে হচ্ছে এটা একটা নতুন তিতির। যার সাথে আগে কখনো তার দেখা হয়নি। কারন তিতির আজ অন্য রকমই ব্যবহার করছে। মাহাদ সেদিকে খেয়াল না করে তিতিরের মাঝে ডুবে যেতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আজ মনে হয় তিতির একটু বেশিই আগ্রাসী।"
কিছুদিন পর,
মাহাদ আর তিতির এভাবে একসাথে ১৯ দিল কাটালো। চিটাগাং, কক্সবাজার, দারুচিনির দ্বীপ সহ আরো অনেক দর্শনীয় স্থান চষে বেরিয়েছে দু'জনই। অফিসের কিছু কাজ ছিল, মাহাদ সেগুলো নিপুণ হাতে সম্পূৃর্ন করেছে। মাহাদ তিতিরকে এই কটাদিন একদমই নিজের কাছ ছাড়া করেনি। ২০ দিনের দিন মাহাদ তিতিরকে নিয়ে ঢাকাতে ব্যাক করে। ঢাকায় ফিরে মাহাদ ওর ফোন খুলল। আর সাথে সাথে ওর মায়ের নাম্বার থেকে কল আসল। নাহ্ এটা ওর মা নয়। এটা বাতাসি ছিল।
এই হতচ্ছাড়া এতদিন কই ছিলি? তোকে কতবার কল দেওয়া হয়েছে দেখ। টিনের চশমা খুলে দেখ! দুনিয়াতে কিয়ামত হয়ে গেলেও দেখছি তোর খোঁজ মিলবেনা। কই ছিলি বল.....!
" বাহ্ তোমার কথার পরিবর্তন হয়ে গেছে দেখছি। এই হতচ্ছাড়াটা তার হতচ্ছাড়ির সঙ্গে হানিমুন সেরে আসলো হতচ্ছাড়ার দাদী! হানিমুন মানে কি, তাতো তুমি বোঝ নিশ্চয়?"
" তুই আবার ঐ মাইয়ার কাছে গেছস? ঐ মাইয়া তোরে কিছু দিতে পারবো ক!"
" ও যা দিতে পারবে তা পৃথিবীর আর কেউ দিতে পারবেনা। তাই তুমি তোমার নিজের চরকায় তেল দাও। আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা বলে কল কেটে দিল মাহাদ।"
মাহাদ ফোনটা চেক করে দেখল, এর মধ্য ফুয়াদও প্রায় ৮৬ বারের মত এই ক'দিনে কল দিয়েছে। ভাইয়া এতবার কল দিয়েছে বলে ফুয়াদকে কল দিল মাহাদ। কিন্তু রিসিভ হলনা। হয়ত বিজি আছে।
তিতিরকে বাসায় নিয়ে এসে মাহাদ ওর দু'টো হাত ধরে অনুরোধ করে বলল," আর এমন কোন ডিসিশন নিওনা যেটাতে আমার কষ্ট হয়।"
"তিতির শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।"
"দেখ তিতির, এবার কিন্তু তোমার অপরাধ আর মাফ করবোনা। তোমাকে শাস্তি দিতে কিন্তু কোন মানুষজন আর দেখবোনা আমি। সবার সামনে শাস্তি দিব। তাই যেখানেই যাওনা কেন হয় আমার সাথে যাবে না হয় আমাকে ইনর্ফোম করবে বুঝেছ?"
" বললামতো বুঝেছি। তারপরও কেন এত বকাবকি করছেন!"
