বকুল ফুলের মালা - পর্ব ৩১ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৬১!! 

এই মূহুর্তে মায়রা শাশুড়ির সামনে বাটি ভর্তি গরম গরম ভেজিটেবল স্যুপ নিয়ে বসে আছে। দু এক চামচ খাওয়ার পরই শাশুড়ি মাথা নেড়ে খাবে না বলার চেষ্টা করলেই মায়রা বাচ্চাদেরকে ধমক দেয়ার মতো ভঙ্গিতে চোখ গরম করে তাকাচ্ছে।  আর তাতেই তিনি আর কিছু না বলে আরো কয়েক চামচ স্যুপ বিনা বাধায় খাচ্ছেন। একটু পর পরই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে দেখে এবারে আয়ান একটু শব্দ করেই হেসে ফেললো। আর আয়ানের হাসির শব্দ শুনে মায়রা চোখ কটমট করে তাকালো। 

-এই তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছ কেন? তোমার জন্যই মা খেতে পারছে না। যাও এখান থেকে?

-যাব্বাহ! আমি কি করলাম?

-যেতে বললাম না তোমাকে? রুমে গিয়ে রেস্ট করো গিয়ে--। যাও--।

-মা? দেখো তোমার বউমা তোমার সামনেই আমাকে কিভাবে বকছে? এটা কেমন কথা?

মায়রা আবার কটমট করে আয়ানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কলিংবেলের শব্দে আর কিছু বলা হলো না। আয়ানও ছুটলো দরজা খোলার জন্য। মায়রা শাশুড়িকে খাইয়ে দিতে দিতে ভাবতে লাগলো। এখন কে আসতে পারে? বাবার আসার কথা নয় এখন। তাহলে?

আয়ান নিচে এসে এসে মেইনডোর খুলতেই আরিশা আর তাওহীদকে দেখে অবাক হয়ে গেল। আয়ান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে আরিশার কোল থেকে আরশিকে নেয়ার চেষ্টা করতেই আরিশা মুখ বাঁকিয়ে সরে গেল। 

-কে ভাই আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না? আমি এসেছি আমার আন্টির সাথে দেখা করতে। আর আমার বান্ধবী মায়ুর খোঁজ খবর নিতে---। হুহ। সরুন তো সামনে থেকে?

-কি? এই আরু? কি বলিস এসব?

আরিশা আয়ানকে মুখ ভেঙ্গিয়ে তাওহীদের দিকে তাকালো।

-হ্যাঁ গো সোয়ামি? এই খারাপ লোকটা কে গো? এই পচা লোকটার তো এখন বাসায় থাকার কথা ছিল না। এ এখনো বাসায় কেন? আর আমাদেরকে ঢুকতে দিচ্ছে না কেন? আমরা কি দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো? নাকি চলে যাবে?

তাওহীদের জবাব দেয়ার প্রয়োজন হলো না। তার আগেই আয়ান খানিকটা বিব্রত হয়ে দরজার সামনে থেকে সরে এলো। আরিশা আরেকবার মুখ বাঁকিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। আর এই সুযোগে আয়ান তাওহীদের সাথে হ্যান্ডশেইক করে কোলাকুলি করলো। তারপর একটু টেনে তাওহীদকে সরিয়ে আনলো আরিশার থেকে কিছুটা দূরে। 

-ভাই? কাহিনীটা কি? আপনার বউ আজ এমন পাগলের মতো কথা বলছে কেন? 

-আরু তোমার উপরে অনেক খেপে আছে ভাই। শুধু খেপে আছে বললে কম বলা হবে। বলা যায় রেগে ফায়ার হয়ে আছে।

অজান্তেই আয়ান কিছুটা ভয় পেয়ে ঢোক গিললো। আজকে কপালে কি আছে কে জানে! তার উপরে আরিশা যদি জানতে পারে এই কয়টা দিন কি হয়েছে বা মা গতকাল থেকে অসুস্থ তাহলে তো হয়েই গেল। আয়ানের আজ রক্ষাই নেই। আরিশা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে পিছন ফিরে তাওহীদকে আয়ানের সাথে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

-এই যে সোয়ামি? আপনি এই বাজে লোকটার সাথে কি কথা বলছেন? তাকে জিজ্ঞেস করুন আন্টি, আঙ্কেল আর মায়রাকে দেখছি না কেন? এখনো ঘুম ভাঙ্গে নি উনাদের?

-আসলে----। আসলে আরু? হয়েছে কি--।

-এতো আমতা আমতা না করে সবাই কোথায় আছে বলে দিলে ভালো হয় না?

-না মানে---। বাবা অফিসের কাজে একটু-- সিলেটে গেছে--।

-ওহ! আঙ্কেল নিশ্চয়ই যাওয়ার সময় আন্টিকে আর মায়রাকে নিয়ে যায় নি? তাই না?

-আরে না না! মায়রা মায়ের রুমে আছে----।

-ওহ! আর সেটা কেন বলতে পারবেন প্লিজ? 

-না মানে---। আসলে আরু? মা গতকাল থেকে একটু অসুস্থ। 

-ও আচ্ছা---। আর?

-আর কিছুই না। মায়রা মাকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিতে----।

-হুমমমম। গুড। 

-আরু শোন না?

আরিশা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে আয়ানের ডাক শুনে ঘুরে তাকালো। আরিশার রাগে লাল মুখটা দেখে আয়ান ভয়েই আর কিছু বলতে পারলো না। আরিশা আরশিকে ঠিক করে কোলে নিয়ে মেয়ের সাথেই কথা বলতে বলতে আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।

-এই লোকটাকে দেখেছিস না? ওই পচা লোকটার কোলে একদম যাবি না। ওর সাথে আমাদের দুজনেরই আড়ি। মনে থাকবে?

-আরু? শোন? আরশিকে মায়ের কাছে নিস না।

-এখন কি আমি আমার মেয়েকে কার কাছে নিবো কার কাছে নিবো না তার জন্য তোর কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে?

-আরে বাবা? ডাক্তার বলেছে মায়ের হয়তো ভাইরাল ফিভার হতে পারে। ছোটো মানুষ ইনফেক্টেড হতে পারে। ওকে বরং তুই আমার কাছে দিয়ে যা প্লিজ?

-তোর কাছে? অসম্ভব----।

-আরু?

আরিশাকে কি বলবে আয়ান নিজেও বুঝতে পারছে না। মেয়েটা যা রেগেছে এখন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করাটাও মুশকিল। আয়ানের এসব ভাবতে ভাবতে আরিশা এসে তাওহীদের কোলে আরশিকে দিয়ে দিল। আয়ানের দিকে একবার না তাকিয়েই আরিশা এবারে সিঁড়ির দিকে ছুটলো।

-তাওহীদ? তুমি যদি আরশিকে ওই বদ ছেলের কোলে দাও তবে তোমার একদিন কি আমার একদিন--। মনে থাকে যেন---।

তাওহীদকে কথাটা বলেই আরিশা ছুটে উপরে আয়ানের মায়ের রুমের দিকে চলে গেল। আয়ান বেচারা এবারে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তাওহীদ আয়ানের কোলে আরশিকে দিতেই আয়ান যেন বাস্তবে ফিরে এলো। আরশি আয়ানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে দেখে আয়ানের মুখেও সেই হাসির ছোঁয়া লাগলো।

-তাওহীদ ভাই আপনার বউ এসে দেখলে কিন্তু আমার রাগ আপনার উপরে ঝাড়বে----।

-আরে নাহ ভাই। দেখবেন বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতেই পারবে না। হাজার হোক আপনি তো ওর বেস্টফ্রেন্ড---।

-সেরকম হলেই বাঁচি ভাই। নইলে আমার কপালে যে আমার কি শনি নাচছে উপরের এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না---।

এদিকে মায়রা স্যুপ খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে সবে শুইয়ে দিয়েছে এমন সময় আরিশা রুমে ঢুকলো। আরিশাকে দেখে মায়রা আর আয়ানের মা দুজনেই যেমন অবাক হলো তেমনি খুশিও হলো। আরিশা আয়ানের মায়ের পায়ের কাছে এসে বসলো।

-কেমন আছো আন্টি? শরীরের কি হাল করেছ তুমি? তোমার ছেলের বউটা বুঝি বেশি জ্বালাতন করছে?

আরিশার কথাটা শুনে মায়রা খানিকটা বিব্রত হলেও শাশুড়ি হেসে ফেললেন।

-আরে নাহ মা। একটু দুর্বল লাগছে এই যা। এরা দুজন এমন কান্ড করছে যেন আমি গুরুতর অসুস্থ। তেমন কিছুই না।

-হুম---। মায়রা? কেমন আছো?

মায়রা আরিশার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটু হাসলো। মেয়েটার চোখে মুখের ক্লান্তিটা আরিশার চোখ এড়ালো না। আরিশাও মিষ্টি করে একটু হাসলো।

-একটু দেখবে ওরা দুজনে আরশিকে সামলাতে পারছে কিনা? আমি ততক্ষণ আন্টির সাথে একটু গল্প করি কেমন?

-আচ্ছা আপু---।

মায়রা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে আরিশা চাচ্ছে না এই মূহুর্তে মায়রা ওই রুমে থাকুক বা তাদের কথাবার্তা হয়তো মায়রাকে নিয়েই হবে তাই মায়রাকে চলে যেতে ইশারা করছে আরিশা। মায়রা তাই শাশুড়ির দিকে অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলো। শাশুড়ি বহুদিন পর মায়রার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সত্যিকারের হাসি।

-যাও মায়রা। তুমিও কিছুক্ষণ রেস্ট করে নাও। আমার শরীরটা এখন ভালো আছে। দরকার পড়লে তোমাকে ডাকবো---।

-জি আচ্ছা মা---।

আরিশার থেকে বিদায় নিয়ে মায়রা রুম থেকে বেরিয়ে নিচতলায় ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ালো। কেমন একটু ভয় ভয় করছে মায়রার। আরিশা কি বলতে বা জানতে এসেছে মায়রা সেটা জানে না। তবু ভয় করছে ওর। আচ্ছা আয়ান কি আরিশাকে আসতে বলেছে? মায়ের সাথে কথা বলার জন্য? সেরকম হলে তো আয়ান তো বলতো। এমনি কোনো কাজে এসেছে ওরা? নাকি অনেকদিন দেখা হয় না তাই এসেছে? কিন্তু সেরকম হলেও আয়ানকে অন্তত জানিয়ে আসতো ওরা। অবশ্যই জানিয়ে আসতো। তাহলে? কিছুই মেলাতে পারছে না মায়রা। হিসেব মিলছে না বলেই আরো ভয় লাগছে ওর। বার বার মনের ভেতরে কেউ যেন কু গাইছে। আবার না জানি কি হয়!

৬২!! 

-আন্টি? তুমি কি কোনো কারণে আয়ান বা মায়রার উপরে আপসেট? প্লিজ আন্টি এই বিষয়টা যত তুমি তোমার মনের মধ্যে চেপে রাখবে তত তুমি নিজেই অসুস্থ হবে। আমাকে বলো প্লিজ?

আরিশার কথাটা শুনে আয়ানের মা একটু চমকে উঠলেন ঠিকই। কিন্তু সেটা আরিশাকে বুঝতে দিলেন না। সহজ ভঙ্গিতে আরিশার চোখে চোখ রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপার বৃথা চেষ্টা করলেন। মায়রাকে যতই মেনে নেয়ার চেষ্টা করুক না কেন কোথায় যেন একটা চাপা ক্ষোভ, চাপা অভিমান রয়েই গেছে উনার মনের মধ্যে। সেটা কারো চোখে পড়ুক না পড়ুক আরিশার চোখে ঠিকই ধরা পড়ে গেছে। তাই সেটা লুকানোর আর কোনো বৃথা চেষ্টা করলেন না আয়ানের মা। সরাসরি আরিশার চোখে চোখ রাখলেন।

-আরু? তোর কি মনে হয় ওরা আমাদের থেকে পুরো ব্যাপারটা লুকিয়ে ভুল করে নি?

-ভুল তো করেছে আন্টি। তবে সেটা হয়তো তোমাদেরকে কষ্ট না দেয়ার জন্যই করেছে ওরা।

-তার মানে তুইও পুরো ব্যাপারটা জানতি? তাই না?

-জানো আন্টি? আয়ান আর আমার বন্ধুত্বটা ঠিক সাধারণ আর দশটা বন্ধুর মতো নয়। এমন অনেক কিছুই আছে যেটা তুমি বা আঙ্কেল বা ইভেন মায়রা পর্যন্ত জানে না। কিন্তু আমি জানি। পার্টনার ইন ক্রাইম ব্যাপারটার মতো অনেকটা। ভাই বোনের চেয়েও যদি বেশি কোনো যদি সম্পর্ক থেকে থাকে, তবেই সেটাই আয়ান আর আমার সম্পর্ককে বলতে পারো।

-তুই সবটা জানতিই যদি তাহলে আগেই কেন---?

-আন্টি? আয়ানের লাইফে কখন কি হচ্ছে সেটা আমি জানবো না তা কি হয় বলো? আর মায়রার ব্যাপারটা বলছো? সেটাও আমি জানি, প্রথম থেকেই জানতাম। কিন্তু কি করবো বলো তো? সবকিছুর উপরে তো আমাদের হাত থাকে না বলো?

-তুই তো মায়রার কথাটা আমাদের জানাতে পারতি আরু। তাহলে অন্তত----।

-কি আন্টি? থেমে গেলে কেন? তাহলে কি? মায়রাকে আয়ানের বউ করে আনতে না তাই তো? কিন্তু সেটা করলে তোমার ছেলেটা কি আধো বেঁচে থাকতো?

-আরু? কি যা তা বলছিস?

-আমি মন গড়া কোনো কথাই তোমাকে বলছি না আন্টি। তোমার মনে আছে এই তো চার পাঁচ মাস আগেই তুমি আমাকে কল করে বলেছিলে আয়ানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে আয়ানকে আমি আর তাওহীদ মিলে খুঁজে বের করলাম?

-হ্যাঁ---।

-সেদিনটা কি ছিলো জানো? মায়রার জন্মদিন ছিল। মায়রাকে হারিয়ে তোমার ছেলেটা তো একটা জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে ছিল। হাসতে ভুলে গেছিল, না কারো সাথে কথা বলতো ঠিক করে, না খাওয়া দাওয়া করতো। শুধু মায়রাকে ভোলার জন্য সারাদিন কাজে ডুবে থাকতো। কিন্তু যখন একা থাকতো? তখন কি ভাবতো জানো? কি করে এই অসহ্য যন্ত্রণার জীবনটা থেকে মুক্তি পাবে। তুমি জানো ও মরে যাওয়ার কথাও ভেবে ফেলেছিল----।

-আরু? কি বলছিস এসব?

-ছয়টা মাস ওরা দুজন আলাদা হয়ে সমান কষ্টই পেয়েছে আন্টি। আয়ানকে জোর করে কক্সবাজারে নিয়ে গেছিলাম আমি যাতে ওর মুডটা ফ্রেশ হয়। সবটা ভুলে যেন সামনে এগোতে পারে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেখানেই আবার ওদের দুজনের দেখা হয়। আর ওদের দেখা না হলে কখনো আমরা জানতেও পারতাম না মেয়েটার উপরে কি অমানুষিক নির্যাতনটা হয়েছে। তুমি জানো? ওই লোকটা মায়রাকে মায়রার মামা মামির বাসায় মেরে অজ্ঞান ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। আবার সে কোথা থেকে খবর পেয়ে কক্সবাজারেও গিয়ে হাজির হয়। সেটা কেন জানো? ডিভোর্স দেয়ার জন্য---।

-কি বলছিস? এ কি মানুষ?

-তুমি তো জানো আন্টি। একটা মেয়ে যা কিছু হয়ে যাক নিজের সংসারটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু এমন অমানুষের সাথে থাকাটা কি আধো সম্ভব? তুমিই বলো?

--------------------------

-তুমি হয়তো ভাবতে পারো আয়ান এতো তাড়াহুড়ো করে কেন বিয়ে করলো মায়রাকে। ইদ্দত শেষ হওয়ার পরের মাসেই কেন বিয়ে করতে হলো। কি জানো তো আন্টি। আয়ানকে এই কাজটায় আমি মন থেকে সাপোর্ট করেছি। এই যে দেখো যত দিন যেত তত মায়রাকে নিয়ে হয়তো নানাজনে নানা কথা তুলতো। হয়তো সেটা তোমরা বিশ্বাসও করে নিতে। কখনো মানতেও না। জানো? এই বিয়েটা ভাঙ্গার পিছনে মায়রার কতটুকু দোষ ছিল আমি জানি না। কিন্তু দোষের চেয়েও অনেক বেশি শাস্তি ওকে পেতে হতো। এই যে এখন যেমন পাচ্ছে। ওর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল বলে ওর সব ভালো দিকটা মুছে গেছে তোমার কাছে। তুমিও তাই ভাবছ যা আমাদের সমাজের আর দশজন লোক ভাবে। তুমিও হয়তো ভাবছ স্বামী মারতো! এ আর এমন কি? আরো কিছুদিন সহ্য করা উচিত ছিল মায়রার। অথবা আর দশটা অত্যাচারিত মেয়ের মতো স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মরে যাওয়া উচিত ছিল।

-আরু?

-কি বলো তো আন্টি? আয়ান আর মায়রা ভুল তো করেছে। অবশ্যই ভুল করেছে। সেটা কি জানো? মায়রার বাবা মা যখন ওকে ওই লোকটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো ওদের উচিত ছিল তোমাদেরকে ওদের সম্পর্কটার কথাটা জানানো  কিন্তু গাধা দুটো এই সামান্য কাজটা করতে ভুলে গেছে। আয়ান অবশ্য মায়রাকে বলেছিল ওর সাথে চলে আসতে। মেয়েটা আসতে পারে নি জানো? হয়তো বাবা মায়ের অসম্মান করার মতো সাহস ওর ছিল না। বা 'বাবা মরে যাবে' এই একটা কথা ওর রাস্তা আটকে দিয়েছিল। আসলেই ঠিক। আয়ানের উচিত হয়নি মায়রাকে বিয়ে করা। একদম উচিত হয়নি----।

-এভাবে বলিস না আরু-----।

-জানো আন্টি? একটা মেয়ের উপরে যতই অন্যায়, অত্যাচার হোক না কেন সে চাইলেই নিজের সংসার ছেড়ে চলে আসতে পারে না। তাকে সমাজের কথা ভাবতে হয়, পরিবারের কথা ভাবতে হয়। আর এতো কিছুর পরেও একটা মেয়ে যদি সংসার নামের সেই নরক থেকে বেরিয়েও আসে তাকে আমরা সুস্থভাবে বাঁচতে দেই না। সংসার না করতে পারার দোষটা কিন্তু সবটাই গিয়ে পড়ে মেয়েটার ঘাড়ে। আমরা জানতেও চাইনা সেখানে একটা মেয়ের দোষ কতটুকু। সমাজের মানুষগুলো সেই মেয়েটার শরীরের কালশিটে দেখে না, তারা দেখে মেয়েটার যৌবনদীপ্ত শরীর। মেয়েটার চোখের নিচের কালিটুকু চোখে পড়ে না, তাদের চোখে পড়ে মেয়েটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই সহজ দৃষ্টিটাতেও সমাজের লোকগুলো অশ্লীল ইঙ্গিত খোঁজায় ব্যস্ত থাকে। এতো কিছুর পরেও মেয়েটা যদি মাথা উঁচু করে সমাজে চলার চেষ্টা করে তাহলেও দিনশেষে কিন্তু মেয়েটার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তোলা হয়। কি অদ্ভুত না আমাদের এই সমাজ? কি অদ্ভুত তার রীতিনীতি!

-আমাকে ক্ষমা করে দে আরু---।

আরিশার কথাগুলো শুনতে শুনতে আয়ানের মা কেঁদে ফেলেছেন। কোনমতে আরিশার হাত ধরে কথাগুলো বলতেই আরিশাও বিব্রত হয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন।

-আরে? আন্টি কিসব বলছো? এভাবে বলো না প্লিজ? আর এভাবে কেঁদো না প্লিজ? তুমি মায়রাকে মন থেকে মেনে নিয়েই দেখো একবার। দেখবে মেয়েটাকে ততটাও খারাপ মনে হবে না----।

-ওর উপর আমার আর কোনো রাগ নেই রে আরু। আমি ওর কাছেও নাহয় ক্ষমা চেয়ে নিবো----।

-ছি আন্টি! মা কখনো সন্তানের কাছে ক্ষমা চায় বলো? সন্তানদের কখনো মায়ের ভুল ধরতে নেই। তুমি শুধু ভালোবেসে ওকে কাছে টেনে নিও। দেখবে ও তোমাকে মাথায় করে রাখবে। 

এদিকে, মায়রা নিচে এসে দেখলো আয়ান আর তাওহীদ আরশিকে নিয়ে দুষ্টুমি করতে করতে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। মায়রাকে দেখে আরশি হাত পা নাড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে দেখে আয়ান আর তাওহীদ দুজনেই তাকালো। সারা রাত জাগার কারণে বেশ টায়ার্ড লাগছে মেয়েটাকে। মায়রা এগিয়ে এসে আরশিকে কোলে নিতে গিয়েও থেমে গেল। একটু দূর থেকেই আরশির সাথে দুষ্টুমি করতে লাগলো মায়রা।

-আন্টি ফ্রেশ হয়ে আসি। তারপর তোমাকে কোলে নিবো কেমন মামনি? হুম?

-মায়রা? আই থিংক তোমার রেস্ট নেয়া প্রয়োজন। অনেক টায়ার্ড দেখাচ্ছে তোমাকে---।

-তেমন কিছু না ভাইয়া। ফ্রেশ হয়ে নিলেই টায়ার্ডনেসটা কেটে যাবে। আপনারা কি খাবেন বলুন?

-আমরা নাস্তা করেই এসেছি বোন। তুমি আরিশাকে একটু আসতে বলে যেও। আর এখন ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো যাও। কথা শুনছি না কোনো। আয়ান? তুমিও যাও। কিছুক্ষণ রেস্ট করো। 

-আরে? ভাইয়া?

মায়রা আর কিছু বলার আগেই আয়ান মায়রার হাত ধরে টেনে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। 

-আরে? কি করছ?

-তোমাকে কিছু বলাই বেকার। চুপচাপ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আরু কি করছে দেখে আসি। চলো?

আয়ান মায়রাকে রুমের দিকে পাঠিয়ে এসে মায়ের রুমে আসতেই দেখলো আরিশা মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মা ঘুমিয়ে গেছে দেখে আয়ান আরিশার দিকে তাকিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে হাসার চেষ্টা করলো। আরিশা ভ্রু কুঁচকে আয়ানের দিকে তাকালো।

-আন্টি ঘুমাচ্ছে। কিছু বলার থাকলে পরে আসবি----।

-আসলে? আমি সরি আরু।

-ওকে। এবার যা। আমি এখন তোর সাথে চিৎকার চ্যাঁচামেঁচি করে আন্টির ঘুমটা ভাঙাতে চাইছি না।

-শোন না?

-তুই যাবি আয়ান?

-আরে? শোন না? তাওহীদ ভাই তোকে ডাকছে---।

-ওহ আচ্ছা। যাচ্ছি।

-আরু? আমি সত্যি সরি রে। এতো টেনশনের মধ্যে খেয়ালই ছিল না--।

-মায়রাকে বল এখন একটু ঘুমাতে। সারা রাত এভাবে জাগলে শরীরটা খারাপ হবে। আর আমাদের কথা চিন্তা না করতে। এ বাড়ির লোকজন আমাকে কি ভাবে জানি না। তবে নিজেকে আমি এ বাড়ির মেয়েই মনে করি।

-তুই এখনো রেগে আছিস আমার উপরে আরু--। বলছি তো সরি?

-আন্টির ঘুম এখন ভাঙবে না। জ্বরটা ছেড়ে এসেছে। আর ওষুধও খেয়েছে। আপাতত ঘুমাক কিছুক্ষণ। তুইও গিয়ে রেস্ট কর।

-আরু?

আরিশা আয়ানের কথা শোনার অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেল। আর আয়ান আরিশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, এই মেয়েটাকে বোঝা তার পক্ষে অসাধ্য। রাগ করলে ওকে মানানো কার সাধ্য, অথচ সবার কেয়ার কিন্তু ঠিকই করবে। কতোক্ষণ এভাবে রাগ করে থাকবে মেয়েটা কে জানে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন