হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ০৯ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৭!! 

-ওহ শিট! প্রজ্ঞা! 

বেশ কিছুদূর গাড়ি চালিয়ে আসার পর রাগটা কিছুটা কমে এলে হঠাৎ প্রজ্ঞার কথাটা খেয়াল হলো ধূসরের। এই শুনশান জায়গাটা থেকে মেয়েটা একা ফিরবে কি করে সেটা মাথায় আসতেই গাড়িটা ঘুরিয়ে প্রজ্ঞাকে যেখানে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সেদিকেই গাড়ি চালিয়ে নিল ধূসর। প্রজ্ঞাকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল সেই জায়গাটা থেকে বেশ কিছুটা দূরেই চলে এসেছিল ধূসর। রাগের বশে কাজটা যে একেবারেই ঠিক করে নি সেটা ভেবেই নিজেকে মনে মনে হাজারটা গালি দিল ধূসর। প্রজ্ঞা ঠিক আছে কিনা সেটা ভেবেই রাগে নিজের মাথাটা ফাটাতে ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে ধূসরের। কেন যে রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারে নি প্রজ্ঞাকে দেখে সেটা ভেবে আশপাশের জায়গাটা দেখতে লাগলো ধূসর। প্রজ্ঞাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ধূসর চমকে উঠে হাত বাড়িয়ে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করলো। 

-হ্যাঁ শুভ্রা বল-------।

-ধূসর? ধূসর কোথায় তুমি? কালরাত থেকে না বাড়ি ফিরেছ না সকালে অফিসে গিয়েছ? কোথায় তুমি বলো প্লিজ? আমি এদিকে টেনশন করে মরছি আর তুমি কি সুন্দর 'হ্যাঁ শুভ্রা বল' বলছ! বাড়িতে যে কেউ তোমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে কথাটা কি একবারও মনে পড়ে না তোমার? একদিনও মনে পড়ে না?

-আজাইরা প্যাঁচাল করবি না একদম শুভ্রা। আমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতে তোকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়েছে? না তো। তাহলে এসব ন্যাকামি করিস কেন আমার সামনে? ডিজগাস্টিং। আমার অফিস, আমার বাসা, আমি যাবো নাকি রাস্তায় থাকবো তার কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে আমার?

-এভাবে বলছ কেন ধূসর? এই পাঁচটা বছরেও এক বারের জন্যও আমার পাশে বসে দুইটা মিনিট ধীরে সুস্থ কথা বলেছ তুমি? এমন একটা দিনের কথা বলতে পারবে যেদিন তুমি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে জিজ্ঞেস করেছো আমি ভালো আছি কিনা?

-এসব ন্যাকামি করার সময় আমার নেই শুভ্রা। কথাটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবি সেটাই তোর আর তোর প্রাণের প্রিয় আঙ্কেল আন্টির জন্য ভালো। 

-প্রজ্ঞা যখন ছিল তখন এই ন্যাকামিগুলোর জন্য তোমার আশেপাশে আসার জো ছিল না ধূসর। 

-সবাই প্রজ্ঞা নয়।

-ঠিকই বলেছ ধূসর। সবাই প্রজ্ঞা নয়। আর প্রজ্ঞা নয় বলেই সেদিন হসপিটালে যখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলে সেদিন প্রজ্ঞার মতো তোমাকে ফেলে চলে যেতে পারি নি।

-তুই কিছু বলবি শুভ্রা? নাকি আমার মাথাটা খেতেই কল দিয়েছিস প্রতিদিনের মতো? আমি বুঝি না এতো অপমানের পরও তোর শিক্ষা হয়না কেন। আমি অফিসে যাই নি এটা তোকে কে বললো? তোর আঙ্কেল তো দেশে নেই, অফিসেও স্পাই লাগিয়েছিস নাকি?

