মায়াবতী (পর্ব ১৯)


৩৭!! 

উদয়াচলের মেইন এন্ট্রেন্স থেকে মায়ার রুম পর্যন্ত আসার মিনিট পাঁচেকের দূরত্বটাকে আজ ঘন্টাখানেক বলে মনে হলো রাহাতের কাছে। প্রতি পদক্ষেপের সাথে নিজের বুকের ঢিপঢিপ শব্দগুলোও যেন আরো দ্রুততর হচ্ছে রাহাতের। মায়ার রুমের সামনে পৌঁছে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলো রাহাত। কিন্তু শান্তই বা হতে পারছে কই? চোখের সামনে দিহানের মুখটা একবার ভেসে উঠছে আর কখনো মায়ার মায়াবী মুখটা মনের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে ছেলেটার। বন্ধু না ভালোবাসা? এই এক প্রশ্ন মগজে যে হুট ফোটাচ্ছে রাহাতের। মায়াবতী, যে পাগলীটা নিজের জীবনের চেয়েও হয়তো বেশি ভালোবাসে রাহাতকে। আর দিহান? ভালোবেসে এখন পর্যন্ত অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পায় নি। দুজনেই তো রাহাতের জীবনে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে?

-আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন? ভেতরে আসুন না?

 

নিজের মনে হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে মায়া যে কখন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা টেরই পায়নি রাহাত। মায়ার ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা মিষ্টি হাসিটা হাত বাড়িয়ে রাহাতকে নিজের দিকে টানছে যেন। মায়া রাহাতের দিকে এক নজর তাকিয়ে রুমে ঢুকলো। রাহাতও ধীর পায়ে মায়ার রুমে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কি বলবে নিজেও জানে না সে। নিজের মনের কথাগুলো মায়াকে জানাতে এসেছিল আজ রাহাত। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল!

-আপনি গিটার বাজাতে পারেন আমি জানতামই না। আমাকে শেখাবেন প্লিজ? আমার না খুব শখ গিটারে অন্তত একটা হলেও গানের সুর বাঁধার। উফফ। কাউকে ডেডিকেট করে লেখা গানের কথাগুলোকে গিটারের তারে সুর দিবো, ভাবতেই কেমন গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে আমার।

-হুম।

রাহাতের কণ্ঠটা কেমন একটা বিষন্ন শোনালো মায়ার কাছে। রাহাতের মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো এই কিছু সময়ের মাঝে লোকটার হলো টা কি! একটু আগেই তো লোকটা কি সুন্দর হাসিখুশি ছিল, গান করছিল। গানটা তো শুধু গানও ছিল না। রাহাতের মনের প্রত্যেকটা শব্দ যা শোনার জন্য এতোদিন ধরে মায়া অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল, সেই শব্দগুলো গান হয়ে যেন রাহাতের কণ্ঠে ধরা দিয়েছিল। তাহলে এখন কি হলো!

-মায়া? দিহান তোমাকে খুঁজছে অনেকক্ষণ ধরে। 

-দিহান ভাইয়া? কেন? কিছু লাগবে নাকি? কি লাগবে আপনি জানেন কিছু? তাহলে মিহান ভাইয়াকে বলে নাহয় একটা ব্যবস্থা----।

-তোমাকে লাগবে ওর মায়া। 

-হোয়াট! আমাকে লাগবে মানে কি? এসব কি আবোলতাবোল বকছেন আপনি?

-আবোলতাবোল না মায়া। দিহান তোমাকে হয়তো বিয়ের জন্য---।

-উনি নিজে আপনাকে কথাটা বলেছে?

-হ্যাঁ। দেখো মায়া। দিহান আমার বন্ধু বলে বলছি না। ও ছেলেটা অনেক ভালো। 

-উনি আপনাকে বললেন যে উনি আমাকে প্রপোজ করবে, আর আপনি কিছু বললেন না? কিচ্ছু না?

-মায়া?

-জাস্ট আনসার মাই কোশ্চেন ড্যাম ইট৷ আপনি আপনার বন্ধুকে কি বলেছেন? 

