১১!!
নদীর পানির মধ্যে কমলা রঙা সূর্য টা যখন ডুব দিয়েছে তখন ধ্রুবর আর মাইশার মনে পড়লো বাসায় ফেরার কথা। ধ্রুব গাড়ি চালাচ্ছে আর পাশে বসা মাইশা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে। একটু ভয় ভয় লাগছে৷ সাথে কিছুটা অস্বস্তিও। ভয়টা কিসের আর অস্বস্তিটাই বা কিসের কিছুই বুঝতে পারছে না মাইশা। এর আগে বহুবার রাতুল এভাবে বাসায় ড্রপ করেছে ওকে। তখন তো এমনটা হয় নি! ভালোবাসা ছিল বলে! আচ্ছা এখনো রাতুলের পাশে এভাবে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারবে ও? রাতুলের চোখে এতোদিন তো ওর জন্য একটা স্নিগ্ধ ভালোবাসা ছিল। সেই ভরসা দেওয়া চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার একটা আশ্বাস পেত! কিন্তু আজ! সেই বিশ্বাসটা ভাঙার পর আর কখনো কি কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে মাইশা? এই যে পাশে বসে থাকা ধ্রুব! ওকে বিশ্বাস হবে তো?
ধ্রুবও গাড়ি চালাতে চালাতে আড় চোখে মাইশাকে দেখছে। মেয়েটা একদম চুপ করে জানালার দিকে মুখ করে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওকে কেন জানি এতোটা শান্ত দেখে ধ্রুবর বুকের ভেতরটা কেমন কেমন করে উঠছে। কিন্তু কি বলবে সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না। গাড়ির জানলাটার আবছা কালো আঁধারে মাইশার মুখের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। সেই প্রতিচ্ছবিটার চোখদুটো জলে ভরা দেখে ধ্রুবর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
-এই যে মেঘপরী? মন খারাপ?
-হুম?
মাইশা কোন মতে চোখের পানিটা চোখের ভিতরে চালান করেই হাসি হাসি মুখ করে ধ্রুবর দিকে তাকাল। লোকটা মেঘপরী ডাকলে কেমন কেমন একটা লাগে ওর। কেমন কেমন সেটা বুঝে উঠছে না।
-কি!
-মন খারাপ মেঘপরীর?
-নাহ------।
-আচ্ছা---। শোনো? এতোক্ষণ বাইরে যে বাসায় বকা দিবে না?
-নাহ--। বলে গিয়েছিলাম যে আসতে দেরি হতে পারে---।
-ও আচ্ছা।--- মেঘপরী?
-হুম?
-তোমার ক্লাস শেষ হলে যদি কলেজ থেকে আনতে যাই, রাগ করবে?
মাইশা ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বলবে! মানুষটার তো এখন অফিশিয়ালি ওর উপর একটা অধিকার তৈরি হয়েছে। ওকে কি না বলা যায়! তবু না বললে কি মানুষটা আর নিতে আসবে না?
-রাগ করলে?
-রাগ করলে তোমার সামনে আসবো না--। তবে তোমাকে দূর থেকে দেখেই না হয়-----।
ধ্রুব আর কিছু বললো না। মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেছে ওর। তবু সেটা হজম করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেই গাড়ি চালানোতে মন দিলো। বাড়ি পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগলো না। মাইশা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই ধ্রুবও নামল। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে এতোটা কাছ থেকে আর দেখা হবে না। কল করলে রিসিভ করবে কিনা কে জানে! ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধ্রুবর। মাইশাও সেটা খেয়াল করলো।
-আচ্ছা আসি?
-হুম।
মাইশা বাড়িতে ঢুকার জন্য পা বাড়ালো। কি মনে হতে পিছন ফিরে একবার তাকালো। মানুষটা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
-কালকে কিন্তু আমার ১টার সময় ক্লাস শেষ------।
-হুম?
-কেউ আনতে গেলে আমি অবশ্য রাগ করবো না----।
কথাটা শেষ করেই ছুটে বাসায় ঢুকে গেলো মাইশা। কি বললো মেয়েটা বুঝতেই ধ্রুবর কয়েক মিনিট সময় লাগলো। বুঝতে পারার পর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটলো ওর। গাড়িতে উঠে বসে দোতলার বারান্দাটার দিকে তাকালো। মাইশার রুমের বারান্দায় আবছা আলো আবছা আঁধারিতে একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ধ্রুব চিনতে পারলো আধো মূর্তিটাকে। তারপর ধীরে ধীরে গাড়িটায় স্পিড দিলো। মেয়েটাকে কাছে থেকে পাচ্ছে না তাতে কি! কাল থেকে সে তার মেঘপরীটাকে দেখতে পাবে প্রতিদিন বিনা বাধায় বিনা সংকোচে। এই বা কম কিসে?
১২!!
বেশ কিছুদিন কাটলো এভাবে। ধ্রুব প্রথমদিকে মাইশাকে শুধু ছুটি হলে কলেজ থেকে আনতে যেত। আজকাল সে সময় করে সকালেও মাইশাকে কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে যায়। তার অফিসটা মাইশার কলেজ থেকে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা। মাইশা জানে মানুষটা কেন এমন করে। মানুষটার ওকে দেখতে নাকি ভালো লাগে! তাই ও আর কি করবে ভেবে না পেয়ে কিছু বলেও না। অবশ্য বলবে কি! ওর কাছেও বেশ ভালো লাগছে ব্যাপারটা। মানুষটার কেয়ারিংটার নেশা ধরে যাচ্ছে মাইশার দিনে দিনে। মানুষটা বুঝতে পারে কিনা কে জানে!
আজকে অবশ্য শুক্রবার। কলেজ বন্ধ। আর ধ্রুবর অফিসও নেই। সো লম্বা একটা ঘুম দিবে চিন্তা করে শুয়ে আছে মাইশা। মোবাইলটা বেশ অনেকক্ষণ ধরে 'শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা' বলে চেঁচাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে সেটা বেশ মজা লাগছে শুনতে। মনে হচ্ছে চারপাশ ছাপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সেই বৃষ্টিতে দু হাত ছড়িয়ে মাইশা ভিজছে। একা একা ভিজছে? নাকি সাথে আছে কেউ? যে মুগ্ধ চোখে ওর বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যটা উপভোগ করছে? কে হতে পারে মানুষটা? ঘুম আর ঘোর সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে মাইশার। ৩য় বার গানটা শুরু হতে লাফিয়ে উঠলো মাইশা। গান তো নিজে নিজে বাজবে না।তার মানে কল এসেছে। মোবাইলটা গেল কোথায়!
কোনমতে ঘুম আর ঘোর কাটিয়ে খাটের পাশে বেড সাইড টেবিলের উওর থেকে মোবাইলটা নিয়ে কলটা রিসিভ করলো মাইশা।
-হ্যালো?
-ভাবিইইইইইইই---।
-হ্যালো মেহের মনি--৷ কেমন আছো বাবু?
-তুমি তো ভুলেই গেছো----।
- না গো পিচ্চি--। ভুলি নি তো-।
-ঘুমাইতেসো এখনো মিষ্টি ভাবিটা?
-হুম-----।
-একটু কষ্ট দিই আজকে ভাবিটাকে!
-বলো মেহের--। কষ্ট হবে কেন?
-বাসায় আসো না গো ভাবি---!
-কি?------বাসায়!
কথাটা শোনামাত্র খাটে লাফিয়ে উঠে বসলো মাইশা।
-হ্যাঁ ভাবি--। আজকে একটা স্পেশাল দিন তো-----।
-কি স্পেশাল!
-আজকে আমার বার্থডে----।
-ওমা তাই নাকি! হ্যাপি বার্থডে পিচ্চি বাবুটা--। কি গিফ্ট নিবা বলো!
-তোমাকে---।
-সেকি?
-আসো না? প্লিইইইজ?আজকে আরো অনেক কিছু স্পেশাল আছে।
-তোমার বার্থডে পার্টিতে তোমার ফ্রেন্ডরা আসবে-----।
-আরে পার্টি টার্টি নাই--। আসো না?সিক্রেট সিক্রেট--।
-আচ্ছা আম্মুকে বলে আসছি---।
-ভাবি! তুমি এত্তোগুলা সুইট--। আজকে তোমার জন্য গিফ্ট আছে৷
-ওমা তাই! বাড্ডে গার্ল কি গিফট করবে আমাকে?
-সেটা আসলে দেখিও---। কখন আসবা?
-বিকালে আসি?
-না না--। সারপ্রাইজ মিস হয়ে যাবে আমার--। এখনি আসো।
-সেকি! এখনি?
-আসো না প্লিজ!
-আচ্ছা বাবু---। কিন্তু আমি তো জানি না কেমনে কেমনে যেতে হয়-।
-তোমার জানতে হবে না। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিসি তোমাকে আনার জন্য--। হি হি---।
-ওরে দুষ্টু মেয়ে--। তুমি জানতা আমি আসবো যে?
-হ্যাঁ তো-৷ তুমি তো আমার লক্ষী ভাবি----।
-মেহের?
-ভাবি-- তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসো----।
-আসছি বাবুটা---।
মাইশা মা আর বাবাকে বলে এসে রেডি হতে এলো রুমে। পিচ্চি পাগলীটার কথা তো ফেলতে পারবে না। আর কি নেয়া যায় ওর জন্য? ভাবতে ভাবতে রেডি হয়ে নিলো মাইশা। রেডি হওয়া শেষ হলে আয়নায় নিজেকে দেখছে এমন সময় নিচে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো৷ কে নিতে এলো! ধ্রুব? ভাবতেই মাইশার মুখটায় লাল একটা আভা ছড়িয়ে পড়লো। অবশ্য ধ্রুব আসলে তো কল করত একবার!নাকি? মা বাবাকে বলে বেরিয়ে এলো মাইশা বাসা থেকে। বুকের ভেতরটা অকারণেই ঢিপঢিপ করছে মাইশার৷ হঠাৎ এমন কেন হচ্ছে কে জানে?