-ধূসর? উফ! তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা যায় না, এমন আজেবাজে টপিক নিয়ে এসো কথার মাঝে তুমি। ভালো করে যে দুটো মিনিট কথা বলবো তার উপায় নেই।

-আমার সাথে কথা বলতে কে বলে তোকে হ্যাঁ? রাখ ফোন। যত্তসব। আমি আমার কাজ করছি, ইচ্ছে হলে অফিসে যাবো, ইচ্ছে না হলে যাবো না। বুঝতে পেরেছিস?

-বাড়িতে আসবে কখন? ফুফু বাড়িতে একা আছে। একবারও কি ইচ্ছে হয়না নিজের মায়ের পাশে বসে দু মিনিট মন খুলে কথা বলতে? এতো রাতে ফিরো, আবার সকালেই বেরিয়ে যাও-----।

-তোর জ্ঞান দেয়া হয়ে গেলে আমি রাখছি। তোর ফুফু আর আঙ্কেলকে কোম্পানি দেয়ার জন্য তুই তো রেডিই বসে আছিস, আমার তো দরকার নেই। 

-ধূসর? কখন বাসায় ফিরবে সেটা তো বলো? 

-রাখ তো ফোন। ব্যস্ত আছি বললাম যে বুঝতে পারছিস না? রাখ তো রাখ। বিরক্ত করিস না আমাকে।

শুভ্রা আর কিছু বলার আগেই ধূসর নিজেই কলটা কেটে দিয়ে আরো মিনিট খানেক সামনের দিকে গাড়ি ছোটাতেই দেখতে পেল প্রজ্ঞা উল্টোদিক থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটা গাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। ধূসরের এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো গাড়িটা সোজা যেন প্রজ্ঞার দিকে তেড়ে গিয়ে ধাক্কা দিবে। ধূসর খানিকটা দূরে ছিল বলেই কি করবে ভেবে না পেয়ে গাড়ির হর্ন চেপে ধরলো। আর প্রায় সাথে সাথেই যেন গাড়ির ড্রাইভার সম্ভিত ফিরে পেয়ে গাড়িটা ব্রেক করে প্রজ্ঞার সামনে দাঁড় করিয়েছে। প্রজ্ঞা সেই গাড়িটায় উঠে চলে যাওয়ার সময়ও ধূসর বেশ খানিকটা দূরেই ছিল। তাই প্রজ্ঞাকে আটকাতে পারে নি ছেলেটা। অথবা প্রজ্ঞা রাগ করেই ধূসরকে দেখেও না দেখার ভান করে ওই লোকটার সাথেই চলে গেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই প্রজ্ঞা যে গাড়িটায় উঠেছে সেটার ড্রাইভারের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ধূসরের। আর সাথে সাথেই ধূসরের কেন জানি মনে হল এই লোকটাকে ধূসর চিনে, কোথাও দেখেছে লোকটাকে। কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটাই মনে করতে পারছে না বেচারা।

অন্যদিকে, কালো রঙের গাড়িটা হঠাৎ একদম সামনে এসে থামতেই প্রজ্ঞা নিজেও চমকে উঠেছিল। ভয়ে ভয়ে সাহস করে ড্রাইভারের দিকে চোখ পড়তেই লোকটা একটু অপরাধীর মতো মাথা চুলকালো দেখে নিমিষেই ভয়টা কেটে গেল প্রজ্ঞার। মার্কেটের দিকে যাবে বলতেই লোকটা প্রজ্ঞাকে গাড়িতে উঠতে বলে পিছনের সিটের ডোর লকটা খুলে দিল। সুনশান রাস্তায় হঠাৎ লিফ্ট নিবে কি নিবে না ভাবতে ভাবতেই শেষে গাড়িতে উঠে পড়লো প্রজ্ঞা। আবার কখন আরেকটা গাড়ি আসবে কে জানে। লোকটাকে দেখে খারাপ বলে মনেও হচ্ছে না। গাড়ির ড্রাইভার পাশের একটা গাড়িকে হাতের ইশারা করে সামনের দিকে আবার ফুলস্পিডেই গাড়ি ছোটালো। 