---------------------------

-কি ভেবেছেন টা কি আপনি? আমি কি আপনার হাতের খেলার পুতুল যে আপনি আমার সাথে যা ইচ্ছে করবেন? যখন ইচ্ছে যাকে ইচ্ছে দান করে দিবেন? এতোদিন আপনি নিজের মধ্যে আমার অস্তিত্বটা অনুভব করতে পারেন নি বলে দ্বীপের মতো একজনের সাথে আমার বিয়ের খবর শুনেও আপনি নিশ্চুপ ছিলেন। আচ্ছা তখন নাহয় আপনি আমাকে ভালোবাসতেন না। কিন্তু এখন? এখন কেন এমনটা করছেন রাহাত? এখনও কি আপনার মনে আমার জন্য একটুও জায়গা তৈরি হয়নি রাহাত? একটুও না? 

-মায়া? একটু শান্ত হও প্লিজ? আমার কথাটা একবার শোনো?

-শোনার কি বাকি আছে রাহাত? গত দুটো দিন ধরে আবার আগের মতো কেয়ার দেখালেন। প্রতিটা সেকেন্ডে আপনি এমন একটা ভাব করলেন যে আমাকে ছাড়া আপনি একটা মূহুর্তও চলতে পারছেন না। অথচ হাস্যকর ব্যাপার দেখুন? নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে পর্যন্ত আমার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন নি আপনি। অবশ্য কি বলবেন? বলার মতো কিছু থাকলে তবে না বলবেন। তাই না রাহাত? 

-মায়া?

-আপনার বন্ধুর গুণ কীর্তন করা হয়ে গেছে তাই না? এবারে নিশ্চয়ই আর কিছু বলার নেই? বলার না থাকলে প্লিজ আমার সামনে থেকে চলে যান আপনি। প্লিজ?

-মায়া? বুঝতে পারছি আমার উপরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তোমার এই মূহুর্তে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কি করবো। তোমাকে ভালোবাসি। এতোটা ভালোবাসি যে তোমার জন্য নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে না আমাকে। কিন্তু দিহান? ও যে ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু মায়া। ওকে কি করে-----?

-ওকে কি করে কি রাহাত? 

রাহাত এতোক্ষণে দরজার দিকে পিঠ করে মায়ার একদম সামনে এসেই কথা বলছিল। পিছন থেকে হঠাৎ দিহানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই চমকে পিছনের দিকে ফিরলো রাহাত আর মায়া দুজনেই। দিহান কয়েক পা এগিয়ে এসে রাহাতের মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ স্থির করে তাকালো।

-কি বলছিলি তুই রাহাত? আমি তোর ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু? তো এই ভাইয়ের চেয়েও বেশি লোকটার জন্য কি করতে চাইছিলি তুই? বল আমাকে? আমিও একটু শুনতে চাই।

-দিহান? 

-আমার প্রশ্নের জবাবটা দে রাহাত। আমার দিকে তাকা? বল তুই কি করতে চাইছিলি? বল?

-দিহান?

রাহাত কিছু বলার আগে এবারে মায়া দিহানের দিকে তাকালো।

-উনি আপনাকে কি বলবে ভাইয়া। আমি বলছি শুনুন। উনি আমার কাছে আপনার ঘটকালি করতে এসেছিলেন। 

-হোয়াট?

-জি। 

-বাহ রাহাত! তুই তো ভাই বন্ধুর জন্য ইতিহাস রচনা করে ফেলছিস। দারুণ তো! তা কি করতে চাইছিলি একটু বলবি আমাকে? আমি মায়াকে বিয়ে করার জন্য প্রপোজ করবো বলতেই নিজের ভালোবাসার অধিকারটা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতি? তাতে নিজে খুশি থাকতে পারতি? নাকি যার জন্য এই অসাধারণ স্যাক্রিফাইসটা করার কথা ভাবছিলি সে খুশি হতে পারতো? আর এই মেয়েটা? তোর নিজের কথা নাহয় বাদ দিলাম। কিন্তু এই মেয়েটার আবেগ অনুভূতিগুলোর কি কোনো মূল্যই নেই তোর কাছে? 

দিহান আর মায়া দুজনেই রীতিমতো রাগে ফুঁসছে। আর রাহাত অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে নিজেই নিজেকে কয়েক শ গালি দিলো। দিহান রাগ সামলাতে পুরো রুমটায় পায়চারি করা শুরু করেছে ততক্ষণে। একটু পরে আবার রাহাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দিহান।

-তোর কি সামান্য কমনসেন্সটুকু পর্যন্ত নেই রাহাত? তোর কি মনে হয় আমি তিনদিন ধরে যাকে তোর জন্য পুরো শহরের কোণায় কোণায় খুঁজে ফেললাম তার চেহারাটা আমি দেখি নি? গাধামির একটা লিমিট থাকে রাহাত, আর সেটাকেও ক্রস করে গেছিস। আমি বললাম আর তুই ধরে নিলি আমি বন্ধুর বিয়েতে এসে বন্ধুর ছোটো বোনকে দেখে এতোই ফিদা হয়ে গেলাম যে তাকে সোজা বিয়ের জন্য প্রপোজ করবো? আচ্ছা বুঝলাম, সিরিয়াস ক্রাশ খেয়েছি, প্রপোজও করলাম। তোর কি মনে হয় সেই মেয়েটা সব ভুলে টুলে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে? শালার! এই হাঁটুর সমান বুদ্ধি নিয়ে তুই বিজনেস করিস টা কি করে বল তো? 

রাহাত আবার চুপ করে রইলো। দিহানকে নিয়ে রাহাতের তেমন চিন্তা হচ্ছে না। চিন্তাটা হচ্ছে মায়াকে নিয়ে। দিহান তো ইচ্ছে মতো রাগ ঝেড়ে  একসময় চুপ করে যাবে। কিন্তু মায়া? মেয়েটা আবার রেগে গেলে কি কান্ড ঘটিয়ে বসবে কে জানে! আর এই দিহান! ছেলেটাকে এখন খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে রাহাতের৷ সব ঝামেলা হয়েছেই এই ছেলের জন্য। এখন আবার আগুনে ঘি ঢালছে। 

-তুই আমাকে কি এতোটাই অমানুষ মনে করিস রাহাত? এক নজর দেখে যে মেয়েটাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি আমি, দুটো বছর যার জন্য আমি সবাইকে ছেড়ে, নিজের দেশটা ছেড়ে থেকেছি, তাকে এতো সহজেই ভুলে যাবো ভাবলি কি করে তুই? দেশে ফিরেই সব ভুলে, এমনকি নিজের বিজনেসে কনসেন্ট্রেট না করে সারা দিন তোর অফিসে পড়ে ছিলাম কেন সেটা একবারও অদ্ভুত ঠেকে নি তোর চোখে? নাকি ভেবেছিলি দেশে ফিরেই নতুন কাউকে পেয়ে পুরোনো প্রেমটা ভুলে গেছি?

-দিহান! কিসব বলছিস ভাই?

-পরীক্ষায় তো তুই ডাহা ফেইল করলি রাহাত! এবার আরেকজনের পালা। দেখি সে কি করে। ওয়েট এ মিনিট। তার রিএকশানটাও জানি। তারপর দেখা যাক কি করা যায়। 

-কার কথা বলছিস তুই?

রাহাতের প্রশ্নটার উত্তর দেয়ায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো না দিহান। পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে কারো নাম্বার ডায়াল করে কল করে মোবাইলের লাউডস্পিকার অন করে দিলো দিহান। দু বার কল যাওয়ার পর কলটা রিসিভ হলো। অপরপ্রান্ত থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দই আসছে না দেখে রাহাত ইশারায়  দিহানকে জিজ্ঞেস করলো কে বা কাকে কল করেছে দিহান। দিহান এবারেও রাহাতের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। 

-ভেবেছিলাম আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবো না। তবে একটা সুখবর আছে। সেটা তোমার সাথে শেয়ার না করে থাকতে পারলাম না। 

-কি সুখবর!

কণ্ঠটা চিনতে রাহাতের দেরি হলো না। এটা লিজার গলা। রাহাত আগামাথা কিছু না বুঝে একবার দিহানের দিকে তাকালো আর একবার মায়ার দিকে। মায়া চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। রাহাত আবার দিহানের দিকে তাকালো।

-তুমি হয়তো জানো না। আমি এখন সেন্টমার্টিনে এক ফ্রেন্ডের বিয়েতে আছি। ঢাকায় ব্যাক করলেই এবারে বিয়েটা করবো। এভাবে আর কতদিন বলো? তোমার জন্য অপেক্ষা করে যে জীবন পার করবো সেই সুযোগটাও তো তুমি রাখো নি। তাই ভাবছি এবারে বিয়েটা করেই ফেলি। তোমার একটা কথা অন্তত মেনে নিই। লাস্টদিন বলেছিলে না বিয়ে করুন, সংসার করুন। সেটাই করছি। এবারে খুশি হয়েছ তো তুমি?

এবারে আবার দীর্ঘ একটা নিরবতা ছেয়ে গেল রুমটায়। দিহান ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের স্ক্রিনের চলমান সেকেন্ডের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। 

-কি হলো? কিছু তো অন্তত বলো? খুশি হও নি আমার বিয়ের খবরটা শুনে? তোমাকে পারসোনালিও ইনভাইট করবো অবশ্য। খুশির খবর সবার প্রথমে প্রিয় মানুষের সাথে শেয়ার করতে হয় তো। তাই তোমাকেই জানালাম প্রথমে। আরেকটা খবর আছে অবশ্য। শুনবে? 

-জি? ব-বলুন?

-তোমার মায়া আপু আছে না? তাকেই বিয়ে করছি বুঝলে? 

-মায়া আপু! কি বলছেন? মায়া আপুকে তো রাহাত স্যার----।

-তোমার রাহাত স্যার কি? মায়াকে ভালোবাসে? কখনও বলেছে ওকে? মায়াকে বলার কথা বাদ দাও। তোমাকে বলেছে? অহেতুক কথা বলো কেন? রাহাত আর মায়া দুজনেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এই মূহুর্তে। কই ওরা কেউ তো কিছু বলছে না?

-কিন্তু স্যার আর মায়া আপু একজন অন্যজনকে খুব-----।

-ভালোবাসলে বাসে। আমার তাতে কি? আমি নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাবো না যেহেতু তখন কাউকে পেতেও দিবো না। সহজ ব্যাপার। যা হোক। বিয়েতে কিন্তু অবশ্যই আসবে লিজা। মা আর রিমনকেও নিয়ে আসবে----।

-দিহান?

-কি? কিছু বলবে?

-আপনি? আপনি সত্যি বিয়ে করছেন?

-কি মনে হয় তোমার? আমি তোমার সাথে কি জোকস করছি? আর কিছু বলবা? নাকি এখনো জোর করে কান্না চেপে রাখবা এখনো?

এবারে লিজার ফোঁপানোর শব্দটা রাহাত আর মায়া দুজনেই শুনতে পেল। রাহাত অবাক হয়ে দিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। 

-তুমি চাইলে এখনো অনেক কিছুই আটকাতে পারো লিজা। কিন্তু মনে হয়না তুমি আটকাবে। বিয়েটা করো না-কথাটা বলার মতো পিছুটান তো তোমার নেই তাই না? তাহলে কাঁদছ কেন লিজা?

-আম--আম সো সো সরি দিহান। আমি ভুল করেছি। প্লিজ ফিরে আসুন না? আপনি চলে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি আপনাকে আমার কতটা প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত নিজের উপরে ঘৃণ হচ্ছে আমার আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে। প্লিজ শেষবারের মতো মাফ করে দিন? প্লিজ?

-এবার কি তুমি আমাকে দয়া দেখাচ্ছো নাকি লিজা? নাকি তোমার স্যার ম্যাডামকে আলাদা করে দিবো শুনে তাদেরকে এক করতে এই হঠাৎ ভালোবাসা জেগে উঠল? কোনটা?

-বিশ্বাস করুন দিহান। আমি অনেকবার আপনাকে কল করতে গিয়েও করতে পারি নি। মনে হচ্ছিল আপনাকে সত্যি সত্যিই হারিয়ে ফেলেছি চিরদিনের মতো। প্লিজ দিহান এবারের মতো মাফ করে দিন। আপনি যা বলবেন তাই শুনবো আমি। প্রমিস। কিন্তু প্লিজ ফিরে আসুন?

-উমমমম। ফিরে আসবো? কিন্তু তোমার উপরে রাগ দেখিয়ে যে ওদের দুজনের ভালোবাসাটা ঘেঁটে দিলাম, তার কি হবে? আমি তো মায়াকে কথাও দিয়ে ফেলেছি যে কাল ওকে নিয়ে ঢাকায় ব্যাক করবো। তারপর বিয়ে----।

-আপনি এক্ষুণি ঢাকায় ফিরবেন। আমি আর কিছু জানি না।

-কি বলো এসব? কাল আমার বন্ধুর বিয়ে! এখন কি করে ব্যাক করবো? তার উপরে মায়াকেও তো নিয়ে---।

-আপনি এক্ষুণি ফিরবেন মানে এক্ষুণি। নইলে কিন্তু আমি--আমি-----।

-আরে বাবা! আমার কথাটা তো শোনো? এখনই কি করে ফিরবো বলো?

দিহান এবারে মোবাইলের লাউডস্পিকার অফ করে দিয়ে মোবাইলটা কানে চেপে ধরে রুমটা থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিছু একটা মনে পড়তে পিছনে ফিরে রাহাতকে ইশারা করলো মায়ার সাথে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিতে। ইশারা করেই দিহান লিজাকে এতো রাতে কেন আসতে পারবে না সেটা বোঝাতে বোঝাতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। আর রাহাত? দিহান বেরিয়ে যাওয়ার পর মায়া অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে দেখে রাহাত মনে মনে প্ল্যানিং করতে শুরু করলো। এবারে মায়ার রাগটা কিভাবে ভাঙ্গানো যায়। কোন প্ল্যানই শেষ পর্যন্ত পছন্দ হচ্ছে না রাহাতের। এদিকে মায়াও মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছেও না। মেয়েটার রাগটা এখনই না ভাঙাতে পারলে কাল সকালে কি হবে কে জানে!

৩৮!! 

-আপনার তো আর এখানে কোনো কাজ নেই রাহাত। আপনি এখন আসতে পারেন৷ আর আশা করি কালকের পর আর আপনাকে এই কেয়ার, ভালোবাসা এসবের মিথ্যে অভিনয়টা আর চালিয়ে যেতে হবে না। 

মায়া অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কথাগুলো বলছে দেখে রাহাত এবারে মায়াকে টেনে নিজের দিকে ফেরালো। মায়া শান্ত ভঙ্গিতে রাহাতের চোখে চোখ রাখলেও সেই দৃষ্টিতে রাগের ভাবটা স্পষ্ট। রাহাত একটা হাত বাড়িয়ে মায়ার মুখটা তুলে ধরলো। 

-মিথ্যে অভিনয় নয় মায়া৷ তোমাকে ভিষণ ভালোবাসি আমি। বিশ্বাস করো?

-ওহ ভালোবাসেন বুঝি? জানতাম না তো আমি---।

-মায়া? প্লিজ? মানছি ভুল করেছি। তাই বলে তো আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। তোমাকে চাই আমার। প্রতি মূহুর্তে চাই। কিন্তু দিহান ওভাবে কথাগুলো বলায় আমি ডিসিশন নিতে পারছিলাম না কি করবো। 

-ডিসিশন তো আপনি নিয়েই নিয়েছেন রাহাত। আর আমিও বুঝে গেছি আপনার জীবনে আমার জায়গা ঠিক কতোটুকু।

-মায়া? প্লিজ আমার কথাগুলো একবার শোনো? আমার ভুলগুলো ক্ষমা করতে বলবো সেই মুখটা আমার নেই। কিন্তু ভুলগুলো শুধরে দেয়ার জন্য হলেও তো আমার তোমাকে চাই মায়া৷ দেখছই তো কেমন পাগল ছাগলের মতো বোকামি করে ফেলি। সেই হাস্যকর টাইপের বোকামিগুলো যাতে না করতে পারি, সেই জন্যও তো তোমাকে চাই মায়াবতী। তুমি যা বলবে, যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে। শুধু এই শেষ বারের মতো একটা সুযোগ দাও প্লিজ? প্রমিস আর কখনো এমন বোকামি করবো না। প্রমিস মায়া। প্লিজ?

মায়া রাহাতের হাতটা সরিয়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে এসে বিছানা উপরে বসে পড়লো। রাহাত মায়ার পাশে বসে মায়ার হাতের উপরে হাত রাখার চেষ্টা করতেই মায়া হাত সরিয়ে নিয়ে রাহাতের মুখের দিকে তাকালো।

-ভালোবাসা জিনিসটা এতো সস্তা না রাহাত যে আপনি যাকে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে দান করে দিবেন, আবার যখন ইচ্ছে তখন আবার ফিরেও পেয়ে যাবেন। ভালোবাসায় এমন সওদা হয় না রাহাত। যদি সত্যিই আপনার ভালোবাসা হয়ে উঠতে পারতাম তাহলে কারো জন্য আমাকে ছাড়ার কথাটা আপনি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। ভালো লাগা আর ভালোবাসার মাঝে যে সূক্ষ্ম পার্থক্যটা আছে সেটা হয়তো আপনার জানা নেই। যদি জানতেন তাহলে দ্বীপের নামের হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে সুখে থাকার কামনা যেমন করতে পারতেন না, তেমনি আজ নিজের বন্ধুর হয়ে তাকে সার্টিফাইড করতে আসতে পারতেন না। দোষটা অবশ্য আপনার নয় রাহাত। দোষটা আমারই। আপনি প্রত্যেকবার একটু ভালোবেসে কথা বললেই আমিই বোকার মতো সেটাকেই ভালোবাসা ভেবে ভুল করি। আপনাকে দোষ দিয়ে কি হবে যেখানে দোষটা আমারই!

-মায়াবতী? প্লিজ এভাবে বলো না। আমি রিয়েলি রিয়েলি ভিষণ সরি মায়া। আর একটা বারের জন্য তোমার রাহাতকে বিশ্বাস করো প্লিজ? আমি সত্যি আর কখনো নিরাশ করবো না তোমাকে। 

-আপনার আর কিছু বলার আছে? না থাকলে প্লিজ আমাকে একা থাকতে দিন কিছুক্ষণ। আর ভাইয়ার সঙ্গীতের অনুষ্ঠানটা শেষ হলেই সবাই কটেজে ফিরবে। চাই না কেউ আপনাকে আমার রুমে দেখে কিছু উল্টোপাল্টা বলুক। প্লিজ লিভ নাউ।

-মায়াবতী?

-প্লিজ? প্লিজ? প্লিজ? 

রাহাত এবারে কিছুটা মন খারাপ করে চুপচাপ মায়ার রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রাহাত বেরিয়ে যেতেই মায়া রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেললো। রাহাতকে প্রত্যেকবার মায়া ক্ষমা করে দিতে পারলেও আজকের ঘটনাটার জন্য মায়া ওকে কখনোঔ মাফ করবে না। কিছুতেই না। এদিকে রাহাত মায়ার রুম থেকে বেরিয়ে রুমের দিকে না গিয়ে উদয়াচল কটেজের গেইটের দিকে পা বাড়িয়েছে। মায়ার রাগটাও স্বাভাবিক। ভুলটা রাহাতেরই তাই সেটা শোধরাতেও হবে রাহাতকেই। কিন্তু মেয়েটার রাগ কি করে ভাঙাবে সেটারই কোনো প্ল্যান আসছে না রাহাতের মাথায়। আর প্ল্যান আসছে না বলেই হয়তো ছেলেটা পুরো করিডোর জুড়ে পায়চারি করছে। 

-কি রে? আর কয়বার মাপবি জায়গাটা? তোকে এভাবে ঘুরে ঘুরে পায়চারি করতে দেখে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে ভাই।

রাহাত সামনের দিকে তাকিয়েই দেখতে পেল দিহান লাগেজ হাতে কটেজ থেকে বের হচ্ছে। দিহানকে এভাবে একদম রেডি হয়ে বের হতে দেখে রাহাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

-কি রে শালা! প্রথমবার দেখলি নাকি? এভাবে হা করে তাকিয়ে আছিস যে?

-এতো রাতে তুই কোথায় যাচ্ছিস দিহান?

-মেয়েটা কেঁদেকেটে হেঁচকি তুলে ফেলেছে রে ভাই। কাল দুপুরে রওনা হবো বলেছি বলে এখন রাগ করে আর কলই রিসিভ করছে না আমার। নির্ঘাত আবার কাঁদছে। এমনিতেও অনেক কেঁদেছে পাগলিটা, আর না।

-কি বলছিস! এতো রাতে কি করে ফিরবি? রিস্কি হবে অনেক? তাছাড়া কালই তো মিহানের বিয়ে। 

-প্রিয় মানুষটাকে চমকে দিতে এইটুকু রিস্ক তো নেয়াই লাগবে দোস্ত। আর মিহানকে সরি বলে নিবো। তাছাড়া টাউনে তো ওদের বিয়ের রিসেপশানটা হবে সেখানে এটেন্ড করবো নাহয় ম্যাডামকে নিয়ে। তখন আর মিহানও রাগ করে থাকতে পারবে না। 

-এই উত্তাল সমুদ্রে এখন ট্রলার পাবি? তারউপরে ঘাটে পৌঁছতেই তো ১২ টা বাজবে রাতের। কি পাগলামি করছিস বল তো দিহান?

-ভালোবাসায় একটু আধটু পাগলামি থাকতে হয় রাহাত। নইলে কেমন একটা রোবোটিকস হয়ে যাবে ভালোবাসাটা। একটু পাগলামি করে এই একঘেয়েমিটা কাটিয়ে নিলেই দেখবি ১০ বছর পরেও মনে হবে সদ্য প্রেমে পড়া উচ্ছল কিশোর কিশোরী।

রাহাত এবারে একটু হতাশ ভঙ্গিতে পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দিহানের দিকে তাকালো।

-এখন তুইও খোঁচা মার, টিজ কর। ভালোই তো। যার জন্য করি চুরি সেও বলে চোর, যার ঘরে করি চুরি সেও বলে চোর। আমার অবস্থাটা এখন এই প্রবাদের মতো হয়ে গেছে। শালার!

-তো? তোকে আমার জন্য চুরি করতে বলসে কে গাধারাম? তুই বলেই এমন গাধার মতো স্যাক্রিফাইস করছিলি। হাহ্! আমি হলে কি করতাম জানিস?

-কি করতি?

-আমার ভালোবাসার দিকে যদি তুইও নজর দিতি না? তাহলে তোকেও মেরে এই সাগরের জলেই ভাসিয়ে দিতাম। ভালোবাসতে সবাই পারে ঠিকই, কিন্তু সেই ভালোবাসার সম্মান দিতেও জানতে হয়। শুধু ভালোবাসলে হয় না, তাকে নিজের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রাখতে জানতে হয়। নিজের ভালোবাসাটা সবার কাছ থেকে আগলে একদম বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখতে শিখ বুঝলি। 

-হুম। বুঝলাম। জ্ঞানের কথাগুলো আগে বললে তো আর এমন বোকামিও করতাম না। শালা! যত দোষ সব তোর। তোর জন্যই আমার মায়াবতীটা আমার উপরে খেপে আছে। তোকে তো সত্যি সত্যি মেরে ফেলতে মন চাচ্ছে আমার। 

রাহাত কথাটা বলেই কয়েকটা কিল ঘুষি বসালো দিহানের কাঁধে। কয়েক মিনিট দুই বন্ধু দুষ্টুমি করে নিজেরাই হেসে ফেললো। দিহান ঘড়িতে সময় দেখে রাহাতের দিকে তাকালো।

-অনেকটা দেরি হয়ে গেছে রে রাহাত। মিহানদের থেকেও বিদায় নিতে হবে। আসছি কেমন?

-সাবধানে যা৷ আমি পৌঁছে অবশ্যই ফোন করবি। 

-হ্যাঁ করবো ইয়ার। গাড়িতে যেতে সময় বেশি লাগবে না। তাছাড়া রাস্তাও প্রায় ফাঁকাই থাকবে এখন।

-হুম। তবু সাবধানে। ফাঁকা রাস্তা বলে গাড়িকে প্লেইনের মতো উড়িয়ে নিয়ে যাবি ভাবিস না আবার। সেইফ ড্রাইভ করবি। রাশ ড্রাইভ একদম না। ওকে?

-হ্যাঁন জি মেরি ভাই। আর কিছু?

-নাহ! সাবধানে থাকিস।

-হুম। তুইও সাবধানে থাকবি। কি করে মায়ার রাগ ভাঙাবি আমি জানি না, বাট মেয়েটা তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে রে। ওকে সারাজীবন আগলে রাখিস।

-হুম।

-আর একটা কথা তোকে বলা হয়নি। মিহান দিয়া এখানে সবাই জানে তোর আর মায়ার ব্যাপারে। ইনফ্যাক্ট আমি মিহানের সাথে প্ল্যান করেই তোকে সেন্টমার্টিনে নিয়ে এসেছিলাম। যাতে তুই মায়াকে ভালোবাসিস কথাটা সবার সামনে বলতে পারিস। চেয়েছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু তুই এভাবে হুট করে----। 

-আরে! তুই সরি বলছিস কেন? মায়া ঠিকই বলেছে বুঝলি। ওকে ভালোবাসতে পারি নি এখনো ঠিক করে। তবে এবারে আমি ওকে আর কোনো কমপ্লেইন করার সুযোগ দিবো না দেখিস?

-বেস্ট অফ লাক রাহাত। দোয়া করি যেন আমার আগে তুই বিয়েটা করতে পারিস। হা হা হা। 

-হারামি! তোর অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে ঢাকায় ফিরে প্রথমেই বিয়েটা করে নিবি। তোর দোয়া যে কোনো কাজে লাগবে না সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। 

-হা হা হা। তুই চাইলে দোয়া কাজে লাগানোর উপায় বাতলে দিতে পারি। অবশ্য এর পরের রিএকশন কি হবে তার দায়ভার কিন্তু আমি নিতে পারবো না ভাই।

-মানে? কি বলছিস?

-ওয়েট এ সেকেন্ড।

দিহান লাগেজ থেকে একটা ফাইল বের করে রাহাতের হাতে ধরিয়ে দিলে রাহাত ভ্রু কুঁচকে ফাইলের কাগজগুলোয় একনজর চোখ বুলিয়ে নিয়ে চোখ বড় বড় করে দিহানের দিকে তাকালো।

-এসব কি দিহান! এই পেপার?

-তিনদিন সময় নিয়েছি কি কোনো প্ল্যানিং ছাড়া আসার জন্য নাকি? ভেবেছিলাম তোদেরকে হানিমুনে রেখে আমরা সবাই ঢাকায় ব্যাক করবো। তা যখন হলোই না কি আর করা! আমার তো কাজে লাগলো না, দেখ তোর কোনো কাজে লাগে কি না।

-বাট! এই পেপার----।

-আরে ভাই। প্যারা নিচ্ছিস কেন? যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধতে হয়। তুইও নাহয় বাঁধ তোর মায়াবতীকে। তবে কিভাবে করবি সেটা তুই নিজেই ভাব। আমি আসছি রে এখন।

-হুম---।

রাহাতকে একবার হালকা করে জড়িয়ে ধরেই দিহান কটেজ থেকে বেরিয়ে গেল। রাহাত হাতে দিহানের দেয়া কাগজগুলো নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো এন্ট্রেন্সের সামনেই। কিছু একটা ভেবে রাহাতের ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। এই হাসিটাই বলে দিচ্ছে রাহাত তার মায়াবতীকে জয় করার পথ খুঁজে পেয়ে গেছে। এবার শুধু প্ল্যানটা বাস্তবায়নের অপেক্ষা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন