৪৩!!
সকালবেলা মায়রার ঘুম ভেঙে গেল ঠোঁটের উপরে একটা গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ায়। চোখের ঘুমটা কোনমতে কাটিয়ে চোখ খুলে কি হচ্ছে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মায়রা। আর চোখ খুলে তাকাতেই আয়ানকে মুখের একদম কাছে দেখে বেচারি থতমত খেয়ে গেল। আয়ান মায়রার মুখের দিকে বেশ কিছুটা ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা দেখছিলো। মায়রা চোখ মেলে অবাক হয়ে তাকাতেই আয়ান মায়রার উপরে নিজের সবটা ভর ছেড়ে দিলো। মায়রা এতোটা চমকে উঠলো যে কথা বলার ভাষাই যেন হারিয়ে ফেললো। আয়ানও সুযোগটা কাজে লাগাতে দেরি করলো না। মায়রাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে মায়রার ঠোঁট জোড়াকে নিজের ঠোঁটের উষ্ণ বাঁধনে আটকে নিলো। মায়রা কেঁপে উঠে ঘোরের মাঝেই আয়ানের একটা হাত খামচে ধরে চোখ বুজে নিয়েছে। কতোক্ষণ এভাবে দুজনে নিজেদের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল টেরই পেল না। আয়ান একটু পরে মুখটা তুলে মায়রার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখলো। তারপর আস্তে করে মায়রর বালিশটাতেই মাথা রেখে মায়রার কানের কাছে ঠোঁট নিলো। গভীর আবেশে আরেকটা চুমো খেল মায়রার কানের লতিতে। তারপর খুব নরম করে কয়েকটা লাইন শুনালো মায়রার কানের কাছে।
-"তোমায় নতুন করে পাব বলে
হারাই ক্ষণে ক্ষণ
ও মোর ভালোবাসার ধন ।
দেখা দেবে বলে তুমি
হও যে অদর্শন,
ও মোর ভালোবাসার ধন ॥
ওগো তুমি আমার নও আড়ালের,
তুমি আমার চিরকালের—
ক্ষণকালের লীলার স্রোতে
হও যে নিমগন,
ও মোর ভালোবাসার ধন ॥
আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি
ভয়ে কাঁপে মন—
প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন ।
তোমার শেষ নাহি,
তাই শূন্য সেজে
শেষ করে দাও আপনাকে যে,
ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন,
ও মোর ভালোবাসার ধন।"
আয়ানের প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস মায়রার কানের কাছে এসে পড়ে মায়রার ভিতরটা যেন নাড়িয়ে দিচ্ছে। কোন এক নিদারুণ লজ্জায় বেচারি চোখ মেলে আয়ানের দিকে তাকাতেও পারছে না। আয়ানও হয়তো সেটা বুঝতে পারলো। বুঝতে পেরেই হয়তো মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের বুকের উপরে তুলে নিয়ে মুখটা দু হাতে তুলে ধরলো। তারপর ধীরে ধীরে মায়রার নিচের ঠোঁটটায় ছোট্ট করে কামড় বসাতে শুরু করলো। মায়রার ভারী হয়ে পড়া প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন আয়ানকে আরো বেশি করে পাগল করে তোলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। মায়রা কোনমতে আয়ানের বুকে মুখ ডুবিয়ে নিলো। আয়ানের বুকের ধুকপুক শব্দগুলো ছন্দবদ্ধ হয়ে মায়রার কানে আয়ানের ভিতরের কথাটা জানান দিয়ে যাচ্ছে বারবার। আয়ান নিজের সাথে মায়রাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
-কি গো লাজুক পরী? গানটা কেমন হয়েছে বললে না তো?
-তুমি-তুমি কি করছো?
-এতো লজ্জা পেলে কেন গো লাজুক পরী? তোমায় জোর করবো না সেটা বলেছি বটে। কিন্তু নিজের পাওনাটা আদায় করবো না? তা কি হয় বলো?
-কি সব বলো সারাক্ষণ? ছাড়ো?
-ছেড়ে কি হবে গো বউটা? এখন তো কাগজে কলমে অধিকার আছে তোমাকে সারাদিন আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সাথে বেঁধে রাখার। তাই না বলো?
-তোমার মাথাটা সত্যি গেছে আয়ান। সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে তো। তাই ঘুমের ঘোরে কিসব বাজে বকছো!
-না গো ময়না। ঘুমালে তবে না ঘুমের ঘোরে কথা বলবো। ঘুমালামটা কখন? এই চাঁদপনা মুখটা দেখতে দেখতেই তো রাতটা কখন কেটে গেল টেরই পেলাম না। একবার ইচ্ছে করছিল তোমার ঠোঁটে আদর দিয়ে ঘুমটা ভাঙিয়ে তোমাকেও জাগিয়ে রাখি সারা রাত। কিন্তু এই নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটা দেখে আর জাগানোর সাহসটুকু পর্যন্ত পাইনি বিশ্বাস করো?
-তুমি? তুমি সারারাত জেগে ছিলে?
-জি ম্যাডাম। যার নেশায় আমি মাতাল হয়ে আছি তাকে নিজের এতোটা কাছে পেয়ে কি করে ঘুমিয়ে রাতটা কাটাই? আপনিই বলুন তো শুনি?
-তুমি সত্যি পাগল হয়ে গেছ আয়ান। এভাবে প্রতিদিন রাত জাগলে শরীরের কি হবে সে খেয়াল আছে তোমার? উফফ।
-আমার খেয়াল রাখার জন্য তো এখন তুমি আছো জান। নিজের আর কতো খেয়াল রাখবো বলো?
-একটাও কথা বলবা আর তুমি। এখনই ঘুমাবা।
-তাহলে দাও?
-কি দিবো?
-তোমার ওই মিষ্টি ঠোঁটের ছোঁয়া--।
-আয়ান?
-না দিলে আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি। তোমাকে জোর করবো না মানে কিন্তু এই না যে নিজের পাওনাটা আমি ছেড়ে দিবো। উঁহু। সেটা হবে না।
-তুমি একটা----।
-সেন্টেন্সটা কমপ্লিট করুন ম্যাডাম। তারপর দেখছি আর কি কি উশুল করা যায়।
-চুপচাপ ঘুমাও।
-আমি তো চাইছি ঘুমাতে। তুমিই তো দিচ্ছ না?
-আমি কি ধরে রেখেছি তোমাকে?
-ধরে রাখো নি?
মায়রা আয়ানের বুক থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আয়ান নিজেই পাশ ফিরে মায়রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবার মায়রার মুখের উপরে ঝুঁকে এলো। মায়রার লজ্জায় পিটপিট করে আধবোজা চোখের পাতায় চুমো খেল আয়ান। তারপর ধীর হাতে মায়রার গলায় মুখ ডুবিয়ে কাঁধের তিলটা চুমোয় ভরিয়ে দিলো। কিছু সময় পর আয়ান চুপচাপ মায়রার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজলো।
-যত দূরে থাকতে চাইবে ততই নিজের মধ্যে তোমায় লুকিয়ে নিবো। যদি কাছে আসতে চাও তাহলে শুধু একবার হাতটা বাড়িয়ে দিও। আমি নাহয় তোমার চোখের লাজুক চাহনি দেখেই বাকিটা বুঝে নিবো।
মায়রার বুকে মাথা রেখেই আয়ান একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। মায়রাও আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে আয়ানকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে উঠে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি বের করে সেটা নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে কমলা রঙা শাড়িটা সুন্দর করে গুছিয়ে গায়ে জড়ালো মায়রা। ভিজে চুল ভালো করে মুছে নিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো। তারপর বিছানার কাছে এসে ঘুমন্ত আয়ানের মুখের দিকে তাকালো। পাগলটার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে আছে যেন। আয়ানের মুখের স্নিগ্ধ রূপটা মায়রার মনে একটা সুখের দোলা দিয়ে গেল। মায়রা কিছু না ভেবেই ঝুঁকে আয়ানের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। তারপর গায়ে একটা চাদর টেনে দিয়ে দরজাটা হালকা করে টেনে দিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো।
মায়রা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই সায়নার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মেয়েটা মনে হয় দরজার দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়ে ছিল। মায়রার দিকে চোখ পড়তেই আয়ানের মায়ের দিকে ফিরে গেল সায়না। মায়রাও ধীর পায়ে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে এলো।
-ওই যে খালামনি। তোমাদের নতুন বউয়ের ওঠার সময় হয়েছে এখন। দেখো মহারাণী আসছেন---।
-আরে? মায়রা মা? চলে এসেছ?
-জি মা---।
মায়রা একটু লাজুক হেসে শাশুড়িকে সালাম করলো। শাশুড়ি মায়রাকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে গাল হাত ছুঁইয়ে চুমো খেলেন।
-বেঁচে থাকো মা। তা তুমি এখানে এলে কেন মা? ড্রইংরুমে বসো। নাস্তা দিচ্ছি--। খেয়ে নাও। চা খাবে?
-না আমি। সরি মা। দেরি হয়ে গেছে উঠতে। কি করতে হবে আমাকে দেখিয়ে দিন। আমি----।
-আরে! মেয়ে বলে কি? বিয়ের পরের দিন সকালে এসে দেরি হয়েছে বলে কেউ? আরে মেয়ে। কতো ধকল গেছে কয়টা দিন। এখন আপাতত রেস্ট করো। কাজ করার সময় পরেও পাবা। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তো? আয়ানকেও তো সময় দেয়া দরকার নাকি? এখন রান্নাঘরের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল--।
-মা?
শাশুড়ির কথাগুলো শুনে মায়রার লজ্জায় অবস্থা কাহিল। আর এদিকে সায়না বিরক্ত হয়ে একটা কাপে কফি ঢালতে শুরু করেছে।
-খালামনি? তুমি তো দেখছি একদিনেই আদর্শ শাশুড়ির রোল প্লে শুরু করে দিলে? ছেলের বউয়ের লাগাম না টেনে তাকে নিজের ছেলেকে সময় দিতে পাঠাচ্ছ? বাহ বাহ! পরে যখন বউ ছেলেকে নিয়ে আলাদা বাড়িতে গিয়ে থাকবে বা তোমাদেরকে ওল্ডহোমে রেখে আসবে তখন টের পাবে মজা।
-কি রে মা? সত্যি নাকি? এই বুড়ো মা বাবাকে দুবেলা খেতেও দিবি না?
-মা! এসব কি বলছেন? আমি আপনাদেরকে দেয়ার কে বলুন? আপনারা আমাকে নিজের ঘরের এক কোণে জায়গা দিলে সেখানেই সারাটা জীবন পার করতে পারবো। এর চেয়ে বেশি কিছুই চাওয়ার নেই আমার।
-ওরে বাবা! ঘরের কোণে তো জায়গা হবে না মা। তোকে তো আমাদের চোখের মণি করে রাখবো। আর শোন? এখন নাস্তা করে রুমে যা৷ আয়ান তো ওঠে নি এখনো?
-উহু--। নাহ।
-দুপুরে কিন্তু বৌভাতের অনুষ্ঠান। ওকে বলবি দেরি না করে যেন।
-জি মা---।
-এখন কি খাবি বল? চা নাকি কফি?
সায়না এবারে বিরক্ত হয়ে এক কাপ কফি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
-তোমাদের ঢং দেখে আর বাঁচলাম না বাপু। তোমরা তোমাদের নাটক কন্টিনিউ করো। আমি নিজের কাজে গেলাম। হুহ।
সায়নার কথাটা শুনে মুখ তুলে তাকিয়েই ওর হাতের কফি ভর্তি কাপটা চোখে পড়লো মায়রার।
-দাঁড়াও সায়না। তুমি কফি নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
-সে কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে? এই বাড়িতে এসেছ ১২ ঘন্টাও হয়নি তুমি হুকুম চালানোর চেষ্টা করছ?
-কফিটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
-আমি আয়ানের জন্য কফিটা নিয়ে যাচ্ছি। ওর ঘুম ভাঙলেই কফি খাওয়ার অভ্যেস---।
মায়রা এক পা দু পা করে সায়নার হাত থেকে কাপটা নিয়ে নিজেই চুমুক দিলো। সায়না রেগে মায়রার কাজ দেখছে।
-কি সমস্যা তোমার? তুমি কাপটা নিলে কেন? আর এটা কি তোমার জন্য বানিয়েছি?
-উনি ঘুম ভাঙলে কফি খাবেন, নাকি চা খাবেন, না অন্য কিছু- সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি নিজেরটা নিয়ে ভাবো। উনার ব্যাপারটা মাকে আর আমাকে ভাবতে দাও। কেমন? এন্ড বাই দা ওয়ে। কফিটা দারুণ হয়েছে গো আপু।
সায়না রাগে জুতায় গটগট করে শব্দ তুলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এতোক্ষণ আয়ানের মা অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলেন। এবারে খিলখিল করে বাচ্চাদের মতো হেসে ফেললেন। মায়রার এতোক্ষণে হুঁশ হতেই বেচারি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। রাগের মাথায় শাশুড়িও যে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছেন সেই কথাটা বেমালুম ভুলে গেছিলো বেচারি। এখন তাই শাশুড়ির হাসির শব্দ শুনেও লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতেই পারছে না। এই মূহুর্তে মায়রার মনে হচ্ছে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে ভালো হতে।
৪৪!!
আয়ানের মা মায়রার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে আলতো করে চুলে হাত ছুঁইয়ে দিলেন।
-শোন মায়রা? সবসময় এভাবেই আয়ানকে আগলে রাখবি। আর সায়নার কথায় একদম কিছু মনে করবি না। ও এমনই। বয়সে বড় হয়েছে কিন্তু এখনো ছেলেমানুষি রয়ে গেছে।
-জি মা।
-এখন যা ড্রইংরুমে গিয়ে বস। আর পাগলি মেয়ে। এভাবে খালি পেটে কেউ কফি খায়? পাগলি একটা৷
-মা? আপনার আর বাবার নাস্তা করা হয়েছে?
-হ্যাঁ রে মা। হয়েছে৷ এখন তুইও নাস্তা করে নে। খেয়ে একটু রেস্ট কর। যা।
-আচ্ছা মা।
মায়রা কোনমতে নাস্তা করেই ছুটে রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। এতোটা লজ্জা বেচারি জীবনেও পেয়েছি কিনা সন্দেহ। গলা দিয়ে খাবার পর্যন্ত নামতে চাইছিল না। এতোটা অস্থির লাগছিল যে কোনমতে খাওয়া শেষ করেই নিজেদের রুমে চলে এসেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মায়রার চোখ আটকে গেল আয়ানের ঘুমন্ত মুখটার দিকে চোখ পড়ায়৷ সোনালি হলুদ রঙা পাঞ্জাবিটা পড়েই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। রুমের ভারি পর্দা ঠেলে বাইরের কড়া রোদটা ঘরে ঢুকতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু একটা আবছা আলো এসে পড়ছে আয়ানের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটার উপরে। আর সেই শুভ্র আভাটাই যেন আয়ানকে কোন এক দেবদূত মতো দীপ্তিমান করে তুলেছে।
আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়রার কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গেছে। এক পা দু পা করে এসে আয়ানের মাথা বরাবর ফ্লোরে বসে পড়লো মায়রা৷ তারপর অনেকক্ষণ ধরে অপলকে আয়ানের ঘুমন্ত মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটাকে দু চোখ ভরে দেখার আশ যে ওর এই এক জীবনে মিটবে না। এতো কিসের মায়া এই ঘুমন্ত মুখটায় এসে উপচে পড়ছে? এই মূহুর্তে মায়রার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত শান্তি এই ঘুমন্ত মানুষটার চোখে মুখে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কেন এমনটা হয় কে জানে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মায়রা যেন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো আয়ানের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অবশ্য কাজটা করেই বেচারির হুঁশ হতেই নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ঘোরের মাঝে কি করে ফেলেছে ভাবতেই লজ্জায় আবার লাল হয়ে গেল মেয়েটার মুখ। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই পড়নের শাড়িটার আঁচলে টান খেয়ে হুড়মুড় করে আয়ানের উপরে পড়লো মায়রা৷ আর প্রায় সাথে সাথেই এক জোড়া হাত গভীর মমতায় মায়রাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আগলে নিলো তার বুকের ভিতরে৷ মায়রা শক্ত করে চোখ বুজে মানুষটার এই শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর একটা বিফল চেষ্টা করলো। কিন্তু কানের কাছে একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে পড়ায় মায়রার সব ছটফটানি নিমিষেই থেমে গেল।
-এই যে ম্যাডাম? একটা ঘুমন্ত মানুষের ফায়দা উঠানোর চেষ্টা করছিলেন বুঝি? এসব কিন্তু একদম ঠিক না বুঝলেন?
-কি? কিসব বলছো?
-কি আর বলবো? আরেকটু হলে তো আমি আর কাউকে মুখ দেখানোর মতো অবস্থায় থাকতাম না। আমার এতো বড় সর্বনাশটা কেন করতে যাচ্ছিলে তুমি? বলো? জবাব দাও?
-কি! আমি? আমি কি করেছি?
-তুমি কি করেছ আমি কি জানি! বলো বলো কি কি করেছ এতোক্ষণ আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে? বলো বলো বলো?
-আরে! আমি সত্যি কিছু করি নি।
-আমি তো টের পেলাম। তুমি আমার মুখের উপরে ঝুঁকে কেমন ড্যাবড্যাব করে দেখছিলে। তারপর আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে এসে--। হে খোদা! এসব করার আগে তোমার একটা বারও আমার নিষ্পাপ মুখটা তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠেনি মায়রা? বলো? জবাব দাও? কেন করলে এমন? এখন আমি সবাইকে মুখ দেখাবো কি করে?
-আমি কিচ্ছু করি নি। আমি শুধু--।
-হুম হুম? শুধু?
-শুধু তোমার কপালে একটা চুমু খেয়েছি--। তাও ইচ্ছে করে না। তোমার ঘুমন্ত মুখটা এতো----।
-হুম হুম? এতো?
-কিছু না। যাও তো ছাড়ো? আমি জানতাম না কারো কপালে চুমো খাওয়া আমার বারণ। আর দিবো না কখনো। ছাড়ো?
-একবার যখন দিয়েই ফেলেছ তাহলে আর দিবে না বললে তো মানবো না ম্যাডাম। আমার এখনই চাই আবার সেই স্পর্শটা---।
-ছাড়ো? তুমি না কারো সামনে মুখ দেখাতে পারবা না? দিবো না আমি৷ ছাড়ো বলছি পচা লোক।
-আহা! লাজুক পরী! এসব বললে তো এখন মানবো না। নিজে থেকে যখন দিয়েছ একবার, এখনও দিবা। দাও দাও?
-নাআআআআ। দিবো না। ছাড়ো?
-থাক। কি আর করা? দিওই না।
-জি দিবো না---।
-ওকে---। তবে আমিই দেই।
-এই এই এই? একদম না---।
-তুমি দিবা না বলে আমিও দিবো না সেটা তো হবে না ম্যাডাম। আর আমার জিনিস আমি নিয়েই তবে ছাড়বো। ওয়েট করো।
-ছাড়ো?
আয়ান চিবুক ধরে মুখটা আলতো করে তুলে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে মায়রাকে ছেড়ে দিলো। আয়ানের শক্ত হাতের বাঁধনটা আলগা হতেই মায়রা তড়িঘড়ি করে উঠে গেল। আয়ানও উঠে একবার মায়রার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
-এই? তুমি চা খাবে? নাকি কফি? কোনটা আনবো?
আয়ান মায়রার কথাটার জবাব না দিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আর আয়ানের এমন কাজে মায়রা বেচারি পড়লো দ্বিধায়। এখন আয়ানের জন্য চা বানাতে যাবে নাকি সায়না শাঁকচুন্নির মতো কফি বানিয়ে আনবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না বেচারির। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সায়নার কথা মনে পড়তেই মায়রা রাগে লাল হয়ে গেল একাই। চোখের সামনে সকালের দৃশ্যটা ফুটে উঠেছে এমন সময় ওয়াশরুম থেকে আয়ানের ডাকটা কানে এসে বাজলো মায়রার।
-এই মায়রা? টাওয়ালটা দিবে প্লিজ? আহ! চোখটা জ্বলে গেল আমার!
মায়রা তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে নক করলো মায়রা।
-আয়ান? কি হয়েছে? এই?
-চোখে শ্যাম্পু ঢুকেছে। ওফ! অনেক জ্বালা করছে---।
-চোখ মুছে ফেলো না? আর পানি দাও চোখে---। শুনছ?
-আহ! মায়রা? টাওয়ালটা ভুলে রুমে রেখেই চলে এসেছি তো। একটু দাও না টাওয়ালটা! চোখ মেলতে পারছি না আমি----।
-কোথায় টাওয়াল?
মায়রা ব্যস্ত হয়ে পুরো ঘরটায় খুঁজেও টাওয়ালটা না পেয়ে আবার দরজার সামনে এসে আবার নক করলো।
-আয়ান? টাওয়াল তো পাচ্ছি না। দরজাটা খোলো না প্লিজ? আমি চোখ মুছে দিচ্ছি। খোলো না?
-এজ ইওর উইশ ম্যাডাম----।
মায়রার কথাটা বলতে দেরি, কিন্তু আয়ানের দরজাটা খুলতে মূহুর্ত মাত্রও দেরি হলো না। ওয়াশরুমের দরজাটা খুলেই আয়ান হাত বাড়িয়ে মায়রাকে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো যে মায়রা নড়ার সময়টুকু পর্যন্তও পেল না। আয়ান মায়রাকে ওয়াশরুমের দেয়ালের সাথে চেপে ধরতেই মায়রা আয়ানের দিকে তাকিয়েই লোকটার দুষ্টুমিটা ধরতে পারলো।
-এই এই? মিথ্যে বলা হয়েছে না আমাকে? তোমার নাকি চোখে শ্যাম্পু পড়েছে? আমি এদিকে টাওয়াল খুঁজে মরছি---।
-টাওয়াল তো এখানেই আছে। রুমে খুঁজলে পাবে কি করে?
ওয়াশরুমের র ্যাকে সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা কয়েকটা শুকনো টাওয়াল রাখা দেখে মায়রা কটমট করে তাকালো আয়ানের দিকে।
-অসভ্য ছেলে? ছাড়ো বলছি? আমাকে এভাবে ভয় দেখালে কেন তুমি? তোমার সাহস তো কম না?
-যাব্বাবা! আমি কি করলাম? তুমিই তো ভিতর আসতে চাইলে? এখন যত দোষ নন্দ দোষ? ছি মায়রা? এভাবে নিজের দোষ আমার ঘাড়ে চাপাবে? এই তুমি আমার বউ? ছি ছি ছি!
-একদম ভালো হবে না আয়ান৷ ছাড়ো। আমি বের হবো--। সরো।
-সেটা তো হচ্ছে না ম্যাডাম। একবার যখন এসে পড়েছ তখন একেবারে আমার সাথেই বের হবা।
-সরো?
-উঁহু----। না।
আয়ান আস্তে করে মায়রার নাকে নাক ঘষে দিয়ে হাত বাড়িয়ে শাওয়ারটা চালু করে দিলো। আর সাথে সাথেই মাথার উপর থেকে এক পশলা ঠান্ডা পানির স্রোত এসে ওদের দুজনকেই ভিজিয়ে দিলো।
-আরে? আমি ভিজে যাচ্ছি?
-হুম আমি তো সেটাই চাই। প্রতিদিন একসাথে ভিজবো ভালোবাসার বৃষ্টিতে। আর কি যেন জিজ্ঞেস করছিলে তখন? কি খাবো? প্রতিদিন সকালে তোমার ঠোঁটের মিষ্টি খাবো প্রথমে। তারপর তুমি চা খাওয়াবে নাকি করলার জুস-- সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু এই মিষ্টি ঠোঁটের মিষ্টি ছোঁয়া ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই চাই। ওপস! আজকের মিষ্টি তো নেয়া হলো না? ওয়েট।
মায়রাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আয়ান মায়রার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে কিছুক্ষণ দেখলো। শাওয়ারের বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা এসে পড়ে একদম ভিজিয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে। কপালে, নাকে, ঠোঁটে পানির বিন্দুগুলো মুক্তোর মতো জমে চিকচিক করেছে যেন। আয়ান এক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে সেটা দেখলো। তারপর এগিয়ে এসে মায়রার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে নিজের সাথে বেঁধে নিলো। মায়রাও আয়ানের উষ্ণ ঠোঁটের বাঁধনে নিজেকে সঁপে দিয়ে লজ্জায় আরেকবার নিজেকে রাঙিয়ে নিলো। অনেকটা সময় পর আয়ান আবার মুখ তুলে মায়রাী লাজুক মুখটা দেখলো। মায়রার ঠোঁটের কোণের লাজুক হাসিটা যেন অন্যরকম একটা বিশেষত্ব ফুটিয়ে তুলেছে মেয়েটার মধ্যে। মায়রার ঠোঁটের কোণের এই তৃপ্তির হাসিটা আয়ানের ঠোঁটের কোণেও ফুটে উঠলো সাথেসাথেই। আরেকবার ঝুঁকে মায়রার কপালে একটা ছোট্ট ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো মায়রা৷
-খুব ভালোবাসি তোমায় লাজুক পরীটা। বড্ড বেশি ভালোবাসি।