-আমি অনেক অনেক লজ্জিত ম্যাডাম। আসলে আমি মোবাইলে আমার মালকিনের সাথে কথা বলছিলাম তো তাই খেয়াল করি নি আপনি লিফ্টের জন্য ইশারা করেছেন যে। সরি ম্যাডাম। 

-ড্রাইভিং করার সময় মোবাইলে কথা বলাটা এজন্যই রিস্কি। দয়া করে পরেরবার থেকে ব্যাপারটা খেয়াল রাখবেন। আজ বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো। নিজের জন্য বলছি না। আপনার নিজেরও কিন্তু কিছু একটা ঘটে যেতে পারে এভাবে বেখেয়ালে মোবাইলে কথা বলার সময়।

-আমি আসলেই লজ্জিত ম্যাডাম। পরের বার থেকে এমন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবো।

-আমমমমম। আপনার মোবাইলটা কিছুক্ষণের জন্য ব্যবহার করতে পারি প্লিজ? আসলে আমার মোবাইলটা হারিয়ে গেছে, একটা আর্জেন্ট কল করতে হবে একজনকে।

-নো প্রবলেম ম্যাডাম। আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে আমার মোবাইলটা ইউজ করতে পারেন। আই ডোন্ট মাইন্ড।

 ড্রাইভার লোকটা নিজের মোবাইলটা পিছনের সিটের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিতেই প্রজ্ঞা মোবাইলটা নিয়ে হামিদের নাম্বারটাই ডায়েল করলো। লোকটা ওকে খুঁজে না পেয়ে কি করছে কে জানে। দু বার কল হতেই অপর পাশ থেকে হামিদের অমায়িক  কণ্ঠস্বরটা ভেসে এলো।

-হ্যালো হামিদ সাহেব? আমি প্রজ্ঞা--------।

-ম্যাডাম ম্যাডাম ম্যাডাম। আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন? আমি যে কি পরিমাণ টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আপনি ওয়াশরুম থেকে আসতে লেইট করছেন দেখে আমি আপনাকে খুঁজতে লেডিস ওয়াশরুমের ওইদিকে যাই। কি যে কেলেঙ্কারি অবস্থা কি বলবো? সুশীল সমাজের লোকজন আরেকটু হলেই আমাকে গণধোলাই দিত। ভাগ্যিস ওই মূহুর্তে কেউ একজন আপনার পার্স আর মোবাইলটা পায়, আর আমার কথা বিশ্বাস করে নেয়। বাট আশ্চর্য ব্যাপার হলো আজই ওদের ওয়াশরুমের বাইরের সিসিটিভি ক্যামেরাটা কাজ করছে না। 

-হামিদ সাহেব? হামিদ সাহেব? রিল্যাক্স? আমি ঠিক আছি। আপনি এখন কোথায় আছেন বলুন প্লিজ? আমি আসলে অন্য একজনের মোবাইল থেকে কল করেছি। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা।

-আর বলবেন না ম্যাডাম। আপনাকে না পেয়ে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে ক্লাইন্টের সাথে মিটিংয়েও যেতে হবে। শেষে অনেক ভেবে লাঞ্চ করে ক্লাইন্টের সাথে দেখা করতে গেলাম। এতে খাড়ুস লোকগুলো, আমাকে পাক্কা দু ঘন্টা অফিসের ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রেখেছে। এখন বিরক্ত হয়ে আমি চলে আসছি। বলে এসেছি কাল আবার আসবো। সকালের এপয়নমেন্ট নিয়ে এসেছি ম্যাডাম।

এতো কিছুর মধ্যেও ভদ্রলোক লাঞ্চের কথা ভুলে যায় নি শুনে এতো টেনশনের মধ্যেও প্রজ্ঞার হাসি পেল। কোনোমতে নিজের হাসিটা চাপার জন্য একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল।

-আপনি এই মূহুর্তে কোন জায়গায় আছেন হামিদ সাহেব? যিনি লিফ্ট দিচ্ছেন উনি মার্কেট পর্যন্ত লিফ্ট দিবেন তো। আপনি কি কষ্ট করে ওদিকে আসবেন?

-জি জি ম্যাডাম। আমি মার্কেটের ওই দিকটাতেই আছি। আপনি আসলেই আমাকে দেখতে পাবেন। 

-ঠিক আছে। আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আমার বেশি সময় লাগবে না।

প্রজ্ঞার শেষের দিকের কথাগুলো শোনার আগেই হামিদ সাহেব কলটা কেটে দিল। ড্রাইভারের মোবাইলটা ফিরত দিতে গিয়ে একটু বিব্রত হাসলো প্রজ্ঞা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ড্রাইভার গাড়িটা মার্কেটের সামনে এসে ব্রেক করতেই প্রজ্ঞা ড্রাউভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামতে নামতে হামিদ সাহেবকে ব্যস্ত চোখে খোঁজার চেষ্টা করলো। লোকটা মার্কেটের সামনের দিকেই তো থাকবে বলেছিল। গেলটা কোথায়? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ড্রাইভারের গাড়ির হর্ন বাজানোয় চমকে তাকালো প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা তাকাতেই হাতের ইশারায় সামনের দিকে কাউকে দেখালো ভদ্রলোক।

-ওই যে ম্যাডাম, আপনার হামিদ সাহেব। আপনার অপেক্ষায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লেবু চা খাচ্ছে। বড্ড আমুদে লোক বলতেই হবে। ভালো থাকবেন ম্যাডাম। আবার দেখা হবে আশা করছি।

ড্রাইভার লোকটা কথাগুলো বলে একটা রহস্যমাখা হাসি দিয়ে শাঁ করে নিজের গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিতেই প্রজ্ঞা কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। লোকটা অবশ্য প্রজ্ঞার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করলো না। আর প্রজ্ঞা মুখ ঘুরিয়ে একবার হামিদ সাহেবকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে দেখে আবার গাড়িটার চোখের পলকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো ড্রাইভার লোকটা হামিদ সাহেবকে চিনলো কি করে?

১৮!! 

-ম্যাডাম, একটা ব্যাড নিউজ আছে। ঠিক একটা খারাপ খবর বললে ভুল বলা হবে। অনেকগুলোই খারাপ খবর আছে আপনার জন্য। 

কালো রঙের গাড়িটা প্রজ্ঞাকে মার্কেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে শা করে চলে গেল। প্রজ্ঞা যে বোকার মতো ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ছিল সেটা সেও ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। প্রজ্ঞাকে কোনোরকম কৌতূহল প্রকাশ করার সুযোগ না দিয়েই লোকটা রীতিমতো ব্যস্ত মার্কেটের এরিয়া থেকে চলে গেছে। ঠিক চলে যাওয়া না, যাকে এক কথায় বলে পালিয়ে আসা। আধ ঘন্টার মতো পরেই নিজের গন্তব্যে ফিরে এসে কাউকে কল করে কথাগুলো বললো লোকটা। অপর প্রান্ত থেকে ইচ্ছেমতো গালি বর্ষণের অপেক্ষায় আছে লোকটা। ম্যাডামের গালি দিয়ে মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হলে তারপর নিজের বক্তব্যটা বলবে লোকটা। এ যেন তার প্রতিদিনকার রুটিন। আজও হলোও তাই। অপর প্রান্ত থেকে একটা রাগী কর্কশ কণ্ঠে বিশ্রি হাজারটা গালি ভেসে এলো লোকটার কানে। এতোগুলো বছর ধরে এই কর্কশকণ্ঠী গালিগুলো শোনার পরও কেন যেন হজম হতে চায় না লোকটার। তবুও অপমানে কান লাল হওয়ার পরও চুপচাপ ঝাড়িগুলো হজম করে নেয়। মাঝেমাঝে লোকটাও ভাবে, এতো কাজ করিয়ে নেয়, অথচ সামান্য এদিক ওদিক হলেই এমন সব কথা বলে যা শুনে মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় বাকিদের মতো একেও উপরের টিকিট ধরিয়ে দিই। 

-তোদের মতো দুই টাকার লোকদের দিয়ে একটা কাজও যদি কখনো ঠিকঠাক মতো হয়েছে। কি পারিস কি তোরা? গাণ্ডেপিণ্ডে গিলা ছাড়া আর কিছু করতে পারিস? কালকে সামান্য একটা কাজ দিলাম সেটাও করতে পারলি না। ওই বুড়ো যেন কোম্পানিতে কি চলছে না জানতে পারে তার দায়িত্ব দিলাম একজনকে, সে উল্টো বুড়োর সামনেই পারলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে কেটে সব স্বীকার করে দেয়। আর তুই? তুই তো দলের আরেক অকাজের গরু। গরুও না, রাম গাধা। বারবার করে বলেছি প্রপার্টি দখল নেয়ার আগে সব খোঁজ খবর নিবি, মালিক বেঁচে আছে কি না, তার কোনো নোমিনি দেশে আছে কিনা, কেয়ারটেকারকে কিছু টাকা দিয়ে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া যায় কিনা। নিজের মতো কাজ করছি, এই ঢংয়ের কথা বলে আবার একটা গন্ডগোল বাঁধালি তো? এবার নিশ্চয়ই যে কাজটা দিয়েছিলাম সেটাও করতে পারিস নি, তাই তো? তোদের পিছনে মাসে মাসে এতো টাকা ঢেলে কি বালের লাভটা হচ্ছে আমার? এর থেকে আর সবার আগে তোদেরকেই উপরে পাঠাতে হবে মনে হচ্ছে। 

-ম্যাডাম, কাজটা হয়ে যেত আজই। আমার একটু লেইট হয়ে গিয়েছিল আসলে। গ্যারেজ থেকে একজন পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। তাই ওই মেয়েটার কাছে যেতে দেরি হয়ে গেছে। 

-মেরেছিস তো ওকে? আর কেয়ারটেকারটাকে? ওকে জীবিত ছেড়ে দিয়েছিস? তোদেরকে আগেই বলেছি দুটোকেই একসাথে শেষ করে দিতে-----।

-আমমমম। আসলে শেষ পর্যন্ত প্ল্যানটা ক্র্যাক করে নি ম্যাডাম। ব্যাপারটা পুরো এক্সিডেন্টের এংগেলে সাজিয়েও ফেলেছিলাম। শেষমূহুর্তে ধূসর স্যার এসে সব গন্ডগোল করে দিল। ওই রাস্তা দিয়েই স্যার কোথাও একটা যাচ্ছিলেন, বা কোথাও থেকে ফিরছিলেন, আমার গাড়িটা ওই মেয়েটার দিকে যাচ্ছে দেখে বেশ কয়েকবার হর্ন বাজায়। আমিও তাই মেয়েটাকে লিফ্ট দেয়ার বাহানায় নিজের গাড়িতে তুলে নিই।।

-ধূসর? ধূসর তোকে চিনতে পারে নি তো মুন্না? তাহলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে। ও যদি একটুও আন্দাজ করতে পারে ওইদিনের এক্সিডেন্টের পিছনে তোর হাত আছে তাহলে আমার নামটাও সামনে চলে আসবে। এমন কিছু ঘটলে তোকে সোজা গুলি করে মারবো আমি মুন্না।

-আরে না না ম্যাডাম। স্যার আমাকে চিনতে পারবে কি করে? উনি সেদিন মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। আর শেষ মূহুর্তে আমার ট্রাকটা উনার গাড়িতে ধাক্কা দেয়ার সময় এক নজর আমার দিকে ফিরেছিল ঠিকই, বাট তখন তো সব অন্ধকার হয়ে গেছে হঠাৎ ধাক্কা লাগায়। আর এক্সিডেন্টটা নিয়ে উনার মনে কোনো সন্দেহ হলে এতোদিনে জেলে থাকতে হতো আমাদেরকে।

-জাস্ট শাট আপ। তারপর কি হলো? ধূসর কোথায় গেল? ও কোথা থেকে আসছিল? আর মেয়েটা? মেয়েটাকে এখনও শেষ করিস নি কেন হ্যাঁ? 

-গাড়িতেই মেয়েটা আমার মোবাইল দিয়ে কেয়ারটেকারের নাম্বারে কল করে। তখনই সুযোগ বুঝে ওই মেয়ের ঘাড়টা মটকে দিতে চেয়েছিলাম। বাট পুরোটা রাস্তা ধূসর স্যার আমার গাড়িটা ফলো করেছিল। তাই আর কিছু করি নি। 

-ধূসর তাহলে নিশ্চয়ই কিছু আান্দাজ করতে পেরেছে। আহহহহহহ। এবার? এবার কি হবে? ও তো সব জেনে যাবে? ওই বুড়োটারও এখনই গোয়ান্দাগিরি করতে ইচ্ছে হয়েছিল। ওই বুড়োর নাটকেই তো সবাইকে কনভেন্স করেছি যে লোকটা অফিসের কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছে। বাট ধূসর? ওকে কি করে সামাল দিব? একটা কাজও তোরা ঠিক মতো করতে পারিস না হারামজাদারা। আর বিপদে পড়ি আমি। 

-ম্যাডাম। উমমমমম। আমার মনে হয় না ধূসর স্যার আমাকে ফলো করছিল। তাহলে মেয়েটাকে ড্রপ করে দেয়ার পরও উনার গাড়িটা দেখতে পেতাম আশেপাশে কোথাও। বাট ধূসর স্যারের গাড়ির আর মোবাইলের লোকেশন ওই মার্কেটের ওখানেই শো করছে। আই থিংক, স্যার ওই মেয়েটাকেই ফলো করতে করতে আসছিল। আমাকে নয়।

-মেয়ে? কে ওই মেয়ে?! ওই ডাক্তার বুড়োটা তো নাকি বিয়েও করে নি। তাহলে এই মেয়ে কোথা থেকে আমদামি হলো? নাম কি ওর? আর ধূসরের সাথেই বা কি সম্পর্ক ওর?! এক প্রজ্ঞাকে ওর জীবন থেকে সরাতে পারছি না, এর মধ্যে আরেকজন এসে হাজির। আহহহহহহহ। 

-ম্যাডাম। আপনি টেনশন করবেন না একদম। আমি দেখছি মেয়েটার কোনো ডিটেইলস বের করতে পারি কিনা। আর তাছাড়াও হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে। কাল সকালে কেয়ারটেকারের সাথে আসবে ওই মেয়েটাও। আপনার সাথে মিটিংয়ের এপয়নমেন্ট নিয়েছে শুনলাম।

-কাল সকালের মধ্যে ওই মেয়ের সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই মুন্না। এর জন্য যা করতে হয় কর। আর ওই মেয়ের ব্যবস্থা আমি নিজে করছি কাল। তোরা শুধু ওর ডিটেইলস জোগাড় করে দে রাতের মধ্যে।

-ওকে ম্যাডাম। আর ম্যাডাম আপনার আঙ্কেল? উনি তো আবার সেন্সে ফিরলেই পালাতে চেষ্টা করবে। কতোক্ষণ আর পাহারা দিয়ে রাখা যাবে বলুন?