" স্বাধে আর থের্ড দেই! তোমার মাথায় কখন কি কুবুদ্ধি এসে হামলা করে সেটার জন্যই তো যত ভয়। কারো কথায় কান দিবানা। পৃথিবী ধংস হয়ে যাক তবুও আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার কথা একবারও মনে আনবেনা। কে কি বলল সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা দু'জন দুইজনাকে কতটা ভালোবেসে কাছে আসতে পারি সেটাই মূল বিষয়।"
" জ্বী"
মাহাদ অনেকক্ষন যাবত তিতিরকে জড়িয়ে ধরে রইল। তারপর অনেক আদর আর ভালবাসা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
তিতির ব্যালকুনিতে দাড়িয়ে মাহাদের চলে যাওয়া দেখল। তিতির এই ১৯ টা দিনের কথা জিবনেও ভুলতে পারবেনা। মাহাদ এই ক'দিন ওর পাশে ছায়ার মত ছিল। মাহাদ ওকে এত এত এত ভালবাসা দিয়ে পূর্ন করে ফেলেছে যে হাজার বছরের ভালোবাসার দিন-রাত্রিও তার সমান হবেনা। তিতির খুব খুঁশি। ওর জিবনে এতটা ভালো সময় কোনদিনও আসেনি।
♦♦♦♦
ফুয়াদ অফিসে বসে আছে। ওর টিম একটা গ্যাং কে ১লক্ষ পিস ইয়াবা সহ গ্রেফতার করেছে। সব সাংবাদিকগন ফটো তুলতে ব্যস্ত। ফুয়াদ ভিষন চিন্তার মধ্য রয়েছে। কারন যেই গ্যাং কে তারা গ্রেফতার করেছে তারা কোন সাধারন স্মাগলার নয়। সরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছের লোক। এর ভার যে কি পড়বে ফুয়াদের উপর সেটা ফুয়াদ নিজেও জানেনা।
এর মধ্য দেশজুড়ে ফুয়াদ ও তার টিমের প্রসংসায় মেতে উঠেছে। এর জন্য তাকে আরও উচ্চ পর্যায়ে প্রমোশনও দিয়েছে সরকার থেকে। কিন্তু সবকিছু এত দ্রুত হওয়া ঠিক নয়।
তিন দিন পর,
সকাল ১১ টার দিকে কামরান সাহেব হানতান হয়ে ফুয়াদের নাম্বার ডায়েল করেই চলছে। কিন্তু ফুয়াদ মিটিং এ ব্যস্ত বলে ফোন ধরতে পারেনি। এদিকে কামরান সাহেবের চোখমুখ শুখে গেছে। এসির মধ্যও ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। কামরান শেষে মাহাদকে কল দিল।
"হ্যাঁ বাবা বলেন।"
" মাহাদ, ফুয়াদকে বুঝি এইবার আর রক্ষা করতে পারবোনা। গত তিনদিন আগে ও যে ইয়াবার চালান ধরেছে সেটা ওর জন্য মৃত্যু ফাঁদ হয়ে গেছে। ও সাপের লেজে পা দিয়েছে। গোপন সুত্রে খরব আসছে ওর একটা ব্যবস্থা করে ছাড়বে উপর মহল থেকে। তুই যেভাবে পারিস ফুয়াদকে বাসায় নিয়ে আয়। ওর এত রিক্সের জব করতে হবেনা। আমার কি কম আছে? তোরা দু'জনেই পায়ের উপর পা তুলে সারা জিবন খেতে পারবি। ওর সাথে কথা বল বাবা।"
" বাবা টেনশন করেন না, আমি দেখছি বলে মাহাদ কল কেটে দিল। মাহাদ দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে গেল। ফুয়াদের নাম্বারে বার বার কলদিয়েও কোন কাজ হলনা। দু'দিন আগেই ফুয়াদের সাথে দেখা করেছে মাহাদ। শেষে মাহাদ নিসাকে কল দিল।"
" নিসা কল রিসিভ করতেই মাহাদ বলল," নিসা, ভাইয়া কোথায় রে?"
" ওতো গতকাল বান্দরবন গিয়েছে। কোন এক জরুরি কাজে ওকে ডাকা হয়েছে। আসতে ১ সপ্তাহ লাগবে। কেন কি হয়েছে?"
" ভাইয়া বান্দরবন গেছে, এই কথাটা আমাকে কেন বলিসনি? আমি রাস্তায় আছি একটুপর আসছি তোর ওখানে।"
" আয় বলে নিসা কল কেটে দিল।"
♦♦♦♦
মাহাদ প্রায় ১০ মিনিটের মধ্য নিসার বাসায় গেল। নিসাতো মাহাদকে দেখে সেই খুঁশি। ও ব্যস্ত হয়ে গেল কি খাওয়াবে মাহাদকে। নিসা ৬ মাসের প্রেগন্যান্ট তবুও কাজ করার কোন কমতি রাখছেনা। কতদিন পর মাহাদ এসেছে তার বাসায়। কিন্তু মাহাদের এসব অসহ্য লাগছে। ভাইয়াকে বার বার কল দিয়েও কোন রেসপন্স পাচ্ছেনা। এদিকে কামরান সাহেব বার বার কল দিচ্ছে মাহাদকে।
নিধি এর মাঝে স্কুল থেকে আসল। চাচ্চু তুমি আসছো বলেই নিধি মাহাদের কাছে আসল। আজ মাহাদের কিছুই ভালো লাগছেনা। এর মাঝে তিতিরও কয়েকবার কল দিয়েছে কিন্তু মাহাদ রিসিভ করেনি।
এদিকে মাহাদ যতটা পারে ততটা ফুয়াদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করল। দুপুর গড়িয়ে বিকাল তারপর সন্ধ্যাও পেরিয়ে গেল। এমন সময় মাহাদের ফোনে কল আসল ফুয়াদের অফিস থেকে। কল রিসিভ করে কিছু কথা বলেই ফুয়াদের অফিসে ছুটল মাহাদ।
যা হবার তাই ঘটে গেল। ফুয়াদ ও ৮ জন পুলিশ সদস্য সহ একটা কার্ভাডভ্যান নিখোঁজ হয়েছিল দুপুর বেলা। সন্ধ্যার পর সাঙ্গু নদীতে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ ভেঁসে উঠছে।
কথাটি শুনে মাহাদ ধপ করে বসে পড়ল। একদম স্থির হয়ে গেছে মাহাদ। নিসা, বলেই মাহাদ সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল। যত তাড়াতাড়ি বাসায় পৌছানো যায় তত মঙ্গল।
রাত ৮টার ব্রেকিংনিউজ
বান্দরবনে দায়িত্বরত ২ জন পুলিশ অফিসার ছাড়াও আরো ৭ জন পুলিশ সদস্য আতোতায়ীদের হাতে নিহত হয়েছে।
এমন খবরে নিসা সহ মাহাদদের বাসায় শোকের ছায়া নেমে এল। এদিকে রাস্তার মধ্য মাহাদ ড্রাইভ করা অবস্থায় চোখের পানি আর আটকাতে পারছেনা। কি হতে কি হয়ে গেল। এটা যে পরিকল্পনা মাফিক খুন সেটা মাহাদ বুঝে গেছে।
মাহাদ বাসায় ঢুকতেই নিসা দৌড়ে গিয়ে মাহাদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ফুয়াদকে আমার কাছে এনে দে মাহাদ। তুই আগেই জানতিস ওর বিপদ হয়েছে তাহলে চুপ করে কেন থাকলি। তোদের কাউকে ছাড়বোনা আমি বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো নিসা।
নিসাকে আটকানো যাচ্ছেনা। এর মধ্য নিসা পাগলের মত আচরন শুরু করে দিল। মাহাদ কিছুতেই ওকে থামাতে পারছেনা।
কামরান সাহেব আর লাবীবা এই প্রথম ফুয়াদের বাসায় ছুটে আসল। নিসা এদের দেখে চিৎকার করে শাসাতে লাগল। মাহাদ তোর বাবা-মাকে এখান থেকে চলে যেতে বল। আমার কাউকে দরকার সেই। যখন আমার ফুয়াদ ছিল তখনতো তাদের আসার প্রয়োজন হয়নি। তাহলে এখন কেন তাদের আসার প্রয়োজন হল। আমার ফুয়াদের লাশ নিতে এসেছে বলে অকথ্য ভাষায় কথা বলতে লাগল নিসা।
শেষে ওনারা চলে এলেন বাসায়। আসার আগে মাহাদকে বলে আসলো নিসা আর নিধিকে বাসায় আনতে। কারন এখানে থাকাও ওদের রিক্স। মাহাদ অনেক চেষ্টা করল কিন্তু নাহ্ নিসা কিছুতেই রাজি হলনা। নিসা মাহাদের বাসায় কিছুতেই যাবেনা বলে ডুকরে কাঁদতে লাগল।
মাহাদ সাথে সাথে তিতিরকে কল দিয়ে সেখানে যেতে বলল। কারন তিতিরই একমাত্র এটা সমাধান করতে পারবে। নিসা তিতিরকে সহ্য করতে পারেনা।
তিতির জানে আজ বড় কিছু হতে চলছে যেটা সহ্য করার ক্ষমতা তিতিরের নেই। তিতির বোরখা পড়ে আসমাকে সাথে নিয়ে নিসাদের বাসায় গেল।
বাসা ভর্তি মানুষ। সবার ভিড় ঠেলে তিতির মাহাদের কাছে যেতেই নিসা কোথা থেকে এসে মাহাদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তিতিরকে দেখিয়ে দেখিয়ে সবার সামনে কারো তোয়াক্কা না করে মাহাদকে আরো আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মনে হয় মাহাদকে তিতির ওর কাছ থেকে এখুনি কেড়ে নিয়ে যাবে। নিসার কান্নাময় চাহোনি দেখে আসমা ভিষন ভয় পেয়ে গেল। তিতিরের একহাত শক্ত করে ধরল আসমা।
নিসা, আমার সঙ্গে বাসায় যাবি বলতেই নিসা এক কথায় রাজি হয়ে গেল। নিধিকে কাছে ডেকে নিসা ওকে মাহাদের একদম কাছে নিল। তিতির শুধু দেখছে মাহাদকে। মাহাদ চুপ করে দাড়িয়ে আছে। তিতির আর দেরি করলোনা। আসমাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এল। মাহাদ শুধু তিতিরের চলে যাওয়া দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখল। এই কাজ ছাড়া মাহাদের আর করার কিছু ছিলনা।
ঐ রাতেই নিসা আর নিধিকে নিয়ে বাসায় আসলো মাহাদ। বাসায় এসে এক কান্নায় রাত কাটালো নিসা। পরেরদিন ফুয়াদের লাশ সহ সবার লাশ যার যার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। সবার মুখের অবস্থা খুবই খারাপ। মুখটা থেতলে দেওয়া হয়েছে ৯ টা লাশেরই। মনে হয় কত দিনের শত্রুতা থাকলে তাদের সাথে এমন ব্যবহার করে। শুধু ব্যবহৃত জিনিস পত্র দিয়ে এদের পরিচয় পাওয়া গেছে। জাতীয় মর্যাদায় তাদের লাশ দাফন হয়ে যায়।
৬ মাসের প্রেগন্যান্ট নিসা ওর পেটে হাত বুলিয়ে কাঁদতে লাগল। তুই তোর বাবাকে আর দেখতে পারলিনা সোনা। তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নিসার এমন গগনবিদারী কান্নায় এমন কেউ নেই যার চোখে পানি এলনা। ফুয়াদ ফুয়াদ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো। কেউ তাকে শান্ত করতে পারছেনা। ওর নিজের বাবা-মা ও থামাতে পারছেনা। এমনকি মাহাদও না।
দিন যায় সময় যায় নিসার অবস্থা অনেক খারাপ হতে লাগল। চোখের নিচে কালি জমতে লাগল। ১৭ দিন পর নিসার মানুষিক আর শারিরীক ভাবে ভেঙ্গে পড়ার কারনে ওর বেবিটা নষ্ট হয়ে যায়। নিসা আরও ভেঙ্গে পড়ে গেল। মাহাদ ইদানিং নিসাকে সবসময় চোখে চোখে রাখে। কারন এর মধ্য নিসা সুইসাইড করতে গিয়েছিল একবার। প্রচন্ড কেয়ার করতে হয় নিসাকে। অফিস, নিসা, ফুয়াদের কেসের ডেট সহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকার কারনে তিতিরের সাথে মাহাদের খুব একটা যোগাযোগ হয়না। ৩/৪ দিনে হয়ত একটু কথা হয়। তাছাড়া নেই বললেই চলে।
এর ভিতর সংবাদ এল, ফুয়াদ যে ১লাখ ইয়াবা জব্দ করেছিল! সেগুলো ইয়াবা ছিল না। সেগুলো ছিল নাকি ভিটামিনের ট্যাবলেট। কামরান সাহেব একজন এমপি হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার ছেলের বিচার পেলেন না। এর থেকে বড় কষ্ট দায়ক কিছু আছে। শুধু উপর মহলের খেল ছিল এগুলো।
♦♦♦♦
প্রায় মাস খানেক হয়ে গেল, মাহাদের সাথে তিতিরের কোন যোগাযোগ নেই। কয়েকদিন ফোন দিয়েছিল মাহাদকে কিন্তু রিসিভ হয়নি। নিয়তি বলেও তো কিছু আছে। সেটাকে মেনে নিয়ে তিতির চুপচাপ থাকে আর চোখের জল ফেলে। এক সকালে তিতির নাস্তা বানাচ্ছে, এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। তিতির ঐ অবস্থায় উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই লাবীবা আর বাতাসি সোজা রুমের ভিতর ঢুকল। এদের দেখে তিতির চমকে উঠলো। এরা বাসা চিনলো কি করে! তিতির সালাম দিতেই লাবীবা দরজা বন্ধ করে বলল," কেমন আছো তিতির?"
" আর ভাল! মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে তিতির বলল," জ্বী আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল আছি। আপনারা সবাই কেমন আছেন?"
বাতাসি এদিক ওদিক চেয়ে বলল," মাহাদ তো তোরে দেখছি ভালয় রাখছে।
আলহামদুলিল্লাহ্ বলতেই লাবীবা তিতিরের হাত ধরে বলল," মা, একটা জিনিস চাইতে আসছি তোমার কাছে। আমাকে খালি হাতে ফেরত দিওনা।"
" জ্বী বলেন!"
" মা তুমি মাহাদের সাথে সারা জিবনের জন্য সম্পর্কটা শেষ করে দাও। নিসার অবস্থা খুব খারাপ। ও মাহাদের সাথে একটু থাকলে খুশি থাকে। ওর বাচ্চাটাও নষ্ট হয়ে গেছে। বাসার সবাই মিলে ডিসিশন নিয়েছি ফুয়াদ মারা যাওয়ার ৩ মাস ১৩ দিন পার হয়ে গেলেই ওদের বিয়ে দিব। "
" এমন কথা শুনে তিতিরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। অসম্ভব, আমি ওনাকে কিছুতে এবং কোন মূল্যতেই ছাড়তে পারবোনা। আপনি আমার কলিজা চান সেটা আমি কেটে দিব তবুও দয়া করে এমন কথা বলবেন না। আমি পারবোনা।"
মা তোমার পায়ে পড়ছি বলেই লাবীবা সত্যিই তিতিরের পা চেঁপে ধরল। একটা মেয়েকে বাঁচতে দাও মা। তুমিতো সন্তান দিতে পারবেনা। অন্তত একজনকে সেই স্বপ্নটা পুরুন করতে দাও। আমাদের নিধিকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করোনা। ওদের একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও। কারন তুমি মাহাদের জিবনে থাকলে মাহাদ কখনো ওদের সেই অধিকার দিবেনা।
আন্টি আমার পা ছাড়েন বলে তিতির সরে আসল। আমি মাহাদকে ছাড়ছিনা। আপনাদের যা করার দরকার করেন। কিন্তু আমি আমার মত কখনো পরিবর্তন করবোনা।
কইছিলেমনা লাবীবা, কাজ হইবনা? শুধু অ্যার সম্মানডা মাটি করল্যা? কামডা ভ্যালা করলিনা মাইয়া। পস্তাতে হইব তোরে, চল এহান থাইকা বলে বাতাসি লাবীবাকে টেনে হিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে নিয়ে গেল।
তিতির একঠাই দাড়িয়ে রইল ওখানে। চোখের জল সুখে গেছে। আর যে মাহাদকে সে পাবেনা, সেটা ও ভালোভাবে বুঝেই গেছে। কাকে ফোন দিবে সে? বাবাকেও সে ফোন দিয়ে পায়না। উনি অত্যান্ত বিজি মানুষ। মাহাদ...! সেতো আজ দিয়ে ৪ দিল হল ফোন করা বা রিসিভ করা কোনটাই করছেন না। সব কিছু এলোমেল হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ্ আমাকে পথ দেখাও। আমি কি করবো এখন।
♦♦♦♦
রাত ১২ টা,
মাহাদ একটু আগে বাসায় ফিরেছে। খাওয়া, ঘুম নিয়মিত না হওয়ার জন্য চোখের নিচে খানিকটা কালসিটে পড়ে গেছে। মাহাদ ফ্রেস হয়ে এসে না খেয়েই তিতিরের নাম্বার কেবল ডায়েল করতে যাবে এমন সময় নিসা ওর বালিশ নিয়ে মাহাদের রুমে চলে এল।
নিসা আসাতে মাহাদ খানিকটা ভড়কে গেছে। নিসা, তুই এত রাতে এখানে কেন এসেছিস? আর বালিশ তোর হাতে কেন? যা ঘুমা, তোর শরীর এমনিতেই ভালো নেই।
"আমি তোর কাছে ঘুমাবো। আমার ঘুম আসছেনা। ঐ রুমে একা থাকতে ভয় লাগছে আমার। কথাগুলো বলে নিসা এসে মাহাদের বেডে শুয়ে পড়ল।
মাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল," সাবিনাকে সাথে নিয়ে ঘুমাবি, আমার সাথে এভাবে তোকে কেউ দেখলে খারাপ ভাববে। আমার আশে-পাশে এত আসিসনা।"
তোর ভাইয়াকে আমি ভুলতেই পারছিনা মাহাদ বলেই কেঁদে উঠলো নিসা। এই বাসায় আমার আপন বলে কেউ নেই। আমি আমার কষ্টগুলো কারো কাছে শেয়ার করতে পারিনা। আমার খারাপ লাগছে তাই তোর এখানে আসলাম।
মা তোকে যথেষ্ট কেয়ার করে নিসা। মার সাথে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কর। আমি আসছি বলে মাহাদ রুম থেকে বের হয়ে ওর মাকে নিসার কাছে পাঠিয়ে দিল। আজও তিতিরকে আর ফোন দেওয়া হয়ে উঠলোনা মাহাদের। এত ক্লান্ত ছিল যে ওর বাবার বিছানায় শুয়ে পড়তেই চোখ জুড়ে ঘুম আসল। ওর খাওয়াও আর হলনা। এভাবেই মাহাদের দিন কাটছে।
ঘুমানোর আগে ওর বাবাকে শুধু বলল," বাবা, তিতিরকে কাছে এনে রাখলে ভালো হত। তাছাড়া কেউ যদি ভুলেও জানে ও আমার স্ত্রী তাহলে ওর সমস্যা হবে। ওকে নিয়ে আমার খুব ভয় হচ্ছে বাবা।"
দেখ, আমাদের বাসার পরিস্থিতি খুব একটা ভালেনা। ওকে এখন এখানে আনা কিছুতেই সম্ভব নয়। ওর সাথে যোগাযোগ একটু কম করে দে। আমরা একসাথে এত পরিস্থিতির সামাল দিতে এমনিতেই হিমসিম খাচ্ছি। ওকে আর বিপদে ফেলাস না।
মাহাদের চোখের কোনে এক বিন্দু জল চিকচিক করছে। সময় গুলো ওর জন্য কঠিন হয়ে উঠছে।
♦♦♦♦
কিছু দিন আগে হিনুর বড় বোন মিতু, দুলাভাই ওমর ফারুক, ওদের ছেলে-মেয়ে এবং ছোট ভাই হিমেল এসেছে। ওনারা আয়ারল্যান্ডে থাকত। এবার ছুটিতে এসেছেন। হিমেল হয়ত একবারে এসেছেন । হিমেল তিতিরের সমবয়সী। রাশেদা বেগম আর কত একা একা থাকবে। এখন রাশেদা বেগমের পুরো বাসা মানুষে টৈটুম্বুর। ওনি এতদিন পর সব ছেলেমেয়েকে পেয়ে খুব খুশি। শুধু হিনুটাই নেই।
সব ঠিক আছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হিমেলকে নিয়ে। হিমেল এসেই তিতিরের দিকে কুনজর দিয়েছে। তিতির বিবাহিত জানা সত্তেও নানা ভাবে ইশারা ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়েই চলছে প্রতিনিয়ত। তিতির রুম থেকে একদম বের হয়না। তিতির কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। আজ আবার আসমাকে নিয়ে মিতু আপু বাজারে গেছে তাই তিতির ভালো করে দরজা বন্ধ করে ওর রুমে আসতেই চমকে উঠলো। কারন ওর রুমের ভিতর হিমেল বসে আছে।
হিমেল কে দেখেই তিতির কেঁপে উঠলো। আপনি এখানে কেমন করে? আমিতো দরজা আগেই বন্ধ করে দিছি।
" মাই ডারলিং, এটা কার বাসা! এটা আমার বাসা তাই ভাড়াটিয়ার ডুবলিকেট চাবি মালিকের কাছে থাকতেই পারে। এতবার করে বললাম তোমায় আমার ভালো লেগেছে তবুও তুমি মানলেনা তো? কতবার বুঝালাম তোমার স্বামী কিচ্ছু জানবেনা তুবুও রাজি হলেনা। এখন তোমায় আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে শুনি? তোমার মত কত মেয়েকে এই হাতে হান্ডেল করেছি আর তুমিতো বাংলাদেশী একটা সামান্য মেয়ে।"
হিমেলের কথা শুনে তিতির অত্যান্ত ভয় পেয়ে গেল।তিতির কোন হুস না পেয়েই কিচেনে ছুটে গেল কিন্তু তার আগেই হিমেল ওকে ধরে ফেলল। তিতিরকে টেনে হিচড়ে রুমের ভিতর নিয়ে আসল।
আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ। আমার এতবড় ক্ষতি করবেন না প্লিজ বলেই হিমেলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করলো তিতির। শেষে হিমেলের পেট বরাবর একটা লাথি মারে তিতির।
এতে হিমেল ওর পেটে হাত বুলিয়ে তিতিরের দিকে কামনার চোখে তাকালো। এটাই তো চাই আমি বলেই হিমেল ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল তিতিরের গালে। তিতির টাল সামলাতে না পেড়ে খাটে পড়ে গেল। হিমেল একটা শয়তানি হাঁসি দিয়ে বলল," তোর মত ছটফট পাখিকে নিয়ে দেখছি সময়টা আমার খুব ভালোয় কাটাবে।"
হিমেল যখন ওর গায়ের শার্ট খুলল তখনই সামনে গোলাবকে দেখতে পেল। গোলাব দরজার সামনে দাড়িয়ে তিক্ষ্ণ নজরে হিমেলের দিকে চেয়ে আছে।
হেই ডগ ইউ আর স্মার্ট বয়। আয় আমরা দু'জনে মিলেই ওকে ভোগ করি বলতেই গোলাব এক দৌড়ে এসে হিমেলের অন্ডকোষে কামড় বসিয়ে দিল। একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুরকে বলতে হয়না শত্রুর কোন কোন জায়গায়তে তাকে আঘাত করতে হবে।