-ওই বুড়োকে কয়দিন ওভাবেই বেঁধে ফেলে রাখ। শুভ্রাকে ধোঁকা দেয়ার পরিণতি কি হতে পারে ওই বুড়োকে বুঝতে হবে। ওই বুড়োর সাহস কত বড় যে আমাকে ট্রাপে ফেলার জন্য লোকটা আমার আর ধূসরের এঙ্গেজমেন্টের এনাউনমেন্ট পর্যন্ত করে দিয়েছে। আমি এঙ্গেজমেন্টের আনন্দে সব ভুলে থাকবো আর সে আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করবে। প্রমাণ! হাহ্। এবার কর না প্রমাণ জোগাড়? পচে গলে মর ওই অন্ধকার গ্যারেজের মধ্যে। পালাতে চাইছে তো? চেষ্টা চালিয়ে যাক। তোরাও আবার হাত পা গুঁটিয়ে থাকিস না গর্ধবের দল। ওই বুড়ো যদি পালায় তাহলে আমি তোদের সবগুলো অকর্মার ঢেঁকিকে একসাথে জিন্দা জ্বালিয়ে মারবো, ওই গ্যারেজেই। কথাটা বাকি আহামক্কগুলোকেও বলে দিস। 

-পালাতে পারবে না ম্যাডাম। আমি গ্যারেজে চলে এসেছি। আপনার আঙ্কেলকে একটা ইনজেকশন দিয়ে তারপর বের হবো ডাক্তারের মেয়ের খোঁজ করতে। 

-কাল সকালের আগে কোনো স্টেপ নিবি না। যা করার দূর থেকেই করবি। শুধু ইনফর্মেশন জোগাড় করবি তুই। আর কিচ্ছু না। মনে থাকবে?

-ওকে ম্যাডাম।

-আর ধূসর কি করছে, কেন ওই মেয়েকে ফলো করছে সেটাও খোঁজ নে মুন্না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ওই মেয়েটার সাথে প্রজ্ঞার কোনো কানেকশন আছে। আচ্ছা মুন্না? ওই মেয়ে---ওই মেয়েটা প্রজ্ঞা নয়তো? 

মুন্নার সাথে কথা বলতে বলতে শুভ্রা এতোটাই রেগে গিয়েছিল যে শেষের দিকের কথাগুলো রীতিমতো চিৎকার করেই বলে ফেলেছিল। ওরা যে খালি পড়ে থাকা জায়গাটায় সুপার শপ বানানোর জন্য জমি দখল করেছিল সেটার বিষয়ে কথা বলতে কে বা কোথা থেকে এসেছে, আর সেই মেয়ের সাথে ধূসরের কি সম্পর্ক এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ প্রজ্ঞার নামটাই অজান্তে শুভ্রার মনে পড়ে যায়। নিজের সমস্ত অন্যায়ের সাক্ষী ওই মুন্না নামের লোকটাকে কথাটা বলার সাথে সাথেই পিছন থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। শুভ্রা বিদ্যুৎবেগে পিছনে ফিরতেই একটা আচমকা চড় এসে পড়লো ওর গালে। শুভ্রা গালে হাত দিয়ে মানুষটার দিকে একবার তাকিয়েই কলটা কেটে দিল। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা বাঘের মতো ক্ষিপ্রবেগে শুভ্রার হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। আর তার ব্যর্থতার রাগটা প্রকাশ পেল শুভ্রার গালে আরেকটা কষিয়ে থাপ্পর পড়ায়। শুভ্রার তাতে কোনো হেলদোল আছে বলে মনেই হলো না। 

-তুই এতোটা নিচে নেমে গেছিস শুভ্রা যে নিজের লোকজনকেও কষ্ট দিতে একবারও বাঁধছে না তোর? তোর সাহস হলো কি করে আমার ছেলে, আমার স্বামীর ক্ষতি করার চেষ্টা করার? বল ধূসরের বাবাকে কোথায় আটকে রেখেছিস?

-আমি যতই ভাবি আর নতুন করে এসব পচা কাজ করবো না ততই তোমরা সবাই মিলে আমাকে বাধ্য করাও করতে ফুপ্পি। তোমার ওই বুড়ো বরের কি দরকার ছিল আমার পিছনে টিকটিকি লাগানোর? অফিসের একটা লোকেরও সাহস নেই আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার। ওরা জানে আমি কি করতে পারি না পারি। বাট তোমার ওই বুড়োর সাহসটা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল। কি ভেবেছে আমি কিচ্ছু জানতে পারবো না আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র চলছে? 

-তারমানে ধূসরের বাবা যা সন্দেহ করেছিল সেটাই ঠিক? তুই ধূসরের এক্সিডেন্ট, ট্রিটমেন্টের কথা বলে যত টাকা নিয়েছিস সব ধোঁকা ছিল? এক্সিডেন্টটাও তুই করিয়েছিস, প্রজ্ঞার কারণে হয় নি? এতো কিছু করেও তোর মন ভরে নি? আর কি চাই তোর? আমি কতোটা বোকার মতো তোকেই সাপোর্ট করেছি এতোদিন------। ভাবতেই নিজেকে গালে গালে থাপড়াতে ইচ্ছে করছে আমার। আহহহ।

-উফ। ফুপ্পি? তুমিও এবার শুরু করে দিও না তো। আমি কি এমন করেছি? যাকে ভালোবাসি, তাকে নিজের করে পেতে চাই, এতে দোষের কি আছে বলো তো? ধূসরের এক্সিডেন্ট করিয়েছি মানছি। কেন করিয়েছি? যাতে ওই মেয়েটা ধূসরের জীবন থেকে চলে যায়। খুন খারাবি করতে চাই নি। কিন্তু কি লাভ হলো? ওই মেয়েটা ধূসরের জীবন থেকে চলে গিয়েও ঠিকই আমাদের মাঝখানে রয়ে গেছে। আর তোমার ওই গুণধর বুড়ো স্বামী। নিজেকে বিশাল বড় ডিটেক্টিভ ভাবে তাই না? ওই বুড়ো কি জানে অফিসের, এই বাড়িতে, ধূসরের যেখানেই যায়, তার প্রতিটা কোণায় কোণায় আমার হুকুম চলে? আমার সাথে চালাকি করে প্রজ্ঞাকে খুঁজে বের করতে চেয়েছিল না? এবার ওই কালকুঠুরিতেই পচে মরুক। 

-শুভ্রা? ভদ্রভাবে কথা বল। উনি তোর আঙ্কেল হয়।

-আঙ্কেল মাই ফুট! আমার আর ধূসরের মাঝে যে আসবে তাদের কাউকেই ছাড়বো না আমি। তোমাকেও না ফুপ্পি। আর ওই প্রজ্ঞাকেও না।

শুভ্রা কথাগুলো বলতে বলতেই উল্টো হাত দিয়ে একটা ফুলদানি টেনে নিয়ে সজোরে সেটা দিয়ে আঘাত করলো ভদ্রমহিলার মাথায়। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে কয়েকটা কথাই শুনতে পেলেন ধূসরের মা।

-এতো সহজে তো আমি নিজের অধিকার ছেড়ে দিবো না ফুপ্পি। ধূসরকে পাওয়ার জন্য যদি আমাকে তোমাদের সবাইকে খুনও করতে হয় তবে আমি হাসতে হাসতে সেটাও করতে পারি। ধূসরের জন্য যেমন আমি নিজের জীবন দিতে পারি, তেমনি তোমাদের সবার জীবন কেড়েও নিতে পারি। তোমার, তোমার বুড়ো বরের, ওই প্রজ্ঞার, এমনকি খোদ ধূসরেরও।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন